অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
গ্রামের পুবদিকে চালাঘরের হাসপাতাল, পশ্চিমে মরা নদী। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে তার ওপর দিয়ে ঝিঙে-চিচিঙ্গা বোঝাই গোরুর গাড়ি চলে, রাস্তা সংক্ষেপ করতে চালের সাইকেল ছোটে। মরা নদীর ওপার থেকে ফুঁসতে ফুঁসতে কালবৈশাখী এসে পুবের গ্রামীণ হাসপাতালের প্রসবকালীন আর্তনাদও উড়িয়ে নিয়ে যায়। মাইলের পর মাইল শূন্য ভূমির ওপর হাওয়ার শব্দ কখনও হা-রে-রে-রে, কখনও হাহাকারের মতো শোনায়।
একশো বছর আগেও এই নদী বইত। এই সেদিনও খাল, নালা, জল-কাদার চেহারা ধরে আনুমানিক ভাবে বেঁচে ছিল নদীটা। এখন দীর্ঘ বাদা অঞ্চলের পাশাপাশি আরও দীর্ঘ শুধুই নদীর কবর, মাঝে মাঝে দুয়েকটা রক্তমাখা ভাঙা পাঁজরের মতো ছেঁড়া ছেঁড়া নালা। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে বাদা শুকিয়ে গেলে খালও শুকিয়ে যায়। গ্রামের বৃদ্ধরা শুধু হাওয়ায় নদীর দীর্ঘশ্বাস শোনে। এ-ভাষাও তাদের। তাদেরই কেউ কেউ এখনও বলাবলি করে- এই নদী বেয়ে ভেলায় লখিন্দরকে নিয়ে বেহুলা স্বর্গরাজ ইন্দ্রের সভায় গিয়েছিল। কেউ বলে লখিন্দরের বাবা চাঁদ সদাগর এ পথে নৌকোযাত্রা করেছিল। কারও কারও মতে, এটা বড় কোনও নদীই নয়, নামহীন একটা শাখানদী মাত্র।
গোটা বালিসোনা গ্রামেই ঘরদোর কম, রাস্তাও কম, একটাই অপ্রশস্ত পিচরাস্তা, তিন জায়গায় বাঁক খেয়ে বড় শহরের দিকে চলে গেছে। সবুজই এ-গ্রামে বেশি। শুধু বালিসোনা গ্রামেই না, আশপাশের আরও ষোলটি গ্রাম জুড়ে গোটা বালিসোনা অঞ্চলেই অসীম সবুজ।
এতো গাছপালা পরের চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে ক্রমশ উজাড় হয়ে যাবে। ঘরবাড়ি দোকান-বাজার, সেলুন, টিউটোরিয়াল হোম, মলমূত্ররক্ত পরীক্ষার ক্লিনিক, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, রেস্টোর্যান্ট, আর মানুষের অবিরাম ভিড়ে এই নির্জন গ্রাম সব সময় চিৎকার করতে থাকবে। ক্রমশ এখানে দেখা যাবে অসংখ্য বিউটি পার্লার, কিন্ডারগার্টেন, নার্সিং হোম (গোপন গর্ভপাতের ব্যবস্থাসহ), লাইসেন্সড ও বিনা লাইসেন্সের বার, মদের দোকান, জুয়ার আড্ডা, রাজনৈতিক দলের আঞ্চলিক অফিস, চওড়া রাস্তা, বাস, লরি, রিকশা, জিপগাড়ির ভিড়।
তখন হারানো নদীরও নতুন আখ্যান রচিত হবে।
হাসপাতালের মাটির ঘরে তার প্রথম সন্তান ফুটফুটে এক কন্যা- প্রতিবেশিনীর মুখে ভর সন্ধেবেলা এই সংবাদ শুনে সদ্য জমিদারি প্রথার অবসানে অসহায় অবনীমোহন চোধুরী বটতলার জনশূন্যিমোড়ের ‘গাঁজা ও আফিংয়ের দোকান’ থেকে কেনা এক ডেলা আফিং মুখে ফেলে দিলেন। মাথার ওপর বাপ আর বড় দাদারা থাকায় নিজের মধ্যে তাঁর কখনও জমিদারির বোধ ছিল না। তার ওপর বার বার নিজেদেরই বাগানের আম-কাঁঠাল চুরি করার অপরাধে দুমাস আগে তিনমাসের মেয়াদে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করা হয়েছে। জমিদারবাড়ি ছেড়ে এখন কাছেই একটা ছোট একতলা বাড়িতে তাদের থাকার ব্যবস্থা। প্রথম সন্তানও ভূমিষ্ঠ হল তাঁর এই চরম দুঃসময়ে।
তালাক দেওয়ার মতো ত্যাজ্যপুত্র করার আদেশ শুনে ভুবনমোহন চৌধুরীর পঞ্চম সন্তান অবনীমোহন দমকা হাওয়ার মতন বাবার ঘরে ঢুকে বলেছিলেন, ‘আপনি কি চান সরোজিনীকে নিয়ে আমি হাতানিয়া-দোয়ানিয়ায় গিয়ে ঝাঁপ দিই?’
অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টারের বউ তার ভাগের সকালের জলখাবার এক পোয়া নীলচে দুধ আর সিকি পাউন্ড পাউরুটি নার্সের চোখ এড়িয়ে তার ছেলের অ্যালুমিনিয়ামের কৌটোয় ঢেলে দিচ্ছে, পাশের খাটিয়ার ছোট জমিদারগিন্নি তাঁর বাচ্চা নিয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখে হাসল। সেই হাসিতে সংকোচ অপরাধ ও অভ্যস্ত প্রণাম মিশে আছে। নার্স চলে যেতে আরও কয়েকজনের আসন্নপ্রসবা স্ত্রী তাদের বরাদ্দ দুধ-পাউরুটি ঘর থেকে আসা তাদের ছেলেমেয়েদের কৌটোয় সন্তর্পণে ঢেলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
‘তোর বাপকেও দিস এট্টু। রোজ দিস তো? গাছ থেকে পড়বার পর এগবারে অথব্ব হয়ে গেছে!’ এক চাষী-বউ তার চার বছরের ছেলের মাথার চুল হাত দিয়ে গুছিয়ে দিতে দিতে বলল।
ছেলেটি ডাইনে মৃদু মাথা হেলিয়ে জানাল, দেব। তার চোখদুটিতে সব সময় ঘুমভাঙা স্বপ্নের ঘোর, তাই সবাই তাকে নিদ্দা বলে ডাকে। ভালো নাম কেউ এখনও দেয়নি।
বাপের নাম ফণাধর পদ্মরাজ। জন্মের পর-পরই শিশুর শিয়রে ফণাধর সাপ এসেও ছোবল না দিয়ে জঙ্গলে ফিরে গিয়েছিল, সেই গল্প দিনে অসংখ্যবার অসংখ্য জনকে বলতে বলতে নামই হয়ে গেল ফণাধর।
ছোট জমিদারগিন্নি সরোজিনীকে তিন বছর আগের ফুলশয্যার রানির সাজ ছাড়াই পরমাসুন্দরী বলে চেনা যায়। শিশুকন্যা সহ রিকশায় তুলে তাদের আলাদা ছোট বাড়িতে নিয়ে গেলেন জমিদার বাড়ির সেজোগিন্নি।
‘কী দিয়ে মেয়ের মুখ দেখবে দ্যাখো, ঠাকুরপো!’
অবনীমোহন নিজের ঘরেই দেওয়ালে আয়না ঝুলিয়ে দাড়ি কামাচ্ছিলেন। মেয়ের মুখ দেখলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পিতৃমুখী মেয়ে। যদি তার মায়ের সঙ্গে তাঁরও রূপ পায় তাহলে তো দারুণ সুন্দরী হবে, কিন্তু যদি বাপ-মার ভাগ্যও পায়, তাহলে?
মেয়ের নাম রাখা হল- লক্ষ্মীপ্রতিমা।
অবনীমোহনকে সাময়িক ত্যাজ্যপুত্র করলেও ভুবনমোহন চৌধুরী তাঁর বড় ছেলের অকালমৃত্যুর পর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পৌত্র-পৌত্রীদের আনুমানিক সংখ্যা ধরে সকলের শিক্ষাখাতে সমপরিমাণ অর্থের আলাদা তহবিল তৈরি করে দিয়েছেন। সেই তহবিল থেকে লক্ষ্মীপ্রতিমাকে ভরতি করা হল গ্রামেরই বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়ে। কয়েক বছরেই দেখা গেল গণিতে তার অসাধারণ ক্ষমতা। বড় বড় যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ সে নিমেষে করে ফেলে, অনেক সময় খাতায় না কষে মুখে মুখেই ফল বলে দেয়।
প্রতি বছর ক্লাসে ওঠে ফার্স্ট হয়ে। তার রূপে ক্লাসঘর আলো হয়ে যায়। মায়ের আগ্রহে ও যত্নে চলতে লাগল তার নৃত্যশিক্ষা ও যোগব্যায়াম। একদিন হেড মিস্ট্রেস নিজে এসে সরোজিনীকে বললেন, ‘বলতে খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু না বলে পারছি না। আপনার মেয়েকে আপনি স্কুল ছাড়িয়ে দিন। বাড়িতে রেখে পড়ান, স্কুলের পর আমরাই না-হয় একেকজন স্কুল থেকে এসে ওকে পড়িয়ে যাব। পরে শুধু পরীক্ষাটা সেন্টারে গিয়ে দেবে। মেয়ের আপনার যা রূপ, আমাদেরই ভয় করে!’
তেরো বছর বয়সে তাকে কলকাতায় তার মেজজ্যাঠার বাড়িতে রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হল। সেখানে তার বিধবা জ্যাঠতুতো দিদির সস্নেহ তত্ত্বাবধানে স্কুলের শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত যাবতীয় লেখাপড়া ও রূপচর্চা।
অবনীমোহনের সন্ধের আফিংয়ের নেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গতবছর নয়া পয়সা চালু হওয়ার আগের মুদ্রা জমানো। মেয়ের রূপ নিয়ে কোনও বিপদের আশংকা তার মনেই আসে না। মেয়ে তার মুখশ্রী পেয়ে রূপবতী হয়ে বেড়ে উঠছে দেখে তার ভালো লাগে। মেয়ের ভাগ্য নিয়েও তার ভয় কেটে গেছে। সে নিজে ম্যাট্রিকে দুবার অঙ্কে ফেল করে তৃতীয়বার ম্যাট্রিক পাশ করেছিল। মেয়ে প্রথম থেকেই অঙ্কে একশোয় একশো পেয়ে আসছে। গুণেই যখন এতটা তফাৎ, ভাগ্যও তখন নিশ্চয়ই তার বিপরীত হবে।
কতটা বিপরীত তা বোঝা গেল কয়েক বছর পর।
ভণ্ডুল বরাবর বেলায় গিয়ে রেলস্টেশনের চায়ের দোকান থেকে ষোল নয়া পয়সায় ‘যুগান্তর’ এনে দেয়। ‘যুগান্তর’ না পেলে পনের নয়ায় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’। যুগান্তরের প্রথম পাতায় একদিন তাদের লক্ষ্মীপ্রতিমার বড় ফটো দেখে চৌধুরীবাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল। লক্ষ্মীর মাথায় রানির মুকুট। বুকের ওপর উত্তরীয়ের মতো চওড়া ফালির গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা- MISS INDIA.
ছোট মেয়ে সরস্বতীপ্রতিমারও বিদ্যাভাগ্য নিয়ে অবনীমোহন যতটা নিশ্চিন্ত, প্রথম জীবনে তার সাংঘাতিক ভাগ্যবিপর্যয় বিষয়ে ততটাই অজ্ঞ ছিল। দৌহিত্রীর সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ভুবনমোহনকে কোনওদিন জানানোই হয়নি।
ভুবনমোহনের রোজকার অভ্যাস পড়ন্ত বেলা থেকে সন্ধে নামার আগে পর্যন্ত লাঠিতে ভর দিয়ে বাড়ি থেকে তিনশো পঞ্চাশ পা হেঁটে এসে রাস্তার ধারে শিরীষগাছের তলায় তাঁর ঠাকুরদার কবরের অদূরে চেয়ারে বসে পথচলতি মানুষজনকে কুশলজিজ্ঞাসা করবেন। কাউকে কাউকে ডেকে বাড়িতে এসে একদিন ভোজ খেয়ে যাবার নেমন্তন্নও করবেন। তাঁর পরনে রোজই ধপধপে ফিনফিনে ধুতি আর ঘিয়ে রঙের সিল্কের ফতুয়া। আগের আমলের অনেকেই, চাষি, ধোপা, মিউনিসিপ্যালিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, আসা-যাওয়ার পথে তাঁকে কেউ গড় হয়ে, কেউ জোড়হাতে নমস্কার জানিয়ে যায়। তাদেরও নেমন্তন্ন করেন। ‘একদিন’ মানে কোন দিন তা কখনও বলেন না। যারা তাঁকে চেনে তারা তৎক্ষণাৎ হেসে সম্মতি জানিয়ে যে যার পথে চলে যায়। অচেনাদেরও অনেকে থেমে দাঁড়িয়ে ভুবনমোহনের কথা শোনে, কেউ অবাক হয়, কেউ ‘নিশ্চয়ই আসব একদিন’ বলে মুচকি হেসে নিজের পথে এগোয়।
সন্ধের ঠিক আগে তার খাস চাকর ভণ্ডুল যখন ভুবনমোহনের পূর্বপুরুষের ভারি চেয়ারটা তুলে নিয়ে যেতে আসে, ভুবনমোহন লাঠি ভর করে তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলেন, ‘জেলেদের বলে রাখিস, পশ্চিমের বড় পুকুরে জাল ফেলতে হবে। চাঁদোখালির গয়লাদের একবার দেখা করতে বলিস। এবার অনেককে নেমন্তন্ন করা হচ্ছে।’
ভুবনমোহন আগে বসতেন তাঁদের রাসমাঠে, প্রতিবছর রথযাত্রার পরে যেখানে তাঁদের পারিবারিক পাঁচতলা রথ ধুলো খায়, গায়ে মাকড়শা জাল বোনে, চৈত্র-বৈশাখে কাক বুলবুলি বাসা বাঁধে, সেই রথের ছায়ায়। যেদিন রাসমাঠে তেমন তেমন হাওয়া দেয় সেদিন শিরীষের ডালপালা তার মাথায় চামর দোলাত।
এখন বসেন ঠাকুরদার কবরের কাছাকাছি, বাসরাস্তার ধারে।
এই কবর তাঁদের বংশের প্রথম কবর। ঠাকুরদার আমলেই দাহ করার বদলে কবর দেওয়ার সূচনা।
ভুবনমোহনের ঠাকুরদা মুরলীমোহন পরমাসুন্দরী পত্নী কুসুমবালাকে তার প্রথম যৌবনেই হারিয়ে দুঃখে পাগল হয়ে অবিকল-ঘুমন্ত স্ত্রীর শবদেহ আঁকড়ে ধরে বলেছিলেন, ‘কুসুমকে আমি পোড়াতে দেব না!’
সবাই মিলে অনেক বুঝিয়েও তাঁকে শান্ত করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত কবিরাজের পরামর্শে নানা কৌশলে অনেকটা আফিং খাইয়ে দেওয়া হল। তাতেও তাঁকে ঘুম পাড়ানো গেল না, তাঁর কুসুমকে কিছুতেই কাছ ছাড়া করবেন না।
শ্মশানযাত্রার পুরো পথটাই তাঁকে শবদেহের পাশাপাশি চলতে দেখা গেল। কয়েকবার তাঁর আকুল অনুনয়-বিনয়ে ফুলে ঢাকা শববাহী খাট তাঁর চোখের নাগালে নামিয়ে আনতে হল। ঘুমন্ত কুসুমবালার মুখ থেকে তিনি চোখ আর সরাতে পারেন না। হরিধ্বনি সহকারে খাট আবার ওপরে উঠে গেলে তাঁর দৃষ্টি আরও ওপরের আকাশে প্রিয় পত্নীর উপযুক্ত বাসভবনের জমি খুঁজে বেড়ায়।
বালক ভুবনের জ্বলন্ত প্যাঁকাটি ধরা হাত দুহাতে ধরে কুল-পুরোহিতকে শবদেহের মুখাগ্নি করিয়ে দিতে দেখে মুরলীমোহন অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে গিয়ে ঢুলুঢুলু চোখে দাহ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চিতার আগুনের নৃত্যরত শিখার দিকে চেয়ে রইলেন।
সে-বছরই ফাগুন মাসে পাশের ছ-আনির জমিদার অধিকারী বৈষ্ণবদের কাছে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা নিলেন। অধিকারীরা মৃত্যুর পর শব দাহ করে না, গর্তে বসিয়ে কবর দেয়।
‘জীবনের অন্ত্যে তোমার আর তোমার সন্তানদের দেহ যদি মাটিতে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে দিতে চাও, সে তোমার সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমি আমার পিতৃ-পিতামহের শাস্ত্রের বিধান পাল্টে দিতে পারব না। আমাকে আর তোমার গর্ভধারিণীকে যেন শাস্ত্রমতে শ্মশানে নিয়েই দাহ করা হয়।’
ঠাকুরদা তাঁর বাবার আদেশমতো প্রথমে মা ও পরে বাবার মরদেহ শ্মশানে দাহ করার পর নিজেকে দিয়েই চৌধুরী পরিবারে কবরপ্রথা চালু করেন।
ছাদহীন, ঘুনধরা, ইট বের করা দেওয়ালে ঘেরা এই কবরগৃহের কাছে বসে রাস্তার মানুষ দেখা ভুবনমোহনের নেশার মতো।
আরও কয়েক বছর পরে ভণ্ডুল তাঁকে ধরে ধরে বসিয়ে দিয়ে যাবে বাড়ির সামনের পায়ে-চলা রাস্তার পাশে বকুলবেদির গা ঘেঁসে।
শিরীষতলা থেকে বাড়ি ফিরে ভুবনমোহন শ্বেতপাথরের গেলাসে বংশের ধারা মেনে রোজকার মতো হুইস্কি সোডা ও বরফকলের কাঠের গুঁড়োমাখা বরফ নিয়ে বসতেন। চাকরই বরাবরের মতো টেবিলে সাজিয়ে দিত।
তাঁর বাবার আমলে দারোগাকেও এই টেবিলেই হুইস্কি পানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিজেরা নতুন বৈষ্ণব, সম্পূর্ণ নিরামিষাশী, তাই আস্তাবলে মুসলমান সহিসকে দিয়ে আগেই আস্ত মুরগি রোস্ট করা হয়েছে।
সরু বাসরাস্তা যেখানে মরা নদীর দিকে বেঁকে গেছে, সেই রাস্তার দুধারে তিনমাইল-কপিখেতে ভোরবেলা চাষিদের ওপর লাঠি বর্শা বল্লম নিয়ে জমিদারের লেঠেল বাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়ার দিনই বেলার দিকে এই দারোগা-আপ্যায়ন। আক্রান্ত হয়েই চাষিরা তাদের হাতের কাস্তে কোদাল নিড়ানি নিয়ে লড়াই শুরু করার পরে পরেই গ্রামের সব মেয়ে-বউ বঁটি, খুন্তি, কাটারি, শাবল হাতে, অঘ্রাণের হিমেল হাওয়ায় শত্তুরের উদ্দেশে শাপ-শাপান্ত ছড়িয়ে স্বামী সন্তান ভাই ভাসুরদের সঙ্গে যোগ দেয়। ভুবনমোহনের তখন যৌবনকাল।
দূর-শহরের এক শিল্পপতির কাছে এইসব জমি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, অথচ চাষিরা তখনও তাদের চাষ ছাড়েনি, তাই এই আক্রমণ। এখন সেই সুদীর্ঘ কপিখেতে প্লাইউডের কারখানা, গ্রিল কারখানা, আলকাতরায় লেখা ‘সাইট ফর গণপতি বিড়ি ফ্যাক্টরি’, রাস্তার ধারেই নতুন দেখা যাচ্ছে পাঁচিল-ঘেরা ‘সাইট ফর ঝুনঝুনওয়ালা টাইলস’।
এখনও জমিদারের সেই চাষি-উচ্ছেদ ‘কপিখেতের যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। জেলার একপৃষ্ঠার পাক্ষিক সংবাদপত্রে সেসময় এই যুদ্ধের বিবরণ ছাপা হয়েছিল। সেবার চাষিদের সাতটি শবদেহ ভোরের কুয়াশা থাকতে থাকতে বাদার শুকনো নদীবক্ষ খুঁড়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গোর দেওয়া হয়।
রোস্টেড মুরগি সহযোগে মদ্যপান ছাড়াও নগদ পাঁচশো টাকা, সেইসঙ্গে এক কার্টন ভ্যাট সিক্সটিনাইন নিয়ে দারোগাসাহেব ভুবনমোহনের পিতৃদেব জগন্মোহন চৌধুরীকে মার্বেলের মেঝেয় সশব্দে পা ঠুকে স্যালুট করে থানার অন্দরে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে যান। বিকেলে থানায় এসে রিপোর্টে লেখেন- ভোরে অত্যধিক ঘন কুয়াশায় জমির পারস্পরিক সীমানা-বিভাজক আলগুলি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় চাষিরা নিজের নিজের খেতের অধিকার নিয়ে প্রথমে বচসা, তা থেকে অ্যাবিউজিং ও তা থেকেই কোদাল কাস্তে নিড়ানি নিয়ে প্রচণ্ড মারামারি করে আহত হয় ও আহত করে। তবে কারও আঘাত মারাত্মক নয়। জমিদারের লোক খবর পেয়ে স্থানীয় হাসপাতালের টিংচার আইডিন প্রয়োগে সকলকে সুস্থ করে তোলে।
জেলার এস পি সাহেবকে রিপোর্ট পাঠানোর ব্যবস্থা করে দারোগাসাহেব নিজের জিপে বেরিয়ে যান।
জমিদারির এই শেষ যুদ্ধের রক্তপাতের পর এ-অঞ্চলে আর কোনও বড় রক্তপাত কেউ দেখেনি। আবার রক্তের ধারা বইতে দেখা যাবে এর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, ততদিনে পুরো জেলাটা ভেঙে দুটো আলাদা জেলা করা হবে। বালিসোনা হবে জেলার সদরদপ্তর।
অবনীমোহনের ছোট মেয়ে সরস্বতীপ্রতিমার জ্ঞানহীন দেহ প্রথম দেখেছে মন্থরোর মা। বাদায় নদীর শুকনো বুকে শাড়ি শায়া ব্লাউজ ধুলো-কাদা মেখে পড়ে আছে। চোখ মুখ গামছা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, দুহাত বাঁধা গোরুর দড়ি দিয়ে। কলকাতায় পার্ক সার্কাস এলাকায় স্থানীয় বনধ ঘোষিত হওয়ায় লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজও আজ বন্ধ। হঠাৎ ছুটির সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেলা থাকতে থাকতে সরস্বতী গিয়েছিল দূরে কোথাও নদীর কোনও ঘাটে বসে নাকি বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী লিখেছিলেন বা লিখতে শুরু করেছিলেন তার খোঁজে।
মন্থরোর মা আসছিল জমিদারের বড় নাতি দিল্লি থেকে এসেছে, তাকে এক ডজন তিতির দিতে অর্থাৎ বিক্রি করতে। চোখে ভালো দেখে না। কোমর প্রায় নব্বই ডিগ্রি ভেঙে হাঁটে, বাদা দিয়ে আসবার সময় সরোকে সে ঠিকই চিনিছে। দুই বোন লক্ষ্মীপ্রতিমা আর সরস্বতীপ্রতিমাকে শিশুকাল থেকে সবাই ‘নকো-সরো’ বলেই ডাকে।
অবনীমোহন সেজো ও ন’বউকে নিয়ে মন্থরোর মার সঙ্গে প্রায় ঝড়ের মতো যখন অকুস্থলে পৌঁছলেন তখন সেখানেও আদিগন্ত বাদার বুকে হু হু হাওয়া বইছে। অদূরে একটা গাবগাছের নিচু ডালে সরস্বতীপ্রতিমার বডিস গাছে আটকানো কাটা ঘুড়ির মতো ওলোট পালোট খাচ্ছে।
সেজোবউ সঙ্গে আনা শাড়ি-চাদরে সরোকে ঢেকে দিল। হাত-মুখের বাঁধন খুলতে অবনীকে হাত লাগাতে হল। সরস্বতী গোঙাচ্ছে, হয়তো জ্ঞান এসেছে।
বার বার কোল বদল করে দুই বউ সরোকে বাড়ি এনে মাদুরে শুইয়ে দিল। রক্ত ধুলো কাদা ধুইয়ে পরিষ্কার করে এবার শুরু হল রক্ত বন্ধ করার পারিবারিক টোটকা চিকিৎসা। পুলিশকে খবর দেওয়া যাবে না। অবনীমোহন মেয়ের ঠোঁট ফাঁক করে ঘন্টায় ঘন্টায় হোমিওপ্যাথি আর বায়োকেমিক ওষুধ খাওয়াতে লাগলেন।
সরোজিনী স্বামীর তিন মাস নির্বাসনের মধ্যে একবার শীতলক্ষার মন্দিরে গিয়েছিলেন। বহু বছর পর আজ আবার দুই মেয়ের জন্য মানত করে ইট বাঁধার কথা মনে হয়েছিল। বাড়ি ফিরে ঘটনা শুনে প্রথমে থম মেরে গেলেন, তারপর নিঃশব্দে কাঁদলেন, তারপর মাঝে মাঝেই শুধু ভারি দীর্ঘশ্বাস শোনা যেতে লাগল।
লাস্ট ট্রেনে রাত সাড়ে বারোটায় অবনীমোহনের পিঠোপিঠি ভাই, বছর খানেকের ছোট অম্বরীশ বহুদিন পরে সেদিনই বাড়ি ফিরল। গায়ে ছাইরঙা শক্ত মোটা কাপড়ের শার্ট প্যান্ট, স্বাস্থ্যও আগের চেয়ে অনেক ভালো। শক্তপোক্ত, পেটাই করা চেহারা, মুখটা পাথরের। অনেক বছর আগে গয়ানাথ মেথর ক্রুদ্ধ বচসার সময় মাথার মলভর্তি ড্রাম অম্বরীশের মাথায় ঢেলে দিয়েছিল। সদ্য-তরুণ অম্বরীশ রোজকার মতো দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে সামনের বকুলবেদীতে দাঁড়িয়ে মুখে দেবে বলে এলাচের খোসা ছাড়াচ্ছিল, দুপুরের এই সময়টা সে প্রায়ই বাড়ির সামনে এই বকুলবেদীতে দাঁড়িয়ে একটা গোটা এলাচ একটু একটু করে খায়, তখন এ রাস্তা দিয়ে গয়ানাথকে যেতে এর আগেও কয়েকবার নিষেধ করেছে, অনেকদিন পর আজ আবার এপথে বকুলবেদীর সামনে দিয়ে ভরা মলপাত্র মাথায় মিউনসিপ্যালিটির মেথর গয়ানাথকে যেতে দেখে তার মাথায় আগুন ধরে যায়। বৈশাখ মাস, কালবৈশাখির দেখা নেই, রাস্তার পিচ গলন্ত, মলের ভরা ড্রাম মাথায় গয়ানাথের সারা মুখ গলা দরদর করে ঘামছে।
অম্বরীশ রাগে উত্তেজনায় বেদী থেকে এক লাফে নেমে এসে হুংকার দিয়ে বলল, ‘এই শুয়োর! এ রাস্তায় তোকে দুপুরে আসতে বারণ করেছি না!’
‘আপনাদের গু নিয়েই তো যেতে হয়।’
‘জুতিয়ে তোর মুখ লম্বা করে দেব, শুয়ার!’
হঠাৎ কী হল, গয়ানাথ তার মাথার ড্রামটা অম্বরীশের মাথায় উপুড় করে দিল।
এরপর থেকে গয়ানাথ নিরুদ্দেশ।
অম্বরীশ গয়ানাথের খোঁজে সেই যে বেরল আর ফিরল না।
বহুবছর পর যেদিন কলকাতা থেকে লাস্ট ট্রেনে অম্বরীশ ফিরে এল, আশপাশের গ্রাম ধরে পুরো অঞ্চলটাই কিছুটা বদলে গেছে। সেদিনই সকালে সরোকে বাদা থেকে তুলে আনা হয়েছে। অত রাতেই সে ঘটনাটা বিস্তারিত শুনে, সরোর জ্ঞান ফিরেছে জেনে তার ঘরে গিয়ে মেয়েটার মাথায় খানিকক্ষণ হাত বুলোল, তারপর বলল, ‘ওরা ক’জন ছিল?’
অনেক সান্ত্বনা ও সাধাসাধির পরও বহুক্ষণ চুপ করে থেকে সরো উত্তর দিল ‘দুজন’।
‘চিনতে পেরেছিলি?’
আবার চুপ, তারপর কঁকিয়ে উঠে বলল, ‘গগন আর জালালউদ্দীন।’
অম্বরীশ জিজ্ঞাসু চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়।
অনেক সময় নিয়ে অবনীমোহন প্রায় অচেনা স্বরে বলল, ‘দুজনের ঠাকুরদাই কপিখেতের যুদ্ধে ঠাকুরদার বাহিনীর বল্লমে প্রাণ দিয়েছে। ভোরের কুয়াশায় অন্যদের সঙ্গে ওদেরও বাদায় পুঁতে ফেলা হয়েছিল। তুইও তো জানিস।’
‘ওদের ছেলেদের, তাদের ছেলেদেরও চিনি। আমি আসছি।’
ওই পোশাকেই রাতের অন্ধকারে অম্বরীশ বেরিয়ে গেল।
ফিরল প্রায় তিনঘন্টা পর।
অবনীমোহন কিছুক্ষণ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা পড়বার চেষ্টা করে বলল, ‘এত রাতে গিয়েছিলি কোথায়?’ অম্বরীশকে নিরুত্তর দেখে এবার বলল, ‘তুই কি আর্মিতে আছিস? গয়ানাথের খোঁজ পেয়েছিলি?’
‘ওর খোঁজেই এসেছি। তুই জানিস কিছু? নিশ্চয়ই ফিরে এসেছিল?’
‘তুই যাবার কিছুদিন পরই ফিরেছে। চাকরির কথা বললি না তো?’
‘আর্মিতে ছিলাম। তারপর জাহাজে। এমাসেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। মুসৌরিতে একটা বাড়ি কিনেছি, এরপর ওখানেই থাকব।’
‘বিয়ে করেছিস?’
‘করবও না। প্রথম সবজির ট্রেনটা ক’টায় যেন এখানে আসে?’
‘রাত ৩টে ৫৪-য়।’
‘বাবা এখন কীরকম?’
‘একইরকম। এখনও গিয়ে বসে, সবাইকে নেমন্তন্ন করে।’
‘সরোকে বলিস, যারা ওর সর্বনাশ করেছে তাদের সঙ্গে ওর আর কখনওই দেখা হবে না। আর আমি যে বালিসোনায় এসেছি সেকথা কেউ কখনওই যেন জানতে না পারে।’
গয়ানাথকে তার চালাঘরে নয়, যে ঘাস-ওঠা সরু পথটা পুকুরপাড় ঘেঁসে তার গোবর নিকোনো উঠোনে ঢুকে গেছে, সেই মেটেপথের ওপর পাওয়া গেল। চোলাই খেয়ে দ্বাদশীর জ্যোৎস্নায় মুখ হা করে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সাইলেন্সার লাগানো রিভলবারের দুটো গুলিতে তার প্রাণ বেরিয়ে যাবার পরও পা দিয়ে ঠেলে তাকে পুকুরে ফেলে দেওয়া হল।
পরদিন একপৃষ্ঠার ‘পাক্ষিক সংবাদ’-এ বড় হরফে ছাপা হল- ‘আততায়ীর গুলিতে তিন তাজা প্রাণ হল বলিদান। পুলিশ যাই বলুক, জালালউদ্দীন ও গগনকে গুলি করেই মারা হয়েছে। গয়ানাথের মৃত্যুও জলে ডুবে নয়, গুলিতে।’
জালালউদ্দীন আর গগন দুজন তাদের পাড়ার দুপ্রান্তে থাকে, কিন্তু দুজনকেই পাওয়া গেল বাদার গাবগাছের ডালে। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে।
এর কয়েক বছর পর অম্বরীশ মুসৌরিতে নানা উদ্ভট কাজের কল্পনায় কাটিয়ে বাড়ি বেচে কলকাতায় ফিরে এল। সেখানে তার সমাজসেবার কাজে বাড়িতে লোক আসা-যাওয়ার বিরাম নেই।
কলকাতায় রোজই অম্বরীশের বেশ কয়েকবার স্নানের অভ্যেস। তার দীর্ঘ স্নানের সময় কেউ এসে বসে আছে দেখলে নেপালি বালকভৃত্য বাথরুমের দরজায় কপাল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করবে ‘বর্তমানে কে? নেপাল রুনছা, হিমল রুনছা, বর্তমানে কে?’
‘তোর ভবিষ্যৎ রে ব্যাটা!’ দু-তিনবার একই প্রশ্ন শুনে বাথরুম থেকে অম্বরীশের উত্তর।
মুসৌরির হোটেলে কাজ খোয়ানোর পর অম্বরীশ ছেলেটাকে পাহাড়ের কোলে তার দু-ঘরের দেড়তলা বাড়িতে এনে কাজে বহাল করেছিল। কলকাতার বাড়িতেও সে-ই তার দিনরাতের সেবক। প্রভুর কাছে বাংলা শিখে সে বাথরুমকে ‘বর্তমান’ বলতে পারে।
বরাবরের বিজয়ী দলের টিকিটে বিধানসভার ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিনগুলোয় বাড়িতে বাইরের লোকের ভিড় খুব বেড়ে গেল। সব সময় কেউ না কেউ আসছে। তখনও ‘বর্তমানে আর কতক্ষণ?’বলে বাথরুমের বন্ধ দরজার সামনে গান ধরবে- ‘নেপাল রুনছা, হিমল রুনছা, বর্তমানে কতক্ষণ?’ (নেপাল কাঁদে, হিমালয় কাঁদে, বাথরুমে আর কতক্ষণ?) সব কথাতেই নেপাল রুনছা, হিমল রুনছা বলা তার অভ্যাস।
ভোটে হেরে কলকাতার পাঠ তুলে বালিসোনায় পাকাপাকি ফিরে আসবার সময়, বাড়ির চিলেকুঠুরি অনাথ ছেলেটাকে লিখে দিয়ে অম্বরীশ তার বাড়ি বিক্রি করে দিল।
পরের বছর বালিসোনার মিউনিসিপ্যালিটি ভোটে জয়ী হয়ে সে চেয়ারম্যান হয়ে বসবে।
ভুবনমোহন বাড়িতেই রেজিস্ট্রার আনিয়ে ‘তেইশবিঘা-আমবাগান’ বিক্রির দলিল রেজিস্ট্রি করাচ্ছেন, এমন সময় প্রদীপ, অকাল-প্রয়াত জ্যেষ্ঠপুত্রের একমাত্র সন্তান, যে দুদিন আগে দিল্লি থেকে ক’দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে, ঘরে ঢুকে বলল, ‘ঠাকুরদা, আপনি নাকি সব বাগান বেচে দিচ্ছেন? আপনি নিশ্চয়ই জানেন, যে গ্রামে বা যে শহরে আমাদের বসবাস সেখানকার কোনও রূপান্তর উচিত না অনুচিত আগে সেটা বিচার করা দরকার?’
ঠাকুরদা অবোধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছেন দেখে প্রদীপ বলে চলল, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় কতগুলো অদলবদল ঘটে, সেটা ভালোর দিকে, না মন্দের দিকে যত আগাম বোঝা যায় ততই মানুষের ভালো।’
‘বাগান না বিক্রি করলে আমাদের চলবে কী করে? নেমন্তন্নও তো অনেক লোককে করতে হয়। বিক্রি করছি শুধু তেইশ-বিঘাটা।’
‘কাকাদের মধ্যে যারা কোনওদিন কিছু করেনি তাদের কাজ করতে বলুন। চাকরি বা ব্যবসা যে-কোনও একটা কাজে লাগতে বলুন। বাগান বেচে না দিয়ে বাগানের ফল বেচেও তো ব্যবসা হতে পারে। তেইশ বিঘা বাগান অন্যের হাতে গেলে তারা হয় গাছ কেটে কারখানা বসাবে, নয়তো সিনেমা হল বানাবে। আগে সিনেমা দেখতে এখানকার লোককে ট্রেনে পনেরো মাইল যেতে হত, এখন এখানেই তিনটে সিনেমা হল। এভাবে এই অঞ্চলটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ঠাকুরদা। জায়গাটার চরিত্রই বদলে যাচ্ছে। এ তো কুরূপান্তর। বদলাতে হলে চাই সুরূপান্তর। যাতে মানুষের ভবিষ্যৎটা ভালো হয়।’
ঠাকুরদা নাতির মুখে একসঙ্গে এত কথা কোনওদিন শোনেননি। বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার বাবা-কাকারা আমার মুখের ওপর কোনওদিন কথা কয় না, দু-দিন দিল্লি গিয়ে তুমি আমার সাতপুরুষের জায়গা-জমির চরিত্র বুঝে গেলে?’
‘আপনার মুশকিল হচ্ছে বাইরের পৃথিবীটা আপনি একদমই জানেন না।’
ভুবনমোহন হঠাৎ প্রচণ্ড রেগে তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ কণ্ঠে হুংকার দিয়ে উঠলেন- ‘চোপ!’
শতবর্ষ পূর্ণ হবার তেরোদিন আগে সে-ই তাঁর শেষ কথা। এরপর আবার তিনি কণ্ঠস্বর ফিরে পাবেন একশো তিন বছর বয়সে, মৃত্যুর ঠিক এগারো মাস আগে।
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের তিনমাস পর যখন তাঁকে কলকাতার হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনা হল, তখন কথা বলতে গেলে ঠোঁট বেঁকে যায়, গালের মাংস কাঁপে। কথা যেটুকু মুখ থেকে বেরোয় বোঝা যায় না। অথচ দৃষ্টি দেখে বোঝা যায় চারপাশের সবই তিনি নিরীক্ষণ করছেন ও বুঝতে পারছেন। শুধু বোঝাবার ক্ষমতাই নেই। স্লেটে বা কাগজে লিখে বোঝাতে গেলে তাঁর হাতের আঙুল এতই কাঁপতে থাকে যে তিনি স্লেটের ওপর চকখড়ি বা কাগজের ওপর কলম ধরতেই পারেন না। আরও একটু সুস্থ হলে ভুবনমোহনকে তার খাস চাকর ধরে ধরে পূর্বপুরুষের একই চেয়ারে বাড়ির কাছেই পায়ে-চলা পথের ধারে বকুলগাছের বেদীর সামনে বসিয়ে দিয়ে আসে। বাসরাস্তার তুলনায় এ রাস্তায় লোক চলাচল কম। চেনা-জানারা, একদা-প্রজা চাষি-মজুররা কত্তাবাবুর সামনে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কেউ হাতজোড় করে, মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করে।
ভুবনমোহন সবাইকেই কিছু বলেন, কাউকে কাউকে নেমন্তন্নও করেন, কিন্তু তার সেই কথা কণ্ঠ পায় না।
আগের বার প্রদীপকে তিতির দেওয়া হয়নি, ‘সে যা একখানা বেজম্মা দিন গিয়েছেলো, হাতে তিতির, কিন্তু মাথার ঠিক ছেলো নি।’ এবার প্রদীপ আসার খবর পেয়ে মন্থরোর মা আবার চারটে তিতির ধরে লাঠি ঠুকে ঠুকে কত্তাবাবুদের বাড়ি এসে হাজির।
চত্বরের লাগোয়া বারান্দায় প্রদীপকে পেয়ে বলল, ‘কলকেতা থেকে নাতি আসবে বলেছেল, এলোনি, ইদিকে সাঁঝ নাগতে নেগেছে, ভাবলুম পাখি কটা তবে খোকাকেই দে’আসি। দাও বাবা, চার আনা পয়সা দাও।’
চারটে তিতির পাখি প্রদীপের সামনে নামিয়ে রেখে মন্থরোর মা হাত পাতল। পাখিগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার পা সুতলি দিয়ে বাঁধা, সেই অবস্থায় তারা ডানা ফরফর করে মাঝে মাঝে ওড়ার চেষ্টা করছে, হাঁপিয়ে গিয়ে দম নেবার চেষ্টায় তাদের ছোট্ট পেট ফুলে ফুলে উঠছে।
প্রদীপ বেশ মুশকিলে পড়েছে। মন্থরোর মা জানে না, বেশ কিছুদিন হল সে আমিষ ছেড়ে দিয়েছে। যদি তিতিরগুলো কিনে নিয়ে পরে উড়িয়েও দেয়, তার দাম মাত্র চার আনা?
জোর করে বেশি দাম দিতে গেলে সে কিছুতেই নেবে না। বোঝাতে গেলে বা বেশি জোর করলে সে এই বলে কাঁদতে বসবে- ‘খোকাও আমায় ভিখিরি ভাবলি বাবা!’ প্রদীপ আগেও অনেকবার দেখেছে। বছর কয়েক আগে, একবার মন্থরোর মা দুটো নারকেল নিয়ে এসে এক টাকা চাইল। বাজারে দুটো নারকেলের দাম তখনই সাত-আট টাকার কম নয়, কিন্তু সেকথা বোঝায় কে! শেষ পর্যন্ত তাকে সাহস করে প্রদীপ একটা দু টাকার নোট দিল। চোখে তো প্রায় দ্যাখেই না, একটাকা আর দু-টাকার নোটে নিশ্চয়ই তফাত করতে পারবে না। মন্থরোর মা নোটটার ওপর ঝুঁকে পড়ে আঙুল দিয়ে প্রথমে তার ধারগুলো ও পরে জমি ও তারপরে দুটোই একসঙ্গে পরীক্ষা করতে করতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল- ‘তুমিও আমায় ভিখিরি ভাবলে বাবা! তোর দরজায় আমি কি ভিখিরি এয়েছি, খোকা!’
প্রদীপের দিক থেকে সাড়া না পেয়ে মন্থরোর মা অধৈর্য হয়ে বলল, ‘দাও বাবা, চার আনা পয়সার জন্যি আর বোস থাকতি পারি না। অ্যাতটা আস্তা, ঘরে ফিরতি আত হয়ে যাবে।’
প্রদীপ একটু নির্দয় হয়ে বলল, ‘মাছ-মাংস আমি ছেড়ে দিয়েছি দাদিমা।’
সে যখন এই বাড়িতে হামাগুড়ি দেয় তখন থেকেই (পরে শুনেছে, তারও অনেক আগে থেকে) মন্থরোর মা তাদের বাড়িতে ডিম, দুধ, নারকেল এইসব দিয়ে যেত। কথা বলতে শিখে মন্থরোর মাকে সে দাদিমা বলে ডাকত। তার রাঙাকাকিই শিখিয়েছিলেন। আরও কেউ কেউ মাঝে মাঝেই মাছ ডিম দুধ মধু ইত্যাদি দিত, তারা ছিল ব্যাপারী, সেসব ছিল জমিদারের সেবায় তাদের ভেট।
‘তুমি কি নিমাই সন্নিসি হবে নাকি? কচি বয়েস, মাংস না খেলি চলে? এখনও বে-শাদিও করলে নি!’
আসলে মন্থরোর মার সঙ্গে আজকাল প্রদীপের বিশেষ দেখা সাক্ষাৎ হয় না। থাকে দিল্লিতে, কালে-ভদ্রে ছুটি নিয়ে দু-চার দিন আসে, আসে বালিসোনার সবুজের টানে। ছোটবেলা থেকেই গাছপালা আর লেখাপড়ার শখ, এর কোনওটাতেই সময় তত দিতে পারে না- এই তার এক ক্রমবর্ধমান দুঃখ।
‘কই, বাবা?’
অগত্যা ঘর থেকে একটা সিকি এনে মন্থরোর মার হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার কাজকম্ম কেমন চলছে, দাদিমা?’
মন্থরোর মা সিকিটা আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে সামনের দিকে বৃথা খানিক চেয়ে থেকে বলল, ‘দিন আর কাটে না বাবা। ওজ সুয্যি উঠতিছে, ওজ সুয্যি ডুবতিছে, কিন্তু মনি হয় ঝ্যানো সুয্যি উঠতিছেও না, ডুবতিছেও না।’
মন্থরোর মার আসল নাম কী কেউ জানে না। আদপেই তার কোনও নাম আছে বা ছিল কিনা, জানার দরকারই হয় না। এ বিষয়ে কেউ কখনও কিছু ভাবেও না। পাড়ার কেউ মন্থরোর মার উঠোনে দাঁড়িয়ে মন্থরোকেই জিজ্ঞেস করে, ‘মন্থরোর মা মাঠ থেকে ফিরেছে রে, মন্থরো?’
দাঁত খোঁটা মন্থরোর আযৌবন অভ্যেস, দাঁত খুঁটতে খুঁটতে সেও জবাব দেবে, ‘মন্থরোর মা কি তোমার ঝ্যামন-ত্যামন বংশের মেয়েছেলে নাকি গো, বেলা তিনটেতেও মাঠে-ঘাটে ঘুরে মরবে? কী, বিছের ওষুধ নিতে এয়েছো, না কাছিমের ডিম?’
বা হয়তো বলে (বিশেষ করে সন্ধেবেলা কেউ এসে ডাকলে), ‘মন্থরোর মা কি তোমার জন্যি ডুমুরের মধু নে’ বসে ওয়েছে যে অ্যাগবারে হত্যে দে’ পড়লে?’
ডুমুরের মধু মানে অবশ্য চোলাই মদ। মন্থরোর মা নিজে চোলাই করে না, শুধু ছাপ্লাই দেয়।
শুধু মন্থরোই না, মন্থরোর মাও তার আব্বাকে লতায়-পাতায় মুর্শিদাবাদের নবাবের বংশধর বলে বিশ্বাস করে।
মন্থরোর মা’র ‘নানা’ ভাতের সন্ধানে মুর্শিদাবাদের লালবাগে গোরুর মেটের মতো পাতলা ইটের জরাজীর্ণ আব্বা-নানার ভিটে আর তাদের পরিবারের নিজস্ব কবরস্থানের মায়া ত্যাগ করে ঘুরতে ঘুরতে বালিসোনার এই পশ্চিম সীমানায় এসে যখন ডেরা বাঁধে তখন এখানকার এইসব গ্রাম বলতে ছিল শুধু বন-জঙ্গল। জঙ্গলের শেষে জলা। মন্থরোর মা’র নানা জঙ্গল কেটে প্রথমে নিজের চাষ-বাস ও পরে ক্রমশ আরও পাঁচজনের চাষ-বাসের ব্যবস্থা করে। ক্রমে ক্রমে এখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে চাষি তাঁতী জেলে কামার কুমোর গয়লাদের এনে বসায়। প্রথম প্রথম সে জমিদারকে কোনওরকম খাজনা দিত না। জঙ্গল কেটে জমি চাষ-বাসের যোগ্য করে তুলে সে নিজেকে এই নতুন জনবসতির একরকম জমিদারই ভেবে নিয়েছিল। তার পত্তন করা এলাকার নামও দিয়েছিল ‘ছোট লালবাগ’। পরে চৌধুরীবাড়ির চোরা কুঠুরিতে তিন রাত কয়েদ খেটে সে জমিদারের বশ্যতা মেনে নেয় ও খাজনা দিতে শুরু করে। তার শাদিও হয় এই নতুন বসতি করা ঘরের মেয়ের সঙ্গে। মাটিও নিল এখানেই। নানা বেঁচে থাকতে থাকতেই মন্থরোর মা’র আব্বার শাদিতে কার্বাইডের বড় বড় বাতি জ্বালিয়ে ঘটা করে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। তারপর গৌরবর্ণা সুন্দরী কিশোরী মন্থরোর মা’র শাদি হল, এই গাঁয়েরই ছেলের সঙ্গে। বছর চোদ্দ-পনেরো পরে চার ছেলে তিন মেয়ে রেখে সে-মানুষটাও মরে গেল। সেই থেকে মন্থরোর মা-ই সংসার চালায়। সে-সময় প্রদীপের মা বুকের শ্বেতিকে কুষ্ঠ ভেবে হতাশায় ভুগছিলেন। তার ওপর অদ্ভুত এক স্নায়ুরোগে কড়া ওষুধ খেয়ে দিনরাতের বেশির ভাগ সময় তার নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কাটত। সে-সময় প্রায় দুবছর মন্থরোর মা-ই তাঁর সবরকম সেবাশুশ্রূষাও করেছে। চব্বিশ ঘন্টা রোগী পরিচর্যার জন্য পাশের ছোট ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা ছিল। ডাক্তার, মন্থরোর মা ও ভুবনমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র ছাড়া সে-ঘরে আর কারও প্রবেশের অনুমতি ছিল না। বড় বউরানির গর্ভসঞ্চারের খবর হওয়ার সাত মাস এগারো দিন পর শুধু একজন ধাই ওঘরে ঢুকেছিল। প্রদীপকে ভূমিষ্ঠ করিয়ে সে চলে যায়।
তা সেই এক-দেড় কুড়ি বয়েস থেকে আজ এই চার কুড়ি পেরনো বয়স অব্দি মন্থরোর মাকে করতে হয়নি, গোটা জেলায় এমন কাজ বোধহয় বেশি নেই। তাছাড়া উপায় কী, বাপ-মরা অতগুলো ছানাপোনা নিয়ে বিধবা হওয়া- উদয়-অস্তে তা ধরো গে তোমার এক কুড়ি পেট। মজার কথা, মন্থরোও বুড়ো হত চলল, তবু আজও সে মাকে খাওয়ানো দূরের কথা, মা না হলে তাকেই উপোস করে থাকতে হত।
মন্থরোর নিজের চার ছেলে সেয়ানা হয়ে কে কোথায় ছিটকে-ছড়িয়ে গেছে মন্থরো জানে না। ছোট ছেলেটাও মাঝে মাঝে চলে যায়। রাজমিস্ত্রির সঙ্গে যোগাড় দেয়, জনমজুর খাটে, মাটি কাটে। তখন চুলে খুব তেল দিয়ে টেরি বাগায়। তারপর চুলে ধুলো পড়লে বাড়ি ফিরে আসে। তখন রোজ রোজ শাক-ভাতে কি গুগলির ঝোলে বিরক্ত হয়ে কোনওদিন একমুঠো কাছিমের ডিম, কোনওদিন কয়েকটা পাখিটাখি খুঁজে আনে।
মন্থরোর ছেলেরাই শুধু নয়, মন্থরোর মার মেয়েদের ছেলেমেয়েরাও কে কোথায় আছে, কে কে বেঁচে আছে, কাদের শাদি হয়েছে, কার ক’টা ছেলেমেয়ে হয়েছে- এসব হিসাবও মন্থরোর মা’র ভারি গোলমাল হয়ে যায়। একটা সময় ছিল যখন আশপাশের দু-চার গাঁয়ের সিকিভাগ ছেলেমেয়েই মন্থরোর মা’র নাতিপুতি। তারাও বেশিরভাগ অন্তত বছরে কোনও না কোনও সময় মন্থরোর মা’র বাড়িতে এসে থেকে যেত। মন্থরোর ছেলেরাও তখন বাড়িতেই থাকত। মন্থরোর মা তখন লোকের বাড়ি-বাড়ি দুধ বেচত, ডিম বেচত, ছালা ভরা নারকেল বয়ে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসত। তখনও যেটুকু জায়গা-জমি ছিল তাতে শশা ফলাত, বরবটি চিচিঙ্গিা ফলাত। পালং মটর বুনত। কাজের তার শেষ ছিল না। তার কারণ মন্থরোর মা’র সারা জীবনে একটাই কাজ- যেভাবে হোক সংসারের দুটো ভাত যোগাড় করা।
কার্তিক মাস শেষ হতে চলল, সন্ধের মুখে এখনই ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। মন্থরোর মা এই বয়সে, এই কুয়াশায়, ঝাপসা অন্ধকারে লাঠি ঠুকে ঠুকে চলে যাচ্ছে, কোমর থেকে শরীরটা ভেঙে রাস্তার হাত তিনেক ওপরে প্রায় রাস্তার সমান্তরালে সে হাঁটে। মন্থরোটা একেবারে অপদার্থ। প্রথম থেকেই হাবা-গোবা তো ছিলই, তার ওপর বয়স হবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে যেন ক্রমশ আরও অপদার্থ হয়ে পড়েছে। মন্থরোর মা’র ছোট ছেলে দুটি বেঁচে থাকলে এই বয়সে তাকে হয়তো এত কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করতে হত না। মারা যাবার সময় ওদের কত আর বয়স। জন্মেছিল এক বছরের ব্যবধানে, মরল একই বছরে। তার মধ্যেই দুজনে নিজেদের সাধ্যমতো পয়সা এনে মাকে দিয়েছে। ফোজোর ছিল বন-জঙ্গল ঘুরে হরেক পাখি ধরে কলকাতায় নিয়ে বিক্রির ব্যবসা। পাখির বাসা থেকেও ছানা বের করে আনত। ঘরে রেখে তারপর খাইয়ে-দাইয়ে একটু বড় করে বিক্রি করে দিত। দু-তিন বছরেই এই কাজে সে দিব্যি হাত পাকিয়ে ফেলেছিল। একবার চৈত্রমাসে আমলকী গাছের কোটরে হাত গলিয়ে সাপের ছোবল খেয়ে গাছ থেকেই মাটিতে পড়ে যায়। মন্থরোর মা-ই প্রথম খবর পেয়ে দৌড়ে এসে ছেলেকে কোলে করে ঘরে নিয়ে যায়। উঠোনে মরা ছেলেকে বুকে নিয়ে সে নাকি সারা দিন শুধু কেঁদেছে। সে তো তখন জানত না মাস কয়েক পরে তাকে আবার এভাবেই কাঁদতে হবে!
এরই মাস কয়েক পরে, প্রদীপ সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি নিয়ে গ্রামে এসে মন্থরোর মার বাড়ি গিয়ে দেখে সে উঠোনে বসে একমনে বেতের ঝুড়ি বুনছে।
ক’মাস আগে ফোজো মারা গেছে, কী বলা যায় ভেবে না পেয়ে খানিকক্ষণ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে সে বলে, ‘দাদিমা কি আজকাল বেতের কাজও করছ নাকি?’
একটু দূরে, কোনাকুনি দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল, এতক্ষণ দেখতে পায়নি। গলার স্বর শুনে মন্থরোর মা মুখ তুলে তাকে দেখে বলল, ‘কবে এলে বাবা? ক’দিন আর তোমাদের বাড়ি যাওয়া হয়নি। ফোজো নেই, পাখির ছানা ধরতে গে’- বলতে বলতে মন্থরোর মা মাথা নামিয়ে আঁচল দিয়ে চোখ ঢাকা দিল।
তারপর চোখ মুছে হাতের কাজ করতে করতে আবার বলল, ‘দাউদ ফিরবে সাঁঝের বেলা ব্যাঙ নে’। থলেয় ভরে নে’ আসে। তা ফড়েদের আসবার তো কোনও টাইম নেই। আতেও আসতি পারে, কাল ভোরেও আসতি পারে। থলের মধ্যি গাদাগাদি ব্যাঙ কি অতক্ষণ বাঁচে? ঝুড়ি চাপা দে রাখলি নিশ্চিন্দি। মরা ব্যাঙ ফড়েরা আঙুল দে তুলে হুই বাদায় ফেলে দেবে।’
কথা বলতে বলতে ওরই মধ্যে শক্ত দেখে একটা ঝুড়ি প্রদীপের সামনে উপুড় করে দিয়ে বলল, ‘দ্যেঁইড়ে কেন বাবা, বোসো। এর উপরিই বোসো। হ্যাঁ বাবা, বিদেশ-বিভুঁয়ে চাকরি করো, সেখানকার সাহেবরা নাকি ব্যাঙের ঠ্যাং খেতে ভালোবাসে? ফড়েদের মহাজন নাকি বরফ চাপা দে সে-দেশে ওজ এলগাড়িতে ব্যাঙের ঠ্যাং পাঠাচ্ছে?’
প্রদীপ হুঁ-হাঁ করে উত্তর দিয়ে বলল, ‘তোমার বড় ছেলে কাজকম্ম কিছু ধরেছে?’
‘ওই দ্যাখো না, কদমতলায় গামছা পেতে শুয়ে শুয়ে দাঁত খুঁটতিছে।’
প্রদীপ সেবার কর্মস্থলে ফিরে যাবার আগেই দাউদ মারা গেল ব্যাঙ ধরতে গিয়ে, সে-ও সাপের বিষে।
কলকাতার নাতি মানে ফোজোর ছেলে, সুজা। ফোজোর অপঘাত মৃত্যুর সময় একেবারে শিশু ছিল। ছেলেটা কিছুদিন তাদের বাড়িতে রাঙাকাকির ফাইফরমাশ খেটেছিল। রাঙাকাকির ফুলবাগানের কাজকর্ম করত। প্রদীপ দুয়েকবার ছুটিতে এসে ওকে একটু লেখাপড়াও শিখিয়েছিল। তারপর সুজাও একদিন গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। মন্থরোর মা বলে, এখন নাকি কলকাতায় কোন লটারির দোকানের গাড়ি চালায়।
মন্থরোর মা সেই নাতির জন্যেই সেদিন তিতির রাঁধবে ভেবেছিল। ছেলেটা নাকি তিতিরের মাংস খুব ভালোবাসে। নাতি না আসায় পাখিকটা প্রদীপকে গছিয়ে গিয়েছিল।
মন্থরোর মা’র জীবন ছেলেবেলা থেকে প্রদীপ যতটুকু দেখেছে, তা হল দারিদ্র থেকে আরও দারিদ্রের মুখে ধাবমান একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। এর মধ্যে যা কিনা চরম বিস্ময়ের, তা হল তার অদ্ভুত সততা আর আত্মমর্যাদা বোধ। সে তার সংসারের দুমুঠো ভাতের জন্য কী না করে! তারপরও হয়তো উপোস করে, কিন্তু কখনও মুখ ফুটে দুটো পয়সা চাইবে না। কাউকে ঠকানো তার স্বভাবেই নেই, বরং নিজেই ঠকবার জন্য স্বভাবটিকে বাগিয়ে রেখেছে। প্রদীপের বাবার অকালমৃত্যুর পর মন্থরোর মা দুধ ডিম নারকেলের দাম নেওয়া ছেড়ে দিল। মনে আছে, তার মা একবার বহু চেষ্টাতেও ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত কিছুটা রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘শোনো মন্থরোর মা, তুমি যখন দাম নেবে না, কাল থেকে আর আমাদের দুধ-ডিমও তুমি দেবে না।’
‘তা বললি হয়! তোমরা না নিলি, গরিব নোক, না খেতি পে মারা যাব, মা!’
‘সে তো তুমি টাকা না নিলেও না খেতে পেয়ে মরে যাবে।’
‘টাকা নিই কী করে মা! তুমি মা-নখ্যি গত মাসে এক কুড়ি টাকা দেছেলে, বললে, দুখানা কম্বল কিনে নাও মন্থরোর মা, যা শীত! তা সে তো তেনারই টাকা। তিনি আর নেই, দুধ ডিম নারকেল দে সে টাকা শোধ করতি হবে না?’
সন্ধ্যা গাঢ় হতে হতে ক্রমশ রাত নামছে। লেবু গাছগুলোর মাথায় ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি। ঠাকুরদার ঘরের মাথায় চিলেকোঠায় বাড়ির পোষা তক্ষক তালে তালে ডাকতে শুরু করেছে। তিতিরগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো, বিশেষ সাড়াশব্দ নেই। ঘর থেকে গোঁপ-ছাঁটা কাঁচি এনে প্রদীপ পাখিগুলোর পায়ের সুতলি কাটার চেষ্টা করতেই একসঙ্গে চারটি পাখিই প্রবল ডানা ঝাপটাতে লাগল।
শনিবার ঘুম ভেঙেই প্রদীপের মনে পড়ল, রাজধানী এক্সপ্রেস ধরতে হবে। সোমবার থেকে আবার অফিস।
অনেক কাল পর সে সকালে দিঘিতে স্নান করতে গেল। আসলে দিঘিটা দেখারও ইচ্ছে। দিঘিতে যাবার পথে কিছুটা ঘুরে মন্থরোর মার বাড়ি গিয়ে দেখে মন্থরোর মা বাড়ি নেই। উঠোনেও নেই, ঘরেও নেই।
ফিরে আসতে আসতে ঝোপঝাড়ের এদিকে-ওদিকে তাকাল, যদি কোথাও উবু হয়ে বসে শাকপাতা কাটে কী আর কিছু করে। চোখে পড়ল না।
আরও খানিক এগোতেই দেখা হল মন্থরোর সঙ্গে। কোত্থেকে ফিরছে। মাথায় কাপড়ের টুপি, হাতে একটা গাছের ডাল- লাঠির মতো ধরে আছে।
প্রদীপকে দেখেই বলল, ‘ফিরি যাচ্ছ খোকা?’
‘মন্থরোর মাকে দেখলাম না-’
‘তার কি কাজের কামাই আছে? তার বসি থাকলি চলে?’
প্রদীপ বিরক্তি চাপবার চেষ্টা করে বলল, ‘তা বুড়ো মাকে এবার ছুটি দিয়ে নিজে কিছু করলেও তো পারো?’
‘আমি ফকির হয়িছি।’ বলে মন্থরো দাঁত বের করে একগাল হেসে হাত বাড়াল ‘একটা সিগ্রেট দাও দিকি খোকা।’
‘চান করতে যাচ্ছি, সিগারেট কোথায় পাব? তাছাড়া সিগারেট আমি ছেড়ে দিয়েছি।’
‘তা’লি দশ নয়া দে যাও।’
মন্থরোর বয়েস এখন কত হবে? ঠিক ঠিক হিসেব করা মুশকিল। চল্লিশ-পঞ্চাশ হবে হয়তো। অথবা আরও বেশি। ছিল নিষ্কর্মা, হল ফকির!
দিঘিটা বছর-বছর ছোট হয়ে আসছে। জলও আগের মতো তেমন টলটলে নেই। তার ওপর কার্তিক-শেষের ঠান্ডা। তাছাড়া প্রদীপের সময়ও সংক্ষেপ। ১টা ২৩-এর বালিসোনা লোকালে না গেলে হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস ধরা কঠিন।
বালিসোনা-লোকাল প্ল্যাটফর্ম বদলে শিয়ালদামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁকা ট্রেন। জানলার ধারে বসে ঠাকুরদার কথা ভাবতে ভাবতে কানে এল- দুটো পয়সা দে যাও বাবা। আল্লা তোমার ভালো করবে, গরিবকে দুটো পয়সা দে যাও বাবা-
মন্থরোর মা কোমর থেকে প্ল্যাটফর্মের সমান্তরালে ঝুঁকে লাঠিতে ভর দিয়ে কোনওক্রমে তার সাদা মাথা তুলে আশপাশের লোকেদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে।
এক দম্পতি বোধহয় তাদের ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল, ভদ্রলোকটি ভুরু কুঁচকে মন্থরোর মার বাড়ানো হাতে ছোট কোনও একটি মুদ্রা ফেলে দিল। মন্থরোর মা হাতের লাঠিটা গলা আর কাঁধের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে খুব যত্ন করে পয়সাটা আঁচলে বাঁধল। তারপর লাঠি ঠুকে ঠুকে আরেক দলের কাছে গিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল- দুটো পয়সা দে যাও বাবা-
ঢং ঢং করে ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা বাজল।
প্রদীপ পার্স থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে মন্থরোর মাকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। মন্থরোর মা যাদের কাছে ভিক্ষে চাইছিল সেখানে কিছু না পেয়ে পাশের লোকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে ডাকল- দাদিমা! এই নাও- এদিকে, এই যে, ট্রেনের জানলায়-
মন্থরোর মা মাথা এদিকে ওদিক ঘুরিয়েই প্রদীপকে দেখতে পেল। অথবা তার গলা শুনে আন্দাজে তাকাল।
‘এসো তাড়াতাড়ি। ট্রেন ছেড়ে দেবে।’
মন্থরোর মা লাঠি ঠুকে এগিয়ে এল- ‘খোকা! কবে এলি বাবা?’
‘এলাম কী, যাচ্ছি। দিল্লি যাচ্ছি। তুমি তো আর তিতির নিয়ে এলে না?’
‘তিতির ভালো নেগেছে তো খোকা? বর্ষায় এয়ো, কাছিমের ডিম দেব। কাত্তিক অব্দি থাকলি তালের আঁটির ফোঁপরা দেব।’
শেষবার ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজল।
প্রদীপ নোট-সুদ্ধু হাতটা জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দিল।
মন্থরোর মা নোটটা দেখে নিমেষের জন্য থমকে গেল।
‘ধরো, ধরো।’
মন্থরোর মা হাত বাড়াল না, শুধু তার লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ট্রেনের পিছন দিকে মিলিয়ে গেল।
পরের বছর বাদায় হাতের আন্দাজে শাক তুলতে তুলতে সাপের ছোবলে নেতিয়ে পড়ার পর-পরই চৌধুরীবাড়ির দুজন মুনিষ দেখতে পেয়ে কাঁধের গামছা পাকিয়ে মন্থরোর মার বাহুতে বাঁধন দিয়ে কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে এল। ভণ্ডুলের মুখে খবর পেয়ে সরোজিনী প্রদীপকে তাড়া লাগায়, ‘তুমি আমার সঙ্গে চলো। এখনও যদি জ্ঞান থাকে, নিজের হাতে ওর মুখে একটু জল দিয়ো। এসো তাড়াতাড়ি।’
প্রদীপের মা এগিয়ে এসে কঠিন স্বরে বললেন, ‘না, খোকার যাবার দরকার নেই!’
সরস্বতীপ্রতিমার আতঙ্ক এখনও কাটেনি। অবনীমোহনের হোমিওপ্যাথি আর বায়োকেমিক ওষুধ খেয়ে সে দিন-রাতের বেশিটাই ঘুমোয়। কলেজে দীর্ঘ অনুপস্থিতি দেখে ইতিহাসের অধ্যাপিকা খোঁজ নিতে এসেছিলেন। সরস্বতীর মাথায় আঘাত লাগার কাল্পনিক ঘটনার বর্ণনা শুনিয়ে তাঁকে বলা হয়েছে, আরও কিছুদিন ও কলেজে যেতে পারবে না।
‘বেশ তো, বাড়িতে বসেই সে-ক’দিন পড়ুক না। অনেকদিন ব্র্যাবোর্ন থেকে ইতিহাসে কেউ ফার্স্ট ক্লাস পায়নি, তোমাকে কিন্তু পেতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে।’
সরস্বতীর দুচোখ জলে ভরে এসেছে।
এর দুদিন পর চাকর ঘরের বাইরে থেকে বলল, ‘একবার বাইরে আসবেন মা?’
সরস্বতীর মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, বাইরে এসে চাকরের হাতে সরস্বতীর কোমরের মাদুলি ঝুলতে দেখে ছিনিয়ে নিলেন, প্রথমেই চোখে পড়ল কারটা ছেঁড়া।
‘তোরা কোথায় পেলি?’
‘নিদ্দা এনেছে।’
নিদ্দাকে কিছু বলতে হল না। জোড়হাতে কোমর ভেঙে সরোজিনীকে নমস্কার করে বলল, ‘তখন সন্ধে হব-হব ভাব, বাদায় গেছি গোরু তুলতে, দেখি এটা পড়ে আছে। উপোর দেখে মনে হল এ নিচ্যয় কত্তাবাবুদের বাড়ির হবে। এই ভাবখানা মনে উঠতিই সোজা চলে এনু।’
এ সেই নিদ্দা, লক্ষ্মীপ্রতিমার জন্মের সময় যার মা নিজের জন্য বরাদ্দ হাসপাতালের জলমেশানো নীল দুধ আর পাউরুটি নার্সের চোখ এড়িয়ে ছেলেকে দিয়ে ঘরে পাঠাত।
‘ওকে পেট ভরে খই-চিঁড়ের মোয়া খাইয়ে দে। মাদুলির কথা আর কাউকে তোরা বলিস না।’
শরৎকালের এক বিকেলে এল অনসূয়া, তার কলেজের প্রিয়তম বন্ধু, সঙ্গে তার দাদা তাপস। সরস্বতী অসুস্থ শুনে তাকে দেখতে এসেছে। তাপসের সঙ্গে প্রথম দেখা ১২ই জানুয়ারি, স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে, সিমলা স্ট্রিটে, বিবেকানন্দের পৈতৃক বাড়িতে। দ্বিতীয় দেখা সেবছরই বসন্তে, সরস্বতীপুজোর দিন, অনসূয়াদের বাড়িতে। অনেকদিন পর এই তৃতীয় দর্শনে তাপসের মুখের দিকে সরস্বতী চোখ তুলল না।
তাদেরও মাথায় ধাক্কা লাগার গল্প বলা হয়েছে।
‘দাদাকে দেখে আজ হঠাৎ লজ্জা পেলি যে?’
‘ওদিকটায় জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে, সোজাসুজি আলোর দিকে আর তাকাতে পারছি না।’
‘তুই যে বলিস তুই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস আলো! ভোরের আলো, বিকেলের আলো, চাঁদের আলো, তারা ভরা আকাশের আলো- আলোর তো তোর লম্বা লিস্ট!’
বোনের এই কথায়ও তার মুখে কোনওরকম ভাব ফুটতে না দেখে এবার তাপস বলল, ‘আপনার আঘাত খুব বেশি, বুঝতে পারছি। তবে তা যত বড়ই হোক তার চেয়ে বড় আঘাত এই পৃথিবীতে সর্বদাই কেউ না কেউ পাচ্ছে। গত তিনদিনে এরকম তিরিশটা সাংঘাতিক ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা নিউজ পেপারে সারা দুনিয়া পড়েছে। আন্দিজ পাহাড়ে বিমান ভেঙে পড়ার ঘটনা জানেন তো? পাহাড়ের ওপর শত শত মাইল শুধু জমাট বরফ। তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে এরোপ্লেনটা ঠিক মাঝখান থেকে দু-টুকরো হয়ে গেল। ভেতরে তখন ১৮০ জন যাত্রী, এয়ার হোস্টেস, পাইলট- যারা তখনও বেঁচে সবাই মারাত্মক আহত, একশোর বেশি যাত্রীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। দুজন পাইলট ও সাতজন এয়ার হোস্টেস কেউ বাঁচেনি। যারা বেঁচেছে তাদের কারও পেট ফেঁড়ে সামনের আসনের ব্যাকরেস্ট ঢুকে গেছে, কেউ নিজের দুহাতে পেটের বেরিয়ে আসা নাড়িভুড়ি ধরে আছে, কারও পা হাঁটু থেকে খুলে গেছে, সব বর্ণনা করব না। মারাত্মক আহতদের অনেকেই দু-তিনদিন ধরে বাঁচবার প্রবল চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত মারা গেল। ছজন মাত্র যাত্রীর আঘাত অল্প। তাদের মধ্যে একজন ডাক্তার। তিনি এক তরুণীর ভাঙা পাঁজর হাতের চাপে ঠেলে সামনের মৃতদেহের স্কার্ফ টেনে নিয়ে জোরে বেঁধে দিলেন। সেইসঙ্গে পর পর চারটে ইনজেকশন। অন্য এক মধ্যবয়সির বাহুমূল থেকে উল্টে যাওয়া হাত হ্যাঁচকা টানে ফের সোজা করে দিলেন। ছজনে মিলে প্রথমে অখণ্ড মৃতদেহগুলো ধরাধরি করে বাইরে তুষারের মধ্যে ছ-ফুট অন্তর অন্তর মাত্র দু-ফুট গভীর গর্ত করে কবর দেওয়া হল। হিমাঙ্কের অনেক নীচের তাপমাত্রায় বেশিক্ষণ বিমানের বাইরে থাকা অসম্ভব। দৌড়ে ভেতরে ঢুকে খণ্ড বিখণ্ড মৃতদেহ, ভাঙাচোরা হ্যান্ডব্যাগ সুটকেশ ডিঙিয়ে মাড়িয়ে যাবার সময় দেখল চকোলেট ভরা একটা সুটকেশ তুবড়ে গিয়ে খুলে পড়ে আছে। প্রত্যেকেই হাতে যতটা পারে চকোলেট তুলে নিয়ে প্রথমে নিজেরা কয়েকটা করে খেয়ে তারপর যাদের কোনওরকমে বাঁচাবার চেষ্টা চলছে তাদের কারও কারও মুখের সামনে ধরছে, যদি কেউ কোনওক্রমে খেতে পারে।’
সরস্বতী কখন যে তাপসের চোখে চোখ রেখে এই দুঃসহ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার বর্ণনা শুনতে শুরু করেছে, সে নিজেও জানে না। শুনতে শুনতে ব্যথায় তার বুক ভেঙে যায়, তা সত্ত্বেও তাপস থামতেই বলে উঠল, ‘তারা কি বাঁচল? তারা বাড়ি ফিরতে পারল?’
তাপস একথার উত্তর না দিয়ে শুরু করল, ‘নিজের দেশে গিয়ে বিয়ে করবে বলে চিলির একটা মেয়েকে নিয়ে পেরু যাচ্ছিল একটা ছেলে। ছেলেটার কোমর থেকে মেরুদণ্ড দু টুকরো হয়ে গেছে, ঘাড়ও ভাঙা, মেয়েটা দুহাতে প্রেমিকের ভগ্নদেহ বুকে জাপটে ধরে শুধু কেঁদে চলেছে।’
‘বেশিরভাগ ক্যাবিন-ব্যাগেজই ছেঁড়া ফাটা কিংবা খোলা। অনেক ব্যাগের লকিং অক্ষত থাকলেও পিছন বা পাশ ফেঁড়ে গেছে। যদি কোনও ওষুধ পাওয়া যায়- সুস্থ ছজন দ্রুত ব্যাগগুলো ঘাঁটতে লাগল।
‘একজনের মনে পড়ে গেল মৃতদের মধ্যে দুজন ডাক্তার ছিলেন, ফলে আরও তন্ন তন্ন করে ওষুধের সন্ধান চলল।
‘একটা স্টেথোস্কোপ, একটা ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র, সঙ্গে কয়েকরকম জীবনদায়ী ওষুধ মিলল দুটো ব্যাগ থেকে।
‘মেয়েটির বুকের ওপরই শেষ রাতে ছেলেটি মারা গেল, তখন ঘন তুষারাবৃত আন্দিজ পাহাড়ের শিখরশ্রেণী সূর্যের প্রথম কিরণে রঙিন হয়ে উঠছে।
‘ভেবে দেখুন, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এদের কারও কোনও যোগাযোগ নেই। এই বিমান বা এই দুর্ঘটনার কথা কেউ জেনেছে কিনা এরা জানে না। একদিন বিমানের ল্যাজের দিকে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া একটা ট্রানজিস্টার রেডিও পাওয়া গেল। ছজনের একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অনেক কসরৎ করে রেডিও চালু করে পর পর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হঠাৎ শোনা গেল- ভয়ানক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য আন্দিজ পাহাড়শ্রেণীতে ভেঙে পড়া চিলির বিমান সন্ধানের চেষ্টা আগামী গ্রীষ্ম পর্যন্ত বন্ধ রাখা হল। তবে এই সময়টা আন্দিজে ঘন ঘন তুষারঝঞ্ঝার কারণে বিমানটি তুষারে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যাওয়ার কথা। যাত্রীদের কারও বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও কম।’
তাপসের বোনও রুদ্ধশ্বাস শ্রোতা। তারই মধ্যে একবার দাদার মুখে আরেকবার বন্ধুর মুখে অন্যমনস্ক চেয়ে থাকছে।
‘মেয়েটার কী হল?’ সরস্বতীর গলায় চাপা উদ্বেগ।
‘একাত্তর দিন মৃত্যুর সঙ্গে সম্ভব-অসম্ভব সবরকম লড়াই চালিয়ে শেষপর্যন্ত চারজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে পেরুর রাজধানী লিমায় ফিরিয়ে আনা হয়। ওই মেয়েটি সেই চারজনের একজন। ছজন সুস্থ পুরুষের তিনজনই মারা গিয়েছিল। শেষ জন শেষ নিশ্বাস নিয়েছিল উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার আসবার ঠিক আগের মুহূর্তে। ওই সাতজনের খাদ্য কী ছিল ভাবতে পারেন? সহযাত্রীদের মৃতদেহের মাংস, তুষারের তলা থেকে বের করে রোদে পুড়িয়ে তাদের খেতে হত। কখনও প্লেনেরই ভাঙা একটা টুকরো দিয়ে মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করা হত। কতক্ষণ সূর্যের দেখা পাওয়া যাবে সেটাই তখন প্রত্যেকের জীবনের একমাত্র প্রতীক্ষা।’
‘মেয়েটার কী হল?’ সরস্বতীর একই প্রশ্ন।
‘অনেকদিন পর তিনজনের একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হল।’
এর ছ-বছর পর সরস্বতী-তাপসের বিয়ের বাহাত্তর ঘন্টা আগে সরস্বতী তাপসের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ নামিয়ে রেখে বলল, ‘অনেক ভাবলাম, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। ছ-বছর ধরে কথাটা বলতে পারিনি। এখন না বললেই নয়।’
‘আবার নতুন কী হল?’
‘নতুন না, পুরনো।’
‘আন্দিজ পাহাড়ে বিমান ভেঙে পড়ার সেই সাংঘাতিক দুর্ঘটনার কথা বলেছিলাম মনে আছে?’
‘তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? তাছাড়া আমার এটা দুর্ঘটনা নয়,’ সে মুখ তুলে তীব্র স্বরে বলল, ‘আই হ্যাড নো হেড ইনজুরি। আই ওয়াজ রেপড।’
‘তোমাদের মন্থরোর মাকে তোমার মনে আছে তো? তোমার ওই দুর্ঘটনার দিন-কয়েক পর টানা ক’দিন কলেজে যাচ্ছ না- রুমকি মানে অনসূয়ার কাছে জেনে আমি তোমাদের বাড়ি যাচ্ছিলাম তোমাকে ই এইচ কার-এর ইতিহাসের একটা দর্শন পড়তে দেব বলে, তোমাদের বাসস্টপ চিনতে না পেরে আরও পাঁচ-ছটা স্টপ পরে গিয়ে নেমেছিলাম। ঠিক করলাম হেঁটেই ফিরব। এক জায়গায় দেখি একটা বুড়ি রাস্তার অনেক নীচে বাদা অঞ্চল থেকে মুখে কী একটা বিলাপ করতে করতে উঠে আসছে। কাছে আসতে কানে এল- ‘ও মা সরো, ওমা সরস্বতী। কে তোর এ সব্বোনাশ করল রে?’ একবার এই বিলাপ, আর পরের মুহূর্তেই অদৃশ্য সেই শয়তানের উদ্দেশে অশ্রাব্য সব খিস্তি, গালিগালাজ। মাথা নেড়ে ঘাড় দুলিয়ে মুখ যতটা পারে তুলে রাস্তার ধুলোয় পৃথিবীর হাওয়ায় সে ছড়িয়ে দিতে চাইছিল তার রাগ, দুঃখ, ঘৃণা।
মনে সমবেদনা নিয়ে ওর সঙ্গে আলাপ করতেই বুক উজাড় করে সে আমাকে অনেক কথা বলল। বালিসোনা গ্রামের মানুষ কী করে এমন শয়তানের কাজ করল সে ভেবে পায় না। মন্থরোর মা তিন পুরুষ এই বালিসোনার আলো-বাতাস নিচ্ছে। এখানকার অনেকেই পুরুষানুক্রমে তোমাদের বাড়ির নুন খেয়েছে, সবই বলল। সে আমাকে বাদায় নিয়ে গিয়ে জায়গাটাও দেখিয়েছে, হয়তো আমার কাছে প্রতিকারের আশায়। মানুষটা এমনিতেই তো কোমর ভেঙে মাটির সঙ্গে প্রায় সমতলে হাঁটে। এক হাতে লাঠিতে ভর দিয়ে আরেক হাত একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে একবার সামনের দিকে আকাশে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেখায়- ‘হুই দিকে শাড়ি, হুই দিকে বেলাউজ, হুই দিকে শ্যায়া-’
‘প্রথমে যন্ত্রণায় আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর নিজেকে, আর তোমাকেও, কিছুদিন সময় দিয়ে রুমকিকে নিয়ে তোমার কাছে গিয়েছিলাম। তার আগে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে বড় বড় দুর্বিষহ অনেকগুলো দুর্ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত পড়ে আন্দিজের বিমান দুর্ঘটনা বেছে নিয়েছিলাম।’
সরস্বতী প্রায় যেন হৃদপিণ্ড গলায় নিয়ে শুনছিল, শেষটা শুনে তার মন আরও স্তব্ধ হয়ে গেল। সে নির্বাক, দুচোখ বেয়ে শুধু জল নামছে।
তাপস বেশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘মন্থরোর মা হয়তো আজও অদৃশ্য শয়তানদের উদ্দেশে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে। এর অনেক শব্দই আমার অজানা, শুনিনি কখনও, তার মধ্যে একটা কথা এখনও মনে আছে। বেজম্মার বিছে। বেজম্মা জানি, কিন্তু বেজম্মার বিছে শুনিনি বা পড়িনি কোথাও। বলল বাদায় নাকি প্রায়ই যায়। গিমেশাক, ঢেঁকিশাক, শুশনি, আমরুল, ধুলো, ব্রাহ্মীশাক যখন যা হয়, তুলতে যেতে হয়। যুক্তিফুল বলে একটা ফুলের কথাও বলেছিল। আমি নিজেকে খানিকটা সামলে নেবার পর নামগুলো মনে করে করে লিখে রাখি। এর মধ্যেও হয়তো ইতিহাসের আঁকিবুঁকি আছে।’
চোখের জল মুছে সরস্বতী বলল, ‘মন্থরোর মা যে-শয়তানদের উদ্দেশে শাপশাপান্ত করত সেই দুজনকেই পরদিন ভোরে বাদায় গাবগাছের ডালে গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় ঝুলতে দেখা গেছে। গ্রামের একপাতার পত্রিকায় লিখেছিল দুজনকেই নাকি আগে গুলি করে মেরে তারপর গলায় দড়ির ফাঁস লাগানো হয়েছে। তবে পুলিশ জোড়া আত্মহত্যা বলেই চালিয়ে দিয়েছে।
‘আসলে আগের দিন গভীর রাতে লাস্ট ট্রেনে আমার মিলিটারি কাকা এসেছিল, সব শুনে, তখনই গিয়ে দুজনকে আর্মিতে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের চাকরি দেবে বলে ভুলিয়ে বাদায় এনে গুলি করে।’
এই অংশ তাপসের সম্পূর্ণ অজানা ছিল। বলল, ‘মন্থরোর মা হয়তো এটা জানে না।’
‘ভোরে শুশনিশাক তুলতে গিয়ে জোড়া শব সে-ই তো প্রথম দ্যাখে। কিন্তু ওরাই যে সেই দুটো শয়তান সেটা জানত না।’
‘জানলে ওর প্রাণ ঠান্ডা হত। ওর বুকের মধ্যে আগুন জ্বলতে দেখেছিলাম। সেবার অবশ্য তোমাদের বাড়িতে আর যাইনি।’
‘মন্থরোর মা আর নেই। একদিন বাদায় শাক তুলতে তুলতে সাপের ছোবলে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। কী আশ্চর্য ব্যাপার দেখো! ওর দুই জোয়ান ছেলেও অনেককাল আগে সাপের কামড়েই মারা গিয়েছিল। আজীবন নিষ্কর্মা মন্থরো আগেই ফকির হয়েছিল, এখন একেবারে একা হয়ে গেল। সত্তর-আশি বছরের বুড়ো মানুষ, মাথায় মুসলমানী জালি টুপি, গলায় ফকিরি মালা, কপাল চাপড়ে কাঁদে আর বলে, ‘আম্মা ভেন্ন কে আমার ক্ষুদার অন্ন জোগাবে।’
বক্তা শ্রোতা দুজনই হেসে ফেলল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন