বিষাদগাথা – ২০

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

বালিসোনায় এমন অদ্ভুত কুয়াশা আগে কেউ কখনও দেখেছে বলে বয়োবৃদ্ধরাও মনে করতে পারে না। সকাল আটটা শুধু ঘড়িতেই, ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ দেখে বেলা বোঝাই যায় না। বকুলবেদি, শিরীষগাছ, ছাতিমবন, শিউলি-চাঁপা গোরস্থান সব কর্পূরের মতো উবে গেছে। গোটা বালিসোনা এক অসীম সাদা শূন্যতায় ঢাকা।

কুয়াশা ফুঁড়ে কে এই অসময়ে এসে চৌধুরীবাড়ির দরজার ভারি কড়া নেড়েই চলেছে, জানার উপায় নেই।

দরজা খুলে দরোয়ানের সঙ্গে বাইরে এসে ভণ্ডুল মানুষটার একহাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখে বুঝল একে আগে কোনওদিন দেখেনি। লোকটা ভরাট গমগমে গলায় বলল, ‘এটা যদি অম্বরীশ চৌধুরীর বাড়ি হয়, তাকে গিয়ে বলো তার জাহাজের দোস্ত জাহাঙ্গীর এসেছে।’

মা-বাবা দুজনের কেউই বোধহয় কুয়াশায় সময় বুঝতে পারেনি, তাদের দরজা বন্ধ দেখে পরীক্ষিৎ বেরিয়ে এল।

জাহাঙ্গীর পরীক্ষিতের মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, ‘আশ্চর্য! এতটা বয়েস কমালি কী করে?’

‘আমি ওঁর ছেলে, পরীক্ষিৎ।’

‘অম্বরীশ কোথায়, ডাকো তাকে। দেশে ফিরে শাদি করল অথচ আগে বা পরে একটা খবরও দিল না। ওর ছেলে হিসেবে তোমার বয়েস তো অনেক বেশিই মনে হচ্ছে।’

ভেতরের দালানে জাহাঙ্গীরকে বসিয়ে পরীক্ষিৎ বেরিয়ে যাবার অল্প পরে অম্বরীশ এল, নিজের চোখকেই তার বিশ্বাস হয় না।

তার চেয়েও বেশি অবাক জাহাঙ্গীর, কেউ যেন তার চুলের মুঠি ধরে এক ঝটকায় তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেই অবস্থায় কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতার পর সে কথা বলতে পারল- ‘এ চেহারা তোর হল কী করে? করল কে?’

‘ভূতে আর মানুষে।’ অস্থিচর্মসার মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বসতে বসতে অম্বরীশ বলল, ‘বোস। কত যুগ পরে দেখা! বাড়ি খুঁজে পেলি কী করে?’

‘আমাকে হঠাৎ হাবা ঠাওরালি নাকি? বালিসোনার কথা, তোদের রাসমাঠের কথা, বকুলবেদির কথা তোর মুখে লক্ষবার শুনেও তোদের বাড়ি খুঁজে পাব না? অম্বরীশ, সত্যি করে বল তো, তোর কি এডস হয়েছে?’

‘তার চেয়েও বেশি। বালিসোনার গরল গিলেছি। অতীতের, বর্তমানের সব বিষ পান করেছি আমি।’

‘আগে তো এ ভাষায় কথা বলতিস না। আমাকে বুঝিয়ে বল তো তোর ঠিক কী হয়েছে? আমি বলছি তোর ভয় পাবার কিছু নেই! রিও-র সেই রিভলবার আজও আমার সঙ্গেই আছে।’

সমুদ্র জ্বালানো জ্যোৎস্নায় রিও-ডি-জেনেরোর কোপাকাবানা বিচে তিন গুণ্ডার সমবেত আক্রমণ রুখে দিয়ে একজনের রিভলবার কেড়ে নেবার সেই হাড় হিম করা ধ্বস্তাধ্বস্তি অম্বরীশকে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক করে দিল।

‘সবকিছু খুলে বল আমাকে। দোস্তের জন্য আমি সবকিছুই করতে পারি।’

অম্বরীশ তখনও চুপ করে আছে দেখে বন্ধুকে বাঁচাতে নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চেয়ে জাহাঙ্গীর চোখমুখ হাত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে- ‘মাইকেল বন্দরের কথা নিশ্চয়ই ভুলিসনি!’

‘মাইকেল না, মার্সেই বা হয়তো ভার্সাই। ফ্রান্সে মাইকেলের ঋণজর্জর প্রবাসজীবন কেটেছিল সেখানে। ওখান থেকেই মাইকেল মধুসূদন দেশে বিদ্যাসাগরের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখতেন। আমার অবস্থাও এখন ওইরকম। ঋণজর্জর। পূর্বপুরুষের ঋণের বোঝা বইছি।’

‘কত টাকার ঋণ? আমি মেটাব। আমি একটা জাহাজ কিনেছি। মালবাহী জাহাজ। লন্ডন থেকে আইসল্যান্ডের রেকিয়াভিক হয়ে গ্রিনল্যান্ডের তাসিলাক আর নানোরতালিক রুটে কন্টেনার দেওয়া-নেওয়া করছি, ভাব তো! তোকে ছাড়া আমি ভাবতে পারি না। চল, আবার দুই জিগরি দোস্ত একসঙ্গে সমুদ্রে!’

‘আমার সেই স্বাস্থ্য আর নেই। হয়তো বয়েসও নেই।’

‘সে আমি দেখব, আমি বুঝব। আগে হাত মেলা।’

অনেক দিন পর অম্বরীশ আবার বালিসোনার পথে নামল। জাহাঙ্গীরকে নিয়ে পুরনো অস্টিন থেকে নেমে ক্রাচে ভর করে বন্ধ পাউরুটির কারখানার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বেশির ভাগ পতাকা গ্রীষ্ম-বর্ষার রোদে-জলে পচে গেছে। অবরোধকারীদেরও অনেককেই আর দেখা যাচ্ছে না। যারা তখনও বসে বা শুয়ে আছে তাদেরও আগের সেই উগ্র দৃষ্টি, সেই মারমুখী তেজ আর নেই। তাদের কাছেই জানা গেল, অনেকেই ধরনা ছেড়ে উঠে গেছে। কেউ রোগে শয্যাশায়ী, কেউ অনাহারে মৃতপ্রায়, দুজন চরম দারিদ্র সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।

‘আমি তোমাদের মালিকের বন্ধু। কী পেলে তোমরা আবার কারখানা চালু করতে পারো?’

কারখানার কাজের শেষে যাত্রার পার্ট করে বিখ্যাত হরিদাস অম্বরীশের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘হাতে কিছু টাকা পেলেই ধার-কর্জ মিটিয়ে বউ-বাচ্চা মিলে পেট পুরে দুটো ভাত খেয়ে আবার আমরা লেগে পড়তে পারি, কত্তাবাবু। মাস-কতক আগে উল্টোরথের দিন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর নিয়েও আমরা ক’জন আপনার কাছে এই কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম, আমাদের নেতা যেতে দিল না।’

জাহাঙ্গীরকে নিয়ে বাদার পথে এগোতে এগোতে অম্বরীশের শারীরিক কষ্ট বেড়ে গেল।

‘তুই এখন যা বলবি তাতেই এরা রাজি হয়ে যাবে। কাজে ফিরতে ইচ্ছুকদের হাতে কিছু টাকা দিলেই হবে। যদি বলিস আমিই দিয়ে দিতে পারি।’

‘আমার অত কষ্টের কারখানা নতুন করে করার আর ইচ্ছে নেই। কারখানায় আমার আর মনই নেই।’

বাদায় পৌঁছে সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘রুটি-কারখানা করেছিলাম এই নদীর জন্য।

জাহাঙ্গীর শীতের বাদা, আধখোড়া মরা নদী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে অম্বরীশের ক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বালিসোনা ভ্যাম্পায়ারের মতো তোর রক্ত চুষে খেয়েছে। তোকে ছিবড়ে করে দিয়েছে। আমি তোকে শহরে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে জাহাজে নিয়ে যাব। বালিসোনার বাইরে গেলেই তোর রোগমুক্তির শুরু। চল দোস্ত, প্রাণের বন্ধু আমার, আমাকে নিরাশ করিস না। তোকে নিয়ে যেতেই আমি বালিসোনায় এসেছি রে।’

অম্বরীশের দু-চোখ জলে ভরে উঠল। জাহাঙ্গীরের উৎসুক দৃষ্টি থেকে জলভরা চোখ আড়াল করে তার একটা হাত ধরে বলল, ‘যাব, নিশ্চয়ই যাব। সমুদ্রেই যাব। এখনই না, তুই বসন্তকালে আসিস।’

বন্ধুকে বিদায় জানাবার পর আর সে মুখ খোলেনি। তিনদিন ধরে পারমিতা পরীক্ষিৎ অবনী সরোজিনীরা বার বার প্রশ্ন করেও তাকে কথা বলাতে পারেনি। চোখের অবিরাম জল ছাড়া অম্বরীশের আর কোনও ভাষা নেই। পঞ্চমদিনে কুয়াশাঢাকা সকালে যখন তার কান্না চিরকালের মতো থেমে গেছে বলে জানা গেল, তখনও অম্বরীশের দু-চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলের দাগ শুকোয়নি।

জঙ্গলের মাথা, রেললাইনের পাথর, দূরের বাদা বিকেলের আলোয় বড় মায়াময়, পরীক্ষিতকে কাতর করে। বাবা এই সেদিনও এই সব কিছুর মধ্যে ছিলেন, এখন আর কোথাও নেই, কোনওদিন তাঁকে দেখা যাবে না- পরীক্ষিতের মন এখনও এ-সত্য সইতে পারে না। সব সময় তার মন জুড়ে থাকেন বাবা। যখন ছিলেন, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি। শীতের স্বল্পায়ু বিকেলে রেললাইন ধরে হেঁটে যেতে যেতে তার ভ্রম হয় পাথরকুচির ওপর, কাঠের স্লিপারগুলোর ওপর ক্রাচের মৃদু খটখট শব্দ তুলে বাবাও তার সঙ্গে চলেছেন।

বাবাকে সে কখনও ঠিকমতো বুঝতে পারেনি শুধু নয়, বুঝতে চায়ওনি ভেবে তার মন টনটন করে ওঠে। বাদায় মাটির ঢিবির গায়ে হেলান দিয়ে তাঁর সেই বসে থাকা সে চেষ্টা করেও আর ভুলতে পারে না। তার কেবলই মনে হয়, মানুষের জীবন কোথায় শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হবে, কেউ জানে না। এক যুগ আগে রাঙা-জ্যাঠাইমা হয়তো ঠিকই বলেছিলেন, ‘মেথর তাড়া করে সেই যে বালিসোনা ছাড়ল, তারপর থেকে তোর বাবা সারা জীবন শুধু নিষ্ফল যুদ্ধই করে গেল।’

২১

বসন্তের সূচনায় এক সন্ধের মুখে বিষাদগ্রস্ত পরীক্ষিৎ তিকানদের বাড়ি গিয়ে দেখে একসময়ের পোড়-খাওয়া লড়াকু নেতা জগদীশ আচার্যের নিম্নাঙ্গ বহু কসরৎ করে সাবান দিয়ে ধুইয়ে তিকান নোংরা লুঙ্গি বদলিয়ে দিচ্ছে। পরীক্ষিৎ নিমেষে উল্টো মুখে ঘুরে গেল। ভারি অপ্রস্তুত হয়েও বাবাকে কাচা ফতুয়া পরাতে পরাতে তিকান বলল, ‘বাইরের দরজা বন্ধ করিনি? আমার আর মাথার ঠিক নেই। ভেতরে এসো। বাবা তো আর আমাকেও চিনতে পারছে না!’

এদিকে ফিরে পরীক্ষিৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’

‘ডাক্তার দেখেছেন, ওষুধ খাওয়াচ্ছি, খুব করে হলুদ খাওয়াতে বলেছেন তাও দিচ্ছি, কিন্তু ফল কিছু দেখছি না।’

‘আমি একটু আসছি’ বলে চলে গিয়ে পরীক্ষিৎ অবনীমোহনকে নিয়ে যখন ফিরে এল, তখন হিংস্র পাঁচ যুবকের একটা দল শাসাতে শাসাতে তিকানদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। একজন মাঝারি মাপের নেতাকেও ওদের সঙ্গে দেখা গেল।

অবনী জগদীশের চোখের শূন্যদৃষ্টি অনেকক্ষণ ধরে নিরীক্ষণ করার পর চেয়ারে বসে বলল, ‘স্মৃতি হল আরণ্যক মৃত্তিকা। তার স্তরে স্তরে জীবনের শিকড় নেমে গেছে। এঁর তো মূল শিকড়টাই ছেঁড়া। আর জোড়া লাগবার নয়, এখন দরকার শুধু সেবা আর সাহচর্য।’

পরীক্ষিৎ তিকানকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা কারা, ওভাবে শাসিয়ে গেল!’

ভয়ে উত্তেজনায় তিকান তখনও স্বাভাবিক স্বর ফিরে পায়নি। বলল, ‘বাড়িটা ভেঙে পাঁচ-সাত তলা তুলবে, ফ্ল্যাট করে বিক্রি করবে। আমাদের তাড়াতে চায়। বাবা যতদিন পার্টিতে ছিলেন, কিছু বলতে পারেনি, এখন মাঝেমাঝেই শাসাতে আসে।’

বালিসোনার শিমুলগাছ লাল ফুলে ভরে গেছে, সজনে ফুল শেষ হয়ে ডালে ডালে ডাটার সূচনা হয়ে গেল, হঠাৎ-হঠাৎ মন-উদাসী হাওয়া দিচ্ছে, সেই পূর্ণ বসন্তে একদিন তিকান হারিয়ে গেল।

বুধবারের ‘বিষাদগাথা’ আজকাল ক্রমশ মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। কোনও কোনও দিনের কোনও লেখার কয়েক লাইন তুলে স্টেশনে রাস্তায় পোস্টারও দেখা যায়।

ফাল্গুনের শেষে একদিন সকাল থেকেই মেঘবৃষ্টিতে আকাশ কালো হয়ে আছে। স্যাঁতসেঁতে আবছা অন্ধকার ফুঁড়ে চৌধুরীবাড়ির দরজার ভারি কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলতে পরীক্ষিৎকে এগিয়ে আসতে দেখে দরোয়ান ব্যস্ত হল। দরজা খুলেই সেই জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর- ‘অম্বরীশ কোথায়? ডাকো তাকে। বলো গিয়ে, তার জাহাজের দোস্ত জাহাঙ্গীর এসেছে।’

‘ভেতরে আসুন। এত দেরি করে এলেন!’

‘আমাকে তো বসন্তকালেই আসতে বলেছিল। বলেছিল ওই সময় আমার সঙ্গে জাহাজে যাবে।’

‘বাবা চলে গেছেন। আমি আপনার জাহাজে যেতে চাই। আমাকে সঙ্গে নেবেন?’

‘প্রথমত, তোমার সমুদ্রের অভিজ্ঞতা নেই। দ্বিতীয়ত, তোমার বাবা বলেছিলেন, তোমাকে বালিসোনার খুব দরকার।’

যেমন মেঘবৃষ্টির অন্ধকারে এসেছিল, তেমনই মেঘবৃষ্টির অন্ধকারেই চলে গেল। যাবার সময় মাছ ধরার জাল-ঢাকা প্লাস্টিকের ছাউনির মেয়ে দুটি তাদের জন্মান্ধ ভাইকে নিয়ে পারমিতার কাছে তাদের আরও দুঃখের কথা জানাতে এসেছিল, নিজেদের ঘরে ফেরার এখনও কোনও ব্যবস্থা হয়নি। জাহাঙ্গীর তাদের সব কথা শুনে ‘এই তোমাদের ভাইটির সব দায়িত্ব আমি নিলাম’ বলে যেন সম্মতির জন্য অথবা ছেলেটার দুই দিদিকে বুঝিয়ে বলার জন্য পরীক্ষিতের দিকে তাকাল। তাদের অভাগা ভাইয়ের এমন ভাগ্য খুলে যাওয়ার বিষয়ে পরীক্ষিতের কাছে বিস্তারিত শোনবার আগেই দুই বোন আচমকা এমন শব্দ করে ফুঁপিয়ে উঠল যে জাহাঙ্গীর-পরীক্ষিৎ দুজনেই চমকে গেল।

জাহাঙ্গীর জানতে চাইল, ‘তোমাদের এতে মত নেই, এই তো?’

‘না, না, বাবু, আমরা দুই বোন জীবনে কখনও এত আনন্দ পাইনি। আনন্দে কেঁদে ফেলেছি। এতদিনে ভগবান মুখ তুলেছেন।’

দু-বোনের এক বোনের মুখে কান্নার কারণ শুনে জাহাঙ্গীর বলল, ‘আল্লাহ তোমাদের ভালো করুন।’

‘আপনি মোছলমান? মোছলমান এমন হয়?’

‘কী নাম তোমাদের?’

‘ও লজ্জাবতী, আমার নাম ময়নামতী। আপনার দেশ-ঘর কোথায়?’

‘শুনলে না আমার কোনও দেশ-ঘর নেই, আমি দেশে-দেশে জাহাজে মাল বওয়া-নেওয়া করি।’

দুই বোনের আরও কী কথা বৃষ্টির সঙ্গে আকস্মিক দিক বদলানো বাতাসের ঝাপটায় ভেসে গেল। জাহাঙ্গীর গায়ের রেইনকোট খুলে ছেলেটার গায়ে বেঢপ চড়িয়ে ক্রমবর্ধমান স্যাঁতসেঁতে আবছা অন্ধকারে এগিয়ে গেল।

একটু পরে অকালের মেঘবৃষ্টির আঁধার ফুঁড়ে সে একাই ফিরে এল। দু-হাতে চোখ-মুখের জল চেঁছে ফেলে পরীক্ষিৎকে হঠাৎ বুকে চেপে ধরে খুব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তোমার বাবার মৃত্যুদিনে তাঁর কবরে আইসল্যান্ড গ্রিনল্যান্ডের মাটি দিয়ে যাব।’

পরীক্ষিৎ তৎক্ষণাৎ তার অসম্মতি জানাল- ‘মাটি তো দেয় কবর দেওয়ার সময়। বাবাকে নিয়ে আর খোঁড়াখুঁড়ি করবেন না।’

ভেতরের বারান্দায় জাহাঙ্গীরের জন্য বাগানের মুচকুন্দ ফুলের সরবত পড়েই রইল, জাহাঙ্গীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘এই বসন্তেই ওর সমুদ্রে যাবার কথা ছিল।’

২২

উনিশটি পূর্ণিমা গাছবাড়িতে সুখে কাটবার পর অমাবস্যার দুদিন আগে তিন মাসের পোয়াতি নন্দিনীর পেটের ওপর হাত, উরুর ওপর পা রেখে দিবাকর যখন গভীর নিদ্রায়, দুজনের কেউই দরজার চার ফেরতা দরমা কাটার শব্দও শুনতে পায়নি, তখন চার সশস্ত্র যুবক আচমকা দুজনের হাত মুখ শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে।

একজন দিবাকরের বুকে, আরেকজন তার পিঠে রিভলবার ঠেকিয়ে তাকে ঘরের বাইরে এনে এবার মাথার তালুতে রিভলবার ঠুকে হুকুম করল- ‘সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামো।’ একজন তার একটা পা টেনে সিঁড়িতে প্রথম ধাপে দাঁড় করিয়ে দিল। আরেকজন নন্দিনীর দিকে ফিরে গম্ভীর স্বরে শোনাল- ‘আমরাই ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব। পুলিশকে খবর দিলে তক্ষুনি গুলি করে এর মাথার খুলি উড়িয়ে দেওয়া হবে।’

বাঁধা দুহাতের এক আঘাতেই সামনের ছেলেটির মুণ্ডু উড়িয়ে দেবার জন্য দিবাকর শরীর টানটান করে মোক্ষম মোচড় দেবার আগেই একজন নন্দিনীর বাঁ স্তনের ওপর তার রিভলবারের মুখ চেপে ধরল, আরেকজনের হাতের লম্বা ছুরি তার তলপেট ছুঁয়ে রইল।

দিবাকরকে নীচে নামিয়ে দুচোখ বেঁধে দেওয়া হল। মোটর লাগানো নৌকোয় তুলে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে না ভেবে জঙ্গলের মধ্যে অসহায় নন্দিনীর কথা কল্পনা করে ক্রোধে তার মাথা চৌচির হয়ে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে নিরুপায় হাহাকারের লাভাস্রোত বইছে।

নৌকো থেকে নামিয়ে দিবাকরকে জিপে তোলা হল। সাত ঘন্টা পর জিপ থেকে নামিয়ে আরও কয়েক ঘন্টা হাঁটিয়ে তাকে গভীর জঙ্গলে একটা তাঁবুর মধ্যে ঢুকিয়ে তার চোখ মুখ হাতের বাঁধন খোলা হল।

পুরু গামছায় প্রায় সারা মুখ ঢাকা একটা লোক দিবাকরের কাছে এসে কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার যন্ত্র তৈরির হাত মাথা খুব পরিষ্কার। আমাদের এই দোনলা বন্দুক ভালো করে দ্যাখো, তোমাকে পাঁচনলা বন্দুকের নকশা করে দিতে হবে। সেই নকশা মতো একটা বন্দুক বানিয়ে এখানকার দুজনকে হাতে-কলমে তোমার নকশা ও তার কারিগরি শিখিয়ে দিয়ে তোমার ছুটি।’

তার প্রতি এদের ব্যবহার শুধু ভালোই নয়, তাকে এরা রীতিমতো যত্ন আত্তি করছে। আলাদা তাঁবুতে তার থাকার ব্যবস্থা, দুবেলা পেট পুরে সুখাদ্য খাওয়ানো, যখন যে যন্ত্রপাতি দরকার জানালেই পাওয়া যায়। কামার বা ছুতোরের সহায়তাও চাইলেই মেলে। তবে আলাদা তাঁবুতে থাকতে দিলেও তাঁবুর চারপাশের পাহারা এক মুহূর্তের জন্যও আলগা করে না।

পাশাপাশি পাঁচ গুলি ছোড়বার পাঁচনলা বন্দুক এরা মানুষ মারার কাজে লাগাবে। সেই বিষাক্ত বন্দুক তাকেই উদ্ভাবন করতে হবে ভেবে দিবাকর মনে মনে যন্ত্রণা বোধ করে। এদের বিরুদ্ধে ক্রোধে মাথা জ্বলতে থাকে। নন্দিনীর কথা ভেবে মুখ বুজে সে কাজ করে যায়।

তার আরও একটা বড় দুঃখ, লিওনদাদার পরামর্শ মতো বালিসোনার গরিব মানুষের জন্য সে একটা যন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। ঘাস, পাতা, ফুল, ফল, ফলের বীচি, বাদাম, ধান, গম, শেকড়বাকড় সেই যন্ত্রে ঢুকিয়ে হাত দিয়ে মাড়াই করে নিলেই খুব সস্তায় প্রচুর প্রাোটিন, ভিটামিন, খনিজ পদার্থে ভরপুর খাদ্য তৈরি হয়ে যাবে। এ কাজে সে অনেকটা এগিয়েও ছিল, এখন সব ভুলে মানুষ মারা বন্দুকের ভাবনা ভাবতে হচ্ছে!

গাছবাড়িতে দাগানো উনিশ পূর্ণিমার পর আরও তিন পূর্ণিমা কেটে গেছে। বিপ্লবীদের জঙ্গলে দিবাকর দুই শিক্ষার্থীর চোখের সামনে পাঁচনলা বন্দুক তৈরি করে নকশাসমেত সেই বন্দুক তাদের হাতে তুলে দেবার পরদিন পুরু গামছায় প্রায় সারা মুখ ঢাকা নেতা দিবাকরের সামেন এসে দাঁড়াল। একটাও কথা না বলে বন্দুকে পাঁচটা গুলি ভরে উড়ন্ত পাখির ঝাঁক তাক করে ট্রিগার টিপল। ঠিক পাঁচটা পাখি ওলোটপালোট খেতে খেতে নীচে পড়ে গেল।

বন্দুকে হাত বোলাতে বোলাতে লোকটা বলে উঠল, ‘সাবাশ, সাবাশ! ভেরি গুড!’

তার চোখের ইঙ্গিতে আগের মতোই দুজন দিবাকরের চোখ বাঁধতে এগিয়ে এল। মুখ-ঢাকা লোকটি দিবাকরকে বলল, ‘বন্দুকের ব্যাপারে, আমাদের ব্যাপারে, জঙ্গলের ব্যাপারে কখনও কারও কাছে মুখ খুললেই মৃত্যু। কথাটা প্রাণ থাকতে ভুলবে না আশা করি।’

দিবাকর ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেও তার চোখের দৃষ্টিতে রাগ ও ঘৃণার ঝিলিক। ভয়ে ও উদ্বেগে সে কিছুটা অস্থিরও।

তার চোখ বেঁধে দেবার পর মুখ ঢাকা লোকটি সেই দুজনকেই আদেশ দিল, ‘বালিসোনায় বউয়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে আয়।’

‘জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছেলে দুটির একজনের পেছন-পেছন তার হাতের লম্বা লাঠির ডগা ধরে জিপ অব্দি দিবাকর হেঁটে চলেছে। ঘন্টাখানেক চলার পর লাঠি হাতে ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়ে দিবাকরকে বলল, ‘পেচ্ছাপ করবে?’

‘দরকার নেই। তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাই।’

‘আমি পেচ্ছাপ করে আসছি। একটু দাঁড়াও।’

দু-মিনিট দুজনের কারও-ই সাড়া নেই। তারপরই একসঙ্গে দুটি রিভলবারের গুলি দিবাকরকে শুধু ‘মা গো!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠবার সময়টুকু দিল।

বাইশতম পূর্ণিমাও এসে চলে গেল, দিবাকর তবু ফিরে এল না দেখে নন্দিনী দিবাকরের লেখা চিঠিখানা নিয়ে বার বার পড়ে। দিবাকরকে নিয়ে যাবার পর-পরই অল্পবয়েসি অচেনা একটা ছেলে এসে চিঠিটা দিয়ে গেছে। সে ভালো আছে, শিগগিরি ফিরে আসবে, তার বিষয়ে কাউকে কিছু জানাবার দরকার নেই। পড়তে পড়তে বুক ব্যথা করে উঠলে কখনও সরোজিনী কখনও লক্ষ্মী কখনও মিতার কাছে ছুটে যায়, কখনও বড় মা’র কাছে। নিজের মা’র কাছে আর যায় না, তাকে দেখলেই ‘ও রে, সে আর বেঁচে নেই রে’ বলে অলক্ষুণে কান্নায় মেয়ের বুকেই মাথা খুঁড়বে। ভোরবেলা অবনীমোহন ধ্যানে বসলে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে নন্দিনীও নীরবে বসে থাকে- যদি হঠাৎ তিনি চোখ খুলে কোনও আশার কথা শোনান। একেক দিন তাদের যে সন্তান আসছে তার হাত পা গা মাথার মাপ কল্পনা করে সারা দিন সেইমতো উল বোনে আর দিবাকরের সঙ্গে মনে মনে কত যে কথা বলে যায় সে নিজেই তার খেই রাখতে পারে না।

লিওন ও পরীক্ষিৎ প্রথম থেকেই পুলিশকে ঘটনাটা আগাগোড়া খুলে বলতে চেয়েছিল। নন্দিনীর বাধায় তাদের নিরস্ত হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সকলে মিলে আলোচনা করে থানায় যখন নিখেঁাজের ডায়েরি করা ঠিক হল, তখনও নন্দিনী কেঁদে-কেটে একসা, পুলিশকে জানালেই তার দিবাকরকে নাকি ওরা শেষ করে দেবে।

উলের মোজা, দস্তানা, টুপি, হাঁটু ঢাকা, গোড়ালি পর্যন্ত নানা মাপের ফ্রক ও নানা রঙের পঞ্চে ঘর ভরে গেল, দিবাকরের কোনও খোঁজ বা খবর পাওয়া গেল না। পূর্ণিমার হিসাব রাখা নন্দিনী ছেড়ে দিয়েছে, অমাবস্যার কাছাকাছি এক রাতে যখন সবাইকে অবাক করে একমাথা কোঁকড়ানো চুল আর তারই গায়ের রং নিয়ে তার পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হল তখনও নন্দিনী জানে না দিবাকর কবে ফিরবে। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে, তেল মাখিয়ে রোদে রেখে স্নান করাবার সময়, বিকেলবেলা সাজিয়ে গুজিয়ে কপালে চুমু ও কাজলফেঁাটা দিতে দিতে উদাসমনে ভাবে ছেলে কবে তার বাবার কোলে ঝাঁপাবার সুযোগ পাবে? কবে দিবাকর জোনাকজ্বলা ঘরের পূর্ণিমা-অমাবস্যায় তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠবে? যত ভাবে ততই তার বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

ছেলের নাম প্রভাকর, না জ্যোতির্ময়, না অপরাজেয়- তা নিয়ে অনেক আলোচনার পরও বাড়ির সকলে একমত হতে পারছে না দেখে পরীক্ষিৎ বলল, ‘ওর নাম রাখো মেঘাবৃত। মেঘাবৃত বসু। তোমাদের দুজনের পদবী জুড়ে বসুচৌধুরীও হতে পারে।’

নামকরণ শেষ হবার জন্য কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ব্রতীন দরজার বাইরে থেকে জানাল, ‘একজন দিদিমণি এসেছেন, পরীক্ষিৎ দাদাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান।’

লখনউ থেকে সরস্বতীর চিঠি নিয়ে এক মহিলা এসেছে। সে পতিতাপল্লীর মেয়েদের পেশাপূর্ব পারিবারিক জীবন নিয়ে গবেষণা করছে। সেই কাজে বালিসোনার রেড লাইট এরিয়ায় ওই পেশায় যুক্ত মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে পরীক্ষিৎ কি মেয়েটিকে সাহায্য করতে পারে? মেয়েটি বাঙালি হলেও জন্ম, শিক্ষা সবই বাংলার বাইরে।

আগে এপাড়ায় আট-দশটা খড়ের চালাঘর মাত্র ছিল, এখন টিন টালি অ্যাসবেসটসের ছাদ দেওয়া প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটি ঘর। দরজায় দরজায় সন্ধে থেকে উগ্র সাজসজ্জা করে মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। যেসব দরজার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে নেই, সেসব দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

অন্যান্য কয়েকটি রাজ্যে তার আগের অভিজ্ঞতা থেকে এখানেও নীলাঞ্জনা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মেয়েদের প্রথমেই জানাল সরকার এইসব অসহায় মেয়েদের সাহায্য করতে চায়। সেই জন্যই নীলাঞ্জনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে প্রত্যেকের আগেকার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে। নীলাঞ্জনা প্রথমে অভ্যাসবশে ইংরিজিতে বলল। পরীক্ষিৎকে তার বাংলা করে দিতে হল।

দ্বিতীয় দিনে একটা দরজার সামনে এক দীর্ঘাঙ্গী মেয়ের মুখে পরীক্ষিতের চোখ আটকে গেল। লজ্জাবতী-ময়নামতীর একজন!

লজ্জাবতী বা ময়নামতী পরীক্ষিৎকে চিনতে পারেনি। তার সঙ্গে মহিলা দেখে পরীক্ষিৎকে ঘরে আসার জন্যে পীড়াপিড়ি করবে কিনা স্থির করতে পারল না।

‘হোয়াট এ চার্মিং লুক! ল্য ফ্লর দু মাল! হাউ শি কুড অ্যাপিয়ার ইন দি সিন? আই মাস্ট নো হার পাস্ট ইন এভরি ডিটেল।’

‘প্লিজ ডোন্ট আস্ক হার এনিথিং। আই নো এভরিথিং অফ হার। শি হ্যাজ এ টুইন সিস্টার উইথ ইকোয়ালি ইল ফেট। লেটার আই উইল টেল ইউ অল।’

অন্যদিকে চলে যাবার সময় পরীক্ষিৎ নিজের কৌতূহলে না জিজ্ঞেস করে পারল না- ‘তুমি ময়নামতী?’

মেয়েটি পাশের বন্ধ দরজাটা দেখে বা দেখিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘ময়নামতী ভিতরে। আমি লজ্জাবতী।’

২৩

ছেলেবেলায় তারই বয়েসি একটা ছেলেকে মেলার দোকান থেকে মোয়া চুরির অপরাধে মোয়া ভরতি বিরাট ধামা এক লাফে ডিঙিয়ে এসে দোকানদারের চড় কিল ঘুঁষি মারার দৃশ্য এখনও হঠাৎ হঠাৎ পরীক্ষিতের মন ফুঁড়ে উঠে আসে। মোয়ার ধামা লাফিয়ে পেরবার সময় নিজেরই পায়ে লেগে ধামা উল্টে সব মোয়া দোকানের সামনের কাদায় পড়ে যাওয়ায় দোকানদার রাগে অন্ধ হয়ে মেরেই চলে। দোকানের সামনের জলকাদা ঢাকতে ভাঙা ইট টালি ফেলা হয়েছিল, তার ওপর উপুড় করে ফেলে সবাই মিলে ছেলেটাকে পায়ের চাপ দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলল। মোয়ায় কাদায় মাখামাখি। দোকানদার তখনও জোর পায়ে ছেলেটার পিঠের ওপর লাফাতে লাফাতে বলছিল- প্যাঁকাটির মতো তোর সব ক’টা পাঁজর আমি গুণে গুণে ভাঙব রে ছোড়া!

একটা একটা করে বুকের পাঁজর ভেঙে গেলে মানুষের কী হয়- পরীক্ষিতের ছেলেবেলার সেই ভীত সন্ত্রস্ত ভাবনা আজও মাঝে মাঝে পেয়ে বসে, বিশেষত বিনিদ্র রাতে।

এই ভাবেই এক গ্রীষ্মের গুমোট রাতে বাবার কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাঁরই হাতে লেখা ভাঁজ করা কয়েকটা কাগজে পরীক্ষিতের চোখ আটকে গেল। একটা কাগজের মাথায় লেখা- ‘সাত খুন মাফ।’ নীচে বিবরণ। অম্বরীশের ঠাকুরদার আমলে তাঁরই নেতৃত্বে বালিসোনার কোন এক কপিখেতের যুদ্ধে সাত চাষিকে খুন করা হয়। জমিদারের লোকেরাই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাতটি শবদেহ বাদায় গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়। আরেকটা কাগজের মাথায় লেখা- ‘সাত কংকালের কাহিনী।’ গভীর রাতে একে একে সাতটি কংকাল এসে অম্বরীশের বুকের ওপর বসে তার দম বন্ধ করে ফেলতে চায়, তারই বিশদ বর্ণনা।

তৃতীয় কাগজের শিরোনাম- ‘খুন করে কাউকে মেরে ফেলা যায় না।’

পুরো রাতটা জেগে বসে সব ক’টা কাগজের লেখা বার বার পড়ার পর ভোরে সেগুলো নিয়ে অবনীমোহনের কাছে গেল। অবনীমোহন ছাদে উদীয়মান সূর্যের মুখোমুখি বসে ছিল, ভোরের প্রথম আলোয় পৃথিবীকে দেখা তার অনেক দিনের অভ্যাস। পরীক্ষিতের কাগজের বান্ডিলের শিরোনামগুলোয় একবার মাত্র চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এর সবটাই আমি জানি। খুন করে সত্যিই তো কাউকে মেরে ফেলা যায় না। সব হত্যাই কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকে। হয় বিষ ছড়াতে, নয় অমৃত ফলাতে। আসল কথা, কোনও ঘটনাই কোনওদিন চিরতরে অতীত হয়ে যায় না।’

কৃষ্ণপক্ষের শুরু থেকেই মাঝ রাত পেরিয়ে পরীক্ষিৎ, অবনী আর লিওন বাদায় এসে খোঁড়াখুড়ি শুরু করে দিল। বাইরের শুধু একজনকেই সঙ্গে নেওয়া হয়েছে, সে অভিজ্ঞ নিদ্দা। তৃতীয় দিনে একটা ঢিবি খুঁড়ে, ভাঙা-চোরা সাতটি কংকালই পাওয়া গেল। এই ঢিবির গায়ে হেলান দিয়ে অম্বরীশ সারা রাত ঘুমিয়ে ছিল।

পরীক্ষিৎ দেরি করতে চায় না, বর্ষা আসার অনেক আগেই বালিসোনার বিশিষ্ট মানুষদের ডেকে, চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে সাত কংকালের ভাঙা হাড়গোড় তুলে ঢিবির পাশে নতুন খোঁড়া গর্তে সযত্নে মাটি চাপা দিল। তার ওপরে কংক্রিটের বেদিতে শ্বেতপাথরের ফলক গেঁথে দেওয়া হল। সাদা পাথরের গায়ে কালো হরফে পরীক্ষিৎ লিখিয়ে এনেছে:

বালিসোনার কপিখেতে

প্রথম ফসলরক্ষার যুদ্ধে নিহত

সাত শহীদের স্মৃতিতে

হিন্দু-মুসলমানের কংকালের একত্র অবস্থান নিয়ে ভিড়ের মধ্যে নিহতদের পল্লীর লোকেরা ও পরিবারের বংশধররা প্রথমে গুঞ্জন, পরে প্রতিবাদ করলে পরীক্ষিৎ তাদের বুঝিয়ে বলল- কংকালের কোনও ধর্ম থাকে না। কংকাল শেয়ালের না মানুষের, বালকের না বৃদ্ধের, পুরুষ না নারীর- কংকালের হাড়ে-গঠনে তার পরিচয় থাকে, কিন্তু কংকাল হিন্দুর না মুসলমানের, বৌদ্ধদের না খ্রিস্টানদের, কংকালের গায়ে তার কোনও চিহ্নই থাকে না। কেন থাকে না? কারণ কংকালের কোনও ধর্ম নেই। কংকাল সর্ব ধর্মের অতীত।

পরীক্ষিতের কৈফিয়তে অসন্তুষ্ট, হিংস্রদৃষ্টি কয়েকজনকে শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতিবেশীরা জোর করে নিয়ে যাবার পর জলকাদাভরা জনশূন্য বাদায় শহীদবেদীর সামনে অসময়ে ধ্যানরত অবনীমোহনের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পরীক্ষিতের দুচোখ জলে ভরে এল।

বাড়ি ফিরে অনেকদিন পর মিতার বুকে মাথা রেখে সে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘বাবা বোধহয় এবার একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারবেন!’

লক্ষ্মী-লিওনের বাড়িতে নীলাঞ্জনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। পরীক্ষিৎ ব্যস্ত থাকায় এর মধ্যে পতিতাপল্লীতে আর যাওয়া হয়নি, সে-ক’দিন নীলাঞ্জনা ঘরে বসে লিখে, বই পড়ে কাটিয়েছে।

সপ্তাহখানেক পর পরীক্ষিতের সঙ্গে এ-চালা ও-চালা ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে পল্লীর পশ্চিম প্রান্তে একটা নতুন দোতলা বাড়ি থেকে গান বাজনার আওয়াজ শুনে নীলাঞ্জনা দাঁড়িয়ে পড়ল।

পরীক্ষিৎও বিস্মিত। এপাড়ায় এরকম বাড়ি কখনও ছিল না।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেই ছোট একফালি অপ্রশস্ত লম্বা ঘর, মেঝেয় এলোমেলোভাবে জুতো রাখা আছে, কয়েকজন বাদার মাটি কাটার লোক কড়া ফিনাইলের গন্ধে ভরা প্লাস্টিকের বালতি-ঝাঁটা নিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। অ্যালুমিনিয়ামের থালায় মদের বোতল, সোডার বোতল, বাটি-ওপচানো বরফ খণ্ড নিয়ে সার্কাসের মেয়েদের মতো ফোলানো ইজের ও আঁটো ব্লাউজ পরা যুবতীরা ব্যস্ত হয়ে এদিক-ওদিক যাতায়াত করছে।

বড় হলঘরের দরজার পর্দা সরাতে বাইজীর নাচগানের জমজমাট আসর আলোয় ঝলমল করে উঠল। মাথায় কদমছাঁট চুল, ধুতির ওপর হাফশার্ট পরা পালোয়ানের মতো দুটো লোক পরীক্ষিৎদের সামনে লাফিয়ে এসে তাদের আটকে দেবার আগেই সামনে মদের সুদৃশ্য পাত্র হাতে তাকিয়ায় আধশোয়া আরবের এক শেখ নীলাঞ্জনার উদ্দেশে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল- ‘এনতি জমিরা! এনতি জমিরা! শু ইসমাক?’

বোম্বাইয়ে ‘হোটেল-প্রসটিটিউশন’ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের সময় নীলাঞ্জনাকে আরবি ভাষা কিছুটা শিখতে হয়েছিল। এরকম একটি পরিবেশে আরব শেখের মুখে ‘এনতি জমিরা’ শুনে সে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হল। কথাটার মানে ‘তুমি সুন্দর! কী সুন্দর তুমি!’ এত সাহস যে নামও জিজ্ঞেস করছে- ‘শু ইসমাক’, তোমার নাম কী? তাকেও নিশ্চয়ই এই পল্লীর মেয়ে ভেবেছে। বিদেশে এসে মেয়েদের এরা কী চোখে দ্যাখে তার ভালোই জানা আছে।

লোকটা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে নীলাঞ্জনার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে পরীক্ষিৎ হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে এল।

তার আগেই তার কানে এল- ‘হেডমিস্ট্রেসের সেই জারজ ছেলেটা না? তুমিও শেষে বেশ্যাপাড়ায় মাগী সাপ্লাইয়ে লেগে পড়লে, বাবা? মালটা তো ভালোই বাগিয়েছ!’

পিছন ফিরে ফরাসে প্রায় গড়িয়ে পড়া রুদ্র ঝম্পটিকে দেখেই চিনতে পারল পরীক্ষিৎ। চুলে পাক ধরেছে, মুখ আরও গোল, গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি।

‘সাপ্লায়ার, না নিজেই মাড়াতে এসেছ, খোকা?’

সিঁড়ির শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছে পরীক্ষিৎ হড় হড় করে বমি করে দিল।

নীলাঞ্জনা তার কাঁধের থলে থেকে ছোট তোয়ালে বের করে দিয়ে বলে, ‘লেট’স গো টু পোলিস ফার্স্ট।’

পরীক্ষিতের স্বর দুর্বল, হতাশায় ভরা- ‘লাভ নেই, ঝম্পটি পুলিশের চোখে এখনও ফেরার। সে এখানে আছে, হয়তো নিয়মিতই আসে, পুলিশ ভালো করেই জানে।’

অনেক রাতে পরীক্ষিতের মনে হল তার একটা পাঁজর এবার প্যাঁকাটির মতো পুড়ছে।

সকালে অবনীমোহনের কাছে গিয়ে সে প্রশ্ন করল, ‘আপনার কি মনে হয় না মানুষ মাত্রই সম্পূর্ণ অসহায়? জন্ম থেকেই চিরপরাজিত?’

‘আমার ঠিক এর উল্টোই মনে হয়। আমার মনে হয় মানুষ অপরাজেয়, শুধু সকলে সেটা উপলব্ধি করতে পারে না।’

অবনীমোহনের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেও পরীক্ষিৎ কোনও সান্ত্বনা পেল না। অনেকদিন থেকেই মিতার তীর্থদর্শনে যাবার ইচ্ছে নানা অজুহাতে সে ঠেকিয়ে রেখেছে, এবার হঠাৎ রাজি হওয়ায় মিতা রাত জেগে বাঁধাছাঁদা শেষ করে ফেলল।

সাতসকালেই সকলের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ির পুরনো অস্টিনে চড়ে দুজন বেরিয়ে পড়ল। লক্ষ্মী-লিওনও সঙ্গে গিয়ে ট্রেনের ইন্টার ক্লাসে তাদের বসিয়ে দিয়ে এল।

পরীক্ষিত মিতাকে নিয়ে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে দেবদেবী দর্শন করায়। সে নিজে তখন মন্দিরে ঢোকার মুখে মিতার চটি পাহারা দেয়। আসলে ওই ফাঁকে সে মানুষের মুখ দেখে। সারি সারি মানুষ মন্দিরে ঢুকছে বা ঢোকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে, আবার দর্শন সেরে দলে দলে বেরিয়ে আসছে। এ এক মানুষের চলমান মেলা। কারও মুখের সঙ্গে কারও মুখের সামান্য মিলও নেই।

সন্ধেবেলা বহু কালের পুরনো লোহার রেলিং-ঘেরা নদীর ধারে বসে নদীর জলে ওপারের মন্দিরের আলোকমালার প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে দুজনেই নিঃশব্দে যে যার স্মৃতিপুঞ্জে ডুবে আছে, হঠাৎই নদীর শীতল হাওয়ায় ভেসে-আসা কীর্তনের সুরে মিতার মন ব্যথাতুর হয়ে উঠল-

না পুড়ায়ো রাধাঅঙ্গ

না ভাসায়ো জলে

মরিলে তুলায়ে রেখো

তমালের ডালে

পরীক্ষিতের বুকে ভূমিকম্প হল। এ তো তিকানের গলা, তার প্রিয় পদাবলী! এ পদ সরোজিনীরও বড়ই প্রিয়। তাঁর হুকুমে কত বার যে তিকান এই পদ তাঁকে শুনিয়েছে তার শেষ নেই।

‘আমাদের তিকান না? দ্যাখ না খোঁজ নিয়ে। তীর্থে এমন অনেক কিছুই ঘটে। যা পাবার আর আশা নেই, তাও পাওয়া যায়।’

অনেকক্ষণ বসেও ওপারে যাবার কোনও নৌকোর দেখা নেই। নিরাশ হয়ে কাল সকালে যাবার কথা ঠিক করে উঠে পড়বার মুখে তীরের কাছ ঘেঁসে একটা বড় মাপের ছইওলা নৌকো যেতে দেখে পরীক্ষিৎ হেঁকে বলল, ‘এ কি ভাড়ার নৌকো? ওপারে আমাদের পৌঁছে দেবে?’

‘এ আবার কোন সুমুন্দির পো রে?’

নেশায় জড়ানো গলায় কথাটা বলতে বলতে একজন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে আবার বসে পড়ল, বাকি দু’জন শুয়েই শুয়েই বোতল থেকে চুমুক দিচ্ছে। ছইয়ের মুখে হ্যাজাকের আলোয় ঝলমলে শাড়ি গয়না পরা একটা মেয়েকে তীর থেকেও দেখা যাচ্ছে।

হাওয়ায় তখনও ভেসে আসছে-

না পুড়ায়ো রাধাঅঙ্গ

না ভাসায়ো জলে

মরিলে তুলায়ে রেখো

তমালের ডালে।

কৃষ্ণ কালো তমাল কালো

তাইতে তমাল লাগে ভালো।

পরদিন সকালে নদীর ওপারে কাছাকাছি তিনটি মন্দিরে খোঁজ করেও তিকানের কোনও খবর পাওয়া গেল না।

কিছুটা দূরে অশ্বত্থগাছের ঝুরি-জর্জরিত একটা মন্দিরে গিয়ে জানা গেল, সন্ধ্যায় যে কীর্তন গেয়েছিল ভোরে সে তার বোষ্টমের সঙ্গে মন্দির ছেড়ে চলে গেছে। সাত মাস তারা ছিল এই মন্দিরে।

‘তার নাম কি তিকান?’

‘তাকে তো পুতুলবোষ্টমী বলেই সবাই ডাকত।’

‘তার চিবুকে তিল দেখেছেন?’

‘নদীতে নেয়ে উঠলে দেখা যেত। অন্য সময় চন্দনের ফোঁটায় ঢেকে রাখত। তার আসল কথাই তো আপনি জানতে চাইলেন না। প্রভুদত্ত গলা! প্রভুর কৃপা না হলে অমন কীর্তনের কণ্ঠ কেউ পায়? আপনারা কে?’

মিতা বলল, ‘ওর দেশের মানুষ।’

মন্দির থেকে ফেরার পথে খেয়াঘাটের পাশে চায়ের দোকানে মুণ্ডিতমস্তক, কপালে তিলক কাটা এক তরুণের হাতের খবরের কাগজে পরীক্ষিতের চোখ আটকে গেল। দিবাকরের বিকৃত মুখের ছবি। সন্দেহবশে ভালো করে দেখতে গিয়ে পুলিশের সম্পূর্ণ বিজ্ঞাপনটি পরীক্ষিৎ পড়ে ফেলল। মিতাকেও দেখাল।

‘কী সাংঘাতিক! এ তো দিবাকরের ছবি। চল, ফিরে যাই, খোকা। অমন চুপ করে আছিস কেন? তোর চোখ এত লাল হল কী করে?’

‘খুব তাড়াতাড়ি বালিসোনায় ফিরতে হবে আমাদের’ -যেন জ্বরের ঘোরে কথা বলছে পরীক্ষিৎ।

২৪

জঙ্গলে তিনদিন ধরে রেইড করে ফেরার পথে দিবাকরের পচা-গলা দেহ পুলিশই আবিষ্কার করেছে। সরোজিনী-হাসপাতালের মর্গে শব রেখে খবরের কাগজে আনুমানিক বয়েস ও অন্যান্য তথ্য জানিয়ে মৃতের আবক্ষ ছবি সহ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপনে আরেকটি তথ্যও উল্লেখ করা হয়েছে। মৃতের শার্টের ঘড়ির পকেটে শুকনো বিবর্ণ একটা রজনীগন্ধা ফুল পাওয়া গেছে।

ছবি দেখেই দিবাকরের মুখের আদল চিনতে পেরে নন্দিনীর বুকের ভেতর হাতুড়ি ঘা পড়ছিল, রজনীগন্ধার কথা পড়ে সে চিৎকার করে উঠে জ্ঞান হারাল। মাথায় অনেকক্ষণ জল দিয়ে হাওয়া করে তার জ্ঞান ফেরানোর পর সে হাত বাড়িয়ে আঙুল দিয়ে খবরের কাগজে রজনীগন্ধার জায়গাটা দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ওই ফুল ও নিজেই চিংড়ির জল ঝরানোর মেশিনে শুকনো করে শার্টের ভেতরের পকেটে রেখে দিয়েছিল। ওটা আমাদের ফুলশয্যার ফুল।’ কথাটা শেষ করে ঢিল-খাওয়া কুকুরের মতো সে কঁকিয়ে উঠল।

কেন ওকে ওরা বিছানা থেকে তুলে নিয়ে গেল, কোথায় ওকে নিয়ে গেল, বলেছিল পুলিশকে কিছু না জানালে ওকে শীগগিরই ফিরিয়ে দিয়ে যাবে, আমি তো পুলিশকে কিছু জানাইনি, কাউকে জানাতেও দিইনি, তবে কেন ওকে মেরে ফেলল- তিনমাস ধরে কয়েক ঘন্টা পর পর এইসব কথার সঙ্গে তার আর্ত কান্না বহু দূর থেকেও লোকে শুনেছে।

ছ’মাসের শিশু মুখে কয়েকটা আঙুল পুরে শুধু ওয়া, ইয়া, হোআও ইত্যাদি শব্দ করে কী যে বলে যায় কেউ বোঝে না।

থানায় গিয়ে দিবাকরের হত্যার বিষয়ে কোনও তথ্য তো জানাই গেল না, বরং যখন-তখন চৌধুরীবাড়িতে পুলিশের আনাগোনা শুরু হল। নন্দিনীকে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদও ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

পুলিশের অভিযোগ, এতদিনেও কেন মিসিং ডায়েরি করা হয়নি? মাঝরাতে বিছানা থেকে রিভলবারের মুখে দিবাকরকে তুলে নেওয়া হয়েছে জেরায় সেকথা জেনে পুলিশের আরও অভিযোগ- কেন থানায় কিডন্যাপিং রিপোর্ট করা হল না? ডাকাতি বা খুনের চেষ্টার অভিযোগও তো করতে পারতেন। পুলিশকে কিছুই জানাননি কেন?

‘আমাকে ভয় দেখিয়েছিল, পুলিশকে জানালে তক্ষুনি ওকে মেরে ফেলবে।’

‘পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে না দিলে বিপদ কি কমে? বাঁচাতে পারলেন ওকে?’ গোয়েন্দা অফিসার নোট লিখতে লিখতে চোখ না তুলেই কথা বললেন।

নন্দিনীকে সরিয়ে এগিয়ে এসে এবার পরীক্ষিৎ বলল, ‘পুলিশ বাঁচাতে পারত? পুলিশকে জানালে পুলিশ কি ওকে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে পারত? পুলিশের চোখের সামনে ফেরার রুদ্র ঝম্পটি দশ বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পেরেছে? পশ্চিমপাড়ার একেবারে পশ্চিমে নতুন দোতলা বাড়িতে গেলেই রুদ্র ঝম্পটিকে পাওয়া যায়, তবু পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করতে পারছে না, পুলিশের ওপর মানুষ আর আস্থা রাখতে পারে কি?’

‘আপনারও তাহলে ওপাড়ায় যাতায়াত আছে? তা তাতে দোষেরই বা কী!’

কাকতালীয় ঘটনার মতো ঠিক ওইসময়ই উত্তেজিত নীলাঞ্জনা, পরীক্ষিৎ এ ঘরে আছে জেনে, তাকে কিছু বলতে এসে সামনেই পুলিশ দেখে বলে উঠল, ‘রেডলাইট এরিয়ায় দোতলা বাড়ি এখনই রেইড করুন। বাইজী নাচের বড় হল ঘরের পিছনে ব্লু ফিল্ভমের স্টুডিও, এখনও সেখানে শুটিং চলছে, এক্ষুনি গেলে হাতেনাতে ধরা যাবে।’

গোয়েন্দা অফিসার কিছু বলতে যাচ্ছিল, থানার ও সি তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় নীলাঞ্জনাকে বলল, ‘নতুন নাকি? নাম? কত নম্বর চালা? ওখানে লাগল কার সঙ্গে? কবে এসেছ ওপাড়ায়?’

পরীক্ষিৎ ও সি-র চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ইনি নীলাঞ্জনা মিত্র, সুইডিশ সরকারের স্কলারশিপে ভারতের পতিতাদের নিয়ে গবেষণা করছেন। দেহব্যবসাকে যাদের জীবিকা হিসেবে নিতে হয়েছে তাদের পেশায় আসবার আগের পারিবারিক জীবন এঁর গবেষণার বিষয়। পশ্চিমপাড়ায় এঁকে আমিই প্রথম কয়েকদিন নিয়ে গিয়েছিলাম, এখন একাই যান। আপনাকে আলাদা করে আর দোষ দেব কী! দারিদ্র ও দুর্নীতির দেশে রাষ্ট্র যেমন পুলিশকে অমানুষ বানায়, পুলিশও তেমনি সাধারণ মানুষের জীবনে ঢুকে তার শোধ তোলে।’

মূর্তিবৎ পুলিশদের মধ্যে থেকে ও সি-র গলা শোনা গেল- ‘পশ্চিমপাড়া আজই রেইড করা হবে।’

‘কখন?’ নীলাঞ্জনার প্রশ্ন।

ও সি-র উত্তর, ‘কাগজপত্র রেডি করতে, ফোর্স অ্যারেঞ্জমেন্টে যেটুকু সময় লাগে। আপনিও আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন।’

ঠিক দুঘন্টার মাথায় পশ্চিমপাড়ার নতুন দোতলা বাড়ি চারদিক থেকে সশস্ত্র পুলিশ ঘিরে ফেলা মাত্র রিভলবার-হাতে আরও বড় একটা পুলিশের দল বাড়ির ভেতরে ঢুকে প্রত্যেকটা ঘর সার্চ করেও কোথাও আপত্তিকর কিছু পেল না। বড় হলঘরে আজ শুধু গানের আয়োজন চলছে। বড় টি-পটে চা, থালায় ঢালাও বিস্কুটের ব্যবস্থা, আলাদা রেকাবিতে সাজা পানের স্তূপ।

পিছনের স্টুডিওয় বিয়ে ও অন্নপ্রাশনের ছবি প্রসেসিং ও ডেভেলপিংয়ের কাজ চলছে। আরবের শেখ ও রুদ্র ঝম্পটিকে এখানকার কেউ চেনে না, ওদের কথা শোনেইনি কখনও।

এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা পুবমুখো এগিয়ে লজ্জাবতী-ময়নামতীর দুই দরজাই পাশাপাশি বন্ধ দেখে নীলাঞ্জনা ও সি-কে বলল, ‘এরা দুজনেই আজ দুপুরে শুটিংয়ে ছিল, লজ্জাবতীকে ভালো মতো সরকারি সাহায্যের লোভ দেখিয়ে ওর কাছ থেকেই আমি সব জেনেছি। এখানে নাকি ভদ্রঘরের মেয়েরা, কলেজের ছাত্রীরাও কেউ কেউ আসে। এই ডানদিকের ঘরটা ওর, বেরলেই ওকে চেপে ধরুন, ব্লু ফিল্ভমের ব্যবসা এখানে কারা চালাচ্ছে জানতে পারবেন।’

দারোগার ইঙ্গিতে দুজন কনস্টেবল এগিয়ে গিয়ে দুটো দরজাতেই প্রথমে জোরে ধাক্কা ও পরে লাথি মারতে দরজা খুলে পড়ে গেল। কোনও খদ্দের না, দুই বোন যে যার নিজের ঘরে আচমকা ঘুম ভেঙে সামনে পুলিশ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে বসেছে।

দুজনকে টেনে এনে বাইরে দাঁড় করানো হল। নীলাঞ্জনা বলল, ‘পুলিশ তোমাদের কিছু বলবে না, আমাকে যে অসভ্য বায়োস্কোপের কথা বলেছিলে সেই অসভ্য বায়োস্কোপের ছবি তোলা আজ কখন শুরু হয়েছিল, কতক্ষণ চলছিল এদের বলো তো লজ্জাবতী।’

‘আমি লজ্জাবতী না, আমি আপনারে চিনি না।’

আরেক বোনও একইভাবে বলল, ‘আমি আপনারে চিনি না।’

‘অ্যারেস্ট দেম। দে উইল হ্যাভ টু কনফেস।’

দারোগার নির্দেশে দুটো মেয়েকেই মোড়ের মাথায় কালো গাড়িতে তুলে থানায় এনে লক-আপে ঢোকানো হল।

নীলাঞ্জনা ‘থ্যাংক ইউ স্যার’ বলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ফিরে গেল।

রাত্রে লজ্জাবতী-ময়নামতীকে একসঙ্গে বসিয়ে জেরা শুরু হল।

দারোগা প্রথমে লজ্জাবতীকে জিজ্ঞেস করল, ‘বায়োস্কোপের ফটো তোলে বড় না ছোট ক্যামেরায়?’

‘ছোট ক্যামেরায়।’

‘তোদের পাড়ার মেয়েরা সেখানে শাড়ি-সায়াটায়া খুলে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায়? তোরা দুজন আজ দাঁড়িয়েছিলি?’

যেমন শেখানো হয়েছিল সেইমতো ছোট ক্যামেরার কথাটা মিথ্যে বলেই বুক ঢিবঢিব করছে। দুজনের কারও মুখে কথা নেই। দারোগা কিছু বলবার আগেই লজ্জাবতী বলল ‘একটা মিথ্যে বলে ফেলেছি বাবু, ছোট ক্যামেরা না, বড় ক্যামেরায় ছবি নিচ্ছিল।’

লজ্জাবতীর কোমরে রিভলবারের একটা ঘা দিয়ে দারোগা এবার হুংকার ছেড়ে বলল, ‘ঠিক করে বল, ল্যাংটো হয়ে তোরাও দাঁড়িয়েছিলি?’

‘একটা ব্যাটাছেলেও ছিল।’

‘প্যান্ট পরা?’

‘না, ন্যাংটা।’

‘তোরা দুজনও ছিলিস তো?’

‘আর একটা মেয়েও এসেছিল।’

‘সেও এপাড়ার?’

‘না, সে বাইরে থেকে এসেছিল, হাতে বই-খাতা ছিল। প্রথমে শাড়ি-বেলাউজ খুলতে চাইছিল না।’

‘তিনটে মেয়ে ওখানে কী করছিলি?’

‘লোকটা তিনজনের সঙ্গেই করছিল।’

‘সে কী? কীভাবে? তিনজনের সঙ্গেই কীভাবে?’

‘একজনকে মেঝেয় শুইয়ে, আরেক জনকে পিঠে শুইয়ে, আরেক জনকে সামনে বসিয়ে। ছবি তোলা হচ্ছে তো, তাই।’

‘তোরা ওভাবে ন্যাংটা হয়ে, ব্যাটাছেলের সঙ্গে বায়োস্কোপের ছবি তুলতে দিস কেন?’

‘অনেক টাকা দেয় বাবু। হপ্তাভর চল্লিশ-পঞ্চাশটা খদ্দের থেকে যা আয় হয়, একবেলা ছবি তুলিয়ে তার চেয়ে বেশি পাই বাবু।’

জবানবন্দী লিখে নিয়ে দারোগা মোটা খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আঙুলের ছাপ দে। এই নে কালির বাক্স। বাঁহাতের বুড়ো আঙুল কালিতে ভিজিয়ে ঠিক এই খানটায় ছাপ দে।’

দুজনেই পর পর বুড়ো আঙুলের ছাপ দিল।

দারোগা এতক্ষণে একটা কিং সাইজ সিগারেট ধরিয়ে গাঁজার কলকের মতো দুহাতে ধরে লম্বা লম্বা কয়েকটা টান দিয়ে বলল, ‘ছোট ক্যামেরাই সত্যি, কেউ জিজ্ঞেস করলে ওটাই বলবি। ল্যাংটো ব্যাটাছেলে-মেয়েছেলেদের যেসব কথা বললি, ওসব ভুলে যা, ওরকম কেউ ওখানে কখনও যায়নি, ক্যামেরার সামনে তোরাও কেউই দাঁড়াসনি। যা যা আমাকে বলেছিস, সেগুলো আর মনে আনবি না, আমি যা বলে দিলাম সেটাই তোরা বলেছিস, তাতে আঙুলের ছাপ দিয়ে দিয়েছিস। কথাটা মনে রাখিস। যা, ঘরে যা। বড় ক্যামেরার সামনে যত পারিস ল্যাংটো হয়ে নেত্য কর।’

দুদিন পরে নীলাঞ্জনা পশ্চিমপাড়ায় লজ্জাবতী-ময়নামতীদের দেখে কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইল কে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করল।

জামিন কী, দুজনের কেউই জানে না শুনে নীলাঞ্জনা বলল, ‘কে তোমাদের থানা থেকে ছাড়িয়ে আনল?’

দুই বোন একসঙ্গে দারোগার শেখানো কথাটাই বলল, ‘থানায় মেয়েদের আলাদা লক-আপ নেই বলে বড়বাবু আমাদের ঘরেই থাকতে বলেছে।’

কিছুটা দূরে, দোতলা থেকে যথারীতি নাচ গান বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে।

পরীক্ষিৎ একদিন দুপুর রোদে নীলাঞ্জনার খোঁজে নানা জায়গায় ঘুরে পশ্চিমপাড়ায় তার চেনা-জানা লজ্জাবতী-ময়নামতীদের কাছে গিয়ে দেখল লজ্জাবতীর ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, ময়নামতী নিজের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দূরে হালুইকরের দোকানের কাউকে তীক্ষ্ণ নজরে লক্ষ করছে। পরীক্ষিৎ বলল, ‘কেমন আছো লজ্জাবতী?’

‘আমি লজ্জাবতী না, ময়নামতী।’ বলে সে হাসল।

‘আমার সঙ্গে সেই যে সরকারের দিদিমণি আসতেন, তাঁকে আজ এপাড়ায় দেখেছ?’

‘আজ দেখিনি। কয়েকদিন আগে এসেছিল।’

কথার মধ্যেই লজ্জাবতীর ঘরের দরজা খুলে গেল। ঘর থেকে লজ্জাবতীর আগে আগে দ্রুত বেরিয়ে এল অল্পবয়সি একটা ছেলে। সারা মুখে শিশিরের মতো ঘাম। পরীক্ষিৎকে দেখে উল্টো মুখে হন হন করে হাঁটা লাগাল। দুম করে পরীক্ষিতের মনে পড়ে গেল এ তো বিরোধী দলের ছাত্র ফ্রন্টের এক নেতা, তপন না তাপস কী যেন নাম।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন