আশাপূর্ণা দেবী
হল-এর মধ্যে থেকে বোঝা যায়নি ফাংশানের শেষে পথে বেরিয়ে রাস্তাটা এমন সুনসান দেখাবে। বসেছিল তো একটি সুরের মূর্ছনায় ভারাক্রান্ত অনাস্বাদিত স্বাদের মধ্যে! হাত তুলে ঘড়িটা দেখবারও খেয়াল হয়নি।
তাছাড়া দর্শকের আসনে একটি আসনও তো খালি ছিল না, লোকে ঠাসা ছিল। কী করে ভাববে, অনুষ্ঠানান্তে পথে বেরিয়েই রাস্তাটা এমন ঝিমঝিমে দেখবে! অতগুলো লোক হঠাৎ ভোজবাজির মতো উবে গেল না কী?
আসলে মেখলার তেমন জানা ছিল না, যারা কলামন্দিরের টিকিট কেটে এ হেন একটি শৌখিন অনুষ্ঠানে এসে বসে, তাদের প্রায় সকলেরই সঙ্গে গাড়ি থাকে; অর্থাৎ গাড়িবান-গাড়িবতীদের জন্যেই এসব অনুষ্ঠান। কেউ কেউ-বা ওই গাড়িবানেদের কাছে একটা লিফ্ট পাবার আশ্বাস পেয়েই এসে বসেছেন। বাকি যে ক’জন? এই মেখলা আর শিলাদিত্যর মতো? তারাই পথে বেরিয়ে ঝিমঝিমে রাস্তা দেখেই সুরের মায়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে বাস-ট্রামের লক্ষ্যে ছুট মারে।
ওরই মধ্যে যারা একটু ইতস্তত করে, বোদ্ধার মতো ইতি-উতি চেয়ে ভাবতে থাকে কোনটা সুবিধে হবে? বাস? ট্রাম? না কী দুর্গা বলে একটা ট্যাক্সিরই চেষ্টা করবে? তাদের চোখের সামনেই হলভর্তি লোক পথে বেরিয়ে এসেই ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে যায়।
মেখলা বলল, কী ব্যাপার রে ছোড়দা? এই ক’মিনিটেই এতো লোক হাওয়া হয়ে গেল?
শিলাদিত্য এখন ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, সঙ্গে হাওয়া গাড়ি থাকলে, আর ‘হাওয়া’ হতে কতক্ষণ রে বাবা!
তো এখন কী করবি? ট্রামে যাবি? না বাসে? কোনটা সহজ হবে?
কোনোটাই মাখনমার্কা সহজ হবে না হে চাঁদু। দুটোতেই তো বদলের ঝামেলা আছে। যা একখানি জায়গায় বাস আমাদের! আসার সময় তবু একটা সুবিধে পাওয়া গিয়েছিল, তাই—
মেখলা বলল, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে শেষ অবধি বসে তো থাকা হলো, এখন বাড়ি গিয়ে কী হয় দ্যাখ?
হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন বলে উঠল, কেন? বাড়ি ফিরে পিটুনি খাবার ভয় আছে না কী?
কথাটা কৌতুকের, তবে স্বরটা বেশ ভরাট ভারী।
শিলাদিত্য চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে উঠল, আরে যুধাজিৎ। তুই? কী ব্যাপার? এতোক্ষণ হল-এর মধ্যেই ছিলি না কি?
যুধাজিৎ ভান-করা আক্ষেপের গলায় বলে উঠল, কেন বাবা! থাকতে নেই? আমার মতো গোলা লোকের দৈবাৎ একদিন রবিশঙ্করের সেতার শোনার ইচ্ছেটা বেআইনী?
বাজে কথা বলছিস কেন? কে আবার কবে তোকে ‘গোলা’-মার্কা দিয়েছে? বরং—
আগে দিতো না, এখন দিচ্ছে। হরদমই দিচ্ছে রে। যেদিন থেকে মা সরস্বতীর চরণে সেলাম ঠুকে তাঁকে টাটা করে চলে এসে লক্ষ্মীঠাকুরের দরবারে হত্যে দিতে শুরু করেছি, সেদিন থেকেই দিচ্ছে…….এমন কী মা পর্যন্ত খুঁৎ খুঁৎ করেছে, ব্যাবসা করছিস করছিস, পরীক্ষাটা না দিয়েই পড়াটা ছেড়ে দিলি? আর ক’মাস গেলেই তো—
শিলাদিত্য বলল, তা সত্যি। তোর ওই হঠাৎ পড়া ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নেমে পড়া দেখে আমরা সকলেই একটু ইয়ে হয়ে গিয়েছিলাম। পরীক্ষাটা অন্তত দিতে পারতিস। তোর রেজাল্ট নিশ্চিতই ভালো হতো।
যুধাজিৎ অগ্রাহ্যের গলায় বলল, তা হয় তো হতো। না হয় ফার্স্টক্লাসটাই পেতাম, কিন্তু তারপর? রিসার্চ ধরতে হতো। একটা ডক্টরেট না করে নিতে পারলে তো আর মফস্বল শহরের কলেজেও একটা লেকচারারের পোস্ট জুটতো না? বল? জুটতো?
শিলাদিত্য ঈষৎ দ্বিধার গলায় বলল, তা হয়তো জুটতো না। আজকাল তো—
যুধাজিৎ একটু হেসে বলে, হ্যাঁ, আজকাল সর্বত্রই আইনের বড় কড়াকড়ি। তবে চিচিং ফাঁক-এর মন্ত্রটি প্রয়োগ করতে পারলেই ওই কড়াকড়ির দড়াদড়ি আলগা করে ফেলা যায় এই যা। তো—এখন বাড়ি ফিরছিস তো?
তাছাড়া?
তবে চল তোদের সঙ্গে আর খানিকটা সময় কাটাবার সুযোগ করে নিই। অনেক দিন পরে দেখা হলো, তাই না?
মেখলা মনে মনে ভাবল, এই সেরেছে! ও কী ভেবেছে আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে? তাই গায়ে পড়ে আলাপ করতে এসেছে? … ভঙ্গীটা খুব স্মার্ট…চেহারাটাও হ্যান্ডসাম। ছোড়দা তো নেহাৎ বেঁটে নয়, তবু ওর থেকে কতখানিটা লম্বা। কিন্তু
কিন্তু শিলাদিত্য বোনের এই বোকাটে সমস্যার সমাধান করে দিয়ে বলে উঠল, কেন? সঙ্গে গাড়ি আছে না কী?
ওই আছে একখানা যা হোক, তা হোক। দু-চার দিন পরে হয়তো আর থাকবে না। তো আজ তো রয়েছে, চল!
শিলাদিত্য কুণ্ঠিতভাবে বলে, আরে আমরা তো এমনিই চলে যাচ্ছিলাম। তুই আবার কেন? ইয়ে—
যুধাজিৎ চশমার ফাঁকে একটু বিদ্যুতের ঝিলিক হেনে বলল, কেন? পরের গাড়িতে চাপতে তোর বোনের আপত্তি আছে না কি?
ধ্যাৎ! ওর আবার আলাদা কী আপত্তি থাকতে যাবে? আমিই বলছিলাম, আমাদের তো যেতে হবে সেই শ্যামবাজারের মোড়ের কাছে, আর তোর বাড়ি হচ্ছে-
থাক। আমার বাড়ির ঠিকানাটা তোর কাছ থেকে না জানলেও চলবে। আমার প্রশ্নটার উত্তরটাই দরকার। মেয়েদের আবার অনেক রকম সব ফৈজৎ থাকে কিনা!
শিলাদিত্য বলে উঠল, এই টুসকি, আমার বন্ধু কী বলছে শুনলি?
একেই তো ছোড়দার ওই অতিস্মার্ট বন্ধুটির কথার ধরনে গা জ্বলে উঠেছিল, তার ওপর ছোড়দার এই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। বাইরের লোকের সামনে ফস করে ওই নেহাৎ বাড়ির ডাকনামটা ধরে ডাকা! আচ্ছা—বাড়ি ফিরে নিচ্ছি একহাত।…কিন্তু নাঃ, রেগে যাওয়াটা প্রকাশ করা চলবে না। তাতে মান থাকে না। বাবু ভারী স্মার্ট ভাব দেখাচ্ছেন মেখলাও হারবে না। তাই সঙ্গে সঙ্গে চটপট বলে উঠল, শুনলাম। তবে কী দেখে উনি আমায় এতোটা জ্ঞানগম্যিহীন ভেবে নিলেন, সেটাই ভাবছি।
জ্ঞানগম্যিহীন।
নয়? চিরকালের কথা—’ধনবানে কেনে গাড়ি, জ্ঞানবানে চড়ে।’ অথচ উনি ধরে নিচ্ছেন-
যুধাজিৎ শব্দ করে হেসে ওঠে। বলে, নাঃ, দেখছি আমারই জ্ঞানগম্যির অভাব প্রকাশ পেয়ে গেছে।…যাক ধন্যবাদ! তাহলে চলে আসুন এদিকে। শিলাদিত্য আয়! সত্যিই রাত অনেকটা হয়ে গেছে। নটা পঞ্চান্ন।
গাড়ি যেখানে পার্ক করা ছিল সেখানে চলে আসতেই শিলাদিত্য বলে উঠল, এইটা না কী? এই তোর যেমন তেমন একখানা? এতো দারুণ গাড়ি। মারুতি না? কত দিন হলো কিনেছিস?
যুধাজিৎ বলল, এই কিছুদিন। তবে বললাম তো আজ আছে, হয়তো কাল থাকবে না!
তার মানে?
মানে ভালো খদ্দের পেলেই বেচে দেব।
সেকী রে? মানে?
মেখলা বলে ওঠে, তার মানে, অতঃপর বোধহয় একখানা ‘কনটেসা’ কিনে নেবেন।
যুধাজিৎ বলে, তা নাও হতে পারে। অতঃপর হয়তো একখানা রংজুলা, পার্টস খোওয়ানো অ্যামবাসাডারই কিনতে পারি।
শিলাদিত্য একটু চকিত হয়ে বলল, মানে বুঝলাম না।
বোঝাব। গাড়িতে উঠে আয়।
গাড়ির ভিতরটা দেখে মেখলা প্রায় মোহিত। চড়ার মধ্যে তো ‘ট্যাক্সিই চড়া হয়। তাও এমন কিছু হরবখৎ নয়। মাঝে মাঝে ঘরের গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা হয় মার সেই মামাতো দাদার গাড়িতে। কাজেকর্মে গেলে বা দৈবাৎ বেড়াতে গেলে, ফেরার সময় তিনি হয়তো ড্রাইভারকে ডেকে বলেন, গাড়িটা বার করে পিসিমাকে পৌঁছে দিয়ে এসো ননী! মাকে একটু বিশেষ স্নেহের চক্ষে দেখেন বলেই।
তো সেই গাড়ি, আর এই গাড়ি। তুলনা করতেই হাসি পাচ্ছে।
পিছনের বৃহৎ আসনটায় একা মেখলা আরামে যেন ডুবে পড়ে তলিয়ে যাচ্ছে। শিলাদিত্য বসেছে বন্ধুর পাশে সামনে।
একটুক্ষণ চালিয়ে যুধাজিৎ বলে উঠল, তুই এখন কী করছিস?
কী আর করব? ওই যা করছিলাম তাই চালিয়ে যাচ্ছি। আর দু-একটা টিউশনি চালাচ্ছি, এই আর কী। অবশ্য থিসিসটা শেষ হয়ে এসেছে—
অতঃপর?
অতঃপর আর কী? তুই-ই তো বললি তখন, হয়তো কোনোমতে একটা মফস্বল শহরের কোনো কলেজে একখানা লেকচারার পোস্ট পেয়ে বর্তে যাওয়া।
যুধাজিৎ মসৃণভাবে গাড়িটা চালাতে চালাতে বলে, দ্যাখ, আমার বাবা চিরদিন স্কুল মাস্টারি করেছে। কিছু মনে করিস না, ওতে ছেলেবেলায় বড় অছেদ্দা ছিল আমার। মনে হতো কাজটায় যেন তেমন মানসম্মান নেই, অথচ ওই লাইনটা ছাড়া অন্য কিছু ভাবনাতেও আসতো না। তাই ভাবতাম, আমি বড় হয়ে কলেজের প্রফেসর হবো। পড়ছিলামও সেইটা মাথায় রেখেই। হঠাৎ একদিন হেসে উঠে বা মানে লোকে যেমন দৈবাদেশে স্বপ্নাদ্য মাদুলী পায় তেমন হঠাৎ একদিন দিব্যজ্ঞান লাভ হয়ে গেল, দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল। দেখলাম ওতে কোনো প্রসপেক্ট নেই। টাকা চাই। অনেক টাকা। ওইভাবে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে লেকচারার থেকে রীডার, রীডার থেকে হয়তো ভাগ্যে থাকলে প্রফেসর অতঃপর—নাঃ, ওর কোনো মানে হয় না। ঘষটে ঘষটে নয়, টপাটপ সিঁড়ি ভেঙে চুড়োয় উঠে যেতে হবে। টাকা এসে পড়বে ঝপাঝপ, টাকায় বাড়ি ভরে যাবে—
হঠাৎ একটু থামে। তারপর একটু মুচকি হেসে বলে, অবশ্য ‘ডাক্তার’মাস্টার’ এসব প্রফেশনেও আজকাল অনেক রস এসে গেছে। কিন্তু সে ছিঁচকেমি করে উঠতে পারব না জানি, তাই মা সরস্বতীকে টা টা বাই বাই।…‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’—এ তো শাস্ত্রবাক্য— তাই না?
শিলাদিত্য আস্তে বলল, কিসের বিজনেস?
কিসের নয়? যখন যা হাতের কাছে এসে যায়! এই এখন ধর গাড়ি কেনাবেচা চালাচ্ছি। সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি-ফাড়ি কিনে তাকে নবকলেবর করিয়ে ফেলে, মোটা কিছু মুনাফা রেখে বেচে ফেলা। এই যেমন এই গাড়িখানা—এখন একে দেখে ধারণাও করতে পারবি না, পুর্ব অবস্থা কী ছিল! আসলে একটা অ্যাকসিডেন্টে পড়ে যা-তা হয়ে গিয়েছিল। মেখলা পিছন থেকেই এ প্রসঙ্গে যোগ দিয়ে বলে উঠল, ওমা, আমি ভাবছিলাম একদম নতুন।
যুধাজিৎ একটু ঘাড় ফিরিয়ে বলল, পুরোনোকে নতুন চেহারায় দাঁড় করানোয় একটা রোমাঞ্চ আছে। তবে—এতেই তো দাঁড়িয়ে থাকব না, এরপর জমি কেনাবেচায় নামব। তাতে দারুণ লাভ। ছাপ্পর ফুঁড়ে টাকা।
হঠাৎ শিলাদিত্য বলে ওঠে, এতো টাকায় তোর কী দরকার? খুব একখানা মহা বড়লোকের মেয়ের প্রেমে পড়ে বসে আছিস বুঝি? যারা টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। অনেক টাকা না করতে পারলে জামাই করবে না?
মেখলা একটু উৎকর্ণ হয়।
যুধাজিৎ বলে, দূর। ওসব প্রেম-ফ্রেমের মধ্যে যুধাজিৎ সরকার নেই। সে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে চায়, যাতে মেয়েরাই তার প্রেমে পড়বার জন্যে ছুটে আসবে!
মেখলার মুখটা লাল হয়ে ওঠে অকারণই। কারণ এ প্রসঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই। তবু লালাভ মুখে বলে ওঠে, মেয়েদের সম্পর্কে তো দেখছি আপনার বেশ উচ্চ ধারণা! টাকার পাহাড় দেখলেই তারা প্রেমে পড়বার জন্যে ছুটে আসে।
যুধাজিৎ অত্যন্ত অবহেলায় বলে, এখনো পর্যন্ত সেই ধারণাতেই আছি। এ যুগে টাকা দিয়ে সব কিছুই কিনে ফেলা যায়, বুঝলেন? রমণীর মন? সে তো সহজেই!
শিলাদিত্য একটু অস্বস্তির গলায় বলে, তোর মতবাদটা একটু উগ্র
হয়তো।…তবে সত্য। খাঁটি সত্য।
শিলাদিত্য বোধহয় আবহাওয়াটা একটু হালকা করতেই বলে ওঠে, মনে হচ্ছে বোধহয় কোথাও দাগা পেয়েছিস, তাই রাতারাতি দিব্যদৃষ্টি খুলে গেছে। তো এরপর তাহলে প্রোমোটার হচ্ছিস?
যুধাজিৎ বলল, ধরে নে তাই। তবে আমি আমার মতবাদ থেকে সরে আসছি না। দুনিয়াখানা আরো কিছুদিন দ্যাখো মানিক! তারপর দেখো আমার মতবাদে আসো কিনা
…আসলে এখন আর সে যুগ নেই রে যে মানুষ বুনো রামনাথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
….এখন সন্ন্যাসীরও আড়ম্বর দরকার, চাকচিক্য দরকার। এয়ারকনডিশানড্ ঘর, এয়ারকনডিশানড্ গাড়ি এবং ঘরে রঙিন টি. ভি. এসব দরকার। গেরুয়া-পরা সন্ন্যাসীদেরও, বোঝ? তো অন্যদের কথা বাদই দে।…’খালিপদ’ মন্ত্রীদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। ‘আদর্শ’ শব্দটা একটা হাস্যকর বাতিল শব্দ। এ যুগে টাকাই ঈশ্বর। টাকাই পরমেশ্বর!
মেখলা আবার উত্তেজিত হলো। মেখলাকে উদ্দেশ করে অবশ্য বলেনি কথাটা যুধাজিৎ। তবু মেখলা বলে উঠল, সবাই একরকম নয়।
যুধাজিৎ ঘাড়টা আবার একটু ঘোরাল। বলল, হ্যাঁ, এ বিষয়ে অবশ্য আমি আপনার সঙ্গে একমত। সব্বাই একরকম নয়। ব্যতিক্রম তো কিছু থাকবেই সংসারে। তবে অধিকাংশ নিয়েই তো বিচার। তাই না? আচ্ছা—শিলাদিত্য, তোদের বাড়িটা চিনে আসতে বোধহয় খুব ভুল করছি না?…যদিও বহুদিনই আসিনি। আর খুব বেশিবারও আসিনি।
তা ঠিক।
শিলাদিত্য বলল, তোর বাড়িটা কলেজের কাছাকাছি বলে আমারই যাওয়াটা বেশি হয়ে যেতো। আচ্ছা, তোর বাবা তো—
নাঃ, নেই। বছর পাঁচেক হলো মারা গেছেন।
তোর দাদা?
বিয়েটিয়ে করে একটি পুত্রের পিতাও হয়ে গিয়ে এখন সপরিবারে নিজ কর্মভূমি দুর্গাপুরে বাস করছে।
ওঃ। তাহলে বাড়িতে শুধু তুই আর তোর মা
তাছাড়া আর কে? দিদি তো নিজের সংসার নিয়ে এমন ব্যস্ত যে একদিন বেড়াতে আসতেও সময় পায় না। তবে পাবে। আমি একটু বড়লোক হয়ে নিই, তখন পাবে।…
তোর বোধহয় চশমাটা পালটানো দরকার যুধাজিৎ।
বলছিস?…আরে দেখিস! তখন তো পরিস্থিতিও বদলে যাবে হে। মার তোদের জন্যে মন কেমন করছে’ বলে, ঘনঘন জামাইবাবু কোম্পানীকে বাড়িতে ডাকব, ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়ার ঢালাও ব্যবস্থা করব, আসতে গাড়ি পাঠিয়ে দেব, গাড়ি করে ফেরত দেব।… তখন সময় না পেয়ে যাবে কোথায়?
শিলাদিত্য হেসে ফেলে।
বলে, এখন তোকে অনেকটা বুঝতে পারছি।
কচু পারছো? কী পারছো শুনি?
বললে রেগে যাবি। … আর তোর সেই কাকাটির খবর কী? যিনি সবসময় খেলোয়াড়ের সাজ করে ঘুরে বেড়াতেন। কী হাসিই পেতো। বাঘডোরা টাইট গেঞ্জি—আর কিছু মনে করিস না, সেই কাঁধ ঝাঁকানো আর শরীরে মোচড় দেওয়া!
তিনি? তিনি মহাত্মা মানুষ। এদেশে তাঁকে মানায় না বলে, চলে গেছেন ওদেশে। এখন শুনতে পাই ওয়াশিংটনে আছেন।…
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় যুধাজিৎ। বলে, ওর জন্যেই বাবার শেষ জীবনটায়—থাক সে কথা। এই তো এসে পড়েছি মনে হচ্ছে। নলিন সরকার স্ট্রিট, তাই না?…উঃ, চারিদিকে অনেক বাড়ি হয়ে গেছে। তা কোথায় বা না হচ্ছে?
আচ্ছা-
নেমে পড়ে দরজাটা খুলে ধরে, একটু নমস্কারের ভঙ্গী করে মেখলাকে উদ্দেশ করে বলে, কথা হলো, ঝগড়াঝাঁটিও হয়ে গেল একটু, কিন্তু আপনার ডাকনামটা ছাড়া আসল নামটা জানা হলো না। যদিও ডাকনামটি দারুণ!
দারুণ না ছাই। বিচ্ছিরি। আমি তো ঠিক করে বসে আছি—বাইরের লোকের সামনে এভাবে ওই বাজে নাম প্রকাশ করে বসার জন্যে এই ছোড়দাকে একহাত নেব।
আমার কিন্তু সত্যিই দারুণ লেগেছে।
শিলাদিত্য বলে ওঠে, ভালো নাম মেখলা। দাদুর রাখা নাম। বাড়ির দরজা থেকে চলে যাচ্ছিস, আর একদিন আসিস! বিজনেসম্যান! সারা শহর তো চষে বেড়াস। তাই নয়? এদিকে এলে একদিন—
যুধাজিৎ বলল, কেন? শুধু এখানে আসার জন্যেই এদিকে আসা যায় না?
শিলাদিত্য থতমতভাবে বলে, আরে সে হলে তো কথাই নেই।…তো তোকে আর ধন্যবাদ কী দেব? অনেকদিন পরে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল।
সেটা উভয়ত। তবে ধন্যবাদটা তোদেরই প্রাপ্য। গাড়িখানা একটু ধন্য হলো।
মেখলা ফস করে বলে ওঠে, তা একে তো দু-দিন পরে বেচেই দেবেন!
যুধাজিৎ একবার ওর মুখের দিকে তাকাল।
একটু তফাতেই রাস্তার আলোটা আলোক বিকিরণ করছে, সেই আলোর মুখটা বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। একটু গম্ভীর গলায় বলল যুধাজিৎ, দেব কিনা তাই ভাবছি এখন। আচ্ছা….
গাড়িটা চোখছাড়া হয়ে যাবার পর তবে শিলাদিত্য দরজার কড়াটা নাড়ল। …হ্যাঁ, ওদের বাড়িতে—অথবা এ পাড়ায় অনেক বাড়িতেই এখনো দরজায় কড়ানাড়ার ব্যবস্থাটাই রয়ে গেছে।
এটা ইচ্ছে করেই করল শিলাদিত্য। বাবাকে তো জানে, এতো রাতে দরজা খুলে দিতে তিনি নিজেই নেমে আসবেন, এবং দরজা খুলে গাড়ি এবং গাড়ির মালিকটিকে দেখলেই হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে বসবেন।…আর ততটা সুযোগ না পেলেও ছেলেমেয়েকেই প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে বসবেন লোকটা কে, কী বৃত্তান্ত।
কিন্তু ইত্যবসরে মেখলা একনজর ওপর দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়েছে। দোতলা তিনতলা দুই বারান্দাতেই একটি করে নারী-মূর্তি।
গাড়িটা ছেড়ে দিতেই মেখলা বলে উঠল, তোর বৃথাই সাবধানতা ছোড়দা। যথারীতি ‘ওয়াচ’ হয়ে গেছে। আশ্চর্য, বুড়িও এখনো পর্যন্ত জেগে পাহারা দিচ্ছে।
শিলাদিত্য বলল, স্বভাব যায় না মলে।
তারপর বলে উঠল, যাক। কীরকম দেখলি আমার বন্ধুকে?
দেখলাম মানে? ‘কনে দেখা’র মতো বলছিস যে?
তারপরই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে উঠল, একটা ছোটলোক। ছোটলোক।
না তো কী। টাকা দিয়ে সংসারের সব কেনা যায়।’…অসভ্য।
শিলাদিত্য বলে, খুব একটা ভুলও বলেনি। যা অবস্থা চারদিকে। সবকিছুই তো—
খুব একটা ভুল যে বলেনি, সে কথা মেখলাও হয়তো মানতো, যদি না লোকটা ‘রমণীর মন’ শব্দটি ওই সবকিছুর সঙ্গে যোগ করে বসতো।
কথাটা তো সমগ্র নারীসমাজের পক্ষে রীতিমত অবমাননাকর।…তবে—
ভাবাটা শেষ হলো না।
ভিতরে প্রথমে ছিটকিনি নামানোর ‘খটাস্’ শব্দটা শোনা গেল, তৎপরে দরজার বুকের ওপর চাপানো লোহার খিলটা নামানোর ঘড়াং
সাবেকি বাড়ি। সদর দরজা ‘লোহা কাঠের’। …তার বুকে লোহার খিলই মানানসই। খিল নামানোর পরও দরজার নীচের দিকের ছিটকিনি ওঠানোর খটাস্ শব্দটা শোনা গেল। অতঃপর দরজা খুলে গেল। …দরজায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আদিত্য গাঙ্গুলী।
দু’জনেই ভেবেছিল, দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ঙ্কর একটা ঝড়ের দাপট তাদের ওপর আছড়ে পড়বে। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কড়া গলায় কাটা কাটা প্রশ্ন করবেন, স্বেচ্ছাচারিতার একটা সীমা থাকা উচিত কিনা? ছেলেরা জবরদস্ত যা করে চলেছে তা মেয়ের পক্ষেও সঙ্গত কিনা? এবং এই খারাপ দিনকালে দুটো ছেলেমেয়ে এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবেই বা কেন?
কিন্তু আদিত্য গাঙ্গুলী নীরব নির্বাক। একবার শুধু জরিপ করার ভঙ্গীতে দু’জনের আপাদমস্তক অবলোকন করে নিয়ে নিঃশব্দে পিছন ফিরে ভিতরে ঢুকে গেলেন।
শিলাদিত্য বলতে যাচ্ছিল, কী ব্যাপার! আমরা কী ফিরব না ভেবেছিলেন না কী? তাই দরজার সমস্ত সাজসজ্জা সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল? কিন্তু বলবে কাকে?
.
বাড়িটা তিনতলা। তবে তিনতলাটা একতলা দোতলার মতো পূর্ণাবয়ব নয়। অর্থাৎ একতলা দোতলায় যেমন চারখানি করে ঘর তিনতলায় তেমন নয়, মাত্র দুখানি ঘর। বাকিটা খোলা ছাত। তবে ছাতের পাঁচিলে ইট সিমেন্টের গাঁথুনি নেই, দোতলার বারান্দার মতো রেলিং বসানো। রাস্তা থেকে তাই বারান্দা বলেই মনে হয়। শুধু মনে হওয়াই নয়, মেখলা বলেও। ‘ওই যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন!’ ও পাহারাই বলে।
নয়নতারা সেই রেলিঙের ধার ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নির্নিমেষ নেত্রে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কতক্ষণে মেয়েটা বাড়ি ফেরে। দিনকাল যে কত খারাপ তা তো ক্রমশই মালুম হচ্ছে। পরাধীন দেশে যা নিরাপত্তা ছিল, আজ স্বাধীন দেশে তা নেই।
ভাবলেন নয়নতারা, তখন যারা স্বাধীনতার সংগ্রামে নেমেছিল তাদের কথা অবশ্য বাদ দিতে হয়, তারা তো রণক্ষেত্রে। শত্রুপক্ষ’। তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হবে, সেটা অভাবিত নয়। ‘বন্দে মাতরম’ বললেই পিটুনি। কিন্তু সাধারণ গেরস্থ মানুষ, যাদের মধ্যে শুধু জীবনযাত্রা নির্বাহ করে চলা ছাড়া আর কোনো উচ্চচিন্তার বালাই ছিল না, তাদের কোনোদিন এমন সদাশঙ্কিত হয়ে থাকতে হতো না। …এখন এ কী হয়েছে? ঘরের ছেলেমেয়েরা যতক্ষণ না বাড়ি ফেরে, ততক্ষণ বসে বসে দুর্গানাম জপ করতে হয়।
অবশ্য মেখলার মা-বাপ, বিশেষ করে মা ভাবতে রাজি নন যে তাঁদের মেয়ের জন্যে চিত্তাকাতর হয়ে বসবেন ‘নয়নতারা’ নামের এই হাড়জিরজিরে বৃদ্ধাটি। যেন সেটা তাঁর পক্ষে একরকম অনধিকার চর্চা। আমাদের মেয়ের ব্যাপার আমরা ভাবছি না? তোমার আবার ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে আসবার দরকারটা কী?…আর কিছুই নয়, মেখলার মা-বাপ যে ছেলেমেয়েকে যথেষ্ট পরিমাণে শাসনের মুঠোর মধ্যে রাখতে পারছেন না, সেটা প্রমাণিত করার জন্যেই ছেলেমেয়ের কোনোখান থেকে ফিরতে দেরি হলেই বারবার গলা তুলে প্রশ্ন করা, হ্যাঁরে। অমুক একনো ফেরে নাই?
ছেলেমেয়ের কাছে এ সন্দেহ প্রকাশ করে নীহারিকা, আমরা রয়েছি, তবু উনি একেবারে ভাবনায় মরে যাচ্ছেন। আর কিছুই নয়, এটি হচ্ছে পাহারা দেওয়া। পাছে বলি, হ্যাঁ অনেকক্ষণ এসেছে তো!
ছোট থেকে সদাসর্বদা এ ধরনের কথা শুনতে শুনতে ছেলেমেয়েদের মনের মধ্যেও যেন ‘দাদু’ ‘ঠাকুমার’ প্রতি একটা বিরুদ্ধ ভাব গড়ে উঠেছে। মনে করতে অভ্যস্ত হয়েছে, ওঁরা যেন তাদের মা-বাবার ‘প্রতিপক্ষ’। এবং নাতি-নাতনীর ব্যাপারে কোনো মন্তব্য বা অভিমত প্রকাশ করে বসলে, সেটা হবে ওঁদের বিরোধী পক্ষের ভূমিকা এবং অনধিকার চৰ্চাও।
না, স্নেহের ব্যাকুলতার কোনো প্রশ্ন নেই। নয়নতারা অথবা সত্যব্রত নাতি-নাতনীর অসুখ করলেও যদি একটু ব্যস্ততা প্রকাশ করেন, তাঁর পুত্র ও পুত্রবধূ সেটাকে অহেতুক বাড়াবাড়ি বলে মনে করে। …যেন অনেকটা লোক দেখানোও।
আর ওষুধ পথ্য বা ডাক্তার সম্পর্কে কোনো পরামর্শ দিতে এলে? নিতান্তই বিরক্তি বোধ করে।
কেন? আমরা কী এতই অজ্ঞ? নিজের ছেলেমেয়ের অসুখে যথার্থ ব্যবস্থা নিতে পারি না? তোমাদের সেই আদ্যিকালের অভিজ্ঞতার অহঙ্কার নিয়ে কী একখানা আহামরি পরামর্শ দিতে আসছো? ওসব এখন বাতিল হয়ে গেছে।
অবশ্য ওরা যখন বাচ্চা ছিল, তখনই শুধু নয়নতারা বা সত্যব্রত নিজেদের ‘অভিজ্ঞতা’র ফসল ওঁদের কাছে এনে ধরে দিতে চেষ্টা করতেন। অবোধের নিঃশঙ্কতা আর কী!
অ বৌমা। জ্বর হয়েছে বলে ছেলেটাকে এই দুপুর রোদেও মোজা-টুপি পরিয়ে রাখছো? শীতকাল? তা কী হলো। অত আটেকাটে বন্দী করে রাখলে জ্বর কমে না। …অ আদিত্য! বাবা তোর ওই চড়া চড়া ওষুধ দেওয়া ডাক্তারকে এবার ছাড়ান দে। একজন হোমিওপ্যাথ দেখা! বাচ্চাকাচ্চার অসুখে হোমিওপ্যাথি ভালো।
বলতেন এসব কথা আগে আগে। পরে আর বলতে আসতেন না। দেখতেন পরামর্শ তো গ্রাহ্য করবেই না, উল্টে বিরক্ত হবে বেজার হবে।
জ্বর কত উঠেছে? অ বৌমা? অ আদিত্য, কথা কস না ক্যান? বলে উদ্বেগ প্রকাশ করলে, বৌ এতো চটে যাবে, ছেলে বৌয়ের সেই রাগী মুখ দেখে ভয় পেয়ে মিথ্যে করে জ্বরের মাপ কমিয়ে বলবে।
প্রতিনিয়ত এই সব ছোটখাট অভিজ্ঞতার কাঁটাবন পার হয়ে এসে প্রায় নির্লিপ্তই হয়ে গেছেন এখন সত্যব্রত আর নয়নতারা। তবু উদ্বেগ উৎকণ্ঠা এগুলোর হাত এড়াতে পারেন কই?
তা তার কণামাত্র প্রকাশ করে ফেললেই তো পরিস্থিতি বিগড়ে যায়।
ক্রমশই তাই নয়নতারা তাঁর এই তিনতলার নির্বাসন কক্ষে নিজেকে আটকে রাখতে চেষ্টা করেন।
হ্যাঁ, তিনতলার এই ঘর দুখানাতেই এখন গৃহের প্রাক্তন গৃহিণী ও গৃহকর্তার বসবাস। …অবশ্যই ওঁদের প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট।…বাড়িটার গড়নপেটন আর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, পুরোনো কালের। এ যুগে কেউ সাধারণ একখানা বসতবাড়িতে এমন বৃহৎ বৃহৎ ঘরের কথা চিন্তাই করতে পারে না। তাছাড়া রান্নার ভাঁড়ারঘর বাদ দিয়েও তিনটে তলা মিলিয়ে দশ দশখানা ঘর। জমির অপচয়ের নমুনা একখানা।…তবু এইভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অভ্যাস হয়ে গেছে। কারণ প্রাক্তন হলেও, সেই একদার গৃহকর্তার একান্ত অমত নীচের তলায় ভাড়াটে বসানোয়।
না বাবা। আমি যতকাল আছি, বসতবাড়িতে ভাড়াটে বসাস না। তাতে বাড়ির কোনো আব্রু থাকে না। তাছাড়া এখন তো আবার দেখছিস, ভাড়াটে একবার ঢুকলে আর জীবনে বেরোয় না। তার মানে চিরকালের মতো ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’ হয়ে থাকা
তা প্রাক্তন গৃহকর্তার অন্য কোনো বাক্য গ্রাহ্য হোক না হোক, এটি গ্রাহ্য করতেই হয়েছে। কারণ—বাড়িখানা ওই লোকটারই স্বোপার্জিত অর্থে কেনা। দেশঘর ছিল পাবনায় সেখানেই দাপটের সঙ্গে ওকালতি করতেন, কিন্তু—আরো হাজার হাজার জনের মতো তাঁর ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে গেল দেশভাগের সময়।
কিছুদিন চেষ্টা করেছিলেন সত্যব্রত টিকে থাকবার, অতঃপর অনেকের যা হয়েছে শেষ অবধি তাঁরও তাই। আর টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। পৈত্রিক বাড়ি, বাড়িভর্তি জিনিসপত্র, সাজানো সংসার সবকিছু ফেলে চলে আসতে হয়েছে উদ্বাস্তুর ভূমিকায়।…তবে নেহাৎ কিছু নির্যাতিত হননি, এবং নগদ টাকা মোটামুটি যথেষ্ট পরিমাণেই নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। টাকাকড়ি, কিছু জামাকাপড়, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং চলে আসার বিরুদ্ধে অত্যন্ত উত্তেজিত সদ্যবিধবা মা, এই সম্বল করে এক রাষ্ট্র থেকে আর এক রাষ্ট্রে। পুত্র আদিত্যর বয়েস তখন বছর দশ।….. কন্যা সন্ধাতারা আট।
চলে এসে কলকাতার এক বন্ধুর সঙ্গে চিঠি লেখালিখি করে নলিন সরকার স্ট্রিটের এই বাড়িখানা ভাড়া করে বাস করতে শুরু করেন। নগদ টাকা জলের মতো ফুরোচ্ছে দেখে, সেই বাড়িটাই বাড়িওলার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে কিনে ফেলেন। …বাড়িখানা তাঁদের পাবনার তুলনায় ‘কিছুই না’ হলেও, মোটামুটি সঙ্কুলানের পক্ষে যথেষ্ট এবং রাস্তার ওপর বলে আলাদা সুখ।
কলকাতায় এসে বহু চেষ্টায় আবার ওকালতিই ধরেছিলেন সত্যব্রত।
পুরোনো বাড়ি মেরামত করিয়ে নিয়ে নতুনতুল্য করে ফেলেছিলেন, এবং সর্বদা বিরক্ত খুঁতখুঁতে শুচিবাইগ্রস্ত মাকে বিশুদ্ধভাবে রাখবার জন্যে তিনতলাতেই ছাতের এক কোণে বানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর জন্যে নিজস্ব স্নানের ঘর ইত্যাদি। …দুখানা ঘরের মধ্যে একখানা ছিল বিন্দুবাসিনীর শোবার ঘর এবং অপরখানা ঠাকুরঘর, প্লাস রান্না-ভাঁড়ার ঘর।
বেশ কয়েকটা বছর পুত্র-পুত্রবধূর হাড় ভাজাভাজা করে তবে ক্ষুব্ধ বেদনার্ত বাতিকগ্রস্ত বিন্দুবাসিনী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তদবধি ঘর দুটো এলোমেলোভাবেই পড়েছিল সংসারের বাতিল বাড়তি জিনিসপত্র বুকে করে।…দোতলাটায় সত্যব্রত সপরিবারে এবং একতলাটায় বৈঠকখানা ঘর, মক্কেলের ঘর, আর খাবার ঘর ইত্যাদিতে ব্যবহার হতো।… কে জানতো —সংসারচক্রের পাকচক্রে একদিন সতব্রতকেই তাঁর মায়ের অধ্যুষিত এলাকাটিতেই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তবে আপাতত তাই আছেন। কারণ মানুষও কোনো একসময় জিনিসেরই মতো বাতিল বাড়তি হয়ে যায়।
এখন আর মক্কেলের রমরমা নেই। কারণ কিছুদিন যাবৎ কানে কিছু কম শুনছেন সত্যব্রত, এবং চোখেও কম দেখছেন।
তাছাড়া পাবনার সেই পসার তো আর এখানে হওয়া সম্ভব নয়। এখানে তাঁকে লোকে বহিরাগতই ভেবে আসছে। সেখানে ছিলেন গাঙ্গুলীবাড়ির গাঙ্গুলী।
তবে ইতিমধ্যে সংসারজীবনটি প্রায় দাঁড়ি টানবার পথে নিয়ে এসেছিলেন। কন্যা একটি বৃহৎ সংসারের ব্যস্ত গৃহিণী, পুত্র-পুত্রবধূ কে জানে কখন কোন ফাঁকে সত্যব্রত দম্পতীকে রিটায়ারের দলে ফেলে দিয়ে নিজেরা কর্তা-গিন্নীর পোস্টে উঠে বসেছে।…
তা সেও তো নেহাৎ বালক নয় যে বরাবর নাবালকের ভূমিকায় থাকবে? তা থাকতেই বা দেবে কেন তার গৃহিণী সচিব? তারই তো এখন বড় ছেলে পলিটিকস্ করছে, ছোট ছেলে এম এ পাশ করে গবেষণাপত্র তৈরী করছে এবং মেয়ে একই সঙ্গে কলেজের পড়া ও গান শেখা চালিয়ে যাচ্ছে।
নীহারিকার নির্দেশেই এখন সংসারের কুটোটিও নড়ে এবং নড়তে পায় না।
তবে ভগবান জানেন তাঁরই নির্দেশে কি, কারো বিনা নির্দেশেই একদিন আদিত্য বলে বসল দেখো মা, আমার মনে হয়, তোমরা যদি এখন ঠাকুমার অ্যাপার্টমেন্টটায় থাকো, অনেক আরাম পাবে। সংসারের গোলমাল থেকে একটু দূরে থেকে শান্তি হবে।
নয়নতারা চমকে উঠেছিলেন। এ আবার কী প্রস্তাব!
প্রথমটা বলেও ফেলেছিলেন। ক্যান? সংসারে আবার গোলমালটা কিসের?
কিন্তু পরক্ষণেই ভুল ভাঙল ছেলের দ্বিতীয় কথায়। ছেলে দেয়ালমুখো হয়ে দেয়ালের একটা টিকটিকির দিকে তাকিয়ে থেকেই গম্ভীরভাবে বলল, গোলমালের সৃষ্টি করলে, সেটা হবেই!
নয়নতারা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। সেখানে যেন একটি স্থির সংকল্পের ভাব। …আস্তে বললেন, তার যদি মনে লাগে, সেটা আমিই সৃষ্টি করছি, তো—যা ভাল বুঝছিস কর।
তখন আদিত্য একটু থতমত খেয়ে বলেছিল, আসল কথা সবাই তো সমান বুঝমান নয়। …তা তুমি তো সারাজীবন ঢের খাটলে, সেই পাবনার বাড়ি থেকেই তো দেখে আসছি। চিরদিন প্রাণপাত। নিঃশ্বাস নেবার অবকাশ নেই। এবার নয় একটু বিশ্রাম করো না।
নয়নতারা বলে উঠতে পারতেন, কে তোকে বলতে গেছল, আমি বিশ্রাম চাই? হ্যাঁ, যতদিন তোর ঠাকুমা ছিল, এক-এক সময় প্রাণ হাঁপিয়ে উঠতো বটে, এখন তো আমি দিব্যিই আছি।
কিন্তু তা বললেন না। শুধু বললেন, তোর বাবার কী এই উঁচুতলায় উঠে সুবিধে হবে? হাঁটুতে ব্যথা। বারবার সিঁড়ি ভাঙাভাঙি।
আদিত্য বলে উঠল, বারবার এতো—দরকারটা কী বাবার? …এখানে তো কল-পায়খানা সবই রয়েছে। পাম্পটা বসানো পর্যন্ত জলেরও অসুবিধে নেই। বরং এখানটা খোলামেলা। সকালে একবার মর্নিং ওয়াক-এর জন্যে নেমে, নীচে থেকেই চা খেয়ে কিছুক্ষণ না হয় বৈঠকখানায় বসে তারপর উঠে আসবেন।…তেমন দরকারি মক্কেল হলে, তাকে ওপরেও পাঠিয়ে দেওয়া যায়। অবশ্য আজকাল আর কই তেমন? …আর বাবাকে খাবার— টাবারও তো অনায়াসেই এনে দিতে পারবে।
নয়নতারা বুঝলেন দাবার ছক সাজানো হয়ে গেছে। এখন প্রথমটা শুধু একটা বোড়ের চাল ঠোকা হলো। আস্তে বললেন, তো তোর বাবাকে বল? দ্যাখ রাজি হয় কিনা!
বাবাকে? ও বাবা। সে আমার কর্ম নয়! বাবাকে একটা কথা বোঝাতে আকাশ ফাটাতে হয়। তুমিই বলে দিও। তোমার ফিসফিস কথাটিও তো বেশ শুনতে পান দেখি। আমাদেরই গলা চেরে।
অপমানে কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। তবু নয়নতারা কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন। বলে উঠতে পারলেন না, তোমাদের মধ্যে যদি তেমন ছেদ্দাভক্তি থাকতো তাহলে গলা চিরতে হতো না। …তোমরা কিছুতেই মানবে না, কাছে বসে ধীরে ধীরে বললে ঠিকই মানুষটার মাথায় ঢোকে। আসলে মাথাটাই একটু কম চটপটে হয়ে গেছে। কান থেকে কথাটা পৌঁছে যেতে সময় নেয়। তোমরা দূর থেকে পরিত্রাহি চেঁচাবে।…
কিন্তু নতুন করে আর বলে লাভ কী? বহুবার বলেছেন, জনে জনে সবাইকে। সকলেই একই ভুল করে। দূরে থেকে চেঁচায়। কাছে এসে বসবার সৌজন্যটুকু স্বীকার করে না। যাক। উপায় কী? ভগবানই যখন অমন চৌকস মানুষটাকে এমন বেচারীর ভূমিকায় ফেলে দিয়ে বসেছেন!
বললেন, আচ্ছা বলব। তবে বোঝাতে দেরি হবে, হঠাৎ আমাদের বিশ্রাম আর শান্তির দরকারটা তদের মাথায় এলো ক্যান?
মুখটা কালো হয়ে গেল ছেলের। একটু চমকে গেল।
তারপর বলে উঠল, আমাদেরও তো বয়েস হয়েছে মা? আমাদেরও তো সংসার চালাবার মতন বোধবুদ্ধি হয়েছে একটু-আধটু। ছেড়ে দিয়ে দ্যাখোই না একটু পারি কিনা ফেলিওর হই কিনা! সংসারখানা চিরকাল একই ছাঁচে চলবে, তার কী মানে আছে? তোমাদের এলাহি মেজাজ। চারদিকে রাতদিন অপচয়, বুঝে চলতে পারলে—
নয়নতারা কথার মাঝখানেই বলেছিলেন, আমাদের জিনিসপত্তরগুলা উঠিয়ে দেবার ব্যাবোস্তা করে দে তবে। আমি আমার ঠাকুরঠুকুরদের নিয়ে যাচ্ছি।…
আহা এক্ষুণিই কী একেবারে—
চলে গেছল তাড়াতাড়ি। যেন পালিয়ে গেল। তবে দেখে মনে হলো যেন, তেমন কিছু প্রতিরোধ এল না দেখে বেঁচে গেল।
নয়নতারা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন।
ধাত্রীর হাতটা কী নিপুণ। তার হাতের অস্ত্রটা কী সূক্ষ্ম! …কখন কোন সময় নিঃশব্দে নাড়িচ্ছেদ হয়ে গেছে টেরও পাওয়া যায়নি।
পাবনার বাড়ি থেকে চলে আসার সময় যে ছেলেটা তার উঠোনের সেই জামরুল গাছটায় টাঙানো দড়ির দোলনাটা ধরে হাপুস নয়নে কেঁদেছিল, কিছুতেই সেটা খুলে দিয়ে আসতে দেয়নি। বলেছিল, থাক, থাক বলছি। কখনো খুলবে না। এ কী সেই ছেলেটাই?
বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামল। বুকটা হিম হয়ে গেল। নয়নতারা একটু গলা ঝুলিয়ে ঝুঁকে না দেখে পারলেন না। আহত কাউকে ধরাধরি করে নামাচ্ছে না তো? কারুরই বাড়ি ফেরার সময় পার হয়ে গেলেই যে কেবল বিপদের চিন্তাগুলোই মাথায় আসে! … রাস্তাঘাটে কোনো অ্যাকসিডেন্ট হলো না তো? …অহরহই যে পথ-দুর্ঘটনা।
না, হাসতে হাসতেই দুই ভাইবোন গাড়ি থেকে নামল। …ওই লম্বা ছেলেটি কে? বোধহয় কোনো বন্ধু-টন্ধু? গাড়িটা তাহলে ওরই। …পৌঁছে দিয়ে গেল। ভালো তো। ছাতটুকু পার হয়ে ঘরে চলে এলেন।
সত্যব্রত একটা ইজিচেয়ারে বসে একখানা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। মাথার কাছে একটা উঁচু টুলের উপর একটা টেবল ল্যাম্প জ্বলছে। …তবে দেখে মনে হচ্ছে না বইয়ের মধ্যে ডুবে বসেছিলেন।
নয়নতারা পাশেই বিছানার ধারে বসে গলার স্বর নামিয়ে বললেন, অরা এলো।
সত্যব্রত তাকালেন। চশমাটা চোখ থেকে খুলে একবার মুছে নিয়ে আবার পরলেন। নয়নতারা বললেন, একটা ঢ্যাঙাপানা ছেলে গাড়ি চাপিয়ে পৌঁছা করে দিয়ে গেল।
সত্যব্রত বললেন, কাদের ছেলে?
নয়নতারা তাড়াতাড়ি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আস্তে কথা বলার ভঙ্গী করলেন। ….নিজে ভালো শুনতে পান না বলেই আজকাল সত্যব্রতর গলাটা জোরালো হয়ে গেছে। বোধহয় মনে করেন, অন্যেও সহজে শুনতে পাচ্ছে না।
নয়নতারা গলা আরো নামিয়ে এবং মুখকে স্বামীর কানের আরো কাছে সরিয়ে এনে বললেন, জানি না। অদের কোনো বন্ধু হবে। …তো অখন শান্ত হয়ে শুয়ে পড়ো সত্যব্রত বললেন, হুঁঃ। তারপর বললেন, তোমার তো খাওয়া হয় নাই?
এইবার যাব।
অরা এটা পছন্দ করে না। তুমিও এইখানে আমার সঙ্গে খেয়ে নিলেই ভালো হয়। নয়নতারা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, মন লাগে না। অরা কেউ বাড়ির বাইরে থাকলেই মন উচাটন লাগে। খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়া যায়?
ওরা তো তাই চায়।
বলে বইটা বন্ধ করে উঠে এসে বিছানায় বসলেন সত্যব্রত। সাবধানে আস্তে বললেন, ওরা যা চায় তাই করাই ভালো।
নয়নতারা ক্লান্তভাবে বললেন, আর কত ‘ভালো’ করব? …মানুষের প্রাণ তো? ভয় লাগে যদি পথে কোনো—
সবসময় অত বিপদের কথা ভাব কেন?
ইচ্ছে করে কী আর ভাবি? ভাবনা এসে যায়। আচ্ছা তুমি—
এই সময় দরজার পর্দাটা নড়ে ওঠে। কাজের মেয়ে কাজলের মুখটা উঁকি মারে, কী গো ঠাকুমা, এখনো খিদা হয় নাই?
নয়নতারা বলেন, তেমন হয়নি। চল—যা হোক দুটি খেয়ে আসি।
হ্যাঁ, ইতিপূর্বে সত্যব্রতর খাবারটা দিতে আসার সময় কাজল বলেছিল, মাসিমা বলল, আপনিও এই সঙ্গে খেয়ে ন্যান না। একসঙ্গে দু’জনার ভাতটাই এনে দিই। আপনিও তো বুড়ো মানুষ!
নয়নতারা বলেছিলেন, মোটে খিদে হয়নি রে এখন। সন্ধেবেলা চায়ের সঙ্গে কী যেন খাওয়া হলো?
কী আবার? শুধু তো একগাল মুড়ি। …আপনি খেয়ে নিলে আমার একটু সুবিধা হয়।
নয়নতারা রেগে উঠে বলেন, ক্যান? তর আবার এতে কিসের সুবিধা?
না, ইয়ে, আর কিছু না। তুমি তো কেবল টিকটিক করবে, সকড়ি হাত ধুলি না? ভাতের ডেচকিতে মানসো মুরগীর হাত দিচ্ছিস না তো?
ওঃ। সেটুকুও করতে পারবি না? রাজার দুলালি।
হ্যাঁ, বড়জোর এই কাজলের ওপর রাগ ফলানো যায়। কিন্তু আশ্চর্য! নিজেদের মানসম্মান সম্পর্কে জ্ঞান টনকে হলেও তেমন ক্ষত্রে নীহারিকা অনায়াসে নিতান্ত অমায়িক গলায় বলে, তা সত্যি মা! আপনার ওই এঁটো সকড়ি বাতিকে ছেলেমানুষ বেচারার মাথা গুলিয়ে যায়।
নয়নতারা হয়তো একটু হেসে বলেন, এইতেই মাথা গুলিয়ে যায়? তোমার দিদিশাশুড়িটিকে তো দেখেছ কিছুদিন? যদি তার হাতে পড়তে হতো কাজললতার?
এ কথা বলতে পারেন না, অথচ ওই কাজলকে নিজেদের অবস্থা মতো, বেলা দুটো তিনটে পর্যন্ত না খেয়ে বসিয়ে রাখো, ‘ছেলেমানুষ’ বলে মনে পড়ে না।
একদিন নয়নতারা বলে ফেলেছিলেন, আহা, ছেলেমানুষ। এতোটা বেলা, এতোক্ষণ দুটো মুড়িটুড়ি খেলে পারতো।
সেই স্নেহ প্রকাশে রসাতল হয়ে গিয়েছিল। এই উক্তি না কী নীহারিকার পক্ষে রীতিমত অপমানজনক হয়েছিল।
কাজল বলল, আচ্ছা, খিদা হলে নেবে যেও
আর সবাই খেয়ে নিচ্ছে না কী?
শোনো কতা! দিদি-দাদারা তিনজনাই তো এখনো বায়রে, খেয়েটা নেবে কে? মাসিমা, মেসোমশাই?
তরতরিয়ে নেমে যায়।
নয়নতারা সেই নামাটা তাকিয়ে দেখেন।
খিদা না হলেও এখন নেমে যান নয়নতারা।…দেখেন টেবিলে মেয়ে, ছোট ছেলে, আর তাদের মা।
একধারে নয়নতারার নির্দিষ্ট কোণটায় স্পর্শদোষ বাঁচিয়ে তাঁর থালা। ভারী তো খাওয়া। একমুঠো ভাত আর একটু মাছের ঝোল। ক্রমশই আর ‘মুরগী মাংস ঠেকানো’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করতে সাহস করেন না। …কাজ হয় না, শুধু সংঘর্ষ হয়।
নয়নতারাকে দেখেই মেখলা বলে ওঠে, আচ্ছা ঠাকুমা। আমাদের কত কারণে দেরি হতে পারে! তোমার বসে থাকবার কোনো মানে হয়?
নয়নতারা জোর করে মুখে হাসি এনে বলেন, তদের জন্যি বসি থাকতি আমার দায় লেগেছে। …খিদে হয় নাই, তাই খাই নাই। তো বাপ্পা ফেরে না?
নীহারিকা সংক্ষেপে বলে, সে আজ ফিরবে না বলে গেছে।
কোথায় গেছে? ফিরবে না কী গো?
এমন প্রশ্নের সাহস নেই। টেবিলে পাতা থালার দিকে তাকিয়ে বলেন, তো খোকা?
‘খোকা’ অর্থে আদিত্য।
বাবার মাথা ধরেছে। খাবে না।… বলে চেয়ারটাকে শব্দ করে টেনে খেতে বসে শিলাদিত্য।…
ওরা রাতে ভাত ছোঁয়ও না। কখনো কখনো ঠাট্টা করে বলে, বাঙাল বুড়ির রাতে ভাত না হলে চলে না।
আজ ঠাট্টার মেজাজ নেই।
বাবা যে মেজাজ দেখাতেই মাথা ধরার ছুতো করে খেল না, এটা তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। এতে তাদের মানের হানি হয় না? রোসো, এবার থেকে রোজ এই করব। ক’দিন রাগ দেখাবে দেখি!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন