বিষাদগাথা – ৩০

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

চার বছর এগারো মাস পর এক শনিবার দুপুরে পরীক্ষিৎ বালিসোনায় ফিরল।

মিতার চেহারার দিকে আর তাকানো যায় না। তার সদা-শংকাতুর চোখে পরীক্ষিৎ পড়ন্ত বিকেলেও চোখ রাখতে পারল না- তার বুকের ভেতরটা এক ধাক্কায় শূন্য হয়ে গেছে! বিরাট লম্বা চুল-দাড়িতে প্রায়-অচেনা পরীক্ষিৎকে চিনতে পেরে বা না পেরে মিতাও শুধু চেয়ে রইল।

সেই রাতেই লক্ষ্মী ও নীলাঞ্জনা দুজনে অরণ্যসূর্যের দুহাত ধরে লক্ষ্মীদের বাড়ি যাবার আগে সরোজিনীর সঙ্গে দেখা করতে এসে লম্বা চুল-দাড়ির পরীক্ষিৎকে দেখে বিস্মিত।

‘চিনতে পারোনি, লক্ষ্মীদি? আমি পরীক্ষিৎ।’ অরণ্যকে দেখিয়ে, ‘তোমার ছেলে?’

‘তোকে ঠিকই চিনেছি। তুই-ই অরণ্যকে ভুল ভেবেছিস। ও আমার ছেলে না, নীলাঞ্জনার।’

এবার নীলাঞ্জনাকে, ‘কবে বিয়ে করলে? খবর পাইনি তো।’

‘যে-বছর তুমি বিদেশে গেলে, সেবছর পুজোর পরেই আমার বিয়ে হয়। সামাজিক বিয়ে তো না যে ঘটা করে খবর দেব, গন্ধর্ব বিয়েও না, আমাদের বিয়েটা আরণ্যক বিয়ে। গোধূলি লগ্নে, তখনও আকাশে অস্তগামী সূর্য ছিল।’

‘ছেলের কী নাম রেখেছ?’

উজ্জ্বল চোখে, মুখে গর্বমেশা হাসি ফুটিয়ে নীলাঞ্জনা পরীক্ষিতের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘অরণ্যসূর্য, আমি অরণ্য বলেই ডাকি।’

পরীক্ষিৎ তবু প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি এখন এখানেই থাকো? তোমার প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়নি? তোমার স্বামীও কি এখানেই আছেন, নাকি তিনি লখনউতে?’

সরোজিনীর সংশয় নিমেষে উধাও। সেই এক ভাগ্যচক্র, এক ঘটনাক্রম। সেই একই মুখের আদল। মনে মনে কথাগুলো বলে পরীক্ষিৎকে মুখে বলল, ‘ওরে বাবা, আজই এলি, আজই এত কথা জানতে হবে নাকি? তোকে চিনতে তোর বাবার তো কয়েক মাস লেগেছিল। নিজেকেও দুটো দিন তো দিবি। তাছাড়া জীবনের সব কিছু কি শুধু শুনলেই জানা হয়ে যায় রে, নিজেকেও খুঁজতে হয়।’

অবনীমোহন আর বাড়ি থেকে বেরয় না। রোজই শুধু এক বাটি খই-দুধ খেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়ে। একদিন হাতছানি দিয়ে পরীক্ষিৎকে কাছে ডেকে মৃদু স্বরে বলল, ‘তোর কথাই হয়তো ঠিক। মানুষ আজন্ম হেরেই আছে। শেষ জীবনটাও একবিন্দু আলো জ্বালাতে পারলাম না রে, জীবনের শুরুর মতো শেষটাও লাঞ্ছনাতেই কেটে গেল।’

পরীক্ষিৎ কী বলতে যাচ্ছিল, অবনীমোহন তাকে থামিয়ে বলল, ‘বালিসোনার মানুষের দুঃস্বপ্নের মূলে পৌঁছতে চেয়েছিলাম, এখন তো জীবনটাই একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।’

সরোজিনী কাছে এসে বলল, ‘চুপ করো। এক হার-জিতে যুদ্ধ শেষ হয় নাকি? আমি নতুন সেনাবাহিনী তৈরি করছি না? এবার নতুন যুদ্ধ শুরু হবে।’

জাহাঙ্গীরের উদ্যোগে অম্বরীশের রুটি কারখানা অনেক দিন পর আবার চালু হলেও পরীক্ষিৎ ও মিতার হয়ে পরিচালনা করতে হয় লিওনকে। পরীক্ষিৎ তার সঙ্গে কয়েকদিন কারখানায় যাতায়াত করার পর কারখানার সব শ্রমিক কর্মচারীদের সমবায় সমিতি গড়ে তাদের হাতেই কারখানার ভার তুলে দিল।

দুটি শর্তও দেওয়া হয়েছে, লিওন যেমন বাজারের অর্ধেক দামে মিষ্টি তুলসি সরবরাহ করত, তেমনই করে যাবে, কারখানাকেও তেমনই প্রয়াত শিবকৃষ্ণের স্কুলে আগের মতোই সস্তায় নিয়মিত পাউরুটি দিতে হবে।

এদিকে মিতার জন্য শহরের নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট আনা হয়েছে। কেস হিস্ট্রি শুনে ভালো করে রোগী পরীক্ষা করার পর ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে কাগজের মাথায় একটা মেন্টাল হোমের নাম লিখে পরীক্ষিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, এটাই বেটার অপশান।

পরীক্ষিৎ জানে মিতা বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইবে না, সে বলল, ‘সেটা মনে হয় সম্ভব হবে না। দরকার হলে বাড়িতে নার্সের ব্যবস্থা করা যায়।’

‘ডাক্তারের কাজ কি নার্স দিয়ে হয়? আমার পক্ষেও এত দূরে ঘন ঘন আসা তো সম্ভব নয়। হোমে আমার অন্য পেশেন্টও আছে, ওখানে অ্যাডমিশন নিলে আমিও নিয়মিত চেক করতে পারি।’

কথার মাঝখানেই নন্দিনীর ঘর থেকে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেল। জঙ্গলে যেখানে দিবাকরের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানেই গুলিতে ঝাঁঝরা বালিসোনা থানার ‘ন্যায়বান, সুদর্শন’ ও-সির দেহ পড়ে আছে বলে মোহন মউলে খবর এনেছে। চৌধুরীবাড়ির ছোটদের জন্য মাস-পয়লার মধু দিতে এসে মোহন অনেকবার ও-সিকে নন্দিনীর ঘরের নীচের বাগানে বেড়াতে বেড়াতে নন্দিনীর সঙ্গে গল্প করতে দেখেছে। ও-সি যে ন্যায়বান সেকথা মোহনের চেয়ে বেশি আর কে জানে! একবার এক কনস্টেবল ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায়ের চেষ্টা করছিল, তার হাত থেকে এই ও-সিই তাকে বাঁচিয়েছিল। আর মানুষটা সুদর্শন তো বটেই। চোখের জল কিছুতেই থামাতে না পেরে সে কান্নার সঙ্গেই চেঁচাতে লাগল, ‘মা গো, ও মাগো, অমন ন্যায়বান, সুদর্শন মানুষটা রক্তের নদীতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। শার্টের পিঠে পাঁচটা রক্তের গর্ত দেখে এলাম গো!’

পরীক্ষিতের নুতন নতুন ‘বিষাদগাথা’ মানুষের মনে ক্রমশ আরও প্রবল হয়ে তরঙ্গ তোলে। রবিবারের গানের মিছিলও ততদিনে আরও অনেক বড় আকার পেয়েছে। খবরের কাগজে বেশ কয়েকবার সচিত্র প্রতিবেদন বেরবার ফলে বালিসোনার বাইরের মানুষও এসে ভিড় করছে। তাদেরও কেউ কেউ মিছিলে পা মেলায়, কেউ কেউ গানে গলা মেলায়।

ঠিক হয়েছে এক রবিবার গানের মিছিলে ‘বিষাদগাথা’র বেশ কিছু বাছাই পংক্তি বড় হরফে লিখে একশো প্ল্যাকার্ড বানিয়ে হাতে হাতে বয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, পাঁচদিন ধরে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা দিন-রাত তাই নিয়ে মেতে আছে। রবিবার ভোর থেকে রাসমাঠে গানের মিছিলে গলা মেলাবার মানুষজন ভিড় করে আসতে শুরু করেছে, হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড উঠে যাচ্ছে, পদযাত্রীদের সারি রাসমাঠের এমাথা থেকে ওমাথা ছাড়িয়ে রাস্তায় অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, সমবেত কণ্ঠে শুরুর গান দিয়ে মিছিল চলতে শুরু করেছে, হঠাৎ পরপর উনিশটি আধা-সামরিক বাহিনীর ট্রাক রাসমাঠে ঢুকতে লাগল। সঙ্গে প্রচুর পুলিশের গাড়িও আসছে। একেকটা ট্রাক মাঠে ঢোকা মাত্র মেশিনগান হাতে সৈনিকরা লাফিয়ে নেমে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা ট্রাক থেকে তাঁবুর সাজসরঞ্জাম নামিয়ে সৈনিকরা তখনই মাঠের মধ্যে তাঁবু খাটাতে লাগল।

সংগীতমিছিল প্রথমে যতটা সম্ভব এক ধার দিয়ে এগোবার চেষ্টা করেও ক্রমশ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল। লক্ষ্মী লিওন পরীক্ষিৎ সরোজিনী সরস্বতী তাপস ও প্রথম কয়েক সারির আরও কিছু বিশিষ্ট মানুষ এক আর্মি অফিসারের কাছে জানতে চাইল- এভাবে হঠাৎ শান্তিপূর্ণ সংগীত-মিছিলের ওপর আর্মির অ্যাগ্রেসানের মানে কী?

অফিসার বুঝিয়ে বলল, ‘দিস ইজ নট অ্যান এনক্রোচমেন্ট অন ইওর মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। অ্যাকসেপ্ট আস অ্যাজ ইয়োর ফ্রেন্ডস। দিস ইজ আ ওয়ার এগেনস্ট জাঙ্গল টেররিস্ট। দে আর ভেরি ক্লোজ টু দিস ফেস্টিভ্যাল গ্রাউন্ড।’

রাসমাঠ থেকে না বেরনো পর্যন্ত মিছিল মিলিটারি ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা বাঁচিয়ে খুব ধীর গতিতে এগোতে লাগল। সমবেত কণ্ঠের গানে সকালের আকাশ বাতাস ভরপুর, এরই মধ্যে মিছিলের মধ্যে থেকে তিনটে ছেলে ও একটা মেয়েকে পিঠে মেশিনগান ঠেকিয়ে মাথার ওপর দুহাত তোলা অবস্থায় সেনাবাহিনীর কয়েকজন বের করে এনে ঘিরে ফেলল। প্রত্যেকের হাতে মেশিনগান তাক করা। হঠাৎই বিদ্যুৎ গতিতে তিনজনের দুই যুবক কুংফুর মতো শরীরের চরকিবাজি করে রিভলবার থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মাটি ঘেঁসে পালাবার চেষ্টা করতে গেল, অন্য ছেলেটি ও মেয়েটিও একই কায়দায় উল্টো দিক দিয়ে দৌড় লাগাল। সেই চারজন ছাড়াও, ছত্রখান মিছিলের আরও ন’জন নিরীহ তরুণ সশস্ত্রবাহিনীর গুলিতে লুটিয়ে পড়ল। ধরা পড়া চারজনের এলোপাথারি গুলিতে তিনজন সেনার সঙ্গে সাতজন গানের তরুণ-তরুণী ও দুজন বালক-বালিকাও মারা গেল।

পরীক্ষিৎ হাঁটুতে গুলির ক্ষত নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত উন্মত্ত মানুষের ভিড়ে একবার সেনাপ্রধানের খোঁজে, একবার জঙ্গলের বিপ্লবীদের নেতার খোঁজে দৌড়োয়। চেনা-জানা যারা হারিয়ে গেছে, তাদের খোঁজে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে, যারা লুটিয়ে পড়ে কাৎরাচ্ছে তাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে। নীলাঞ্জনা সরোজিনী লক্ষ্মী সরস্বতীকে খোঁজে, তার ছেলে অরণ্যসূর্যের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকে।

কারও কাঁধে চড়বে না বলে, শেষ পর্যন্ত পায়ে হাঁটিয়ে পরীক্ষিৎকে হাসপাতালের নিয়ে যাওয়া হল।

শেষবেলায় সরোজিনীকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবনীমোহন জিজ্ঞেস করল, ‘রাসমাঠে কি আজ কোনও উৎসব হচ্ছে? অনেক পটকার আওয়াজ শুনলাম!’

সরোজিনী আঁচলে হাত-মুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘পটকা কী গো, মেশিনগান-রিভলবারের যুদ্ধ!’

প্রবল উৎকণ্ঠায় অবনী বলল, ‘সে কী! এ কাদের যুদ্ধ?’

‘তোমাদের সেই কপিখেতের যুদ্ধ। তার কি শেষ হয়েছে নাকি? সেই যুদ্ধই আজও চলছে।’

আধাসেনা-বিপ্লবীদের গুলির লড়াইয়ে গানের মিছিলের হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ল। তা সত্ত্বেও পরের রবিবার ভোরে রাসমাঠের খালি অংশে জড়ো হয়ে সকলে নিহতদের উদ্দেশে আকাশে মুখ তুলে করজোড়ে নীরব প্রার্থনা জানাল। তারপর যথারীতি বালিসোনার আকাশ বাতাস সমবেত গানের কথা ও সুরে গমগম করতে লাগল।

তারও দুদিন পরে পরীক্ষিৎকে অ্যাম্বুলেন্সে শুইয়ে বাড়ি আনা হল। মিতার কাছ থেকে চেয়ে এনে অম্বরীশের ক্রাচ-দুটোর ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সরোজিনী আপনমনে বলে উঠল, ‘সেই এক ঘটনাচক্র।’

৩১

সরোজিনীর মাথার চুলে একফালি সাদার পোচ ছাড়া সবটাই কালো, দাঁত অটুট, মেরুদণ্ড সামান্য বেঁকলেও বোঝা যায় না, কিন্তু রাসমাঠে আধাসেনার সঙ্গে বিপ্লবীদের সংঘর্ষের সময় ভীত মানুষের দৌড়োদৌড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার পর থেকে তাঁকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়।

এক রবিবার গানের মিছিল থেকে ফেরার পথে লক্ষ্মীর মেয়ে চিরন্তনী মন দিয়ে দিদিমাকে দেখতে দেখতে বলল, ‘তোমাকে এখন আরও সুন্দর দেখায়, দিম্মা। এবার লর্ড বায়রনের স্টাইলে হাতে একটা ছড়ি নাও, দেখবে সবাই তোমার সব কথা শুনবে।’

‘তুই নিজে সুন্দর। তোর ফাজলামিও সুন্দর।’ বলে সরোজিনীকে হেসে ফেলতে দেখে চিরন্তনী দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘কী অপূর্ব দেখালো গো তোমায়! এবার মঙ্গলমঞ্চে তুমিই কথা বলবে!’

‘মঙ্গলমঞ্চ আসলে তোদের জন্য। পরে তোরাই ওখানে বলবি। এখন তাড়াতাড়ি চ’, পরীক্ষিৎ মিছিলের কথা শোনার জন্য বড় ব্যাকুল হয়ে থাকে রে।’

চিরন্তনীকে তাড়া দিলেও সরোজিনী নিজে খোঁড়া পায়ে দ্রুত হাঁটতে পারে না। অনেক বুঝিয়েও তাকে হাসপাতালে ভরতি করা যায়নি, নিজের নামের হাসপাতালে রোগী হয়ে সে কখনওই যাবে না। তার পায়ের পাতার হাড় ভেঙেছে বলেই মনে হয়, অবনীও তাকে হাসপাতালে অর্থপেডিক সার্জেনকে দেখানোর জন্য বলে রাজি করাতে পারেনি। অগত্যা সে-ই কয়েকদিনের জন্য আর্নিকা ও সিম্ভাইটাম খাওয়ায়।

মিছিলের দৈর্ঘ্য সপ্তায়-সপ্তায় বেড়েই চলেছে, প্ল্যাকার্ডে পরীক্ষিতের বিষাদগাথার টুকরো ছাড়াও তার কবিতার কোনও কোনও অংশও এখন তুলে দেওয়া হচ্ছে, মাঝে মাঝে গান থামিয়ে কবিতার অংশগুলো সমবেত কণ্ঠে আবৃত্তিও করা হচ্ছে। শুনতে শুনতে পরীক্ষিতের চোখে কোনও ভাবান্তর ফোটে না।

একদিন লিওনার্দো সরোজিনীর সঙ্গে এসে পরীক্ষিতের কপালে বটপাতার মতো তার বিরাট হাতের পাতা বুলোতে বুলোতে বলল, ‘তোমার কয়েকটা কবিতা আমি আমার ভাষায় অনুবাদ করবার চেষ্টা করছি। কাজটা কঠিন।’

পরীক্ষিতের দৃষ্টিতে আগ্রহ লক্ষ করে লিওন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, পরীক্ষিৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে ধীরে ধীরে বলল, ‘এক বক্স হোমিওপ্যাথি ওষুধ আর একটা গাড়ি যদি পেতাম- সব ছেড়ে অবনীজ্যাঠাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে আরোগ্য বিলোতাম।’ একটু দম নিয়ে আবার বলল, ‘জানো লিওন, বালিসোনার সবাই কোনও না কোনও অসুখে ভুগছে।’

পরীক্ষিৎ নিচু গলায় বলে চলল, ‘অবনীজ্যাঠা ষোলটা ওষুধে অধিকাংশ রোগ সারিয়ে দিতে পারেন। বারোটা আমাকে শিখিয়েছেন, চারটে বাকি।’

কপালে থেকে লিওনের হাতটা টেনে নিয়ে নিজের হাতের মধ্যে ধরে দু-তিনবার চাপ দিয়ে আবার বলল, ‘তুমি পারবে লিওন। একটা ড্রাইভার সুদ্ধু গাড়ি তুমি জোগাড় করে দাও। টাকার ব্যবস্থা আমরাই করব। ওষুধের দায়িত্বও আমার। অবনীজ্যাঠাকে একবার আসতে বলবে? একেবারে সরে আছেন!’

কথার শেষ পরীক্ষিৎ অনেকক্ষণ ধরে দম নেবার পর ক্লিষ্ট স্বরে বলল, ‘অনেক কষ্ট দেখলাম, মানুষের কষ্ট দূর করার চেয়ে বড় কাজ আর নেই দাদা।’

এতদিন বিকেল হতে না হতেই সরোজিনীর বালসেনার দল চৌধুরীবাড়িতে তাদের লাইব্রেরিতে এসে ভিড় করত, সরোজিনীও তাদের জন্য একেক দিন একেকরকম খাবার নিয়ে বসে সকলের সঙ্গে গানে, গল্পে, বই পড়ার মজায় আনন্দে কাটাত। চৌধুরীবাড়ির ওপর পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর নজরদারির গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে অভিভাবকেরা তাদের ছেলেমেয়েদের আর চৌধুরীবাড়িতে পাঠায় না। বর্তমানে বিপ্লবচিন্তার সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রাক্তন বিপ্লবীদের কেউ কেউ এই সেদিনও সরোজিনী বা পরীক্ষিতের কাছে আসত। তারাও আর আসে না। সরোজিনীই তাদের আসতে নিষেধ করে দিয়েছে। সে জানে তাদের ওপর নিশ্ছিদ্র গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। পরীক্ষিৎ কোন কোন দেশে কোথায় কোথায় কাদের কাছে কেন গিয়েছিল তার সব তথ্য জানতে চায় তারা। এ জন্য গোয়েন্দারা জাহাজ কোম্পানিতে, বিমান সংস্থায় যাদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহের চেষ্টা করছে তাদেরই একজন, দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়, গোপনে সরোজিনীকে এসব কথা জানিয়ে গেছে। মঙ্গলমঞ্চ কারা চালায়, এর পিছনে কে, জাঙ্গল-টেররিস্টরাও এর মধ্যে আছে কি না, নানা সূত্র থেকে জানবার জন্য গোয়েন্দারা মরিয়া।

বকুলবেদির কামরাঙাপাগল শীত গ্রীষ্ম বারো মাস বেদির চারপাশে সারা দিন শুধু ঠোঁট নেড়ে মুখের ভঙ্গিতে নেচে কুঁদে নীরবে কথা বলে যায়, চৌধুরীবাড়িতে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেখলে শুধু তখনই তার সামনে লাফ দিয়ে পড়ে চোখ ঘুরিয়ে চিৎকার করে ওঠে- ‘খবরদার! ঠাকুররে কামরাঙা না দিয়ি ঠাকুরবাড়ি ঢুকতি পাবা না!’ আগন্তুক ভয় পেয়ে গেলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, ‘ঠাকুররে কামরাঙা না দিলি কি চলে রে পাগলা!’ তারপরই হুংকার- ‘নাম কী? আসছ কোত্থেকে?’

পাগলের লম্ভঝম্ভ হুংকারে ভয় না পেলে বলবে, ‘কে হে তুমি? কৃছিজীবি, না মচ্ছজীবি, না বুদ্ধিজীবি, না বন্দুকজীবি, না বিছুটিজীবি?’

‘সোমবারউলি বুড়ি’ সত্তর বছর ধরে প্রতি সোমবার চৌধুরীবাড়ির দরজা থেকে এক মুঠো চাল আর তিনটে আলু নিয়ে যায়, শেষ ক’বছর একটা করে মিষ্টি রুটিও দেওয়া হচ্ছিল। কামরাঙাপাগলের হুংকার শুনে সেই যে একদিন ভয় পেয়ে চলে গেল, তারপর থেকে আর সে ভিক্ষে নিতে আসে না।

একদিন দুপুরে পাগলের তর্জনগর্জনের সঙ্গে মেয়ে কণ্ঠের হাউমাউ কান্না শুনে ভণ্ডুল বেরিয়ে এসে দেখল দরজার সামনেই মাঝবয়সি এক বিধবাকে কামরাঙাপাগল লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ভয় দেখাচ্ছে, আর ধমকে চেঁচিয়ে বলছে, ‘নাম কী? ঘর কোথায়? কামরাঙা না দিলি ভেতরে যেতি পারবা না!’

ভণ্ডুলকে দেখে তারই পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিধবা জানাল উদ্বাস্তু বালিকা বিদ্যালয় থেকে তার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তিনটে অচেনা ছেলে মেয়েটাকে টেনে-হিঁচড়ে একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেছে। তার মাথার ঠিক নেই, সে প্রথমে এখানেই ছুটে এসেছে, বউরানি নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন। ভণ্ডুল লাফিয়ে পা সরিয়ে নিল। তাকে ভেতরে নিয়ে যাবার আগেই সরোজিনী, নীলাঞ্জনা ও মিতা পরীক্ষিতের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে বসতে দিল। বিধবা চোখের জল অফুরান হওয়া সত্ত্বেও বার বার মোছার চেষ্টা করে মিতাকে দেখে বলল, ‘আপনাগো দয়াতেই নিরুপমা অ্যাৎটা পথ আইতে পারসে, আপনার স্কুলেরই মাইয়া, ওরে আপনারা বাঁচান, মাগো!’

মিতা তার ছাত্রীর নাম শুনে বলে উঠল, ‘নিরুপমা ক্লাস ইলেভেনে পড়ে না? থানায় জানিয়েছেন?’

নীরুপমার বিধবা মা ডাইনে-বাঁয়ে মাথা এত ঝাঁকালো, যে তার চোখের জল ছিটকে মিতার কনুইয়ে এসে লাগল। সে উত্তেজিত হয়ে বিধবার হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, ‘এক্ষুনি চলো, থানায় যাব!’

থানার ডিউটি অফিসার দুষ্কৃতীদের দেখতে ঠিক কীরকম জানতে চায়। লম্বা না বেঁটে, কালো না ফর্সা, কপাল সরু না চওড়া, নাক তীক্ষ্ণ না বোঁচা, চুল বড় বড়, না ঘাসছাঁট, ঘন না পাতলা, কালো না কটা, গোঁফ আছে, না নেই, দাড়ি ফ্রেঞ্চকাট না কামানো, না খোঁচা-খোঁচা, না ছাগলদাড়ি, গালে কপালে কাটা দাগটাগ আছে, না ভদ্র চেহারা, কথা বলছিল বাংলায়, না হিন্দিতে, না তেলুগুতে- তিনজনের বিষয়ে আলাদা আলাদা সব প্রশ্নের উত্তর ভীত শংকিত বিধবা যতটা মনে করতে পারল বলল।

লেখা হয়ে গেলে অফিসার বললেন, ‘দুটোকে তো চিনতে পারছি, আপনাদের অবনীমোহন চৌধুরীর ওপর যারা অত্যাচার করেছিল তাদেরই দুজন। ও কেসটার সব আসামীই তো এখন বেইল-এ, সেটাই সেলিব্রেট করছে আর কী! নিরুপমাদেবীর একটা ফটো দিয়ে যাবেন। এনেছেন নাকি?’

‘সঙ্গে তো নাই, আইজই দিয়া যামু।’

মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দরজায় দরজায় ছুটোছুটি করে, এখানে ওখানে ধরনা দিয়ে মেয়ের সঠিক কোনও খবর পাওয়া গেল না। তৃতীয় বছরের মাঝামাঝি পুলিশ অফিসার জানাল নিরুপমাকে খুব সম্ভব মিডল ইস্টে পাচার করে দেওয়া হয়েছে, এবিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পুলিশের হাতে এসেছে। তবে নিশ্চিত হতে আরও তদন্ত দরকার।

আসামীরা প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস হয়ে গেল।

নিরুপমার মা দীপান্বিতা দেশ ভাগের সময় নিজের স্বামীকে হারিয়েছে, দেশের এক ভাগ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে আরেক ভাগে এসে মেয়েকে হারাল।

গানের মিছিলে এই ঘটনায় গভীর বেদনা ও তীব্র ধিক্কার জানিয়ে লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে হাতে ঘুরতে দেখা গেল। সরোজিনীর নিজের হাতে লেখা আলাদা রকম কোনও কোনও প্ল্যাকার্ড দেখে পথচলতি অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে নিজেও অস্থির। পায়ের ব্যথার জন্য বারণ করা সত্ত্বেও মিছিলের পুরোভাগে হাঁটবেই। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীর চাপে ভুবনমোহনের তেপায়া লাঠি নিতে বাধ্য করা হল তাকে।

পরীক্ষিৎ তার বাবার ক্রাচে ভর দিয়ে কোনওরকমে কয়েক পা গিয়ে আধাসেনার ক্যাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে মিছিলের যাত্রা শুরু দেখল। তারপর সারা রাত জেগে সে তার নতুন বিষাদগাথা লেখায় ডুবে রইল।

মর্মান্তিক নিরুপমা-বৃত্তান্ত এরপর নানা জনের হাতে নানা ভাষায় নানা জায়গায় লেখা হতে লাগল। বালিসোনা থেকে বড় শহর পর্যন্ত সব দোকানে বাজারে স্টেশনে প্রচুর পোস্টারও পড়ল। নিরুপমার অন্তর্ধান রহস্য পুজোর ছুটির আগেই নতুন করে হাইকোর্টে বিচারের জন্য গৃহীত হল।

ছুটির পর কোর্ট খোলার আগেই, দেওয়ালির পরদিন, বিবস্ত্র দীপান্বিতাকে বটবৃক্ষের পিছনে বসে কাঁদতে দেখে ওই বনাঞ্চলের ছাগলের পাল তাদের রোজকার লতাগুল্ভম ছেড়ে কিছুটা দূরে বিচরণ করতে লাগল।

তখন থেকেই চোখের সামনে কুকুরকে ঢিল মারতে দেখলে বা লরির চাকায় বিড়াল চাপা পড়লে বা কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে, সারা দিন এরকম সব কিছুতে ‘এয়া নি মানষের সয়!’ বলা দীপান্বিতার মুদ্রাদোষে দাঁড়িয়ে গেল।

কামরাঙাপাগলের দেখা নেই। তিনদিনের অনুপস্থিতির পর একদিন ভোরে রেললাইনের ধারে মুণ্ডু ও দুহাত কাটা অবস্থায় তার মৃতদেহ পাওয়া গেল। বুকের ওপর একটা সাদা কাগজে লাল রঙে লেখা- পুলিশের চরের উপযুক্ত শাস্তি।

ভোরে জোর কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙেই পরীক্ষিতের মনে হল এ নিশ্চয়ই জাহাঙ্গীর। এবার তার মাথার সব চুল সাদা। চুল সাদা হবার কারণ আর এবারের দিগভ্রষ্ট সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা সে এভাবে শুরু করল- ‘গাঢ় কুয়াশায় সমুদ্রে পথ হারিয়ে জাহাজ একটা জমাট কুয়াশার দ্বীপে গিয়ে ভেড়ে। সেখানে তিন মাস থাকার সময় মাথার সব চুল কুয়াশার মতোই সাদা হয়ে গেল। সেই দ্বীপে দ্রাগো নামে তিন হাজার বছরের প্রাচীন একটা গাছ আছে। গাছের নীচে এক অতিবৃদ্ধ সাধুর মূর্তির সামনে দ্বীপবাসীরা দণ্ডীকাটার মতো শুয়ে পড়ে তাদের জীবনের তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে প্রার্থনা করে। আমি জানতে চেয়েছিলাম আমার জীবনের সবচেয়ে বড় গুণাহ কোনটি? কেউ যেন কানে কানে বলে গেল- লজ্জাবতী-ময়নামতী দুজনকে নিকা করে জাহাজে না নিয়ে যাওয়া আমার সবচেয়ে বড় পাপ। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো কাজ কী? ওদের জন্মান্ধ ভাইকে দৃষ্টিদান। আরও অনেক প্রশ্ন মনে ভিড় করে আসছিল, কিন্তু তিনটির বেশি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। আমি তৃতীয় প্রশ্ন করলাম- আমার ইন্তেকাল কবে?’

‘উত্তর পেলেন?’

‘পেলাম। এই তিন প্রশ্নের উত্তর আরও আগে পেলে জীবনটা আরেকটু সুন্দর করে গড়তে পারতাম।’

পরীক্ষিৎ ব্যথাতুর স্বরে বলল, ‘ওই দ্বীপে আমিও কি যেতে পারি না?’

‘আমার পুরো একটা জীবন লাগল। তোমার জীবনের এখনও অনেক বাকি। দ্যাখো চেষ্টা করে, হয়তো একদিন পারবে। আশ্চর্যের কথা কী জানো, ওটা মূর্তি, না মানুষের ফসিল, বাইরের লোকের পক্ষে বোঝা বড় কঠিন। কুয়াশা মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন চোখে চোখ রেখে বসে থাকতে থাকতে মনে হয় মূর্তির চোখের পাতা হঠাৎ হঠাৎ নড়ে উঠছে। দ্বীপবাসীদের বিশ্বাস, ওটা সাধুর মূর্তি না, স্বয়ং সাধু। তাঁরও বয়েস নাকি গাছটির মতোই আড়াই তিন হাজার বছর!’

সকালে জাহাঙ্গীরকে কোথাও দেখা গেল না। ভোরে কেউ কোনও কড়া নাড়ার শব্দও নাকি শোনেনি।

শীতের শেষে বসন্তের সূচনায় শুভ এসে জানাল সে তার দুই দিদিকে জাহাজে নিয়ে যাবে। জাহাজে তারা রান্নাবান্নার কাজ করবে।

পরীক্ষিৎ জিজ্ঞেস করল, ‘জাহাঙ্গীর এলেন না? তাঁর মত আছে এতে?’

‘জাহাঙ্গীর সাহেব তো গত মাসে সমুদ্রেই মারা গেছেন। তাঁর জাহাজের ব্যবসা তাঁর শিক্ষামতো এখন আমিই দেখি। দিদিদের নিয়ে যাবার কথাও তিনিই আমাকে বলে গেছেন।’

ব্যাগ থেকে কড়ে আঙুলের মতো ছোট্ট একটা শুকনো শেকড় বের করে পরীক্ষিতের হাতে দিয়ে বলল, ‘জাহাঙ্গীর সাহেব এটা আপনার বাবার সমাধিতে পুঁতে দিতে বলেছেন। এর মধ্যেই নাকি তিনি আছেন, পরকালেও তাঁর জাহাজের দোস্তকে পাহারা দেবেন।’

নীলাঞ্জনা সেদিনই সব ব্যবস্থা করতে লেগে গেল। দুই বোনের ডাক্তারি পরীক্ষা, নতুন পোশাকের ব্যবস্থা, দেহ ও গৃহের পরিচ্ছন্নতা শেখানো- সব কিছুতেই মন দিতে হয় তাকে।

একদিন দুজনকে নিয়ে একটা জেনারেল ডায়েরি করাতে থানায়ও যেতে হল। অভিযোগ- কিছুদিন আগে লজ্জাবতী-ময়নামতীকে ভয় দেখিয়ে তাদের নগ্ন ছবি তোলাতে বাধ্য করা হয়েছিল। সে-ছবি কোনও-না-কোনও ভাবে কপি, প্রদর্শন, বিক্রি বা বিতরণ করা হতে পারে বলে তাদের আশংকা।

ডায়েরি লিখতে লিখতে অফিসার বলল, ‘এসব কি কেউ প্রকাশ্যে করে! স্মাগলিংয়ের মতো এও এক গোপন ব্যবসা।’ লেখা শেষ করে সোজা নীলাঞ্জনার চোখে চোখ রেখে যোগ করল, ‘খোঁজ পেলে খবর দেবেন, পুলিশ রেইড করতে যাবে।’

পরীক্ষিতের সঙ্গে নীলাঞ্জনার বিয়ের পর থেকে সমাজতাত্ত্বিক-গবেষক, মহিলার অবৈধ সন্তানের কারণে তার প্রতি পুলিশের ভয় ও সমীহ ভাব অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। থানার পদস্থ পুলিশ অফিসাররা তাকে একটু নিচু চোখেই দ্যাখে। বালিসোনায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে এরকম বিয়ের নামই হয়ে গেছে ‘সন্তানোত্তর বিয়ে’। শিক্ষাদীক্ষাহীন লোকেরা বলে, ‘বাছুরসুদ্দু গোরু নিয়ে গেল!’

নীলাঞ্জনার নিজের সাজসজ্জা সাধারণ, লখনউয়ের শালোয়ার-কামিজের বদলে বালিসোনায় হালকা একরঙা শাড়ি, কিন্তু লজ্জাবতী-ময়নামতীকে সাজিয়েছে তার রুচি ও কল্পনা উজাড় করে। দুই বোনের মুখের ত্বকের তিক্ততা ও কাঠিন্যের ছাপ মুছিয়ে নীলাঞ্জনা তাদের আগেকার প্রাকৃতিক লাবণ্য ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে যেহেতু এ-অঞ্চলের অনেকেই তাদের চেনে, তাই পথে কোনও অশান্তির আশংকায় দুজনেরই আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা।

দুজনকে বসানোও হয়েছে পর্দাঢাকা রিকশায়। শুভ বসেছে পিছনের আলাদা রিকশায়। তারও পিছনে একটা মাতাল ‘ওরে আমার ময়নামতী, আমায় ফেলে চললি কোথায়’ বলে কাঁদতে কাঁদতে রিকশা ধরার বৃথা চেষ্টায় অনেক দূর এসেও তাদের রিকশা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি।

রিকশা আটকাল পুলিশ ব্যারিকেডে। আগের দিনই খবরের কাগজে বেরিয়েছিল- প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থার মদতে সাতজন বিস্ফোরণ-প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসবাদী বালিসোনা, অন্নদাসী, কীর্তনখোলা, সোনাগুঁড়া, বামুনগ্রাম, প্রজাপতিপুর- প্রভৃতি গ্রামে চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকেছে, উদ্দেশ্য শহরের বড় কয়েকটা রেলস্টেশনগুলো উড়িয়ে দেওয়া।

সকাল থেকেই স্টেশন রোডের মুখে রাস্তা আটকে একদল পুলিশ বাস লরি গাড়ি থামিয়ে ভেতরে সন্দেহজনক কেউ আছে কিনা দেখে তবেই যেতে দিচ্ছে। খোলা রিকশা ছেড়ে দিলেও পর্দাঢাকা রিকশার ছাড় নেই। লজ্জাবতীদের রিকশার পর্দা তুলে বোরখা ঢাকা দুজনকে দেখে একজন মেয়ে কনস্টেবল শিমুলগাছের গুঁড়ির আড়ালে নিয়ে গিয়ে বডি সার্চ করে দুজনকেই ভদ্র নিরীহ মুসলমান বলে নিশ্চিত হয়ে ছেড়ে দিল।

৩২

‘মানুষের কুৎসিত মন দেখিলাম, বিবেকহীন সমাজ দেখিলাম, উদাসীন বিচারব্যবস্থা দেখিলাম, আর আমার বাঁচিবার ইচ্ছা নাই। তোমরা আমাকে ক্ষমা করিয়ো।’

বালিশের নীচে চিরকূট রেখে কখন রাতে উঠে গেছে, সরোজিনী টের পায়নি। অনেক রাত অব্দি পায়ের ব্যথায় জেগে শেষ দিকে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল সে।

বকুলশাখা থেকে তাকে ঝুলতে দেখে জীবনে প্রথম সরোজিনী জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

অবনীমোহনের সুদীর্ঘ শেষযাত্রার প্রথমেই সাদা কাপড়ের ওপর খুব বড় বড় করে লেখা তাঁর শেষ কথা ক’টি দুপাশে দুজন পতাকার মতো ধরে বয়ে নিয়ে চলল। শবযাত্রা যত এগোয় তার দৈর্ঘ্যও তত বাড়ে। রাস্তার দুপাশের ভিড় বাড়ে আরও বেশি। বালিসোনার নতুন পুরনো সব চওড়া রাস্তা ঘুরে দিনের শেষে মিছিল এসে থামল রাসমাঠে। সেখানে তার ভাইয়ের পাশে তাকে সমাধি দেওয়া হবে।

তিনদিন পরই রবিবারের সংগীতমিছিল। এসপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখতে লক্ষ্মী-সরস্বতী-নীলাঞ্জনা-লিওনের অনেক অনুরোধেও সরোজিনী রাজি হল না। সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে ভুবনমোহনের তেপায়া লাঠি ভর করে পরীক্ষিৎকে পাশে নিয়ে সে যথারীতি মিছিলের সামনে পরীক্ষিতের মতোই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল। তার পিছনেই লক্ষ্মী-সরস্বতীর হাতে অবনীমোহনের শেষ কথাগুলো লেখা বড় পতাকা। অবনীমোহনের আত্মহত্যার একুশ দিন পরে পরীক্ষিৎ তার বিষাদগাথায় সংগীতমিছিলের সমবেত এই গানকে বজ্রগর্জন ও বেহালার মূর্ছনা বলে উল্লেখ করেছিল।

মিছিল থেকে ফেরার সময় সরোজিনীর পায়ের যন্ত্রণা লুকনো গেল না। বাড়ি ফিরে দেখা গেল ডান পায়ের গোড়ালি থেকে আঙুলের গোড়া পর্যন্ত পুরো পা বেলুনের মতো ফোলা।

হাসপাতালের ডাক্তার এসে পায়ের অবস্থা দেখে অবিলম্বে অপারেশনের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন, কিন্তু সরোজিনী তাতে রাজি না। বালসেনাদের নিয়ে তার আনন্দপাঠ আগের মতোই চলতে লাগল।

পরের রবিবার যেভাবেই হোক সংগীতমিছিলে যাওয়া আটকাতে ভোর-ভোর লক্ষ্মী-সরস্বতী আর নীলাঞ্জনা সরোজিনীর কাছে ছুটে এল। পরীক্ষিৎ আগের বারের মতো এবারও সরোজিনীর কোনও কাজে বাধা দেওয়ার বিপক্ষে।

তিনজনে সরোজিনীর ঘরে ঢুকে দেখল, তখনও তার ঘুম ভাঙেনি। মিছিলের সময় হয়ে যাচ্ছে দেখেও সেদিন তিনজনের কেউ আর মিছিলে গেল না।

পরীক্ষিৎ বেরবার আগে সরোজিনীর যাওয়া না-যাওয়া বিষয়ে জানতে এসে সেও আর সেদিন মিছিলে যাবার উৎসাহ পেল না, পায়ের কাছে বসে তার রাঙাজেঠিমার নরম গোলাপি পাথরে বানানো অদ্ভুত শান্ত মুখের দিকে চেয়ে রইল। তার মনের মধ্যে একটা বিস্ফোরক অনুভূতির সঙ্গে দূরাগত কাগজপোড়া গন্ধও মিশে আছে।

আগের রবিবারে মিছিলে হেঁটে সরোজিনীর পা ফোলার পর থেকে চিরন্তনী রোজই দিদিমার মাথার কাছে, বুকের কাছে শুয়ে বসে অনেক রাত পর্যন্ত তার সঙ্গে গল্প করে। কথা দিদিমাই বলে, বেশির ভাগ সময় সে শুধু মনোযোগী শ্রোতা। কালও সে ঘুমিয়ে পড়বার আগে পর্যন্ত দিদিমা গানের মিছিল নিয়ে অনেক কথা বলছিলেন। তাঁর বিশ্বাস বালিসোনার সব মানুষই একদিন এই গানের মিছিলে শামিল হবে। পুরো বাংলাই একদিন বালিসোনার পথে হাঁটবে, বালিসোনার গান গাইবে। সকালে ডাকাডাকিতে চিরন্তনীর ঘুম ভাঙলেও তার পিঠে রাখা সরোজিনীর হাতে জাগার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না।

ডাক্তার এক মুহূর্ত দেখে বললেন, ‘কষ্ট যা পেয়েছেন- পায়ে, কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণা ওঁকে ছুঁতে পারেনি। ঘুমের মধ্যেই হার্ট ফেল করেছেন! অবনীবাবু চলে যাবার পর হয়তো আর বাঁচতেও চাননি।’

খবর পেয়ে নিরুদ্দেশ নিরুপমার মা দীপান্বিতা এসে ‘এয়া নি মানষের সয়!’ বলে সরোজিনীর পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগল।

তার শেষযাত্রার পুরোভাগে তার বালসেনার দল, তার পিছনে লক্ষ্মীদের আর শিবকৃষ্ণবাবুর স্কুলের ছেলে-মেয়েদের দীর্ঘ মিছিল, তার পিছনে বালিসোনার আবালবৃদ্ধবণিতা। সবার শেষে চৌধুরীরা প্রায় সকলে। হাসপাতালের পাশ দিয়ে মিছিল যাবার সময় ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের অনুরোধে ফুলে-ঢাকা সরোজিনীকে সামনেই বাদামগাছের তলায় নামানো হল। অনেক রোগীও বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। সরোজিনীর মুখটুকু ছাড়া সবটাই ফুলে ছাওয়া, তার ওপরেই হাসপাতালের সবার পুষ্পাঞ্জলি দান শেষ হলে মিছিল আবার নিঃশব্দে এগিয়ে চলল।

সূর্যাস্তের অনেক আগে লক্ষ্মী-নীলাঞ্জনা বালসেনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোর করছে, পরীক্ষিৎ কাছে এসে বলল, ‘এদের ঘরে ফেরাবার দায়িত্ব আমাকে দেবে?’

‘মা’র শেষযাত্রায় শেষ অব্দি থাকবে না?’

‘আমি সইতে পারছি না লক্ষ্মীদি।’ পরীক্ষিতের গলা বুজে আসে।

রাতে বাড়ি ফিরে সকালের কাগজপোড়া গন্ধের উৎসের খোঁজ পাওয়া গেল। রাঁধুনি জানাল পর পর তিনদিন রাত জেগে সুষমা বিদ্যালয়ের বচ্ছরকার উৎসবের জন্য বাতাসা আর নকুলদানা বানিয়ে বাকি রাতটুকু সে রান্নাঘরেই শুয়েছে, গতকালই প্রথম নিজের ঘরে গিয়েছিল। ভোরে উনুনে আঁচ দিতে এসে দ্যাখে ভেতরে তিনটে খাতা একদম পুড়ে গেছে, বাকি একটা খাতা তখনও পুড়ছে। জল ঢেলে আগুন নিভিয়ে আধপোড়া খাতাটা সে শুকোতে দিয়েছে। পরীক্ষিৎ দেখল মলাটে তখনও ‘ঋণী সরোজিনী’ লেখাটা পড়া যায়। ভেতরের পাতার বেশির ভাগ অংশই পুড়ে কালো হয়ে গেছে। মাথার দিকে না-পোড়া লেখারও কোনও লাইন আস্ত নেই। সম্পূর্ণ দগ্ধ তিনটে খাতার দুটোর কালো হয়ে যাওয়া মলাটের একটায় ‘বিরহিনী সরোজিনী’, আরেকটায় শুধু ‘বালিসোনার’ কথাটা কালো পাথরে ছুরির লেখার মতো ফুটে আছে। পরীক্ষিৎ ভাবে রাঙাজ্যাঠাইমা কি তাঁর মৃত্যু আগে থেকেই জানতেন, নাকি এ তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু?

তার আধপোড়া খাতার ভাব-ভাষার ভগ্নাংশগুলি নানাভাবে সাজিয়ে রাতের পর রাত সম্ভাব্য অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করা তার নেশায় দাঁড়িয়ে গেল।

৩৩

অরণ্য কলেজে ভর্তি হবার বছরে নতুন নতুন বন্ধুর সঙ্গে দুটি জ্যান্ত পুতুলও পেল। নীলাঞ্জনার যমজ ছেলে-দুটি পুতুলের মতো আদরে-খেলায় বড় হতে লাগল। এক দশকেই দুভাই সকলের মুখে মুখে হয়ে উঠল রূপকথার লালকমল আর নীলকমল।

তাদের দৌরাত্ম্য আগে থেকে কেউ আঁচ করতে পারে না। দুভাই যখন বাড়ির পিছনের বাগানে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা তন্ময় হয়ে কী ভাবে, তারও নাগাল পায় না কেউ। তাদের চার চোখে কখন কী খেলে বেড়ায় শুধু তারাই জানে। কখনও স্বপ্ন, কখনও দুঃখ, কখনও দুষ্টুমি- না ঘুমনো পর্যন্ত ভাবের আনাগোনা চলতেই থাকে। যত দেখে পরীক্ষিতের মন ততই তার নিজের শৈশবে ফিরে যায়, নীলাঞ্জনার মন শংকায় ভরে ওঠে।

মিতা কিছু দেখেও না, শোনেও না। রেডিওয় চাকরির একটা সময় রোজ ভোরে তাকে গীতাপাঠ করে শোনাতে হত। পুরো ভগ্বদগীতা তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সেই স্মৃতি, সেই স্বর সে ফিরে পেয়েছে। সবসময় পায়চারি করতে করতে সুন্দর কণ্ঠস্বরে গীতাপাঠ করাই এখন তার একমাত্র দিনযাপন।

গত বর্ষাতেও বাদায় দুভাইকে জেলেদের সঙ্গে নৌকো বাইতে দেখা গেছে শুনে মিতা নীলাঞ্জনার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিস ফিস করে বলেছিল- ‘বাদার কুবাতাস ওদের গায়ে লাগতে দিয়ো না তুমি। ও-বাতাস লাগলে পিঠে পাঁচ ক্ষত নিয়ে ওরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বে গো!’

এখন আর কিছুই বলে না। সারা গায়ে-মাথায় পাঁক মাখা দুভাইকে শক্ত হাতে বাহু ধরে টেনে এনে মইনুদ্দিন যখন বাইরের উঠোনে গীতাপাঠরত বউরানিকে পেয়ে নালিশ করল যে বাবুর বাড়ির এই খোকাবাবুরা আমাদের ঘরের ছেলে-পিলেদের সঙ্গে বাদার পাক ঘেটে মাছ ধরছিল, তখনও মিতা এক মুহূর্ত পায়চারি থামায়নি, গীতাপাঠও বন্ধ করেনি।

নীলাঞ্জনা তাদের ধরে দীঘিতে চুবিয়ে আনতে গেল। সেখানেও দুই ভাই মায়ের হাত ছাড়িয়ে এপার-ওপার সাঁতরে দীঘি তোলপাড় করতে লাগল।

রাতে পরীক্ষিৎ লেখা থামিয়ে দেওয়ালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দেখে নীলাঞ্জনা পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে বলল, ‘তুমি জন্মান্তর মানো?’

প্রশ্নটা বুঝতে সময় নিয়ে পরীক্ষিৎ বলল, ‘মানব কি, ওবিষয়ে কিছু জানিই না।’

‘অরণ্য আগের জন্মে কী ছিল, কোথায় ছিল জানি না, এ জন্মে আমার কাছে এসেছে সূর্যাস্তের সময়। হয়তো সেই জন্যই ও সূর্যাস্তের মতো শান্ত।’

‘তোমার তা-ই মনে হয়?’

উত্তর না দিয়ে নীলাঞ্জনা বলে গেল, ‘এই বিচ্ছু-দুটোকে দ্যাখো, সব সময় কালবৈশাখীর মতো, কোন দিকে কী ভাঙবে-চুরবে, তার ফন্দি আঁটছে। নয়তো ঝড়ের আগের মতো থম মেরে আছে।’

পরীক্ষিৎ লিখতে লিখতে মুখ তুলে, নীলাঞ্জনার কথা মন দিয়ে শুনে বলল, ‘প্রত্যেক মানুষই বোধহয় এক-একটা আলাদা ইউনিভার্স।’

‘বাচ্চারা বাদরামো করছে, তার মধ্যে আবার ইউনিভার্সের কী দেখলে? তুমি জানো- লক্ষ্মীদিদের কচি-কচি লাউভরা চারটে লাউগাছে বাড়ির ছাদ ঢেকে গিয়েছিল, পরশু দুপুরে বাঁদর-দুটো গিয়ে ছুরি দিয়ে দুটো গাছের গোড়া কেটে সেখানে মুখ লাগিয়ে নাকি জল তেষ্টা মিটিয়েছে! এত জল বেরিয়েছে যে উঠোন কাদা-কাদা হয়ে গেছে। লিওন এসে না পড়লে হয়তো বাকি গাছ দুটোর গোড়াও কাটত। লিওনকে কী বলেছে জানো? লাউগাছের ওরকম শুকনো লাঠির মতো শরীরে এত জল পোরা আছে দেখে তারা অবাক হয়ে গেছে। বাকি দুটোর গোড়া কেটেও উঠোনে ছোট্ট একটা পুকুর করা যায় কি না সেটা দেখারও খুব ইচ্ছে।’

পরীক্ষিৎ ভাবে, তার বাবা কি তার এই দুই ছেলের মধ্যে ফিরে এল! জন্মান্তর সত্যি আছে কিনা সে জানে না। থাকলে ভালো হত।

শ্রাবণ মাসের পঞ্চমীতে ঝাঁপান উৎসবের দিন একদল বেদে-বেদেনী এসে চৌধুরীবাড়ির দরজায় ‘কই গো, মা কই?’ বলে হাঁক পেড়ে দাঁড়াল। আগের দুবার সরোজিনী এদের তাড়িয়ে দিয়েছিল, এবার সাহস করে তাকেই ডাকল হয়তো।

মনসা পুজো উপলক্ষে বালিসোনায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই ঝাঁপান উৎসবে আশপাশের অনেক জেলার মানুষ এসে ভিড় জমায়। কত্তামায়েদের পরিচিত তেমনই কেউ হয়তো এসেছে মনে করে ভণ্ডুলরা কয়েকজন বাইরে আসতে একটা শক্ত পাকানো চেহারার বেদে এগিয়ে এসে বলল, ‘তোমাদের বাড়িতে শাখামুটি আর তার বউ চামরকষা বাসা বেঁধেছে।’

এক যুবতী আগ বাড়িয়ে জানাল, ‘শাখামুটির ছোবলে যদি বা বাঁচো, চামরকষার এক ছোবলে শরীল নিমেষে নীল হয়ে যাবে। যদি বলো, আমরা ধরে নিয়ে যাই।’

ভণ্ডুল তেড়ে উঠে বলল, ‘তোমরা আগেও বার কতক এসেছিলে না? কত্তামা তাড়িয়ে দিয়েছিলেন!’

মেয়েটা পায়ের কাছ থেকে ঝাঁপি খুলে একটা সাপের লেজ ধরে তুলে সাপের মতোই হিসহিস করে বলল, ‘এই দ্যাখ চামরকষা। তোদের বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে যাই?’ আরেক হাতে আরেকটা সাপ তুলে বলল, ‘এই দ্যাখ শাখামুটি।’

নীলাঞ্জনা-পরীক্ষিতের সঙ্গে লালকমল-নীলকমলও বেরিয়ে এসেছে।

শাখামুটির সারা গায়ে কালো-হলুদ ডোরা, চামরকষার গায়ে হালকা সবুজের সঙ্গে সাদা ডোরা।

পরীক্ষিৎ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কি সাপখেলা দেখাতে এসেছ?’

‘না বাবু, আপনাদের বাড়িতে একজোড়া শাখামুটি-চামরকষা বাসা বেঁধেছে। আমরা ধরে নিয়ে যেতে এসেছি।’

‘বাড়ির কোথায়, তোমরা জানো? কোন ঘরে বলতে পারবে?’

‘না বাবু, ঘরে না, বাগানে।’

কালো-হলুদ, সাদা-সুবজ ডোরা দেখে লালকলম-নীলকমল একসঙ্গে ‘কী সুন্দর’ বলে হাত বাড়াল- ‘আমিও ওরকম লেজ ধরে নাচাব।’

নীলাঞ্জনা লাফিয়ে দুজনের সামনে পড়ে চেঁচিয়ে উঠল- ‘খবর্দার না!’

পরীক্ষিৎ তর্জনী তুলে হাতে ধরা সাপ দুটো দেখিয়ে বলল, ‘ঝাঁপিতে ঢোকাও। যাও, বাগানের সাপ ধরে নিয়ে চলে যাও।’

একজন প্রবীণ বেদে পরীক্ষিতের সামনে এসে বলল, ‘বাড়ির চারপাশ শুঁকে আর কোনও সাপ এখানে আছে কি না আমি বলে দিতে পারি। এখান থেকেই মনে হচ্ছে কাছেই পুকুরপাড়ে একটা তেঁতলে কেউটে সোজা লেজের ওপর ভর দিয়ে উঠে কিছুটা দূরের কাউকে ছোবল মারবার তাল করছে।’ আকাশে মুখ তুলে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে যোগ করল, ‘মনে লাগছে এখানে শঙ্খচূড়ও আছে। দুটোর তো শঙ্খ লেগেছে মনে হচ্ছে। একবার দেখব বাবু?’

শুনে উপস্থিত গ্রামবাসীদের কয়েকজন নতুন গামছা আনতে ঘরমুখো ছুটল। শঙ্খ লাগা সাপের যুগলমূর্তি নতুন গামছায় এসে খেলা করে গেলে সে গামছা নাকি গৃহস্থের সংসারে সৌভাগ্য আনে।

বেদেনী দুহাতের সাপ ঝাঁপিতে পুরতে পুরতে নীলাঞ্জনার উদ্দেশে বলল, ‘সাপধরা তো ভালো, মা, ওদেরও আমি শিখিয়ে দিতে পারি।’

‘তোমাদের কাজ সেরে চলে যাও! আর কখনও এখানে আসবে না।’ বলে দুই ছেলেকে হাত ধরে টেনে নিয়ে নীলাঞ্জনা ভেতরে চলে গেল।

ঘরে ঢুকে দুজনকেই পর পর সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘সুন্দর সুন্দর বলে ঝাঁপ দিচ্ছিলি, সুন্দরের মধ্যে কী মারাত্মক বিষ আছে তোরা জানিস? এখনও আমার সারা গা কাঁপছে!’

অরণ্য জেলা-লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে এসে ভারি ভারি বইগুলো টেবিলে নামিয়ে রেখে পুরো ঘটনাটা শুনল, তারপর দুভাইয়ের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘আমার বুদ্ধি আছে, সাহস নেই, তাই অনেক কিছুই করতে পারি না। তোদের সাহস আছে বুদ্ধি নেই, তাই সব কিছুই করতে যাস।’

পরীক্ষিৎ-নীলাঞ্জনাও তাদের বৃথাই অনেক বোঝাল।

শনিবার নিঝুম দুপুরে স্কুল থেকে ফিরেই দুভাই গোয়ালে ঢুকে অভ্যেসমতো সরাসরি গোরুর বাঁট থেকে দুধ খেতে গিয়ে থেমে গেল। কালো গোরু চোনা ও গোবর ছেড়েই চলেছে, চোখ দুটো ওল্টানো, চেনা হাম্বার বদলে গলা থেকে অদ্ভুত আওয়াজ বের করছে। সবুজ-সাদাডোরা একটা সাপকে গোয়ালের নর্দমার গর্ত দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে নীলকমল লাফিয়ে গিয়ে সাপটার ল্যাজ ধরে হ্যাঁচকা টানে বের করে এনে মাথাটা দেওয়ালে আছড়ে আছড়ে মেরে ফেলল।

‘মা, মা, দ্যাখো; দাদা, দেখে যাও; বাবা দ্যাখো’ বলতে বলতে দুই ভাই তিনজনের খোঁজে খানিক এঘর-ওঘর করল। তাদের না পেয়ে নন্দিনীকে মরা সাপটা দেখাল, তারপর মেঘাবৃতকে দেখাল, অনর্থক মিতার কাছে দেখাতে গেল। তারপর লালকমলের কাঁধে সাপটাকে ঝুলিয়ে ল্যাজটা নিজে ধরে থেকে সবাইকে দেখাতে দেখাতে লক্ষ্মীদের বাড়ির দিকে গেল।

কাঁধে ঝোলানো অত বড় একটা সাপ দেখে লক্ষ্মী চিরন্তনী দুজনেই আঁতকে উঠল। লিওন পুরো বৃত্তান্ত শুনে জিজ্ঞেস করল, ‘গোরুটা বেঁচে আছে, না মরে গেছে?’

‘তা তো আমরা দেখিনি। আমরা তো সাপটাকে মারতেই ব্যস্ত ছিলাম।’

দু-বাড়ির সকলে গোয়ালে গিয়ে দেখল গোরুটা মরে পড়ে আছে। ডান পায়ের খুরের একটু ওপরে যেন খোঁচা লেগে রক্ত শুকিয়ে আছে।

লালকমলের কাঁধে সাপ, মাথাটা তার বুক অব্দি ঝুলে আছে, পিছনে ল্যাজ ধরে আছে নীলকমল- এই দৃশ্য দেখে অরণ্য মাথা ঘুরে পড়ে গেল, নীলাঞ্জনা আঁতকে উঠে চোখ ঢাকল, পরীক্ষিৎ শুধু ধীরে ধীরে পায়চারি করে চলল।

সপ্তাহ না ঘুরতে দুই ভাই পরস্পরের হাত ধরে দুহাত দোলাতে দোলাতে অরণ্যসংলগ্ন রেললাইন ধরে সোনা ব্যাঙ, ঘাস ফড়িং, পাখি, প্রজাপতি, গোসাপ, বনবেড়াল খুঁজতে খুঁজতে হেঁটে বেড়াচ্ছিল, দূরে সিগন্যালে থেমে থাকা একটা ট্রেন দেখে ছুটে এসে শেষ কামরার দুই বাফার দুহাতে জড়িয়ে দুই ভাই ঝুলে পড়ল। একটু পরে হুঁইসেল দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করলে তাদের মন উত্তেজনায় নাচতে লাগল, আজ অনেক দূরে চলে যাবে তারা।

ট্রেন পূর্ণ গতিতে ছুটছে, বাফারের গোলাকার লোহার ঘসায় পাঁজর টাটাচ্ছে, লালকমল-নীলকমল ভয় পেয়ে বাফার ছেড়ে দিতেই লাইনের পাথরের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

বুকের নানা জায়গায় ছড়ে গিয়ে শার্টে রক্তের ছোপ, দুজনেরই চিবুক ফেটে রক্ত পড়ছে, এই অবস্থায় নিজেরা হেঁটে হাসপাতালে চলে এল।

কোথায় কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে- ডাক্তারের এই প্রশ্নের উত্তরে আগাগোড়া সবটাই তারা খুলে বলল। একজনের কোনও অংশ বাদ পড়লে আরেকজন সেটা পূরণ করে দেয়।

ক্ষত পরিষ্কার করে, ওষুধ লাগিয়ে, ইনজেকশন দিয়ে চিবুকে বড় স্টিকার সেঁটে একজন নার্সকে দিয়ে দুজনকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হল।

পুরো বৃত্তান্ত শুনে নীলাঞ্জনা নিজের কপালে একবার মাত্র করাঘাত করে বলে উঠল, ‘পৃথিবীতে তোরা বাঁচতে এসেছিস, না মরতে?’

এক ভাই বলল, ‘সূর্য রোজ কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়, দেখতে ইচ্ছে করে, মা।’

আরেক ভাই বলল, ‘একটা ভূ-গোলক কিনে দাও না, মা।’

‘গ্লোব তো তোদের একটা আছে।’

‘ওটা তো ছোট।’

তিন মাস পর একদিন ভোরে উঠে নীলকমল-লালকমলকে জাগিয়ে নীলাঞ্জনা তাদের সাদা হাফপ্যান্ট, সাদা হাফশার্ট, সাদা মোজা, কেডসের নতুন জুতো দিয়ে বলল, ‘চানটান করে আধঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নাও। একসঙ্গে জলখাবার খেয়ে তোমরা বাবার সঙ্গে বেরবে।’

দুভাইয়ের মনে ফূর্তি। ‘কোথায় যাব মা? বাবা অনেক দূরে নিয়ে যাবে?’

‘রেলগাড়িতে চড়তে হবে। সারা দিন সারা রাত রেলগাড়িতে থাকবে। প্রচুর খাবার দিয়ে দিচ্ছি। তিনবার খেতে হবে তো।’

আনন্দে দুভাই পাঁচশো করে স্কিপিং করে ফেলল। বিছানায় কয়েকবার ডিগবাজিও খেল।

যাত্রার পরিকল্পনা, উদ্যোগ, ব্যবস্থা সবই নীলাঞ্জনার। চিঠিপত্রের যোগাযোগ থেকে শুরু করে রেলে খাবার জন্য মুড়ির মোয়া, তিলের খাঁজা, চিড়েভাজা, চিনির বাতাসা, পরোটা, মোহন ভোগ, সন্দেশ ইত্যাদি গুছিয়ে দেওয়া অব্দি সবই সে-ই করেছে। পরীক্ষিতের দায়িত্ব শুধু আদেশ পালন।

নিজের আসন ছেড়ে এক আসনেই দুভাই একসঙ্গে বসেছে। পরীক্ষিৎ বসেছে মুখোমুখি। গম্ভীর মুখে বাইরের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে আছে। দুভাই পরস্পরের গলা জড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে সব কিছু দেখছে। বড় বড় গাছ, তালগাছের সারি, ফসল ভরা খেত, জলভরা পুকুর-সুদ্দু তাদের পৃথিবীটাও যে অবিরাম পিছনের দিকে চলে যেতে পারে এটা দুজনের কেউই কখনও ভাবতে পারেনি, দেখেও যেন বিশ্বাস হয় না। গাছপালা ঘেরা কতগুলো চালাঘরের ছোট ছোট একেকটা গ্রামও পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে।

দেখতে দেখতে দুজনের চোখে ঘোর লেগে গেল। নীলকমল বাবাকে বলল, ‘আমাদের পৃথিবীটা যে ঘোরে আগে তো এরকম দেখতে পাইনি, বাবা। শুধু বইয়ে পড়েছি।’

‘একদিন এই পৃথিবীর কথা বলব তোমাদের। জাহাজে করে সমুদ্রে ঘুরতে ঘুরতে যেসব দেশ আমি দেখেছি সেসব দেশের কথা তোমাদের বলব। অনেক রকম দেশ, অনেক রকম মানুষ। গায়ের রং, কথা বলার ভাষা, পরনের জামাকাপড়, ঘরবাড়ি, খাবার-দাবার, গান-বাজনা সব দেশে একরকম নয়। অনেক রকম তাদের আচার-অনুষ্ঠান। এমন দেশেও গেছি, যেখানে তখন সারা রাত আকাশে সূর্য ছিল। কোনও কোনও দেশ কয়েক মাস ধরে বরফে ঢাকা, কোনও দেশ মরুভূমির বালিতে ঢাকা, কোনও দেশ জঙ্গলে ঢাকা, সব বলব তোমাদের।’

লালকমল বাবার কথার মধ্যে ডুবে ছিল, বলল, ‘ওইসব দেশে আমরা দুভাই যেতে পারি না? দাদাকেও নিয়ে যেতে পারি না?’

‘বড় হও, আরও বুদ্ধি হোক, বিদ্যা হোক, সাহস বাড়ুক, তখন নিশ্চয়ই যাবে।’

রেলগাড়ির দুলুনিতে দুভাই খুশি।

একসময় নীলকমল দূরের পাহাড়শ্রেণী দেখিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘অতবড়ো পাঁচিল কিসের বাবা? অনেকক্ষণ থেকে দেখা যাচ্ছে। খুব লম্বা।

‘পাঁচিল নয় রে, ওটা পাহাড়। ওই পাহাড়ের কাছেই যাচ্ছি আমরা।’

‘পাহাড়ের ওপারে কি বাঘ সিংহ দৈত্য দানব আছে?’ নীলকমল উঠে এসে বাবার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল।

‘থাকলে কি তোমরা দৈত্যের সঙ্গে লড়তে যাবে নাকি?’

‘অবশ্যই।’ একটুও না ভেবে দুভাই কথাটা বলল একসঙ্গে।

‘দাদার কথাটা মনে রেখো। আগে বুদ্ধি বাড়াও, বিদ্যা বাড়াও, তারপর সাহস দেখিয়ো।’

‘দাদা এল না কেন বাবা?’

টার্মিনাল স্টেশনে ট্রেন থেমেছে, ছেলেদের নিয়ে, জিনিসপত্র নিয়ে নামবার তাড়াহুড়োয় পরীক্ষিৎ নীলকমলের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল।

দুই ভাইকে পাহাড়ের কোলে সৈনিক স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে তার তিনদিন পরে ফিরে আসার সময় দুজনের গালে মাথায় তাদের মায়ের মতো চুমু দিয়ে বলল, ‘দাদার তো সামনে বড় পরীক্ষা, পরীক্ষা দিয়েই আসবে, মাও আসবে। পুজোর ছুটিতে আমি এসে তোমাদের বালিসোনায় নিয়ে যাব।’ পিছনে ফিরে চোখের জল আড়াল করে কিছুটা এগিয়েও জল মুছে ফিরে এসে আবার বলল, ‘যেভাবে তোমরা সাপ মারো, দীঘি পারাপার করো, দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করার কথা ভাবো, লেখাপড়াটা এখানে সেভাবেই করবে। পুরো মন লাগিয়ে।’

‘অবশ্যই’ বলেই নীলকমলের সংযোজন, ‘বাবা, জানো, জানো- চৌকিদার বলেছে, এখানে অনেক ভালুক আছে। মহুয়া খেতে আসে। মহুয়া কী, বাবা?’

লালকমলের কৌতূহল, ‘পাহাড়ের ওপারে কী আছে, বাবা?’

বিষাদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত পিতা আপাতত এই বলে তাদের নিরস্ত করল, ‘ভালো করে লেখাপড়া শিখলে নিজেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, বাবা।’

৩৪

সবে দিন শুরু হয়েছে, বকুলগাছে ও আশপাশের গাছে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, পরীক্ষিৎ অনেক রাত অব্দি লিখে ভোরবেলা শুয়েছে, দরজার কড়া নাড়া শুনে নীলাঞ্জনা এগিয়ে গিয়ে দেখল দরোয়ান দরজা খুলে এক তরুণীর মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ভদ্র, সুশ্রী চেহারা, লালপাড় সাদা শাড়িতে যেন সুন্দরীই মনে হচ্ছে, নীলাঞ্জনা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কার কাছে এসেছ মা?’

‘পরীক্ষিৎ চৌধুরীর সঙ্গে একবার দেখা করব।’

পরীক্ষিৎ নিজেই উঠে এসেছে। কিছুটা দূর থেকে বলে উঠল, ‘তিকান, তুমি?’

‘তিকান আমার মা, আমি পরী। মাকে রেলস্টেশনে বেঞ্চে শুইয়ে রেখে তার ইচ্ছেতেই আমি আপনার কাছে এসেছি। তার তো আসবার ক্ষমতা নেই, আমাকেই বাড়ির রাস্তা বুঝিয়ে দিলেন।’

‘নীলাঞ্জনা, ওকে একটু বসাও, আমি তৈরি হয়ে আসছি।’

‘তুমি কিন্তু রাত থেকে এখনও অব্দি ঘুমোওনি।’

‘ঘুমোবার সময় অনেক পাব। ওকে দেখো।’

হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তিকানের মেয়ের সঙ্গে স্টেশনে গিয়ে পরীক্ষিৎ প্রথমে তিকানের কপালে হাত রাখল, তারপর নাড়ি দেখল, তারপর তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে শুইয়ে দিল।

হাসপাতালে রোজই পরীক্ষিৎ তাকে দেখতে যায়। কোনও কোনও দিন নীলাঞ্জনাও সঙ্গে যায়। একদিন মিতাকেও নিয়ে গিয়েছিল। আশ্চর্যের কথা, মিতা একবার দেখেই বলল, ‘তুমি কীর্তন ভুলে গেছ?’

মৃদু ও মলিন হেসে তিকান বলল, ‘কীর্তনই আমাকে ভুলে গেছে।’

‘পরী তোমার মতোই কীর্তন গায়। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যেও গায়। ও তো আমার সঙ্গে শোয়।’

পরীও কয়েকদিন হাসপাতালে তার মাকে দেখে গেছে।

একদিন হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে পরীক্ষিৎ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার মা এত অসুস্থ হলেন কী করে? এ তো মনে হয় অনেকদিন ধরে ভুগছে।’

‘আমার বাবার জেল হবার পর থেকেই আমাদের অনটন শুরু হয়। অনেকদিনই দুবেলা খাবার জোটেনি। কোথাও কোনও মন্দিরে বা জলসায় কীর্তন থাকলে দুজনে গেয়ে কিছু পেয়েছি, তাই দিয়ে চলেছে কিছুদিন। তারপর আবার যে কে সেই।’

‘তোমার মা-বাবা মন্দিরে থাকতেন না?’

‘বাবা যতদিন ছিলেন আমরা মন্দিরেই থাকতাম। কোথাও তিন মাস, কোথাও ছ’মাস। মা তো একসময় আখড়ায়ও ছিল। বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার পর থেকে কোথাও দু-চার দিনের বেশি থাকতে পারি না। যেখানেই যাই, আমাদের মা-মেয়ের ওপর নানাজনের কুনজর পড়বেই। তাদের উৎপাত থেকে বাঁচতে কোথাও থিতু হতে পারিনি।’

বকুলবেদির কাছে পৌঁছে পরীক্ষিৎ জিজ্ঞেস করল, ‘পুলিশ তোমার বাবাকে ধরল কেন?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানাল, ‘বাবা নাকি একজন জেলভাঙা বিপ্লবী। জেল থেকে পালিয়ে চেহারা পাল্টিয়ে তখনও নাকি বিপ্লবের কাজই করে বেড়াচ্ছিলেন। একদিন ঘোর বর্ষায় সন্ধের মুখে কাঁধ অব্দি চুল, গলায় কণ্ঠী, কপালে তিলক- মন্দিরে মার কাছে আশ্রয় চান। পরে দুজনে কণ্ঠী বদল করে মন্দিরও বদলে ফেলেন। পুলিশের ধারণা আমার বাবা বোষ্টমের ছদ্মবেশে তার আগেকার বিপ্লবী দলকে সংগঠিত করে বেড়াচ্ছিল।’

‘তোমার মা-ই তাকে নিয়ে তোমাকে আমার কাছে আসতে বলেছিলেন?’

‘না না, আপনার কাছে না। বালিসোনায় মায়ের বাবার একটা বাড়ি ছিল, রাজনীতির লোকেরা মাকে আর আমার দাদুকে তাড়িয়ে সেখানে উঁচু বাড়ি করছিল। সেই বাড়িতে যদি ছোট একটা ঘরও পাওয়া যায়, সে চেষ্টা করতেই আমরা এখানে আসি। মা একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাধ্য হয়ে আপনাকে খবর দিতে বললেন। আচ্ছা, আমার মাকে-দাদুকে যারা বাড়ি ছাড়া করল, সেই লোকগুলোর মন কি বিষাক্ত সিসে দিয়ে তৈরি?’

‘তোমার যখন খুব বেশি মন খারাপ হবে, এই বকুলবেদিতে এসে বসো। ওদের কথা আর ভেবো না। লোভের বিষ সিসের চেয়েও মারাত্মক, সেই বিষে মন কালো হয়ে গেলে মানুষের হৃদয় বলে আর কিছু থাকে না রে।’

পরীক্ষিৎ, মিতা, নীলাঞ্জনা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, চিরন্তনী অনেকে মিলে তিকানকে হাসপাতাল থেকে নিতে এসেছে। একটা গাড়িতে মিতা লক্ষ্মী চিরন্তনীর সঙ্গে তিকান; পরী বসেছে অন্যদের সঙ্গে পরীক্ষিতের পাশে, আরেকটা গাড়িতে।

চৌধুরীবাড়িতে সোজা না গিয়ে তিকানের মন জুড়োতে, পরীর মন ভোলাতে কাছে দূরে কয়েকটা ঝুলন দেখানো হল।

বালিসোনার সবচেয়ে বড় ঝুলনযাত্রা হয় রাসমাঠে। ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়, নদী, নৌকো, দোলনা, কলাগাছ, বাঁশগাছ, ঘাসের বুকে গোরুর গাড়ি, গামলার সমুদ্রে আলোজ্বলা জাহাজ, সকলেই মুগ্ধ হয়ে দ্যাখে। এবছর নতুন যোগ হয়েছে পাহাড়ি রাস্তায় দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেন। সরু রেললাইনে তিনকামরার ছোট্ট ট্রেন ব্যাটারিতে চলছে, সামনের কামরার নীচে ব্যাটারি-বাক্স সাঁটা।

চলন্ত রেলগাড়ি দেখতে ভিড়ও হচ্ছে খুব। এই আশ্চর্য রেলের নির্মাতা বালক মেঘাবৃত। অনেকদিন আগে শুধু স্কুলের সুদীপের মুখে টয় ট্রেনের কথা শুনে একার হাতে লাইন সমেত পুরো ট্রেনটাই বানিয়ে সে বাবার ফটোর পিছনে লুকিয়ে রেখেছিল। এবছর লাইন তৈরি করে এই প্রথম সকলের সামনে তার চলন্ত টয় ট্রেন দেখানো হচ্ছে। মহালয়ার ভোরে সে প্রতিবছর লাইন ছাড়া শুধু ট্রেনটা ফটোর সামনে রেখে বাবাকে ছবিতেই প্রণাম করে।

তিকানকে পেয়ে মিতার অসাড় মন আস্তে আস্তে সাড় ফিরে পেল। সে নিজের হাতে তিকানকে দুবেলা বড় গ্লাস ভরা দুধ খাইয়ে তার গলার আওয়াজ ফিরিয়ে এনে সারাদিনে যখন তখন কীর্তন ফরমাশ করে। গীতার বদলে তার নতুন নেশা তিকানের গভীর গলায় কীর্তন গান। কীর্তনে ডুবে থেকে আগের চেয়ে তার কথাবার্তাও ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছে।

একদিন সরোজিনীর প্রিয় পদ ‘না পুড়ায়ো রাধা অঙ্গ, না ভাসায়ো জলে’ গাইতে গাইতে কান্নায় তিকানের গলা বুজে এল, মেয়ে পরী এসে মার চোখের জল মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেও কেঁদে ফেলে তাকে শান্ত করল। সে জানে আজ একুশে শ্রাবণ মার সঙ্গে বাবার কণ্ঠীবদল হয়েছিল।

আজকাল নন্দিনীও কীর্তন শুনতে চলে আসে। তিকানকে কাঁদতে দেখে সেও ফোঁপাতে থাকে।

মিতা দুলে দুলে দুচোখ বুজে শুনছিল, কান্নার শব্দে চোখ মেলে তিনজনকে কাঁদতে দেখে বলল, ‘ভেবো না, মা-মেয়েকে কেঁদে ভাসাবার জন্য এখানে আশ্রয় দিয়েছি। এ বাড়িতে কান্নার অভাব নেই বাছারা। তোমাদের আদর করে ডেকে এনেছি, কীর্তন গেয়ে তার দেনা শোধ করতে হবে। কই, ধরো দেখি ‘আমি যোগিনী হইয়ে যাব সেই দেশে যেথায় নিঠুর হরি। মা গাইবে, না মেয়ে গাইবে?’

‘মার কাছে আমি! মা-ই গাইবে।’ বলে নিজেই গুনগুন করে উঠল ‘দে দে, আমায় সাজায়ে দে গো-’

সকাল দুপুর সন্ধে সবসময় কীর্তন চলতে লাগল। বিশেষ বিশেষ তিথিতে রাতেও কীর্তন শোনা যায়। গানের কোনও কোনও কথায় বা সুরে নন্দিনীর মনের ব্যথা মিশে তার বুকে ঢেউ ওঠে।

দিবাকরের খুনিদের শাস্তি চেয়ে বছরের পর বছর নন্দিনীর প্রার্থনা বিফলে যাবার পর একদিন গান শুনতে শুনতে তোলপাড় হৃদয়ে সে সকলকে লুকিয়ে একাই রেললাইন পার হয়ে জঙ্গলে গেল। পুরো দুদিন জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মাঝে মাঝেই গলা তুলে বলতে লাগল, ‘যারা আমার ঘুমন্ত স্বামীকে আমার পাশ থেকে তুলে এনে খুন করেছে, আমার গর্ভের শিশুসন্তানের জনককে তার সন্তানের মুখ দেখতে দেয়নি, সেই শিশুকে যারা সারা জীবনের জন্য পিতৃহীন করে দিয়েছে, যতদিন না তারা অনুতাপে দগ্ধ হয়ে দয়া মায়া করুণার মর্ম বুঝবে, ততদিন তাদের বেঁচে থাকা যেন যন্ত্রণায় জ্বলে-পুড়ে যায়।’ নাট্টাভিনয়ে মুখস্থ পাঠ বলার মতো নন্দিনী জঙ্গলের নানা জায়গায় একই কথা বলে বেড়ায়।

দ্বিতীয় দিন দ্বিপ্রহরে এক বুড়ি লাঠি ঠুকে ঠুকে নন্দিনীর কাছে এসে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘তুমি কে মা? তুমি এই বনের দেবী?’

‘আমি এসেছি আমার স্বামীর খুনিদের খোঁজে। এখানেই কোথাও তাকে পাঁচ গুলিতে শেষ করে ফেলে রেখেছিল।’

বুড়ি যথাসাধ্য কোমর সোজা করে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘জঙ্গলের ওই জল্লাদরাই তো আমার দুই নাতিকে আজ তেরো দিন ঘর থেকে তুলে এনেছে, গ্রামের কচি-কাঁচাদেরও নাকি ওরা টেনিং দিয়ে জল্লাদ বানায়।’

প্রথমে একটা শেয়ালের সুরেলা ডাক, তারপর একসঙ্গে অনেক শেয়ালের হুক্কাহুয়া শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে একদল পুলিশ এসে দুজনকে ঘিরে ফেলে বলল, ‘আপনি নন্দিনী চৌধুরী?’

‘হ্যাঁ। নন্দিনী বসুচৌধুরী। দিবাকর বসুর খুনিদের খোঁজ পেয়েছেন?’

‘আমাদের সঙ্গে আসুন। আপনার বাড়ির সবাই পাগল হয়ে আছেন।’

নন্দিনী ফেরার পথে এদিক-ওদিক শুকনো পচা পাতায় ছাওয়া মাটি যেখানে যেখানে বেরিয়ে আছে সেইসব জায়গায় চোখ বোলাচ্ছে লক্ষ করে একজন অফিসার বললেন, ‘কিছু কি আপনার পড়ে গেছে? কিছু খুঁজছেন? খোঁজার মতো সময় নেই কিন্তু। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হবে।’

‘এখানে আরও একজনকে পাঁচ গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল ওরা।’

বাড়ি ফিরে বিধ্বস্ত পোশাকেই নন্দিনী সকলের প্রশ্নের একই উত্তর দেয়- ‘দিবাকরের খুনিদের অভিশাপ দিয়ে এলাম। গাছ থেকে গাছে যেভাবে হাওয়া বয়ে যায় সেইভাবে সমস্ত জঙ্গলে আমার অভিশাপ ছড়িয়ে দিয়েছি।’

পরের রবিবার থেকে ভোরে উঠে সেও মেঘাবৃতর সঙ্গে তৈরি হয়ে গানের মিছিলে যায়। সরোজিনীর মৃত্যুর পর মিছিল আরও দীর্ঘ হয়েছে। তিকান-পরীর জন্য পরীক্ষিৎ তার একটা নতুন বিষাদগাথা কিছুটা অদল-বদল করে কীর্তনের রূপ দিয়েছে। কথার টানে, সুরের মায়ায় মিছিলের সেই গান তিকানদের গলা থেকে বালিসোনার অনেকের গলায় বয়ে যায়। মিতাও প্রথমে কীর্তনের টানে এসে পরে নিয়মিত, যত দূর পারে, মিছিলে হাঁটে। লালকমল নীলকমল পুজোর ছুটিতে এসে গাঁটসুদ্দু কয়েকটা বাঁশ কেটে লম্বা লম্বা লাঠি বানিয়ে মহা উৎসাহে ছোটদের রণ-পায়ে হাঁটার নিয়ম শিখিয়ে দেয়। সৈনিক স্কুলের পিছন দিকে আদিবাসী পল্লিতে যেমন দেখেছে সেইমতো রণপার ছোটখাটো একটা মিছিল সাজিয়ে মূল মিছিলের সঙ্গে জুড়ে দেয়। নিদ্দার নাতিও রণ-পা চড়ে গর্বভরে পা ফেলছে।

এরপর থেকে আশপাশের গ্রামের অনেকেই এসে মিছিলে যোগ দিতে এল, কেউ কেউ নিজেদের রণ-পা নিয়েও এসেছে। সরোজিনী পরীক্ষিৎ যে গ্রামে গিয়ে সরস্বতী পুজোর দিন শ্লেট-খড়ি দিয়ে এসেছিল, সেখানকারও কাউকে কাউকে মিছিলে দেখা গেল।

শীতের ভোরের কুয়াশা ফিরে এল। সাদায় ঢাকা সারা পৃথিবী। অদৃশ্য রাস্তায় গানের মিছিলকে কখনও মনে হয় অশরীরী আত্মার গান, কখনও মনে হয় প্রকৃতিরই একটা রূপ। মাঝে মাঝে মিছিলের কেউ কেউ দেখতে পায়- তাদের সামনেই ওই তো সরোজিনী চলেছে, ওই তো অবনীমোহন, ওই চলেছে অম্বরীশ, ওই যাচ্ছে জাহাঙ্গীর, ওই যে শিবকৃষ্ণ, ওই যায় দিবাকর।

মিছিলের জীবিত যাত্রীরা অনেকেই মৃতের উপস্থিতি অনুভব করে। অনেকে বিশ্বাস করে তারা এই মিছিলে আগের মতোই একসঙ্গে চলেছে।

একদিন আরও গাঢ় কুয়াশার ভোরে বাদা-জোড়া টাউনশিপের আকাশচুম্বী কুয়াশা ছিঁড়ে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটগুলোর জানলায়, বারান্দায় একে একে আলো জ্বলে উঠল, মিছিলের গান শুনে বাসিন্দারা কুয়াশা-ঢাকা ঝাপসা মিছিলের রহস্য বুঝতে চায়। মিছিলের স্লোগান শুনতে অভ্যস্ত তারা রবিবারের গানের মিছিলের অর্থ বা উদ্দেশ্য ধরতে না পেরে কেউ কেউ অধৈর্য হয়, কেউ কেউ কৌতূহলী হয়।

নির্বাচনের চারদিন আগে বালিসোনার রাস্তায় রাস্তায় ফ্ল্যাগমার্চ শুরু হওয়ায় সবরকম রাজনৈতিক মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। রাসমাঠও আবার আগের মতো আধা-সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে অর্ধেকটা ঢাকা পড়ল।

গানের মিছিল কোনও রাজনৈতিক দলের মিছিল নয়- একথা কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত সরকারি নিষেধ অমান্য করে, পুলিশ ও আধা-সেনাবাহিনীর অনুরোধ ও হুমকি উপেক্ষা করে ছোট আকারে রবিবার গানের মিছিল বেরল। সকালের দৈর্ঘে্যর ঘাটতি বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে এল, মধ্যাহ্নে মিছিলের চেহারা অনেকক্ষণ ধরে টিভিতে দেখিয়ে এটাকে বালিসোনার দীর্ঘতম সংগীতমিছিল আখ্যা দেওয়া হল। সেই সংবাদে একথাও বার বার বলা হতে লাগল যে লাঠি বা গুলি চালানোর অনুমতি না পাওয়ায় পুলিশ বা আধা-সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে ছিল। মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস বা জলকামান ব্যবহারেও সরকারের সায় মেলেনি।

ভোট গ্রহণের দিন বৃহস্পতিবার বালিসোনা সকাল থেকেই আশ্চর্য শান্ত। বুথে বুথে দীর্ঘ লাইনে সারিবদ্ধ ভোটদাতারা একের পর এক ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসছে।

পাঁচদিন পরে ভোট গণনার দিন ব্যালট বক্সের সিল ভেঙে গণনা শুরুর অল্প পরেই সকলে আশ্চর্য হয়ে দেখল যে অল্প কিছু ভোট শাসকদলের ও বিরোধী দলের প্রার্থীর চিহ্নে পড়লেও বেশিরভাগ ব্যালট পেপারে সব প্রার্থীর নাম ও প্রতীকচিহ্নের পাশেই সীলমোহর দেওয়া। সব বুথের ভোট গণনার শেষে বাতিল ভোটের সংখ্যা শতকরা বিরানব্বইয়ে পৌঁছল।

বালিসোনার তিনটি আসনই শূন্য পড়ে থাকায় এই অঞ্চলের ভোট বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে, না ভোট বাতিল নিষ্প্রয়োজন বিবেচনায় পরে এখানে উপনির্বাচনের তারিখ জানানো হবে তাই নিয়ে গোটা রাজ্যের ফলাফল বিশ্লেষণের ফাঁকে ফাঁকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রাজনীতিবিশেষজ্ঞ নির্বাচন-ভাষ্যকারদের তর্ক-বিতর্ক চলল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন