বিষাদগাথা – ২৫

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

রাতের বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি ভোরের দিকে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে সকাল থেকে আবার শুরু হয়ে গেল। নীলাঞ্জনা চলে যাবে বলে পরীক্ষিতের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। পরীক্ষিৎ হাতের তালুতে মাথা রেখে সাদা পাতার ওপর ঝুঁকে চুপ করে বসে আছে, নীলাঞ্জনা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে তার পিছনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি চলে যাচ্ছি পরীক্ষিৎ।’

‘এত বৃষ্টিতে তুমি যাবে কী করে?’

‘বৃষ্টি তো একসময় থামবেই, তখন তো যেতেই হবে।’

‘আর দুয়েকটা দিন থেকে যেতে পারো না?’

‘পারলে চিরদিন তোমার কাছে থেকে যেতাম।’

পরীক্ষিতের একটা হাত নিজের হাতের তালুতে অনেকক্ষণ ধরে রেখে নীলাঞ্জনা বলল, ‘এ-ক’দিনে তোমাকে দেখে বুঝেছি তুমি বড় দুঃখী, আমাকে তোমার প্রয়োজন। ভুল বলেছি?’

পরীক্ষিৎ এবার মৃদু হাসে, ‘ভুল মানুষ যখন করে, তখন ভুল বলে তাকে চেনা যায় না। আমি ভুল ধরিয়ে দিলেও তুমি মানবে না। ভুল তো তুমি করেছই। তোমার চেয়ে বয়েসে আমি কত বড় তুমি জানো?’

নির্বাক দুজনের মাঝখান দিয়ে ধীর লয়ে সময় বয়ে যায়। নীলাঞ্জনা ব্যাগ থেকে নিজের নাম-ঠিকানা ফোন নম্বর লেখা এক টুকরো কাগজ টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে বলল, ‘সরস্বতীপ্রতিমার কাছে কখনও গেলে, আমাকে ভুলে যেও না, দেখা না হলে দুঃখ পাব।’

দেশের বিভিন্ন শহর থেকে, গ্রাম থেকে নীলাঞ্জনা পরীক্ষিৎকে চিঠি লেখে। প্যারিস থেকে পর পর দুটো এয়ারোগ্রাম পেয়ে সে তার কাজের পরিধি আঁচ করে।

ব্রাজিলের সাওপাওলো থেকে পাঠানো হর্নবিল পাখির ডাকটিকিট লাগানো এনভেলাপ খুলে বড় চিঠি সে আগাগোড়া দুবার পড়ল। পরীক্ষিতের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার উত্তাপ লাইনে লাইনে। তার গবেষণার ক্ষেত্রে তার দার্শনিক নিরীক্ষণের কথাও পরীক্ষিৎকে লিখেছে।

‘বেশির ভাগ পশুপাখির মধ্যে দেখবে স্ত্রী-পুরুষের শারীরিক মিলন ভালোবেসেই হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। শুধু কুকুর আর মানুষের মধ্যেই বোধহয় ধর্ষণের রেওয়াজও আছে। মানুষের মধ্যে যারা ভাগ্যদোষে কি সামাজিক শোষণে পতিতাবৃত্তি নিতে বাধ্য হয়, সেটা শুধু তাদেরই লাঞ্ছনা না, সমগ্র মানবসমাজেরই ক্যানসার। যা দেখছি, যত দেখছি, নারী-পুরুষের এই খাদ্যখাদক সম্পর্কের বিষ ততই আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শুনলে অবাক হবে আমাদের দেশে যত মেয়ে যে পরিস্থিতিতে এ পথে আসে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মেয়ে একই আর্থিক সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করতে বাধ্য হয়।’

কোজাগরী পূর্ণিমার দিন সকাল থেকে নন্দিনীর দু-চোখ বেয়ে জল ঝরতে থাকে। অদ্ভুত একটা স্বরে কাঁদতে কাঁদতে সে জেদ ধরল, তাদের আগের সেই গাছবাড়িতে সেদিনই তাকে নিয়ে যেতে হবে। পরীক্ষিতের পক্ষে সেদিন নিতান্ত অসম্ভব, পরদিনও তা-ই, অগত্যা লক্ষ্মীপুজোর দুদিন পরে এক বছরের মেঘাবৃতকে সরোজিনীর কাছে রেখে নন্দিনী পরীক্ষিতের সঙ্গে সাগরখাড়ি রওনা হল। স্টেশনের দিক থেকে রিকশায় নীলাঞ্জনা আসছে, নন্দিনীর মনে ভয়, তাদের যাত্রা পণ্ড হবে না তো! ওদের গন্তব্য শুনে নীলাঞ্জনা আবদার করে সে-ও গাছবাড়িতে যাবে।

সমুদ্রতীরে চিংড়ির জল নিংড়োনোর মেশিনের দুজন ছেলের একজন শুখা-চিংড়ির প্যাকেটের পাহাড় পাহারায় সেখানেই থেকে গেল, আরেকজন নৌকোয় তিনজনকে দ্বীপে পৌঁছে দিয়ে দ্বীপের সৈকতে নৌকো তুলে নৌকোতেই চিৎ হয়ে শুয়ে রইল।

সিঁড়ির দড়ি পচে গাছের গুঁড়িতে এক টুকরো লেগে আছে, সিঁড়িটা জোয়ারের সময় ভেসে গিয়ে একটু দূরে কয়েকটা গাছের গোড়ায় আটকানো। পরীক্ষিৎ নীলাঞ্জনা সিঁড়ি টেনে এনে গাছবাড়িতে লাগাল। ঝড়ে ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো ছড়ানো, তার মধ্যে জোনাকি রাখার মাটির প্রদীপটা খুঁজে পেয়ে নন্দিনী সেটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ কী ভাবল, তারপর, বালিসোনার বাড়ি থেকে বেরনোর পর এই প্রথম কথা বলল, ‘আমি এ ঘরে একটু একা থাকব।’

দ্বীপের সরু এক চিলতে সৈকত ছেড়েই জঙ্গলের শুরু। দিবাকরদের গাছবাড়ি অনেক পিছনে ফেলে পরীক্ষিৎ নীলাঞ্জনা ক্রমশ জঙ্গলের আরও গভীরে চলে এসেছে। এক জায়গায় পাতলা হয়ে আসা গাছপালার পরই দীর্ঘ কাশবন। ওপরে ছড়ানো মেঘের ফাঁক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের রাঙা আলো চুঁইয়ে পড়ছে।

এগিয়ে যাচ্ছে, না ফেরার পথ ধরেছে সে বিষয়ে কারও চেতনা নেই। ছিল স্নিগ্ধ কাশবন, এখন সামনেই মারাত্মক কেয়াঝোপ।

কেয়াঝোপ ঘেঁষে কিছুটা এগিয়ে পরীক্ষিৎ ধন্দে পড়ল- এবার কোনদিকে? নীলাঞ্জনা সঙ্গে নেই এতক্ষণ খেয়াল করেনি। পিছনে তাকিয়ে দেখল, অস্বাভাবিক বড় একটা মাদারিগাছের মোটা গুঁড়িতে হেলান দিয়ে নীলাঞ্জনা দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যায় অনেকক্ষণই সে পরীক্ষিতের চলে যাওয়ার দিকে অপলক চেয়ে আছে। তার মাথাটাও কন্টকাকীর্ণ গাছের গায়ে হেলানো, কিছুটা ডান কাতে। মুখে মাথার চুলে শেষ বিকেলের আলো অতি স্বচ্ছ রেশমফালির মতো লেগে আছে।

মাদারিগাছের লাল রঙের পাতলা ফুলের আকর্ষণে বালকবয়েসে পরীক্ষিৎ অনেকবার কাঁটার আঁচড় খেয়েছে। নীলাঞ্জনা জ্ঞানে আছে তো!

পরীক্ষিৎ কাছে এসে নীলাঞ্জনার মুখে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে দুহাতে মুখটা ধরে ধীরে ধীরে নিজের দিকে টেনে নিল।

‘তোমার জীবন থেকে আমি সত্যিই ঝরে গেলে তুমি হয়তো টেরও পাবে না পরীক্ষিৎ।’ এই প্রথম তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল পড়ল।

‘আমি তো জানিই না তুমি আমার সঙ্গে আসছ না।’

‘কী ভাবছিলাম জানো? তুমি যদি এই দ্বীপে আমাকে একা রেখে চলেও যাও, আমি পিছু ডাকব না।’

কথা শেষ হতে না হতেই পরীক্ষিতের বাঁ কনুই তুলে ধরে বলে উঠল, ‘এ কী! কাটল কী করে?’

‘কী জানি! হয়তো কেয়াপাতায়।’

‘এ তো রক্তের ধারা নামছে! চোষো, চোষো, চুষে নাও।’

পরীক্ষিতের দ্বিধা দেখে নীলাঞ্জনা হঠাৎই নিচু হয়ে রক্তরেখায় মুখ লাগিয়ে চুষতে শুরু করেছে।

পরীক্ষিৎ বলল, ‘সাপে কাটলে ওঝারা এভাবে বিষ ঝাড়ে দেখেছি।’

নীলাঞ্জনা মুখ তুলল। রক্ত বন্ধ হয়ে গেছে। বলল, ‘আমি তো তোমার বিষই ঝাড়লাম। তুমি আমাকে অমৃত দাও।’

সূর্য এখানে অনেকটা সময় নিয়ে অস্ত যায়।

তৃণশয্যায় নগ্ন যুগলমূর্তির ওপর দিয়ে একটা সাপ ধীরে ধীরে কখন একদিক থেকে আরেকদিকে চলে গেছে, দুজনের কেউই টের পায়নি।

ক্রমশ সূর্য ডুবে গেলে নারকেলবনের সারির ফাঁকে তখনও রঙিন আভা, পুবদিকে দ্বাদশীর সদ্যোজাত হালকা জ্যোৎস্না, দুজনে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে নীলাঞ্জনা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘চলো, ফিরে যাই। যাবে? সেই আমাদের তৃণশয্যায়? ওই আদিম জঙ্গল, প্রাণী বলতে শুধু আমরা- তুমি কী ভাবছ?’

‘ভাবব কী, আমার মন থেকে দুটো চোখ কিছুতেই মুছতে পারছি না। প্রথমে ভেবেছিলাম প্যাঁচা, পরে দেখলাম মানুষ। একটা লোক উবু হয়ে বসে চোখের সামনের লতাগুল্ভম দুহাতে সরিয়ে নিষ্পলক চোখে তোমাকে দেখছে, তুমি যখন উঠে দাঁড়িয়েছ তখনই প্রথম দেখলাম।’

পরীক্ষিৎ এবার সময় নিয়ে আবার বলল, ‘মানুষের শরীর বোধহয় মহাকাশের মতোই বিস্ময়কর।’

গাছবাড়ি খুঁজে পাওয়ার যেন তাড়া নেই, বড় বড় প্রাচীন সব গাছের বাধা পেরিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে আসার পথে নীলাঞ্জনা এবার বলল, ‘আজকের এই জঙ্গল, এই সন্ধ্যা তুমি ভুলে যাবে?’ কথাটা বলে পরীক্ষিতের মুখের দিকে চাইল।

বিলম্বিত জ্যোৎস্নায় অনেকক্ষণ অনুমানে অচেনা জঙ্গলে হাঁটার পর নীলাঞ্জনার সন্দেহ হল তারা পথ হারিয়েছে। পরীক্ষিতের মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।

দূর থেকে সমুদ্রের শব্দ শুনে নীলাঞ্জনা হঠাৎ বলল, ‘আমার একটা কথা মনে আসছে। অভাগা মেয়েদের উপযুক্ত পুনর্বাসনের জন্য দুনিয়া জুড়ে একটা আন্দোলন করা যায় না? একটা চিন্তার বিপ্লব?’

পরীক্ষিৎ অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘দিবাকরকে যারা খুন করল তারাও কি বিপ্লবই করছে?’

‘সে কি? কবে? ওকে কারা খুন করবে?’

আবার অনেকক্ষণ কারও কোনও কথা নেই, ডালপালা সরিয়ে পথ করার আওয়াজও ঝিঁঝিঁর একটানা তীক্ষ্ণ ডাকে চাপা পড়ে যাচ্ছে।

গাছবাড়ির কাছাকাছি এসে নীলাঞ্জনা জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছ বলো তো?’

‘ভাবছি এরপর কী? যা কিছু ঘটছে তার শেষ কোথায়?’

নন্দিনী ঘরের মধ্যে কারও সঙ্গে কথা বলছে। যে-ছেলেটা নৌকো বেয়ে কাল সকালে সৈকতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সে-ই হয়তো এসেছে। হয়তো দিবাকরের খবর চায়। পরীক্ষিৎ ঘরে ঢুকে দেখল, নন্দিনী কাঠের রং-চটা দেওয়ালের দিকে মুখ করে হাত মাথা নেড়ে একা একা কথা বলছে, ‘অত ঘন কোঁকড়া চুলে জোনাকির ঝাঁক বাসা বাঁধল কী করে? চুল যদি পুড়ে যায়? চুলের ছায়ায় তোমার মুখ ঢেকে যাচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি না গো।’

বালিসোনা থেকে আনা টিফিন ক্যারিয়ার খুলে নীলাঞ্জনা পুরি হালুয়া নিমকি সন্দেশ নন্দিনীকে দিতে এসে নিঃশব্দে তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

পরীক্ষিৎ গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘নন্দিনী! যেটুকু পারো খেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল ভোর-ভোর বেরতে পারলে ভালো হয়।’

নন্দিনী ঘোর ভেঙে পরীক্ষিতদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

সমুদ্রসৈকত ছেড়ে যাবার আগে, পরীক্ষিৎ চিংড়ি-মেশিনের ছেলেদুটির সঙ্গে কথা বলল। ছেলেদুটি জানাল, কাছাকাছি দোকান-বাজারে খুব সস্তায় সের দরে চিংড়ির প্যাকেট পৌঁছে দিয়ে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে তারা কোনওরকমে কাজটা চালু রেখেছে। লিওন যেমন বলে দিয়েছিল, পরীক্ষিৎ সেইমতো চিংড়ি মেশিনের ছেলে দুটিকে জানাল, এরপর থেকে দিবাকরের লিওনদাদা এই ব্যবসা দেখবে। শিগগিরই এসে টাকাও দিয়ে যাবে। বিপণনের ব্যবস্থাও করবে সে-ই।

‘দিবাকরদা আর আসবে না?’ এ প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে তিনজন নদী পার হয়ে গেল।

জুলাই মাসের গোড়ায় একদিন বেলাবেলি লিওনার্দো পরীক্ষিতের সঙ্গে এসে অসীম সৈকতের কোথাও শুখাচিংড়ির কারখানা দেখতে পেল না। সাগরখাঁড়ি জায়গাটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেই সৈকতটাই সমুদ্রে তলিয়ে গেছে দেখে কারখানার ছেলে দুটো হয়তো সাগরের আরও ভেতরের দ্বীপে, হয়তো দিবাকরের গাছবাড়িতে যন্ত্র তুলে নিয়ে গেছে- এমন অনুমান করে একটা জেলেডিঙিতে তারা দ্বীপের দিকে এগিয়ে চলল।

চারদিকে সমুদ্র, দ্বীপ কোথাও নেই।

তীর ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে এসে ডিঙি-বাওয়া জেলে সাগরে জাল নামিয়ে দিয়েছিল, বাবুদের কথা থেকে আঁচ পেয়ে বলল, ‘আপনারা কি কিছু খুঁজতে এয়েছেন বাবু?’

পরীক্ষিৎ বলল, ‘এখানে কোথাও একটা দ্বীপে একটা গাছবাড়ি ছিল না?’

‘এখনও আছে, জলের নীচে। গাছবাড়ির ভাঙা-পচা কাঠের টুকরা-টাকরা, সমসারের দু-একখানা সামগ্গিরি মাঝেমধ্যে জালে ওঠে।’

ফেরার পথে নদীর পাড়ে শুখাচিংড়ির ছেলে-দুটোর সঙ্গে হঠাৎ দেখা। পরীক্ষিৎদের সামনে ঝুঁকে করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘দিবাকরদা কবে আসবে?’

‘ইনি দিবাকরের লিওনদাদাবাবু। চিংড়িকারখানার জন্য কিছু টাকা এনেছেন।’

‘সে-কারখানা সাগর গিলে খেয়েছে বাবু। আমরা এখন সাপধরার কাজ করি। ওষুধকারখানায় সাপের বিষ সাপ্লাই দিই।’

আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসছে। লিওন ছেলেটার দিকে টাকা বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘এটা রাখো।’

‘দিবাকরদার সেই যন্ত্রই তো নেই, টাকা দিয়ে আর কী হবে বাবু!’

‘তবু রাখো। সাপধরা কিন্তু খুবই বিপজ্জনক, তোমরা তো বেদে নও। পারলে একাজ ছেড়ে অন্য কিছু করো।’

‘জন্ম থেকে আমাদের তো বাবু সাপ-খোপ নিয়েই জীবন কাটে। এই বর্ষাকালেই ফি বছর কত লোককে এখানে সাপে কাটে।’

ছেলে-দুটোকে দূরের নারকেলবনের দিকে হারিয়ে যেতে দেখে লিওন-পরীক্ষিৎও মেঘ-বিদ্যুৎ মাথায় নদী পার হতে এগিয়ে গেল।

২৬

বাদায় সকাল থেকে লোক আসার আর বিরাম নেই। বেলা যত বাড়ে ভিড়ও তত বাড়ে। যেখানে বুজকুরি কেটে জল উঠছে সকলেই সবার আগে সেই জায়গাটা দেখতে চায়।

জলের উৎসমুখ জলে ঢাকা, শুধু বুজকুরি উঠে বৃত্তাকারে জল বেড়ে চলেছে। হারানো নদীর খোঁজে বেশ কয়েকটা গর্ভীর গর্ত খোঁড়া হয়েছিল তারই কোনওটা থেকে হয়তো অবিরাম জল উঠছে।

জল যত বাড়ে, মানুষের আনাগোনাও তত বাড়ে। তৃতীয় সপ্তাহে অম্বরীশের কাটা খাত ধরে হঠাৎই একদিন উত্তরে দক্ষিণে জল ছুটতে লাগল। সাউথ উইন্ড টাউনশিপের গভীর করে খোঁড়া দীর্ঘ ভিতও আর আলাদা করে বোঝা যায় না।

সারাদিনের কাজের শেষে চারজন মাটি-তোলা শ্রমিক গর্তের ঠান্ডায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, তিনদিন পর আবার তাদের জলে-ফোলা শবদেহ পাওয়া গেল বালিসোনার পাঁচ গ্রাম পরের সোনাগুঁড়া গ্রামের নারকেললসারির নীচে যেখানে বহু যুগ পরে শীর্ণকায় নদী হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসে আছড়ে পড়েছে।

‘বলা নেই কওয়া নেই, এমন কৌশিকী ষাঁড়াসাড়িঁর বান এল কোত্থেকে?’ বালিসোনার বয়োবৃদ্ধদের মনে ভয়, অল্পবয়সিদের মনে উত্তেজনা। অশুভ সংকেত ধরে নিয়ে গৃহবধূরা পুজো দেয়। বান যদি, তবে আর নামে না কেন- তা নিয়ে পথে-ঘাটে, মাঠে-বাজারে আলোচনা তর্কাতর্কি দিনে দিনে বেড়ে চলল।

অম্বরীশের কাগজপত্রের মধ্যে পাওয়া ঘাটের ধ্বংসাবশেষের নকশা ও অবস্থান অনুযায়ী একটা ঘাট নির্মাণ করা হবে, পরীক্ষিৎ তার সাধ ও কল্পনা মতো শহর থেকে সাদা পাথরে ‘মিতাম্ববþ শাখানদী’ লিখিয়ে একটা স্তম্ভের গায়ে বসাচ্ছে, পর পর তিনটে জিপে পুলিশ ও দুটো অ্যাম্বাসাডরে কয়েকজন সরকারি অফিসার এসে কাজ থামাবার নির্দেশ দিল। একজন সরকারি অফিসার পরীক্ষিতের সামনে এসে কড়া স্বরে বলল, ‘এ জমি সরকারি, সরকার লিজ দিয়েছে। অন্য কেউ এখানে কিছু করার চেষ্টা করলে সেটা আইনের চোখে অপরাধ, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’

একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে একটা অস্পষ্ট কার্বন কপি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আর এক মিনিট এখানে থাকলে এই কোর্ট অর্ডার অনুযায়ী আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হব।’

সরকারি অফিসারদের আরেকজন যোগ করল , ‘আপনার মতো শিক্ষিত মানুষ ভুললেন কী করে সরকারের জমিতে বিনা অনুমতিতে কিছু করা যায় না!’

‘এ তো জমি না, নদী!’

‘নদীর নীচেই জমি আছে।’

‘ভুল। জমির নীচে এই নদী প্রাচীন কাল থেকেই ছিল। মানুষই তাকে মাটি চাপা দিয়েছে।’

‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট! চলুন, আমার সঙ্গে থানায় চলুন, কাল আপনাকে কোর্টে প্রডিউস করা হবে।’

আসামীকে জিপে তুলে কিংসাইজ সিগারেট ধরিয়ে অভ্যাসবশে দু-হাতের তালুতে গাঁজার কলকের মতো ধরে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পুলিশ অফিসার না বলে পারল না, ‘আপনাদের মতো চিন্তাশীলদের জন্যই আজকাল পুলিশের কাজ বেড়ে গেছে! সেবার তো দেখলেন, বেশ্যাপাড়ায় রেইড করে কিছু পাওয়া গেল?’

পরীক্ষিৎ এতক্ষণে চিনেছে, এ সেই ও-সি, যে নন্দিনীকে জেরায় নাস্তানাবুদ করে তুলেছিল। নীলাঞ্জনাকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমপাড়ায় সাজানো রেইডে গিয়েছিল!

দুপুর থেকে বসিয়ে রেখে সন্ধে নাগাদ একজন কনস্টেবল এসে পরীক্ষিৎকে জানাল বড়বাবু বলে পাঠিয়েছেন আপনি বাড়ি চলে যেতে পারেন।

নদীর নামকরণ ও ঘাট নির্মাণে সরকারি বাধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য পরীক্ষিত থানা থেকে লক্ষ্মী-লিওনের বাড়ি গিয়ে দেখল শিবকৃষ্ণের সাধনসঙ্গী উমাশশীও এসে বসে আছে। সকলের মুখ থমথমে, উমাশশীর বাড়িতে আজ সকাল থেকেই অরন্ধন।

শিবকৃষ্ণ-প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ে নীলাম্বরের ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই, লিওনদের স্কুল পুরোপুরি আবাসিক, তার মা তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না, ফলে সেখানেও সে ভর্তি হতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মিউনিসিপ্যালিটির ফ্রি স্কুলে নাম লেখাতে হয়েছে। তার এমন ভয়ানক দাম দিতে হবে কেউ ভাবেনি।

দাম শুনে পরীক্ষিতের মুখও অন্ধকার।

‘জানেন ভাই, কী হয়েছে? কী আর বলব দাদা, আপনাদের?’ -বলে উমাশশী উদ্বেগভরে বলে চলল, ‘কাল স্কুল থেকে ফিরে নীলাম্বর আমাকে কী বলল জানেন? বলল- ‘আমার ফিতে’ ইংরিজিতে কী মা? আমি যখন জানতে চাইলাম, তোকে এসব কে বলেছে? তখন কী বলল আপনারা ভাবতে পারবেন না। বলল ওদের স্কুলের দু-ক্লাস উঁচুতে কে এক হলধরদা আছে, সে আমাদের স্কুলের ক্লাস টেনের মেয়েদের আমার ফিতের ইংরিজি জিজ্ঞেস করতে বলেছে। আরও এরকম কী কী শিখছে ভগবান জানেন! আমি আজ রান্নাঘর খুলিনি, ওকে স্কুলেও যেতে দিইনি।’

সকলেই পরস্পরের দিকে চিন্তিত চোখে তাকায়। পরীক্ষিৎ শোক পালনের নীরবতা ভেঙে হঠাৎ স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, ‘কী অপরূপ আদিগন্ত ধানখেত ছিল এখানে। ধানখেতের ঢেউ লেগে লাল টালির বাড়িটা যেন আবেশে দুলত। সেসব কোথায় গেল!’

লক্ষ্মীদি ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘সত্যি রে, পরীক্ষিৎ। কত পাখি আসত এখানে, আর আসে না।’

‘লক্ষ্মীদি, তোমার মনে আছে, মিতার সঙ্গে এখান থেকে চলে যাবার পরও আমি যখনই আসতাম ফিরতে চাইতাম না!’

উমাশশী উদ্বেগ আর ধরে রাখতে পারল না। লিওনের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনাদের স্কুলে এখন আর ভর্তি হওয়া যায় না? হোস্টেলে থেকেই না-হয় পড়ুক। ছেলে তো মানুষ হবে। ওকে বাড়িতে রাখতে আর ভরসা পাচ্ছি না। ছি ছি!’

লক্ষ্মী আশ্বাস দিল, ক্লাসের সিট ও হোস্টেলের ব্যবস্থা দেখে কিছু একটা নিশ্চয়ই করা যাবে।

বাবার সারা জীবনের স্বপ্নের সঙ্গে মায়ের নাম জুড়ে দেবার ইচ্ছে থেকে নতুন এই আঞ্চলিক নদীর নাম ‘মিতাম্বর শাখানদী’। এ নাম লক্ষ্মী লিওন অবনীমোহন সরোজিনী সকলেরই পছন্দ। ঘাট নির্মাণের বাধা দূর করতে অন্যদের সঙ্গে মেজো জ্যাঠাবাবুরও পরামর্শ নেওয়া হল। সেজোজ্যাঠা ও তার দলনেতাদের প্রতিরোধ সত্ত্বেও ঐতিহাসিক ঘাট নির্মাণের পক্ষে বালিসোনার মানুষের সাত হাজার স্বাক্ষর ও তেরো হাজার টিপ সই পুরসভায়, পুরমন্ত্রণালয়ে, স্বরাষ্ট্র দপ্তরে জমা দিয়ে সরকারকে অনুমতি দিতে বাধ্য করা হল।

জল একইভাবে বেড়ে চলেছে। সাউথ উইন্ড টাউনশিপের যেটুÅকু বা কাজ হচ্ছিল, তার সবটাই জলের তলায়। কপিখেতের যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতিফলকের ডগাটুÅকু শুধু জেগে আছে।

দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় পরীক্ষিৎ নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়। কখনও নির্মীয়মাণ ঘাটের দেওয়ালে মাথা রেখে বহু দূরের দিকে চেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মাথা একপাশে ঢুলে পড়েই সোজা হয়ে যাচ্ছে দেখলে বোঝে দু-চার মিনিট ঘুমিয়েও পড়েছিল।

সমুদ্রে সাংঘাতিক জলোচ্ছ্বাসের বিস্তারিত খবর বালিসোনায় পৌঁছল ঘটনার অনেকদিন পর। কুড়ি-পঁচিশ ফুট উঁচু ঢেউয়ের তোড়ে তীরের চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে গ্রামের পর গ্রাম চিরতরে তলিয়ে গেছে। সরকারি হিসেবে মানুষ মারা গেছে তিনশো সাতান্ন জন। নিখেঁাজের সংখ্যা চার হাজার। তাছাড়া এগারটা নদী-শাখানদী-উপনদীর গতিপথ কম-বেশি বদলে গেছে। তার সঙ্গে বালিসোনা নদীর পুনর্জন্মের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও যোগসূত্র আছে কিনা সেটা এখনও জানা যায়নি। লিওনের মতে ইন্দোনেশিয়ায় বালিদ্বীপের হোলিস্প্রিং মন্দিরের কুন্ড যেমন অবিরাম পাতাল ফুঁড়ে ওঠা জলেরই সৃষ্টি, এ-ও হয়তো তেমনই, পাতাল-নদী। কে একজন বলল, পাতালগঙ্গা নয় তো?

একদিন গোধূলিতে গাছের মোটামোটা ডাল বেঁধে তৈরি নৌকোর মতো একটা জলযান অসমাপ্ত ঘাটে এসে নোঙর করল। জোর বাতাসে ফুলে-ওঠা খুব উঁচু পালের নীচে দু-পাশের দুই গুঁড়ির ওপর পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে রোগা ঢ্যাঙা একটা লোক। বয়স চল্লিশ হতে পারে, ষাটও হতে পারে, সঠিক আন্দাজ করা যায় না। দুই গুঁড়ির মাঝখানের বিরাট ফাঁকা জায়গা থেকে জল ছিটকে উঠে লোকটার প্যান্টের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। গায়ে নানা রঙের ছিটকাপড় জোড়া দেওয়া ঢিলে-ঢালা জ্যাকেট, মাথায় বেতের ছুঁচলো টুপিতে ময়ূরের পালক গোঁজা, কোমরে তলোয়ারের মতো কাঁচা কাঠের দিশি বেহালা ঝুলছে।

পালতোলা, অথচ নৌকোও ঠিক না, অদ্ভুত চেহারার এই বাহন বালিসোনায় কেউ কখনও দেখেনি। নৌকো থেকে নেমে লোকটি অসমাপ্ত সিঁড়ির ঢাল বেয়ে পরীক্ষিতের সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘স্বর্গত অম্বরীশ চৌধুরীর বাড়ি কোন দিকে বলতে পারেন ভাই?’

পরীক্ষিৎ চমকে উঠে দাঁড়ায়। লোকটার টুপির পিছনে আকাশ রাঙিয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, ফলে তার মুখ আরও অস্পষ্ট, প্রায় অন্ধকার, পরীক্ষিৎ সম্পূর্ণ সংশয়াচ্ছন্ন মনে নিয়ে জানতে চাইল- ‘আপনি কে? কোথা থেকে আসছেন? আপনার নাম কী? কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন?’

‘আসছি নেগম্বো থেকে। না, না, নিকোবর থেকে, এটাও ভুল বললাম, আসছি ফিফি দ্বীপ থেকে। হয়তো এটাও ভুল। এই আজকাল আমার হয়েছে, সবসময় সব কিছুর নাম ভুলে যাই। মনে পড়েছে, এখন আসছি রাশিয়ার মারস্মার্ক বন্দর থেকে, না কী, কে জানে- হয়তো ব্লাডিভস্টক থেকে। দূর ছাই, হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে- এখন আসছি ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের ফোতোভেনতুরা থেকে। মুশকিল কী জানেন, যত বলি ততই ভুল বলি। ধরে নিন চূর্ণী বা জলঙ্গী নদী থেকে আসছি। কোত্থেকে আসছি-র থেকে, কোথায় এলাম অনেক বড় ব্যাপার। তার চেয়ে বড় কথা, আমার নাম বীরবল বিদুষক, না, না, আলাউদ্দিন খিলজি, দূর ছাই, মনে পড়ে না কেন? আমার নাম কী জানেন? চেঙ্গিস খান, নাকি কুবলাই খান, না না, আমার নাম কলম্বাস, এও বোধহয় ভুল বললাম, আমার নাম কি তবে আলেকজান্ডার, নাকি হিউয়েন সাং? ভাস্কো ডা গামা বলেছি নাকি? আমার নাম মনে হয় আলেকজান্ডারই হবে। সবচেয়ে বড় কথা আমি জাহাঙ্গীরসাহেবের নোকর। এখন বলুন তো স্বর্গত অম্বরীশ চৌধুরীর বাড়ি কোন দিকে?’

কথা বলে শরীর দুলিয়ে-দুমড়িয়ে, সামনে-পিছনে ঘন ঘন ঘাড় ঝাঁকিয়ে। তারই ফাঁকে ফাঁকে অস্তগামী সূর্যের মেঘফাটা আলো হঠাৎ হঠাৎ পরীক্ষিতের চোখের ওপর ঝাঁপায়। লোকটার কোমরের বেহালার সঙ্গে প্যান্টের ঢোলা পকেটের কঠিন কিছুর ঠোকাঠুকি পরীক্ষিতের কান এড়াল না।

‘আমার সঙ্গে আসুন। অম্বরীশ চৌধুরী আমার বাবা। জাহাঙ্গীরসাহেব এখন কোথায় আছেন?’

টুপিটা একবার খুলে জোরে জোরে তার ভেতরে বার-কতক ফুঁ দিয়ে আবার পরে নিয়ে হাতের বিচিত্র ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে আলেকজান্ডার বলল, ‘তিনি এখন রেকিয়াভিক, না না, নানোরতালিকে তাঁর সাগরবিবির সঙ্গে নিদ্রা গেছেন। ভুল, একদম ভুল বলেছি। তিনি একটা অন্ধ ছেলেকে নিয়ে লন্ডনে চোখের হাসপাতালে দিন-রাত্তির এক করে দিচ্ছেন। ভুল নাকি? এটাও কি ভুল বললাম? মনে পড়েছে, তাসিলাকের পথে প্রচণ্ড ঝড়ে জাহাজডুবি হতে হতে বেঁচে গিয়ে তিনি জাহাজের ছাদে বসে বালিসোনার নকশা আঁকতে লেগেছেন। না না, এই ঠিক মনে পড়েছে- জলদস্যুদের আক্রমণে বিধ্বস্ত একটা জাহাজ থেকে একটা মেয়েকে উদ্ধার করতে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছেন। এই এক মুশকিল। যত বলি তত ভুল বলি। এই দেখুন না, ‘দরিয়াবিবি’ বললাম তো-?’

‘সাগরবিবি বলেছেন?’

‘সাগরবিবি ভুল, দরিয়াবিবি ঠিক।’

টুপি খোলার সময় পড়ে যাওয়া ময়ূরের পালক ফিরিয়ে দিয়ে পরীক্ষিৎ বলল, ‘দরিয়াবিবি কে?’

‘সম্রাট জাহাঙ্গীরের যেমন নূরজাহান, জাহাঙ্গীরসাহেবের তেমনই দরিয়াবিবি।’

‘জাহাঙ্গীরসাহেব বলেছিলেন, তিনকুলে ওঁর কেউ নেই-’

‘কুলে তো নেই, সমুদ্রে আছে। আমিও সমুদ্র থেকেই আসছি। আপনাকেই আমার দরকার।’

বাড়ি পর্যন্ত এসে প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে পরীক্ষিতের হাতে দিয়ে বাক্সের গায়ের লেখাটা দেখিয়ে বলল, ‘এই যে দেখছেন আইসল্যান্ড লেখা, এদিকে আইসল্যান্ডের মাটি, আর ওপাশে গ্রিনল্যান্ড লেখাটা দেখেছেন? ওদিকে গ্রিনল্যান্ডের মাটি, মাঝখানে পার্টিশান। এই মাটি আপনার বাবার কবরে ছড়িয়ে দেবেন। জাহাঙ্গীরসাহেব নিজে আসতে পারলেন না, তাই আমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।’

কথাটা বলেই লোকটা সোজা উল্টো মুখে হন হন করে ঘাটের পথে হাঁটা লাগাল।

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, আজকের রাতটা এখানে থেকে যান।’ বলতে বলতে পরীক্ষিৎ দৌড়ে গিয়ে তার হাত ধরার আগেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, অসমাপ্ত সিঁড়ির ধাপে তার কপাল ঠুকে গেছে। নির্জন সন্ধ্যায় নদীর হাওয়ায় এমন গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল তার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া যেসব কথা লোকটা বলল সেসব তো সত্যিও হতে পারে, অথচ আইসল্যান্ড-গ্রিনল্যান্ডের মাটির অংশটা বাদে পরীক্ষিৎ কোনওটার বিন্দুবিসর্গ জানত না। তবে এই যে বলে গেল- তার ওই অদ্ভুত নৌকোটা আসলে ক্যাটামেরন, তামিল ভাষায় ক্যাটা মানে গাছ আর ম্যারন মানে বাঁধা, এখন মনে পড়ছে পরীক্ষিত সেটা অম্বরীশের লংকাদ্বীপের কাগজপত্রের মধ্যে দেখেছিল। সেখানে ক্যাটামেরনের একটা স্কেচও ছিল। বড় বড় গাছের ডাল বেঁধে নৌকোর মতো একটা যান। তাহলেও কি এটাকে স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে! ওর অনেক কথাই তো পরীক্ষিৎ আগে কারও কাছে শোনেনি! আবার স্বপ্নই যদি না হবে তাহলে সেই কাঠের বাক্স কোথায় গেল? আর সেই অদ্ভুত ক্যাটামেরন? নদীতে নৌকো বাওয়ার মতো জলই তো নেই!

২৭

বালিসোনায় প্রতিবছর শীতকালে কুয়াশা যেন বেড়েই চলেছে। এরকম এক শীতের কুয়াশা ঢাকা ভোরে চৌধুরীবাড়ির দরজার ভারি কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। এবারও জাহাঙ্গীর। সঙ্গে লজ্জাবতী-ময়নামতীর সেই জন্মান্ধ ভাই।

জাহাঙ্গীর জানাল, ছেলেটাকে নিয়ে যাবার পর থেকেই তার জীবনে অনেক শুভ ঘটনা ঘটছে। সে জন্য আজন্ম নামহীন ছেলেটার নাম রেখেছে শুভ।

শুভ ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আমার দিদিরা কেমন আছে? আমি দিদিদের কাছে একবার যাব। দুজনের জন্য অনেক কিছু এনেছি।’

পরীক্ষিৎ জাহাঙ্গীরকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি কাঠের বাক্সে দু-দেশের মাটি নিয়ে এসেছেন? ডালায় দু-দেশের নাম পাশাপাশি লেখা?’

‘আশ্চর্য! আশ্চর্য! তুমি কী করে জানলে? তুমি কি আল্লার দূত? আল্লার করুণা তুমি পেয়েছ?’

দুদিন পরে অম্বরীশের মৃত্যুদিনে তার সমাধিতে পরীক্ষিৎ পারমিতা ও তাদের অনুরোধে জাহাঙ্গীর প্রথমে আইসল্যান্ডের, পরে গ্রিনল্যান্ডের মাটি ছড়িয়ে দিল। অবনীমোহন সেদিন ভোর থেকেই ভাইয়ের সমাধির পাশে বসে দীর্ঘক্ষণ ধ্যানে কাটাল। সরোজিনী প্রতিবারের মতো ফুল ছড়িয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে যাবার সময় নন্দিনীর ছেলে মেঘাবৃতর কচি হাতে কয়েকটা ফুল গুঁজে দিয়ে গেল। লিওনার্দো নিজের বুকে ক্রশ এঁকে তাদের মেয়ের দু-হাতের ফুল কবরের ধারে ছড়ানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত লক্ষ্মীকে হাতের আড়াল দিয়ে হাওয়া বাঁচিয়ে পর পর অনেকগুলো ধূপকাঠি ধরাতে সাহায্য করে।

আগের দু-রাতের মতো রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর পরীক্ষিৎ জাহাঙ্গীরকে অতিথিকক্ষে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবার সময় জাহাঙ্গীর তাকে বসতে বলল।

‘বালিসোনার কথা কিছু ভাবছ? এখানকার নতুন নতুন দোকান-বাজার বা ব্যবসা-বাণিজ্যের বদলে যাওয়ার ধরন আর চাষের জমির ব্যবহার- এই দুটো বিষয় নিয়ে ভাবো, দ্যাখো কিছু করা যায় কি না। আল্লাহ যখন নদী ফিরিয়ে দিয়েছে তখন এখানকার মাটিতে মানুষের মনও হয়তো নতুন করে গড়া যাবে। অম্বরীশের স্বপ্ন ছিল বিরাট, জীবন ছিল ছোট। সে নদী এনেছে, তুমি মানুষ আনো।’

পরীক্ষিৎ সোফায় বসে মুখ নিচু করে শুনছিল। মাথা তুলে বলল, ‘দরিয়াবিবি আপনার কে হয়?’

‘দরিয়াবিবি?’

‘সম্রাট জাহাঙ্গীরের যেমন নূরজাহান, আপনার তেমনই দরিয়াবিবি, তাই তো? আপনি বলেছিলেন, আপনার কেউ নেই।’

‘দরিয়াবিবি, নূরজাহান- এসব কী বলছ তুমি?’

‘আলেকজান্ডার নামে আপনার কোনও কর্মচারী আছে?’

জাহাঙ্গীর বিছানায় বসে কথা বলছিল, লাফিয়ে উঠে বলল, ‘আলেকজান্ডার? কী ব্যাপার বলো তো? আমার একজন কর্মচারী ছিল, তার নাম আলালুদ্দিন। একবার মাঝসমুদ্রে জাহাজডুবি হতে হতে বেঁচে ফিরি, ও আর ফিরতে পারেনি।’

‘দরিয়াবিবি বা সাগরবিবি বলেও কি কেউ নেই?’

‘এসব নাম তুমি পেলে কোত্থেকে? সাগর, দরিয়া- আমার তো কোনও বিবিই নেই। তবে একজন ছিল, সে আমার কেউ না, আলালুদ্দিন তাকে বুয়েনস-বিবি বলত।’ খানিক চুপ থেকে জাহাঙ্গীর আবার বলল, ‘আমার জীবনে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে, সমুদ্রে অনেক আশ্চর্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে কিন্তু সান্দ্রা আরান্দার সঙ্গে আলালুদ্দিনের প্রেম দেখে ভেবেছি এ কী করে সম্ভব? ওই একবারই আমি আমার জীবন নিয়ে আফশোস করেছি! উন্মাদ সমুদ্রঝড়ে মারাত্মক বিদ্যুৎচমকের মতো ওই একবারই আমার হৃৎপিণ্ড চলকে উঠেছিল! আর্জেন্টিনার মেয়ে, জলদস্যুদের হঠাৎ হানায় জাহাজের প্রায় সবাই যখন হয় মৃত, নয় বন্দী, তখন সে জলে ঝাঁপ দেয়। আমিই তাকে আল্লার কৃপায় উদ্ধার করি। আমার জাহাজ থেকে সমুদ্রে জোডিয়াক নামিয়ে আলালুদ্দিনকে দায়িত্ব দিই সবচেয়ে কাছের বন্দরে নিয়ে যেতে। যতদিন না তার দেশের আপনজনদের সন্ধান মেলে ততদিন সেই বন্দরশহরে তার থাকার ব্যবস্থা করে দিই। দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিলাম আলালুদ্দিনকে। হয়তো জোডিয়াকে তুলে নেবার পর থেকেই আলালুদ্দিন ওর প্রেমে পড়ে যায়। সান্দ্রাকে সে বুয়েনস-বিবি বলত। আলালুদ্দিনের মৃত্যুর খবর পেয়ে সান্দ্রা সেই যে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিল, চার মাস পর মারা যাবার আগে পর্যন্ত তাকে আর কিছু খাওয়ানো যায়নি। ওষুধও না।’

আবার চুপ। এবার বলল, ‘তুমি বালিসোনার কথা ভাবো। আমার দিক থেকে সবরকম সাহায্য তুমি পাবে। চালুÅ লাইনসুদ্ধু জাহাজ বিক্রি করেও আমি চলে আসতে পারি। আমার জীবনে ওই একজনই বন্ধু- অম্বরীশ।’

লজ্জাবতী-ময়নামতী ভাইকে এরকম পরিবেশে আসতে দেবে কিনা তা নিয়ে পরীক্ষিতের মনে সংশয় ছিল। প্রসঙ্গটা তোলবার আগেই বালিসোনায় ভাই এসেছে শুনে দুই বোন আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

পরীক্ষিৎ তবু বলল, ‘ভাইয়ের সঙ্গে কোথায় দেখা করতে চাও?’

‘আমাদের তো কোথাও যাবার উপায় নেই, ওকেই এখানে নিয়ে আসুন। একবার অন্তত চোখের দেখা দেখে নিই।’

শুনে শুভরও আর তর সয় না। বেলা থাকতে থাকতে পরীক্ষিতের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল।

মুখে পুরু পাউডার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, ঝলমলে শাড়ি-ব্লাউজে সেজে তার দিদিরা দরজার বাইরে কেন দাঁড়িয়ে আছে ভেবে না পেয়ে শুভ দুজনের হাতে গার্নেটের লাল টকটকে বালা তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আমি আসব বলে তোমরা এমন সেজেছ?’

‘তুই দেখতে পাস? তুই আমাদের দেখতে পাচ্ছিস? মা গো!’

প্রথম বাক্যটা লজ্জাবতীর। দ্বিতীয়টা ময়নামতীর। ‘মাগো!’ দুজনের একসঙ্গে কঁকিয়ে ওঠা।

‘এটা খুব বিচ্ছিরি জায়গা! ফিশিং-হারবারের মতো আঁশটে গন্ধ!’ শুভর মুখ থেকে সব খুশি নিমেষে মুছে গেল।

দুই বোন গলা চিরে চেঁচিয়ে উঠল- ‘ওকে এখানে আনলেন কেন?’

‘তোমরাই তো বললে।’

‘ও যে দেখতে পায় বলেননি তো?’

‘এখন চোখে দেখতে পাচ্ছে বলে তোমরা খুশি হওনি?’

এক মাঝবয়সি মাতাল ‘লজ্জাবতীর লজ্জা ভাঙতে এয়েচি গো!’ বলতে বলতে ময়নামতীর চিবুক ধরে আদর করতেই ময়নামতী পিছন ফিরে মুখ আড়াল করল।

‘দিদি গো! কী মুখ দেখলাম তোমাদের। জীবনে প্রথম তোমাদের দেখলাম। এই তোমাদের বাড়ি? এখানেই তোমরা থাকো?’ বলতে বলতে শুভ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।

রাতে অতিথিকক্ষে ঘটনাটা শুনে জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে ধীরে ধীরে বলল, ‘এ তো একটা মাত্র ঘা, গোটা শরীরের রক্তই যেখানে দূষিত, সেখানে শরীরের নানা জায়গাতেই বিষ শুধু ফুটে বেরবার অপেক্ষা। কথাটা সবাই মিলে ভাবো। বালিসোনায় কবি, শিল্পী, ভাবুকের তো অভাব নেই।’

যেদিন কোনও রাজনৈতিক দলের মিছিল বা জনসভা নেই সেরকম একটা রবিবার দেখে রাসমাঠে বালিসোনা-মঙ্গলমঞ্চের সমাবেশ ডাকা হল। হাতে আড়াই সপ্তাহ সময়, তার মধ্যে সভার পরিকল্পনা ও প্রচারের সব কাজ শেষ করতে পরীক্ষিৎরা সকলেই হাত লাগাল। সমাবেশে বালিসোনার মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন অবনীমোহন, লক্ষ্মী, লিওনার্দো, প্রদীপ, পরীক্ষিৎ, পারমিতা, অম্বরীশের বন্ধু হিসেবে জাহাঙ্গীর, তাছাড়া আরও কয়েকজন বিশিষ্ট কবি, অধ্যাপক ও চিন্তাশীল মানুষ। নন্দিনী ওদিন কিছু বলতে চায়, তাকে বোঝাতে হল এখনও তার শোকের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে, এখনই তার জনসমক্ষে কিছু না বলাই ভালো, তার বক্তব্য অন্যরা তো বলবেনই। সরোজিনীর মঞ্চে বলা অভ্যেস নেই, নেপথ্যে থেকে পুরো অনুষ্ঠানের দেখভাল করার দায়িত্ব তার।

সমাবেশের লোকসংখ্যা আগের শোভাযাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেল। নানা দিক থেকে আলোচনার পর ঠিক হল বালিসোনার মানুষের দুঃখদুর্দশা দূর করার জন্য দৈনন্দিন যা কিছু করণীয়, পুলিশ, প্রশাসন ও মঙ্গলমঞ্চকে একসঙ্গে বসে তা স্থির করতে হবে। মঙ্গলমঞ্চের মতে, বালিসোনাকে অশুভের প্রভাব-মুক্ত করতে প্রথমেই তিনটি ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হোক। একদিকে নতুন নতুন দোকান-বাজার ব্যবসা-বাণিজ্যের নৈতিক-সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, আরেকদিকে চাষের জমির ন্যায্য ও মানবিক ব্যবহার। তৃতীয় সমান গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র- ভয় ও দারিদ্র্য থেকে বালিসোনার সব শ্রেণীর মানুষের মুক্তি। এইসব কাজে বালিসোনা মঙ্গলমঞ্চ থেকে যখন যে ন্যায়-নীতির বিধান দেওয়া হবে, স্থানীয় প্রশাসনকে মেনে চলতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোও এর বিরোধিতা করতে পারবে না। আপাতত মঙ্গলমঞ্চের একটি অস্থায়ী কোর কমিটি… ঘোষণা শেষ হবার আগেই বিস্ফোরণের শব্দে ধোঁয়ায় আর্ত চিৎকারে বালিসোনার ঐতিহাসিক সমাবেশ ছত্রখান হয়ে গেল।

সেদিনই বেশি রাতে সেজোভাই আনন্দমোহন বাড়ি ফিরেই অবনীমোহনকে ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘তোরা কী মনে করিস- প্রশাসন গাঁজাখোরদের আসর? নাকি ছোকরা কবিদের বাসর?’

অবনী শান্ত স্বরে জানতে চাইল, ‘এসব কথা উঠছে কেন?’

‘উঠছে এই জন্য যে তোরা প্যারালাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালাতে চাস! এ আমরা কিছুতেই সহ্য করব না।’

কথার সঙ্গে মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে, অবনীমোহন ভ্রু কুঁচকে চুপ করে রইল।

যেতে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে আনন্দমোহন কৈফিয়ত চায়, ‘পরীক্ষিৎ, প্রদীপ, রাঙাবউ, লক্ষ্মী, লিওনরাই বা এসবের মধ্যে যাচ্ছে কেন? দেশের ব্যাপারে কিন্তু বিদেশিদের নাক গলানো সহ্য করা হবে না!’

অবনীমোহন এবারও শান্ত স্বরে বলল, ‘এর মধ্যে বোমা-বারুদ আসছে কী করে সেটা তো আগে ভাবা দরকার।’

বিস্ফোরণের ঘটনায় পরীক্ষিতের মন বিষাদে ছেয়ে গেছে। মঙ্গলমঞ্চের পথে কোথাও শেষ পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে কিনা সে-বিষয়ে তার মনে ঘোর সন্দেহ।

রথের মেলায় শুভকে পঞ্চমুখী বাঁশের বাঁশি কিনে দেবার শপথ ভেঙে রথের চার মাস আগেই সে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। এবার সেও সমুদ্রে যাবে।

বাঁশির কথা শুভরও আর মনে নেই। বেশিরভাগ সময় সে জাহাজে তার ছোট্ট কুঠুরিতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, নয়তো পিছনের ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে অনন্ত জলরাশির দিকে চেয়ে থাকে। যখন কাঁদে, তখন কখনও কখনও পরীক্ষিৎ এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। জাহাজ গভীর সমুদ্রে না পড়া পর্যন্ত এভাবেই নির্বাক তার দিন কাটে। গার্নেট কেটে বালা তৈরির কাজ আবার শুরু করার দিনও মাঝে মাঝেই মেশিনে মাথা রেখে তাকে কাঁদতে দেখে জাহাঙ্গীরও এসে তার মাথায় হাত রাখে। কোণের টেবিলে গার্নেট পালিশ করা থামিয়ে প্রৌঢ় ইংরেজ কারিগর বলে, ‘হি মাস্ট হ্যাভ লস্ট সামওয়ান ভেরি ডিয়ার টু হিম।’ একটু পরে আবার বলে, ‘আই কুড ফিল হিজ সাফারিং। গত বছর লন্ডন টিউবে বিস্ফোরণে স্ত্রী-কন্যা দুজনকেই হারিয়েছি আমি।’

পরীক্ষিতের স্বপ্নের কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায়, জাহাঙ্গীরকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘শুভকে আপনি লন্ডনের আই হসপিটালে অনেকদিন ধরে চিকিৎসা করিয়ে ছিলেন, না?’

জাহাঙ্গীর মাঝসমুদ্রের মতো স্থির দৃষ্টিতে পরীক্ষিতের দিকে চেয়ে থাকে।

বালিসোনায় মিথ্যার মহামারী থেকে পালিয়ে দেশে-দেশে মানুষের জীবন দেখে বেড়ানোর স্বপ্ন পরীক্ষিতের মনে দিনে-দিনে ফিকে হয়ে আসছে। জাহাঙ্গীরের অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার মালবাহী জাহাজে এই সমুদ্রযাত্রার কোনও মিল নেই।

ওপর তলায় ছ’টা একশয্যার এয়ার কন্ডিশানড কেবিনের চারটেয় তারা থাকে। বাকি দুটিতে কখনও কখনও বিশিষ্ট দুয়েকজন যাত্রীও নেওয়া হয়। তারা মন্ত্রীও হতে পার, মাফিয়াও হতে পারে। একবার এক আরবদেশের রাজা গণআন্দোলনের চাপে শুধু তাঁর কনিষ্ঠ বেগমকে নিয়ে গোপনে দেশত্যাগ করে এই জাহাজেই বেশ কয়েকদিন ছিলেন। সেসময় জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মগোপনে নানা ভাবে সাহায্য করেছিল। তাঁর শোক লাঘব করতে কোমল শয্যা ও বিবিধ সুখাদ্যের ব্যবস্থা করেছিল। পালকের চেয়েও হালকা চিনদেশের রেশমসুতোর লেপ আর আর্জেন্টিনার বিফের স্টেক বিষাদগ্রস্ত বেগমসাহেবার আহারে-শয্যায় অরুচি নাকি কিছুটা হলেও কাটিয়ে দিয়েছিল। সেই উপকারের কথা রাজা ভোলেননি। তাঁর বর্তমান আবাস স্পেনের গ্রানাডার কাছে আলমেরিয়া উপসাগরের তীরে আলমেরিয়া বন্দর থেকে যখনই তাঁর কোনও না কোনও জাহাজ জাহাঙ্গীরের সমুদ্রপথ দিয়ে যায় তখন ক্যাপ্টেনের হাতে তিনি জাহাঙ্গীরের জন্য অতি মূল্যবান সব উপহার পাঠান। জাহাজের ব্যবসার বীজও তিনি নাকি জাহাঙ্গীরের কাছেই পেয়েছেন। একবার রেকিয়াভিকে জাহাজ আনলোডিং-লোডিংয়ের মাঝখানে আরব-রাজার ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে হীরের কুচি বসানো স্পেনের ষাঁড়ের শিঙের তৈরি বড় এক জোড়া চিরুনি ও মিনে-করা কাঠের বাক্সে তিল-পেস্তার আরবি মিঠাই দিয়ে জানাল, রাজার ইচ্ছেয় তাঁর সমুদ্রপরিবহণ ব্যবসা বাড়াতে জনা-ষাটেক শখের অভিযাত্রী নিয়ে ছোট একটা জাহাজে সে শিগগিরই বিশ্বপরিক্রমায় বেরোবে।

‘মাই অ্যারাবিয়ান কিং জানতে চেয়েছেন তোমার জাহাজের দায়িত্ব তোমার লোকেদের হাতে ছেড়ে তুমি রাজার মেহমান হিসেবে আমাদের সঙ্গে যেতে চাও কিনা।’

রাজার আতিথেয়তা সম্পর্কে গ্রানাডায় আল-হামব্রার প্রাসাদের কাছে তাঁর নতুন কেনা মস্ত অট্টালিকায় দু’দিন থেকেই জাহাঙ্গীরের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এবার জাহাজে বিশ্বপরিক্রমায় পরীক্ষিৎকে ঠেলে দিতে চায়। ঠিক হল, তার প্রাণের বন্ধু অম্বরীশের ছেলে, তার ইয়াং ফ্রেন্ড, পরীক্ষিৎকে নিয়ে জাহাঙ্গীর নিজেই রাজার গ্রানাডার বাসভবনে যাবে। তাঁর সম্মতি থাকলে এই স্বপ্নচর, বিষাদগ্রস্ত পরীক্ষিৎকে আলমেরিয়া বন্দরে সে-ই জাহাজে উঠিয়ে দিয়ে আসবে।

২৮

নদী নিয়ে যখন অনেকে অনেক কিছু ভাবছে, পাতালগঙ্গা, আদিগঙ্গা, বালিসোনা, মিতাম্বর-শাখানদী- নানা নামে নানা মানুষ ফিরে-পাওয়া নদীকে নিজের মতো করে আঁকড়ে ধরেছে, ঠিক তখনই নদী আবার শুকোতে শুরু করল। চৈত্রে বাদা ফেটে চৌচির। নদীর বওয়া জলও বেশির ভাগ জায়গায় রুখে গিয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

মাটি ফুঁড়ে ওঠা জলের বুজকুরিও আর দেখা যায় না। সেবছরই হেমন্তের মাঝামাঝি নদীখাত ভরাট করে নতুন করে শুরু হয়ে গেল টাউনশিপের পাইলিংয়ের কাজ।

প্রথমে পাতাল-ফোয়ারা দেখতে ও পরে নদীর পুনরুজ্জীবনের সাক্ষী হতে যারা সারা দিন ভিড় করত, তাদের অনেকেই এখন বিকেলে নতুন সিঁড়ির ধাপে এসে বসে। হাওয়ায় দুদণ্ড জিরোয়। তরুণরা রাজনীতি নিয়ে তর্ক করে, খেলা, সিনেমা নিয়ে আড্ডা দেয়। বয়স্করা নিজেদের মধ্যে গল্প করে। বৃদ্ধরা মনোরম অতীতের জন্য হা-হুতাশ করে। কেউ-বা সমাজের সাংঘাতিক পরিবর্তন নিয়ে ছি-ছি করে। রাত নামলে দুনিয়ার পাগল ও ভিখিরিরা যে যার চট ছেঁড়াকাথা মাদুর বিছিয়ে শোওয়ার জায়গার দখল নেয়। যাদের চট, কাঁথা, মাদুর বা অন্য কিছুই নেই তারা সিঁড়িতে শুয়ে পড়ে সেই জায়গাটুকুর ওপর নিজের মালিকানা জাহির করতে সেখানে বার বার প্রস্রাব করে। পাগলদের মধ্যে যাদের ঘুম আসে না, তারা সারা রাত জেনারেটর, মিক্সিং যন্ত্রের আওয়াজ কেউ সন্দেহবশে, কেউ আহ্লাদ করে শোনে। তরুণ-বয়সি শ্রীরামচন্দ্র তার চোদ্দ বছরের বনবাসে শয্যাগ্রহণ করবে না বলে প্রতিরাতে ঘাটে বসেই আকাশের বাঁধা পথে নিঃশব্দে বিচরণশীল ক্রেনের সঙ্গে তর্জনী তুলে অবিরাম কথা বলে যায়।

রাত কিছুটা নির্জন হলে লিওন তাদের অ্যাডভোকেট মেজোজ্যাঠার পরামর্শে পেশাদার ফটোগ্রাফার নিয়ে নানা দিক থেকে টাউনশিপের নির্মাণকাজের ছবি তোলায়। লিওনের আগ্রহে একদিন একসঙ্গে অনেকগুলো ছবি দেখতে দেখতে অবনীমোহন হঠাৎই ধ্যানস্থ হল। পরে ধ্যান থেকে জেগে উঠে বলল, ‘এ এক স্বল্পায়ু শহর হবে। এক আত্মঘাতী নির্মাণ।’

ছেলেবেলায় একা একা হাঁটতে হাঁটতে জনশূন্যি মোড়ে যে বৃদ্ধ বটবৃক্ষকে দেখে অবনীমোহনের মনে হত এই সেই বোধিবৃক্ষ, এখানেই গৌতম বোধিলাভ করেছিলেন, যৌবনে গাঁজা ও আফিংয়ের দোকানে লুকিয়ে আফিং কিনতে এসে যে গাছের ডালে নানা সময়ে তিনজনকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখে ভয়ে তার বুক হিম হয়ে গেছে, এখন যে গাছের পাঁচশো পায়ের মধ্যে গাঁজা আফিংয়ের দোকানের পিছনে গাছের কাটা-গুঁড়ির বেঞ্চে সন্ধে থেকে মাঝ রাত পেরিয়ে দেশি-বিলাতি মদের আসর বসে, একদিন সূর্যোদয়ের আগেই সেই বটবৃক্ষের নীচে এসে অবনীমোহন অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধ্যানস্থ হল।

তার মন বড় ব্যাকুল। সে বুঝতে চায় কেন হঠাৎ বালিসোনায় মানুষ ঘুমের মধ্যে সারা রাত দুঃস্বপ্ন দেখবে। যারা দীর্ঘদিনের অধিবাসী, দিনের বেলা তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হলে আগের রাতের অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন ছাড়া আজকাল আর কোনও কথা হয় না। সব সময় মনের এই ভয়-বিনিময় করতেও পারে না, চোখে চোখ রেখে পরিত্রাণহীন বিপন্নতায় বাক্যহারা হয়ে যায়। মানুষ এত ভয় পাবে কেন, জীবন এমন দুঃস্বপ্ন পাবে কেন, অবনীমোহন এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।

সূর্য গাছের মাথায় চড়ে ক্রমশ পশ্চিমে অস্ত গেল, গাঁজা-আফিংয়ের দোকানের পিছনে মদের আসর বসে গেছে, বেঞ্চে জায়গার অভাবে যারা দাঁড়িয়ে বাঁ হাতের গেলাসে চুমুক দিয়ে ডান হাতের শালপাতার চুবড়ি থেকে জিভ দিয়ে চাট নিতে নিতে অপেক্ষা করছে- বেঞ্চের কয়েকজন কতক্ষণে পশ্চিমপাড়ায় যাবার জন্য জায়গা খালি করবে, অবনীমোহন তখনও গভীর ধ্যানে মগ্ন। তার স্থান-কালের বোধ সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে।

থানায় রাত বারোটার ঘন্টাও বেজে গেছে। মদের আসরের মাতালদের একজন ‘নিরুপমা আমার রে বাঞ্চোৎ।’ ‘ও তোর বউদি, এঁড়েচোদা।’ ‘তোর মুখ আমি জুতিয়ে, জুতিয়ে না, গুঁতিয়ে যদি না দি-’ বলতে বলতে বটতলা পেরিয়ে যাবার সময় দলের একজন অন্ধকারে অবনীমোহনকে দেখে টেনে টেনে বলল, ‘এ আবার কোন সাধুবাবা রে শালা!’

সকলেই নিঃশব্দে অবনীমোহনের দিকে এগিয়ে গেল।

‘এ তো সেই মঙ্গলমঞ্চের পাণ্ডাটা রে! নারদমুণি সেজে ঘুরে বেড়ায়।’

ঠোঁটে আঙুল চেপে সকলেই সকলকে চুপ থাকতে বলে পরস্পরের প্রতি ইঙ্গিতে কর্তব্য বিনিময় করে দলের সাতজন প্যান্টের বোতাম খুলে একযোগে অবনীমোহনের ঘাড়ে মাথায় প্রস্রাব করতে লাগল। একজন পিছন থেকে অবনীমোহনের চুলের ঝুঁটি ও দুজন তার দুহাত মুচড়ে টেনে ধরে হ্যা হ্যা করে হাসছে। বাকিরা প্যান্ট খুলেও হেসে লুটিয়ে পড়ায় তাদের প্রস্রাব কিছুটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল।

সরোজিনীর কচি-সংসদে মেঘাবৃতর পরে আরও একজন নতুন সদস্য হয়েছে। তিন বছরের অরণ্য। নীলাঞ্জনার ছেলে, ছুটি পেলেই ছেলেকে নিয়ে বালিসোনায় চলে আসে। কর্মসূত্রে কখনও লম্বা সফরে যেতে হলেও ছেলেকে সরোজিনীর কাছে দিয়ে যায়। সরোজিনী গুনগুন গান গেয়ে তাকে ঘুম পাড়ায়। মিতার মধ্যে যেদিন কোনওরকম অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না, সেইসব দিনে মিতার কাছে ঘুমোতে পাঠায়। দুয়েকদিনের জন্য কোনও সেমিনারে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে ছেলে লখনউয়ে নিঃসন্তান সরস্বতীদিদির হেপাজতে দিব্যি থাকে।

‘বিয়ের খবর দিলি না, জামাই দেখালি না, কেমন মেয়ে রে তুই!’ সরোজিনীর এ-কথার উত্তরে নীলাঞ্জনা মৃদু হেসে বলল, ‘আরণ্যক বিয়ের তারিখ কি আগে থেকে কেউ বলতে পারে? আর তোমার জামাই? তিনি এখন বিদেশে।’ কথার শেষেও সে মুখ টিপে হাসল।

ভোরে ও বিকেলে রাসমাঠে সরোজিনীর নিজের পাঠক্রম ও প্রশিক্ষণ সূচি অনুযায়ী কচি-সংসদের সব সদস্যের আনন্দপাঠ চলে। নিজের নাতি-নাতনি ছাড়াও লক্ষ্মীদের স্কুল ও সুষমা বালিকা বিদ্যালয়ের বহু ছাত্র-ছাত্রী কচি-সংসদের দুবেলার মুক্তমেলায় শামিল হয়েছে। হইচই, খেলাধূলা, আবৃত্তি, গান গল্পে রাসমাঠ উৎসবের মতো ভরে উঠছে দেখে ঘরে ফেরার পথে অনেকে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে যায়।

সন্ধের আগে ঘরে ফিরে অবনীমোহন তখনও ফেরেনি দেখে সরোজিনী ব্রতীন ও ভণ্ডুলকে তার খোঁজে পাঠাল। সাত সেলের টর্চ নিয়ে দুজন তখনই বেরিয়ে পড়ল। নদীর ঘাটে, দিঘির পাড়ে, রেললাইনের ধারে আলো ফেলে ফেলে তারা অবনীমোহনকে খুঁজে বেড়াল। পথে লিওনের সঙ্গে দেখা, সেও খবর পেয়ে খুঁজতে এসেছে।

মধ্যরাত পার করে হতাশ হয়ে উৎকণ্ঠা নিয়ে ফিরে আসার পথে বকুলবেদির কাছে অবনীমোহনের দেখা পাওয়া গেল, নিঃশব্দে বাড়ি ফিরছে। গায়ে উৎকট প্রস্রাবের গন্ধ।

বারান্দায় সরোজিনীর একেবারে সামনে এসে অবনীমোহন ফুঁপিয়ে উঠল, পরের মুহূর্তে মুখে হাত চাপা দিয়ে বমি আটকাতে আটকাতে বাথরুমে ছুটে গিয়ে কমোডে হড় হড় করে বমি করতে লাগল। বমির তোড়ে তার একপাটি বাঁধানো দাঁত খুলে কমোডের ভেতর পড়ে গেল। সরোজিনী ঠোঁট কামড়ে ধরে তার পিঠ ডলে দিতে থাকে।

ঠিক কোথায় আঘাত, কী ধরনের আক্রমণ, অবনীর মতো মানুষের ওপর এমন নারকীয় অত্যাচারের পিছনে কে বা কারা, অনেক চেষ্টা করেও অবনীমোহনের কাছ থেকে সরোজিনী, লিওন, কেউই কিছু জানতে পারল না। কাল ভোরেই লক্ষ্মীকে নিয়ে আসবে জানিয়ে লিওন বাড়ি গেল। সরোজিনীর ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত মাঝে মাঝে শুধু দুজনের দীর্ঘশ্বাস শুনে এঘরের বংশানুক্রমিক এক বাসিন্দা উঁচু কড়ি-বরগা থেকে প্রতিবারই ‘ঠিক ঠিক ঠিক’ বলে সমবেদনা জানাল।

দীর্ঘ বিনিদ্র রাত শেষ হবার মুখে অবনী আরও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এখানকার জল হাওয়া মানুষ- কিছুই আর আমাদের জন্য নয়, সরোজিনী। বালিসোনায় এমন অদ্ভুত ভাষা, এত অচেনা মানুষ কখনও দেখিনি।’

এবারও সেই আদিযুগের প্রাণী কড়ি-বরগা ছেড়ে দেওয়ালের মাঝামাঝি নেমে এসে বলল, ‘ঠিক ঠিক’।

পরদিন সকালে ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে বললেন, ‘সিভিয়ার মেন্টাল শক। ভিকট্মি অব এক্সট্রিমলি আনপারমিসিবল টর্চার। হিউম্যান ইউরিন নাক মুখ দিয়ে অনেকটাই ভেতরে গেছে।’

অবনীমোহনের প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে দুয়েকটা দিন হাসপাতালে থাকতে হবে।

ব্লাড প্রেশার, ওয়েট, এজের সঙ্গে প্রেসক্রিপশনের কোণায়, ডাক্তারের হাতে লেখা তিনটি পর্যবেক্ষণও থানায় ও-সিকে দেখানো হল। হাতের লেখার ওপর বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নতুন ও-সি লিওন লক্ষ্মী সরোজিনীকে পর পর দেখে নিয়ে মুখ খুলল- ‘কাউকে সন্দেহ করেন? এনি সাসপেক্ট? ভিকট্মি কাউকে চিনতে পেরেছেন? কারও নাম বলেছেন?’

‘তিনি কথা বলার অবস্থায় নেই। আমরাও কেউ স্পটে ছিলাম না।’

‘দ্যাট’স দ্য প্রবলেম! এফ-আই-আর করে যান। দেখি কী করা যায়। সুস্থ হলেই আমায় জানাবেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে।’

লক্ষ্মীকে হাসপাতালে অবনীমোহনের কাছে রেখে সরোজিনী রাসমাঠে যাবার জন্য বেরতে যাচ্ছে, লক্ষ্মীই বাধা দিল- ‘আজ বাদ দাও না, মা। কাল থেকে আবার যেও।’

সরোজিনী ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার কি আর কাল আছে রে! তোমরাও আর কালকের দিকে চেয়ে থেকো না। ওরা মঙ্গলমঞ্চ করতে না দিক, আমরা মঙ্গলসংগীত গেয়ে বেড়াব।’

পরদিন লখনউ থেকে সরস্বতী-তাপসও অরণ্যকে নিয়ে চলে এল। ভুবনমোহনের সমাধির পাশ কাটিয়ে বাড়িতে পা দেওয়া মাত্র সরোজিনী অরণ্যকে বুকে টেনে নিল।

‘এ কী মা! তোমার এমন চেহারা হল কী করে?’

ছেলেকে সরস্বতীর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সরোজিনী হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে উঠল, ‘কাল বলে আর কিছু নেই রে। তোমরাও কালকের ওপর বরাত দিয়ে আর বসে থেকো না।’

অবনীমোহনকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর একদিন রাতে সরোজিনী তাকে অনেকক্ষণ ধরে নানা ভাবে বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত সেদিনের ঘটনা বলতে রাজি করাল। সব কথা শুনে মহিষাসুরমর্দিনীর মতো ক্রোধে সরোজিনীর সমস্ত মন জ্বলে ওঠে।

বিকেলে ও-সি এলে সে-ই তাকে ঘটনার বিবরণ দিল।

‘হসপিটালের ফাইন্ডিংস, ক্লিনিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট, সব আমি দেখেছি। নাক মুখ দিয়ে প্রচুর ইউরিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’ ও-সি নোট করতে করতে অবনীমোহনকে জিজ্ঞেস করল, ‘অপরাধীদের দেখলে শনাক্ত করতে পারবেন? গাঁজা-আফিঙের দোকানদারকে অ্যারেস্ট করে সে-রাতের মদের আসরের চোদ্দটা মস্তানকে তুলে এনেছি, আসল কালপ্রিটগুলোকে পারবেন আইডেন্টিফাই করতে?’

‘আমি ওদের মুখ আর দেখতে চাই না।’

ধীরে ধীরে কথাটা বলে অবনীমোহন দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

সবাই চলে যেতে সরোজিনী অবনীমোহনের মুখ নিজের দিকে টেনে নিয়ে আঁচল দিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছিয়ে দিল।

অবনী তার আঁচল ধরা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘আমার বরাবরের ধারণা, যার শেষজীবনটা, গৌতম বুদ্ধ বোধি লাভের অনেক আগেই যেমন বলেছিলেন, মসৃণ ঝিনুকের মতো হল না, তার পুরো জীবনটাই বৃথা। আমার এ জীবন বৃথা গেল, সরো।’

সরোজিনী অবনীর মুখে হাত চাপা দেয়।

মাঝরাতে দরজায় চেনা খটখট শুনে সরোজিনী ঘর থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ‘এখনও ঘুমোসনি? যা, যা, শিগগির গিয়ে শুয়ে পড়। রাত আর কতটুকু বাকি!’

‘দরজাটা একবার খোলো না রাঙাদি। খুব দরকারি কথা আছে।’

সরোজিনী জানে দরজা না খুললে মিতাকে নিরস্ত করা যাবে না। আবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে দিলে সারারাত আর বেরতে চাইবে না। দরজাটা ভেজিয়ে রেখে সে নিজেই বাইরে এল। মিতা মাঝে মাঝেই যেমন বলে সেইরকমই ফিসফিস করে বলল, ‘শুনছ, শুনতে পাচ্ছ? বাদার হাওয়া!’

‘এ তো বালিসোনার জন্মের সময় থেকে শোনা যায় রে। লক্ষ্মীর জন্মের সময়ও আমি শুনেছি। তখন হাসপাতালের খড়ের চালা মাঝে মাঝে উড়িয়েও নিত। তুই শুতে যা তো।’

‘না, রাঙাদি, না। এ হল কুবাতাস। কংকালের গন্ধ পাচ্ছ না? আর কী জোরে বইছে!’

‘ওরে বাবা, পুব থেকে পশ্চিম এ হাওয়া কোথাও কোনও বাধা পায় না বলেই এত জোরে বয়! রাঙাদা তোকে ক্যালিফস দিয়েছিল না? খাস নিয়ম করে? আজ খেয়েছিস?’

‘অরণ্যকে আমার কাছে দেবে? একা ভয় করছে।’

‘ওকে তো লক্ষ্মী নিয়ে গেল। আমি তোর কাছে শোবো। তুই শো গিয়ে, আমি তোর রাঙাদাকে ঘুম পাড়িয়ে, আসছি।’

মুখের কথায় মিতার ভয় কাটল না। সরোজিনী ঘরে ঢুকে যাবার আগেই সে খুব জোরে তাকে আঁকড়ে ধরল।

২৯

অনেক দিন পর পরীক্ষিতের চিঠি পেল পারমিতা। দীর্ঘ চিঠি, তবু যতবার পড়ে ততবারই শেষ পর্যন্ত পড়ে। জাহাজে চড়ে কত অদ্ভুত সব দেশে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রকৃতির কী আশ্চর্য রূপ, কোমলে-কঠোরে, সৃষ্টিতে-প্রলয়ে সব একাকার! মানুষের কতরকম সুখ-দুঃখ, সমুদ্র কত বিশাল, এখনও-বর্তমান হিমযুগের সুদীর্ঘ হিমবাহ কত বিস্ময়কর, পরীক্ষিৎ তার বিশদ বিবরণ দিয়ে লিখেছে ‘এসব দেখতে দেখতে লোভ হিংসা মিথ্যাচারে জরাজীর্ণ বালিসোনার কথা ভেবে মহাসমুদ্রের উন্মাদ ঢেউয়ের মতো আমার সমস্ত মন তোলপাড় করে। একদিন রাতে (তোমাদের ওখানে পরের দিন বিকেলে) আমাদের জাহাজ সাংঘাতিক ঝড়ে পড়েছিল। সাড়ে তিনঘন্টা জীবন-মৃত্যুর মাঝখান দিয়ে যাবার পর ভোরবেলায় ঘুমিয়ে বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম। বিরাট একটা মিছিলের সামনের সারিতে গলা খুলে গান গাইতে গাইতে চলেছেন। একবার মনে হল গানটা আমার লেখা, তারপরই বুঝলাম ওটা বাবারই লেখা। খুব আশ্চর্য, না?’ চিঠিটা কোন দেশ থেকে লেখা তার কোনও উল্লেখ নেই। কোনও ঠিকানাও দেয়নি।

সরোজিনী চিঠিটা পড়ে বলল, ‘পরীক্ষিতের সঙ্গে আমার বোধহয় টেলিপ্যাথি চলে। এই যে ছেলেমেয়েদের মঙ্গল-গান শেখাচ্ছি, ভেবেছিলাম স্কুলে, পাড়ায় ছোট বড় নানা অনুষ্ঠানে এইসব গান এরা গেয়ে শোনাবে, গান দিয়ে মানুষের হুঁস ফেরাবে, তার চেয়ে পরীক্ষিৎ যেমন স্বপ্নে দেখেছে, বড় করে গানের মিছিল বের করলে একসঙ্গে অনেক মানুষের হৃদয় ছোঁওয়া যাবে।’

পুজোর পর থেকে প্রতি রবিবার সকালে বালিসোনার রাস্তায় মঙ্গলসংগীতের মিছিল বেরতে লাগল। প্রাণজুড়নো ওইসব গানের দর্শক-শ্রোতা বাড়তে বাড়তে এমন হল যে প্রতি সপ্তাহেই বালিসোনার প্রধান সড়কের দুপাশে কয়েক মাইল দীর্ঘ মানুষের প্রাচীর উঠে যায়। তাদের মধ্যেও অনেকে মিছিলে এসে গানে গলা মেলায়। শেষ পর্যন্ত শিবকৃষ্ণের রোববার সকালের পাঠশালা দিন বদলিয়ে শনিবারে নিয়ে যেতে হল।

এক রবিবার ঘন কুয়াশা সত্ত্বেও স্থির হল গানের মিছিল যেমন বেরয়, বেরবে। মিছিল চোখে না দেখা যাক, সমবেত কণ্ঠের গান তো মানুষের কানে পৌঁছবে। যারা তখনও লেপের নীচে, কুয়াশাভেদী গান তাদেরও হয়তো ঘুম ভাঙাবে।

অদৃশ্য মিছিল থেকে গানের কথা, সুরের মায়া ক্রমশ বালিসোনার আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে গেল। রাস্তার দুপাশের মানুষের মন ছুঁয়ে, কাছে-দূরের পল্লীতে পল্লীতে গিয়ে ঢেউ তুলল।

হঠাৎই কুয়াশা ফুঁড়ে মিছিলের সামনের সারির ঠিক পিছনে ‘অম্বরীশের জাহাজের দোস্ত জাহাঙ্গীরও এই মিছিলে আছে’ বলে জাহাঙ্গীর কুয়াশা না কাটা পর্যন্ত গানে বিভোর হয়ে নিঃশব্দে হেঁটে চলল।

চারদিক স্পষ্ট হবার পর সে সরোজিনী ও পারমিতার কাছে এসে জানাল বালিসোনার মানুষের জন্য অম্বরীশের রুটি কারখানা সে আবার চালু করতে চায়।

সারা সপ্তাহ রুটি কারখানার কর্মচারীদের সঙ্গে সে কথা বলল। যারা আন্দোলন ছেড়ে ঘরে ফিরে গেছে তাদেরও ডেকে নিল। গোড়ার দিকের কারিগরদের ঠিকানায়ও লোক পাঠায়।

পরের রবিবার সকাল থেকে সকলের সঙ্গে সেও গানের মিছিলে যোগ দিল। চৌধুরীবাড়ির শুধু অবনীমোহন আর, এই প্রথমবার, নন্দিনী ছাড়া সকলেই এসেছে। তাদের অনেকেরই গানের গলা ভালো। কেউ কেউ শুধু স্লোগানে গলা মেলাল।

দিবাকরের খুনের ব্যাপারে নতুন ও-সি খুব আগ্রহ নিয়ে নন্দিনীর কাছ থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করে। কখনও দুপুরে, কখনও সন্ধ্যায়, কখনও রাতে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে, কখনও নন্দিনীকে তার স্মৃতির মধ্যে ডুবতে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ কেটে যায় তাদের। অবনীমোহনের অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করায় এই ও-সির ওপর চৌধুরীবাড়ির সেজোছেলে ছাড়া বাকি সকলেরই গভীর আস্থা। রবিবার খুব সকালেই ও-সি চলে আসায় নন্দিনীকে রেখে অন্যরা গানের মিছিলে বেরিয়ে গেছে। দিনে দিনে মিছিলের দৈর্ঘ্য ও সংগীতের আওয়াজ বেড়ে চলেছে দেখে জাহাঙ্গীর প্রায়ই বলে, ‘সাইক্লোনের মতো শক্তিশালী অস্ত্র একদিন হয়তো এই গান দিয়েই তৈরি হবে।’

দুপুরে বাড়ি ফিরে সরোজিনী মিতা ও লক্ষ্মী- মেঘাবৃতকে ফিরিয়ে দিতে এসে একা বসে থাকা নন্দিনীর মুখ দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। ও-সি হয়তো দিবাকরের খুনের তদন্ত মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছে, অথবা খুনী কে জেনে ভয়ে উদ্বেগে সে নির্বাক? হয়তো ও-সির জেরায় বারবার দিবাকরের রক্তক্ষয়ী স্মৃতির চাপ সে আর নিতে পারছে না!

এইসব জল্পনার মধ্যেই নতুন ও-সি দরজার বাইরে থেকে বলল, ‘ভেতরে আসতে পারি?’

লক্ষ্মীই বলল, ‘আসুন।’

সুদর্শন ও-সির পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। হাতে মস্ত একটা গোলাপের তোড়া।

লক্ষ্মী এবার মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলল, ‘বালিসোনায় এই প্রথম একজন মানুষের মতো পুলিশ দেখলাম।’

সবাইকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে ফুলের তোড়া টেবিলে নামিয়ে দিয়ে ‘সরি, আমি পরে আসব।’ বলে ও-সি বেরিয়ে গেল। নন্দিনী তার যাওয়ার সময় একবার মাত্র চোখ তুলে তাকাল।

পরের মুহূর্তেই ও-সি ফিরে এসে হঠাৎ সবাইকে জাপানিদের মতো কোমর ভেঙে ‘বাও’ করে বলল, ‘আই হ্যাভ এ গ্রেট রেসপেক্ট ফর ইউ অল। আপনাদের গানের মিছিল আমি দেখেছি। আই উইশ আই কুড জয়েন ইউ। কলেজ সোশ্যালে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে আমি হাততালি কুড়িয়েছি শুনলে এখন হয়তো আপনারা হাসবেন।’

এবারও লক্ষ্মীই বলল, ‘ওমা, হাসব কেন? বরং জানতে চাইব মিছিলে যোগ দিতে আপনার বাধা কোথায়?’

‘আমাদের প্রশাসন এখনও অতটা উদার হয়নি।’ কথা বলছে লক্ষ্মী-সরোজিনীর সঙ্গে, কিন্তু মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে নন্দিনীর মুখমণ্ডলে।

‘সব বেড়াই কখনও না কখনও, কাউকে না কাউকে তো ভাঙতেও হয়।’

সরোজিনীর এ-কথার লেজুড় হিসেবে লক্ষ্মী বলে উঠল, ‘প্রশাসনেরও তো পরিমার্জনা দরকার।’

হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে মেঘাবৃতকে দুহাতে উঁচুতে তুলে ধরে ও-সি বলল, ‘একশো ভাগ ঠিক। শিশুও যদি মিছিলে যেতে পারে, পুলিশই বা পারবে না কেন?’

‘আমাকে নামিয়ে দাও, আমার বগলে লাগছে।’

নন্দিনী দূর থেকেই হাত বাড়াল, ‘আয়, আমার কাছে আয়।’

মেঘাবৃতকে নামিয়ে দিয়ে ও-সি বলল, ‘ও-সিরা থানায় সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’

এবার নন্দিনীকেও হাসতে হল।

যাবার সময় ও-সি বলে গেল, ‘এই শিশুর পিতৃহত্যাকারীকে আমি ফাঁসিতে ঝোলাবই।’

ঘর খালি হয়ে গেলে নন্দিনী ফুলের তোড়া তুলে ধরে ঘ্রাণ নিতে গিয়ে গোলাপের আড়ালে লুকনো গোলাপি রঙের ভাঁজ করা একটা কাগজ পেল। তাতে একটাই লাইন- ‘দেবী, দয়া করো, আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না।’

ও-সি পরদিন আবার এল। অনেকক্ষণ কথা খুঁজে না পেয়ে নন্দিনীর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় অস্বস্তি কাটাতে মেঘাবৃতকে কাছে টানবার চেষ্টা করে বলল, ‘ওকে আমার মেঘদূত বলে ডাকতে ইচ্ছে করে।’

নন্দিনী মুখ তুলে বলল, ‘ডাকুন না।’ একটু থেমে, ‘রাঙাজেঠির কাছে আমি কালিদাসের মেঘদূত কাব্য শুনেছি।’

মেঘাবৃত ও-সির হাত ছাড়িয়ে মিতার ঘরের দিকে চলে গেল।

ও-সি একটু কাছে এসে বলল, ‘তোমাকে নন্দিনী ছাড়া আর কিছু মানায় না। মিসেস বসুচৌধুরী ডাকার পক্ষে বড্ড বড়। আমি ‘নন্দিনী’ বলতে পারি?’

নন্দিনী খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘অন্য কারও সামনে ডাকবেন না।’

ও-সি হঠাৎ নন্দিনীর মুখ তুলে ধরে ওষ্ঠ চুম্বন করল। নন্দিনী প্রথমে মুখ সরাবার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ও-সির দুহাতের মধ্যে থর থর করে কাঁপতে লাগল।

এরপর চৌধুরীবাড়িতে ও-সিকে আরও ঘন ঘন আসতে দেখা গেল। কাজের কথা ছাড়াও নানা বিষয়ে বাড়ির অন্যদের সঙ্গে অনাবশ্যক আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে সে নন্দিনীকে বার বার দ্যাখে। তারপর চা শেষ করে উঠে পড়ে।

একদিন সন্ধে পার করে এসে নন্দিনীকে বলল, ‘দিবাকরকে আর ফিরিয়ে দিতে পারব না, কিন্তু ওর খুনিদের আমি জীবিত বা মৃত ধরবই। দেবী, তোমার পায়ে সে-ই হবে আমার প্রথম হৃদয়াঞ্জলি।’

মেঘাবৃত হঠাৎ ঘরে ঢুকে দুজনকে চুমু খেতে দেখে দুজনের ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে ও-সিকে মাথা দিয়ে হাতের মুঠো দিয়ে ঘা মারতে মারতে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘কেন আমার মাকে ধরেছ? ছাড়ো, ছেড়ে দাও। ছাড়ো বলছি।’

সেদিন থেকে চৌধুরীবাড়িতে তার আসা নিষিদ্ধ হয়ে যাবার পর কখনও কখনও তেতলার জানলায় হঠাৎ ও-সির স্থির মূর্তি দেখেছে নন্দিনী।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন