বিষাদগাথা – ৪০

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

মাঘমাসের শেষে বৃষ্টি হতে দেখে চাষিদের মনে আশা, এবার জমিতে ভালো ফলন হবে। একজন বুড়ো কৃষক নাতির বয়েসী একজনের হাতে নিজের কলকে ধরিয়ে দিয়ে নিজের মনেই বলে উঠল, ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ধন্য রাজার পুণ্য দেশ। খনার বচন কি মিথ্যে হয় রে!’

রবিশস্য উঠে যাবার পর ফাল্গুনের গোড়ায় বেশির ভাগ জমিতে তিল ছড়ানো হল। বালিসোনার বড় দুটি রপ্তানিসংস্থার দালালরা পৌষমাসে চাষিদের ভালোমতো দাদন দিয়ে গেছে। কে কত দাদন ধরাতে পারে তা নিয়ে রেষারেষির শেষ ছিল না। আরবদেশে সাদা তিলের বিরাট বাজার। দীঘির অদূরে সরস্বতীর হাঁসের মতো সাদা নতুন তেতলা বাড়ির আরবি বাসিন্দারা জনে জনে তিলের চাহিদার কথা বলে বেড়াচ্ছে। আরবিদের প্রিয় পদ হোমস-এ তো বেগুন বাটার চেয়ে তিলই বেশি। তাদের দেশে এরকম অনেক পদ ও মিষ্টিতে তিলের আধিক্য।

আরবদেশে মিস্ত্রি-মজুরের চাকরির আশায় নীচের তলার মাদ্রাসায় যারা আরবি শিখতে আসে, তাদেরও সে-দেশের তিলপ্রধান পদ ও মিষ্টির মহিমার কথা বলা হয়।

আগে আরবদেশীয় মাত্র দুয়েকজনকেই বালিসোনায় দেখা যেত, আজকাল তাদের আনাগোনা কেন বাড়ছে তা নিয়ে বর্ষীয়ানদের মনে নানা সংশয়। এভাবে বাড়ি করে তারা এখানে থাকছে কী করে সেটাও তাদের কাছে এক রহস্য। এ রহস্য ভেদ করার দায়িত্ব যাদের সেই পুলিশের বক্তব্য, এরা তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে আসে, যে বাড়িতে তারা থাকছে সেটাও তাদের আত্মীয়দেরই।

ব্যাখ্যা শুনে বিরক্ত এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক অফিসার বললেন, ‘সব জেনেও দে হ্যাভ ক্লোজড দেয়ার আইজ।’

সোমনাথ মণ্ডল বন্দরের শুল্ক বিভাগে সুনামের সঙ্গে চাকরি করে সদ্য অবসর নিয়েছেন, আরবিদের কথায় বললেন, ‘আপনি শুধু আরবদেশীদেরই দেখছেন, উর্দুভাষীদের সংখ্যাও বালিসোনায় কীরকম বেড়ে চলেছে লক্ষ করেননি?’

কর্মজীবনে ব্যাঙ্কের কৃষিঋণ দপ্তরে ছিলেন, সেই অভিজ্ঞতার জের টেনে নিকুঞ্জবাবু বললেন, ‘আরবিভাষী হোক, আর উর্দুভাষী হোক, এই যে সবাইকে নীলচাষের মতো তিলচাষে লাগিয়ে দিল এর ফল কী ভয়ানক হবে ভাবতে পারেন? তিলে-তিলে এরা বালিসোনার সর্বনাশ করে ছাড়বে।’

আসাম ত্রিপুরা আন্দামানে নিজের বেত সংগ্রহের ব্যবসা মার খাওয়ার পর থেকে বিষাদগ্রস্ত সুদেব হাজরা কানের নীচে ঘাড় ও গালের সন্ধিস্থল থেকে ঝুলে থাকা মৌচাকের মতো বহুদিনের পুরনো টিউমার অভ্যেস মতো বাঁহাতে ধরে রেখে নিস্পৃহ স্বরে বলল, ‘সামনের মাসে মুসলমানদের স্তমা সমাবেশ। স্তমা, না ইস্তমা, না ইসমা জানি না, আমার মুরগি খামারের ছেলেরা স্তমা বলেই ছুটি চেয়ে রেখেছে।’

‘মোছলমানদের এই বারো মাসে তের পার্বণের ঠেলায় আমাদের তো ত্রাহি-আল্লা অবস্থা! রমজান, ঈদ, মহরম তো ফি-বছর দেখছি-’

নিকুঞ্জবাবুর কথার মাঝখানে মণ্ডল বলে উঠল, ‘সবেবরাত? সবেবরাত জানেন না?’

‘স্তমা ওগুলোর মতো বার্ষিক পরব না, এ হল গিয়ে মুসলমানদের মহাসমাবেশ। চার বছর পর পর একেকবার একেক জায়গায় হয়।’

স্তমা উপলক্ষে বালিসোনায় রেল, বাস, লরি, দেশি-বিদেশি গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি বোঝাই দেশ-বিদেশের ইসলামধর্মাবলম্বীদের ভিড়ে এখানকার বাতাসের গন্ধই বদলে গেল। রাসমাঠে আগাছায় ঢাকা অসমাপ্ত শপিং মলের এক ফালি জায়গা বাদে সব জায়গার ঘাস ঢেকে খালি বাস লরি গাড়ি, ঘোড়া খুলে নেওয়া শকটের ভিড়। অধিকাংশ গাড়ি ধর্মসমাবেশ যতদিন চলবে ততদিন এখানেই থাকবে।

দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, মিশর, তুর্কি, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই থেকে অনেকে স্তমায় যোগ দিতে বালিসোনায় এসেছে। আরব দেশের আপাদমস্তক ধপধপে সাদা পোশাকের দীর্ঘদেহী পুরুষদের দেখে বালিসোনার মানুষ অবাক চোখে চেয়ে থাকে। প্রথম ক’দিন একেকরকম মুখের আদল দেখে একেক দেশের মানুষকে আলাদা করার প্রতিযোগিতা চলল। সব দেশের মৌলবীরাই সুদর্শন। কালো বা সাদা শ্মশ্রু শোভিত, সাদা বা কালো আলখাল্লায় ঢাকা তাদের সম্ভ্রান্ত চেহারা নিয়ে বালিসোনায় পাড়ায় পাড়ায় নিন্দা-প্রশংসার ঢেউ বয়ে গেল।

রাসমাঠ থেকে আধমাইল এগিয়ে ফসল তুলে নেওয়া বিরাট চাষের খেতে অনুষ্ঠানের আকাশচুম্বী প্যান্ডেল, বহু দূর থেকে দেখা যায়। বাসরাস্তার ধারে বিদেশিদের জন্য অনেকগুলো ডিপ টিউবয়েল বসানো হয়েছে। বড়রাস্তা থেকে প্যান্ডেল পর্যন্ত তিরিশ ফুট চওড়া রাস্তা করা হয়েছে, আগাগোড়া লাল নীল সবুজ কাপড়ের আচ্ছাদনে ঘেরা। রাস্তার দুধারে বড় বড় ইলেক্টিক বাতির নীচে নানা পসরার সারি সারি দোকান। ছুরি কাঁচি রঙিন কাচের বাসন, তুর্কিদের সেরামিকের গাঢ় নীল রঙের বৃত্তাকার সৌভাগ্য-চাকতি, আতর, সুর্মা, নানারকম মেঠাইয়ের দোকানে দোকানে মানুষের ভিড়। অনেক দোকানেই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিনা পয়সায় পানি বা সরবত পানেরও ঢালাও ব্যবস্থা।

প্যান্ডেলে ঢোকার অধিকার শুধু মুসলমানদের। ছোটরাও যাচ্ছে। তাদের সবাইকে শামিকাবাব দেওয়া হচ্ছে। যারা ভেতরে যেতে পারেনি তারা রাস্তায় ভিড় করে চারদিকের মাইক থেকে মৌলবীদের পাঠ শুনছে।

বালিসোনার বড় বড় সব রাস্তায় ভিড় সামলাতে কাছাকাছি তিন থানার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রোজই দিনের শেষে পুলিশদের সঙ্গে রাস্তার এইসব লোককেও কাবাব, মেঠাই, সরবত খাওয়ানো হয়।

প্রায় পক্ষকাল পরে স্তমা শেষ হয়ে গেলে, বালিসোনার সাধারণ মানুষের মনে সরবত-মেঠাইয়ের মধুর স্মৃতি ছাড়াও তাদের আরও একটা বড় পাওনা হয়েছে- মিনি-মাগনায় সাত-সাতটা গভীর জলের নলকূপ!

রাসমাঠে রোজকার প্রাতঃভ্রমণের আড্ডায় সোমনাথ মণ্ডল, নিকুঞ্জ হালদার, অতীশ রায়, দাসগুপ্ত, সেনগুপ্ত, মুখুজ্যে, বাড়ুজ্যে প্রমুখ শিক্ষিত বয়োবৃদ্ধেরা রাসমাঠ জুড়ে বাস-লরি-গাড়ির রাত্রিবাসীদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটানোর দুর্গন্ধে যারপরনাই বিরক্ত।

‘সে-আমলের ভুবন চৌধুরীর কবরটা এখানেই কোথাও না? তার অবস্থাটা ভাবো একবার।’ শশধর আঢ্যির এ-কথার পিঠে অবসর পাওয়া সংস্কৃতের হেড পণ্ডিত নিরাপদ ভটচায বরাবরের মতো পৈতেটা বুড়ো আঙুলে একপাক পেঁচিয়ে রেখে সেই আঙুলেই তর্জনী চেপে বড় একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, ‘তাঁর অবিনশ্বর আত্মা এমন খোশবু সইতে পারলে হয়! নিজের জমিতে নিজের কবরে বারোভূতের মলমূত্র মস্তকধার্য করা কি চাট্টিখানি কথা!’

নিকুঞ্জবাবু বললেন, ‘পণ্ডিতমশাই, মলমূত্র কী বলছেন, এ তো দুনিয়ার ম্লেচ্ছদের গু মাথায় নিয়ে বসে থাকা।’

‘শীট’ থেকে এফিডেফিট করে সেন হওয়া বিনোদ বলল, ‘তোমার আবার সব তাতে বাড়াবাড়ি! গুয়ের আবার ব্রাহ্মণ-ম্লেচ্ছ কী!’

কুঁড়ে কর্মকারের আসল নাম লোকে ভুলে গেছে। চাকুরিজীবনে কুঁড়েমি করে এত বেশি অফিস কামাই করেছিল যে একবার মাসের শেষে সর্বসাকুল্যে ছিয়াশি পয়সা বেতন পেয়েছিল। সেই কুঁড়েও সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে যোগ করল, ‘ভুবন চৌধুরীর সেই ছেলেটা, যে বালিসোনায় খাটা-পায়খানা বন্ধ করেছিল, সেও তো বাপের পাশেই ঠাঁই পেয়েছে!’

৪১

গ্রীষ্মে তিলফুলে রাস্তার দুধার দিগন্ত অবধি সাদা হয়ে উঠেছে। এক রবিবার সংগীতমিছিলের শেষ পর্বে ফুলের সাগরে ঢেউ উঠেছে দেখে আনন্দে গান গাইতে গাইতেই একদল কিশোর-কিশোরী রাস্তা ছেড়ে তিলখেতে নেমে পড়ল। তারা আল ধরে এগিয়ে চলেছে।

নীলাম্বরের মা মিছিলের বাইরে এসে তাদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘ওরে, মেয়েরা, তোরা ফিরে আয়। তিলফুল তুলে মালক্ষ্মীকেও বারো বছর বামুনের ঘরে দাসীর কাজ করতে হয়েছিল, তোরা জানিস না? মেয়েরা, তোরা ফুল ছুঁসনি যেন, বিয়ের আগে একটা তিলফুল ছিঁড়লেও শাপ লাগে, তোরা ফিরে আয়।’

তার গলার স্বরে তার বয়েস এখনও ছাপ ফেলেনি দেখে অনেকেই আশ্চর্য হয়। কথাগুলো মেয়েদের উদ্দেশে বললেও তার আসল লক্ষ্য তাদেরই স্কুলের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী তিস্তা, যেমন গানে, তেমনই লেখাপড়ায়, তেমনই পারিবারিক পরিচয়ে মেয়েটি একটি রত্নবিশেষ। একেই সে মনে মনে তার ভাবী পুত্রবধূ বলে ভেবে রেখেছে।

মেয়েরা তিলফুল নিয়ে তার সতর্কবার্তা কেউ শুনে, কেউ না শুনে ছেলেদের সঙ্গে আনন্দে গাইতে গাইতে তিলখেতের মধ্যে এগিয়ে চলল।

সেদিন গানের মিছিলের শেষে নন্দিনী নীলাম্বরের মাকে বলল, ‘সত্যিই তিলফুল তুললে মেয়েদের শাপ লাগে, দিদি?’

‘ওমা, তুমি লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়োনি? লক্ষ্মী তিলফুল তুলেছিল বলেই ব্রহ্মা তাকে শাপ দিয়েছিল। তাতেই তো মালক্ষ্মীকে বারো বছর অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হয়েছে।’

‘সর্বনাশ! তাহলে আমার কী হবে দিদি?’

‘তাহলে বলি, কোনওদিন তোমায় বলিনি, আজ বলছি, দিবাকরকে ওভাবে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করল শুনেই আমার মনে হয়েছিল তুমি নিশ্চয়ই বিয়ের আগে তিলফুল তুলেছিলে!’

‘আমার দুর্ভাগ্যের কথা না। ওই যে মেয়েরা তিলখেতে ছুটে গেল, ওদের মধ্যে একটা মেয়ের সঙ্গে আমার মেঘাবৃতর বিয়ের কথা হয়ে আছে। সে যদি ফুল ছিঁড়ে থাকে?’

‘কোন মেয়েটা বলো তো?’

‘তোমাদের স্কুলেই পড়ে। তিস্তা।’

পরের রবিবার খুব সকালে রাসমাঠে নেমে এসে পরীক্ষিৎ সংগীতমিছিলের যাত্রা শুরু করিয়ে মিছিল দৃষ্টির বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত বাবার কবরের কাছে বসে রইল। সমবেত কণ্ঠের গান ভেসে এলেও মিছিলের সম্মুখভাগ যখন আর চোখে পড়ে না, তখনও মিছিলের শেষটুকু ধীরে ধীরে রাসমাঠ পার হচ্ছে দেখা গেল। সেইসময়টা পরীক্ষিৎ নিজের মনে কথা বলে চলল। ভোর থেকেই আকাশ খুব মেঘলা দেখে জাহাঙ্গীরও চলে এল। অম্বরীশ নিজের কবরের ওপরে কায়ক্লেশে এসে বসল।

সাদা তিলখেতের মধ্য দিয়ে একমুহূর্তের জন্য পরীক্ষিৎ সাদা শাড়ি পরা রাঙা-জ্যাঠাইমাকে আসতে দেখল। কোথা থেকে আসছিলেন, কোথায় যাচ্ছেন, কিছুই জানা হল না। তাঁর নতুন সেনাবাহিনী গড়ার কাজ এখন দিশেহারা, গতিহারা নিছক একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়নি কি? পরীক্ষিৎ ভাবে, এ তো বড় রঙ্গ- কাজ শেষ না হলেও জীবন শেষ হয়ে যায়! তার নিজেরই বছরের পর বছর সমুদ্রে ঘোরার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসছে, কোথাও কোনও কূল এখনও দেখা গেল না। রাঙা-জ্যাঠাইমাও তার জীবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। দিনের শেষে তাঁকে না দেখে তার বুক মোচড়ায়, দুঃখে মন অসাড় হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে ভেজা চোখে হঠাৎ দেখল, সাদা ফুলে ভরা তিলখেতের হাওয়ায় সাদা আঁচল উড়িয়ে রাঙা-জ্যাঠাইমা বহু দূরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, পরীক্ষিৎ তাঁকে দেখছে, তিনি জানতেও পারছেন না। জানলে একবার অন্তত পরীক্ষিতের দিকে তাকাতেন।

দুপুর গড়িয়ে গেলে ভণ্ডুলরা এসে পরীক্ষিৎকে পাঁজাকোলা করে বাড়ি নিয়ে গেল।

মাঝরাতে জ্বর বাড়লে নীলাঞ্জনা তার মাথায় আইসব্যাগ ধরে। পরদিন সকালে ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে জানালেন- ‘মেজর মেন্টাল শক। তাছাড়া হয়তো কোনও ব্যাপারে সাংঘাতিক ফ্রাসট্রেশনে ভুগছেন।’

ওষুধে জ্বর নামছে না দেখে সন্ধ্যায় অন্য ডাক্তার আনা হল। তাঁর ডায়াগনোসিস- মারাত্মক স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি, একাকীত্বের ক্লান্তি। সেইমতো আরও দুটো ওষুধ বাড়িয়ে দেওয়া হল।

জ্বর নেমে যাবার পর মিতা একটা দুর্গামূর্তি দেখিয়ে পরীক্ষিৎকে জিজ্ঞেস করল, ‘পেতলের দুর্গাঠাকুর তুই কোথায় পেলি রে? তোর জোডের ‘হিসট্রি অফ সিভিলাইজেশন’-এর খণ্ডগুলোর ধুলো ঝাড়তে গিয়ে বইয়ের পিছনে পেলাম।’

পরীক্ষিৎ হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে বলল, ‘পেতলের? বাবা ভেবেছিলেন সোনার। নদী খুঁড়তে খুঁড়তে পেয়েছেন। এটা, আর একটা অজ্ঞাত আমলের স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে বাবার ধারণা হয়েছিল হারানো নদীও খুঁজে পাওয়া যাবে। ঘাটের ধ্বংসাবশেষটাও বাবাকে হাতছানি দিত। ডায়েরিতে এসব লিখে গেছেন। তুমি বলছ ওটা সোনার নয়, পেতলের?’

‘দেখে বুঝতে পারছিস না?’

‘স্যাঁকরাকে দেখিয়ে নিলে হয়।’

পাঁচ পুরুষ ধরে জমিদারবাড়ির সোনা-রুপোর গয়না, থালা-বাটি, ঠাকুরের সিংহাসন বানায় যে স্যাঁকরাবংশ তাদের এখনকার তরুণ বংশধর রাধাবল্লভ দুর্গামূর্তি যাচাই করে এসে জানাল, এটা অনেক আগের আমলের জিনিস। তেইশ ক্যারেট সোনার তৈরি। নদী খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গেছে মানে এ তো এখন সরকারের সম্পত্তি। সেকথা সালংকারে ব্যাখা করে জিজ্ঞেস করল, ‘গলিয়ে ফেলি কত্তাবাবু? জিনিসটা তাহলে আর সরকারের ঘরে যায় না। সোনার দাম দিন দিন যেভাবে বেড়ে চলেছে, আখেরে আপনাদেরই লাভ! আজকাল সোনা ঢেলে বিশেষ কেউ আর তেমন গয়নাগাটিও বানাচ্ছে না।’

পরীক্ষিৎ ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘সরকারের জিনিস গলাবি কী রে! পরিচয়লিপি তৈরি করে দুর্গামূর্তি সরকারকেই দান করে দেব।’

পরীক্ষিতের আত্মঘাতী পিসির দুই ছেলে রাসমাঠ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে শুনে কিছুদিন হল মামার বাড়িতে এসে বসে আছে, তারা দুজন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘এটা তো মামা পেয়েছিল, এতে আমাদের মায়েরও ভাগ আছে।’

এবার একজনের গলা, ‘মার অবর্তমানে তার অংশ তো আমরাই পাব।’ দুজনে আবার একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘তোমরা এটা কাউকে দান করতে পারো না।’

পরীক্ষিৎ, নীলাঞ্জনা, পারমিতা তিনজনই বিরক্ত হয়ে যে যার মতো চুপ করে রইল।

দুই ভাই পরপর তিনজনের মুখ দেখে নিল। এক ভাই বলল, ‘এবার কিন্তু আমরা আমাদের মায়ের সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিতেই এসেছি। আমাদের পাওনা-গণ্ডা নিয়ে তবেই ফিরব।’

অন্য ভাই বলল, ‘রাসমাঠের কীরকম দাম পাওয়া যাবে পরীক্ষিৎ?’

পরীক্ষিৎ ক্লান্ত স্বরে বলে, ‘আমি বেঁচে থাকতে রাসমাঠ বিক্রি হতে দেব না।’

একভাই এবার হেসে ফেলল, ‘জন্মালে মরতে হবে, অমর কে কোথা থাকবে ভাই? তুমি আর কদ্দিন, যা তোমার শরীরের অবস্থা!’

পারমিতা ক্রোধ চেপে বলল, ‘গঙ্গার ধারে তোমাদের পৈতৃক বাড়িতে শুনেছি তোমরা দুভাই চিতার কাঠের ব্যবসা করো, বাড়িতে চ্যালা কাঠ ডাঁই দিয়ে রাখো। বারো মাস তিরিশ দিন, দিন নেই রাত নেই শবযাত্রীরা, চণ্ডালরা এসে কাঠ প্যাঁকাটি নিয়ে যায়। এই করে যারা সংসার চালায় তারা চৌধুরী বাড়ির কে? কেউ না! তোমরা আর এসো না। কিছু টাকা দিয়ে দিচ্ছি, নিয়ে চিরকালের মতো চলে যাও!’

দুভাই একসঙ্গে, ‘কত টাকা?’

পরীক্ষিৎ শ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা কত আশা করো?’

‘কাল রাসমাঠ ঘুরে এসে বলব। স্বর্ণদুর্গার কীরকম ওজন?’

নীলাঞ্জনা কথা না বলবার সংকল্প ভেঙে বলে উঠল, ‘স্বর্ণদুর্গায় তোমাদের কোনও অধিকার নেই। ওতে তোমাদের মা’র কোনও অংশ নেই। আমি পরীক্ষিতের মাথা ধোয়াব, তোমরা বাইরে যাও।’

‘স্বর্ণদুর্গা কত ভরি বললে না তো?’

সেজোভাই আনন্দমোহন দরজার বাইরে আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল, হঠাৎ ঘরে ঢুকে বলল, ‘আমি সব খবর নিয়েছি। তোদের দামড়া ছেলে তিনটেকে চিতার কাঠ শ্মশানে ডেলিভারি দেওয়ার কাজেও লাগিয়েছিস!’

এক ভাই রাগে উন্মত্ত দৃষ্টিতে আনন্দমোহনের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকেও ঠান্ডা মাথায় বলল, ‘এ জায়গাটা আমাদের সতীদাহগঞ্জো হলে আজ রাতেই তোমার ধড় গঙ্গায় ভাসত, মামা। মুণ্ডুটা আমরা পাইকারদের কাছে বেচি, খুলিও কাজে লাগে।’

‘মামা! কে তোদের মামা!’ রাগে কাঁপতে কাঁপতে আনন্দমোহন দারোয়ান ভূধরকে হাঁক পাড়লেন, দরজার দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ভূধর! ভণ্ডুল! এ দুটোকে ঘাড় ধরে বাড়ির বাইরে বার করে দে। একেবারে বালিসোনা পার করে দিয়ে আসবি। দরকার হলে আমাদের দলের ছেলেদের খবর দিবি।’

এক ভাই ভণ্ডুলদের দিকে হাতের তালু তুলে রেখে বলল, ‘তার দরকার নেই মামা। আমরা রাসমাঠ দেখে ফিরে যাচ্ছি। আবার আসব।’

‘খবরদার আর বালিসোনায় কখনও পা দিবি না! দাসপাড়ার প্রমোদ-ছোঁড়ার সঙ্গে তোর মা যেদিন স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল সেদিনই চৌধুরীবাড়ির মুখে চুনকালি দিয়েছিল। তারপর আত্মঘাতী হয়ে আরও এক পোচ কালি লাগাল। এখন তো কাঠপোড়া কালি লাগাচ্ছিস! চিতার কাঠ বেচে খাস, এবার এসেছিস সম্পত্তির ভাগ নিতে! সহোদর বোন না হলে কবেই মেয়েটাকে কুচি কুচি করে কেটে হাতানিয়া- দোয়ানিয়ায় ভাসিয়ে দিতাম! কে রে তোরা? তোদের পদবি আলাদা, গোত্র আলাদা, তোদের বাপ ছিল জোচ্চর রেশন-দোকানদার, রেশনের চাল-চিনি ব্ল্যাক করত, তোরা হলি চিতার চ্যালাকাঠ সাপ্লায়ার!’

‘চিতায় আমরা তুলতেও জানি। ওদের বলে দাও কেউ যেন আমাদের গায়ে হাত না দেয়! রাসমাঠ একচক্কর ঘুরে চলে যাব। এত তড়পালে, তাই বলে যাচ্ছি, এখানে তোমাদের যে দল, ওখানে আমরাও কিন্তু সেই দলই করি।’

‘চোপ! বেরো, বেরো এখান থেকে!’

‘বেরব তো নিশ্চয়ই, আবার আসবও ঠিকই! বলো তো একশো ভাগ শুকনো কিছু কাঠ আগাম পাঠিয়ে দিই। শ্মশানে এই কাঠকে কী বলে জানো তো? বারুদমাখা কাঠ। সামনের ভোটে কিন্তু ভিজে কাঠও ব্ল্যাকে বিকোবে!’

নীলঞ্জনা আর পারমিতা পরীক্ষিৎকে ধরে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মাথা ধুইয়ে দিচ্ছিল, যাতে দেওয়াল ভেদ করেও যম-রাক্ষসের বাগযুদ্ধ জলের শব্দে ঢাকা পড়ে যায়, কিছুতেই পরীক্ষিতের কানে না পৌঁছয়।

মাথা ধোওয়ানো শেষ হবার অল্প পরেই প্রদীপ পরীক্ষিতের খবর নিতে এল। রোজ রাতে সে একবার এসে দেখে যায় পরীক্ষিৎ কতটা সুস্থ হল, কাল তাদের বেরনো হবে কিনা।

ততক্ষণে পরীক্ষিতের ধুম জ্বর ফিরে এসেছে।

তিলখেতেই আবার রাঙা-জ্যাঠাইমার সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। এবার তাকেও দেখেছে। ভরা জ্যোৎস্নায় সাদা তিলফুলের মধ্যে গ্রিক দেবীর মতো সাদা গাউনে আবক্ষ ঢাকা সরোজিনী পরীক্ষিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভেঙে পড়িস না রে। বালিসোনানদী না বাঁচলে বালিসোনা-ও বাঁচবে না। তোর বাবা এখনও মাটি খুঁড়ে চলেছে, নদীর খোঁজ ও একদিন পাবেই।’

পরীক্ষিতের খুব কৌতূহল, সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখন কী করছ রাঙাজেঠি?’

‘আমার অনেক কাজ। চ’ এবার বাড়ি ফিরি। তুই শুয়ে থাকবি, আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেব।’

বাড়ি ফিরে সত্যিই রাঙা-জ্যাঠাইমা তার শিয়রে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বার আগে পরীক্ষিৎ বলল, ‘তুমি যে বেঁচে আছো আমি জানতাম না। আর কখনও চলে যেয়ো না।’

নীলাঞ্জনা পরীক্ষিতের কপালে জলপটি দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, জ্বরের ঘোরে তার ভুলবকার শব্দে জেগে উঠে আইসব্যাগ এনে মাথায় চাপাল।

৪২

সেবছরই প্রথম বালিসোনার রাস্তায় উটের সারি দেখা গেল।

কুরবানি ঈদের কিছু আগে থেকে দরজিদের কাঁচি ধার দেবার দোকানগুলোয় গোরু হালাল করার ছুরিতে শান দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। ঈদের দুদিন আগেই মাঝরাতে রাস্তা জুড়ে গোরুর দীর্ঘ সারি দেখা গেল। সকালের দিকে সাতটা উট যেতে দেখে অনেকেই জানলা দিয়ে ছোটদের দেখাতে লাগল।

ঈদের দিন সকাল থেকে কুরবানির রক্তমাখা নতুন থামি ও গেঞ্জি পরে থালায়, বাটিতে, হাঁড়িতে, গামলায়, ব্যাগে, বস্তায় বড় বড় মাংসের খণ্ড প্রতিবেশীদের বাড়ি-বাড়ি বিলোন শুরু হল। ট্রেনের কামরায় কাঁচা মাংসের থলে থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়তে দেখে হিন্দু যাত্রীরা নাক ঢাকে, মুখ বিকৃত করে। তাদের ক্রুদ্ধ গালিগালাজের মধ্যেই লম্বা-চওড়া চেহারার এক বুড়ি ট্রেন ছাড়বার মুখে একটা মাংসের বস্তা কামরার দরজায় ভিড় করে দাঁড়ানো যাত্রীদের পায়ের কাছে ধপাস করে নামিয়ে দুহাত দিয়ে বস্তাটা ভেতরে ঠেলতে ঠেলতে বলল, ‘চর্বি সব জমে গেছে গো, তোমাদের গায়ে এক ফোঁটা রক্তও লাগবেনি!’

হুইশিল পড়ে গেছে, যাত্রীরা তবু অনড় দেখে বুড়ি অনুনয় করল, ‘সাতটা ইস্টিশন পরেই শহরের দোকানে নাম্যে দে চলে আসব, আমারে একটু তুলে নেন বাবুরা।’

ট্রেন চলতে শুরু করেছে। লম্বা-চওড়া বুড়ি এক গুঁতোয় জায়গা করে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে বস্তাটা কামরায় ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমরা যে দুগ্গাপুজোয় পাঁঠা বলি, মোষ বলির রক্ত মাখো তখন কি মোছলমানরা কিছু বলে?’

দরজায় দাঁড়ানো যাত্রীদের দুজন ছাত্র হাত বাড়িয়ে বুড়িকে সাহায্য করতে ঝুঁকলে বয়স্করা হইহই করে ওঠে।

পিছনের কামরা থেকে উচ্চ রবে সমবেত কণ্ঠের ‘জয় জয় রাম, জয় জয় রাম’ শুনে এ-কামরার অনেকে তালে তালে মাথা নাড়ছিল, সেদিকে ইঙ্গিত করে মাংসের বস্তাওলা বুড়ি দুঃখ করে বলল, ‘রামনামের কামরায় তো পায়ের নাতি উঁচিয়ে দরজা থেকে তেইড়্যে দিল, এখানে তবু যা হোক একটু জায়গা দিলে বাবুরা!’

এক মাঝবয়েসি মহিলা সিটে বসে অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন, পুজোয় বলির কথাটা শুনে পাশের কলেজ ছাত্রীকে বললেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম, স্কুল ছুটির পর হিন্দু-মুসলমান মেয়েরা বাড়ির পথে কিছুটা এগিয়ে দু-দল দুদিকে চলে যাবার সময় আমরা ওদের খ্যাপাবার জন্য মজা করে বলতাম, আল্লা আল্লা করিস তোরা, আল্লা আছে ঘরে? লুঙ্গি টুপি পরে আল্লা ঝিঙে চুরি করে। ওরাও আমাদের দিকে ফিরে বলত, কালী কালী করিস তোরা- তোদের কালী ল্যাংটা, স্বামীর বুকে দু-ঠ্যাং তুলে নাচছে খালি খ্যামটা।’

ছাত্রীটি হেসে ফেলে বলল, ‘এখন তো এরকম ঠাট্টা তামাসা থেকে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে, মাসিমা।’

দুধসাদা দু-তিনতলা বাড়ির বাসিন্দারা গোরু-উটের মাংস তিনভাগ করে একভাগ গরিব-দুঃখীদের (বেশিটাই তিলচাষিদের), আরেক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে বাকি একভাগ নিজেদের প্রয়োজনে রাখে। বেশ কিছুটা মাংস অনেকদিন ধরে রোদে শুকনো হয়। তখন অন্ত্যজ হিন্দুরাও নাকে গামছা চাপা দিয়ে রাস্তা পার হয়।

পরের মাসেই উত্তুরে হিমেল হাওয়া শুরুর বদলে দখনে-বাতাস বইছে দেখে বালিসোনার বয়োবৃদ্ধরা ভয় পেল। পৌষের পর মাঘ শেষ হয়ে এল, মাঝে মকরসংক্রান্তির সময় দিন তিনেকের কনকনে হাওয়া ছাড়া গোটা শীতকালটাই তেমন জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ল না।

পরীক্ষিৎ তার রাঙাজ্যাঠার ওষুধের বাক্স ঘেঁটে চিকেন পক্সের হোমিওপ্যাথি প্রতিষেধকের বড় শিশি বের করে দেখল ভেতরের সব দানা গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে।

দোকান থেকে চার ড্রামের চার শিশি নতুন ওষুধ কিনে সরোজিনীর বালসেনাবাহিনীর ছেলেমেয়েদের দিয়ে আলাদা আলাদা মোড়ক বানিয়ে বালিসোনার দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করল। একাজের মূল দায়িত্ব দেওয়া হল তার স্নেহভাজন, প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর।

শীতঋতু থাকতেই গরম পড়ে যাওয়ায় সাপেরা গর্তের শীতঘুম ছেড়ে উঠে এসেছে। মাঘমাসের কৃষ্ণপক্ষেই সাতজন চাষিকে সাপে কাটার খবর পাওয়া গেল। বৃদ্ধরা গুড়ুক গুড়ুক শব্দে তামাক টানে আর ভাবে এসব নতুন বছরের অশুভ সংকেত নয় তো?

সকাল থেকে বসন্তের ওষুধ বিলির তদারকি সেরে বাড়ির কাছাকাছি এসে পরীক্ষিতের ভুরু কুঁচকে গেল। তাদের গেটের সামনেটা ঢেকে বিরাট একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে।

লালকমল-নীলকমলের সামনে ট্রাক থেকে ভারি ভারি যন্ত্র নামানো হচ্ছে, আর্মির পোশাকে দুজনকে চিনতে খানিকটা সময় নিয়ে পরীক্ষিৎ অজানা শংকায় বলে ওঠল, ‘এসব কী? এ কি কোনও যুদ্ধের প্রস্তুতি?’ বলতে বলতে লালকমল-নীলকমলের দিকে এগিয়ে গিয়ে অদ্ভুত একটা আবেগে দুজনকে একসঙ্গে বুকে টেনে নেয়। ‘এতদিন কোথায় ছিলে? তোমরা কেমন আছো? এখন এলে কোথা থেকে?’- তার প্রশ্নের যেন শেষ নেই।

পরীক্ষিতের চেয়ে মাথায় লম্বা লালকমলের গলার স্বরও বদলে গেছে। বাবার বুক থেকে আলগা হয়ে ভরাট গলায় বলল, ‘ঠাকুরদা নদীর একটা রুট্ম্যাপ করেছিলেন না? ওটা একবার দেখা দরকার। বালিসোনা থেকে সাগরমোহনা মোট পঁয়ষট্টি মাইল।’

নীলকমলও তার বদলে যাওয়া স্বরে যোগ করল, ‘ভারতের সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে দীর্ঘ খাল আমরাই বানাব।’

‘ইন্ডিয়ান আর্মি এই ধরনের কাজ করতে রাজি হবে?’

‘আর্মির সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা দুভাই বালিসোনাকে তার হারানো নদী ফিরিয়ে দেব।’

‘তোমরা আর্মিতে নেই? আর্মির পোশাক কেন তাহলে?’

‘এ তো ওল্ড মিলিটারি গুডসের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। আমরা কিনেছি হিমাচলের একটা দোকান থেকে।’

‘যন্ত্রগুলো কীসের? ওগুলোও কি তোমাদের?’

‘দুটোই জার্মানির তৈরি। রাজস্থানে লুপ্ত নদী সরস্বতীর সন্ধানে এরকম অনেক যন্ত্র ওরা ব্যবহার করে। পুরনো হয়ে গেলে বেচে দেয়। আমরা এই দুটো কিনে নিয়েছি।’

বাড়িতে ঢুকে মৃদুস্বরে কীর্তন শুনে পরীক্ষিৎ উত্তেজনায় চমকে ওঠে। মিতার ঘরে তার সামনে বসে তিকান নয়, পরী গাইছে। পরীর পাশে ছ-সাত বছরের একটা শান্ত চেহারার মেয়ে।

লালকমল-নীলকমল একসঙ্গে ঘরে এসে বলল, ‘ভালো আছো মিতাঠাম্মা?’ লালকমল আলাদা বলল, ‘তোমার কীর্তন শোনার জন্য কেমন পরীকে এনে দিলাম। পরীর মেয়ে শিউলির কচি গলার কীর্তন শুনেও তুমি অবাক হয়ে যাবে।’

‘তিকান এল না কেন?’ পরীক্ষিৎ জড়োসড়ো পরীর দিকে উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে রইল।

দু-ভাই একটা কম্পাস আর একটা দূরবীন কেনার খবর বাবাকে দিতে যাচ্ছিল, তাছাড়া পাহাড়ের নীলা আর চুনিও বাবাকে দেখাতে চায়, বলল, ‘দোল পূর্ণিমায় পাড়ার প্রতিবেশিনীদের সঙ্গে বৃন্দাবনে গিয়ে আর ফেরেনি। অন্যরা সবাই ফিরে এসেছে, তাদের কেউ কেউ বলছে- যমুনায় স্নান করতে গিয়ে তিকান মাসি জোয়ারে ভেসে গেছে।’

পরী গান থামিয়ে মুখ নিচু করে বসে ছিল, এই প্রথম কথা বলল, ‘পাড়ার মাতব্বররা আমাকে মায়ের শ্রাদ্ধ করতে বলেছিল, আমার মন সায় দেয়নি। মা হয়তো পথ হারিয়ে ঘুরে মরছে, একদিন ঠিক ফিরে আসবে। ঠিক আসবে, দেখো তোমরা।’

মিতা বলল, ‘তা-ই যেন হয় রে! মেয়েটা সারাজীবন শুধু দুঃখই পেয়ে গেল।’ শিউলির কপাল থেকে নরম চুলসারি সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধর মা, একটা কীর্তন ধর দেখি।’

পরীর চোখে জল দেখে শিউলি ফোঁপাতে শুরু করেছিল, এবার কেঁদে উঠল।

পরীক্ষিৎ বলল, ‘মেয়েটা পরীর, বুঝতে পারছি। তোমাদের মধ্যে ওর বাবা কে?’

‘ওর বাবাকে কি তুমি দেখেছ? পরীকে এ-বাড়িতে প্রাইভেট পরীক্ষার টিউশান দিতে আসত। শিউলি পেটে আসার খবর শুনেই পালিয়েছে! পালাবে কোথায়!’

পরীক্ষিতের সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে লালকমল নীলকমল অম্বরীশের তৈরি লুপ্ত নদীপ্রবাহের পথচিত্র খুঁজতে খুঁজতে প্রাচীন স্বর্ণমুদ্রাটা দেখতে পেল। লালকমল বলল, ‘আমরা পাথরের প্রাচীন মুদ্রা পেয়েছি বাবা, জেড পাথরের, মোট এগারোটা। হাতির দাঁত বসানো মুকুট-পরা মাথার ছবিওলা সেই মুদ্রা কোথাকার, কার সময়ের, জানতে পারিনি।’

নীলকমল বলে উঠল, ‘জানো বাবা, মুদ্রার কাছেই জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের মধ্যে একটা কাঠের মূর্তি আছে। হয়তো কোনও দেবতার মূর্তি’, থেমে লালকমলের দিকে চেয়ে, ‘বলি, লাল?’

‘না বললে বাবা বুঝবে কী করে?’

‘জানো বাবা, একটা অদ্ভুত ব্যাপার, মূর্তির লিঙ্গটা একহাতের বেশি লম্বা। সেই পাহাড়ে পাথরের মধ্যে আমরা চুনি আর নীলার অনেক পাথর পেয়েছি।’

‘মূর্তিটা হয়তো কোনও আদিবাসীগোষ্ঠীর পৌরাণিক দেবতা। পাথরের মুদ্রাও হয়তো তাদের গোষ্ঠীপতি বা রাজার।’

অম্বরীশের কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে পরীক্ষিৎ বলল, ‘লুপ্তপ্রবাহের পথচিত্র মোহনার অনেক আগে শকুনতলি গ্রামে শেষ হয়ে গেছে। শকুনতলির বাসিন্দারা পুরুষানুক্রমে বিশ্বাস করে আসছে যে এখানেই বালিসোনা-নদীতে লখিন্দরের শবের গন্ধে শকুনির ঝাঁক সারা দিন ধরে আকাশে চরকি কেটেছিল।’

শকুনতলির পরে আরও পাঁচটা গ্রাম ছুঁয়ে সেকালে এই নদী সাগরে গিয়ে মিশত। হারানো নদীর বুকে কালে কালে কোথাও শনিমন্দির হয়েছে, কোথাও চালাঘর তুলে লোকজন বসবাস করছে, কোথাও ডোবা খুঁড়ে, পুকুর কেটে মাছ ধরা চলছে, কোথাও বাজার বসে গেছে, অম্বরীশের করা ম্যাপ থেকে সেগুলো আলাদা করে লিখে নেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে নীলকমল।

চৌধুরীবাড়ির স্যাঁকরা রাধাবল্লভ হুগলি থেকে রত্নপাথর কাটার কারিগর আনিয়ে চুনি ও নীলা পাথরগুলোর উপযুক্ত আকার ও উজ্জ্বলতা আনল। রাধাবল্লভ নিজে সাতটা বিভিন্ন ক্যারেটের চুনি ও তিনটে নীলা কিনে নিল, বাকিগুলোও তার কাছে রইল, যখন যেটা ভালো দাম পাবে, কলকাতার বউবাজারের দোকানে বেচে নিজের কমিশন রেখে লালকমলদের টাকা দিয়ে যাবে। রাধাবল্লভ একসঙ্গে এতগুলো রত্নপাথর দেখে এগুলোর কোনও ইতিহাস জানতে চায়নি, ভেলভেটের হাতখানেক লম্বা থলি ভরে নীলা-চুনি নিয়ে চলে যাবার সময় শুধু বলে গেল, ‘সাতপুরুষ ধরে আপনাদের সেবা করে আসছি কত্তাবাবু, আপনাদের বিশ্বাসই আমাদের মূলধন। ভালো দামই পাবেন আপনারা। এ হল আসল বার্মিজ রুবি, বার্মিজ স্যাফায়ার।’

লালকমল বলল, ‘বর্মার জঙ্গলে আমরা অনেক দিন ছিলাম।’

নীলকমল বলল, ‘নীলা-চুনির মান গোত্র ওজন দাম একটা কাগজে লিখে নাম সই করে আমাদের কাছে রেখে যান, কার্বন কপি আপনি নিয়ে যাবেন।’

বালিসোনা গ্রাম বাদে বাকি আঠেরটি গ্রাম ঘুরে দেখে চাপা পড়া নদীর বুকে চালাঘর, বাজার, মন্দির, সেলুন, চায়ের দোকানের প্রত্যেককে তাদের চাহিদা মতো টাকা বিলি করতে ফাল্গুন শেষ হয়ে গেল। চৈত্র থেকে মাটি খোঁড়ার বড় বড় দুটো যন্ত্র চালু করা হল। দিন রাত কাজের জন্য প্রচুর লোকও লাগানো হয়েছে।

তিন মাস অবিরাম মাটি তোলার পর ঊনত্রিশ জায়গায় মাটি ফুঁড়ে জল চুঁইয়ে উঠতে লাগল। নদীখাত যত মোহনার দিকে এগোয়, তত বেশি জলমুখের সংখ্যা ও পরিধি বাড়ে। শ্রাবণের শেষাশেষি বৃষ্টিতে অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটুজল হলেও ভাদ্রের মাঝামাঝি জল শুকিয়ে গেল। সকলে আশা করেছিল হয়তো মোহনায় জোয়ারের সময় পুরো পঁয়ষট্টি মাইল বা তার অনেকটা জলে ভরে যাবে।

সেই আশাতে লুপ্ত নদীখাতের দুপাড়ে মাটির স্তূপে গ্রামের মানুষ ভাগে ভাগে শাক-সবজির চাষ শুরু করেছে।

প্রদীপও অনেক দিন পর নতুন উৎসাহে খালের দুপাড়ের জন্য ফল ফুল তাল সুপুরি নারকেল গাছের চারা বিলোবার ব্যবস্থা করল। লালকমল-নীলকমলকে পেয়ে প্রদীপ তাদের বোঝায়, ‘পৃথিবীতে তৃতীয় মহাযুদ্ধ কাদের সঙ্গে কাদের হবে জানিস?পরমাণুযুদ্ধের আশংকা আর নেই, এবার বিশ্বযুদ্ধ হবে যারা প্রকৃতি ধ্বংস করে আর যারা প্রকৃতি রক্ষা করে সেই দু-দল মানুষের মধ্যে। মানুষের প্রাণবায়ুর জন্য এই মহাযুদ্ধ বালিসোনায় আমরা শুরু করে দিয়েছি। পৃথিবীর যেখানেই ভালো গাছের বীজ পাবি বালিসোনায় এনে ছড়িয়ে দিস।’ হঠাৎ লালকমলের কাছে ঘেঁসে এসে চোখের তারা ঘুরিয়ে চারদিক দেখে নিল। তারপর পাতলা কাগজের সাতটা পুরিয়া হাতে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এতে ভালো ভালো মানুষের বীজ আছে, খালপাড়ের নতুন মাটিতে বুনে দে গিয়ে। ভালো মাটি পেয়েছি, এবার দরকার শুধু ভালো গাছের বীজ আর ভালো মানুষের বীজ। যত পারিস ছড়িয়ে যা।’

নীলকমল হেসে বলে, ‘তোমার বিয়ে হল না কেন, ছোটদাদু?’

‘গাছপালার সঙ্গে কবেই আমার নাবালক-বিয়ে হয়ে গেছে! তোরা আর সেসব জানবি কী করে! তোরাও কি সেই এক কন্যেকে দুজনে মিলে বাল্যবিয়েই করলি?’

লালকমল বলল, ‘আমাদের ঠাকুর্দা মনে হয় আমাদের জন্মের বহু আগে বালিসোনার হারানো নদীর সঙ্গে আমাদের দু-ভাইয়ের বিয়ের কথা পাকা করে গেছেন।’

লক্ষ্মী হাসপাতালের নানা দুর্নীতির খবরে হতাশ ও বিরক্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। রোগীর অপারেশনের পর সেলাই করার মোটা সুতোর বদলে রোগীর আত্মীয়রা ভালো সুতো চাইতে গেলে ওয়ার্ডবয় টাকা দাবি করে। তাই নিয়ে বচসা ও তার পরিণামে বিনা সেলাইয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়ে এক রোগীর মৃত্যু হয়। তারপর থেকেই লক্ষ্মী হাসপাতালে যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে খালপাড়ে এসে লালকমল-নীলকমলদের সঙ্গে খানিকক্ষণ কাটিয়ে যায়। বালিসোনার মানুষের কাছে এটা খাল না, তাদের বিশ্বাস লালকমল-নীলকমল বালিসোনার হারানো নদীই ফিরিয়ে আনছে। কেউ কেউ কল্পনায় দুই পাড়ে নারকেল তাল সুপারিবনের সারি এখন থেকেই দেখতে শুরু করেছে।

মাঝে মাঝে ভোরে এসে লক্ষ্মী নদীখাতের ধার বরাবর হাঁটতে হাঁটতে মোহনার দিকে অনেক দূর অবধি চলে যায়। গ্রামের মানুষের রোগব্যাধির খবর নেয়। নদীর বুকে একটা ভাসমান হাসপাতাল তার এখন ধ্যান-জ্ঞান। একজন ডাক্তার, একজন কম্পাউন্ডার, একজন নার্স আর একজন মাঝি ও রাঁধুনি নিয়ে ছোট্ট চলমান হাসপাতাল। এরও নাম সরোজিনীর নামে হবে ভেবে রেখেছে। সরোজিনী আরোগ্য তরী। পুরো পঁয়ষট্টি মাইল উনিশটি গ্রামের প্রত্যেকটিতে একদিন করে বজরা নোঙর করে রেখে, সেই গ্রামের অসহায় মানুষদের চিকিৎসা হচ্ছে- সে চোখ বুঝলে দেখতে পায়। খাল কাটা বা নদী উদ্ধার শেষ হবার আগেই সে হুগলির বলাগড় থেকে লিওনের নকশা মতো ছোট বজরা বানাতে উদ্যোগী হল।

সরোজিনী গ্রামীণ হাসপাতালে সরকার থেকে একজন প্রশাসক বসানো হয়েছে। একদিন সেই প্রশাসক ডাঃ খাস্তগীর ভোরবেলা মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে নদীর ধারে লক্ষ্মীকে ধরে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আপনি নাকি নৌকো-হাসপাতাল করার কথা ভাবছেন? এভাবে মানুষের চিকিৎসা হয়? এসব করে আপনি কী পান মিসেস চৌধুরী-উনগারেত্তি?’

‘ঠিক জানি না, হয়তো শান্তি পাই।’

বালিসোনা নদীর জলে-কাদায় বালিসোনার মানুষও শান্তি দেখার আশায় বুক বেঁধেছে। নদী যেদিন ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে সেদিনটার কল্পনা করে কেউ কেউ নবান্নের মতো ঘরে ঘরে নদী-উৎসব পালন করার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে।

দীর্ঘ নদীখাত ‘ল্যাজা হইতে মুড়া খুঁইজ্যা’ দেখেও ‘জলে সোনা, থলে সোনা, বালি সোনাগুঁড়া’ পাওয়া যায়নি বলে লালকমল-নীলকমলের মনে খেদ নেই, তারা ঊনত্রিশটা জলমুখ নিয়েই তুষ্ট, বিভিন্ন ঋতুতে জলের স্বাদ গন্ধ ও কমাবাড়ার বিশ্লেষণে তারা বেশি মনোযোগ দিল।

নদী বেঁচে উঠলে কী কী হবে, তা নিয়ে মানুষের মনেও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। নদীর ধারে ঘাসজমিতে অনেক বেশি গোরু চরতে দেখে তারা আনন্দ পাবে। একদিন নিশ্চয়ই আমবন জামবন বট অশত্থের মাথায় ভোরে ও সন্ধ্যায় পাখিদের উচ্চ কলকাকলিও শোনা যাবে।

বালিসোনায় মানুষের আশা-আকাÉার নতুন ঢেউ উঠতে দেখে লালকমল-নীলকমলের আনন্দের সীমা নেই। রোববারের ভোরের মিছিল যখন হাজার হাজার লোকের গানে-স্লোগানে মুখর, পরীক্ষিৎ যথারীতি মিছিল রওনা করিয়ে অম্বরীশকে নদী উদ্ধারের কথা বলে যাচ্ছে, তখন রাস্তা জুড়ে পর পর আটটি মিলিটারি ট্রাককে পথ ছেড়ে দিয়ে মিছিল বেঁকে নদীখাতের ধার ধরে এগিয়ে চলল।

মিছিলের কয়েকজন সবার আগে দেখল হাঁটুজলে বুজকুরির মধ্যে কার শব ভেসে আছে। একজন বলল, তবে কি কাল রাতে মোহনার জোয়ারে ভেসে এসে ভাঁটায় এখানে আটকে পড়েছে!

মেঘাবৃতর হাতে সম্পূর্ণ হওয়া ডানাওলা দুটো সাইকেলে লালকমল-নীলকমল নদীখাত ও মিছিলের মাঝখান দিয়ে দ্রুত চলে যাবার সময় শুধু বলে গেল, ‘আগে বাঢ়ো, আগে বাঢ়ো, শবের কথা পরে ভাবো।’

রোজকার মতো খাল থেকেই এক ঘটি গঙ্গাজল নিতে এসে পরী শবদেহ দেখে আঁৎকে উঠে চোখ ঢাকল। ভয়ে ভয়ে হাত সরিয়ে দ্বিতীয়বার শবের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার দৃষ্টি পাথরের মতো নিষ্পন্দ হয়ে গেল। সেদিন থেকে পরী আর কখনও গঙ্গাজল নিতে খালে যায়নি।

৪৩

গভীর রাতে কয়েকজন মিলিটারি-পুলিশ লালকমল-নীলকমলকে তুলে নিয়ে গেল। তিরিশে আগস্টের কয়েকদিন আগে সৈনিক স্কুলের পাহাড়ি স্টেশন থেকে যে তিনজন বালিসোনায় এসেছে, এত বছর পরেও তাদের প্রত্যেককে সেই রাতেই নিঃশব্দ অভিযান চালিয়ে অজানা কোথায় নিয়ে যাওয়া হল কেউ জানে না। টানা তিনদিন জেরা করে লালকমল ও নীলকমলকে রেখে অন্যজনকে বালিসোনায় ফিরে যাবার ট্রেনের টিকিট ও পথের খাওয়াখরচ হাতে দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। তিরিশে আগস্টের মিছিলে পুলিশকে লক্ষ করে ছোড়া গ্রেনেডগুলো সৈনিক স্কুলের পাহাড়ি স্টেশনের জন্য পাঠানো লুঠ হওয়া গ্রেনেড হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। তিরিশে আগস্টের ঘটনার প্রধান উদ্যোক্তা চৌধুরী পরিবারের যে-দুজনকে সেদিন ভিড়ের মধ্যে দেখা গেছে তারা আগের দিনই পাহাড়ি স্টেশন থেকে বালিসোনায় এসেছিল।

রাজধানীতে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা সচিবালয়ে অনেক অনুসন্ধানের পর পরীক্ষিৎ জানতে পারল, গুডস ট্রেনের সিল ভেঙে আর্মির অস্ত্র লুটের অভিযোগে লালকমল-নীলকমলকে প্রাথমিক জেরার পর তাদের উত্তর-পূর্ব ভারতের সেনা-অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র দপ্তরে সদ্য ভারপ্রাপ্ত সহকারি সচিব, তার প্রাক্তন ছাত্রী ঊষা অফিসের বাইরে এসে মনের দ্বিধা কাটিয়ে পরীক্ষিৎকে বলল, ‘আপনাদের তিন পুরুষের আই বি রিপোর্ট রাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে আনানো হয়েছে। আপনার আলাদা পুলিশ রিপোর্টের ফাইলও দেখা হচ্ছে, স্যার। এগুলো ওদের বিরুদ্ধে যাবে মনে হয়।’

নীলা হঠাৎ ঊষার একটা হাত ধরে কাতর স্বরে বলল, ‘বিশ্বাস করো ভাই, আমার ছেলে-দুটো বদমাস নয়, কোনওদিনই ওরা সন্ত্রাসবাদী নয়, দোষ ওদের একটাই, বালিসোনাকে বড্ড ভালোবাসে। সে তো ওদের বংশেরই দোষ। আমার শ্বশুরমশাইয়ের সময় থেকে চলছে।’

‘জানি, ম্যাম, জানি। আমি তো লক্ষ্মী-বড়দির স্কুলের ছাত্রী, স্যারের কাছেও পড়েছি।’

যাওয়া-আসায় প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার ট্রেন জার্নিতে বিধ্বস্ত পরীক্ষিৎ নীলাকে বাড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে নদীখাতের ধারে এসে বসে পড়ল। এখনও হাঁটুজল আছে, জলের ওপর হাওয়া বিলি কাটছে।

সারা বছর বুকজল, হাঁটুজল, কাদাজল নিয়ে টিঁকে থাকার চেষ্টা সত্ত্বেও সামনের গ্রীষ্ম পর্যন্ত নদী বাঁচল না। জৈষ্ঠে পঁয়ষট্টি মাইলের বেশিটাই ধুলো বালি শুকনো মাটিতে মরুপথের চেহারা নিল।

বালিসোনার কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরে লালকমল-নীলকমলের পক্ষে কথা বলতে গেলে তাদের সকলকেই জানানো হল, তাদের কিছু করার নেই, এটা পুরোপুরি সামরিক বাহিনীর হাতে।

প্রদীপ খবরের কাগজ ফুÅটো করে সেই ফুটো চোখের সামনে ধরে কুঁজো হয়ে বসে লিখছিল, পরীক্ষিৎ ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বলল, ‘লেখায় ব্যাঘাত ঘটালাম হয়তো। প্রদীপদাদা, তোমাকে একবার দিল্লি যেতে হবে।’

প্রদীপ মুখ তুলে ভুরু কুচকে পরীক্ষিতের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘দিল্লির পাঠ আমি তুলে দিয়েছি রে। আমার হাঁটুও আর ঠিক নেই।’

‘তোমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে প্লেনে নিয়ে যাব। আমাদের বড় বিপদ। বালিসোনার সামনে মস্ত ফাঁড়া। লালকমল-নীলকমলকে হয়তো প্রাণ দণ্ড দেওয়া হবে! একবার চলো, হয়তো তুমিই বাঁচাতে পারো।’

দিল্লির অফিসেও লিফট থেকে হুইল চেয়ারে বসেই নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিরক্ষা সচিবের ঘরে ঢুকে প্রদীপ বলল, ‘কল্লোল, একে তুমি চেনো?’

‘বিষাদগাথার লেখককে কোন বাঙালি না চেনে, স্যর! রোজ সকালের ফ্লাইটে কলকাতা থেকে আমার বাংলা কাগজ আসে।’ কল্লোল উঠে দাঁড়িয়ে পরীক্ষিতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনার সঙ্গে এখানে দেখা হবে ভাবিনি। আমি ভাগ্যবান। আপনি কেমন আছেন স্যর?’ শেষ কথাটা প্রদীপের উদ্দেশে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে প্রদীপের চাকরির শেষ দুবছর কল্লোল ছিল তার অনেক জুনিয়র, প্রদীপের উপদেশে ও সুপারিশে, সেইসঙ্গে শিডিউল কাস্ট হবার বিশেষ সুযোগে সে ক্রমশ ওপরে উঠে আসে। সকলের জন্য কফি বলে দিয়ে প্রদীপকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারি স্যর?’

‘পরীক্ষিতের দুই ছেলে লালকমল আর নীলকমলকে ভুল করে মিলিটারি পুলিশ তুলে নিয়ে এসেছে। ওরা দুটি যমজ ভাই, মানুষ হিসেবে দুটি রত্ন। তুমি কিছু করো। তোমরা চাইলে আমি পরীক্ষিৎ দুজনেই বন্ড দিয়ে যেতে পারি।’

কল্লোলের কাছ থেকে ফেরার পথে প্রদীপ হঠাৎ পরীক্ষিৎকে বলল, ‘শীতের ফুলকপির মতো এখন নাকি ছোট ছোট অ্যাট্ম বোমাও বাজারে উঠছে?’

চিন্তামগ্ন পরীক্ষিৎ হঠাৎ ঘোর ভেঙে বলে উঠল, ‘ছেলে-দুটোর সাহস যদি আমার থাকত আমি দেশের দূষিত শাসনব্যবস্থাটাই বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিতাম! দুর্নীতির দুর্গন্ধে আজকাল আমার গা গুলোয়।’

গান্ধিজীর ডান্ডি অভিযানের ভাস্কর্য ছাড়িয়ে এসে পরীক্ষিৎ আবার তার নীরবতা ভাঙল, ‘গানের মিছিল রাজধানীর রাস্তায় আনা যায় কিনা ভাবতে হবে।’

প্রদীপ পরীক্ষিৎ কেউ জানত না, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের যে গাড়িতে তাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে তাতে যে-কোনও কথা বা শব্দ অলক্ষ্যে রেকর্ড হয়ে যায়।

বালিসোনায় ফিরে প্রদীপ সেই রাতেই পরীক্ষিৎকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে বলল, ‘লাল-নীল আমার মতো একই ভুল করল, ওরাও বিয়ে করল না। রাঙাকাকা আত্মনিধনের ঠিক আগে আমার ঘরে- তুই যেখানে বসে আছিস, সেখানে দাঁড়িয়ে বলে গিয়েছিলেন, ভালো মানুষের বীজের বড় অভাব রে। এটাই হয়তো রাঙাকাকার শেষ কথা।’

পরীক্ষিতের গভীর দীর্ঘশ্বাসে তার বুকের কাছাকাছি শুকনো ডালপালা থেকে ধুলো উড়ল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে সে কথা বলতে পারল, ‘জাহাঙ্গীর সাহেবও মানুষ আনার কথা বলতেন।’

একটু বেলার দিকে গরমে ঘেমে পরীক্ষিতের ঘুম ভেঙে গেল। চারদিকে ভাদ্রের গুমোট। প্রচণ্ড গরমে রাসমাঠে মাপজোক তদারকি করতে করতে আনন্দমোহন হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেছে, হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই তার মৃত্যু হল। ডাক্তার একমুহূর্ত পরীক্ষা করে বললেন, ‘ম্যাসিভ হার্টঅ্যাটাক!’

নীলা, পরী, মিতা, নন্দিনী, চিরন্তনী, অরণ্য, মেঘাবৃত সকলেই দিনের পর দিন লালকমল-নীলকমলের পথ চেয়ে থাকে। শিউলিও তার লালমামা নীলমামার কথা জিজ্ঞেস করে। লক্ষ্মী-লিওন দুবেলা খোঁজ নিয়ে যায়। পরীক্ষিৎ ছেলে দুটোর ভবিষ্যৎ জানতে চেয়ে নানা জায়গায় যাতায়াত করে রোজই বিফল হয়ে ঘরে ঘরে।

দু-ভাইকে বালিসোনায় আর দেখা গেল না। তাদের নিয়ে নানা গুজব এখানকার বাতাসে ভাসে। কখনও শোনা যায়, কোনও দুর্গম অঞ্চলে জেলের দুটি আলাদা সেলে দুজনকে রাখা হয়েছে। কখনও রটে, তারা জেল ভেঙে বেরিয়ে গেছে। এমনও শোনা গেল, পালাতে গিয়ে রক্ষীদের গুলিতে তারা মারা গেছে। শহরের এক অল্পবয়েসি সাংবাদিক বলল, মণিপুর, নাগাল্যান্ড হয়ে লুকিয়ে বালিসোনায় ফেরার পথে সশস্ত্র বাহিনীর চোখে পড়ে গিয়ে গ্রেপ্তার এড়াতে দুজনে একসঙ্গে কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে নিজেদের গুলি করেছে।

পরীক্ষিতের এক প্রাক্তন ছাত্রের তরুণপুত্র গর্বভরে জানিয়ে গেল, লালকমল-নীলকমল ভারতীয় গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে চিনে ঢুকে গেছে।

মনসা পুজোর আগেরদিন সন্ধেবেলা রান্নাপুজোর বাজার করে ফেরার পথে সাসপেন্ডেড পুলিশ অফিসার নবীন গুছাইত তথাগতর মাধ্যমে খবর পাঠাল, বালিসোনা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই বিশেষ আদালতের পথে হ্যান্ডকাফের আঘাতে লালকমল একজন রক্ষীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়ায় তাকে আর্মির গাড়ি থেকে নামিয়ে সেই মুহূর্তে গুলি করা হয়। নীলকমলেরও দ্রুত বিচার শেষ করে তাকে হয়তো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। গুছাইত বলে পাঠিয়েছে, তাকে এয়ার ফেয়ার সমেত হাজার-পনের টাকা দিলে সে আর্মির হেডকোয়ার্টার থেকে লেটেস্ট খবর এনে দিতে পারে।

টাকা নিয়ে চলে যাবার পর, একদিন মাঝরাতে বিরাট পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে এসে পরীক্ষিৎকে ঘিরে ধরে গাড়িতে তোলবার আগে পর্যন্ত তথাগত বা নীলাঞ্জনারা কেউই গুছাইতের দেখা পায়নি।

পরীক্ষিৎ সারা রাত জেগে বসে বিষাদগাথা লেখে। হঠাৎ যদি রিফিল ফুরিয়ে যায় তাই আরও একটা কালো কালির বলপেন হাতের কাছেই রাখা থাকে। লাল কালি নীল কালির আলাদা দুটো কলমও তার আছে। একটা দিয়ে লালকমলের বাল্য-কৈশোরের কথা যখন যেমন মনে পড়ে লিখে রাখে, অন্যটা দিয়ে একইভাবে নীলকমলের বাল্য-কৈশোর লিখে যায়। তাদের দুঃসাহসিক দুষ্টুমির কথা লিখতে লিখতে কোনও শব্দ চোখের জল পড়ে অবোধ্য আকার নিলে শব্দটি সে নিঃস্ব লোকের শেষ সম্বল আগলানোর মতো তক্ষুনি আবার লিখে ফেলে।

প্রায় পাঁচ বছরের সমুদ্রযাত্রায় দেখা অদ্ভুত যে-সব দেশের কথা তার বালকপুত্রদের বলা হয়নি, সেই সব কথা সেই বালকবয়েসি লালকমল-নীলকমলকে সামনে বসিয়ে রাতের পর রাত শুনিয়ে যাওয়া তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল।

নীলাঞ্জনা সারা বছরই পরীক্ষিতের প্রিয় কিছু জিনিস যেভাবেই হোক জোগাড় করে আনে। গ্রীষ্মে ফলসা, বর্ষায় কদমফুল, শরতে শিউলি, হেমন্তে ছাতিম, শীতে পাটালি গুড়ের পায়েস, বসন্তে সজনেডাটার সুক্তো বাড়ি থেকে বয়ে এনে কালো ভারী একটা টেবিলে পরীক্ষিতের উদ্দেশে পিণ্ডদানের মতো নামিয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত সময় শেষ হলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিরে যায়। নীলাঞ্জনা অনেক আবেদন-নিবেদন করে, পরীক্ষিতের লেখার অভ্যাসের কথা বলে, শেষ পর্যন্ত কারামন্ত্রীর অনুগ্রহে তার হাতের শিকলিবেড়ি খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেও পায়ের ডান্ডাবেড়ি কাটাতে পারেনি।

বংশে আত্মহত্যার ইতিহাস আছে বলে চারখানা কলম রাখার অনুমতি পেতেও নীলাঞ্জনাকে অনেক উদ্যোগ করতে হয়েছে।

একেকদিন কাছে-পিঠে সেপাই সান্ত্রী বা গোয়েন্দা অফিসারকে দেখা না গেলে পরীক্ষিৎ হঠাৎ ঝুঁকে এসে জালের ওপর ঠোঁট চেপে নীলাঞ্জনাকে ফিসফিস করে বলে, ‘একটা ঘোড়া আর এক বাক্স হোমিওপ্যাথি এনে দেবে? একটা গাধা হলেও হবে। দাও না গো।’

৪৪

দুয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ছাড়া মেঘাবৃত এমনিতে খুব কম কথা বলে। কিন্তু তিস্তার সঙ্গে দেখা হলে তার কথা আর শেষ হয় না। রোজই ছাড়াছাড়ি হবার সময় মনে হয় কী যেন বলা হয়নি।

দুজনে দুটো উভচর সাইকেলে যখন উড়তে থাকে, তখনও তারা কথা বলে। তখনও মেঘাবৃতই বক্তা। একটু পর পর তিস্তাকে শুধু বলতে হয়, বলো শুনছি। হাওয়া কাটিয়ে মেঘাবৃতর কথা তিস্তার কানে ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে কি না তারই প্রমাণ দিতে হয় তাকে। তাতেও কাজ না হলে সাইকেলের সুরেলা বাঁশি বাজাতে হয়। ক্রিং ক্রিংয়ের বদলে সাঁওতালি বাঁশির সুর। লালকমল-নীলকমলের কাছে পাওয়া।

তিস্তা যদি কথা বলে, মেঘাবৃত সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ওড়ে, শুনতে পাওয়ার প্রমাণ দেয় না। তিস্তা যদি বলে, ‘আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছ তুমি?’ মেঘাবৃত উত্তর দেয়, ‘তোমার শিউলি রঙের কথা আমি মেঘের ওপর থেকেও শুনতে পাব। তুমি বিশ্বাস করো না, কিন্তু তোমার কথা আমি দেখতে পাই। সাদা আর কমলা মেশানো। শিউলিফুলের মতো।’

‘তুমি একটা পাগল! তোমার মেঘাবৃত নাম কে রেখেছে বলো তো! আমি তোমাকে শুধু ‘মেঘ’ বলে ডাকব।’

‘মেঘ, মেঘা, মেঘু, মেঘবর্ণ, যা খুশি ডাকতে পারো। মেঘাবৃত নামটা আমার পরীক্ষিৎমামার দেওয়া।’

দূর থেকে দীর্ঘ বকের সারি লম্বা চাঁদমালার মতো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে দেখে দুজনেই সাইকেলের গতিমুখ কিছুটা বদলে নিল।

‘তোমার মনের সবটাই সাদা, তোমাকে আমি মাঝেমাঝে সাদা মেঘও বলব। আচ্ছা, পরীক্ষিৎমামাকে ছেড়ে দেবার জন্য আমরা গভর্নমেন্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি না? গানের মিছিল থেকে আরও বড় জনমত তৈরি করতে পারি না? গান্ধিজীর মতো অহিংস আন্দোলন তো এখনও করা যায়, তাই না?’

বকের সারির নীচ দিয়ে যেতে যেতে মেঘাবৃত বলল, ‘আমার সে শক্তি নেই। অরণ্যদা কিছু করার কথা ভাবছে। লক্ষ্মীমাসিদের সঙ্গে প্রায়ই আলোচনা হয়।’ বলে চুপ হয়ে গেল।

‘থামলে কেন? বলো, শুনছি।’

‘নীলামাসি, আমার মা- সবাই পরীক্ষিৎমামাকে নিয়ে ভাবছে।’

তিস্তা ও মেঘাবৃতকে একসঙ্গে সাইকেলে ঘুরতে দেখলে বা আকাশে উড়তে দেখলে নীলাম্বরের মাথা গরম হয়ে ওঠে। তাদের সাইকেল না থামা পর্যন্ত সে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করে।

কিছুদিন ধরে সব কিছুতেই তার বিরক্তি ও অধৈর্য উমাশশীরও চোখে পড়েছে। তার আলমারি থেকে টাকা চুরি যাবার দুয়েকদিনের মধ্যেই তার মুখের ভাবে, চালচলনে হঠাৎ বদল দেখে উমাশশীর ভাবনা হয়।

পশ্চিমপাড়ায় এক রাতে একটা মেয়ের ঘরে একজন রাজনৈতিক নেতার ছেলে খুন হওয়ায় ক’দিন পতিতাপল্লিতে যখন-তখন পুলিশি তল্লাসি চলার পর পাড়ায় আবার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এল। সেই ভরা ব্যবসার সময় পল্লির লাগোয়া অ্যাসবেসটসের ছাদ দেওয়া নতুন কয়েকটা ঘরে পুলিশ আচমকা তল্লাসি করতে এসে দ্যাখে দরজায় দরজায় ‘গৃহস্থের বাড়ি’, ‘গেরস্তপাড়া’, ‘ব্রাহ্মণকুটির’ লেখা রয়েছে। ব্রাহ্মণকুটিরে হারমোনিয়ামের সঙ্গে মেয়েকণ্ঠে ‘রেশম ফিরিরি, রেশম ফিরিরি’ শোনা যাচ্ছে।

পুলিশ অফিসার গানের ভাষা বোঝবার চেষ্টায় দরমার দরজায় কান পাতল। কয়েকটা ছেলে একসঙ্গে কিছু বলছে বলে কারও কথা বোঝা গেল না। গান থামিয়ে মেয়েটা বলল, ‘ব্লাউজ খুললে এসট্রা দশ টাকা, লুঙ্গি খুললে এসট্রা কুড়ি। কে আসবে ঠিক করো, বাকি দুজনকে কিন্তু বাইরে অপেক্ষা করতে হবে।’

দুজন পুলিশ আস্তে দরজা ফাঁক করল। লুঙ্গি ও ব্লাউজ পরা একটা নেপালি মেয়ের সামনে তিনটে ছেলে বসে আছে। তাদের একজন খুব চেনা, সুষমা-স্কুলের উমাশশীর ছেলে নীলাম্বর।

আজই প্রথম আগের স্কুলের দুজন বন্ধুর সঙ্গে নীলাম্বর এপাড়ায় এসেছিল। মেয়েটার সঙ্গে তাদের তিনজনকে থানায় নিয়ে গিয়ে শুধু মেয়েটার নামে কেস দিয়ে তিনজনকেই ছেড়ে দেওয়া হল। কাউকে খবরটা জানানো হবে না- এই শর্তে মাথাপিছু চারশো করে ঘুষের টাকা নীলাম্বরই প্যান্টের ভেতরের পকেট থেকে বের করে দিয়ে দিল। এটা আলমারির টাকা চুরির পরদিনের ঘটনা।

সেই থেকে নীলাম্বরের হাবভাবের বদল উমাশশীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠল। বিরহ বা উদাস-উদাস ভাব নয়, এ অন্য কিছু। নন্দিনীর ছেলের সঙ্গে তিস্তার মেলামেশার কথা সেও শুনেছে, নীলুর মুখে হয়তো তার মনের সেই ঈর্ষা। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করা, ঘুমের সময় ঘুমনো- এসবও আর আগের মতো নেই দেখে উমাশশী সমস্যার মীমাংসা খোঁজে। তিস্তাকে তিলফুল ছুঁতে সে নিজে দ্যাখেনি, কিন্তু তিলখেতে ছোটাছুটির সময় ফুলের ছোঁওয়া তার গায়ে লাগেনি বলে মেনে নেওয়াও তো শক্ত। নীলুর অবস্থা দেখে শেষ পর্যন্ত সন্দেহের সুযোগ নিয়ে তিস্তাকে তিলস্পর্শদোষ থেকে মনে মনে অব্যাহতি দিয়ে উমাশশী তিস্তার মায়ের কাছে ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথাটা পাড়ল।

‘বিয়ের মন বলো, বয়েস বলো, তিস্তার তো এখনও কোনওটাই হয়নি, দিদি। তাছাড়া ও তো লেখাপড়া শেষ না করে নিজের সংসার শুরুই করবে না।’

‘তিস্তাকে একবার ডাকো না ভাই।’

‘ও তো এখন বাড়ি নেই। তোমাদের সুষমা-স্কুলের খুব সুনাম শুনতে পাই, ছেলেটাকে তৈরি করছ? তোমার পরে তো ওকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে।’

‘স্কুলের পরিচালনার ভার তো লিওন-লক্ষ্মীর ওপর। ওদের চেষ্টাতেই গতবছর আমাদের হাই স্কুল হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল হল। সুষমা গার্লস হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল।’

‘সুষমা কি তোমার মেইডেন নেম? মানে কুমারীকালের নাম?’

উমাশশী কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মুখ তুলে বলল, ‘ও-নাম এখানে আর কে-ই বা জানে! দেখি, দরখাস্ত তো দেওয়া হয়েছে।

‘কিসের দরখাস্ত?’

‘স্কুলের নাম বদলাবার।’

উড়ন্ত সাইকেলের গতিপথ অনুসরণ করে নীলাম্বর বুঝে নিল, ওরা আজ ঘোড়াদহের মাঠে নামবে। বছরে দুবার ধান কাটার পর এই মাঠেই চাষিদের ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা জমিদারি আমল থেকে চলে আসছে। তখন বিজয়ীদের পুরস্কারও দিতেন জমিদারবাবুরা। এখন দেয় ধানের মহাজনরা।

দুজনে মাঠে নামতেই নীলাম্বর দৌড়ে গিয়ে কপট বিনয়ে হাত জোড় করে বলল, ‘দোলের দিন অপরাহ্নে আমাদের স্কুলের ছাদে ঘরোয়া বসন্ত-উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। আপনারা পায়ের, থুড়ি, সাইকেলের ধূলি দিয়া, কপালে আবির দিয়া নিজেদের ও অন্যদের আনন্দবর্ধন করিয়া আমাদের বাধিত করিবেন। পত্র ছাড়া নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয়।’

দুজনে এতক্ষণ শুনছিল, নীলাম্বরের কথা শেষ হতেই হো হো করে হেসে উঠল।

নীলাম্বর বলল, ‘তোমাদের কিন্তু আসতেই হবে। আবির খেলা হবে, গান হবে, ভালো সরবতের সঙ্গে জলযোগের ব্যবস্থাও থাকবে।’

রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় মেঘাবৃত নীলাম্বরকে সাইকেলে তুলে নিল।

হিন্দি ও বাংলায় হোলির গানের পর তিনটি রবীন্দ্রসংগীত শেষ হতে আবির দেওয়া শুরু হল। সমবয়সিদের কপালে ও বড়দের পায়ে ছাড়া শরীরের আর কোথাও আবির দেওয়া বারণ।

মিষ্টিমুখের শুরুতেই ছোট-বড় সবাইকে মাটির গেলাসে শাঁস ঘেঁটে দেওয়া ডাবের জল, রূহআফজা সিরাপ, দুধ-বাদাম-মধু দিয়ে সরবত, বাদামবাটা মেশানো সিদ্ধি যার যার পছন্দমতো পরিবেশন করা হল।

‘তুমি কী নেবে?’ এক হাতে সিদ্ধি, আরেক হাতে দুধ-বাদাম-মধুর সরবত তিস্তার সামনে ধরে নীলাম্বর অপেক্ষা করে আছে।

তিস্তা হেসে হাত বাড়িয়ে সরবতের গ্লাস নিল।

‘তুমি, মেঘাবৃত?’

‘আমাকেও সরবত দিতে পারো।’

নীলাম্বর মেঘাবৃতর সরবত নিয়ে না ফেরা পর্যন্ত তিস্তা গ্লাস হাতে বসে থাকে, সাদামেঘের সঙ্গে গ্লাস ঠোকাঠুকি করে পান করবে।

নীলাম্বর মেঘাবৃতর হাতে সরবত তুলে দিয়ে আরেজনকে রূহআফজার লাল সরবত দিতে চলে গেল।

তিস্তা মেঘাবৃতর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে নিজের গ্লাসটা তাকে দিয়ে খুশিতে চোখে-চোখে হাসল।

মেঘাবৃতর সরবত শেষ হয়েছে দেখে নীলাম্বর কাছে এসে দুজনের চোখে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘আরেক গ্লাস হবে নাকি? এবার একটা সিদ্ধি নিয়ে দেখবে? সব কিন্তু বাবার কয়লাখনির সময়কার ওস্তাদ কারিগরের পাকা হাতের কাজ। পুরী-মোহনভোগও ওরাই বানাচ্ছে। খাঁটি ঘিয়ের। হতে আরও খানিকটা সময় লাগবে। পোস্ত দিয়ে হাতে-গরম আলুর খোসাভাজা আসছে, এক গ্লাস সিদ্ধি এনে দিই?’

‘আমাকে আর-এক গ্লাস ওই দুধ-বাদামের সরবত দিতে পারো।’

‘তিস্তা, তোমাকে?’

‘আগেরটা সরবতের বদলে সিদ্ধি দাওনি তো? মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে।’

‘সরবত খেয়ে মাথা ঝিমঝিম! তাহলে এক গ্লাস সিদ্ধি খেয়ে দেখো, মাথা ছেড়ে যাবে।’

নীলাম্বর একহাতে সরবত, আরেক হাতে সিদ্ধি এনে দুজনকে দিয়ে গেল।

তিস্তা চুমুক দেবার আগে মেঘাবৃত তার হাত থেকে সিদ্ধির বড় গ্লাসটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের সরবত তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এতটা সিদ্ধি খেলে আর দেখতে হবে না! তুমি সরবতেই থাকো।’

সরবতের চমৎকার স্বাদে ও মৃদু নেশায় নীলাম্বরের হাত থেকে তৃতীয় বারের সরবতও নিয়ে মজার খেলা হিসেবে নিজেদের মধ্যে পালটা-পালটি করে নিল।

তিস্তা একচুমুকে অর্ধেক গ্লাস শেষ করে মেঘাবৃতর একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘চলো না, আমরা আকাশে উড়ি!’

মেঘাবৃত জড়ানো গলায় বলল, ‘তোমার নেশা হয়ে গেছে। চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।’

‘আমি বাড়ি যাব না। আমার মোটেই নেশা হয়নি। আমি মেঘের মধ্যে উড়ব। চলো, আমরা দুজনে উড়ে বেড়াই।’

মেঘাবৃত তিস্তার চোখে নিজের ঘোর-লাগা চোখ রেখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল, ‘তুমি আমার সঙ্গে মেঘের মধ্যে থাকবে? আমি বাসা বানাব?’

চতুর্থ দফায় মেঘাবৃত সিদ্ধি নিল, তিস্তা নিল সরবত। এবার তিস্তাই জোর করে গ্লাস বদলে নিল।

অর্ধেক গ্লাসও শেষ হয়নি, তিস্তা দুহাতে নিজের মাথা শক্ত করে চেপে ধরে ‘অসহ্য যন্ত্রণা, অসহ্য যন্ত্রণা, মাথা জ্বলে যাচ্ছে, মাথা বার্স্ট করবে’ বলতে বলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগল।

চেঁচামেচি শুনে নীলাম্বর দৌড়ে এল। তিস্তার আধখাওয়া সরবতের গ্লাস তুলে নিয়ে আর্তনাদ করে উঠল, ‘এ কি! এ তো সিদ্ধি!’ এবার মেঘাবৃতর দিকে চেয়ে, ‘এটা তোমাকে দিয়েছিলাম! তোমার প্রথম সরবতটা তুমি খেয়েছিলে?’

‘আগে ডাক্তার, এখুনি একজন ডাক্তার চাই!’ বলতে বলতে সে কোলে করে নিজেই তিস্তাকে হাসপাতালে নিয়ে চলল।

‘আমি গাড়ি বের করতে বলছি। চলো, তুমি আমি দুজনে ধরে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাই। পয়লা সরবত তুমি খেয়েছিলে?’

‘তিস্তা গ্লাস বদলাবদলি করে নিয়েছিল।’

হাসপাতালে পেট পাম্প করে সবটুকু সরবত তুলে ফেলেও তিস্তার মাথার যন্ত্রণা কমল না। তাকে একসপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখা হল। নিওরোলজির ডাক্তার যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করে, গ্লাসের অবশিষ্ট সরবতের রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রায় দিলেন, ‘মেয়েটাকে পাগল করে দেওয়া হয়েছে। চার-গ্লাস সরবতের মধ্যেই ধুতরোর বিচি বেটে মেশানো হয়েছিল। মধুর পরিমাণ খুব বেশি ছিল বলে জিভে টের পাওয়া যায়নি।’

পুলিশ কয়লাখনির পুরনো লোক, বাড়ির অন্যান্য কাজের লোক, উমাশশী, নীলাম্বর, মেঘাবৃত- সবাইকে আলাদা আলাদা জেরা করে শেষ পর্যন্ত নীলাম্বরকে গ্রেপ্তার করল। ধুতরো বাটার শিল-নোড়াও সঙ্গে নিয়ে গেছে। যে মেয়েটি বেটেছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হল। কী বাটছে না জেনে সে শুধু দাদাবাবুর নির্দেশ মতো বেটেছে।

পুলিশি হেপাজত ও জেল হেপাজতে মিলিয়ে ন-মাস আটক থাকার পর বড় বড় উকিলদের যুক্তিতর্কে একমত হয়ে বিচারক আসামীকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দিলেন। দুটি শর্ত, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামী বালিসোনার বাইরে যেতে পারবে না এবং প্রতি সপ্তাহে একবার করে থানায় হাজিরা দিতে হবে।

হাসপাতালে, বাড়িতে, নার্সিং হোমে অনেক চিকিৎসা করিয়েও তিস্তার সুস্থ মনটাকে আর জাগানো গেল না। সিদ্ধ যোগীপুরুষের মন্ত্রপড়া ছাই মাথায় দিয়ে, নানা জনের পরামর্শে নানান শেকড়বাকড় শুঁকিয়ে, মন্ত্রপূত লোহার বালা পরিয়ে, কিছুতেই মানসিক সুস্থতার সামান্য লক্ষণও দেখা গেল না। এই ঘটনার পর বালিসোনার কোনও কোনও বাড়িতে দোল খেলাই বন্ধ হয়ে গেল।

তিস্তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবার পর যখনই মেঘাবৃত তার কাছে গিয়ে নির্বাক বসে থাকে, তখনই অন্তত একবার সে বলবে, ‘আমাকে মারতে চেয়েছিলি, তার বদলে তিস্তার জীবনটা শেষ করে দিলি কেন?’ একথা সে কার উদ্দেশে বলে সবাই জানে, কিন্তু এ বাড়িতে কথাটা কাকে শোনায় সে নিজেও জানে না।

বাড়ির ঝিরা সবাই মিলে তিস্তাকে জোর করে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে স্নান করাবার পর সে আর জামাকাপড় পরবে না। হাতের কাছে লাঠি, খুন্তি, ঝুলঝাড়া, যা পাবে তা-ই নিয়ে সে মা-কালীর বেশে উঠোনের কাক মারতে যায়। শেষ পর্যন্ত তাকে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াবার পর জামাকাপড় পরানো হয়।

সব শুনেও উমাশশী নীলাম্বরকে অপরাধী ভাবতে পারল না। তার ধারণা, তার ছেলেকে বিনা দোষে যন্ত্রণা দেওয়া হচ্ছে। তিস্তার যে এরকম কিছু ঘটবে সে তো আগেই জানত। তিলফুল তুলে মা-লক্ষ্মীই নিস্তার পাননি, এ তো এক সামান্য মেয়ে।

কলকাতার সরকারি হাসপাতালের নিউরোলজির প্রফেসর-ডাক্তার, পরীক্ষিতের স্কুলের বন্ধু সুব্রত একদিন এসে তিস্তাকে পুরো তিনঘন্টা পর্যবেক্ষণ করে বেশ কয়েকটা ওষুধ বন্ধ করে, কয়েকটা বদলে দিয়ে বিধান দিলেন- পিসবোর্ডে ভালো করে রাংতা সেঁটে কালীর হাতের খড়্গের মতো একটা খড়্গ বানিয়ে রোগীর চোখের সামনে রেখে দিন।

খড়্গ দেখে তিস্তা ক্রমশ শান্ত হল। চোখের তারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কালীর বেশে কাক তাড়া করে উঠোনময় ছুটে বেড়ানো এখন বন্ধ হয়েছে। বেশির ভাগ সময় সে হাতের খড়্গ কখনও কোলে নিয়ে কখনও বুকে নিয়ে, সেটাকে নাচাতে নাচাতে ‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’ বলতে বলতে একসময় হুহু করে কেঁদে ওঠে।

সরস্বতীপুজোর দিন সকালে রোজকার গামছা-পরা শুচিবায়ুগ্রস্ত গয়লার বদলে তার জিনস পরা ছেলেটা দুধ দিতে এলে তিস্তা ঝাঁপিয়ে পড়ে খড়্গটা তুলে নিল। এক লাফে ছেলেটার সামনে গিয়ে দুহাতে খড়্গটা উঁচিয়ে ধরে কুড়ুলের কোপের মতো গয়লার ছেলের মাথায় মারল। ছেলেটার নাক কেটে রক্ত পড়তে লাগল, কপালেও অনেকখানি কেটে গেছে।

অরণ্য একদিন গভীর সহানুভূতিতে মেঘাবৃতর সঙ্গে তিস্তাদের বাড়িতে এল। তার মা-বাবাকে দেখে মনে হল তাঁদের কথা ফুরিয়ে গেছে, জীবন্মৃত অবস্থায় দিন কাটানো ছাড়া তাঁদের আর কিছু করারও নেই।

তিস্তাকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে সাহস করে অরণ্য তার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘তুমি বড্ড কষ্ট পাচ্ছ, বোন। কিসে তোমার একটু শান্তি হবে আমাকে বলো। তোমাকে সুস্থ দেখতে, আগের মতো হাসতে দেখতে তুমি যা বলবে আমরা তা-ই করব।’

তিস্তা মাথা নামিয়ে কোলের খড়্গের দিকে চেয়ে শান্ত হয়ে বসে আছে। তাকে পাগল বলে চেনাই যায় না। অরণ্য আগের কথাটা আরেকবার বলতে বলতে থেমে গেল- তিস্তা চোখ খোলা রেখেই ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেছে।

মেঘাবৃত কী ভেবে তার সাইকেলের বাঁশির সুর বাজাতে লাগল। তিস্তার নিদ্রামগ্ন দৃষ্টিতে তার কোনও ছাপ পড়ছে কিনা বোঝা গেল না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন