অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
নোকো অর্থাৎ লক্ষ্মীপ্রতিমা একটা নতুন ল্যান্ডমাস্টার গাড়িতে বালিসোনার চৌধুরীবাড়ির গেটে এসে যখন পৌঁছল তখন সরস্বতীকে তার মা টেনে টেনে চুল আঁচড়ে জোড়া বিনুনি করে দিচ্ছে। মিস ইন্ডিয়া হবার পর এই প্রথম তার বালিসোনায় আসা। ক্লাস এইট-এ পড়তে পড়তে সেই যে বালিসোনা ছেড়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিল তারপর থেকে সে বালিসোনায় আসত বছরে একবার, শুধু পুজোর সময়।
মায়ের হাত থেমে গেছে, বোনের চোখে পলক পড়ে না।
তিনজনে যখন গল্প-কথা-হাসি-খুশির ঝড় তুলেছে লক্ষ্মী তখনও গত একবছরে তার ভারতসুন্দরীর অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলতেই পারেনি, ভণ্ডুল দরজার বাইরে থেকে বলল, ‘কত্তাবাবু জানতে চাইলেন গাড়ি চড়ে এ বাড়িতে কে এল? আর একটা কথা, বড়দিদিমণির ড্রাইভারসাহেব দুহাতে ধরে পেট থেকে গলা অব্দি গাদাগাদা কাগজের বাক্স নামিয়ে দিয়ে গেলেন।’
‘বাক্সগুলো এঘরে দিয়ে যা। ঠাকুদ্দা কি এখন ঘরে, মা?’
‘তোকে দেখেছেন, তাহলে বকুলবেদীর সামনে চেয়ারে বসে আছেন।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তো দেখলাম একজন ওখানে চেয়ারে বসা। খুব রোগা-পাতলা চেহারা। ঠাকুদ্দা তো পাঠানদের মতো লম্বা-চওড়া।’
‘অসুখের পর ওরকম হয়েছে। কথাও বলতে পারেন না।’
কার্ডবোর্ডের বাক্সগুলোর মধ্যে থেকে বেছে বেছে ‘মা’ ‘সরো’ ‘বাবা’ লেখা তিনটে বাক্স টেনে নিয়ে প্রথমেই খুলল সরোর বাক্স। এক সেট রাজস্থানী ঘাগড়া ব্লাউজ, চুনরি, সঙ্গে উটের হারের রাজস্থানী গয়না। আর এক সেট হায়দ্রাবাদী ইক্কত শাড়ি, সঙ্গে মুক্তোর দু সেট অলংকার। একটা একটা করে পরিচয় দিয়ে সবটাই বোনের কোলে ঠেলে দিয়ে লক্ষ্মী বলল, ‘কীরে, পছন্দ তো?’
সরস্বতী উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে হাঁটু ভেঙে দিদিকে জাপটে ধরে ‘তুই কী ভালো রে দিদি, তুই কী ভালো!’ বলতে বলতে দিদির বুকেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।
অবনীমোহন ঘরে ঢুকে সরো কাঁদছে কি হাসছে বুঝতে পারেনি, নোকোর উদ্দেশে বলল, ‘আমার জন্যে কিছু আনিসনি?’
সরস্বতী ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বোনকে বুক থেকে নামিয়ে, অবনীমোহনের বাক্স খুলে হায়দ্রাবাদী চোস্ত-শেরোয়ানির প্যাকেট আর মাদার পার্লের ছোট একটা কৌটো বাবার হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার আফিং রাখার কৌটো! কী চমৎকার না, বাবা?’
‘ও ঘুম-পাড়ানো নেশা ছেড়ে দিয়েছি রে। কতদিন পর তোকে দেখছি বল তো? তুই কলকাতায় চলে যাবার পর পরই বকুলতলাটা বাঁধানো হল। বেদীর পশ্চিমদিকে দেখিস, গায়ে একটা তারিখ লেখা আছে। তোর চলে যাওয়ার তারিখ। কাঁচা প্লাসটারে লিখেছিলাম। ক’দিন ধরে তোকে দেখবার জন্যে মনটা বড় ব্যাকুল হয়েছিল।’
‘তাহলে দাও, মা ওতে সিঁদুর রাখবে। তোমার যা কমপ্লেকশান, চোস্ত-শেরোয়ানিতে তোমাকে দারুণ মানাবে বাবা। মায়ের জন্য কী এনেছি বলো তো? আসামের মুগা শাড়ি, সঙ্গে তসরের শাল।’
সকালে সকলে মিলে আগের মতো ভেতরের বরান্দায় টানা আসন পেতে জলখাবার খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, ভুবনমোহনের আত্মঘাতী কুঁজওলা বড় মেয়ের দুই শিশুপুত্র আগেরদিন তাদের কাকার সঙ্গে মামার বাড়ি এসেছে, প্রথমে তাদের এনে বসানো হল। কাকাকে মূল বাড়ির বাইরে আলাদা করে অতিথিগৃহে রাখা হয়েছে, তার একটা বদ অভ্যাস- রাতে মশারির তলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ঘুমন্ত মেয়েদের ছুঁয়ে দেখা। তাকেও ডাকা হল। ভণ্ডুল নিয়ে এল কত্তামশাইকে। সেজো তার শ্যালকের সঙ্গে আগের রাত থেকে নিজের ঘরে মদ ও তাস নিয়ে জুয়ায় মেতে আছে, বউকে দিয়ে বলে পাঠাল, পরে খাবে। লক্ষ্মী সরস্বতী আর ন’ভাইয়ের বালিকা কন্যা নন্দিনী, তিন বোন এমনিতেই সুন্দরী, তায় সাত-সকালেই সুন্দর করে সেজেছে, এল কলকল করতে করতে, বসেওছে পাশাপাশি। বেগুন ভাজা ছোলার ডালের পর দুই বউ আর এক বিধবা আত্মীয়া লুচির ডালা নিয়ে এল। সরোজিনীর হাতের বালতিতে ধোঁকার ডালনা, লক্ষ্মীর পাতে দিতে দিতে বলল, ‘তোদের বাবাকে ডেকে আসিসনি?’
‘না তো। আসছি এক্ষুণি।’ বলে লক্ষ্মী হাতের লুচির টুকরোটা নামিয়ে রেখে উঠে গেল। ফিরল প্রায় দশ মিনিট পর, মুখ থমথমে। হাতে একটা কাগজ। গলায় কান্নার ঢেলা ঠেলে লক্ষ্মীর মুখ দিয়ে বেরল- ‘বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন!’
‘মামা বেইবেই গেছে, বউ নিয়ে আব্বে।’ আত্মঘাতী মেয়ের দুই শিশুপুত্রের একজনের মন্তব্য। তাদের কাকাকে দেখেছে, যখনই কোথাও চলে যায়, তার কিছু দিন পর লাল শাড়ির ঘোমটা দেওয়া একটা বউ নিয়ে বাড়ি ফেরে।
লক্ষ্মী তাকে থামিয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা চিরকালের মতো চলে গেছেন। লিখেছেন সন্ন্যাসের পথে যাচ্ছেন। আর ফিরবেন না।’
ভুবনমোহন লক্ষ্মীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে সব শুনছিলেন, হঠাৎ একশো তিনবছর বয়সি বাকশক্তিরহিত বৃদ্ধ সবাইকে চমকে দিয়ে ‘ও হো হো হো!’ করে আর্তনাদ করে উঠলেন।
বুকফাটা আওয়াজ শুনে সেজো ভাই হন্তদন্ত হয়ে তাস-হাতেই বেরিয়ে এল।
‘কী হয়েছে এখানে? এখানে হয়েছেটা কী? কে অমন চ্যাঁচালো?’ কথা শেষ হবার ঠিক আগেই চোখে পড়ল বাবার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে।
‘সেজ্জ্যাঠা, ছোটকা বাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাসী হতে চলে গেছেন। চিঠি লিখে গেছেন।’
‘বরাবরই ওর নাটক করা অভ্যেস। একবার তো কোন যাত্রাদলের সঙ্গে পালিয়েও ছিল। এবারও ওইরকমই কিছু হবে, একটু ড্রামা করে গেল। কই, আমাদের খাবার কই? হাতমুখ ধুয়ে আসছি।’
কেউ কেউ খাওয়া শেষ করছে, বাকিরা সবাই ঠাকুরদাকে ঘিরে আছে।
ঠাকুরদার ঘরে লক্ষ্মীকে তার বাবার চিঠি পড়তে হল: ‘আমি স্বজ্ঞানে চিরকালের মতো সংসার ছাড়িয়া যাইতেছি। যে পিতৃদেবকে শিশুকাল হইতে বিশাল-দেহ দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেখিয়াছি তাঁহাকে এমন বালকের মতো শীর্ণকায় দেখিয়া সংসারজীবন সম্বন্ধে আমার মনে ঘোর সংশয় জাগিয়াছে। তদ্ব্যতীত নোকো-সরোর ন্যায় দুই অসামান্যা কন্যার রত্নগর্ভা জননীর স্বামী হিসাবে কোনও দায়িত্বই আমি পালন করিতে পারি নাই। নিজেদের বাগানের ফল চুরির পাপের শাস্তি স্বরূপ পিতৃদেব কর্তৃক গৃহ হইতে বিতাড়িত ও সাময়িক ত্যাজ্য পুত্র হইয়া আমার সহধর্মিণীকে তিনমাস কত কষ্টই না দিয়াছি। প্রথম সন্তানের জন্ম হইল কি না চাষীভূষিদের পরিবারের সঙ্গে খোড়োচলের গ্রামীণ হাসপাতালে। সংসারী মানুষের সুখদুঃখ, পাপপুণ্য লইয়া বিগত অনেকগুলি বৎসর আমি ক্রমাগত ভাবিয়া আসিতেছি। আফিং ছাড়িয়া ইহাকেই নেশা করিয়াছি। এই ভাবনার নেশায় আমার মনের বহু গ্লানি কাটিয়াছে। আমি আমার জীবনের পথ খুঁজিয়া পাইয়াছি।
‘সংসারজীবন ত্যাগ করিলাম। নোকোকে একবার দেখিবার জন্য এতদিন অপেক্ষা করিয়াছিলাম। তাহার উপহার আমার কোনও কাজে আসিবে না, তাই রাখিয়া গেলাম। সন্ন্যাসই মানুষের সত্যকার পথ।’
সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে ভুবনমোহন স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘নিজে চলে গেল, আমার গলায় স্বর দিয়ে গেল। তোকে তিনমাস ত্যাজ্য করেছিলাম, তুই আমাকে সারাজীবনের জন্য ত্যাজ্য করে গেলি, বাবা?’
পরের বছর, গ্রীষ্মের ধুলোবালি ধুয়ে মুছে বাদা-ভাসানো বর্ষার পরে আসন্ন শরতের মুখে, বাদার জল নেমে গিয়ে জলার অংশে পানিফল তোলার শেষে, ব্যাপারিরা কোমরজলে নেমে জাল পেতে ঘাই দিয়ে মাছ ধরে নেওয়ার পর চাষি তাঁতী নাপিত কুমোরদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল পাঁক ঘেঁটে হাত দিয়ে অবশিষ্ট শোল, ল্যাটা, বান, মাগুর নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেছে, বহুদিনের পুরনো কর্মচারী যতীন বরের ছেলের মুখে বাদার প্রতিবছরের মতো এই ক’মাসের একই ঘটনাচক্র- জলে ভাসা, জল নামা, পানিফলের চাষ ও ফসল তোলা, ব্যাপারিদের মাছ ধরা ও গরিবঘরের ছেলেদের হাত দিয়ে মাছ পাকড়ানো তারপর আবার শাকের সবুজ আস্তরণ, বাসরাস্তার দিকের উঁচু জমি নতুন ঘাসে ভরে যাওয়া- শুনতে শুনতে ভুবনমোহন একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন- ‘অভিমানে বৈরাগী হয়ে গেলি, বাবা!’
যতীন বরের ছেলে ব্রতীন বুঝল, কত্তামশাই বাদার বৃত্তান্ত কিছুই শুনছেন না। দিনের শেষে ভণ্ডুল তাঁকে ঘরে নিয়ে যেতে এসে দেখল তাঁর মাথাটা খড়ের চালা থেকে লিত লাউয়ের মতো চেয়ারের হাতলের দিকে ঝুলে আছে।
বকুলগাছের মাথা ততক্ষণে বকে সাদা হয়ে গেছে। এতো বক এই বকুলগাছে আগে কখনও দেখা যায়নি। বাদা ছেড়ে সন্ধের মুখে সার বেঁধে সব এখানে উঠে এসেছে।
ভুবনমোহন যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি ছাড়া আর কারও তাঁর ঘরের সিন্দুকে হাত দেবার অনুমতি ছিল না। এখন সেই সিন্দুক খুলে পাওয়া গেল খামে সাতটা ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট। প্রত্যেকটি পঞ্চাশ হাজার টাকার। প্রতিবছর একটা করে কিনেছেন, প্রত্যেকটাই কেনার তারিখ থেকে দশ বছর মেয়াদের। ম্যাচিওরিটিতে দেড় লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে। সবকটি সার্টিফিকেটেই নমিনি করে গেছেন সরোজিনীকে। এর মধ্যে দুটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। চারটি খামের ওপর লেখা- ‘পৌত্র-পৌত্রীদের শিক্ষা ও পৌত্রীদের বিবাহ খরচ’। একটিতে ‘জ্যেষ্ঠ পুত্রবধুর সাধ-আহ্লাদের খরচ ও বিদুষী সরোজিনীর বিলাতি গ্রন্থ আনাইবার খরচ।’ আরেকটিতে লেখা ‘হিন্দুশাস্ত্র মতে আমার শ্রাদ্ধ ও দরিদ্রভোজনের খরচ।’
সিন্দুকের এক কোণে ঘোড়ার পিঠে বসবার পার্সিয়ান কার্পেট, তার নীচে একটা না-খোলা হুইস্কির বোতল, গাঁজলা ওঠা। ভুবনমোহন অসুস্থ হবার পর আর হুইস্কি ছোঁননি। শীতের ভোরে খেজুর রস, গ্রীষ্মের দুপুরে ডাবের জল, বিকেলে সারা দিন ঘরের কোণে রাখা ঠান্ডা তরমুজের রস- এইসব হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রিয় পানীয়।
সিন্দুকের তলা থেকে বড় বড় খামগুলো তুলে নেবার পর পাওয়া গেল তাঁর উইল। নিজের হাতে লেখা। মাত্র কয়েক লাইন:
‘আমার পিতার কবরের পাশে আমাকে যেন কবর দেওয়া না হয়। রাসমেলায়, রথযাত্রায় বালিসোনা অঞ্চলের আবালবৃদ্ধবনিতা যে পথে রাসমাঠে প্রবেশ করে সেই প্রবেশপথে আমাকে কবর দিও। তাহার উপরে কোনও কাঠামো গড়িও না। যেন আবার সেখানে স্বাভাবিক ঘাস গজাইতে পারে।’
এই অবিশ্বাস্য অসম্ভব ইচ্ছা শুধু জ্যেষ্ঠপুত্রের বিধবা ও কনিষ্ঠা পুত্রবধু ছাড়া আর কেউ মানতে চায় না। বিশেষ করে পিতার কবর মাড়িয়ে আপামর জনসাধারণ রথযাত্রা রাসযাত্রায় যাবে আসবে এ যে কল্পনার অতীত। কিন্তু সদ্য প্রয়াত পিতার শেষ ইচ্ছা অমান্য করাও যায় না।
মেজো ছেলে কলকাতা থেকে এসে বাবার কবরের আদেশনামা নিজের হাতে নিয়ে দুবার পড়ে ‘ডিসগাস্টিং’ বলে গাড়ি ঘুরিয়ে সেদিনই কলকাতায় ফিরে গেল। তার হাইকোর্ট ফেলে এসব বাজে সেন্টিমেন্টাল ব্যাপারে সময় নষ্ট করা অর্থহীন। তার স্ত্রী সুনয়নী অবশ্য শ্রাদ্ধ না মেটা পর্যন্ত থেকে গেল। লক্ষ্মীপ্রতিমা তার জ্যাঠতুতো দিদিকে নিয়ে গুজরাটে গেছে তার হাসপাতালের জন্য ডোনেশান সংগ্রহে, তারা ঠাকুরদার শ্রাদ্ধে আসতে পারেনি।
শ্রাদ্ধের সাতদিন আগেই বাসরাস্তার ধারে রাসমাঠের কিনারে সিনেমা হলে নায়ক-নায়িকার ছবি-আঁকিয়ে দুলাল পটুয়াকে দিয়ে ৩০x১২ ফুট বোর্ডে স্বর্গীয় পিতা ভুবনমোহন চৌধুরীর শ্রাদ্ধ উপলক্ষে সার্বজনীন মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ জানানো হল। সঙ্গে লেখা হল- পিতৃদেব জীবদ্দশায় যে সকল পথচারীকে নিমন্ত্রণ করিয়া গিয়াছেন, এবং যাহাদের করিতে পারেন নাই, সমগ্র বালিসোনা অঞ্চলের এমন সকল আবালবৃদ্ধবনিতাকে ঐ দিবস বেলা এগারো ঘটিকা হইতে রাসমাঠে ভোজে যোগ দিতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো যাইতেছে।
ঘিয়ে ভাজা লুচি, ছোলার ডাল, মুগডালের খিচুরি ও পাঁচমিশেলি সবজির ঘন্ট, চাঁদোখালির দই, সুবল সাউয়ের ছানাপোড়া, আর স্থানীয় ময়রাদের আগের দিনই বাড়িতে আনিয়ে ভিয়েন বসিয়ে সারা রাত ধরে বানানো সন্দেশ রসগোল্লা লেডিকেনি দানাদার- সন্ধে ছ’টা অব্দি দূর দূর থেকে দলে দলে লোক এসেও খেয়ে শেষ করতে পারেনি। বালিসোনার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কলকাতা থেকে ছাপানো নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের জন্যও একই নিরামিষ ভোজনের ব্যবস্থা।
শ্রাদ্ধ মিটে যাবার কয়েকদিন পরই সরোজিনী কবরের দুপাশে কল্পনায় দুটি তোরণস্তম্ভ ধরে নিয়ে তার একপাশে একটা শিউলিচারা আরেক পাশে একটা স্বর্ণচাঁপার কলম পুঁতে দুবেলা তাতে জল দিতে ভোলে না।
পরের বছর শিউলির সময় পার করে কালীপুজোর শেষে দুটো একটা করে শিউলি ঝরতে দেখা গেল। পুরো হেমন্তকাল কবরের বুকে নতুন দুর্বাঘাস শিউলিতে সাদা হয়ে উঠল। বর্ষায় কবরের ওপরের আকাশ-বাতাস স্বর্ণচাঁপার বর্ণে-গন্ধে দৈবভাব ধারণ করল। ক্রমশ রাসমাঠের এই প্রবেশপথটি লোকের মুখে মুখে শিউলি-চাঁপা গোরস্থান নামে খ্যাত হল।
বাবার গৃহত্যাগের পরদিনই লক্ষ্মী তার সংবর্ধনা বাতিল করে দিয়েছে। বিকেলে ভণ্ডুল এসে বলল, ‘এস-ডি-ও সাহেব এসেছেন পুলিশ নিয়ে। বড়দিদিমণিকে চাইছেন।’
ভণ্ডুলের পিছন থেকে যতীনবাবু জানালেন, ‘পুলিশের জিপগাড়ির পিছনে অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে এস-ডি-ও এসেছেন, এই যে কার্ড দিয়েছেন।’
‘বসবার দালানে নিয়ে বসাও। আমি আসছি।’
লক্ষ্মী আসা মাত্র অল্পবয়সি এস-ডি-ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি, সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আপনি অনুগ্রহ করে ক্যানসেল করবেন না।’
সাদা শাড়ি সাদা ব্লাউজ পরা লক্ষ্মীকে দেখে এস-ডি-ও-র চোখে মুখে মুগ্ধতা তার চোখ এড়ায়নি। সেও প্রতিনমস্কার করে বলল, ‘আমাকে আপনারা মার্জনা করবেন। কোনও পাবলিক অনুষ্ঠানেই আমার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়। তবে সংবর্ধনার চেয়ে অনেক বড় একটা কাজে আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই। আমি এখানকার গ্রামীণ হাসপাতালকে বড় করে গড়তে চাই। ধরুন পুরনোটা ভেঙে এক বিঘের ওপর দোতলা বিল্ডিং তৈরি করা। এবারও আসবার সময় সেই খড়ের চালা আর মাটির দেওয়াল দেখেছি। বাইশ বছর ধরে কোথাও এর এতটুকু বদল হল না।’
‘এটা নিয়ে তো একটা সিরিজ অব মিটিং দরকার। তাছাড়া এই মুহূর্তে ফান্ডের ব্যবস্থাও করা যাবে না। ফাইনান্স থেকে অ্যাপ্রুভাল দেবে না। স্যাংশান পাওয়া অসম্ভব।’
‘বেশ তো, আমরাই ক’জন একটা প্রাথমিক আলোচনা শুরু করতে পারি। আপনি ফ্রি থাকলে আমি কাল বিকেল চারটের সময় আপনার অফিসে চলে যাব। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান আর হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট বা ভারপ্রাপ্ত ডাক্তারকে আপনি যদি আসতে বলে দেন তাহলে একটা ফ্রুটফুল আলোচনা কালই হতে পারে।’
যেতে যেতে এস-ডি-ও ফিরলেন- ‘এখানে আপনার কোনও অসুবিধা হলে বা কিছু দরকার হলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন।’
এর সাড়ে-চার বছর পর গ্রামীণ হাসপাতালের দোতলা ভবন উদ্বোধনের দিন লক্ষ্মী, স্থায়ীভাবে ফিরে আসার আগে এই শেষবার বালিসোনা গ্রামে এল। আগের এস-ডি-ও নেই, নতুন এস-ডি-ও-কে আনা হয়েছে, তিন স্কুলের দুই প্রধানশিক্ষক ও এক প্রধানশিক্ষিকা মঞ্চে আসীন। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান তখন তার কাকা, বাবার পিঠোপিঠি ভাই, তার আসন এস-ডি-ও-র পাশেই। এস ডি পি ও, সার্কেল অফিসার, ও সি সবাই নিমন্ত্রিত। স্থানীয় ডাক্তারদের প্রায় সবাইকেই বলা হয়েছে, তারা দর্শক-শ্রোতাদের আসনে বসেছেন। সরোজিনীকে হাত ধরে মঞ্চে তুলে নিল লক্ষ্মী।
‘ভাগ্যদোষে এখানেই, তখনকার সেই মাটির দেওয়াল খড়ের চালার হাসপাতালে আমার মাকে আমার জন্ম দিতে হয়েছিল।’
মঞ্চের সকলেই স্তম্ভিত। এ কি বিশ্বাস্য? সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।
‘আপনারা অবাক হবেন না, অবিশ্বাস করারও কিছু নেই। যেটা সত্যিই বিস্ময়ের, সেটা হল এত দিনেও এই হাসপাতালে কোনও পরিবর্তন হল না। আসুন, সবাই মিলে আমরা প্রদীপ জ্বালাই, তারপর আমার মা ফিতে কেটে নতুন হাসপাতালের দ্বরোদঘাটন করবেন।’
এস-ডি-ও বলে উঠলেন, ‘সি ইজ দ্য ফিটেস্ট পারসন ফর দ্য গ্রেট অকেশান।’
সবাই বলাবলি করতে লাগল, ‘এরকম একটা শুভ অনুষ্ঠানে এর থেকে ভালো আর হয় না।’
মঞ্চের সকলের হয়ে প্রথমেই লক্ষ্মীর উদ্দেশে সংবর্ধনা-পত্রটি পড়লেন উদ্বাস্তু উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা প্রজ্ঞাপারমিতা মৈত্র। তাঁর কণ্ঠস্বর কিছুটা মাদকতাময় ও সুখশ্রাব্য। বালিসোনায় আসবার আগে কয়েক বছর তিনি আকাশবাণীর ঘোষিকা ও পরে প্রাোগ্রাম এক্সিকিউটিভ ছিলেন। কেন তিনি আকাশবাণীর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে গ্রামের উদ্বাস্তু বালিকা বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে চলে এসেছেন, তাই নিয়ে এখনও কেউ কেউ কথা বলে।
সম্ভাষণপাঠ শেষ হতেই এস-ডি-ও মাইকের কাছে এগিয়ে আসছেন দেখে লক্ষ্মী মাইকের সামনে এসে বলতে শুরু করল, ‘আমরা এখানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের জন্য আসিনি। তার চেয়ে অনেক বড় একটা কাজে মিলিত হয়েছি। আপনাদের সকলের সহযোগিতায় এর সূচনা হয়েছে, এখন সকলের আন্তরিক চেষ্টায় এর অগ্রগতি দেখার অপেক্ষায় থাকব। সরকারি ফান্ডের জন্য সময় নষ্ট না করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করুন পরিকাঠামোর উন্নয়নে। সেটাই সরকারের কাজ। রাস্তা বাড়ানো, ইলেক্টিক ছড়িয়ে দেওয়া সরকার ছাড়া আর কেউ তো করতে পারে না। এই যে এখানে একটা নদী মজে আছে, শুনেছি ওটাই নাকি আদি গঙ্গা। সেটা খুঁড়ে বের করে আবার সমস্ত বালিসোনা অঞ্চলকে ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত জলপথে যুক্ত করা যায় কি না তার চেষ্টাও সরকারি উদ্যোগ ছাড়া করা যাবে না।’
অম্বরীশ খানিকটা বিস্ময় নিয়ে ভাইঝির কথা শুনছিল, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘নদী উদ্ধার সরকারি কাজ হতে পারে না। তাহলে তো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দায়িত্বও বিজ্ঞানীর হাত থেকে সরকারের হাতে দিয়ে দেওয়া উচিত। ল অব গ্রাভিটেশন বা থিওরি অব রিলেটিভিটির আবিষ্কারক নিউটন, আইনস্টাইন, কোনও দেশের সরকার নয়।’
কাকার হঠাৎ এই উত্তেজনায় লক্ষ্মী অবাক।
মঞ্চে সমান উদ্দীপনায় ‘মিস চৌধুরী, আপনি বলুন, মিস ইন্ডিয়া, আপনি বলুন’ শুনে দুয়েকটি মুহূর্ত নীরব থেকে লক্ষ্মী বলল, ‘আমি খুব খুশি হব, নতুন এই হাসপাতালের নাম যদি আমার মায়ের নামে রাখা হয়। আমার দুঃখী মা তাতে কতটা আনন্দ পাবেন জানি না, কিন্তু আমার আনন্দের সীমা থাকবে না।’
সহস্র হাততালি থেকে কান বাঁচাতে সরোজিনী কানে আঙুল দিলেন।
শীত পড়তেই চাষিরা গায়ের খাটো ধুতিতে গা ঢেকে ভোরের কুয়াশার মধ্যে খেজুররস নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। যাদের মাঠের কাজ তারা লাঙল বা কোদাল নিয়ে মাঠের পথে। বাদার মাটি-কাদার ওপর কচি কচি শাকের বিস্তৃত আবরণে হিল্লোল তুলতে শুধু হাওয়াই পারে। বাদায় এ যেন প্রতি বছরের প্রাকৃতিক উৎসব।
বাদার যে বিশাল অংশ জলা সেখানে কচুরিপানার বুকে বকের পাল যেন উদ্দেশ্যহীন ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, পানার ফাঁকফেঁাকড় দিয়ে ছোট মাছ দেখতে পেলেই ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে।
কচুরিপানার শেষে তারই সমান্তরালে উত্তর থেকে দক্ষিণ চলে গেছে বহুকালের পুরনো রেললাইন। নিমাইসন্ন্যাসের সময়ে একবার ভয়াবহ ভূ-কম্পে দূরে সরে যাওয়া সমুদ্রের শুকনো ডাঙায় গিয়ে রেললাইন শেষ হয়েছে।
রেললাইন পেরিয়ে লাইনের প্রায় সমান্তরালে ঘন বন।
বন থেকে বেরিয়ে রেললাইন পার হয়ে জলার হাঁটুজল ভেঙে অন্যমনস্কভাবে শাকের খেত মাড়িয়ে অম্বরীশ উইন্ডচিটারের জিপ টেনে কোমর পর্যন্ত নামিয়ে দিল। শীতেও তার কপালে গলায় ঘাম। এবার বাদার উত্তরে দক্ষিণে মনে মনে কিছু একটা জরিপ করে সে বাড়ির পথ ধরল।
মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হয়ে দ্বিতীয় দিনের মিটিংয়েই অম্বরীশ বালিসোনায় খাটাপায়খানার যুগের অবসান ঘোষণা করেছে। দুজন কাউন্সিলর তার এই সিদ্ধান্তের ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইলে অম্বরীশ তাদের নিরস্ত করে বলল, ‘একজনের মল আরেকজন মাথায় বয়ে নিয়ে যাবে সেটা কি খুব মানবিক? একেক জনকে কতগুলো বাড়ির গামলা খালি করে নিজের ড্রাম ভরতে হয় কোনও ধারণা আছে আপনাদের? আপনারা মহাত্মা গান্ধির মতবাদের বিরুদ্ধে যেতে চান নাকি?’
বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘোষণা করে দেওয়া হল- যারা পারবেন তারা যেন তিন মাসের মধ্যে খাটাপায়খানার জায়গায় তিন চেম্বারওলা স্যানিটারি পায়খানা করে নেন। যাদের সামর্থ নেই তাদের জন্য মিউনিসিপ্যালিটি মাত্র কুড়ি টাকায় সুলভ পায়খানা দেবে। যারা সুলভ পায়খানা নিতে চান, তারা এখন থেকে নিজের জমিতে অগভীর কুয়ো খুঁড়ে রাখুন।
বিদ্রোহী কাউন্সিলর দুজন এবার নতুন আপত্তি তুললেন- ‘মাথায় মল বওয়া মেথররা সব বেকার হয়ে যাবে, তাদের কী হবে ভেবেছেন কি?’
‘যখন কাজ বন্ধ হবে তখন থেকে তারা মাটি খুঁড়বে। একই মজুরিতে।’
‘মাটি খুঁড়বে? কোথায়?’
‘দেখতেই পাবেন।’
‘আমাদেরও তো জানা দরকার।’
‘তাহলে জেনে রাখুন- যারা বেকার হবে তাদের কাজ হবে আমাদের হারানো নদী উদ্ধার করা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কিছুটা খুঁড়লেই নদীর চিহ্ন দেখা যাবে। তারপর খুঁড়তে থাকলে একসময় না একসময় নদীর খাতও পাওয়া যাবে। কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি নিজে তদারক করব।’
কাউন্সিলরের গলায় এবার ব্যঙ্গের সুর- ‘আপনি কি বরফের কারখানা বসিয়ে হিমবাহও বানাবেন নাকি?’
অম্বরীশ অনেকটা বলে ফেলেছে, নিজেকে সংবরণ করে নিল, ভাগ্যিস সেই প্রাচীন পুথির কথাটা বলে ফেলেনি, যেটা হাটের দিনে সুর করে শুনিয়ে মাতৃহারা মন্থরো রোজ একবেলা একমুঠো অন্ন জোগাড়ের চেষ্টা করে।
‘বালিসোনা নদী তীরে বালিসোনা গাঁ।
নাও ভাসাইয়া যায় সতী বেহুলা।।
সোনাদানা সব লয়ে নাও ডুব্যা যায়।
বেহুলা তখন ভাসে কলার ভেলায়।
জলে সোনা থলে সোনা বালি সোনাগুঁড়া।
খুঁইজ্যা দেখো নদীটার ল্যাজা হইতে মুড়া।।
‘এ পুথি তুই কোথায় পেলি?’ হাটে মন্থরোকে জিজ্ঞেস করেছিল অম্বরীশ।
‘আম্মার আন্নাঘরের চালার বাতায় গোঁজা ছিলো।’
‘আমাকে দিবি? দিলে টাকা দেব।’
‘ক’টাকা, কত্তাবাবু?’
‘তুই কত চাস?’
‘তা দশ টাকা পেলি হয়।’
‘এই নে দশ, আর এই আরও এক। খুশি তো?’
আম্মার ইন্তেকাল হবার পর এই প্রথম মন্থরো আকর্ণ হাসে।
ভোর ছটা থেকে সন্ধে ছটা পর্যন্ত বাদার নরম মাটিতে ঝপাঝপ তিন কুড়ি কোদাল পড়ে। কখনও গাছের অদৃশ্য শিকড়ে বা গুঁড়িতে কোদাল লাগলে কুড়ুলে শাবলে উপড়ে ফেলা হয়। শুধু মেথর নয়, চাষি, কুমোর, কাঠুরে সকলেই বাদায় কাজ পেয়েছে।
সন্ধেবেলা সবাই ঘরে চলে গেলে অম্বরীশ পাঁচ সেলের টর্চ নিয়ে খোঁড়া জায়গাগুলো থেকে মাটির ডেলা নিয়ে গুঁড়িয়ে দ্যাখে সোনার গুঁড়ো মেশানো আছে কিনা। না পেয়ে একটুও হতাশ হয় না। নদীর চিহ্নই তো এখনও পাওয়া যায়নি। নদীর খাতে না পৌঁছনো পর্যন্ত পুথির কথার সত্য-মিথ্যার শেষ দেখা হবে না। এখনও তো বালিই ওঠেনি! বালি সোনাগুঁড়া।
চৈত্র মাসে সকাল থেকে রোদ চচ্চড়িয়ে উঠে গায়ে জ্বালা ধরায়। মাঠঘাট ফুটিফাটা। এর মধ্যে একদিন বিকেলে কালবৈশাখীও বয়ে গেল। বড় বড় কয়েক ফোঁটা ছাড়া আর বৃষ্টি হয়নি, এই যা বাঁচোয়া। বর্ষা নামবে আর কয়েক মাসের মধ্যে। বাদা ডুবে যাবে। তার আগে নদীখাত খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
কালবৈশাখীর পরে বিকেলে হাঁটুসমান গর্তে নিদ্দার কোদালে কালো মাটির বড় একটা চাঁই উঠে আসতে তার নীচে ভালো সাইজের মাট্মিাখা একটা শাঁকালু চোখে পড়ল। খিদেয় পেটে মোচড় দিচ্ছে, নিদ্দা কোমর ভেঙে নিচু হয়ে শাঁকালু তোলবার জন্য আশপাশের মাটি কিছুটা সরিয়ে দেখল ওটা একটা মানুষের পাছার হাড়। এখানে নেচ্যই কখনও গোরস্থান ছিল।
কাছাকাছি আরও দুজনকে ডেকে এনে সাবধানে মাটি খুঁড়ে দেখা গেল একটা আস্ত নরকংকাল।
একজন কোদাল ফেলে ‘বাপরে’ বলে গর্ত থেকে লাফিয়ে উঠে পড়ে দৌড় লাগাল। এদিকে চেঁচিয়ে যাচ্ছে- ‘নিদ্দাকে কংকালে ধরেছে, নিদ্দাকে কংকালে ধরেছে!’
একটা দুটো নয়, সাতটা কংকাল গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। কেউ চিৎ হয়ে, কেউ উপুড় হয়ে, কেউ পাশ ফিরে। এ নেচ্যই গোরস্তান। হয় মোছলমানদের নয় তো কেরেস্তানদের। বোষ্টমদের না। তেনাদের তো বসিয়ে মাটি দেওয়া হয়।
যে পালিয়েছিল, ফজলুল, সে আর কাজে এল না।
অম্বরীশের নির্দেশমতো সাত কংকাল যেমন ছিল তেমনই মাটিচাপা রইল। কেউ কেউ আবার তার ওপরে আরও কিছু মাটি চাপাল।
বাদা-শ্রমিকদের প্রয়োজন মেটাতে গত মাসে ওখানেই একটা নলকূপ বসানো হয়েছে। তেষ্টা মেটানো, দুপুরে ঘর থেকে আনা ভাত খাওয়ার আগে হাত-মুখ ধোওয়া- সব ভালোই চলছিল, চৈত্রের শেষাশেষি অনেকের আঙুলের গাঁট ফুলে উঠতে লাগল, হাতে-পায়ে ঘা হতে শুরু করল।
অজানা ব্যাধিতে ভীত শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দিল।
পুরসভার তহবিল থেকে সবাইকে বেগুনি রঙের লোশন কিনে বিলি করা হল কিন্তু তাতে কিছু কাজ হল না।
যারা কাঁধের ঝুড়িতে কোদাল চাপিয়ে সকাল থেকে মাঠে মাঠে কাজ খুঁজে বেড়ায় সেরকম ষোলজন দিনমজুরকে কাজে লাগানো হল। দিনের শেষে নগদ টাকা হাতে পেয়ে তারা আনন্দ করতে করতে ঘরে গেল। পরদিন থেকে আর এল না।
চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হবার ঠিক দুমাস আগে অম্বরীশ পুরসভার সাফাইকর্মীর পদে গয়ানাথের ছেলে দয়ানাথকে খুঁজে এনে বসাল। (তার নাম জিজ্ঞেস করায় দয়ানাথ বলেছিল, ‘আমার নাম, বাবু, গয়ানাথ মেথরের ছেলে দয়ানাথ মেথর।’) পুরসভার তহবিলে টান পড়ায় সাত মাস তাদের মতো কর্মীদের বেতন মেলেনি, এরকম তেরজনকে এনে নদীর কাজ চালু রাখার চেষ্টা করা হল। তিনজন ছাড়া বাকিরা সপ্তাশেষে তাদের মজুরি নিয়ে সেই যে ঘরমুখো হল আর ফিরল না।
শ্রাবণমাসের শুরুতে টানা চারদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে বাদা জলে ভরে গেল। জেলেরা চাষিরা ডিঙি বেয়ে সেখানে মাছ ধরে বেড়ায়। দূরের আকাশে কালো ধোঁয়ার ফোয়ারা উড়িয়ে ট্রেন যায়, বাদার জলে তার ছায়া থেকেও ধোঁয়া ওড়ে।
নতুন হাসপাতাল ভবন উদ্বোধনের পর কয়েক মাস এড়িয়ে থাকার শেষে এক শনিবার একাদশীর ঘোলাটে আলোয় খুঁজে খুঁজে অম্বরীশ পারমিতার একতলা বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
জানলার পর্দা ভেদ করে ঘরে হ্যারিকেন বা ডিমলাইটের আলোয় কাউকে দেখা গেল না। দ্বিধা ঝেড়ে অম্বরীশ জোরে দরজার কড়া নাড়ে। তৃতীয়বার কড়া নাড়বার মুখে জানলার পর্দা সরিয়ে একটা ছ-সাত বছরের ছেলে শান্ত চোখে তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘মা বাড়ি নেই। তুমি কে?’
‘তোমার মার কাছে আসিনি, আমি এসেছি উদ্বাস্তু বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা প্রজ্ঞাপারমিতার সঙ্গে দেখা করতে।’
‘মিতাই তো আমার মা। মিতা টিউশানি করতে গেছে, আটটায় ফিরে এসে আমাকে খেতে দেবে।’
‘ওহ, তোমার বাবা কখন আসবেন?’
‘আমার বাবা যুদ্ধ করতে করতে মরে গেছে।’
অম্বরীশ স্তম্ভিত, পর্যুদস্ত, অসাড়। শুধু বলতে পারল, ‘ওহ!’
পারমিতা পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিশ্বাস বন্ধ করে ছেলের মুখে পিতৃপরিচয়টুকু শোনার পরই অম্বরীশের পাশে দেখা দিয়ে বলল, ‘দরজাটা খোল, পরীক্ষিৎ!’
দরজা খুলে দিয়ে পরীক্ষিতের প্রশ্ন ‘আটটা কি বেজে গেছে, মিতা?’
‘নারে, শেষ টিউশানি এখন ক’দিন বন্ধ থাকবে। ভাইবোন দুজনেই আজ মা-বাবার সঙ্গে পুরী যাচ্ছে।’
পরীক্ষিৎ পাশের ঘরে আবার ছবি আঁকায় মন দেয়।
কলকাতার বাসার সেই পুরনো চারটে বেতের চেয়ার, বেতের টেবিল। দুজনে মুখোমুখি বসার পরই অম্বরীশের প্রশ্ন, ‘এ কি আমারই ছেলে?’
দুয়েক মুহূর্ত অম্বরীশের চোখে নিরুত্তর চোখ রেখে পারমিতা বলল, ‘এতদিনে তবু প্রশ্নটুকু করলে!’
‘তুমি তো বলেছিলে তোমার গাইনি-বান্ধবীর সঙ্গে কথা হয়েছে, ও-ই ব্যবস্থা করে দেবে?’
‘প্রথমে তা-ই ভেবেছিলাম। পরে ও-ই আমাকে বোঝাল প্রথম সন্তান নষ্ট না করতে পারলেই ভালো হয়। আমার মনও ওর কথায় সায় দিল।’
‘তোমার মাকে কী বোঝালে?’
‘তোমার ওপর মার অগাধ আস্থা। মার আশা ছিল তুমি ফিরে এসে আমাকে বিয়ে করবে।’
‘ও মাই গড!’ মাথা নামিয়ে কিছুক্ষণ শুধু ভাবে, তারপর আবার মুখ তোলে, ‘তোমাকে কি সব সময় মিতা বলে ডাকে?’
‘জন্ম থেকে মার মুখে শুনে শুনে শিখেছে। আমারও ভালো লাগে, তোমার পর, মার পর অন্তত আরও কারও তো মিতা হয়ে আছি।’
‘পরীক্ষিৎ নামটা কি তোমার মার দেওয়া, না তোমার?’
‘শুধু ভালো নাম না, ডাক নামও আমি পরীক্ষিৎ রেখেছি। হতভাগ্য বাবা অভিমন্যুর মতোই ও চক্রবূ্যহে প্রবেশ করতে পেরেছে, বেরবার পথ খুঁজে পাবে কিনা জানি না।’
‘এখানে কেউ কিছু জানে?’
‘পরীক্ষিৎ তোমাকে যেটুকু বলেছে সবাই সেটুকুই জানে। তবে ওর মুখে কিন্তু তোমার আদল আছে। ওই বয়সে তুমি হয়তো এমনই দেখতে ছিলে।’
‘আমার জন্যই তুমি বালিসোনায় এসেছ?’
আবার কয়েক মুহূর্ত অম্বরীশের চোখে চোখ রেখে নীরবতার পর পারমিতার ধীর জবাব, ‘আমি জানতামই না তুমি বালিসোনায় ফিরেছ। কলকাতায় ফিরে এসেছ খবর পেয়েও কোনও দিন তোমার খোঁজ নিতে চাইনি। রাস্তার পোস্টারে জোড়া বলদের ছবির সঙ্গে তোমার নাম দেখেছিলাম, তবু তোমার ঠিকানা পাবার চেষ্টা করিনি। অমৃতবাজার পত্রিকায় একদিন বালিসোনা উদ্বাস্তু বালিকা বিদ্যালয়ের হেড মিসস্ট্রেসের ভেকেন্সি দেখে অ্যাপ্লাই করে দিয়েছিলাম, এমনিই, কিংবা, কে জানে, হয়তো তোমার গ্রাম বলেই। টিচিং এক্সপিরিয়েন্স ছাড়া এ চাকরি আমার হবে ভাবিনি।’
‘কলকাতায় আমার মেজদার বাড়ি গিয়েছিলে কখনও?’
‘আমি তো তাঁদের চিনিই না। ওরা কলকাতায় থাকেন তাও এই প্রথম শুনলাম। তুমিও তো কখনও তাঁদের কথা বলোনি। বসো, একটু চা করে আনি।’
এই সময় পরীক্ষিৎ মাকে তার সদ্য সমাপ্ত একটা ছবি দেখাতে এসে তখনও অম্বরীশ বসে আছে দেখে বলল, ‘ও কে, মিতা?’
‘তুমিই জিজ্ঞেস করো। আমি চা নিয়ে আসছি।’
পরীক্ষিৎ মার পিছু পিছু ফিরে গেল।
বাদায় মেঘলা আকাশের ক্ষয়াটে চাঁদের আলোও অনেক পরিষ্কার। ভাদ্রের জল বেশ কিছুটা নেমে গেছে, তবু আশ্বিনের শুরুতেও বাদা প্রায় জলে ডোবা।
অম্বরীশ অনেকক্ষণ বাদার ধারে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ কী দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার সারা শরীরে বিদ্যুৎতরঙ্গ বয়ে গেল। বাদার মাঝামাঝি অনেকগুলো নরকঙ্কাল, যেন জলে ভাসছে। কঙ্কাল জলে ভাসে কিনা সে মনে করতে পারল না। চার-পাঁচটা কিংবা হয়তো ছ-সাতটাও হতে পারে। তবে কি নিদ্দার কোদালে ওঠা সেইসব কঙ্কাল? সে তো আবার মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। তাহলে কি বর্ষার জল পেয়ে উঠে এল!
দুটো নরকঙ্কাল চিৎ সাঁতারে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সাহসে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে অম্বরীশ অলৌকিক দৃশ্যটি পরিপার্শ্বের সমগ্রতায় দেখতে থাকে। একটু পরেই দেখা যায় দুটি ছেলে কঙ্কাল-দুটিকে টেনে আনছে। অম্বরীশ হঠাৎ অন্ধ রাগে ছেলে-দুটিকে চিৎকার করে ধমকাবার আগের মুহূর্তে বুঝল তারা বিশ্বকর্মা ঠাকুরের দুটো কাঠামো টেনে আনছে। চাষিপাড়ার ছেলে দুটোও তার মুখচেনা, হয়তো হাটে দেখেছে। এবছর ভাদ্রসংক্রান্তিতে অনেক ছোট ছোট কারখানায়ও বিশ্বকর্মা পুজো হতে দেখে সে এই নতুন প্রবণতাকে বালিসোনার সমৃদ্ধির সুলক্ষণ ধরে নিয়েছিল।
রাতের খাওয়া শেষ করে অম্বরীশ তার ঘরের সামনে ঝুলবারান্দার হাওয়ায় দাঁড়িয়ে এলাচ খায়। তার জীবনটাও কি এলাচের খোসার একটা টুকরো যেমন হাওয়ার মুখে উড়ে গেল, সেরকম উদ্দেশহীন উড়ে চলেছে?
ঘুম নেই, তবু সে চোখ বুজে থাকে। তার অদ্ভুত জীবনের কথা ভাবে। এক সময় বারান্দায় খড়মের খটখট শুনে অম্বরীশ দেখল জানলা টপকে একটা কঙ্কাল এসে ঘরে ঢুকছে। পিছনে আরেকটা, তার পিছনে আরও একটা। সংখ্যাটা প্রত্যাশা মতো সাত হবার পরই অম্বরীশ বিছানা ছেড়ে সকলকে ঠাকুরদার আমলের বার্মাটিকের লম্বা আসনে বসাল। সারা রাত ধরে চলল তাদের সঙ্গে কথোপকথন। হঠাৎ অবনীর গলা শোনা গেল, পাটের মতো তার লম্বা চুল দাড়ি, সে অম্বরীশকে বলল, ‘কারও জীবন আসলে তার সারাজীবনের স্মৃতিপুঞ্জ ছাড়া আর কিছু নারে। বর্তমানের সঙ্গে অতীতের নাড়ির যোগ। সব স্মৃতি হয়ে বিস্মৃতির সিন্দুকে রাখা থাকে।’
কঙ্কালগুলো সবাই একসঙ্গে ‘হক কথা, হক কথা, কত্তাবাবু’ বলে বিলীয়মান অবনীমোহনকে মার্বেলের মেঝের ওপর গড় হয়ে প্রণাম করল। ভোর হবার ঠিক আগে, এবার অম্বরীশকে, ‘আবার আসব, কত্তা’ বলে সবাই জানলা দিয়ে বারান্দায় পড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
এর পর থেকে প্রায়ই তার ঘরে কঙ্কালদের আসর বসে। ঠাকুদার আমলের বার্মাটিকের ভারি লম্বা বেঞ্চে বসে বালিসোনার নানা ঘটনা নিয়ে আলোচনা চলে সারা রাত। কঙ্কালরা একদিন ফুলকপির বর্তমান বাজার দরের কথা তুলে একশো বছর আগে এক পয়সায় এক কুড়ি কপির সাইজ ও স্বাদ এমনভাবে বলতে লাগল যেন সেই কপির ঝুড়ি তাদের কোলে বসানো, হাতে তুলে নেড়ে চেড়ে দেখে তারা গন্ধ নিচ্ছে।
একদিন সকাল আটটায় ঘুম ভেঙেই মনে হল কঙ্কালগুলো চলে যাবার পর সে মাত্রই ভোর রাতে ঘুমিয়েছে। ন’টা নাগাদ পারমিতার বাড়িতে পৌঁছেও ক্লান্তিতে সে কড়া নাড়ল না। বাইরে দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে দেখল পারমিতা ছেলেকে খাওয়াবার জন্য একথা সেকথা বলে ভোলাচ্ছে।
‘সারা দিন স্কুলে পড়িয়ে, সন্ধেবেলা টিউশানি করে কত কষ্ট করে টাকা পাই তুই তো জানিস। সেই টাকায় চাল ডাল আলু কিনি, সেই চাল থেকে ভাত হয়। সেই ভাত না খেলে আমার অত কষ্টের টাকাই নষ্ট হয়। এদিকে চালের দাম তো বেড়েই চলেছে। মোটা পাটনাই চাল এই সেদিন ছিল বাইশ টাকা মন, এমাসে চল্লিশ হয়ে গেল।’
‘চল্লিশ হয়ে গেল?’
‘চল্লিশ হয়ে গেল।’
শুনেই সামনে ঝুঁকে, খুব বড় হাঁ করল পরীক্ষিত।
অম্বরীশ জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে মা-ছেলের অর্থনৈতিক আলোচনা মুগ্ধ হয়ে শোনে।
পেঁপে সেদ্ধ কিছুতেই খাবে না।
‘পেঁপে চল্লিশ হয়ে গেল’ শুনে তাও সে খেয়ে নিল।
‘এবার একচুমুকে দুধটুকু খেয়ে নাও তো বাবা।’
‘দুধ খাব না, দুধে গোরুর গায়ের গন্ধ।’
‘দুধ খাবি না? দুধও তো চল্লিশ হয়ে গেল।’
‘চল্লিশ হয়ে গেল?’ বলে দুহাতে দুধের গ্লাস তুলে লম্বা চুমুক।
জানান না দিয়ে যেমন এসেছিল তেমনই নিঃশব্দে অম্বরীশ ফিরে গেল।
আকাশে বিরাট একটা গোটানো সতরঞ্চি সামনের দিকে দ্রুত খুলতে থাকলে যেমন দেখাবে প্রায় সেইরকম পঙ্গপালের ঝাঁক আকাশ ঢেকে এগিয়ে আসছে। একটু পরেই আকাশ পরিষ্কার করে তারা কয়েকটা ঝাঁকে ভাগ হয়ে একেক ঝাঁক একেক ধানখেতে নামতে লাগল।
জীবনে প্রথম এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে নিদ্দার বিস্ময়ের সীমা নেই। সে হতভম্ব হয়ে গেছে। আকাশমুখো পথ চলতে চলতে ওয়াল গরমেন্টের পেসিডেনের সঙ্গে তার প্রায় ধাক্কা লাগছিল।
ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টের প্রেসিডেন্ট শিবকৃষ্ণ সাধুখাঁ যথারীতি একবার ডান হাত একবার বাঁহাত মুদ্রার ভঙ্গিতে উত্তোলিত করে দৃশ্য ও অদৃশ্য জনতার উদ্দেশে বলতে বলতে চলেছে- ‘আমি ক্রুশ্চেভকে বলেছি, বুলগানিনকে বলেছি, কেনেডিকে বলেছি, কাস্ত্রোকে বলেছি, মার্শাল টিটোকে বলেছি- আপনারা সবাই ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টের হেড কোয়ার্টারে এসে পৃথিবী থেকে খাদ্যাভাব দূরীকরণে আমার তত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখুন।’
আকাশের পঙ্গপালের ধাবমান বিস্তারে চোখ পড়তেই নজর তীক্ষ্ণ করে সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, ‘এ তো চিনাদের কাজ, অন্য গ্রহ থেকে তারা জীবাণু পাঠাচ্ছে। নেহরুকে বলেছিলাম চৌ-এন-লাইকে অতটা বিশ্বাস করো না। সেকথা শোনেনি। এ তারই ফল।’
নেহেরুর প্রসঙ্গটা নিদ্দার মুখের সামনে তর্জনী তুলে বলল, দুজনেই আকাশে মুখ তুলে হাঁটছিল, শেষ মুহূর্তে মুখোমুখি সংঘর্ষ সামলে নিয়েছে। নাকের ডগায় তর্জনী তুলে বিশাল-দেহী ‘পেসিডেন’ তাকেই মাথামুণ্ডুহীন কঠিন কিছু বলছে আচমকা দেখে নিদ্দার গা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত শিউরে উঠল। তার কাঁধে কাপড়ের ঝোলায় বাঁধা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে তার মার হাতের গরম ঘুগনি, ৩টে ১২র সৈকত লোকালে দিনের প্রথম ঘুগনি নিয়ে সে হকারি শুরু করে, তারপর আপ-ডাউন মিলিয়ে যতক্ষণ না হাঁড়ি শেষ হয় সে ঘরমুখো হয় না। আগে ট্রেনে কচি শশা, তালশাঁস, কালোজাম ফিরি করেছে। দিনের শেষে যা পয়সা পাওয়া যায় তাতে সংসারের ছ’টা পেট কোনওমতেই চলে না। তার বাপ ফণাধরও আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি, এদিকে তার পরের ভাই বাদেও নিদ্দার ছোট ছোট আরও দুটি ভাই হয়েছে।
ধাক্কা সামলে থমকে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নিদ্দার মুখে-মাথায় লঙ্কাজবায় তুলে শান্তিজল ছিটিয়ে দিল প্রেসিডেন্টের সবসময়ের সঙ্গী উমাশশী। মাথায় প্রেসিডেন্টের অর্ধেক, হাতে মাথা খোলা কাঠের ছোট বাক্সে শিবঠাকুর, বুদ্ধ ও যিশুর তিনটি পুতুল, তিলে-চন্দনে মাখামাখি, জানা না থাকলে বা ভালো করে ঠাহর না করলে মূর্তিগুলো তেমন চেনা যায় না। মূর্তির সামনে একটা গাঢ় নীল রঙের বাটিতে খানিকটা জলে কয়েকটা লঙ্কাজবা। মরশুমে ধুতরো, গাঁদা ও অপরাজিতাও থাকে।
এই ঢ্যাঙাপনা লোকটাকে আর তার সঙ্গের বেঁটে বোষ্টমীকে দেখলেই নিদ্দার ভয় লাগে।
নিদ্দা যখন অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ক্লাস ফোর পাশ করে কয়েক বছর তিনমাইল-কপিখেত ছাড়িয়ে দূরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেত তখন ইসকুলে যাতায়াতের পথে এদের বাড়িও সে দেখেছে। ইটের দেওয়াল, টালির চালার বড় বড় ছ’খানা ঘর, সিমেন্টের রোয়াক, সামনের উঠোনে বিরাট একটা তেঁতুলগাছের গুঁড়িতে টিনের সাইনবোর্ডে আলকাতরায় লেখা:
ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট
সদর দপ্তর
বালিসোনা
ইন্ডিয়া
সামনে স্বয়ং সেই দুজন, মাথার ওপরে ঝড়ে শ্মশানের উড়ন্ত ঘন ছাইয়ের মতো পঙ্গপালের ঝাঁক, নিদ্দার মন কুডাক দিল- ট্রেনে আজ তার ঘুগনি ভালো বিক্রি হবে না, বরং কোনও বিপদ হতে পারে।
হলও তাই। সন্ধের আগে পর্যন্ত আপ ট্রেনগুলোয় যাও দু-চারজন ঘুগনি নিয়েছে, সন্ধের পর থেকে আর খদ্দের মেলে না। বড় শহর থেকে ফেরার ট্রেনগুলোয় বেশির ভাগ লোকই, বিশেষ করে কলেজের ছেলেরা উত্তেজিত। রাজ্যপাল বিধানসভা ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেছেন। প্রতিবাদে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শরিক দলগুলো কাল সারা রাজ্যে চব্বিশ ঘন্টা বনধ ডেকেছে।
সন্ধে আরও ঘন হতেই বন্ধের সমর্থনে বাসরাস্তায় দীর্ঘ মিছিল থেকে স্লোগান উঠতে লাগল। পরদিন সকাল থেকে ট্রেন বাস লরি আটকানো হল। মাথার ওপর চক্রাকারে উড়ন্ত মৌমাছির ঝাঁক নিয়ে সাইকেলের রডে ঝোলানো ব্যাগে মধুর শিশি ভরে কয়েকটা বাড়িতে মধু দিতে যাচ্ছিল মোহন মউলে। আদিতে সুন্দরবনের বাসিন্দা, বাপ-পিতেমো সুন্দরবনের জঙ্গলে যেত চাক ভেঙে মধু আনতে (সেই থেকে নামের সঙ্গে ‘মউলে’ জুড়ে গেছে), একবছরের ব্যবধানে বাপ-ঠাকুর্দা দুজনকেই বাঘে নিয়ে যাওয়ায় মোহন নিজের বিয়ের পণের টাকা ও যৌতুক হিসেবে পাওয়া সাইকেল নিয়ে নতুন বউ আর বিধবা মা-ঠাকুমাকে সঙ্গে করে বালিসোনায় এসে ঘর বেঁধেছে। কাঠের বাক্সে মৌপালন শুরু করে সে তার সংসারের নড়বড়ে অবস্থাটা সামলে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মোহনের গতি-কমানো সাইকেল ছাড়িয়ে ক্রুদ্ধ স্লোগান দিতে দিতে কলেজ-ছাত্রদের একটা মিছিল খানিকটা এগিয়ে যাবার পর পিছনের আরেকটি মিছিলের একজন হাতের লাঠি দিয়ে সাইকেলে বাড়ি মারা মাত্র মৌমাছির ঝাঁক মোহনের মাথা ছেড়ে ছেলেটিকে আক্রমণ করল। সে ‘বাপরে, মারে’ বলে মিছিলের সামনের দিকে দৌড় লাগাতেই, মৌমাছির ঝাঁকও মিছিলের দিকে ধেয়ে গেল। এরই মধ্যে মিছিলের একেবারে মাথার দুজন রাস্তার ধারে মাটির হাঁড়ি-কলসির দোকান খোলা দেখে লাঠি মেরে হাঁড়ি-কলসি ভাঙতে লাগল। চোখের সামনে এই সর্বনাশ দেখে দোকানের মালিক সাদা দাড়িওলা মুসলমান বৃদ্ধ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে ভাঙা হাঁড়ি-কলসির ওপরেই লুটিয়ে পড়ল।
চালের দর চড়তেই থাকে।
মরা নদী যেখানে অনেক দূর অবধি মোহনার জোয়ারের জলে ভরে যায় সেই সুদূর সমুদ্রোপকূলমুখী নদীপাড়ের গ্রাম থেকে সাইকেলের রডে ঝোলানো, ক্যারিয়ারে বাঁধা চালের বস্তা নিয়ে সারি সারি সাইকেল পুলিশ হোমগার্ডের চোখ এড়িয়ে, ধরা পড়লে ঘুষ দিয়ে, সকাল-সন্ধ্যা শহরের দিকে ছুটতে থাকে। দক্ষিণের গ্রামগুলো থেকে গরিব চাষি মেয়ে-বউরা শহরমুখী রেলের কামরায় সিটের নীচে, বাঙ্কে পুরনো লেপ-তোষক কোলবালিশের আকারে, কখনও-বা ছ-সাত মাসের পোয়াতির ছদ্মবেশে পেটের সঙ্গে বেঁধে লুকিয়ে যে যতটুকু পারে চাল নিয়ে শহরে যায়। স্টেশনে ট্রেন ঢোকবার অনেক আগে থেকে চালের বান্ডিলগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে রেললাইনের ধারে ফেলে। সেখানে ফড়েরা থাকে। স্টেশনে নেমে রেললাইন ধরে হেঁটে ফিরে এসে ফড়েদের কাছ থেকে চালের দাম নেয়।
চাল পাচারের সুযোগ-সামর্থে্যর অভাবে গরিব চাষি তাঁতি কামার কুমোরদের ভাতে টান, হাতে নগদ পয়সার টানাটানি পড়ে। অনেক ঘরেই অলীক আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে যাবার হিড়িক পড়ে গেল। কেউ কেউ ভিট্মোটি বেচে বা বন্ধকী জমিজায়গা ছাড়াবার আশা জলাঞ্জলি দিয়ে অচেনা শহরের অনিশ্চিত পথে রওনা হল।
জটেরামের মা চলন্ত রেলগাড়ি থেকে হোমগার্ডের তাড়া খেয়ে রেললাইনে পড়ে মারা যাবার পর প্রথমে জটেরাম ও পরদিন তার প্রতিবেশী রহিমচাচাও গ্রাম ছেড়ে শহরের পথ ধরল। বিল্ব দোলুইয়ের ছেলে, গ্রামের একমাত্র লাঙল-ঠেলা উচ্চমাধ্যমিক পাশ ভরতই রহিমচাচাকে প্রথম দেখতে পেল। রহিমচাচা ছেলে মেয়ে বিবি নিয়ে ইস্টিশানের দিকে যাচ্ছে। তিনজনের হাতে পোঁটলাপুটলি, টিনের সুটকেস।
‘ও রহিমচাচা, তুমিও কলকাতা চললে? সেখানে কি বাবুরা রাস্তার ধারে অন্নসত্র খুলে রেখেছে?’
ভরতের কথায় চাচি ঘোমটা সরিয়ে তাকাল। দৃষ্টি দিশেহারা। দুঃসহ যন্ত্রণায় ঠোঁট চেপে কান্না সামলে রেখেছে।
দুটো গোটানো মাদুর, পাড়-বসানো একটা শীতলপাটি মাথায় নিয়ে শকলু এগিয়ে গিয়েছিল, রহিমচাচা ডাক দেয়- ‘এট্টু আস্তে আস্তে চ বাপ।’ ভরতের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘কলকেতায় একটা কাজের বেবস্থা হয়েছে। সোডা আইসক্রিমের কলে।’
‘মিছে কথা! আমরা শহরে যাচ্ছি ভিক্ষে করতে। আম্মা, আব্বাজান, আমি, শকলু আস্তায় আস্তায় ভিখ মেগে বেড়াব। এতক্ষণে বুঝলে, ভরতদা!’
সাকিনাকে এমন ফটফট করে কথা বলতে আগে শোনেনি ভরত। টেনে চুল বেঁধে লম্বা বিনুনি ঝুলিয়েছে। শাড়িটা ছেঁড়াফাটা, কিন্তু জেল্লাদার। ওর মার শাদির নিশ্চয়ই। ক’মাস আগেও মেয়েটা ইজের পরে খালি গায়ে ঘুরত। একবার পদ্মপুকুরে পায়ে শাপলা জড়িয়ে ডুবে যাচ্ছিল, ভরতই ঝাঁপিয়ে পড়ে চুলের মুঠি ধরে টেনে তোলে।
‘লাঙল বলদ তবে বেচে দিলে?’
‘কী করি? বড় শহরের চাকরি, ওসব দিয়ে আর কী করব?’
‘তোমার বিঘে-কতক নিজের ছিল না?’
‘ছেল তো কতই!’
শকলু পিছন ফিরে হাঁক পাড়ে- ‘তোমরা কি দেঁইড়েই থাকবে নাকি?’
একেকদিন স্টেশনের প্লাটফরমের একটা দিক গ্রাম-ছাড়াদের ভিড়ে প্রায় ঢাকা পড়ে যায়। ট্রেন আসা মাত্র নিমেষে সারা স্টেশনে ছড়িয়ে পড়ে হুড়োহুড়ি ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে উঠে পড়ে। মাঝপথে মোবাইল চেকিং হলে পুলিশসুদ্ধু কালোকোটের চেকারবাবুকে দেখে কেউ কেউ চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে। বাকিদের পরের স্টেশনে জোর করে নামিয়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে নেওয়া হয়। অল্প যে-দুয়েকজন টয়লেটে ঢুকে কিংবা ট্রেনের বাইরে দরজা বা জানলার রড ধরে ঝুলে পড়ে আত্মগোপনের মরিয়া চেষ্টা করে তারা ধরা না পড়লে কামরায় উঠে এসে স্বস্তির শ্বাস ফেলে।
শেষ বিকেলের আলোয় রাস্তা জুড়ে লম্বা লম্বা ছায়া ফেলে এক দল নানা বয়সি মেয়ে-পুরুষকে হাতে মাথায় গেরস্থালী জিনিসপত্র নিয়ে স্টেশনের দিকে যেতে দেখে ওয়াল গরমেন্টের পেসিডেন শিবকেষ্টবাবু এক হাতের তালু উঁচিয়ে আরেক হাতের তর্জনী তুলে গ্রামত্যাগীদের থামিয়ে চিৎকার করে বলে চলেছে, ‘নেহেরুকে আমি দিব্যি দিয়ে বলেছি- দেশভাগে রাজি হয়ো না, তবু তোমরা দেশের ভিট্মোটি ছেড়ে চলে যাবে? দেশ হল মানুষের মা, মাকে কেউ ছাড়ে নাকি!’
তার কথায় কেউ কান দিচ্ছে না দেখে সে আরও এগিয়ে এসে বলল, ‘ভাই সব, আজ আমার বাড়িতে সারা রাত কীর্তন হবে। ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টের সভা হবে। নেহেরুকে জিন্নাকে মাউন্টব্যাটেনকেও আসতে বলেছি। ভারত ভাগ কীভাবে আটকানো যায় তা নিয়ে আজ আলোচনা হবে। চলো ভাই সব, সবাই আমার সঙ্গে এসো। ঢালাও খিচুড়ির ব্যবস্থা হয়েছে।’
কয়লাখনি জাতীয়করণের বলি শিবকৃষ্ণ সাধুখাঁর ধানবাদের তিনটে খনির জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ না পেয়ে দীর্ঘদিন সে তার বালিসোনার বাড়ির ছাদ ঢালাই করতে পারেনি। সরকারি দপ্তরে বৃথা দৌড়োদৌড়ি ও নিষ্ফল প্রতীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত টালিতে ছ’টা ঘরই ছাইতে হয়। এই সময়ে তার স্ত্রীও তাকে ছেড়ে যায়। তারপর থেকেই ক্রমশ তার ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা ও সাধনসঙ্গী হিসেবে মাথায় তার অর্ধেক এই রমণীকে দীক্ষাদান। এই আর্থিক-পারিবারিক বিপর্যয় থেকেই রাস্তায় বেরিয়ে পথচলতি মানুষজনের উদ্দেশে শিবকৃষ্ণের বত্তৃতার সূচনা বলে মানতে চাননি তার রোগের প্রথম পর্যায়ের সাইকিয়াট্রিস্ট, শহরের ডাক্তার মনোরঞ্জন কর। মাস তিনেক চিকিৎসার পর ডাক্তার রায় দিয়েছিলেন- রাজনৈতিক বিশ্বের আগ্নেয়গিরি থেকে তার এই উদ্দাম অপ্রকৃতিস্থ উদগীরণ। তার একটা পুরনো ডায়েরিতে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত বিশ্লেষণ ও তার নিজস্ব মন্তব্য খুঁটিয়ে পড়ে ডাক্তার তাঁর সিদ্ধান্তে পৌঁছন। ডায়েরির একটা বাক্যে ডাক্তারের চোখ আটকে গিয়েছিল। কিছুদিন পর পর একই কথা বার বার লিখেছে- মানুষের ধ্যান-ধারণার যে-ইতিহাস, আমি কি তারই সৃষ্টি? আমি কি তার স্রষ্টা হতে পারব? সাইমালটেনিয়াসলি?
শিবকৃষ্ণর রোগলক্ষণের একটা বৈশিষ্ট্যও তিনি লক্ষ করেছিলেন, তা হল সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পথচারীদের কাছে তার রাজনৈতিক নিদান ঘোষণা করে বাড়ি ফিরে প্রাচীন আমড়াতলায় সঙ্গিনীর অবিরাম পাম্প করে তুলে দেওয়া নলকূপের শীতল জলে অনেকক্ষণ স্নানের পর তার কথাবার্তায় আচার-আচরণে পাগলামির আর কোনও লক্ষণই খুঁজে পাওয়া যেত না। এমনকী কয়লাখনি জাতীয়করণের ক্ষতিপূরণের বিপুল অর্থ গত বছর এক মঙ্গলবার অপরাহ্নে অপ্রত্যাশিতভাবে হাতে পাওয়ার পর তার পরের মঙ্গলবার থেকেই প্রতি সন্ধ্যায় বাড়িতে সকলের জন্য নামসংকীর্তন ও খিচুড়িভোগের উৎসব চালু করে দিয়েছে। একসময় যে নিদ্দা ওয়াল গরমেন্টের পেসিডেনকে সামনে দেখে ভয় পেয়েছিল, সেই নিদ্দাও এখন মঙ্গলবার রেলে ঘুগনি ফিরি বন্ধ রেখে ঘরের সবাই মিলে সারা দিন উপোস করে থাকে, সাঁঝ লাগলেই মা-ভাইদের নিয়ে পেসিডেনের বাড়িতে চলে যায়। পেট চেপে অপেক্ষা করে নামসংকীর্তন কতক্ষণে শেষ হবে। নিজেরা আকণ্ঠ খেয়ে ঘরের মানুষটার জন্য মাটির কলসিতে খিচুড়ি নিয়ে আসে। যে তিনজন বলশালী লোক বড় বড় দুটো উনুনে বিরাট ডেকচিতে খিচুড়ি রাঁধে, তাদের একজন নিদ্দার মার কলসিতে গরম খিচুড়ি ঢেলে দেয়। তিনজনই শিবকৃষ্ণের তিন কয়লাখনির সবচেয়ে বিশ্বস্ত পাহারাদার।
এক মঙ্গলবার, মাঘী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় নামসংকীর্তনের শেষে সবে খিচুড়ি ভোজন শুরু হয়েছে, অম্বরীশকে দেখে অর্ধেক মানুষের হাতের গ্রাস হাতে আটকে গেল। শিবকৃষ্ণ তাকে দেখতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে কাছে এসে বলল, ‘এ কী কত্তাবাবু, আপনি?’
‘শোনো, শিবকেষ্ট, যারা মাটি খুঁড়ছে তাদের জন্য আমি পাউরুটির কারখানা বসিয়েছি জানো তো? কাজের ফাঁকে ওদের আমি রোজ বিনা পয়সায় পাউরুটি খাওয়াই। সবাইকে দিয়েও, কারখানার অনেক পাউরুটি থাকে, সেগুলো বিক্রির জন্য দোকানের লোকেরা এসে ধারে নিয়ে যায়, পরদিন আবার যখন নিতে আসে তখন আগের দিনের দাম মিটিয়ে দেয়। তুমি সবাইকে মঙ্গলবার খিচুড়িভোজ দিচ্ছ, আমি বলি কী, রোজ সকালে বা বিকেলে বালিসোনার গরিব মানুষ যাতে তোমার বাড়ি থেকে মাথাপিছু একটা করে পাউরুটি পায় তুমি তারও ব্যবস্থা করতে পারো, পারো না? যদি ধারে নিতে চাও, ধারে পাবে। ডিসকাউন্টেড প্রাইসে চাও তাও করে দেব।’
সেই থেকে ওয়াল গরমেন্টের উঠোন সারা সকাল বালিসোনার চাষি তাঁতি জেলে কামার-কুমোর, খাটালপাড়ার গয়লা, উত্তরের বেদেপাড়া- সকলের আনাগোনায় মুখর হয়ে উঠল। যেহেতু মাথাপিছু একটা পাউরুটি, তাই সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চা-কাচ্চাদেরও তারা সঙ্গে আনে। তাদের আলাদা লাইন। শিবকৃষ্ণ নিজে শিশুদের কচি হাতে রুটি তুলে দেয়। তারা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে- কখনও অকারণ লজ্জায়, কখনও অনির্নেয় উল্লাসে, কখনও আশপাশের সবাইকে ভুলে, কখনও ভাঙা-ভাঙা বাক্যে, কখনও ছোট ছোট বাক্যে, তাদের সেই কলকাকলি শুনতে শুনতে শিবকৃষ্ণ হঠাৎই একদিন নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে ওঠে- তোদের বাক্যের ভেতরে ভগবান বাস করেন।
এক রবিবার সকালে অম্বরীশ পারমিতা-পরীক্ষিৎকে শিবকৃষ্ণর উঠোনে শিশুদের কাকলি শোনাতে নিয়ে গেল। তার কারখানার গরম পাউরুটির প্রতীক্ষায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লাইনে তখন পাখির কিচিরমিচির চলছে। উঠোন জুড়ে বালিসোনার দীন-দরিদ্র মানুষের ভিড়। কিছুদিন আগেও যারা ভিটে-মাটির মায়া ছেড়ে ভিক্ষের আশায় শহরমুখো হবার কথা ভাবত তারা আর তা ভাবে না।
‘কে না খেয়ে মরলেও নিজের ভিট্মোটি ছেড়ে যাবে না, আর কে পেটের তাগিদে নিজের গ্রাম পিছনে ফেলে চলে যাবে- ভালো করে এদের মুখের দিকে তাকাও, মুখ দেখে তুমি বুঝতে পারবে।’
‘অত ক্ষমতা আমার নেই।’ বলে পারমিতা ছোটদের দলে ভিড়ে গেল। পরে অম্বরীশকে তারও একটা পর্যবেক্ষণ শোনাল- ‘শিশুদের মুখে কখনও কোনও অমানবিক ভাব হয় না তুমি দেখেছ?’
অম্বরীশ চোখে সেই ঝিলিক নিয়েই বলল, ‘রোববার করে এখানে এসে এদের অ আ ক খ শেখাও না কেন! স্কুলে যাবার পথেও এক-আধঘন্টা পড়িয়ে যেতে পারো।’
এইভাবেই পারমিতার হাতে বালিসোনার নিরক্ষর বাপ-মার সন্তানদের বর্ণ পরিচয় শুরু হল। ক্রমশ মুখে মুখে রটে গেল রোববারের পাঠশালার কথা। বছর না ঘুরতেই মঙ্গলবারের নামসংকীর্তনের বদলে একই সময় চালু হল বয়স্কদের বর্ণপরিচয়। তারপর খিচুড়ি ভোগ। শিশুদের রোববারের পাঠশালার মতো বয়স্কদের ‘মংলার’ ইসকুলেও ভিড় বাড়তে লাগল। ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ক্রুশ্চেভ, বুলগানিন, চৌ এন লাই, ফিদেল কাস্ত্রো, মার্শাল টিটোর বাক্যালাপ কমতে কমতে কবে যে বন্ধ হয়ে গেল, কারও চোখে পড়েনি। তখন কেউ যদি শিবকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করত ‘কেমন আছেন?’ বা ‘কেমন আছো হে?’ উত্তরে সে শুধু বলত, ‘ছোটদের সঙ্গে যতক্ষণ থাকি আনন্দে থাকি, অন্য সময় বড় ক্লান্ত লাগে।’
এইসময় থেকে সে আবার ডায়েরি লেখা শুরু করে, এবার খুব অনিয়মিত।
মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে ঢুকতে গিয়ে অম্বরীশ থমকে গেল। দরজার মাথায়, দু’পাশের দেওয়ালে কোথাও লেখা- ‘ছেলে কার?’ কোথাও লেখা- ‘মিতার ছেলের পিতা কে?’ কোথাও তাকেই সরাসরি আক্রমণ- ‘অম্বরীশ, চিংড়িফিশ, তুই না খাস তো আমায় দিস।’
রাগে কাঁপতে কাঁপতে, তখনও-হাতে-ধরা এলাচের ডিবে গায়ের জোরে টেবিলে ঠুকে মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষারত কাউন্সিলারদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে অম্বরীশ বলল, ‘এসবের মানে কী? কারা এসব লিখেছে?’
একজন কৃষকনেতা এবছরই প্রথম কাউন্সিলার হয়েছেন, টিপ্পনি কাটলেন, ‘একদানা বীজ না হলি যেমন চারা গজায় না, এক কণাও সত্যি না থাকলি তেমনি গুজবও রটে না।’
সকলের কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অম্বরীশ গম্ভীর স্বরে বলল, ‘থানায় জানিয়েছেন?’
‘এটা কি সেরকম একটা ইস্যু?’
‘নিশ্চয়ই। সন্দেহজনক সকলের হাতের লেখাই আমি মেলাব।’
তারপরই টেবিলের কলিং বেল বাজিয়ে একজন পিওনকে পেয়ে হুকুম দিল- দেয়ালের লেখাগুলো সব মুছে ফেল। চৌকিদারকে ডাকিয়ে এনে ধমকাল। উপস্থিত সবাই চুপ করে দেখছিল, একজন বলল, ‘আজকের অ্যাজেন্ডায় মাটি খোঁড়া ছিল এক নম্বরে। সেটা কি এখন শুরু হতে পারে?’
অম্বরীশ মৌনসম্মতি জানিয়ে প্রথমেই বলল, ‘মাটি খোঁড়ার কাজে বাড়তি লোক যা নেওয়া হচ্ছে তার সব খরচ ব্যক্তিগতভাবে আমিই জোগাচ্ছি। পৌরসভার ওপর আর বাড়তি বোঝা চাপাতে চাই না।’
কৃষকনেতার ব্যাঙ্গোক্তি, ‘ওখানে কি মানুষ আখ চাষ করবে, না মাছ চাষ করবে?’
পোলিওয় প্রতিবন্ধী কাউন্সিলার কৃষকনেতার কথার পিঠেই বলল, ‘চৌধুরীসাহেব ওখানে স্টিমার চালাবেন।’
অন্য একজনের মতও শোনা গেল- ‘মাটি খুঁড়ে শেষ পর্যন্ত যদি নদীর পাঁজরাটা পানও, তার প্রাণপ্রবাহ অর্থাৎ জল তো পাওয়া যাবে না।’
‘জল পেতি হলি, সকলকে ওখানে বারোমাস তিরিশ দিন মুততি বলতি হয়।’
একটা তুচ্ছ লোকের এমন তীব্র কটাক্ষেও অম্বরীশ রাগ ও বিরক্তি চেপে রাখে। সে তো আর বলতে পারে না- জল নয়, সে খুঁজছে বালি। যে বালি পাওয়া গেলে বালিসোনা হয়তো একদিন সারা ভারতের সবচেয়ে ধনী গ্রাম হয়ে উঠবে।
দুপুরে রোজকার মতো খাওয়ার জন্য বাড়ি না গিয়ে অম্বরীশ পারমিতার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে আদিগন্ত সবুজ ধানখেতের মধ্যে লাল টালির ছোট্ট একমাত্র বাড়িটা নুতন চোখে দেখে। ধানখেতের ওপরের আকাশে অল্প উঁচু দিয়ে একটা পেটকাটা চাঁদিয়াল কেউ পিছন দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ঘুড়িতে বাঁধা তার হাতের টানটান সুতোর গতিবিধি দেখে অনুমান করা যায় খেতের আল ধরে ছুটে চলেছে ঘুড়ির আনাড়ি মালিক।
পারমিতা দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘এক মিনিট বসো, আমি পরীক্ষিৎকে ডেকে আনি। ধানখেতে ঘুড়ি ওড়াতে গেছে অনেকক্ষণ।’
বাইরে বেরিয়ে এসে গলা তুলে ডাকল, ‘পরীক্ষিৎ, তুই কোথায় রে? আর কত ঘুড়ি নিয়ে দৌড়বি? এবার ফিরে আয়। ধানখেতে সাপ থাকে বাবা, তাড়াতাড়ি চলে আয়।’
পরীক্ষিতকে আল ধরে ফিরতে দেখে অম্বরীশ বলল, ‘ওকে নিয়ে কানাঘুঁষো তুমি শুনেছ? দেওয়ালে কী সব লিখেছে দেখেছ?’
‘বাড়ির পশ্চিমের দেওয়ালটা দেখে এসো- সামনের দেওয়ালে লেখার সাহস পায়নি বা সুযোগ পায়নি। এরা কারা?’
‘আমি তো তোমাকেই জিজ্ঞেস করতে এসেছি। স্টেশন মাস্টারের ঘরের দেওয়ালেও লিখেছে।’ একটু থেমে, ‘আমাকে বিয়ে করবে?’
‘হঠাৎ? দেওয়াল লিখনের ভয়ে?’
‘আজকাল রাতে একা শুতে আমার ভয় করে।’
‘সে তো দরজার বাইরে পাহারা বসালেই পারো।’
‘সে ভয় না, ভূতের ভয়।’
‘ভূতের ভয়, তোমার?’
‘ভালোবেসে বিয়ে করলে না, এবার করবে ভয়ে, তাও ভূতের ভয়ে?’ কথাটা মুখে বলার আর ইচ্ছে হল না।
আগের দিন সন্ধে ঘন হবার পর সবচেয়ে গভীর গর্তের তলা থেকে বালি তুলেছিল অম্বরীশ, ব্রিফকেস থেকে বালির প্যাকেট বের করে পারমিতাকে দিয়ে বলল, ‘চ্যাটালো কড়াইয়ে জল দিয়ে বার বার ডাইনে-বাঁয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখো তো সোনাচুর পাওয়া যায় কিনা।’
‘ভূতের ভয়ের মতো এই বালি ঘাঁটাও তোমার এক পাগলামি।’
অম্বরীশ দৃশ্যতই আহত বোধ করেও পরীক্ষিতকে বলল, ‘ঘুড়ি ওড়াতে দৌড়োতে হয় বুঝি! এসো, তোমাকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়ে দিই।’
ঘরের বাইরে ছোট উঠোনে পরীক্ষিতের কাছ থেকে ধরাই নিয়ে, অম্বরীশ আকাশের অনেক উঁচুতে ঘুড়ি তুলে পরীক্ষিতের হাতে লাটাই দিল। পারমিতাকে বলল, ‘একটু চোখ-কান খোলা রেখো, কে এসব লিখে বেড়াচ্ছে জানা দরকার। তারপই প্রসঙ্গ পালটিয়ে, ‘রোববারের পাঠশালা, মঙ্গলের ইসকুল কীরকম লাগছে?’
‘ভালো, খুব ভালো। এখন তো জায়গাই কম পড়ে যাচ্ছে। শিবকৃষ্ণবাবুর দেওঘরে একটা বাড়ি আছে, ওটা বিক্রি করতে গেছেন। বলে গেছেন ফিরে এসে স্কুলের জন্য বড় দোতলা বিল্ডিং করে দেবেন।’
‘ছেলেকে কোন স্কুলে দেবে ভেবেছ কিছু?’
‘আরও দু-বছর যাক, একটু বড় হোক। জানো তো, রোববারের সকালের পাঠশালা আর মঙ্গলবারের সন্ধের স্কুল- দুটোতেই পরীক্ষিতের খুব আগ্রহ। ওখানে ওর অনেক বন্ধুও হয়ে গেছে।’
অঘ্রাণ মাসে তার মিতার বিয়ে হবে শুনে পরীক্ষিতের ভারী উৎসাহ। দেরিতে হলেও, বিয়েতে চিরকালের অনিচ্ছুক প্রৌঢ় অম্বরীশের বিয়ের খবরে চৌধুরী পরিবারের সকলেই একই সঙ্গে কৌতূহলী ও খুশি। সংসারত্যাগী অবনীমোহন বাদে চৌধুরীদের আর সকলেই বিয়ের আগে থেকে সপরিবারে হাজির হয়ে বহুকাল পরে চৌধুরী বাড়িতে উৎসবের হাওয়া তুলেছে।
বিয়ের ঠিক আগের দিন বিদেশ থেকে এসে পৌঁছল লক্ষ্মীপ্রতিমা, সঙ্গে এক লম্বা সুদর্শন সাহেব। গালে চিবুকে বাদামি রঙের পাতলা লতানো দাড়ি। দুচোখে যেন দুটি নীলকান্ত মণি বসানো। বাংলা বলে থেমে থেমে, তবে সম্পূর্ণ নির্ভুল। কাকার বিয়ের পরই দুজনে হিন্দুমতে, সব আচার-অনুষ্ঠান মেনে বিয়ে করবে। বালিসোনায় একটা খুব অন্য ধরনের স্কুল তৈরি করা এদের স্বপ্ন।
অঘ্রাণে পঞ্চমী তিথিতে মহা আড়ম্বরে অম্বরীশের বিবাহ সুসম্পন্ন হবার পাঁচ দিন পর গোধূলি লগ্নে লক্ষ্মীপ্রতিমার বিয়েতে বালিসোনার আকাশ-বাতাস যেন একসঙ্গে মহাষ্টমী পুজো ও ঈদের খুশিতে ভরে উঠল। কিছুদিন পৈতৃক বাড়িতে কাটিয়ে লক্ষ্মীও স্বামী লিওনকে নিয়ে আদিগন্ত ধানখেতের মধ্যে পারমিতার ছেড়ে যাওয়া লাল টালির ছোট্ট বাড়িটা তার মালিক উদ্বাস্তু বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি দুখীরাম মান্নার কাছ থেকে কিনে পাশ্চাত্য রীতিতে কিছু অভ্যন্তরীণ অদল-বদল করে নিয়ে সেখানেই উঠে গেল। বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছবার আগে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়ে লিওনের প্রথম কথা, ‘স্বপ্নের শিক্ষালয় নিয়ে সীমাহীন জল্পনা-কল্পনার এ হল উপযুক্ত স্থান।’
দিদিদের নতুন বাড়িতে রওনা করিয়ে দিয়ে সরস্বতী-তাপস লখনউয়ে ফিরে গেল। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির মেয়াদ পরশুই শেষ। লিওন, পুরো নাম লিওনার্দো উনগারেত্তি, বাড়ির পিছনের বিরাট ফাঁকা জায়গায় বালিসোনার কৌতূহলী মানুষের জমায়েতের ঠিক মাঝখানে বসে সে তার দেশের আশ্চর্য সব পাথরে গড়া ইতিহাসের কথা বলে। সে-দেশের বিচিত্র রীতি-নীতি, গান-বাজনা, মাইলের পর মাইল জলপাইবাগানের গল্প বলে। প্রথম দুয়েকদিন সবাই অবাক হয়ে তার থেমে থেমে বলা প্রত্যেকটি শব্দ শুনল। চকোলেট বিলোন বন্ধ হতে পরীক্ষিৎ ছাড়া আর কোনও শ্রোতা পাওয়া গেল না।
লক্ষ্মীপ্রতিমা যতক্ষণ তার হাসপাতাল নিয়ে কাটায়, পারমিতা যতক্ষণ তার উদ্বাস্তু বালিকা বিদ্যালয় নিয়ে থাকে, অম্বরীশ যতক্ষণ তার নদীর সন্ধানে মেতে থাকে, পরীক্ষিতও ততক্ষণ লিওনের গা ঘেঁসে বসে আজব গল্পের রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। এমনিতেই তার মিতার আগের বাড়ির সেই আকাশের মতো বড় ধানখেত থেকে সে রোজই তার ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত সব গল্প পেয়ে যায়।
১০
লিওন-লক্ষ্মীর কল্পনার স্কুলের জন্য জায়গা বাছা হল কামান-মাঠের পিছনে পরিত্যক্ত পোড়ো জমিতে, যেখানে ইংরেজ সেনাবাহিনী যুদ্ধের সময় ট্রেঞ্চ খুঁড়ে রেখে গেছে। ওই অংশটা ঠিকঠাক করে তার ওপর স্কুলের বিল্ডিং উঠবে, আর তার সামনে পুরো কামান-মাঠ জুড়ে হবে স্কুলের খেলাধূলার বিরাট এলাকা। কামান দুটো স্মারক হিসেবে রেখে, বাকি অংশে ফুটবল, ভলি, ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা, ধানখেত, সবজিখেত, ফুলবাগান, ফলবাগান, একপাশে নৌকো বাইবার বৃত্তাকার খাল, সাঁতারের পুকুর ইত্যাদি অনেক কিছুই করার পরিকল্পনা। লিওন দিনের পর দিন রাত জেগে পুঙ্খানুপুঙ্খ নকশাও তৈরি করে ফেলল।
একসময়ের এই জমিদারী সম্পত্তির বর্তমান মালিক বালিসোনা পৌরসভা। তাদের কাছ থেকে নিরানব্বই বছরের লিজ নিয়ে স্কুল তৈরির কাজ শুরু হতে হতে বালিসোনায় বহিরাগতের ভিড় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
এক অমাবস্যার রাতে কলকাতার লটারির দোকানের গাড়ির ড্রাইভার, মন্থরোর মা’র নাতি সুজাকে জনশূন্যিমোড়ে গাড়িসুদ্ধ আটকাল হিন্দু পাড়ার ছেলেরা। গাড়ি থেকে সুজাকে টেনে নামিয়ে পিছনের দরজা খুলতেই পাঁচ-সাত দিন বয়সের অনেকগুলো বাছুর ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে হুড়মুড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। কয়েকটা বাছুর চার পা মুড়ে শুয়ে আছে, তাদের ওঠারও ক্ষমতা নেই। পাঁচ সেলের টর্চের আলোয় কোমল ফুটফুটে দুধের বাছুরগুলো দেখে মন স্নেহে দ্রব হয়। সুজা এদের এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? অমাবস্যায় বা কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাতে এর আগেও কয়েকবার সুজাকে গাড়ি নিয়ে আসতে যেতে কেউ কেউ দেখেছে।
হিক্কা তোলার মতো চাপা হাম্বা শুনে ছেলেরা এক হ্যাচকায় গাড়ির ডিকি খুলে টর্চ ফেলতেই দেখা গেল সেখানেও ঠাসাঠাসি করে কচি কচি মুমূর্ষু বাছুর পড়ে আছে। ঢাকনা খোলা পেয়ে কয়েকটা বাইরে এল। কয়েকটা উঠল না, হয়তো মরে গেছে।
সুজা প্রথমে কিছু টাকা এগিয়ে দিয়ে ছাড়া পেতে চেষ্টা করল। হঠাৎই কিল চড় ঘুষি লাথি খেয়ে স্বীকার করল, গয়লাপাড়া থেকে মাঝে মাঝে সে এইসব কচি বাছুর কলকাতায় নিয়ে যায়। সেখানে প্যাকিং করার পর এগুলো খিদিরপুর ডকে পৌঁছে দিয়ে তার ডিউটি শেষ। তার এতে কোনও দোষ নেই।
আক্রমণকারীরা সুজাকে ছেড়ে ভীত সন্ত্রস্ত বাছুরদের মধ্যে থেকে তুলনায় বেশি সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান বাছুর বেছে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, সেই সুযোগে সুজা গাড়ি নিয়ে পালাল।
পরদিন প্রায় একই সময়ে লাস্ট শোয়ে সিনেমা দেখে বেসুরো গলায় ‘প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ গাইতে গাইতে চারজন তরুণ ঘরের পথ ধরেছে, অন্ধকার ফুঁড়ে ছ’জন লোক তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুজনের হাতে মাংস কাটা ছুরি, একজন তাক করে আছে ওয়ান শটার, আরেক জন, সে সুজা, লম্বা টর্চ পথচারী চারজনের মুখে ফেলে ‘এইটা, এইটা, এইটা, এইটা’ বলে গত রাতের আক্রমণকারীদের চিনিয়ে দিচ্ছে, সুজার সঙ্গের লোকেরা ‘বোকনো-চোদা কাফেরের বাচ্চা!’ ‘বাছুর কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস, বের কর। বাছুর না পেলে সব ক’টাকে খাসি করে দেব!’ বলতে বলতে পেটে বুকে মুখে যে যেখানে পারল ছুরি চালাল।
‘আমি কাফের না, আমি হিন্দু না’ বলে একজন সুজাদের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। পিঠে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় ‘আমি মোছলমান, আমাকে মেরো না, হায় আল্লা!’ বলতে বলতে পাজামা খুলে তার ছুন্নত-চিহ্ন দেখাতে যাচ্ছিল, উল্টো দিক থেকে যাত্রা-ভাঙা গৃহমুখী মানুষের ভিড় এসে পড়ায় সুজার দল অন্ধকারে কলকাতার দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখা তাদের গাড়িতে লাফিয়ে উঠে পড়ে বিদ্যুৎগতিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আগের দিন প্রাণভয়ে সুজার ফেলে পালিয়ে যাওয়া জীবিত, সুস্থ বাছুরগুলো একেকটা একেকজন ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, যাত্রা ফেরত ভিড়ের মধ্যে তাদেরও বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল, এদেরই তিনজন তিনটে মুমুর্ষু বাছুর কোলে করে নিয়ে গিয়ে বাড়িতেই হালাল করে সালোনও খেয়েছে। কালকের ঘটনার কথা বালিসোনার সকলেই শুনেছে, আজ আহতদের দেখে পরিস্থিতি বুঝতে কোনও সম্প্রদায়েরই সময় লাগল না।
ভোর থেকে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ায় রুটি কারখানার কর্মীদের যারা মুসলমান তারা হিন্দুদের ভয়ে ডিউটি শেষ করেও রাস্তায় বেরতে সাহস পেল না, যারা হিন্দু তারা মুসলমানদের হাতে আক্রান্ত হবার ভয়ে বেরতে পারল না। কারখানার মধ্যে বহুদিনের ঘনিষ্ঠ দুই সম্প্রদায় পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে মেশা ভরসাটুকু মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরে সাতাত্তর ঘন্টা জেগে ঝিমিয়ে কাটিয়ে দিল। এমনিতেই রাস্তায় বিশেষ লোক দেখা যাচ্ছে না। সকলেই আক্রান্ত হবার ভয়ে বাড়ির ছাদে, ঘরের পিছনে ভাঙা থান ইট, আধলা ইট জড়ো করেছে।
তৃতীয় দিনে দাঙ্গা স্তিমিত হয়ে এলে পাউরুটির কারখানায় অম্বরীশ হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের কর্মীদের পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করাতে লেগে গেল। লিওনের চাষ করা চিনির-তিনশোগুণ-বেশি মিষ্টি ছোট-ছোট গাছের পাতার রস ময়দায় মিশিয়ে তৈরি গরম গরম একপাউন্ড মিষ্টি পাউরুটি কোলাকুলির পর প্রত্যেককে একটা করে বিলোন হল।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, তেমনই আচমকাই থেমে গেল। শিবকৃষ্ণর রোববারের সকালের পাঠশালা ও মঙ্গলবারের সান্ধ্য স্কুল বড় দোতলা বাড়িতে উঠে যাওয়ায় ছাত্রসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে পাউরুটির চাহিদাও বহুগুণ বেড়ে গেছে। এবারও বাড়তি কাজের জন্য ভিন্ন-ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক নেওয়া হল। হিন্দু-মুসলমান ছাড়াও এবার খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে নেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে পূর্ব পাকিস্তানের কক্সবাজার থেকে সাত ছেলে নিয়ে এক বিধবা এসে বাসা বেঁধেছে, ধর্মে এরা বৌদ্ধ, তাদের দুই ছেলেকে রুটি কারখানায় কাজ দেওয়া হয়েছে। এদের কক্সবাজারে নিজেদেরই রুটি কারখানা ছিল। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের তিনজনও একই পরিবারের, বালিসোনার বহু প্রাচীন দারুশিল্পী বংশের। এক সময়ে এদের সূক্ষ্ম কাঠের কাজের খুব খ্যাতি ছিল, বাংলার বাইরেও যেত এদের গড়া সিংহাসন, দেওয়াল-তাক, রত্নালংকার রাখার হাতবাক্স, মৌরিদান। পরে সারা বাংলাব্যাপী হস্তশিল্প অবলুপ্তির যুগে এদের দারুশিল্পেও অভাবের বাতাস লাগে। সেই সময়ে পরিবারের কর্তা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেয় ও ছোট-বড় সকলের অন্ত্যজ হিন্দু পদবির সঙ্গে নতুন খ্রিস্টীয় নাম জুড়ে যায়।
ভাড়া-করা বড় বড় দুধের ক্যান ভরা বালি-কাঁকর কাদামাটি ময়রাদের অ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝাঁকিয়ে সোনার কুচি পাওয়া গেল মাত্র তিনজনের পাত্রে, মোট তিন আনা। দুদিন দুরাত ওই অসম্ভব সোনা-নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় ডুবে থেকে অম্বরীশ এর মধ্যে আর কারখানায় যাবার সময় পায়নি, পরদিন তাদের বিবাহবার্ষিকীর দিনে খুব সকালে উঠে কারখানায় ঢুকে দেখল সাদা দেওয়ালে হলুদবাটা দিয়ে কাঁচা হাতের বড় বড় হরফে লেখা-
হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ
ভাইয়ে ভাইয়ে আর নয় যুদ্ধ
নীচে ছোট হরফে লেখা ‘বালিসোনা পাউরুটি কারখানার কর্মীবৃন্দ।’
কর্মীদের মধ্যে সম্প্রীতির বোধ কারখানার উৎপাদনে সুফল দিল। ফলে শিবকৃষ্ণর সাপ্তাহিক পাঠশালা ক্রমশ যখন সরকার অনুমোদিত সুষমা গার্লস হাই স্কুল হয়ে গেল, তখনও বাড়তি চাহিদা মতো পাউরুটি সরবরাহে কোনও সমস্যা হল না। বাজারেও এক ও অদ্বিতীয় ভেষজ মিষ্টিযুক্ত রুটির চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকলে প্রয়োজন মতো উৎপাদন বাড়ানো হল।
শিবকৃষ্ণ লক্ষ্মী ও লিওনের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসে। পারমিতা ও তার ছেলের সঙ্গে কথা বলে শান্তি পায়। অম্বরীশের সঙ্গেও তার শুধু ব্যবসায়িক সম্পর্ক নয়, বালিসোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুজনে শলা-পরামর্শ করে। মানুষকে ভিক্ষুক বানানো অপরাধ- এই যুক্তিতে পয়লা বৈশাখ থেকে এক পাউন্ড রুটির জন্য এক নয়া পয়সা দাম ধার্য করা হয়েছে, সেও অম্বরীশেরই উপদেশে। শিবকৃষ্ণ প্রায়ই আফশোস করে বলে, ‘দশ বছর আগে যদি আপনাদের সঙ্গে দেখা হত!’
একদিন হঠাৎ অম্বরীশকে বলল, ‘আপনার এই ছেলে একদিন বালিসোনার মানুষের হৃদয় জয় করবে। ও যে আপনারই ঔরসজাত সন্তান সেকথা প্রথম যেদিন একসঙ্গে আপনারা তিনজন এসেছিলেন সেদিনই আমি বুঝেছি। ছেলেটি দুর্লভ মনের অধিকারী। আকাশমিব দুষ্পারম। আকাশের মতোই ওর মনেরও পার পাওয়া যায় না।’
এর তিনদিন পর ‘আকাশই তো পাখিদের ওড়বার উপযুক্ত স্থান/সবারই হৃদয়ে আছে ঈশ্বরের প্রবেশ-প্রস্থান’ লিখে শিবকৃষ্ণ ঘুমের ওষুধের খালি শিশি দিয়ে কাগজটা চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। খিচুড়ি ভোগ ও পাউরুটি বিতরণের ভার তার সাধনসঙ্গিনীকে ও স্কুলের দায়িত্ব লক্ষ্মী-লিওনকে দিয়ে আলাদা কাগজে তা পালনের জন্য ঐকান্তিক অনুরোধ জানিয়ে গেছে। সবার নীচে লেখা- যার নামে স্কুলের নাম তিনি যদি কখনও ফিরে আসেন, তাঁকে যেন এই হীরার নাকছাবি ও প্রতিমাসে ব্যাঙ্কের সুদের দুই শত টাকা দেওয়া হয়।
দাঙ্গার কিছুদিনের মধ্যে লিওন-লক্ষ্মীর স্কুল তৈরির কাজে এই দ্বিতীয় বার বাধা পড়ল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন