বিষাদগাথা – ৩৫

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

একদিন মিতা, নন্দিনী, মেঘাবৃত, লিওনার্দোর সঙ্গে বসে পরীক্ষিৎ তিকানের কীর্তন শুনছে, নীলাঞ্জনা ঘরে ঢুকে উত্তেজনা চেপে পরীক্ষিৎকে বলল, ‘এখুনি একবার ঘরে আসতে পারবে?’

পরীক্ষিৎ অনিচ্ছাতেও উঠে এল।

‘তিকানের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছিল?’

প্রশ্নটা বুঝতে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল ‘যদি হয়ে থাকে, সে দোষ তিকানের নয়। যদি না হয়ে থাকে সে দোষ কিন্তু আমার।’ বলে পরীক্ষিৎ হাসল, ‘এতদিন পর, কী ব্যাপার?’

নীলাঞ্জনা একগুচ্ছ হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজ দেখিয়ে বলল, ‘এগুলো কী?’

তার প্রথম যৌবনের শেষ না হওয়া কবিতার কিছু কিছু অংশ, কয়েকটা কাগজে টুকরো টুকরো গদ্য, একটা লেখার ওপরে তার নাকের রক্ত একফেঁাটা শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। তখনও অকারণে তার নাক দিয়ে রক্ত পড়ার ব্যামো সম্পূর্ণ সারেনি।

একটা বিবর্ণ কাগজে স্যাঁতসেঁতে ধেবড়ে যাওয়া কালির লেখা সত্ত্বেও পড়া যাচ্ছে- মহালগ্ন মেঘের মতো উড়ে যাচ্ছে। বৃথা হতে দেব কি দেব না বুঝতে পারি না। যদি তাকে হারাই সারাজীবন দুঃখ পাব, যদি তাকে পাই, তারপর কী, আমি জানি না। কিন্তু তিকানের জ্যোৎস্নামাখা চোখের জল ভুলব কী করে।

নীলাঞ্জনা একভাবে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে দেখে পরীক্ষিৎ বলল, ‘এসব তুমি পেলে কোথায়? আমার তো মনেই ছিল না। কবিতাগুলোর কোনওটাই তো আর লিখতে পারিনি।’

‘আমি ভাবতাম তুমি একা, একেবারে নিঃসঙ্গ।’

‘সে তো এখনও।’

সেকথা না ধরে নীলাঞ্জনা প্রশ্ন করল, ‘পরী কি তোমারই মেয়ে?’

পরীক্ষিৎ মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলল, ‘তোমার কী মনে হয়?’

‘তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’

‘আমি না বললে তুমি নিজে বুঝবে না? বলা-না-বলায় সত্যিটা কি বদলে যায়? তাছাড়া, নীলাঞ্জনা, আমাদের কিন্তু এখন ঈর্ষাকাতর হবার বয়েস না।’

‘তিকানরা কি এখন থেকে এখানেই থাকবে?’

‘সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। ওদের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। বালিসোনায় নতুন বাড়ির কয়েকটা ফ্ল্যাটই তো ওদের পাওনা। দেখা যাক কতদূর কী হয়। তবে মিতা ওদের ছাড়তে চাইবে কিনা জানি না।’

কথার মধ্যেও তার কান-মন তিকানের গানের দিকে বার বার চলে যাচ্ছে দেখে নীলাঞ্জনা ব্যথিত ও অধৈর্য হয়ে বলল, ‘যাও, যাও, তিকানের গান বয়ে যাচ্ছে, তুমি যাও!’

জন্মাষ্টমীর দিন মিতার চাপে মা-মেয়েকে সারা রাত কীর্তন গাইতে হল। মাঝে একবার গলা বসে যাওয়ায় তিকান বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভোরের দিকে নতুন পদ ধরল। আলো ফোটা পর্যন্ত শুনে পরীক্ষিৎ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। পথে মানুষ নেই, শুধু লরির সারি। বালি রড পাথরকুচি বোঝাই করে ভোরের হাওয়ায় বিশ্রী শব্দ তুলে চলেছে।

মন্থরোর মা-র নানা যেদিকটায় জঙ্গল কেটে বসতি পত্তন করে গেছে, তার সামনের অংশে বালি আর পাথরকুচির পাহাড় দেখে পরীক্ষিৎ দাঁড়াল। সারি সারি মজুররা হাতের পলিথিনের প্যাকেটের চুল্লুতে নেড়েবিস্কুট ভিজিয়ে সকালের চা-পান সেরে নিচ্ছে। সূর্য গোল হয়ে দেখা দিলেই তাদের দিনের কাজ শুরু হবে।

চোখে ঘুম, শরীরে অবসাদ নিয়ে পরীক্ষিৎ ফেরার পথে রাস্তা সংক্ষেপ করতে রেললাইন ধরল। স্পষ্ট দেখল, তার পাশে পাশে অম্বরীশ হেঁটে যাচ্ছে।

‘ঘরবাড়ির তলায় চাপা পড়ে সব মাটি মরে গেল রে! মাটি আর আকাশ ঢাকা পড়লে আর বেশি দিন বাঁচে না। মানুষের বুকের মানুষটাও মরে যায়।’ বলে অম্বরীশ যেন এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস জোগাতে পরীক্ষিতের পিঠে বিরাট একটা থাবড়া মেরে তাকে লাইনের পাশে ফেলে দিয়ে চলে গেল।

অবনীমোহনের মৃত্যুর পর তাঁর রীতি অনুযায়ী পরীক্ষিৎ প্রতিবছর ফাল্গুনের গোড়ায় বালিসোনার মানুষকে বসন্তের প্রতিষেধক তিন সপ্তাহের তিন ডোজ মেলাড্রিনাম-২০০ বিলি করে। এবছর ওষুধের মোড়ক খুলে সবাই দেখল মোড়কের একপিঠে ‘মাটি ও আকাশ ঢাকা পড়লে মরে যায়’, আরেক পিঠে ‘মুমূর্ষুকে বাঁচানোই মানুষের ধর্ম’ কথাগুলো ছাপানো রয়েছে।

গানের মিছিলেও পরীক্ষিতের নতুন নতুন বিষাদগাথার অংশ-বিশেষের সঙ্গে এই কথাটাও তুলে ধরা হল। বিষাদগাথা সংবাদপত্রে প্রকাশের পরদিনই পোস্টার হয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। কোনও কোনও পোস্টার গোটা রাজ্যের দেওয়ালে-দেওয়ালে সাঁটা দেখতে পাওয়া যায়। ‘মাটি ও আকাশ’ আর ‘মুমূর্ষুকে বাঁচানো’ এভাবেই শহরে, গ্রামে, জেলায়-জেলায় ক্রমশ দেওয়াল থেকে তরুণদের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল।

শনিবার ভোরে সদর দরজায় জোর কড়ানাড়ার শব্দে পরীক্ষিতের ঘুম ভেঙে গেল। জাহাঙ্গীর মারা যায়নি ভেবে তার মন নানা দুর্যোগের মধ্যেও ভরসা পেল। দারোয়ানেরও আগে গিয়ে সে দরজা খুলে দিল। সামনে বারোজন সশস্ত্র পুলিশ। প্রথম তিন অফিসারের একজন বললেন, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে হেডকোয়াটার্সে যেতে হবে। চলুন।’

‘এভাবে গেঞ্জি পরে যেতে পারব না, জামা গায়ে দিয়ে আসছি।’

‘পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। প্লিজ ডোন্ট ট্রাই টু বিফুল আস।’

নীলাঞ্জনা, অরণ্য, মিতা, তিকান- সকলেই দরজা আগলে রাখা অফিসারদের কাছে জানতে চাইল, পরীক্ষিৎকে এভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?’

‘আজই কোর্টে প্রাোডিউস করা হবে, সেখানে সব জানতে পারবেন।’

সরকারপক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হল। বালিসোনা সহ পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকটি জেলায় এবার একসঙ্গে সব ক’টি প্রতীকচিহ্নে ছাপ মেরে যেভাবে নিঃশব্দে ভোট পণ্ড করা হয়েছে তার পিছনে পরীক্ষিতেরই মাথা আছে বলে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ মিলেছে। ন’বছর আগে রাসমাঠে আধা-সেনাবাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলার পিছনেও পরীক্ষিতের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বৃহত্তর যুদ্ধ ঘোষণার জন্য গানের মিছিলের মাধ্যমে সে একটা বিরাট বাহিনী গড়ে তোলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এরই দিদি লক্ষ্মীপ্রতিমার গ্রিন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও পরীক্ষিৎ আলাদা ট্রেনিং স্কিম চালু করেছে। স্কুলের স্টুডেন্টদের সাঁতার, জিমনাস্টিক, ক্যারাটে, আর্চারি, হর্স রাইডিং শেখানো হচ্ছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত মঙ্গলমঞ্চ অনেকদিন ধরেই সরকারি প্রশাসনের সমান্তরালে নিজেদের বেআইনি বিধিবিধান চালু করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি বালিসোনায় শতকরা আশি ভাগ জমিতে নির্মাণ নিষিদ্ধ করার গোপন ষড়যন্ত্রেও সে লিপ্ত। পরীক্ষিৎ চার বছর এগারো মাস বিদেশে থাকার সময় স্পেনের গ্রানাডা শহরে ও আলমেরিয়া বন্দরে গিয়েছিল। সেখানে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে শাসক উচ্ছেদের অঞ্চলভিত্তিক লড়াইয়ের রীতি-নীতি বিষয়ে তাদের পরামর্শ নিয়েছে। অতএব মহামান্য আদালতের কাছে পুলিশের আবেদন, অভিযোগের পক্ষে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ উদ্ধারের কাজে সহায়তার জন্য পরীক্ষিৎকে চোদ্দ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হোক। আদালত পুলিশের প্রার্থনা মঞ্জুর করল।

সারা রাত গোয়েন্দাদের জেরার উত্তরে পরীক্ষিৎ জানাল- রাসমাঠে আধাসেনা-জঙ্গলসন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ চোখে দেখার আগে সন্ত্রাসীদের সে জানতই না, ভোট পণ্ড করতে সে কখনও কাউকেই বলেনি, যা করেছে মানুষ নিজের বিবেচনায় করেছে, গানের মিছিল মানুষের মনে দয়ামায়া করুণার বীজ ছড়ানোর সংগীত-উৎসব ছাড়া অন্য কিছু নয়, সে চারবছর এগারো মাস বিদেশে ছিল, শুধু গ্রানাডা ও আলমেরিয়াই নয়, আন্দালুসিয়ার কর্ডোবা-গ্রানাডা ছাড়াও স্পেনের আরও অনেক জায়গায় সে ঘুরেছে, রাশিয়ার কির্কিনেস বন্দর থেকে জাহাজে বিশ্বের উত্তরতম শহর হ্যামারফেস্ট হয়ে নরওয়ের মধ্যযুগের রাজধানী বার্জেন পর্যন্ত বহু বন্দরশহরে সে নেমেছে, কোথাও কোনও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তার কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। লক্ষ্মীদির স্কুলে মিলিটারি ট্রেনিং না, প্রকৃত মানুষ গড়ার বিশেষ প্রশিক্ষণসূচি তৈরিতে লক্ষ্মী-লিওনার্দোর সঙ্গে সেও মাথা ঘামিয়েছে মাত্র। তবে, আশি ভাগ জমি খালি রাখার কথাটা অবশ্য একশো ভাগ সত্যি। বালিসোনার কোথাও কোনও ঘরবাড়ি, দোকান-বাজার নির্মাণ করতে হলে পুরো জমির শতকরা আশি ভাগ খালি রাখার স্বপ্ন তো সে তার লেখাতেও বলেছে। কিন্তু মানুষের প্রতি এ তার অনুরোধ ও প্রার্থনা। সশস্ত্র আন্দোলনের আহ্বান নয়।

চারদিন ধরে পরীক্ষিতের একই কথা শুনতে শুনতে গোয়েন্দা অফিসাররা কৌশল বদলে সারা রাত তার চোখের সামনে এক হাজার ওয়াটের দুটো ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে রেখে তার বলা না-বলা কথা ধরে-ধরে অর্থহীন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেল। পাঁচ-ছ ফুটের মধ্যেই ওই তীব্র আলো জ্বলে ওঠা মাত্রই তার গাল ও কপাল আগুনের তাপে ঝলসে যায়। চোখে কিছুই দেখতে পায় না।

গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘন্টা পর, রবিবার ভোরে গানের মিছিল থেকে গান ও গর্জন শুনে বাদাজোড়া নতুন নগরের বহুতল বাড়ির ফ্ল্যাটগুলোর জানলায় বারান্দায় আলো জ্বলে উঠল। পুরনো বালিসোনার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। আকাশের যে-জায়গাটা জুড়ে আগে ক্রেনের নড়াচড়া ছিল ঠিক সেখানকার বহুতল বাড়ির আলোকিত ব্যালকনির সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্র অনর্গল কথা বলে তার বনবাস যাপন করে চলেছে। আজও সে কথা বলায় মগ্ন ছিল, পিছনের রাস্তায় ভোরের সগর্জন বানরসেনার মিছিল দেখে সেও মিছিলের সামনে গিয়ে একবার বাঁহাত একবার ডানহাত তুলে-বাড়িয়ে তার বানরসেনা পরিচালনা করতে লাগল। তার ফূর্তির কারণ ক্রেনের শূন্য জায়গায় আলোর মালায় সজ্জিত লংকাপুরী আক্রমণ করে এবার তার সীতাকে উদ্ধার করা যাবে। সারা রাত তর্জনী তুলে রাবণকে শাসাতে শাসাতে তার হাত ও মুখ ব্যথা হয়ে গেছে।

মিছিল এবার পুরো রাস্তা জুড়ে চলেছে, পাশাপাশি আটজনকে এভাবে আগে কখনও দেখা যায়নি। দৈর্ঘে্যও এই মিছিল আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গান ছাপিয়ে এরকম গর্জনও আগে কেউ শোনেনি। এক পুলিশ অফিসার ও দুজন কনস্টেবল লাঠি উঁচিয়ে শ্রীরামচন্দ্রকে মিছিলের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার সময় কেউ কেউ সেটাকে মিছিলের ওপর পুলিশের লাঠি চার্জ ভাবলেও মিছিল নির্ভয়ে একইরকম উদ্দীপনায় এগোতে লাগল।

পরের রবিবার মিছিলের দৈর্ঘ্য আরও বাড়ল। পরীক্ষিতের মুক্তির দাবিতে লেখক শিল্পী গায়ক অধ্যাপক অভিনেতারাও পথে নেমে এসেছেন। ছুটির দিনের সকালের চা-জলখাবারের উদ্যোগ না করে মেয়েরাও ঘর ছেড়ে মিছিলে পা মিলিয়েছে।

গ্রেপ্তারের তৃতীয় রবিবার ভোর থেকে বালিসোনার প্রধান প্রধান রাস্তায় ১৪৪ ধারা জারি করা হল। শেষ রাত থেকেই পুলিশের জীপ থেকে মাইকে বারবার অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকার ঘোষণা করা হতে লাগল, সকলের বোঝার জন্য এ-ও বলা হল- কোথাও একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি লোক জড়ো হবেন না, হলেই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করবে।

ঘোষণা শুনেও অনেকে এল, অনেকে এল না। অধিকাংশ মানুষ ঘোষণা না শুনে চলে এসেছে। মেয়েরা আজ সংখ্যায় আরও বেশি। কেউ কেউ শিশু-কোলেই এসেছে। টিভিতে খবরের কাগজে খবর দেখেও বহু লোক ট্রেন থেকে নেমে মিছিলে পা মেলাচ্ছে। বাস-রাস্তার দুধারে যেখানে মরুভূমির মতো আদিগন্ত শুকনো জমি সেইখানে মিছিলের পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট পুলিশবাহিনী। মিছিলও দাঁড়িয়ে গেছে। অনেকে রাস্তায় বসে পড়েছে। মাইক হাতে পুলিশ প্রথমে ১৪৪ ধারার কথা জানিয়ে এই জনসমাবেশ বেআইনি ঘোষণা করে সকলকে শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যেতে বলল। একজনও পুলিশের কথায় কান দিচ্ছে না দেখে, ঘড়ি ধরে সময় বেঁধে দেওয়া হল। তার মধ্যে রাস্তা ফাঁকা না করলে সকলকেই গ্রেপ্তার করা হবে। এজন্য সারি সারি পুলিশ-ভ্যানও তৈরি রাখা হয়েছে।

ঊনত্রিশে আগস্ট সকাল ন’টা পঁচিশে পুলিশবাহিনী আবালবৃদ্ধবণিতা নির্বিচারে মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ করল। যাদের পারল তাদের টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তুলল। অনেক কবি-শিল্পী অধ্যাপক ও বয়স্ক মানুষ নিজেরাই এগিয়ে এসে ঠেলাঠেলি করে ভ্যানে উঠে গেলেন।

পরদিন তিরিশে আগস্ট সকালে স্কুল-কলেজ দোকান-বাজার অফিস আদালত বন্ধ করে রাস্তায় মানুষের ঢল নামল। মিছিল থেকে গানের বদলে সেদিন শুধু আকাশ কাঁপানো গর্জন উঠতে থাকল। বিকেল তিনটে সতের মিনিটে শুরু হয়ে পুরো তিনঘন্টা ধরে পুলিশের গুলিবর্ষণের উত্তরে মিছিল থেকেও গুলি ও গ্রেনেডের যুদ্ধ চলল। রিভলবারের গুলি ছাড়াও গামছায় মুখ ঢাকা চারজনের প্রত্যেকের হাতে ছোট আকারের পাঁচনলা থেকে একসঙ্গে পাঁচগুলি ছুটে গিয়ে একেকবারে পাশাপাশি তিন-চারজন পুলিশকে এফেঁাড়-ওফেঁাড় করতেও দেখা গেল। দুটি কিশোরের ক্ষিপ্র ও লক্ষ্যভেদী গ্রেনেড নিক্ষেপ যে দেখল সে-ই অবাক হল। মিতা, নীলাঞ্জনা, নন্দিনী, তিকান, লক্ষ্মী, চিরন্তনী, লিওন ছাড়া মিছিলের আর কেউ তাদের চেনে না। এমনকি পরীও পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে সেরে না ওঠা পর্যন্ত তাদের চিনত না। সন্ধের অন্ধকারে পুলিশের হতাহতের সঙ্গে মিছিলের নিহত ও গুরুতর আহতদের দুটো আলাদা কালো ভ্যানে তুলে নেবার আগেই জ্ঞানহীন পরীকে নিয়ে লিওন লক্ষ্মী নীলাঞ্জনা ও তিকান হাসপাতালে চলে এল। দ্রুত অপারেশন করে বাহু থেকে তার গুলি বের করে দেবার তিনঘন্টা পর পরী যন্ত্রণায় চোখ মেলে নীলাঞ্জনা ও তিকানের সঙ্গে লালকমল-নীলকমলকে দেখে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ওরা কে মা? কাল মিছিলেও দুজনকে দেখেছি।’

‘কাল নয়, আজই মিছিলে দেখেছিস। ওরা লালকমল-নীলকমল, দুভাই, নীলাঞ্জনার ছেলে। কাল তোকে বাড়ি নিয়ে যাব।’

‘কোন বাড়ি? নদীয়ায় নদীর ধারের বাড়ি? নাকি এখানে দাদুর বাড়ি? নাকি মিতাদিদিমার বাড়ি? আমরা কোথায় যাব মা?’

লালকমল-নীলকমল এতক্ষণ সব দেখছিল আর শুনছিল। এবার লালকমল বলল, ‘আমাদের বাড়িতেই নিয়ে যাব।’ নীলকমল ধরতাই দেয়, ‘ঘোড়ায় চড়ে যেতে চাও? আমরা তার ব্যবস্থাও করতে পারি।’ লালকমল বিশদ করে দেয়, ‘স্টেশনের ওধারে জঙ্গলে ঢাকা একটা গোরস্থান আছে, সেখানে সাদা ধপধপে দাড়িওলা এক বুড়ো মুসলমানের খুব সুন্দর একটা ঘোড়া আছে। ছোটবেলায় আমরা দুভাই সেই ঘোড়ায় চড়ে অনেকবার জঙ্গলে আছাড় খেয়েছি।’ এবার নীলকমল- ‘যদি চড়ো, খানিকক্ষণের জন্য চেয়ে আনতে পারি। আমরা চাইলেই দেবে। আমাদের ও বলে লব-কুশ।’

পরী ক্ষীণ স্বরেই বলল, ‘তোমাদের ছোটবেলায়- সেটা কবে? তোমরা তো এখনও ছোটই।’

‘আগে ছিলাম। এখন আমরা বড় হয়েছি। পনেরো শেষ করে ষোলয় পড়েছি আমরা।’

‘খুব হয়েছে, এখন বাড়ি চ’ তো। আগে তো কখনও এরকম স্কুল থেকে একা চলে আসতি না?’

‘মা, তুমি কেন ভুলে যাও, পাহাড়ের দেশে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। পাহাড়ে চড়তে শিখেছি, তীরধনুক দিয়ে খরগোশ, সাপ, বনবেড়াল শিকার করতে শিখেছি। গুলতি দিয়ে পাখির ছানা খেতে আসা ঈগল তাড়াতে পারি। মহুয়া খেতে শিখেছি, আদিবাসীদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে নাচতে পারি, পাহাড়ি নদী হেঁটে পার হতে পারি, ঝরনার মধ্য দিয়ে চলে যেতে পারি।’ দুভাই পালা করে তাদের একেকটা সিদ্ধির কথা বলে যায়।

‘স্কুলে এইসবই শেখায় বুঝি?’

‘না, না, স্কুলের বাইরে শিখি এসব। স্কুলে জানতে পারলে কড়া শাস্তি দেবে।’

‘তাই বলে মহুয়া খাবি? ওসব খাই আমরা?’

‘খেতে খারাপ না মা। ছোটবেলায় একবার বিজয়া দশমীর দিন দারোয়ানের ঘরে সিদ্ধি খেয়েছিলাম, মিষ্টি-মিষ্টি, সেরকম খেতে। আমরা সাঁওতালদের সঙ্গে মোটে দুদিন খেয়েছি।’

পরী প্রথম থেকে দুভাইয়ের মুখের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে তাদের অদ্ভুত সব বাহাদুরির কথা শুনছিল, কিছুক্ষণ পর অ্যানাসথেসিয়ার রেশ পুরোপুরি কেটে যেতে যন্ত্রণায় তার মুখ বেঁকে গেল, শেষদিকে ওদের কথায় আর মন দিতে পারল না। ব্যথা কমার বড় ট্যাবলেট খেয়ে তার আবার ঝিমুনি এল।

তাদের বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে খবর পেয়ে দুভাই পাহাড়ের খাঁজে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে থাকা পলিথিনের চাদরে মোড়া পিসবোর্ডের বড় বড় বাক্সভরা গ্রেনেড থেকে লুকিয়ে বেশ কয়েকটা নিয়ে বালিসোনা এসেছিল। মালগাড়ি থেকে পাহাড়ের বন্দুকবাজদের লুট করা সব জিনিস উদ্ধার হলেও পুলিশ এই গ্রেনেডের বাক্সগুলোর সন্ধান পায়নি শুনে অনেকদিন ধরে লালকমল- নীলকমল পাহাড়ে জঙ্গলে তন্ন তন্ন করে খুঁজে শেষ পর্যন্ত গ্রেনেডের হদিশ পেয়েছে।

বাবাকে পুলিশ লোহার গরাদ দেওয়া ঘরে আটকে রেখেছে শুনে দুভাই মাকে বলল, ‘গরাদ ভেঙে বাবাকে আমরা দুজনে বের করে আনব মা?’

‘ওরকম করা যায় না। এসব কথা আর কখনও মুখেও আনিসনি।’

আদালতের জামিন পেয়ে পরীক্ষিৎ বাড়ি ফিরে দিনের বেলা গাঢ় কালো চশমা পরে থাকে। রাতে পারতপক্ষে আলো জ্বালানো হয় না। জ্বালালে রাতেও তাকে রোদচশমা পরে নিতে হয়। আলো তার চোখে সয় না।

রবিবারের সংগীতমিছিল চলতেই থাকে। এরপর প্রতিবছর ঊনত্রিশে আগস্ট, তিরিশে আগস্ট বালিসোনার শোকদিবস হিসেবে পরপর দুদিনই মিছিল বেরবে ঠিক হল। একদিন মৌন মিছিল, আরেক দিন গানের।

৩৬

স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিয়ে লালকমল-নীলকমল বাড়ি ফিরে এল। পরীক্ষার ফল বেরলে বড় শহরে কলেজে ভর্তি হবে। তার আগে দুজনে দিনের পর দিন বালিসোনার এপাড়া-ওপাড়া এগ্রাম-ওগ্রাম, বনজঙ্গল, খালবিল, পোড়োজমি, জলাভূমি ঘুরে ঘুরে জরিপ করে শেষ পর্যন্ত তাদের স্কুলের দেশের মতো পাহাড় বানানোর বাসনা ত্যাগ করল। স্কুলের দিনগুলোতে পাহাড়ের কোলে, ওপরের জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে দুভাই কতদিন বালিসোনায় এরকম একটা দীর্ঘ পাহাড়ের স্বপ্ন দেখেছে। পাহাড়ের পিছনে রোজ সূর্য ডুবে গিয়েও সারা পশ্চিম আকাশ অদ্ভুতভাবে রাঙিয়ে দেয়, দুভাই ভেবেছিল বালিসোনায়ও ওরকম আকাশ হবে। তার বদলে বাদা জুড়ে বিরাট একটা নতুন শহরে আকাশ ঢাকা পড়ে গেছে, সারি সারি বহুতল বাড়ির আড়ালে অস্তগামী সূর্য তার রঙের পাপড়ি মেলতে পারে না।

মিতা দুই ভাইকে ঘরে ডেকে নিয়ে তাদের কাছে পাহাড়ের গল্প শোনে। পরীকে শোনায়। লালকমল সেখানকার সূর্যাস্ত আর এখানকার সূর্যাস্তের মধ্যে তুলনা করে একদিন বলল, ‘এইসব আকাশ ফুঁড়ে ওঠা বাড়ি কী করে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় বলো তো? দিয়ে আবার এখানে ঘাস-মাটি ভরিয়ে দেওয়া যায় না?’

হুবহু অম্বরীশের মন। মিতা আর ভয় পায় না। তার স্বামীর স্বপ্নের কথা মনে করে বলল, ‘ঘাস মাটির তলায় নদীও হয়তো আবার খুঁজে পাওয়া যায়।’

একা পরীর সঙ্গেও দুভাইয়ের অনেক কথা হয়। কখনও লালকমল-নীলকমল একসঙ্গে আসে, কখনও আলাদা। তখন বাইরে থেকে মিতার সঙ্গে ফিরে এসে তিকান যদি কীর্তন গাইতে শুরু করে, দুভাই-ই কিছুটা শুনে উঠে পড়ে। কীর্তন তাদের ভালো লাগে না। কিন্তু পরী একলা যদি তাদের জন্য গায় তাহলে তারা চুপ করে বসে শোনে। পরী গাইতে গাইতে একবারও চোখ খোলে না বলে সে জানতে পারে না লালকমল-নীলকমল গান শোনার থেকে বেশি তার মুখের দিকে চেয়ে আছে।

রাজধানীর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শেষ না করে অরণ্য ফিরে এল। সারা দিন একরকম, সন্ধে হলে কেমন ঢুলুঢুলু চোখে বসে বসে ঝিমোয়। কেউ কিছু না বললে সে নিজে থেকে কথা বলে না। নীলাঞ্জনা সন্দেহবশে অরণ্যর জিনিসপত্র খোঁজাখুঁজি করতে করতে ম্যাগ ফস ১২X লেখা একটা শিশি দেখতে পায়। ভেতরে ম্যাগ ফসের বড়ির বদলে সাদা পাউডার। শিশির বেশিটাই খালি।

প্রদীপ অনেকদিনই দিল্লির পাট তুলে দিয়ে বালিসোনায় ফিরে দিনরাত ইংরিজিতে কী একটা বই লিখছে। সরোজিনীর মৃত্যুর পর থেকে শুধু সংগীতমিছিল নয়, বালিসোনার সব কিছু থেকেই সে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে সে কারও সঙ্গেই আর আগের মতো কথা বলে না। কেউ এসে কাচার জন্য জামাকাপড় চাইলে বের করে দেয়। খাবার দিয়ে গেলে খেয়ে নেয়। কথা বিশেষ না বললেও কখনও কখনও তাকে কথায় পায়। তখন একবার শুরু করলে আর থামতে চায় না। মাঝেমাঝে অসংলগ্ন কথাও বলে।

একদিন দুপুরে অরণ্য কিছু টাকা চাইতে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘সারা দিন আপনি কী লেখেন ছোটদাদু?’

অরণ্য তাদের বড়দাদুকে কোনওদিন দেখেনি, তার ছেলেকেই ছোটদাদু বলে ডাকে।

‘একটা বই, আস্ত একটা বই লিখছি।’

‘কী নিয়ে লিখছেন?’

‘আমার অটোবায়োগ্রাফি লিখছি। আসলে কী যেন একটা লিখতে চাই, হয়তো সুভাষচন্দ্র বসুর সত্যিকার জীবনী, অথবা হয়তো বালিসোনার ইতিহাস, কিংবা তেইশবিঘা-আমবাগানের আত্মকথা। বিষয়ের খেই হারিয়ে এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে চলে যাচ্ছি রে। খুব ইচ্ছে করে মন্থরোর মার জীবনকথা লিখি। কোনওদিন হয়তো কপিখেতের যুদ্ধও লিখব। কিংবা আমার ঠাকুরদার শেষজীবন। টাকা নিয়ে তুই কী করিস?’

‘এমনিই। আপনার অসুবিধা থাকলে, থাক।’

‘না না, অসুবিধা কিসের? সারাজীবন তো শুধু আয়ই করেছি। বড় খরচ বলতে তো বই কেনা।’ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কী ভেবে, আবার বলল, ‘বই পড়ত বটে রাঙাকাকিমা। ওরকম বিদূষী নারী বালিসোনায় আর কখনও হবে কি না জানি না। অবশ্য চিরন্তনীর কথা বলতে পারব না, ওর একটা বই সম্প্রতি ইংল্যান্ড ও আমেরিকা থেকে একসঙ্গে পাবলিশড হয়েছে শুনলাম। আমি এখনও পড়িনি বা দেখিনি। চিরন্তনী আমাকে বলেছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় দারিদ্র্যের মূল কারণ নিয়ে সে গভীরভাবে ভাবছে। হয়তো ওই বিষয়েই সে লিখেছে। হয়তো নাড়া দেবার মতো মৌলিক কোনও কথা সে বলতে পেরেছে। মুশকিল কী জানো, রাঙাকাকির কথা আমি ভুলতে পারছি না। ওঁর মনটা রবীন্দ্রনাথের যুগের মন। খানিকটা পেয়েছে পরীক্ষিৎ। ও আর পাওয়া যাবে না।’

সন্ধেবেলা অরণ্য ঝিমধরা চেহারায় ঢুলুঢুলু চোখে বকুলবেদিতে বসতে গিয়ে দ্যাখে পরী অন্ধকারে লুকিয়ে বসে কাঁদছে। অরণ্যকে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়। অরণ্য আরও একটু জায়গা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি আমাদের পরী না? তুমি কাঁদছ কেন? তুমি এখানে বসলে আমার কোনও অসুবিধে হবে না। তোমার কিসের দুঃখ? আমার বাবাকে গিয়ে বলো, বাবা সকলের দুঃখ নিয়েই ভাবেন।’

পরী হাউহাউ করে কেঁদে উঠে আরও বেশি অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল।

তিনদিন পর মিতা ও তিকান পরীক্ষিতের ছাড়া পাওয়ার মানতের ঢিল খুলতে বিশালাক্ষীতলায় যাওয়ার সুযোগে দুপুরবেলা পরীকে একা পেয়ে লালকমল কী একটা বলতে গিয়েও কথা পাল্টে নিয়ে বলল, ‘তোমার এ কী চেহারা হচ্ছে দিন দিন, রাতে ঘুমোও না?’

এই দুটি ছেলের ওপর পরীর অগাধ আস্থা, তার জন্য এরা করতে পারে না এমন কাজ নেই। তেমনই কোনও ভরসার কথা ভেবে বিষণ্ণ দুচোখ লালকমলের চোখের ওপর রেখে মৃদু স্বরে পরী বলল, ‘সাত মাস পরে আমি মা হতে যাচ্ছি। তার আগে আমি আত্মঘাতী হব।’

‘সে কী! কী করে তুমি বুঝলে তুমি মা হতে যাচ্ছ?’

‘সব মেয়ে যেভাবে বোঝে।’

‘তুমি মা হলে, এর বাবা কে?’

‘তোমরা জানো না? তোমরাই তো তার কাছে শ্রীচৈতন্যের নিজের হাতে লেখা চিঠি আছে বিশ্বাস করে যখন যা চেয়েছে দিয়েছ। সে-চিঠি তোমাদের দেখাবে বলেছিল না? দেখাতে পেরেছে?’

‘তোমার সেই টিচার?’

‘নদীয়ায় আমার বাবার কাছে আসত, ভালো ছাত্র ছিল। খুঁজে খুঁজে ঠিক চলে এসেছে।’

‘কণ্ঠীবদল না কী যেন বলো, তোমাদের কি তাই হয়েছে?’

‘সামনের অঘ্রাণে বিয়ে হবে বলেছিল।’

‘তাহলে এখনই বাবা হল কী করে?’

‘তোমরা বুঝবে না।’

‘কাল ও এলেই আমাদের খবর দেবে। হাত-পা বেঁধে ওকে দীঘিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসব।’

‘তিন মাস হয়ে গেল আর আসে না, তোমরা জানো না?’ বলেই মুখে হাত চাপা দিয়ে বমি আটকে দৌড়ে বাথরুমে যেতে গিয়ে মিতার সঙ্গে ধাক্কা লাগতে লাগতেও সে সামলে নিল। মিতা ভাবল ঘরে দুজনে হয়তো হাত ধরাধরি করে বসে ছিল, তাদের পায়ের শব্দে একজন লজ্জায় পালাল। দুই ভাইয়ের সঙ্গে পরীর গভীর বন্ধুত্ব। দেখে তিকান অসন্তুষ্ট হয়, মিতার ভারি ভালো লাগে।

সেদিন রাতে আরেকবার বমি করতে উঠে সে তিকানের কাছে ধরা পড়ে গেল।

পরদিনই ভোরে তিকান এই দ্বিতীয়বার সকলের অগোচরে বালিসোনা ছেড়ে চলে গেল। প্রথমবার বাবাকে নিয়ে, এবার মেয়েকে নিয়ে।

দুজনে সত্যিই চলে গেছে আবিষ্কার করে মিতার বুক শূন্য হয়ে গেল। তার মনে হয় তার বড় একটা সম্পদ তার ঘুমের ঘোরে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। এক রাতেই তার জীবনের আরও একটা আশ্রয় যেন চুরমার হয়ে গেল।

বেলায় বাড়িময় শোরগোল উঠল। সকলেই বেকুব বনে গেছে। কাউকে কিছু না বলে, কোনও হদিশ না রেখে এভাবে হঠাৎ গৃহত্যাগের কারণ কেউ ভেবে পেল না। যত ভাবে তত অবাক হয়। ক্রমশ মা ও মেয়েকে চৌধুরী বাড়ির অধিকাংশ সদস্যেরই ভারি রহস্যময় মনে হয়।

এরপর তিকানদের সে বাঁচাবে কী করে, মিতার বুকের শূন্যস্থান ভরবে কী দিয়ে পরীক্ষিৎ ভেবে পায় না।

লালকমল-নীলকমল সকলের নজর এড়িয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে অনেক দূরে রেললাইনের ধারে পৌঁছেই দুজনে একসঙ্গে বুক উজার করে কেঁদে উঠল। অনেকক্ষণ কান্নার পর নীলকমল জিজ্ঞেস করল, ‘ওর বাবা কে, কিছু বলে গেছে?’

‘পরীর প্রাইভেটে পরীক্ষার সেই টিচার।’

‘পরী চলে গেল কেন? পরীকে না দেখলে আমরা বাঁচব না। চল, ওকে খুঁজে বের করি। বলেছিল আত্মঘাতী হবে। আমরা হতে দেব না। বাচ্চাটাকেও বাঁচাতে হবে। আমরা দুজনে ওকে বড় করে তুলব।’

‘আসলে আমাদের ভুলটা কোথায় হয়েছে জানিস?’

‘কোথায়?’

‘যখনই আমরা জানলাম, তখনই আমাদের দুজনের ওকে বিয়ে করে ফেলা উচিত ছিল।’

‘দুজন ছেলে একটা মেয়েকে কি বিয়ে করতে পারে?’

‘পারে না? চল, ছোটদাদুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি। ছোটদাদু অনেক কিছু জানে।’

দুজনকে ঘরে ঢুকতে দেখে প্রদীপ চশমা কপালে ঠেলে ওদের মুখ দেখতে দেখতে বলল, ‘তোমরা কারা?’

‘আমরা লালকমল আর নীলকমল। পরীক্ষিৎ চৌধুরীর ছেলে। আচ্ছা, দুটো ছেলে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারে?’

‘মেয়েটা রাজি হবে কেন?’

‘হবে।’

‘ছেলেদুটোই বা রাজি হবে কেন?’

‘হবে।’

‘দেশের আইন রাজি হবে না।’

‘যমজ ছেলে হলেও না?’

‘ওরে, আমি একটা-ছেলে হয়েও একজন মেয়েকে বিয়ে করতে পারলাম না, তোরা চাস দুজনে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে! বেশ, তাই কর গিয়ে, এখন আমাকে লিখতে দে।’

সারা রাত পরিকল্পনা করে, সামান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ভোর হবার অনেক আগেই লালকমল আর নীলকমল পলাতকা পরীদের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।

সাত মাস পরই পরীর পেট কাটা হবে কল্পনা করে ভয়ে তাদের বুক শুকিয়ে গেছে।

৩৭

একটা কংকালের মুখ মানুষের চামড়া দিয়ে টান টান করে ঢেকে দিলে যেমন দেখায় রুদ্র ঝম্পটির মুখের চেহারা তেমনই হয়েছে। দিনে রাতে দু-পাঁচ মিনিটের জন্যও সে শুতে পারে না, সব সময় বসে থেকে মুখ হা করে শুধু হাঁপায়। চোখ দুটো তখন ঠেলে বেরিয়ে আসে, বাড়ির লোক সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ভয়ে দমবন্ধ করে ভাবে, এই বুঝি চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসবে।

হাঁপানির টান কমলে পিঠের কাছে উঁচু বালিশের স্তূপে হেলান দিয়ে বসে বসেই যতটা পারে জিরিয়ে নেয়।

বড় বড় ডাক্তারবাবুরাও তাকে কোনও আরাম দিতে পারেনি। তার শ্বাসনালীর ভেতরে আটকে থাকা খাসির নলীর হাড়ের টুকরো শুধু ওষুধ দিয়ে বের করা অসম্ভব বলে সবাই রায় দিয়েছে। একমাত্র উপায় জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন। আগে একবার তার গলায় অপারেশন হয়ে গেছে, তারপর নতুন করে আবার অপারেশন করাতে সে নিজে ও তার বাড়ির লোক রাজি নয়। সতেরো বছর ধরে বুক ভরে একটু বাতাস নেবার যন্ত্রণাদায়ক চেষ্টা নিয়ে সে এখনও বেঁচে আছে। তার দলের ছেলেরা, প্রবীণ রাজনৈতিক সহকর্মীরা, প্রতিবেশীরা যে যখনই তাকে দেখতে আসে সে শুধু তার দুর্বল কাঁপা কাঁপা হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাদের দিকে চেয়ে থাকে। শুধু তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। গলার ক্যান্সার অপারেশনের পর থেকে সে আর কথা বলতে পারে না।

সকলের কাছে তার নির্বাক ক্ষমা প্রার্থনার কথা এতদিনে বালিসোনার অনেকেই শুনেছে। তাদের মধ্যেও কেউ কেউ তাকে দেখতে আসে। তাদের কাছেও ঝম্পটি জোড় হাতে ক্ষমা চায়।

চৌধুরীবাড়ির সেজোছেলে বৃদ্ধ বয়েসেও একদিন রাত করে ঝম্পটির কাছে এসে ব্যক্তিগত একটা কাজে তার সাহায্য চাইল। তার অনেকদিনের ইচ্ছে, সামান্য কয়েকটা পারিবারিক কবরস্থান ছেড়ে রাসমাঠ তার বন্ধু-প্রমোটার হরেন ভদ্রের হাতে তুলে দেয়। তার সঙ্গে পার্টনারশিপে ওখানে জেলার সবচেয়ে বড় পাঁচতলা শপিং মল হবে। দীঘির পাড় ধরে অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য বিলাসবহুল বাংলো হবে। বালিসোনার একটা বড় সম্পদ দূর সাগরের দখনো-হাওয়ার কথা এখন মার্কিন প্রবাসী বাঙালিরাও জানে।

মেজদা বা লক্ষ্মী-সরস্বতী খুব একটা বাধা হবে বলে মনে হয় না, তারা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাবে। আধপাগলা প্রদীপকেও সে সামলে নেবে। সমস্যা পরীক্ষিৎকে নিয়ে। তাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। ‘তোমার ছেলেদের তুমি যদি একটু বলে দাও- বাদায় টাউনশিপের ব্যাপারে যেমন বলে দিয়েছিলে আর কী-’

কথা শেষ হবার আগেই ঝম্পটি সারা মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে জোড় হাতে তার অক্ষমতা জানাল।

এক বুধবার বিকেলের দিকে চিরন্তনী এল। রুদ্র ঝম্পটির কথা সে অনেক শুনেছে, কখনও চোখে দেখেনি। এত বেশি অসুস্থ দেখে ধীর স্বরে বলল, ‘নমস্কার। আমি অবনীমোহন চৌধুরীর বড় মেয়ে লক্ষ্মীপ্রতিমার মেয়ে চিরন্তনী। এই শনিবার আমাদের মঙ্গলমঞ্চের সভা হবে। সেখানে আপনি কি আপনার অনুতাপ নিয়ে কোনও বিবৃতি দিতে চান? আপনি লিখে দিলে আমরা সেটা মঞ্চ থেকে পড়ে শোনাতে পারি।’

চৌধুরীবাড়ির কেউ তাকে দেখতে আসবে চোখে দেখেও তার বিশ্বাস হয় না। চিরন্তনী ঘরে ঢোকার মুহূর্ত থেকে ঝম্পটি সেই যে হাত জোড় করেছে, তারপর একবারও আর নামায়নি। তার চোখ দিয়ে এত জল ঝরছে যে এই প্রস্তাবে তার হ্যাঁ-না কিছুই বোঝা গেল না।

শনিবার অনুষ্ঠান শুরুর আগে পর্যন্ত মঞ্চ-সজ্জার কাজ চলল। সাদা কাপড়ের গায়ে বড় বড় করে লেখা- জগৎ সুন্দর হয় মানুষের গুণে, সমাজ সুখের হয় মানুষের দানে।

চিরন্তনী সকলকে নমস্কার জানিয়ে শুরু করল- মঙ্গলমঞ্চ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও আদর্শের কথা আপনারা জানেন। সেই প্রয়োজন আজ আরও বড় হয়ে উঠেছে। বর্ষার জল পেয়ে আগাছার মতো, লোভের জল পেয়ে দুর্নীতি, দুঃশাসন, স্বার্থসর্বস্বতা সমাজের সব স্তরে হু হু করে বেড়ে চলেছে। এর বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ না, বিকল্প মূল্যবোধও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে জন্য শুধু মঙ্গলমঞ্চ নয়, সংগীত-মিছিল থেকেও আমাদের কর্মীদল গড়তে হবে। তারা প্রত্যেকে বালিসোনার ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের সুখ-দুঃখ শুনে দেখে বিচার করে তাদের মূল সমস্যার শ্রেণী বিন্যাস করবে।

যারা গান শোনার আশায় সভায় এসেছিল, তারা চিরন্তনীর বত্তৃতা শেষ হতেই উঠে পড়তে লাগল। তখনই সে পরীক্ষিৎকে হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘তুমি বলো মামা, সবাই তোমার কথা শুনতে চায়।’

পরীক্ষিৎ নিস্পৃহভাবে বলে, ‘আমি কী বলব? এবার নতুনরা কথা বলবে। চিরন্তনী কথা বলবে। মাটি ও আকাশ যথাসাধ্য মুক্ত রাখা কীভাবে সম্ভব আমি ভেবে পাই না। মানুষের দুঃখ কষ্ট কমাতে না পারলে সে সবই বৃথা।’ এ-ব্যাপারে প্রত্যেকের ভূমিকা সম্পর্কে পরীক্ষিতের বিশদ আলোচনার মাঝখানে ‘বল হরি, হরি বোল’ শুনে কেউ কেউ কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে দেখে একজন অস্থিচর্মসার বৃদ্ধের শবদেহ-কাঁধে জনা কুড়ি-পঁচিশ ছেলে শ্মশানে চলেছে। বল হরি হরি বোলের পাশাপাশি ‘কমরেড রুদ্র ঝম্পটি অমর রহে’ শ্লোগানও মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে।

মঞ্চের শ্রোতাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, ‘অ্যাদ্দিন পুলিশের খাতায় ফেরার ছিল, এবার জীবনের খাতায় ফেরার হয়ে গেল।’

শবযাত্রীদের কোলাহলে পরীক্ষিৎ কথা থামিয়ে দিয়েছিল, বহু কণ্ঠে ‘আপনি বলুন, আপনি বলুন’ শুনে সে দ্বিধা নিয়েই আবার তার বত্তৃতা শুরু করল। চোখে কালো চশমা থাকায় সে শ্রোতাদের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না।

‘আমার ঠাকুর্দা বৃথাই চেয়েছিলেন বালিসোনার মানুষ তাঁর সমাধি মাড়িয়ে আমাদের রাসমাঠে আসবে। আমার বাবা বৃথাই চেয়েছিলেন লুপ্ত নদী খুঁড়ে বালি থেকে সোনা বের করে বালিসোনাকে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রাম করে তুলবেন। আমার রাঙাজেঠিমা গান দিয়ে, মান দিয়ে, স্নেহ দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে মানুষকে একত্র করার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন। আমার রাঙাজেঠু অবনীমোহন মানুষের আরোগ্যের জন্য তপস্যা করে গেছেন। আসল কথা, মানুষকে সারাজীবন লড়াই করে যেতে হবে তার চারপাশের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে। প্রত্যেকের জীবনে জয়ী হবার ওই একটাই পথ। কে কোন পথে এগোবেন সেটা তাঁকেই বুঝতে হবে। জানি না, হয়তো মানুষের পায়ে পায়ে তৈরি হওয়া পথই আসল পথ। হয়তো এই পথেই এখন আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মানুষের ওপর সবরকম অন্যায় অবিচার বঞ্চনা লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে মানুষের মনেই ধিক্কার জাগাতে হবে। অন্যায়কারীকে দেখে আকাশ-বাতাসও যেন ছি ছি করে ওঠে।’

সুষমা বিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাসের একদল ছাত্রী স্কুল ফেরত বাসস্টপে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করতে করতে শবযাত্রীদের ‘বল হরি হরি বোল’ শুনে যে যার কপালে হাত ঠেকাল, কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে রাখল, দুজন একেবারে পিছন ফিরে দাঁড়াল।

শ্মশানযাত্রীরা হরিধ্বনি দিতে দিতেই দেখল, উল্টো দিক থেকে একটা ভ্যানরিকশায় হাতে হাতকড়া দিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে নিদ্দাকে নিয়ে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ আসছে। ভ্যানের মাঝখানে চটে মোড়া একটা মৃতদেহ বা ওইরকম কিছু। ‘ও বাবা, তোরে কোথায় নিয়ে চলল রে, ও বাবা, আমায় কার হাতে দিয়ে গেলি রে!’ বলতে বলতে মাঝবয়েসী একটা মেয়েছেলেকেও আলুথালু বেশে ভ্যানের পিছন পিছন দৌড়োতে দেখা গেল।

ভোররাতে সাতশিমুলতলার জঙ্গলে পুলিশ চটের লম্বাটে বস্তা খুলে দেখেছে ভেতরে একটা আস্ত নরকংকাল, মৃতদেহ সাজিয়ে পাচারের চেষ্টা করছিল। সঙ্গে আরও দুজন লোক ছিল, তারা কঙ্কাল কেনা-বেচার দালাল। তারা নিদ্দার চোখ এড়িয়ে দুজন পুলিশের হাতে টাকা গুঁজে দিতে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিদ্দার কাজ খুন করা দেহের গতিবিধি আন্দাজ করা, বালিসোনায় খুন-খারাপির কমতি নেই, খুন করে গোপনে কে কোথায় দেহ পুঁতে দেয় তার খোঁজ পাওয়াটাই আসল। তারপর সুযোগ মতো কবর খুঁড়ে কংকাল বের করে দালালদের হাতে তুলে দেওয়া। দালালারা আগাম বার্তা পেয়ে কংকাল বের করবার জায়গায় চলে আসে। কংকাল খোঁড়ায় নিদ্দার অনেক দিনের অভিজ্ঞতা, সাদা চুল-দাড়ি নিয়ে টান-টান শরীর কোমর থেকে ঝুঁকিয়ে সে এখনও একইরকম নৈপুণ্যের সঙ্গে মাটি থেকে কংকাল বের করে আনতে পারে। সারা জীবন অনেকরকম ব্যবসাই সে করেছে, কোনওটার আয়েই তার হা-মুখ সংসার টানতে না পেরে বুড়োবয়সে কংকাল খোঁড়ার ব্যবসা ধরেছে। তার বউয়ের দুচোখে পুরু ছানি, মাথাটা সবসময় কেষ্টনগরের পুতুলের মতো এপাশ-ওপাশ দোলে। এদিকে তিন ছেলের দুজন পোলিওয় পঙ্গু, একটা নিষ্কর্মা, পাঁচ মেয়েকে কে যে কখন কোত্থেকে এসে কালীঘাটে বিয়ে করবে বা দিল্লিতে চাকরি দেবে বলে নিয়ে চলে গেছে নিদ্দা জানে না। শুধু তার বড় মেয়ে গত পৌষসংক্রান্তির দিনে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের কাছে ফিরে এসেছে। মেয়েটা বরাবরই বোকা, ‘পোষ সংকান্তি’ না কাটিয়ে কেউ কি তার ঠাঁই ছেড়ে বেরয়? মেয়েটাকে কাঁদতে কাঁদতে দূর থেকে ছুটে আসতে দেখে নিদ্দা হাতকড়া পড়া দুহাত তুলে চোখের জল মোছে।

ঝম্পটিবাবুর শবযাত্রীরা তাকে দেখতে দেখতে চলে গেল, কেউ একবারও থামল না।

কনস্টেবল দুজন ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কী একটা পরামর্শ করে ভ্যান থামাল, নিদ্দাকে বলল, ‘তোর মেয়েটা তোর পিছু ছাড়বে না, ছুটতে ছুটতেই বেদমে মরে যাবে। ওকে তুলে নে।’

ভ্যানে উঠে বিলাপের চেয়ে তার কান্নাই বেড়ে গেল।

নিদ্দা ধমক দিয়ে বলল, ‘এবার ক্ষান্তি দে যামিনী!’

কান্নার মধ্যেই একবার এ-সেপাইয়ের, একবার ও-সেপাইয়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে গলা চিরে যামিনী কাঁকুতি-মিনতি করে, ‘আমার বাবারে ছেড়ে দেন গো ছায়েব। বাবারে আমার ছেড়ে দেন।’

‘থানায় চ, দেখি কী করা যায়।’ বলে এক সেপাই আরেক সেপাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকায়।

থানায় ঢুকে ‘জেবনের পিদিম ঝ্যানো নিবু-নিবু করছে, মা রে।’ বলতে বলতে নিদ্দা মেঝেতে বসে পড়ল।

দুজন কনস্টেবলের একজন যামিনীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘বড়বাবু এলে তার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে দেখি তোর বাবাকে তোর সঙ্গেই ফেরত পাঠানো যায় কিনা। ততক্ষণ তুই গাছের ছায়ায় গিয়ে বোস।’

দ্বিতীয় কনস্টেবলকে কিছু বলতে হল না, সে যামিনীকে নিয়ে পুলিশ-ব্যারাকের ছাদে যেখানে কদমগাছের ঘন ডালপালা ঝুঁকে আছে, সেখানটায় গিয়ে বলল, ‘বড়বাবু না আসা অব্দি এখানে বসে থাক। এলে তোকে খবর পাঠাব, তখন বাবাকে নিয়ে ঘরে ফিরবি।’

একটু পরে মাটির ভাঁড়ে চা আর একটা আস্ত পাউরুটি দিয়ে গেল একজন। যামিনী অনেকটা ভরসা পেয়ে চা-রুটি খেয়ে কমদগাছের ছায়ায় হঠাৎই ঢুলে পড়ে গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল।

ভোরবেলা চোখে রোদ লেগে ঘুম ভেঙে গিয়ে সে দেখল গায়ে তার শাড়ি নেই, বেলাউজ পাশে পড়ে আছে, বুক ক্ষতবিক্ষত। উঠে বসতে গিয়ে তার সারা শরীর ব্যথায় টাঁটিয়ে উঠল, শরীরের তলায় চাপ চাপ রক্ত। এতক্ষণে যামিনী শরীরের যন্ত্রণা ভুলে চিলচিৎকারে কেঁদে উঠল।

চারজন সেপাই ছাদে উঠে এল। তাদের একজন হুংকার দিয়ে বলল, ‘চোপ! একদম চেঁচাবি না!’ আরেকজন হাঁটু গেড়ে বসে বলল, ‘খবরদার, কাউকে কিছু বলবি না। বললে খুন করে ফেলব। যাকে বলবি তার মাথাও গুঁড়িয়ে দেব!’

যামিনী তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে চাইল, ঠোঁট নড়লেও মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরল না।

একজন নরম মনের সেপাই তার ভয়ার্ত চোখের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোর বাপ আদালতে চালান গেছে, সেখানকার কাজ মিটিয়ে আজ নিশ্চয়ই ঘরে ফিরবে। তুইও ঘরে যা। রিকশা ভাড়াটা রাখ।’ বলে দুটাকার একটা নোট তার গায়ে ফেলে দিল।

দুপুরে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিদ্দা মাথা ঘুরে পড়ে গেল। সন্ন্যাস রোগে তার মৃত্যুর খবর বাইরে চাউর হওয়ার পর, স্বভাবকবির দেশ বালিসোনার কেউ একজন ছড়া বানাল- ‘মুখোমুখি যদি হয় দুই শবদেহ/দুইয়ে মিলে সাথী চায় আরও এক দেহ।’ তা থেকেই পরে বালিসোনাবাসীদের মুখে মুখে নতুন প্রবাদের জন্ম হবে: মুখোমুখি শবদেহ, সাথী হবে আর কেহ।

৩৮

বাজ পড়বার আগে ছুটন্ত বিদ্যুৎসর্পের মতো অধিকাংশ ফ্ল্যাটের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে দেখে সাউথ উইন্ডের বাসিন্দারা বিরক্ত। ওপরের তলাগুলিতে বেশি ফাটল। ঝড়-বৃষ্টিতে তো কথাই নেই, শুকনো দিনেও যখন ঝম ঝম শব্দে রেলগাড়ি যায় তখন বিল্ডিংয়ের বড় বড় ফাটল কাঁপে। বালিসোনায় ডেভেলপার্স সংস্থার স্থানীয় অফিসে অভিযোগ জানালে প্রতিবারই এক মহিলা তাদের লিখিত অভিযোগ পেনাঙের হেড অফিসে ফ্যাক্স করে দেয়। কোনও উত্তর আসে না, কেউ দেখতেও আসে না, ফাটল ময়ালের হায়ের মতো দিনে দিনে বাড়তে থাকে।

দেওয়ালির রাতে আকাশ জ্বালিয়ে বাজি পুড়িয়ে, বাতাস কাঁপিয়ে পটকা ফাটিয়ে, তৃপ্তিসহকারে পান-ভোজন শেষ করে অনেক রাতে সবাই ঘুমে অচেতন, সেই ফাঁকে ওপরের দুটি তলা তিপান্নটি ঝুলবারান্দা সমেত হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল।

পরদিন ভোর থেকে সারা দিন ধরে নিহত ও আহতদের উদ্ধারকাজ চালিয়েও হতাহতের সঠিক সংখ্যা বোঝা গেল না। সারি-সারি শবদেহ ঘিরে ভিড়, ভিড়ের কাছেই দ্রুত নতুন সারি সাজানো হচ্ছে। পুলিশবাহিনী দিশেহারা। অ্যাম্বুলেন্সে গাদাগাদি করে হাসপাতালে পাঠানো মারাত্মক জখম নারী পুরুষ শিশুর সংখ্যা লিখতে ব্যস্ত পুলিশ জানাল, রাজধানী শহর থেকে বড় উদ্ধারকারী দল আসছে। তারা এসে ভগ্নস্তূপের নীচে সন্ধান না করা পর্যন্ত পুলিশ ভীত সন্ত্রস্ত ক্রুদ্ধ আবাসিকদের ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করল।

বালিসোনার আদিবাসী বৃদ্ধরা যে যার ভিটেয় বসে বলাবলি করতে লাগল, নদী আকাশ চায়, বাতাস চায়, দুই তীরে তার বৃক্ষশিকড়বন্ধন চাই, বুকের ওপর ঘরবাড়ির এত জঞ্জালভার সে সইবে কেন!

ভোরবেলা পরীক্ষিতের ঘুম ভাঙিয়ে নীলাঞ্জনা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ গো, আমাদের লালকমল-নীলকমল ফিরে আসেনি তো?’

প্রশ্নটা বুঝতে পরীক্ষিতের সময় লাগল। ঘুম ভাঙা চোখে কিছুক্ষণ নীলাঞ্জনার দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘ফিরেছে? কই, জানি না তো! আমি তো ওদের ফেরার আশা নিয়েই বেঁচে আছি। হঠাৎ তোমার একথা মনে হল কেন?’

‘কাল রাতে সাউথ উইন্ড ভেঙে পড়েছে, বহু লোক মারা গেছে। এর পিছনে লাল-নীলের হাত নেই তো?’

পরীক্ষিৎ ভাবে, মাটি আর আকাশ ঢাকা পড়লে বাবার কষ্ট হয়। নদীটা খুঁড়ে বের করে বাঁচাতে চেয়েছিল, পারেনি। সেই নদীর বুকের ওপর আস্ত একটা বিদেশি শহর বসিয়ে দেওয়া বাবা সহ্য করবে কী করে! নীলাঞ্জনা ভীত মুখে তার দিকে চেয়ে আছে দেখে পরীক্ষিৎ তার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘লালু-নীলুর এখনও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সাউথ উইন্ড ধ্বংসে বাবার হাত আছে মনে হয়। বাবার দীর্ঘশ্বাসে ঝড়ও উঠতে পারে।’

‘কী! কী বলছ তুমি? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’

‘আমার বাবা তার স্বপ্নের জন্য অনন্তকাল যুদ্ধ চালাতে পারে।’

‘তুমিও কি মিতামায়ের মতো হয়ে যাচ্ছ? বাবা আজ কত বছর নেই, তুমি ভুলে গেছ?’

‘বাবার সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হয়। মাঝে মাঝে কথাও হয়।’

‘পরীক্ষিৎ, তুমি প্রকৃতিস্থ হও। তোমাকেও কি শেষে সারা দিন শুধু তিকানের কীর্তন শোনাতে হবে?’

‘তিকানকে কি তুমি কিছু বলেছিলে?’

‘আমাকে এত ছোট ভাবলে? আমিই চলে যাবার কথা ভেবেছিলাম।’

পরীক্ষিৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার শুয়ে পড়ল।

‘এখন উঠবে না? লাল-নীলের খবর নিয়ে দেখলে হত না!’ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘সন্তানভাগ্য সকলের ভালো হয় না, জানো?’

দু-ভাই নিরুদ্দেশ, অরণ্য কতদিন বাড়ি থেকে দূরে, ‘শুশ্রূষা’য় তার নেশা ছাড়ানোর চিকিৎসা চলছে। অরণ্যর কথা ভেবে নীলাঞ্জনা এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সন্তানভাগ্যের কথাটা আরও একবার বলল।

পরীক্ষিৎ রাতের বেশিটাই সরোজিনীর লাইব্রেরিতে বসে লেখে। দোতলায় প্রদীপের ঘরেও সারা রাত আলো জ্বলে। সে মাঝে মাঝে পরীক্ষিতের কাছে অদ্ভুত অদ্ভুত বই চাইতে আসে। না পেলে বিরক্ত হয়। তার সমস্যার কথাও পরীক্ষিৎকে বলে। বালিসোনার ইতিহাস লিখতে লিখতে কখন সে রাজধানীর ইতিহাস লেখায় ঢুকে যায়, কখন আবার তার জীবনকাহিনীতে মন্থরোর মা এসে পড়ে, সেই জট সে আর ছাড়াতে পারে না। সে বিড় বিড় করে বলতে থাকে, ‘বিশ্বজুড়ে সবুজ ধংসে মানুষের প্রাণবায়ুর উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে, কত কীটপতঙ্গ পশুপাখি শেষ হয়ে যাচ্ছে, ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। জেগে গিয়ে লিখতে লিখতে আবার দুঃস্বপ্নে ডুবে যাই। মাইনাস গাছপালা প্লাস দুঃস্বপ্ন- ইকোয়াল টু দ্রুতবর্ধমান দুঃস্বপ্ন।’

একদিন হঠাৎ পরীক্ষিতের কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আনন্দমোহন তোকে আর আমাকে খুন করতে পারে। রাসমাঠে ও একটা বিরাট শপিংমল বানাতে চায়। সঙ্গে নব্য ধনীদের জন্য বড় বড় বাংলো। আমি বলেছি আমি বেঁচে থাকতে একাজ করতে দেব না। তাই আমাকে খুনের ফন্দি আঁটছে। তোকেও ও খুন করবে। খুব সাবধানে থাকিস, বাবা। ওকে ছুরি-হাতে দেখলেও ভয় পাসনি, ভয় পেলে শরীরের এনার্জি চলে যায়। কথা বন্ধ হয়ে যায়।’

একদিন ঘোর বর্ষারাতে সে পরীক্ষিৎকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। বিরাট ঘরটার অর্ধেক জুড়ে বুনো গাছের জঙ্গল, যেখানে যা পায়, শেকড়-সুদ্ধু তুলে এনে টবে পোঁতে। বড় বড় জানলার চওড়া পটিতে তিল, তুলসি, নয়নতারার ঝাড়। ছোট মাপের রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়াও বাইরের দিকে মাথা হেলিয়ে রেখেছে। পশ্চিমের জানলায় লজ্জাবতী লতার সারি পাতা বুজিয়ে ঘুমিয়ে আছে। পরীক্ষিৎকে ঝোঁপঝাড় বাঁচিয়ে ঘরের অন্য প্রান্তে নিয়ে গিয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে প্রদীপ বিছানার দিকে ইঙ্গিত করল। পাটভাঙা সাদা চাদরে লাল, কালো, হলদে, খয়েরি, সবুজ, বেগুনি রঙের বড় বড় ছোপ। একেকটা ছোপের নীচে একেকটা শব্দ লেখা। কোনওটার নীচে লেখা হিংসা, কোনওটার নীচে প্রতিহিংসা, কোথাও ক্ষুধা, কোথাও প্রেম, কোথাও দাবদাহ, কোথাও দখিনাবাতাস, কোথাও জ্ঞানতৃষ্ণা, কোথাও জ্ঞানদাহ, কোথাও উচ্চাশা, কোথাও ফ্যাশন। এইরকম আরও অনেক শব্দ রঙিন বিছানা জুড়ে লিখে রেখেছে।

‘নিউ জেনারেশনের মনের মানচিত্র তৈরি করছি আমি। তাদের মানসিকতার লসাগু গসাগু বের করা দরকার।’ কথাটা বলে তার মানচিত্রের ওপরেই সে শুয়ে পড়ে তখনই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফোঁপাতে লাগল।

পরীক্ষিৎ নিজের ঘরে যাবার পথে দেখল অত রাতেও ভণ্ডুলের সঙ্গে চারজন যুবক বাড়ির ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন মহিলাও আছেন, একজনকে অনেকেই আজকাল নামে চেনে। পরীক্ষিৎও খবরের কাগজে প্রকৃত গণতন্ত্রের পক্ষে তাঁর অনেকগুলো প্রবন্ধ পড়েছে।

ছেলেরা পরিচিত কয়েকজন কবি লেখক শিল্পীর স্বাক্ষর করা একটা ছাপানো কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষিৎকে বলল, ‘আপনি তো স্যার ক্ষমতাসীন দলের অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখেছেন, এবার শাসনক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে আপনার সমর্থন চাইতে এসেছি আমরা। কাগজটায় শুধু আপনার একটা সই দিলেই হবে।’

দেশবাসীর উদ্দেশে ছাপানো আবেদন পড়ে পরীক্ষিৎ বলল, ‘দুর্জন দুরাচারী ক্ষমতাসীন যে-কোনও দলের বিরুদ্ধে আমাকে পাবে। কারও পক্ষে আমাকে পাওয়া যাবে না। পক্ষসমর্থনের যুগ এটা নয়।’

প্রবন্ধলেখক তরুণী এগিয়ে এসে বলল, ‘সত্যকে সমর্থনের যুগ নয় বললেন, তবে কি এটা মিথ্যাচার সমর্থনের যুগ? আপনার স্বাধীন মতটা শুনতে পেলে ভালো হয়।’

‘সত্যকে সমর্থন করা না-করার কথা কি বলেছি? কথাটা ছিল পক্ষসমর্থন নিয়ে।’

‘বেশ। স্যার আপনার মতে যুগটা তাহলে নিরপেক্ষতার?’

একটি ছেলের এই প্রশ্নের উত্তর পরীক্ষিৎ নিস্পৃহ স্বরে বলল, ‘দেশকে যারা ভালোবাসে, তাদের এখন যুগশুদ্ধির কথা ভাবতে হবে।’

পরদিন বিকেলে পরীক্ষিতের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বেখেয়ালে মন্থরোর মায়ের কবরের কাছে পৌঁছে প্রদীপ দাঁড়িয়ে পড়ল। সেও মন্থরোর মাকে মাটি দিয়েছিল, অথচ কবরটাই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ পরীক্ষিতের দিকে চেয়ে বলল, ‘মন্থরোর মা’র মুখের সঙ্গে আমার মুখের কোনও মিল দেখতে পাও তুমি?’ পরীক্ষিৎকে ‘তুই’ বলে, মনে পড়ল না।

‘আমি তো মন্থরোর মাকে দেখিনি।’

‘আমার চিবুক কি মন্থরোর চিবুকের মতো মনে হয় তোমার?’

‘মন্থরোর কথা আমি শুধু শুনেছি, দেখিনি কখনও।’

দুটো ঋতু কেটে যাবার পর থেকেই পরীক্ষিতের কাঁধ না ধরে প্রদীপ হাঁটতে পারে না। পরীক্ষিৎ তাকে ধরে ধরে বালিসোনার অবশিষ্ট গাছপালা ঝোপঝাড়ের কাছে নিয়ে যায়।

পরের বছর প্রদীপ বালিসোনায় বৃক্ষসুমারি শুরু করল। আগামী কয়েক বছরে কোথায় কত গাছ না লাগালেই নয়, তার একটা ধারণা পাবার জন্য বৃক্ষসুমারি করা দরকার। পরীক্ষিৎকেও একাজে নিয়মিত সাহায্য করতে হয়। পরীক্ষিতের নিজেরও আগ্রহ কম নয়। আবার কিছু গাছ লাগাবার একটা সম্ভাবনা তাকে আকর্ষণ করে।

সাউথ উইন্ডের আকাশচুম্বী আবাসনকে পুরসভার পক্ষ থেকে ভেঙে ফেলার নোটিস দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় অফিসের মহিলা সে নোটিস পেনাঙে হেড অফিসে ফ্যাক্স করে দিল। আদালতের নোটিসও ফ্যাক্স মারফৎ পেনাঙে পাঠানো হল।

পুরসভার শাসানির চেয়েও বেশি প্রাণের ভয়ে আবাসিকরা প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করেও ফ্ল্যাট খালি করতে লাগল। এইসময় থেকে বালিসোনায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ব্যাপক প্রবণতা দেখা গেল। সুযোগ বুঝে বেশিরভাগ বাড়িওলা চড়া ভাড়া হেঁকে বসল।

সংস্থার দুজন ডিরেক্টর হেড অফিস থেকে বিমানে উড়ে এসে বাড়ি ভাঙতে রাজি না হলেও আদালতে হাজিরা দিয়ে অ্যাডভোকেটের মাধ্যমে জানাল, তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ। নকশায়, নির্মাণে, মালমশলায় কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। বাড়ি ভেঙে পড়ার একমাত্র কারণ অধিকাংশ ফ্ল্যাট ওনার্স মেঝের সেরামিক টাইলস তুলে ফেলে পুরো ফ্ল্যাটেই মার্বেল বসিয়েছে। অত বেশি বাড়তি লোড নিতে না পারায় বিল্ডিং কোলাপ্স করে। নিহত বা আহতদের জন্য কোনওরকম ক্ষতিপূরণ দিতেও তাই তারা বাধ্য নয়।

অভিযুক্তদের আইনজীবী ও সরকার পক্ষের আইনজীবীদের সওয়াল-জবাব শুনে বিচারক বিদেশি দুজন ডিরেক্টরকে চোদ্দ দিনের জেল হেপাজতের আদেশ দিলেন।

আদালতের বাইরে বিক্ষুব্ধ জনতার নিশ্ছিদ্র ভিড় কেটে আসামীদের পুলিশের গাড়িতে তুলতে ঘর্মাক্ত পুলিশবাহিনীর একজনের কোমরের বেল্ট ছিঁড়ে গেল। টুপি হারা দুজনের কাদামাখা পদপিষ্ট টুপি দিনের শেষে কুড়িয়ে পেয়ে আদালত চত্বরেই এক পাগল গায়ক থানায় জমা দিয়েই পালিয়েছে।

তেইশ বছর ধরে মামলা চলার পর আদালতের রায়ে পেনাঙের ডিরেক্টররা প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস হয়ে গেল। বিচারক স্থানীয় কন্ট্রাকটরদের ছ’মাসের জেল ও সাতাত্তর হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছ’মাস কারাবাসের আদেশ দিলেন। উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল রইল। পুরসভার আলাদা একটা মামলায় বিদেশি সংস্থাকে বিপজ্জনক বিল্ডিং ভেঙে ফেলবার খরচ হিসেবে পুরসভাকে আট লক্ষ টাকা দেবার আদেশ দেওয়া হল।

৩৯

রবিবারের গানের মিছিলে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় ক্রমেই বেড়ে চলল। কিশোর কণ্ঠের মায়াভরা উচ্চারণে ‘গান দিয়ে প্রাণ বাঁচাব’ ভালো করে শুনতে রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর ছাদে বারান্দায় গৃহবাসীরা ছুটে আসে। মিছিলের সামনে-পিছনে পুলিশের গাড়ি এখন একবারের জন্যও আর বাদ পড়ে না।

চাকরি থেকে আগাম অবসর নেবার পরও পরীক্ষিৎকে তার সাপ্তাহিক কলাম ‘বিষাদগাথা’ লিখে যেতেই হয়। আজও তার কোনও কোনও অংশ গানের মিছিলে লাগে, তার অনেক কথাই দেওয়ালে দেওয়ালে দেখা যায়।

পরীক্ষিৎ মিতার কথাও লেখে। মিতা আজকাল তিকানের গাওয়া ‘আমি যোগিনী হইয়ে যাব সেই দেশে’ গুনগুন করে গায়। ‘দে দে আমায় সাজায়ে দে গো’ গাইতে গাইতে তার গলা বুজে আসে। তবু সারা দিন ওই একই পদ সে বার বার গায়। যখন গায় না তখন একমনে বসে কী ভাবে, পরীক্ষিৎ জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না।

নিদ্দার বড় মেয়ে আগে যখন ভিক্ষে করতে আসত, একমুঠো চালের সঙ্গে একটা আলু বা পটল বা ঝিঙে চাইত, পেলেই তাড়াতাড়ি চলে যেত। পোয়াতি হবার পর এবার এই প্রথম এসে নাতবউরানিকে গান করতে দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে গানের কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। গান থামলে বলল, ‘একমুঠো চাল আর একটু নুন দেবে মা? নুন দিয়েই ভাত কটা খেয়ে নেব।’

যামিনী সব বাড়িতেই আজকাল চাল আর নুন চায়। শুধু ভাত খেয়ে নুনটুকু জমিয়ে রাখে। শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর সবটুকু জমানো নুন সদ্যোজাত শিশুর মুখের হায়ের মধ্যে পুরে তার কচি গলা টিপে তার জীবনের প্রথম চিলচিৎকার চিরদিনের মতো থামিয়ে দিল।

দিন কয়েক আগে ভাইয়েরা ঘরের পিছনের আস্তাকুঁড় থেকে মাটি খুঁড়ে তিনটে বড় বড় মেটে আলু তুলেছিল, সেই গর্তে প্রাণহীন শিশুকে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর পা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাবাতে লাগল। হঠাৎ একসময় হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে সে মাটির ওপর বসে মাট্মিাখা দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদেই চলল।

পরীক্ষিৎ গানের মিছিলে যাওয়া বন্ধ করায় কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকে তার কাছে এসে দুয়েক ঘন্টা তাকে ঘিরে বসে থাকে। পরীক্ষিৎ মন দিয়ে প্রত্যেকের কথা শোনে। তাদের নিজেদের মধ্যের আলোচনায়ও কখনও কখনও কেউ কেউ তাকে দলে টানতে চায়।

এরা সবাই কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, অধিকাংশই লক্ষ্মীদের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী। বেশ কিছুদিন একজন শিক্ষকের বদলি হিসেবে পরীক্ষিৎ লক্ষ্মীর অনুরোধে ক্লাস নিয়েছিল, এরা তার সেই সময়ের মুগ্ধ শ্রোতা। সুযোগ পেলেই গানের মিছিলে যায়, পরীক্ষিতের কাছে আসে।

পরীক্ষিৎ তাদের অনেক বিষয়ে তার সংশয়াচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণা ও কোনও কোনও বিষয়ে তার দ্বিধান্বিত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা বলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুগত হঠাৎ পরীক্ষিৎকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার আপনি যামিনীর মর্মান্তিক পরিণামের কথা শুনেছেন?’

পরীক্ষিৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ও শোনার মূল্য কী? ঘৃণায় রাগে প্রতিবাদে আমি কি জ্বলে উঠতে পেরেছি?’

সুগতর সহপাঠী দেবালয় বলল, ‘না স্যার, সেকথা না। চারজন পুলিশ রাতে তার কুঁড়ে ঘরে ঢুকে তার ছেলেমেয়েদের বাইরে অন্ধকারে বের করে দিয়ে তাকে আবার রেপ করে।’

পরীক্ষিৎ শান্ত স্বরে বলল, ‘তোমরা কী করলে?’

অনেকেই একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘শুনেই সকালে আমরা থানা ঘেরাও করেছি। এস পি এসে দোষীদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি দেবার পর আমরা ঘেরাও তুলেছি। চার পুলিশ নাকি আমাদের আসতে দেখে থানার পিছনের পথ দিয়ে পালিয়েছে। এখন, স্যার, চারজনের এগেনস্টেই পুলিশ কেস হচ্ছে।’

তথাগত অস্বাভাবিক শান্ত স্বভাবের ছেলে, সকলের সব কথা একমনে শোনে, নিজে কিছু বলে না। প্রাচীন কাল থেকে ভারতভাগের সময় পর্যন্ত এদেশের পারিবারিক কাঠামো নিয়ে সে পি এইচ ডি-র থিসিস লিখছে, নানা প্রসঙ্গে পরীক্ষিতের কথা তাকে পথ দেখায়, অনেকক্ষণ থেকে পরীক্ষিতের চোখে চোখ রেখে কিছু বলার কথা ভাবছে দেখে পরীক্ষিৎ বলল, ‘তথাগত, কিছু বলতে চাও?’

‘পরে বলব, স্যার। আজ আমি উঠি।’ অন্যদের দিকে চেয়ে, ‘তোমরা কথা বলো।’

বরাবরের অভ্যেস মতো পরীক্ষিৎ তাকে বাইরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলে তথাগত নিচু স্বরে বলল, ‘আমার মেজকা আপনার খুব বড় ফ্যান, স্যার। বিষাদগাথা একবারের কিস্তিও ওর বাদ যায় না। আপনি তো জানেন, মেজকা পুলিশের বড় গোয়েন্দা অফিসার। নিজে এলে কারও চোখে পড়তে পারে বলে আমাকেই বলেছে আপনাকে জানাতে- পুলিশ আপনার চারপাশে জাল গুটিয়ে আনছে, যে-কোনও সময় আপনাকে অ্যারেস্ট করে এবার কোনও গোপন জায়গায় নিয়ে গিয়ে জেরা করবে। শাসকদল বিরোধীদল- কেউ কিন্তু আর আপনার পাশে নেই স্যার। আপনি কোনও পক্ষেরই কাজে লাগেননি। মেজকার পরামর্শ, আপনি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা দরকার হলে মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্য নিন। আফটার হল, দেশের মানুষ আপনার সঙ্গে আছে, হয়তো সরকার আপনার জন্য কিছু করে দেখাতে চাইবে।’

তথাগত তার স্বভাববিরুদ্ধ একটানা দীর্ঘ কথা বলে দম নিল।

ঘরে ফিরে এসে পরীক্ষিৎ ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে থেকে আগের কথার খেই ধরে বলল, ‘সেই চারজন এস-আই কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা তোমরা জানো?’

‘না স্যার, ওরা এখনও পলাতক। পুলিশ তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েও কাউকে পায়নি। মজার কথা, দোষীরা কিন্তু এখনও একই অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। দেবালয় সবটা জানে না, যামিনীকে এবার শুনেছি ওর ঘরে ঢুকে ধর্ষণের পর খুন করে ফেলতে চেয়েছিল, ওর ছেলেমেয়েদের প্রাণপণ চিৎকারে ভয় পেয়ে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গেছে।’

আরেকজন যোগ করল, ‘যামিনীর ভাই তিনটেকে তো আগেই ছিঁচকে চুরির অপরাধে জেলে পাঠিয়েছে।’

পরীক্ষিৎ প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, ‘সক্রেটিস কেন হেমলক পান করেছিলেন তোমরা জানো?’

যারা জানে এবং যারা জানে না, দুপক্ষই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।

কয়েকদিনের মধ্যে বালিসোনা আদালতের সামনে ভিড় উপচে পড়ল। একদল বিক্ষুব্ধ মানুষের গালি-গালাজ ভেদ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যামব্যাসাডর গাড়িতে একজন প্রাক্তন সাংসদকে আদালতে হাজির করা হল। তার বাড়িতে তল্লাসি চালিয়ে সোনা-হিরের প্রচুর গয়নাগাটি ছাড়াও নগদ বিয়াল্লিশ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। পুলিশবেষ্টিত সাংসদের পিছু-পিছু চার পলাতক পুলিশ সেদিনই তাদের উকিলের সঙ্গে আদালতে আত্মসমর্পণ করল।

দিনের শেষে প্রাক্তন সাংসদ ও চার পুলিশ, কারও-ই জামিন হল না।

যুবাবয়সি এক পাগল বারো মাস তিরিশ দিন আদালত চত্বরে ঘুরে ঘুরে দরদী গলায় একটার পর একটা গান গায়। সবই রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি। মাঝে মাঝে হঠাৎই পরিচিত গানের মধ্যে নিজের বানানো কোনও লাইন গেয়ে ওঠে, শুধু তখনই বোঝা যায় তার চোখের সামনের সব কিছুর ওপর তার তীক্ষ্ণ নজর। একবার এক কুখ্যাত অপরাধী লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় সমর্থকদের বিরাট বিজয় মিছিল বেরিয়েছিল। সেদিন সারা সন্ধ্যা পাগলের গভীর গলায় ‘ওই মহাদানব আসে’ শুনে পথচলতি অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আজও শেষবেলায় ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে/তখনও রাঘব-বোয়াল চুনোপুটি এক ঘাটে গো এক ঘাটে’ গাইতে গাইতে সে বাউলদের মতো কোমর ভেঙে নাচতে লাগল।

পরের সপ্তাহে অপরাধী শনাক্তকরণে যামিনীকে পুলিশের গাড়িতে জেলের ভেতরের বড় চত্বরে এনে চারজন আসামির সঙ্গে সাধারণ পোশাকের ষোলজন লোকের সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। অনেকবার বোঝাবার পর, নানা ভাবে অভয় দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত যামিনীকে একজন অফিসার বললেন, ‘দেখুন তো মা, যারা আপনার ওপর থানার ছাদে, আপনার বাড়িতে অত্যাচার করেছিল তারা কি কেউ এদের মধ্যে আছে?’

তিনজনকে চিনতে পেরে যামিনী থর থর করে কাঁপতে লাগল। নিমেষে তার পায়ের কাছে মাটি ভিজে কাদা হয়ে গেল, পরনের ছেঁড়া-ফাটা ময়লা কাপড়ে জলধারা আটকানোর কোনও চেষ্টাই সে করতে পারল না। আঙুল দিয়ে তিনজনকে দেখিয়ে সে কাঁপতে কাঁপতেই মাটিতে পড়ে গেল। মৃৎশয্যা ছেড়ে সে আর ওঠেনি।

চার বছর সাত মাস মামলা চলার পর তিনজনের দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হল। একজন খালাস হয়ে গেল।

পরীক্ষিতের প্রাক্তন ছাত্রদল এসে তাকে জানাল, রায় ঘোষণার এগারো দিনের মাথায় আইনের ফাঁক গলে খালাস পাওয়া চতুর্থ আসামী রাতের টহলদারি ভ্যানে বসে মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় রাস্তায় পরস্পরের পশ্চাৎ জুড়ে থাকা বিপরীতমুখী এক কুকুর-কুকুরীকে দেখে আদর করতে গিয়েছিল, কুকুরের কামড় খেয়ে লাফিয়ে ভ্যানে উঠতে গিয়ে পা কেটে কয়েক দিনের মধ্যেই ধনুষ্টঙ্কার হয়ে মারা যায়।

ঘটনার বিবরণ শেষ হলে তাদের একজন প্রশ্ন করল, ‘এটা কি স্যার যামিনীর অভিশাপ, নাকি পুলিশের নিয়তি?’ একজন ছাত্রী যোগ করল, ‘নাকি ধর্মের কলে বাতাস লাগা?’ আরেকটি ছেলে বলল, ‘প্রায় একই সময় অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের অপমৃত্যু নিছক একটা কাকতালীয় ঘটনাও তো হতে পারে?’

‘তুমি যেভাবে দেখবে, সেটাই তোমার জীবনে চলার পথ হয়ে উঠবে। আমরা যত কিছুর মধ্য দিয়ে যাই সেগুলো যার প্রাণে যত গভীরে বাজে, তার জীবনের পথও তাকে ততই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যায়।’ একমুহূর্ত থেমে, আবার, ‘নিয়ে যায় কি? কী জানি, হয়তো যায়, হয়তো যায় না।’ বলে পরীক্ষিৎ লেখার কাগজে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নীরব হয়ে গেল। আজ আর কিছু শোনা যাবে না বুঝে তার প্রাক্তন ছাত্রদল উঠে যায়।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন