অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
লিওন-লক্ষ্মীর কল্পনার স্কুলের জন্য জায়গা বাছা হল কামান-মাঠের পিছনে পরিত্যক্ত পোড়ো জমিতে, যেখানে ইংরেজ সেনাবাহিনী যুদ্ধের সময় ট্রেঞ্চ খুঁড়ে রেখে গেছে। ওই অংশটা ঠিকঠাক করে তার ওপর স্কুলের বিল্ডিং উঠবে, আর তার সামনে পুরো কামান-মাঠ জুড়ে হবে স্কুলের খেলাধূলার বিরাট এলাকা। কামান দুটো স্মারক হিসেবে রেখে, বাকি অংশে ফুটবল, ভলি, ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা, ধানখেত, সবজিখেত, ফুলবাগান, ফলবাগান, একপাশে নৌকো বাইবার বৃত্তাকার খাল, সাঁতারের পুকুর ইত্যাদি অনেক কিছুই করার পরিকল্পনা। লিওন দিনের পর দিন রাত জেগে পুঙ্খানুপুঙ্খ নকশাও তৈরি করে ফেলল।
একসময়ের এই জমিদারী সম্পত্তির বর্তমান মালিক বালিসোনা পৌরসভা। তাদের কাছ থেকে নিরানব্বই বছরের লিজ নিয়ে স্কুল তৈরির কাজ শুরু হতে হতে বালিসোনায় বহিরাগতের ভিড় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
এক অমাবস্যার রাতে কলকাতার লটারির দোকানের গাড়ির ড্রাইভার, মন্থরোর মা’র নাতি সুজাকে জনশূন্যিমোড়ে গাড়িসুদ্ধ আটকাল হিন্দু পাড়ার ছেলেরা। গাড়ি থেকে সুজাকে টেনে নামিয়ে পিছনের দরজা খুলতেই পাঁচ-সাত দিন বয়সের অনেকগুলো বাছুর ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে হুড়মুড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। কয়েকটা বাছুর চার পা মুড়ে শুয়ে আছে, তাদের ওঠারও ক্ষমতা নেই। পাঁচ সেলের টর্চের আলোয় কোমল ফুটফুটে দুধের বাছুরগুলো দেখে মন স্নেহে দ্রব হয়। সুজা এদের এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? অমাবস্যায় বা কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাতে এর আগেও কয়েকবার সুজাকে গাড়ি নিয়ে আসতে যেতে কেউ কেউ দেখেছে।
হিক্কা তোলার মতো চাপা হাম্বা শুনে ছেলেরা এক হ্যাচকায় গাড়ির ডিকি খুলে টর্চ ফেলতেই দেখা গেল সেখানেও ঠাসাঠাসি করে কচি কচি মুমূর্ষু বাছুর পড়ে আছে। ঢাকনা খোলা পেয়ে কয়েকটা বাইরে এল। কয়েকটা উঠল না, হয়তো মরে গেছে।
সুজা প্রথমে কিছু টাকা এগিয়ে দিয়ে ছাড়া পেতে চেষ্টা করল। হঠাৎই কিল চড় ঘুষি লাথি খেয়ে স্বীকার করল, গয়লাপাড়া থেকে মাঝে মাঝে সে এইসব কচি বাছুর কলকাতায় নিয়ে যায়। সেখানে প্যাকিং করার পর এগুলো খিদিরপুর ডকে পৌঁছে দিয়ে তার ডিউটি শেষ। তার এতে কোনও দোষ নেই।
আক্রমণকারীরা সুজাকে ছেড়ে ভীত সন্ত্রস্ত বাছুরদের মধ্যে থেকে তুলনায় বেশি সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান বাছুর বেছে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, সেই সুযোগে সুজা গাড়ি নিয়ে পালাল।
পরদিন প্রায় একই সময়ে লাস্ট শোয়ে সিনেমা দেখে বেসুরো গলায় ‘প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ গাইতে গাইতে চারজন তরুণ ঘরের পথ ধরেছে, অন্ধকার ফুঁড়ে ছ’জন লোক তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুজনের হাতে মাংস কাটা ছুরি, একজন তাক করে আছে ওয়ান শটার, আরেক জন, সে সুজা, লম্বা টর্চ পথচারী চারজনের মুখে ফেলে ‘এইটা, এইটা, এইটা, এইটা’ বলে গত রাতের আক্রমণকারীদের চিনিয়ে দিচ্ছে, সুজার সঙ্গের লোকেরা ‘বোকনো-চোদা কাফেরের বাচ্চা!’ ‘বাছুর কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস, বের কর। বাছুর না পেলে সব ক’টাকে খাসি করে দেব!’ বলতে বলতে পেটে বুকে মুখে যে যেখানে পারল ছুরি চালাল।
‘আমি কাফের না, আমি হিন্দু না’ বলে একজন সুজাদের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। পিঠে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় ‘আমি মোছলমান, আমাকে মেরো না, হায় আল্লা!’ বলতে বলতে পাজামা খুলে তার ছুন্নত-চিহ্ন দেখাতে যাচ্ছিল, উল্টো দিক থেকে যাত্রা-ভাঙা গৃহমুখী মানুষের ভিড় এসে পড়ায় সুজার দল অন্ধকারে কলকাতার দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখা তাদের গাড়িতে লাফিয়ে উঠে পড়ে বিদ্যুৎগতিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আগের দিন প্রাণভয়ে সুজার ফেলে পালিয়ে যাওয়া জীবিত, সুস্থ বাছুরগুলো একেকটা একেকজন ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, যাত্রা ফেরত ভিড়ের মধ্যে তাদেরও বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল, এদেরই তিনজন তিনটে মুমুর্ষু বাছুর কোলে করে নিয়ে গিয়ে বাড়িতেই হালাল করে সালোনও খেয়েছে। কালকের ঘটনার কথা বালিসোনার সকলেই শুনেছে, আজ আহতদের দেখে পরিস্থিতি বুঝতে কোনও সম্প্রদায়েরই সময় লাগল না।
ভোর থেকে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ায় রুটি কারখানার কর্মীদের যারা মুসলমান তারা হিন্দুদের ভয়ে ডিউটি শেষ করেও রাস্তায় বেরতে সাহস পেল না, যারা হিন্দু তারা মুসলমানদের হাতে আক্রান্ত হবার ভয়ে বেরতে পারল না। কারখানার মধ্যে বহুদিনের ঘনিষ্ঠ দুই সম্প্রদায় পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে মেশা ভরসাটুকু মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরে সাতাত্তর ঘন্টা জেগে ঝিমিয়ে কাটিয়ে দিল। এমনিতেই রাস্তায় বিশেষ লোক দেখা যাচ্ছে না। সকলেই আক্রান্ত হবার ভয়ে বাড়ির ছাদে, ঘরের পিছনে ভাঙা থান ইট, আধলা ইট জড়ো করেছে।
তৃতীয় দিনে দাঙ্গা স্তিমিত হয়ে এলে পাউরুটির কারখানায় অম্বরীশ হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের কর্মীদের পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করাতে লেগে গেল। লিওনের চাষ করা চিনির-তিনশোগুণ-বেশি মিষ্টি ছোট-ছোট গাছের পাতার রস ময়দায় মিশিয়ে তৈরি গরম গরম একপাউন্ড মিষ্টি পাউরুটি কোলাকুলির পর প্রত্যেককে একটা করে বিলোন হল।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, তেমনই আচমকাই থেমে গেল। শিবকৃষ্ণর রোববারের সকালের পাঠশালা ও মঙ্গলবারের সান্ধ্য স্কুল বড় দোতলা বাড়িতে উঠে যাওয়ায় ছাত্রসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে পাউরুটির চাহিদাও বহুগুণ বেড়ে গেছে। এবারও বাড়তি কাজের জন্য ভিন্ন-ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক নেওয়া হল। হিন্দু-মুসলমান ছাড়াও এবার খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে নেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে পূর্ব পাকিস্তানের কক্সবাজার থেকে সাত ছেলে নিয়ে এক বিধবা এসে বাসা বেঁধেছে, ধর্মে এরা বৌদ্ধ, তাদের দুই ছেলেকে রুটি কারখানায় কাজ দেওয়া হয়েছে। এদের কক্সবাজারে নিজেদেরই রুটি কারখানা ছিল। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের তিনজনও একই পরিবারের, বালিসোনার বহু প্রাচীন দারুশিল্পী বংশের। এক সময়ে এদের সূক্ষ্ম কাঠের কাজের খুব খ্যাতি ছিল, বাংলার বাইরেও যেত এদের গড়া সিংহাসন, দেওয়াল-তাক, রত্নালংকার রাখার হাতবাক্স, মৌরিদান। পরে সারা বাংলাব্যাপী হস্তশিল্প অবলুপ্তির যুগে এদের দারুশিল্পেও অভাবের বাতাস লাগে। সেই সময়ে পরিবারের কর্তা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেয় ও ছোট-বড় সকলের অন্ত্যজ হিন্দু পদবির সঙ্গে নতুন খ্রিস্টীয় নাম জুড়ে যায়।
ভাড়া-করা বড় বড় দুধের ক্যান ভরা বালি-কাঁকর কাদামাটি ময়রাদের অ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝাঁকিয়ে সোনার কুচি পাওয়া গেল মাত্র তিনজনের পাত্রে, মোট তিন আনা। দুদিন দুরাত ওই অসম্ভব সোনা-নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় ডুবে থেকে অম্বরীশ এর মধ্যে আর কারখানায় যাবার সময় পায়নি, পরদিন তাদের বিবাহবার্ষিকীর দিনে খুব সকালে উঠে কারখানায় ঢুকে দেখল সাদা দেওয়ালে হলুদবাটা দিয়ে কাঁচা হাতের বড় বড় হরফে লেখা-
হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ
ভাইয়ে ভাইয়ে আর নয় যুদ্ধ
নীচে ছোট হরফে লেখা ‘বালিসোনা পাউরুটি কারখানার কর্মীবৃন্দ।’
কর্মীদের মধ্যে সম্প্রীতির বোধ কারখানার উৎপাদনে সুফল দিল। ফলে শিবকৃষ্ণর সাপ্তাহিক পাঠশালা ক্রমশ যখন সরকার অনুমোদিত সুষমা গার্লস হাই স্কুল হয়ে গেল, তখনও বাড়তি চাহিদা মতো পাউরুটি সরবরাহে কোনও সমস্যা হল না। বাজারেও এক ও অদ্বিতীয় ভেষজ মিষ্টিযুক্ত রুটির চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকলে প্রয়োজন মতো উৎপাদন বাড়ানো হল।
শিবকৃষ্ণ লক্ষ্মী ও লিওনের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসে। পারমিতা ও তার ছেলের সঙ্গে কথা বলে শান্তি পায়। অম্বরীশের সঙ্গেও তার শুধু ব্যবসায়িক সম্পর্ক নয়, বালিসোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুজনে শলা-পরামর্শ করে। মানুষকে ভিক্ষুক বানানো অপরাধ- এই যুক্তিতে পয়লা বৈশাখ থেকে এক পাউন্ড রুটির জন্য এক নয়া পয়সা দাম ধার্য করা হয়েছে, সেও অম্বরীশেরই উপদেশে। শিবকৃষ্ণ প্রায়ই আফশোস করে বলে, ‘দশ বছর আগে যদি আপনাদের সঙ্গে দেখা হত!’
একদিন হঠাৎ অম্বরীশকে বলল, ‘আপনার এই ছেলে একদিন বালিসোনার মানুষের হৃদয় জয় করবে। ও যে আপনারই ঔরসজাত সন্তান সেকথা প্রথম যেদিন একসঙ্গে আপনারা তিনজন এসেছিলেন সেদিনই আমি বুঝেছি। ছেলেটি দুর্লভ মনের অধিকারী। আকাশমিব দুষ্পারম। আকাশের মতোই ওর মনেরও পার পাওয়া যায় না।’
এর তিনদিন পর ‘আকাশই তো পাখিদের ওড়বার উপযুক্ত স্থান/সবারই হৃদয়ে আছে ঈশ্বরের প্রবেশ-প্রস্থান’ লিখে শিবকৃষ্ণ ঘুমের ওষুধের খালি শিশি দিয়ে কাগজটা চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। খিচুড়ি ভোগ ও পাউরুটি বিতরণের ভার তার সাধনসঙ্গিনীকে ও স্কুলের দায়িত্ব লক্ষ্মী-লিওনকে দিয়ে আলাদা কাগজে তা পালনের জন্য ঐকান্তিক অনুরোধ জানিয়ে গেছে। সবার নীচে লেখা- যার নামে স্কুলের নাম তিনি যদি কখনও ফিরে আসেন, তাঁকে যেন এই হীরার নাকছাবি ও প্রতিমাসে ব্যাঙ্কের সুদের দুই শত টাকা দেওয়া হয়।
দাঙ্গার কিছুদিনের মধ্যে লিওন-লক্ষ্মীর স্কুল তৈরির কাজে এই দ্বিতীয় বার বাধা পড়ল।
শরৎ-হেমন্তের ভোরে প্রায়ই যাকে শিউলি তুলতে দেখে চিনতে পারেনি, বৈশাখে তাকে বকুল কুড়োতে দেখে পরীক্ষিৎ তিকান বলে চিনতে পেরেছে। রোববারের পাঠাশালায় নিয়ম করে আসত। তখন দেখতে ছিল ঠিক একটা ডল পুতুলের মতো। পুতুলের মতোই, কথাও বলত না। নিজের ভালো নামটাও কখনও বলেনি। সকলের সব কথা শুনত খুব মন দিয়ে।
বকুল কুড়োতে কুড়োতে মাঝেমাঝে মাথা তুললে কিংবা গাছের ডালে ফুল দেখতে থাকলে পরীক্ষিৎ দোতলার জানলা দিয়ে মেয়েটার মুখের গড়নে অনেক বদল লক্ষ করে। ফোলা ফোলা গোলাকার মুখের জায়গায় এখন সামান্য লম্বাটে গড়নের মধ্যে খুব অন্যরকম একটা মায়াময় শ্রী ফুটে আছে। অনেকদিনের অদর্শনে যাকে বহুদিন মনেই পড়েনি, বাবাকে ভারত-চিন যুদ্ধের সময় এক ভোররাতে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যাওয়ায় তিন রবিবার পর প্রথম পাঠশালায় এসে যার ফুঁপিয়ে ওঠা পরবর্তীকালে পরীক্ষিতের বেশ কয়েকটা কবিতায় নানা চিত্রকল্পে ফুটে উঠেছে, প্রতিবছর অঘ্রাণের গোধূলিতে রাসমাঠে পরীক্ষিতের বুকসমান ভেসে থাকা ধোঁয়াশায় দুঃখের গন্ধ পাওয়ার কথা তখনও যাকে বলা হয়নি, সেই তিকানকে বৈশাখের ভোরে জানলা দিয়ে সে নতুন চোখে দেখল। বকুলবেদি থেকে অনেকটা তফাতে ভুবনমোহনের কবরে শিউলি গাছের পাশে এই বকুল গাছ পরীক্ষিৎ নিজেই তার রাঙাজ্যাঠাইমার সঙ্গে লাগিয়েছিল।
কবর পার হয়ে ডানদিকে অল্প এগোলে আগের আমলে রাসপূর্ণিমার সময় যে-দিঘিতে জোড়া নৌকোয় একমাসব্যাপী খেমটা নাচের আসর বসত, যে দিঘির জলে, এই সেদিনও, বর্ষাকালে কাগজের নৌকো ভাসানো হত, এখন সেখানে প্রদীপ ও পরীক্ষিতের যৌথ উদ্যোগে বসানো নিমচারার সারি বড় হয়ে জায়গাটাকে এতটা সুন্দর করে তুলেছে সেটাও তিকানকে দীঘির পাড় ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে ফিরে যেতে দেখে পরীক্ষিৎ আজই ঠিকমতো আবিষ্কার করল।
একদিন ফুল তুলে এপথেই তিকানের ফিরে যাবার সময় পরীক্ষিৎ নেমে এসে কয়েকটা পাকা নিমফল তুলে তিকানের হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার ছোটবেলার পুতুলের মতো গোলগাল মুখ এখন এই নিমফলের মতো একটু লম্বাটে হয়ে তোমাকে আরও সুন্দর দেখায়।’
তিকান মনে মনে অনেকদিন পরীক্ষিতের সঙ্গে অনেক কথা বলেছে, দীর্ঘ অদর্শনের পর আজ মুখে বলল, ‘তোমার কাছে আমি তো নিমের মতোই তেতো।’
‘নিমফুলের মধু কিন্তু খুব মিষ্টি। মোহন মউলেকে জিজ্ঞেস করো-’ এরপর অনেকক্ষণ তারা আর কথা খুঁজে পায়নি।
কিছুদিন ধরেই তরুণ বিপ্লবীদের অদৃশ্য উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। বালিসোনার দেওয়াল অদ্ভুত সব পোস্টারে ছেয়ে গেছে। এর মধ্যেই একদিন বালিসোনা হাইস্কুল মাত্র চার মাস পর শতবর্ষে পা দেবার সব প্রস্তুতি বৃথা করে দিয়ে এই অঞ্চলে প্রথম বিপ্লবী তরুণদের হিংসার বলি হল। হাতে হাতে বালতিতে ড্রামে পুকুরের জল ঢেলে তীব্র ধোঁয়া ও দাউ দাউ আগুন আয়ত্তে আনার আগেই অর্ধেক স্কুল বাড়ি পুড়ে ছাই। দূর গাঁয়ের বেশ কয়েকটি মেটেবাড়ির অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক রাতেই আগুন লাগানো হল। সারা দিন নানা জায়গা থেকে নানা গুজব আসে। বালিসোনা থেকে আরও দক্ষিণের যাত্রীদের কাছে শোনা গেল বঙ্কিম-বিদ্যেসাগরের মূর্তির নাকি মাথা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ওই কামরার এক স্কুলশিক্ষক শুধরে দিয়ে বললেন, বিদ্যাসাগর নয়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মুণ্ডু উড়িয়ে দিয়েছে। উৎসাহে উত্তেজনায় উপস্থিত অধিকাংশ নিরক্ষর যাত্রীদের তিনি শোনাতে লাগলেন, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ও মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ওখানকার একই আদালতে একবার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমের এজলাসে বাদী পক্ষের উকিল ছিলেন মধুসূদন। পরে তাদের দুজনের প্রস্তরমূর্তি রাস্তার ধারে অশথগাছের ছায়ায় পাশাপাশি বসানো হয়। বলতে বলতে আবেগে তরুণ শিক্ষকের গলা কাঁপে, ঠোঁট বেঁকে যায়।
ভুল করে বলা বিদ্যাসাগরের মুণ্ডচ্ছেদ পরদিন যেন ভবিষ্যদ্বাণীর মতো ফলে গেল। কলকাতায় কলেজ স্কোয়্যারে বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা তরুণ বিপ্লবীরা ভেঙে দিয়েছে।
রাতের অন্ধকারে বঙ্কিম-মাইকেল-বিদ্যাসাগরের মুণ্ডছেদের ঘটনায় বালিসোনার বয়োবৃদ্ধ অনেকেই বাড়িতে উপোস করেছেন। অনেক শিক্ষকের ঘরেই ছিল অরন্ধন। সরোজিনী সারা দিন পরীক্ষিৎকে তিনজনের সৃষ্টি নিয়ে এলোমেলো নানা কথা বলে গেল।
লক্ষ্মী-লিওনের স্বপ্নের শিক্ষালয় অনেক দূর এগিয়েও তৃতীয় বারের মতো থমকে গেল।
তিনক্রোশ দূরের গাঁয়ে ফুটবল ম্যাচ খেলে ঘরে ফিরছিল এগারজন, সন্ধে নামার মুখে সাতজন যে যার ঘরে চলে গেছে, বাকি চারজন একই পাড়ার, তিন-দুই গোলে হারার জন্য পরস্পরকে প্রথমে উত্তেজিত দোষারোপ ও পরে তারই পরিণামে হঠাৎই আক্রমণাত্মক হয়ে তাড়া করতে করতে অন্ধকারে দৌড়োচ্ছিল, বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা একটা পুলিশের জিপ তাদের সামনে জোরে ব্রেক কষল। চারজন আর্মড পুলিশ লাফিয়ে নেমে চার ছেলের বুকে রাইফেল ঠেকিয়ে প্রত্যেককে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে জিপে তুলল। নিদারুণ ভয়ে একজন বলে উঠল, ‘আমরা নকশাল না।’ সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন একেবারে শুকনো গলায় কোনওক্রমে বলল, ‘আমরা জয়ন্তীপুরে বাঘাযতীন মাঠে বল খেলতে গিসলাম।’ একজন গালে প্রচণ্ড এক চড় ও আরেকজন মুখে ঘুঁষি খেয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল। বাকি দুজন নিজেদের অজান্তে সেই আর্তকান্নায় গলা মেলায়।
সেদিন ভোররাতে বাদা ও তার পার্শ্ববর্তী রেললাইনের ওপারে, জঙ্গল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে অষ্টাদশ শতাব্দীর জরাজীর্ণ শিবমন্দিরের আধমাইল দূর থেকে গুলির লড়াই চালিয়ে পুলিশ জটাজুটধারী সাধক পুজারীকে তার তিনজন শিষ্যসহ গ্রেপ্তার করল। পুজারীর আরও চার সাগরেদ বুকে মাথায় গুলি খেয়ে কাছেই পড়ে আছে। দুজন পুলিশ ও একজন ইনফর্মারের শব খুঁজতে খুঁজতে পুলিশের হাতে আরও একটি পচাগলা মৃতদেহ উঠে এল। শবের মাথায়-মুখে লম্বা জটা ও পা পর্যন্ত লুটনো দাড়ি দেখে বোঝা গেল সে-ই আসল পুজারী। পুলিশ যে জটাজুটধারীকে বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে হাতে পেয়েছে সে আসলে বিপ্লবী দলের প্রথম সারির এক নেতা, শিবসাধক পুজারীর ছদ্মবেশে এখান থেকে গোপনে দলকে সংগঠিত করছে। রাইফেলের মুখে হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে হ্যাঁচকা টানে তার চুল-দাড়ি খুলে নেওয়া হল।
ভালো করে সকাল হবার আগেই পুলিশের কনস্টেবল, এস-আই, ও-সি, সার্কেল ইনস্পেক্টরদের নামের সঙ্গে লাল কালিতে আরও কয়েকজনের নাম লেখা ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকা’য় বালিসোনার বিভিন্ন দেওয়াল ছেয়ে গেল।
বালিসোনার মাথায় মধ্যাহ্ন সূর্য পৌঁছনোর আগে সারি সারি বাইরের পুলিশের গাড়িতে বাসরাস্তা ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল। মূল রাস্তা ছাড়াও বিভিন্ন শাখাপথ জিপের ধুলোয় একটু পর পরই ঢাকা পড়ে যায়। পোস্টারের ছিন্নভিন্ন দু-চার টুকরো ছাড়া বালিসোনার দেওয়ালে তখনকার মতো আর কোনও বিপ্লবের চিহ্ন রইল না। ভোর পর্যন্ত নানা দিকে চিরুনি তল্লাসি চালিয়ে পানের বরজ থেকে তিনজন ও গ্রামের শেষ প্রান্তে বেশ্যাপল্লি থেকে দুজন বিপ্লবীকে জীবিত ধরা হল, পুলিশের একজন ধরে মোট সাতটি মৃত বা মুমূর্ষু দেহেরও দখল নিতে হল পুলিশকে।
পরীক্ষিৎ সন্ধেবেলা লক্ষ্মী-লিওনদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে রাঙা-জ্যাঠাইমাকে সারি সারি পুলিশের গাড়ির খবর শোনাবার জন্য প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে আসছিল, তাকে ধরে সোজা থানার লক-আপে পুরে দেওয়া হল। নিদ্দার মুখে এই খবর পেয়ে সরোজিনী মিতা অম্বরীশ একসঙ্গে থানায় পৌঁছয়। একটু পরেই আসে লিওন ও লক্ষ্মী।
পুলিশ-হেডকোয়ার্টার থেকে অতি উচ্চপদস্থ যে অফিসার থানার অ্যাডিশনাল ও-সি সহ সকলের ওপর কর্তৃত্ব করছেন, তিনিই অম্বরীশদের সঙ্গে প্রাক্তন ভারতসুন্দরী সহ তিন সম্ভ্রান্ত মহিলা থাকা সত্ত্বেও, পরীক্ষিতকে সম্পূর্ণ ভুল করে থানায় ধরে আনার অভিযোগ কানেই নিচ্ছেন না, শেষ পর্যন্ত তাকে নিরস্ত করতে সেই মুহূর্তে থানায় আসা বিস্মিত ও-সি জগদীন্দ্র গোস্বামী এগিয়ে এল। ক্রুদ্ধ লক্ষ্মী অফিসারের টেবিলে ঝুঁকে সেইসময় বলছে, ‘এখানকার গ্রামীণ হাসপাতাল যাঁর নামে, ইনি সেই সরোজিনী, আমার মা। পরীক্ষিৎ আমার ভাই। এরপর তো চৌধুরীবাড়ি থেকেই মিথ্যে সন্দেহে যাকে খুশি তুলে আনবেন!’
অম্বরীশের চোখে আগুন। জোর করে সে নিজেকে সংবরণ করে আছে।
শেষ পর্যন্ত বহিরাগত অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে বার বার অম্বরীশদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। পরীক্ষিতের দু-হাত নিজের দু-হাতে ধরে পুলিশের এই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের জন্য তার কাছে আলাদা করে ক্ষমা চাইলেন।
চোরাগোপ্তা হানায় পুলিশের বন্দুক ছিনতাইয়ের খবর প্রথম প্রথম বালিসোনার অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করতে চায়নি। একসময় ঋণজর্জর চাষিদের বা দাদনে বাঁধা তাঁতিদের মহাজন, উচ্চ হারে সুদের কারবারি, মোটা ফিয়ের ডাক্তার- এরকম নানা পেশার ধনীদের সঙ্গে নিরীহ গরিব মানুষের লাশও নির্জন মাঠে ঘাটে পড়ে থাকা বালিসোনার রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। পুলিশি হানাও বাড়ল বহুগুণ। রাতে বুটের লাথি বা বন্দুকের গুঁতোয় ঘুম থেকে তুলে থানায় বা আর কোথাও নিয়ে যাওয়া কিংবা আকস্মিক কড়া নেড়ে বা দরজা ভেঙে যখন-তখন যে কারও ঘরে ঢুকে পড়া আর অস্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরা হয় না। এর মধ্যেই গাঁজা আফিংয়ের দোকান, দিশি মদের দোকান, বিলাতী মদের দোকান রোজই দুটো একটা আগুন লেগে জ্বলতে দেখা গেল।
বিপ্লবীদের বার্তা-বিনিময়ের প্রধানকেন্দ্র হয়ে দাঁড়াল সব সন্দেহের ঊর্ধে থাকা সুষমা বালিকা বিদ্যালয়। পাউরুটি বিতরণের সময় আগে থেকেই রুটির প্যাকেট ব্লেড দিয়ে সামান্য কেটে তার মধ্যে জরুরি নির্দেশ ঢুকিয়ে নিজেদের দলের ছেলেদের আসার দিকে নজর রাখে রুটি বিতরণের দায়িত্বে নতুন নিযুক্ত দুই যুবক। এরা বিপ্লবী দলের। বিতরণের কাজে বিপ্লবী দলের দুজনের নিয়োগ ও রুটির প্যাকেটে চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা- দুটোতেই সরোজিনীর হাত আছে বলে অম্বরীশের সন্দেহ। বিপ্লবী দলের কয়েকজনকে সরোজিনী চেনে, বালিসোনা থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে কলেজে পড়ে, লেখাপড়ায় খুবই ভালো, কলেজ ম্যাগাজিনে তাদের কারও কারও গল্প কবিতা তারাই তাকে এর আগে পড়িয়েছে, পুলিশের ভয়ে এখন পালা করে তারা মাঝে মাঝে চৌধুরীবাড়ির অন্য সকলের চোখ এড়িয়ে সরোজিনীর নিরাপদ আশ্রয়ে লুকোয়। তাদের উদ্দেশ্য বা গতিবিধি বিষয়ে তারা একটি শব্দও বলে না। শুধু পরীক্ষিৎকে সাবধান করে দেয়- সে যেন তাদের কথা কাউকেই কখনও না বলে।
দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে বড় শহরের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে কয়েকজন সাংবাদিককেও গ্রেপ্তার করা হল। বালিসোনার রাস্তায় পুলিশি টহলও বাড়ল। দোকানে বাজারে অফিসে নিয়মশৃঙ্খলা এখন চোখে পড়ার মতো। ট্রেন লেট বা যখন-তখন ট্রেন বাতিলের ঘটনা বন্ধ হল। ব্যাঙ্কে, পোস্ট অফিসে ঘড়ির কাঁটা ধরে কর্মচারীদের হাজিরায় অনভ্যস্ত বালিসোনাবাসী অবাক। মুদির দোকান, মনোহারী দোকান, ওষুধের দোকানে রোজকার স্টক লিখে টাঙিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করা হল। মিষ্টির দোকান ও রেস্টোর্যান্টে সেদিনকার খাবারের নাম ও দামের তালিকায় অক্রেতা পথচারীও দাঁড়িয়ে পড়ে বেশ খানিকক্ষণ চোখ বোলায়। যাদের ছেলেরা পুলিশের গাড়িতে গ্রামছাড়া, তাদের অধিকাংশেরই আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
দুবছর পর ভোটে ক্ষমতাসীন দলকে নির্মূল করে বিরোধী দলগুলোর ফ্রন্ট রাজ্যের শাসনক্ষমতা দখল করে পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিচ্ছে শুনে বালিসোনার অদৃশ্য ছেলেদের বৃদ্ধ মা-বাবা, কারও দাদা বা দিদি, কারও বউ বা বৌদি রোজই স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কেউ ফিরলেও অনেকেরই আর দেখা মিলল না। শুধু মাঝে মাঝে অজ্ঞাত-পরিচয় কংকালস্তূপ আবিষ্কারের খবর শোনা যায়।
নতুন সরকারের নানা আন্তরিক উদ্যোগ দেখে গ্রামের মানুষ নতুন আশায় বুক বাঁধে।
বিদ্যুৎ, রেললাইনের বৈদ্যুতিকরণ, টেলিফোন-সংযোগ ও সড়ক সম্প্রসারণের আকর্ষণে বেশ কিছুকাল ধরে বাইরে থেকে লোক এসে বালিসোনায় জায়গা জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে, সরকারের বিভিন্ন কল্যাণকর কর্মসূচির প্রয়োজনে কলকাতার ট্রেনের একেকটা কামরা বালিসোনা স্টেশনে এসে খালি হয়ে যায়। শনি-রবি কি জাতীয় ছুটির দিনে এত লোক জমি দেখতে আসে যে জমির দালালদের নাওয়া-খাওয়ার ফুরসৎ থাকে না। চায়ের দোকান, সেলুন, চাঁদসীর ডাক্তারখানার সামনে গাছের গুঁড়িতে, টিনে, দরমার বেড়ায় আলকাতরায় ‘‘সস্তায় জমি বাড়ি ক্রয়ের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান’’-এর বিজ্ঞপ্তি লাগিয়ে তারা খদ্দের ধরে। বালিসোনার আমবাগান, পেয়ারা বাগান, লিচুবাগান, গোলাপজাম বাগান কেটে ছোট ছোট প্লটে বাড়ি উঠতে লাগল। অনেক চাষের খেত ঘর-বাড়িতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল নতুন প্রজন্মের যুবসম্প্রদায়ের ভিড়ে বালিসোনার দোকান, বার, রেস্টোর্যান্ট, দিশি ও বিলাতি মদের দোকান, চায়ের দোকান, টিউটোরিয়াল হোম অনেক রাত অব্দি ভরে থাকে। বাড়ি তৈরির সরঞ্জাম ও হার্ডওয়্যারের দোকানে বৃদ্ধ ও মাঝবয়েসিদের ভিড়ও দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সময় থেকে বালিসোনায় বাংলা বাক্যের গড়ন, শব্দের অর্থ ও ব্যঞ্জনা ক্রমশ বদলাতে লাগল, বহিরাগত হিন্দি-ইংরিজি শব্দের অনুপ্রবেশে একরকমের মিশ্রভাষাও তৈরি হল।
পরীক্ষিৎ পরে খবরের কাগজে তার নিয়মিত কলাম ‘বিষাদগাথা’য় বিষয়টি উল্লেখ করে লিখেছিল, ‘কথার প্রাণ, প্রবাদ, নতুন শব্দ জন্মায় গ্রামীণ জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে, ভাষার ভ্রষ্টাচার ঘটে শহুরে প্রভাবে। ক্ষয়িষ্ণু মানবিকতা আর সেই ছিদ্রপথে ভোগসর্বস্ব জীবনের নিত্য হাতছানি তার আঁতুরঘর।’
অম্বরীশ মাটির নীচে পাঁচ-ইঞ্চি সোনার দুর্গামূর্তি পাবার পর থেকে দ্বিগুণ উৎসাহে মাটি খোঁড়ার কাজ চালিয়ে যায়। এক জায়গায় একটা ঘাটের ভগ্নাবশেষের মধ্যে এবড়োখেবড়ো চৌকো অমসৃণ একটা পাতলা স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কার করে তার মন নতুন স্বপ্নে মেতে উঠল। শ্রমিকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে সে কিছুটা ব্যবধানে আরও দুটো নলকূপ বসিয়েছে। তিনটি নলকূপেই সপ্তাহে একদিন কর্পূর ফেলার ব্যবস্থা করে জল অনেকটাই নির্দোষ করা গেছে।
পুরো পাঁচ ইঞ্চি স্বর্ণদুর্গা পাওয়ার দু’মাসের মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা মেলার দুদিন পরেই প্রত্যেককে বাড়তি আধ পাউন্ডের দুখানা করে মিষ্টি পাউরুটি সে নিজের হাতে বিলি করছিল, এমন সময় পর-পর ছত্রিশটা মোটরসাইকেল বাসরাস্তা থেকে প্রায় উড়ে এসে বাদায় অম্বরীশের সামনে পড়তে লাগল। যারা ইতিমধ্যে রুটি পেয়ে খেতে শুরু করেছে, এবং যারা লাইন দিয়ে অম্বরীশের হাত থেকে রুটি নিচ্ছে, বাইকবাহিনী দেখে সকলেরই মুখ শুকিয়ে গেছে। বাইকবাহিনীর প্রত্যেকের গলায় স্কার্ফের মতো লাল রুমাল গিঁট দিয়ে বুক অব্দি ঝোলানো। এদের একজন বাইকটা ঠেলে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে অম্বরীশের কাছে এসে বলল, ‘এসব বন্ধ করতে হবে।’
অম্বরীশ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কে হে, তোমরা?’
‘দুশশালা! আমার তো বীচিসুদ্দু জ্বলে উঠছে রে!’ ঘাড় সামান্য ঘুরিয়ে নিজেদের বাহিনীর উদ্দেশে কথাটা বলতেই তার ঠিক পিছনের ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওলা যুবকটি বলল, ‘এসব জলা-জমি বিক্রি হয়ে গেছে, এখানে টাউনশিপ হবে। দু-সপ্তাহের মধ্যে আপনার বাঁদরনাচ বন্ধ না হলে আমরাই আপনাকে নিয়ে বাঁদরনাচ নাচাব! কথাটা মনে রাখবেন।’
গতকালই সন্ধের ট্রেনে অম্বরীশ জয়নগর-মজিলপুর স্টেশনে নেমে রিকশায় চড়ে খুঁজে খুঁজে প্রত্নতাত্ত্বিক কালিদাস দত্ত মশাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। পুরনো দোতলা বাড়ি। সিঁড়ি থেকেই নানা মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সাজানো। বালিসোনা অঞ্চলে তাঁর নিজের উদ্যোগে খননকার্য চালিয়ে যেসব দুর্লভ সামগ্রী পাওয়া গেছে, তা দিয়ে তিনি নিজেই বাড়িতে এ-অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুদ্রার আন্তর্জাতিক সচিত্র তালিকায় অম্বরীশের স্বর্ণমুদ্রা নেই দেখে দত্তমশাই রায় দিয়েছেন মুদ্রার ইতিহাসে এই মুদ্রা এখনও অনাবিষ্কৃত। মূল্যও তাই অপরিসীম। কথাটা জানার পর থেকে অম্বরীশ ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফুটছিল, যুবকের কথার এক অক্ষরও তার মাথায় ঢোকেনি। মোটরসাইকেলের ভিড়ে বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এখানে এত মোটরসাইকেল কেন?’
‘কাল সকাল আটটায় রুদ্র ঝম্পটির সঙ্গে দেখা করবেন।’
ছত্রিশ মোটরবাইকের মিছিল বাদাময় চক্কর দিয়ে বাদার আকাশ-বাতাস বাইকের গর্জনে কাঁপিয়ে ফিরে গেল।
অনেকদিন পর সেই রাতে আবার লাগোয়া বারান্দায় খটাখট আওয়াজ শুনল অম্বরীশ। একজন একজন করে সাত কংকাল ঘরে ঢোকা মাত্র সে ব্যস্ত হয়ে আগের আমলের বর্মাটিকের বেঞ্চে তাদের বসাল। সাত কংকাল বসে বসে শুধু পা নাচাতে লাগল, কেউ কোনও কথা বলল না। এই প্রথম এদের উপস্থিতিতে অম্বরীশ ভয় পেয়ে গেল। তাকে ভয় পেতে দেখে সাত কংকাল দুলে-দুলে সুর করে একসঙ্গে বলে উঠল-
কংকালে কংকাল আনে, নদী ভরে বাণে
সকলেই লোভে ভাসে, ভবিতব্য না জানে
তিনবার গাইবার পরই হঠাৎ একটা কংকাল অম্বরীশের বুকের ওপর এসে বসল। অন্যরা একে একে বেরিয়ে গেলেও কংকালটা একভাবে বসেই থাকে। সাহায্যের জন্য, একটু দম নেবার আশায় সে চিৎকার করতে লাগল কিন্তু সে বোঝে তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছে না।
‘এই! এই! কী হল তোমার? ফের বুকের ওপর হাত রেখে শুয়েছ?’ অম্বরীশের গোঁগেঁা শুনে জেগে উঠে মিতা তার ঘুম ভাঙাল। ‘বোবায় ধরা রোগ তো ছিল না তোমার। সারা দিন কী যে করে বেড়াচ্ছ জানি না।’ বলে দুজনেই দুজনকে ছুঁয়ে থেকে আবার ঘুমোবার চেষ্টা করে।
পরদিন গোধূলিতে রাসমাঠে হালকা ধোঁয়াশার চাদরের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে পরীক্ষিৎ তিকানকে থামায়।
‘সেই গন্ধ! তুমি পাচ্ছ? অবিকল সেই দুঃখের গন্ধ।’
তিকান দুবার বড় শ্বাস নিয়ে হেসে ফেলে, ‘এ তো ছাতিমফুলের গন্ধ। আগে এখানে একটা মাত্র গাছ ছিল, এখন তো দিঘির এ মাথায় রাঙা-জ্যাঠাইমার লাগানো চারা বড় হয়ে ছাতিমের বন হয়ে গেছে।’
পরীক্ষিৎ বিশ্বাস করতে পারে না যে সে ছোটবেলা থেকে ছাতিমফুলের গন্ধকেই দুঃখের গন্ধ ভেবে এসেছে। পৃথিবীতে এত মানুষের এত দুঃখ, দুঃখের কোনও গন্ধ নেই? দুঃখের রংও নিশ্চয়ই আছে। ছোটবেলায় এখানে কোনও ছাতিমগাছ ছিল বলেও তো মনে পড়ে না।
হঠাৎ তিনটে মোটরবাইক বড়রাস্তা ছেড়ে রাসমাঠের প্রবেশপথে ভুবনমোহনের কবরের ওপর আস্তে ব্রেক কষে মাটিতে এক পায়ের ভর দিয়ে বাইক সামান্য কাৎ করে রেখে লম্বা চুলে দু’কান ঢাকা আরোহী বলল, ‘প্রেম করছেন করুন, কিন্তু কাল বাবাকে বলবেন নিশ্চয়ই যেন ঝম্পটিদা’র সঙ্গে দেখা করে।’
‘ঝম্পটিদা কে?’
‘জোনাল কমিটির সেক্রেটারিকে এ চাঁদু চেনে না রে!’ সঙ্গীকে কথাটা বলে পরীক্ষিতের দিকে ফিরে আবার বলল, ‘না গেলে কিন্তু থানায় যেতে হবে। সেখানেই কথা হবে!’
তিনটে বাইকই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবার পর তিকান সন্ত্রস্ত স্বরে বলল, ‘এই গুণ্ডাগুলোকে তুমি চেনো না পরীক্ষিৎ, এরাই এখন বালিসোনার হত্তাকত্তা। পরপর চারবার শাসনক্ষমতা পেয়ে এরা এখন চাইলে হাতে মাথা কাটতে পারে। এদের আদেশই এখানে শেষ কথা। থানা-পুলিশ এদের কথায় ওঠে-বসে।’
পরীক্ষিত রাঙা-জ্যাঠাইমার সঙ্গে বালিসোনার পরিস্থিতি আলোচনা করে ঠিক করল খুব শিগগিরই তারা বালিসোনার সমভাবাপন্ন মানুষদের নিয়ে এইসব লাগাম ছাড়া অনাচার-অন্যায়ের প্রতিবাদে মিছিল বের করবে। সরোজিনী ছাড়াও লিওন-লক্ষ্মী, অম্বরীশ, মিতা, পরীক্ষিৎ, সেজো-জ্যাঠাইমা তো থাকবেনই, প্রদীপ, সরস্বতী-তাপসকেও ডাকা হবে। এমনকী হাইকোর্টের জাঁদরেল অ্যাডভোকেট মেজোজ্যাঠাকে লক্ষ্মী নিজে গিয়ে বোঝাবে, যদি আসতে পারেন। তার বাবাকেও যদি এইসময় পাওয়া যেত! তার তো কোনও উপায় নেই। আর সেজোজ্যাঠার তো এতে সমর্থনই নেই। সে নিজেই শাসক দলের বড় শরিকের ঘনিষ্ঠ, সামনের ইলেকশনে টিকিট পাবার আশায় নেতাদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলে।
অম্বরীশ সকালে বাদায় পৌঁছে দেখে বাদার বিরাট অংশ ঘিরে লাল পতাকার বেড়া। বাসরাস্তামুখী বড় সাইনবোর্ডে বড় বড় ছাপার হরফে লেখা- সাইট ফর সাউথ উইন্ড টাউনশিপ।
পরপর পাঁচবারের পৌরসভা-চেয়ারম্যান অম্বরীশ তখনই থানায় গিয়ে রুদ্র ঝম্পটি ও তার দলবলের নামে জোর করে পৌরসভার জমি দখলের চেষ্টার বিরুদ্ধে এফ-আই-আর করতে গেলে থানার ডিউটি অফিসারের নির্লিপ্ত উত্তর- বড়বাবু নেই, এখন এফ-আই-আর নেওয়া যাবে না।
‘ডাকুন আপনার বড়বাবুকে, বলুন অম্বরীশ চৌধুরী ডাকছে। ভেরি আর্জেন্ট।’
থানার পিছনে কোয়ার্টার থেকে বড়বাবুকে আসতে দেখে অম্বরীশ গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আমি জানতে চাই এফ-আই-আর নেবার নির্দিষ্ট সময় কবে চালু হয়েছে? কে চালু করেছে?’
চেয়ারে বসতে বসতে পুরো বৃত্তান্ত শোনার আগেই বড়বাবু বললেন, ‘আপনি কোর্ট থেকে অর্ডার নিয়ে আসুন। কোর্টের অর্ডার ছাড়া আমরা কিছু করতে পারব না।’
‘এফ-আই-আর নেবেন না কেন? তাহলে সেটা ইন রাইটিং দিন।’
বড়বাবুর চোখের ইঙ্গিত বুঝে ডিউটি অফিসার খাতা খুলে অম্বরীশের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করল। আগের দিন সদলবলে এসে তাকে শাসিয়ে যাওয়ার কথা লিখতে বলায় ডিউটি অফিসার লেখা থামিয়ে বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। সবটা লিখিয়ে এফ-আই-আর নম্বর নিয়ে অম্বরীশ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াতেই বড়বাবু সামনে ঝুঁকে এসে শান্ত স্বরে বললেন, ‘একটা কথা বলব স্যার? ওদের সঙ্গে কি পারবেন? তার চেয়ে মোটা একটা টাকা নিয়ে মিটিয়ে নিন।’
‘এ কি কোনও ভুল বোঝাবুঝি যে মিটিয়ে নেব? পুলিশের চেয়ারে বসে বেআইনি গুণ্ডাবাজির সমর্থন করছেন, আবার ঘুষ নিতে বলছেন?’
থানা থেকে বেরবার মুখে অম্বরীশ দেখল থানার গায়েই বটগাছের নীচে লাল মারুতি থেকে নামছে রুদ্র ঝম্পটি, সঙ্গে তার প্রধান দুই সাগরেদ, দুজনের একজনের ডান গালে ওপর থেকে নীচ অব্দি ফালা ফালা করে পুরনো কাটার দাগ ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে একটুও ঢাকা পড়েনি। সে চিনতে পেরেছে, কাল এ-ই তাকে বাঁদরনাচ নাচাবার শাসানি দিয়েছিল।
বাদায় যখন ফিরে এল তখন যুদ্ধক্ষেত্রে একপেশে আক্রমণ সবে বন্ধ হয়েছে, গাঁইতি-কোদাল-শাবল নিয়ে বা ফেলে রেখে তার লোকেরা যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। হাতে একটা মেশিনগানের অভাব বিদ্যুতের মতো অম্বরীশের মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। কনুই থেকে হাত উড়ে-যাওয়া একজন ও মাথা-কপাল ফাটা আরেকজনকে ধরাধরি করে কাছেই ডিসপেন্সারিতে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক ব্যান্ডেজ করিয়ে অন্যান্য কয়েকজন আহতকে সঙ্গে আসতে বলে অম্বরীশ সোজা এস-ডি-ও-র ঘরে ঢুকে পড়ল।
এস-ডি-ও ব্যস্তভাবে টেলিফোনে থানার ও-সিকে ফোর্স নিয়ে বাদায় গিয়ে কালপ্রিটদের গ্রেপ্তারের আদেশ দিল ও ওখানকার লাল পতাকাগুলো তুলে থানায় জমা করতে বলল। একটু পরেই আবার ফোন করল- ‘মোট ন’জন সিরিয়াসলি ইনজিওর্ড। বালিসোনা গ্রামীণ হাসপাতালে পাঠাচ্ছি, আজই প্রত্যেকের জবানবন্দি নেবেন।’
সন্ধেবেলা বালিসোনার চারবারের এম-এল-এ মনোরঞ্জন ভঞ্জ একদল ছেলে সঙ্গে নিয়ে এস-ডি-ও-র বাংলোয় এল। সামনের সোফায় বসে বলল, ‘পুলিশ বেছে বেছে আমাদের দলের ছেলেদের তুলে এনেছে কেন আমি জানতে চাই।’
মাত্র দুবছর আগের ব্যাচের তরুণ আই এ এস অফিসার কঠিন স্বরে বলল, ‘আমি তো দল চিনি না, স্যার।’
এফ-আই-আর-এ নাম আছে, হাইকোর্টে মেজদা যতীন্দ্রমোহনের উদ্যোগে অ্যান্টিসিপেটরি বেল না-মঞ্জুর হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও রুদ্র ঝম্পটি ও আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হল না। আদালত বার বার পুলিশকে আসামীদের গ্রেপ্তার করে এজলাসে হাজির করার আদেশ দিলে পুলিশ প্রত্যেক বার একই রিপোর্ট পেশ করে- ‘দে আর অ্যাবস্কন্ডিং।’
লক্ষ্মীদের বাড়িতে সামনে পিছনে পাশে সেই আদিগন্ত ধানখেতের জায়গায় এলোমেলোভাবে বাড়ি উঠে গেছে। সামনের দীর্ঘ খোলা অংশটা এখন রাস্তা, বড় রাস্তা থেকে সোজা লক্ষ্মীদের বাড়ির পাশ দিয়ে আরও উত্তরে চলে গেছে। সে-রাস্তার ধারেও শীত-গ্রীষ্ম-বসন্তে নতুন নতুন চায়ের দোকান, মুদির দোকান, তেলেভাজার দোকান, মাংসের ঘুগনি ও মোগলাই পরোটার দোকান দেখা যায়।
সকাল আটটায় চারটে মোটরবাইক এসে লক্ষ্মীদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। দরজার ঘন্টি শুনে লিওন দরজা খুলে দুজনকে চিনতে পারল, কিছুদিন আগে যে বাইকবাহিনী তাদের শিক্ষালয়ে গিয়ে দশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছিল, এই দুজন সেই দলের।
‘নমস্কার। আমরা একটু দিদির সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।’
‘ভেতরে এসে বসুন। হয়তো একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
‘নো প্রবলেম। আপনি দিদিকে খবর দিন।’
লক্ষ্মী ঘরে এলে চারজনই উঠে দাঁড়িয়ে তাকে নমস্কার করল। এদের মধ্যে বোধহয় নেতাস্থানীয় একজন বলল, ‘আমরা সরস্বতীর পুজোর পরদিন সন্ধেবেলা ‘বালিসোনা ফেসটিভ্যাল’ করার পরিকল্পনা করেছি। আপনি এক্স মিস ইন্ডিয়া, আপনাকে না পেলে উৎসব হবেই না। কলকাতা থেকে মৌপিয়া সেন, কুমার সুনিশ্চিত, চিররঞ্জন আসবে। সারা বালিসোনা অঞ্চলের যেখানে যত ট্যালেন্ট আছে, সবাই এসে নাচ গান আবৃত্তি করবে। যাদুর খেলাও হবে। রাসমাঠে বিরাট প্যান্ডেল হবে। ডি এম, এস-ডি-ও, এস পি, ডি এস পি সব আসবে। আপনাদের হাসপাতালের সব ডাক্তারদের নেমন্তন্ন করা হবে। সব ইস্কুলের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষকদেরও ডাকা হবে, তাঁদের বাছা বাছা ছাত্র-ছাত্রীরা তো নাচ গান আবৃত্তি করবে।’
সরস্বতী পুজো যত এগিয়ে আসে, রাস্তায় তত বাস লরি গাড়ির অনড় সারি দীর্ঘ হয়। গাড়ি থামিয়ে সদলবলে স্বরস্বতী পুজোর চাঁদা আদায় চলে। কেউ কেউ প্রথমে দাবি মতো টাকা দিতে না চাইলে কিল চড় ঘুষি লাথি খেয়ে পুরো টাকাই দিয়ে দেয়। শুধু রাস্তায়ই নয়, পাড়ায়ও চাঁদার জুলুমের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাবার সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পুলিশকে অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশের নিষ্পৃহ পরামর্শ, ‘দাবি মতো চাঁদা দিয়ে মিটিয়ে নিলেই তো পারেন।’ চেয়ারে হেলান দিয়ে আড়াআড়ি পা নাচাতে নাচাতে একবার এক ডিউটি অফিসার আরও যোগ করে- ‘ক’টাকে ধরে লক-আপে পুরব বলুন তো? আর পুরলেও এযাত্রা আপনি বেঁচে যাবেন কিন্তু আপনার বউ-মেয়েকে সারা বছর তো আর রাস্তায় ঘাটে পুলিশ এসকর্ট দেওয়া সম্ভব না।’
সরস্বতী পুজোর দিন সকালে সরোজিনী, লক্ষ্মী, লিওন, পরীক্ষিতের উদ্যোগে বালিসোনার চাষি-তাঁতি কামার-কুমোর, মিস্ত্রি-মজুর, গয়লা, ঘরামিদের বাড়ি থেকে ছেলে মেয়ে ধরে এনে পুজো মণ্ডপে বাগদেবীর সামনে হাতেখড়ি দেওয়া হল। সংখ্যায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি।
অনেকের বাবারই প্রশ্ন, লেখাপড়া শিখে কী লাভটা হবে?
‘লেখাপড়া না শিখলে কাকে কীভাবে ভোট দিতে হয় জানবে কী করে? গণতন্ত্রে তোমরাই তো ভোট দিয়ে সরকার গঠন করবে!’
তাদের কথায় জানা গেল কী করে ভোট দিতে হয় তারা জানে না। ভোট দেবার বয়েসে পৌঁছে গত চার-পাঁচ বারের নির্বাচনে একবারও তারা বুথে গিয়ে ভোট দেয়নি।
পরীক্ষিৎ অবাক, ‘সে কী! কেন?’
‘ভোটের ছেলেরা বাইক চড়ে সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে বলে যায়, তোমাদের যেতি হবেনি, তোমাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।’
সন্ধের আগেই গোটা রাসমাঠ ভরে গেল। ভুবনমোহনের শেষ ইচ্ছা পূরণ করে শিউলি-চাঁপা কবরস্থান মাড়িয়ে শয়ে শয়ে মানুষ সারা মাঠ জুড়ে চট কাপড় কাগজ বিছিয়ে বসে পড়তে লাগল।
মাঝে মাঝেই ‘মাইক টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি’ আর বিশ্ববিখ্যাত নায়িকা মৌপিয়া সেন, বিশ্ববিখ্যাত গায়ক কুমার সুনিশ্চিত, বিশ্ববিখ্যাত নায়ক চিররঞ্জনের আগমন বার্তার কানফাটানো ঘোষণা শোনা যাচ্ছে।
বালিসোনা সার্কিট হাউসে হঠাৎ মন্ত্রী আসায় ডি-এম, এস-ডি-ও কেউই উৎসবে আসেননি। লক্ষ্মী মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে বালিসোনা উৎসবের উদ্বোধন করার পরই ভিড় ঠেলে এম-এল-এ মনোরঞ্জন ভঞ্জ মঞ্চে উঠে এই অঞ্চলের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক বিনোদনের দিকেও তাদের সরকারের নজর আছে জানিয়ে দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। তারপরই রুদ্র ঝম্পটিকে মঞ্চে উঠে আসতে দেখে লক্ষ্মী তার আসন ছেড়ে নীচে নেমে তিন সারি চেয়ারের প্রথম সারিতে মায়ের পাশে এসে বসল।
রাতে অম্বরীশের দূরের দৃষ্টি ক্রমশ কমে আসতে থাকায় ভাষণরত ঝম্পটির চেহারা স্পষ্ট না চিনলেও গলার আওয়াজ শুনে লিওনকে জিজ্ঞেস করল, ‘সেই অ্যাবস্কন্ডিং ঝম্পটি না?’
‘তোমার অনুমান সত্য। পুলিশ ইনস্পেক্টরও এখানেই আছে, তবু গ্রেপ্তার করছে না।’
মৌপিয়া সেন, কুমার সুনিশ্চিত, চিররঞ্জনের আসতে দেরি হবে শুনেও তাদেরই আকর্ষণে লোক আসছে। একসময়ে রাসমাঠ ছাড়িয়ে দিঘির ওপার, অনেক দূর পর্যন্ত বাসরাস্তার দুধার লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল, লোক আসার তবু বিরাম নেই।
সরোজিনী লক্ষ্মী মিতা পরীক্ষিৎ অম্বরীশ লিওন চলে যাবার পর রাত ন’টা নাগাদ ভিড়ের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি মারামারি শুরু হয়ে গেল। একদল মাতাল ভিড়ের মধ্যে ঢুকে মেয়েদের সঙ্গে নাচতে চেয়ে তাদের হাত ধরে টানাটানি করায় গোলমালের সূত্রপাত। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা ছুরি, পাঞ্চ, পাইপগান, ওয়ান শটার, রিভলবারে ভয়াবহ আকার নিল। মাতালদের হাত থেকে নিজের শালীকে বাঁচাতে গিয়ে কপালে গুলি খেয়ে নিরঞ্জন বসাক রাসমাঠেই মারা গেল। আহত হল অনেকেই। মাঠ জনশূন্য হবার পর চারদিকে চটি, গায়ের চাদর, চশমা, ঘড়ি, ভাঙা কাচের চুড়ি, ধুলো-কাদামাখা চুরনি, ছাপা শাড়ি, ছেড়া ব্লাউজ, কামিজের টুকরো পড়ে থাকতে দেখা গেল। নিরঞ্জনের বুকে মাথা ঠুকতে ঠুকতে তার শালী তখনও আর্তস্বরে চেঁচিয়ে চলেছে- ‘তাঁতে নতুন নকশা চড়িয়ে গ্রামের বাইরে যেতে নেই জানতেন না? তবে কেন এলেন? কেন এলেন? আমায় নিয়ে কেন এলেন?’ শেষ কথাগুলো মাথা ঠোকার তালে তালে বলেই চলেছে।
আশ্বিনেও আকাশ মেঘলা। মাঝে মাঝেই ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিপাত। টানা ন’দিন এরকম চলার পর হঠাৎই এক শনিবার সকালে বালিসোনার সারা আকাশ টকটকে নীল হয়ে উঠল। দুর্যোগের দিনগুলোয় বাড়ির ছাদে বাইরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মহড়া বন্ধ রাখতে হয়েছে লক্ষ্মী-সরোজিনীকে। সেই ক’টা দিন ভেতরের দালানে নিজেদের পরিবারের সদস্যদের মহড়া যথাসাধ্য চালু রাখা হয়েছে।
লখনউ থেকে সরস্বতী এসেছে, একাই। সঙ্গে বড় বড় দুটো সুটকেস। দিল্লি থেকে প্রদীপ এসেছে লম্বা ছুটি নিয়ে। মেজো জ্যাঠাইমা মেয়েকে নিয়ে এলেও যতীন্দ্রমোহন বাদার মালিকানা নিয়ে হাইকোর্টে মামলায় ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেনি।
পরপর তিনদিন নীল আকাশে আসন্ন শীতের লেপ বানাবার পেঁজা-তুলোর পাহাড় দেখে বালিসোনার মানুষ আশ্বস্ত হয়ে অভিনব প্রতিবাদ-মিছিলের মহড়ায় বাড়ির ছেলেমেয়েদের আবার চৌধুরীবাড়ি পাঠাতে লাগল।
দুর্গাপূজার তিনদিন আগে নাচ গান পথনাটিকার বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা দেখে কারও চোখে আর পলক পড়ে না। এমন প্রতিবাদমিছিল বালিসোনার মানুষ কখনও দেখেনি। এ যেন একটা সুদীর্ঘ স্বপ্নদৃশ্য। প্রদীপের ভাষায় ‘নান্দনিক প্রতিবাদ’। দুপুর দুটোর মধ্যে রাস্তার দুপাশে মানুষের গাদাগাদি ভিড় উপচে পড়ার জোগাড়। ঘর বাড়ি দোকানের ছাদে-বারান্দায়, জানলার ফাঁকে, গাছের মগডালে শুধুই মানুষের মাথা।
সরোজিনী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, অনিন্দিতা, পারমিতা, পরীক্ষিত, তিকান, সুকন্যা, সুনয়নী, অম্বরীশ, লিওন, প্রদীপদের হাতে হাতে দৃষ্টিনন্দন প্ল্যাকার্ডে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা এমন মর্মস্পর্শী কথাও বালিসোনার মানুষ আগে কখনও শোনেনি।
কারও প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘হিংসা নয়, ঘৃণা নয়, চাই ভালোবাসা/পরদুঃখে কাঁদা চাই, পরসুখে হাসা।’
কারও প্ল্যাকার্ডে- ‘কেদার-বদ্রী যাও কিংবা করো হজ/ভালোবাসা তার চেয়ে অনেক সহজ।’
কিংবা, ‘ধর্ম যদি ধুয়ে দেয় অন্তরের কালো/সব ধর্ম ঠিক পথ সব ধর্ম ভালো।’
কোথাও লেখা, ‘মানুষ থাকুক যত্নে/এছাড়া আর পথ নেই।’
অনেকে ভক্তিভরে অবাক চোখে দেখছে, অনেকে ঠোঁট নেড়ে কথাগুলো বানান করে পড়ছে। বালিসোনা যেন মন্ত্রমুগ্ধ।
স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে দলে দলে মানুষ এসে মিছিলের শেষ প্রান্তে যোগ দেবার ফলে মিছিল ক্রমশ আরও দীর্ঘ আকার নিল। স্টেশন রোড দিয়ে মিছিল যখন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে সেই সময়টুকুÅর মধ্যে তিনটে আপ-ডাউন ট্রেনের অনেক প্যাসেঞ্জারও গন্তব্য ভুলে প্রথমে কৌতূহলে ও পরে আবেগবশে মিছিলে এসে যোগ দিল।
মিছিলের পিছনে পুলিশের গাড়ি মেনে নিলেও সামনের আর্মড ফোর্সের গাড়ি সরিয়ে নেবার জন্য অম্বরীশদের বহু অনুরোধ-জোরাজুরিও বৃথা হল। অফিসারের একটাই উত্তর- অর্ডার নেই।
প্রকৃতিবন্দনা, মানববন্দনা, বালিসোনাবন্দনার নৃত্যগীতে, বৃক্ষনিধনের নিষ্ঠুরতা ও প্রতিবাদের পথনাটিকার ছন্দে তালে অঙ্গভঙ্গে বালিসোনার বাতাস যখন উচ্ছ্বসিত, আকাশ যখন উচ্চকিত, মানুষ যখন উদ্দীপিত, ঠিক তখন মিছিলের পিছনে আরও দুটি পুলিশের কালো গাড়ি এসে জুড়ে গেল। দুটি গাড়িতেই প্রচুর পুলিশ ছাড়াও বাইকবাহিনীর কয়েকজনকে দেখা গেল, এদের মধ্যে তিনজনের নামে তখনও হুলিয়া জারি আছে।
প্রথমে মিছিলে দুটো বোমা পড়ল, একটা অম্বরীশকে লক্ষ করে। তারপরই মিছিলের পিছন দিক থেকে পুলিশের এলোপাথাড়ি লাঠি চার্জ। মিছিল ছারখার না হওয়া পর্যন্ত তাণ্ডব চলল।
বাম উরুতে বোমার জালকাঠি বিদ্ধ হয়ে অম্বরীশ পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল। হাসপাতালে সব ক’টি জালকাঠি বের করে দেখা গেল তার হাঁটুও জখম হয়েছে। হাঁটু থেকে উরুর অর্ধেক পুরু ব্যান্ডেজ বেঁধে নিউরো সার্জন অম্বরীশকে একমাস বেড রেস্টের আদেশ দিলেন।
প্রহরে প্রহরে তাকে ওষুধ খাওয়াবার দায়িত্ব জোর করে সরস্বতী নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তার এই কাকার কাছে তার কৃতজ্ঞতা সে আজও ভোলেনি। একদিন ওষুধ দেবার জন্য বাড়ানো সরস্বতীর হাত ধরে ফেলে অম্বরীশ বলল, ‘ডাক্তার শুধু শরীর সারাবার ওষুধ দিয়েছে, তোর সুটকেস থেকে আমাকে মন সারাবার ওষুধ এনে দে দেখি। তুই কি লখনউয়ের সব বই-ই নিয়ে এসেছিস? যা বড় বড় দুখানা সুটকেস দেখলাম!’
‘ওষুধটা খেয়ে নাও।’ বলে খানিক চুপ করে থেকে এবার থমথমে গলায় সরস্বতী বলল, ‘শুধু বই না, সব কিছু নিয়ে চলে এলাম। এখানেই থাকব।’
‘তাপসও কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে আসবে?’
‘তাপসের কাছ থেকে আমি চলে এসেছি। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে, কাকা।’
অম্বরীশের ঘরে এখন কংকালের আবির্ভাব রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ধারণা কংকালের ভয়ে সে রাতেও ঘুমোয় না। এমনিতেই বার কতক ওষুধ ইনজেকশনের জন্য তাকে দিনের বেশির ভাগ সময় জেগে থাকতেই হয়, তারওপর শয্যাশায়ী অবস্থায়ও একদিন মিতার সঙ্গে দৈহিক মিলনের পর ঘুমে তার চোখ জুড়িয়ে আসছিল, তবু সে জোর করে জেগে থেকে মিতার অতি মৃদু নাকডাকা মন দিয়ে শুনতে লাগল। চির চেনা এই ধ্বনিটুকুও যেন এখন তার দরকার।
কখন যে বারান্দায় খটখট শব্দ তুলে একে একে সাত কংকাল এসে হাজির হল অম্বরীশ খেয়াল করেনি। আজকাল এরা আর কোনও আলোচনা পাড়ে না, নিঃশব্দে বসে বসে শুধু পা নাচায়। কিছুক্ষণ পর একজন একজন করে সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর মতো তার বুকের ওপর চেপে বসে থাকল। অলক্ষ্যে থেকে কেউ যেন তাদের বসে থাকার মেয়াদ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। সেইমতো তার সময় শেষ হলে, সে উঠে সোজা বাইরে চলে যায়। তখন পরের জন এসে বসে। এইভাবে সাতজন প্রায় সারা রাত ধরে তার বুকে চেপে বসে তাকে এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমোতে দিল না। সে ভীত সন্ত্রস্ত স্বরে চোখ বুজে ‘বাঁচাও, কে আছো বাঁচাও, কেউ কি আছো, আমাকে বাঁচাও’ বলে শুধু চেঁচাতে লাগল। মিতার ধাক্কায় চোখ খুলে তার ঝুঁকে থাকা উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ভাবল- ওরা কি চলে গেছে! এবার কি একটু ঘুমোতে পারব?
যতীন্দ্রমোহন অম্বরীশকে দেখতে আসার সুযোগে হাসপাতালে ও থানায় গিয়ে তার ইনজুরির বিবরণ পরীক্ষা করল। ফিরে যাবার আগে সরোজিনী অম্বরীশ ও পারমিতাকে একজায়গায় বসিয়ে বাদার মালিকানার মামলার আংশিক সুখবর দিল- সেটেলমেন্ট রেকর্ডে, পরবর্তী কালের ল্যান্ড রেভেনিউ ডিপার্টমেন্টে সাত বছরের ব্যবধানে দুটি মিউটেশনে প্রথমে আইন মাফিক ওয়েস্ট বেঙ্গল হাউজিং বোর্ডকে ও পরে আইন ভেঙে কোন এক বিদেশি ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যান্ড টাউনশিপ বিল্ডার্সকে জলের দরে নিরানব্বই বছরের লিজ দেওয়া হয়েছে। আইনের কারচুপি প্রমাণ করাও কঠিন হবে না।
রুদ্র ঝম্পটি ও আরও সাতজনের নামে অম্বরীশকে খুনের চেষ্টার অপরাধে ৩০৭ ধারায় মামলা করতে পুলিশকে বাধ্য করল যতীন্দ্রমোহন। এবারেও দোষীরা পলাতক, তাদের কাউকে ধরা গেল না।
সন্ধের পর অম্বরীশের চোখের দৃষ্টি ক্রমশ আরও কমে যাচ্ছে। কে একজন তার বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘তোর ব্যথা কোথায় বল, মানুষের নিরানব্বই ভাগ আদিব্যাধি সারিয়ে দেওয়া যায়। বল কোথায় তোর কষ্ট? যুধিষ্ঠির নাপিতকে একবার খবর পাঠা তো, আমার জটা-দাড়ি কেটে দিক এসে।’
শেষ কথায় অম্বরীশের বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল- ‘অবনী? অবনী দাদা? ছোড়দা, তুই? আঃ, বাঁচালি।’
অম্বরীশের ভয় করে, হয়তো স্বপ্ন দেখছে।
প্রহ্লাদ কর্মকারের বড় ছেলে যেদিন বাবার সঙ্গে মাটির নীচে ঘাটের ভগ্নাবশেষ দেখতে এসেছিল, সে শহরের পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে শুনে অম্বরীশ বলেছিল তার নতুন বৌদির কাছে সেযুগের বিদেশি ‘টি’ ও জার্মান কাঁটা-কম্পাস আছে, একদিন এসে যেন নিয়ে যায়।
বৌদি প্রায় কিশোরী বয়সে কলকাতায় মহিলাদের প্রথম পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েছিলেন, ওই পলিটেকনিকেরই প্রিন্সিপাল তাঁর নিজের পিসিমার উপদেশে কলেজে যাতায়াত শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত মন বসাতে না পেরে বেথুন কলেজে পড়াশোনা শেষ করেন।
‘টি’ ও কাঁটা-কম্পাস নিতে আসার দিন ছেলের সঙ্গে প্রহ্লাদও মনিববাড়িতে কত্তাবাবুকে দেখতে এল। গভীর সংকোচে বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকার পর সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘আপনি না এলে খননকায্য তেমন এগোচ্ছে না, কত্তাবাবু! যেসব জায়গার জল নেমে গেছে সেখানেও পুরো দমে সবাই হাত লাগায় না। বৃষ্টির আগে যারা মাটি খুঁড়ত তারা রোজই আসে কিন্তু শুকনো জায়গায় তারা কোদাল মারে না। পাউরুটির লোভে আসে, রুটি নিয়ে চলে যায়। ওয়াল পেসিডেনের ইসকুল থেকেও রুটি আনতে যায়।’
প্রহ্লাদের ছেলের মতো আরও কারও কারও ছেলে ট্রেনে বড় শহরের কলেজে, পলিটেকনিকে, আই টি আইতে পড়তে যায়। মেয়েরাও কেউ কেউ যায়। রুটি কারখানার ম্যানেজারের মেয়ে ও ময়দা-মাখিয়েদের একজনের ছেলে মেডিক্যাল কলেজে পড়ে। অনেকে আবার স্কুলের পড়া শেষ না করে বা পাশ করতে না পেরে মনিহারি দোকানে, জামা-কাপড়ের দোকানে, জুতোর দোকানে, চায়ের দোকানে, চশমার দোকানে কাজ করে। বাপ-ঠাকুর্দার পেশায় কারও আর আগ্রহ নেই। অনেকে কাজের সন্ধানে গুজরাট মহারাষ্ট্র কেরালায় চলে যায়।
বালিসোনায় মানুষের ভিড় যত বাড়ে, জমির দামও তত বাড়ে। বাড়ে দোকান-বাজার। কল-কারখানা। ষাট-সত্তর বছর আগের মানুষের মুখের ভাবের তুলনায় এখনকার ভিড়ের মানুষের মুখভাবের পার্থক্যও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে চালচলন, মুখের ভাষার তফাৎ। বালিসোনায় এ-ও এক মৌলিক বদল।
তবে সরোজিনীর পর্যবেক্ষণে এখনও বদলের আঁচ না লাগা কৈশোরের সজীব মুখ, স্বপ্নমাখা চোখ বালিসোনায় দেখা যায়। চিরকাল দেখা যাবে।
‘এটা তোমার উইশফুল থিংকিং নয় তো?’ পরীক্ষিৎ বলল।
‘না রে, এই যে লক্ষ্মীর মেয়েকে নিয়ে এতটা সময় কাটাই, সেও এই মুখের মায়ায়। তোকে যখন প্রথম দেখি তোর চোখে-মুখেও আমি এমন ধারাই দেখেছি। ভুল তো দেখিনি।’ খানিক চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘তোর ঠাকুর্দার মতো যদি রাস্তার ধারে শিরীষতলায় গিয়ে বসতে পারতাম, তাহলে ঠিক এরকম গভীর মনের ছেলেমেয়ে আলাদা করতে পারতাম। খুব ইচ্ছে হয় কাছে ডেকে এদের মনের কথা শুনি। আমার কী মনে হয় জানিস- এই যে যুগে-যুগে নিরন্তর সব কিছু বদলে চলেছে, তা সত্ত্বেও সব যুগেই দেখা যায় কিছু কিছু মানুষের মুখে তাদের গভীর মনের ছায়া পড়ে। হয়তো প্রাগৈতিহাসিক যুগেও এমন ছিল, তা নাহলে পাহাড়ের গুহায় ছবি আঁকার কথা ভাবল কী করে?’
‘তাহলে বাড়িতে একটা ছোট লাইব্রেরি করো না কেন? তোমার তো অনেক বই। লাইব্রেরিতে শুধু কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা পড়তে পারবে, ওই যাদের সজীব মুখ, স্বপ্নমাখা চোখ। চাঁদা লাগবে না। যদি করো, আমি হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে স্টেশনে, পোস্টাপিসে, বাসস্ট্যান্ডে সেঁটে দেবার ব্যবস্থা করতে পারি। ওরকম ছেলেমেয়ে জড়ো করা তো সহজ কথা নয়।’
সরোজিনী ততক্ষণ মনে মনে লক্ষ্মী-লিওনের মেয়ের মুখের মায়াতেই ফিরে গিয়েছিল। পরীক্ষিতের কথাটা হয়তো শোনেইনি, মৃদু স্বরে বলল, ‘মা-বাবার রূপ সৌন্দর্য লুটে নিয়ে মেয়েটা জন্মেছে। দেখিস ও একদিন হয়তো বহু মানুষের কল্যাণসাধন করবে।’
পারমিতা ছেলের নামে একটা মুখ আঁটা খামের চিঠি দিতে এসে এ ঘরে ঢুকে শেষ কথাগুলো শুনে বলল, ‘আবার কিছু একটা প্ল্যান করা হচ্ছে নিশ্চয়ই?’
চিঠি পড়ে পরীক্ষিৎ খুশি। খবরের কাগজের ট্রেনি জার্নালিস্টের লিখিত পরীক্ষার পর কিছুদিন আগে ইন্টারভিউ দিয়ে এসে রোজ সকালে সেই কাগজটাই পড়ার সময়েও কোনওদিন তার মনে কাজটা হবার আশা বা ভাবনা জাগেনি।
সব শুনে সরোজিনীর প্রতিক্রিয়া- ‘তোর পক্ষে ভালো হল। হ্যাঁরে, অত বড় কাগজের অফিসে তুই পারবি তো?’
‘যে কাজের জন্য পরীক্ষা, সেটা যখন পেরেছি, কাজটাও পারব নিশ্চয়ই। ওঁরাও তো শেখাবেন।’
ট্রেনিং শেষ হবার আগে থেকেই রবিবাসরীয় পাতায় একটা-দুটো করে পরীক্ষিতের কবিতা ছাপা হতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যে প্রতি বুধবার সে লিখতে শুরু করল ‘বিষাদগাথা’ নামে এক নতুন কলাম।
বছর না ঘুরতেই ‘বিষাদগাথা’ কলামে পরীক্ষিৎ জলের দরে বিদেশিদের হাতে বালিসোনার বাদা তুলে দেওয়ার নেপথ্য কাহিনী গভীর দুঃখ ও বিষাদের সঙ্গে সাত সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিক লিখে গেল।
রাতে অফিস থেকে ফিরে কিছুক্ষণ অন্তত রাঙা-জ্যাঠাইমার সঙ্গে কথা না হলে তার ভালো লাগে না। ইতিমধ্যে কিশোর মনের সঙ্গে ভাব-বিনিময়ে সরোজিনীর আগ্রহের কথা শুনে লক্ষ্মী তাকে তাদের শিক্ষালয়ে উপদেষ্টা-শিক্ষিকার পদ নিতে রাজি করিয়ে ফেলল। সেখানেও কোনও কোনও দিন ক্লাসের শেষে লক্ষ্মীর মেয়ে চিরন্তনীকে সঙ্গে নিয়ে আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের দুটি আলাদা হোস্টেলে পালা করে পশু পাখি কীট পতঙ্গের অদ্ভুত সব গল্প শুনিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায়। পরীক্ষিত তখনও বসে থাকে।
অল্পদিনেই তার বিষাদগাথার লেখাগুলোতে এক নিঃস্বার্থ, নির্ভীক ও বিষণ্ণ প্রতিবাদীর পরিচয় পেয়ে পাঠক বাংলা ভাষায় এক নতুন মন আবিষ্কার করল। তার কবিতার চাপা হাহাকার বিষাদগাথায় আরও প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল। মানুষের মনে তার কথার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ল চৈত্রের গুমোটের পর কালবৈশাখীর মতো। ‘এই কবি-কলমচীর চোখ দিয়ে শুধু অশ্রু নয়, আগুনও নির্গত হয়’ তাঁর প্রথম গদ্যসংকলনের সমালোচনায় অন্য একটি সংবাদপত্রে মন্তব্য করা হয়েছিল।
পরীক্ষিতের কবিতা, বিশেষ করে তার বিষাদগাথা এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল যে-কোনও ইস্যুতে শাসক দল পরীক্ষিতের সমর্থন পেতে মরিয়া। আবার সরকার-বিরোধীরা তাকে চায় শাসনক্ষমতা-দখলে তাদের নিজস্ব পন্থার সমর্থক হিসাবে।
অঘ্রাণে ধান কাটার পর বালিসোনার প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে ঘরে ঘরে নবান্নের দিন পরীক্ষিৎ তার রাঙাজ্যাঠাইমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভণ্ডুলের দুহাতে দুই ব্যাগ ভরতি বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ পরিবারপিছু একটা করে বিলোতে লাগল। সরস্বতী পুজোর দিন যাদের হাতেখড়ি হয়েছিল তারা সেদিনকার তালপাতা, খাগের কলম বাদেও এবার স্লেট-খড়ি পেয়ে মহা খুশি। ড্রাইভার বিনোদের কাঁধের ঝোলা থেকে স্লেট-খড়ি বের করে যতীন বরের ছেলে ব্রতীন বর হাতেখড়ি হওয়া ছেলেমেয়েদের নামের তালিকা আগে মিলিয়ে দেখে তারপর দানসামগ্রী হাতে তুলে দিচ্ছিল।
কাঁসারিপাড়া থেকে বেরিয়ে তাঁতিপাড়ায় ঢোকবার মুখে পরীক্ষিতের চোখে পড়ল তাদের গাড়ির হুডে হেলান দিয়ে চারজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে, পাশে চারটে মোটরবাইক দাঁড় করানো।
সরোজিনী তখনও তাদের পিছু পিছু আসা গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলায় মগ্ন। গাড়ির কাছাকাছি হতেই চারজনের তিনজন আগের মতোই হেলান দিয়ে রইল, একজন হাতের গোটানো টাইপ করা কোর্ট পেপার সরোজিনীদের সামনে হুডের ওপর রেখে বলল, ‘রাসমাঠের দানপত্রে দুজনে সই করুন। দান করছেন বালিসোনা স্পোর্টিং ক্লাবকে।’
‘মানুষ, না শয়তান এরা?’
সরোজিনীর কথা কানে না নিয়ে পরীক্ষিৎ দৃঢ় স্বরে বলল, ‘দান আর লুণ্ঠন দুটো আলাদা প্রক্রিয়া। রাসমাঠ আপনারা লুট করার চেষ্টা করতে পারেন, আমরা এখনও কাউকে দান করার কথা ভাবিনি।’
পরীক্ষিৎ গালে একটা প্রচণ্ড ঘুষি খেয়ে ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল। আঙুলের বাঘনখে তার গাল কেটে গেছে, ধুলোয় রক্ত পড়ে খানিকটা জায়গা কালচে দেখাচ্ছে।
গ্রামবাসীদের মারের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে তিনজনই বাইকে লাফিয়ে উঠে পালাল, একজন, পরীক্ষিৎ উঠে দাঁড়ালেও তার রক্তের পাশেই শুয়ে রইল।
দুটো ইনজেকশন ও গালে তিনটে সেলাই নিয়ে পরীক্ষিৎ সরোজিনীকে আশ্বস্ত করতে করতে বাড়ি এসে দেখে বসবার দালানে শাসকদলের নেতা বসে আছেন। উঠে দাঁড়িয়ে দুজনকে নমস্কার জানিয়ে পরীক্ষিতের গালের স্টিকিং প্লাস্টারে চোখ রেখে নেতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি অসুস্থ? না কি রোড অ্যাকসিডেন্ট?’
‘আপনি হঠাৎ?’
‘আপনার সঙ্গে খুব জরুরি আলোচনা ছিল। রাজ্যে শান্তির ব্যাপারে আমাদের দল একটা উদ্যোগ নিচ্ছে। আপনার মত মানে সম্মতির আশা নিয়ে আমি নিজে চলে এসেছি।’
‘শান্তির জন্যও সম্মতি দরকার? শান্তি তো সকলেই চায়।’
‘বিরোধী দল তারই সুযোগ নিয়ে আমাদের চেষ্টা বানচাল করতে চাইছে। শুনছি তারা নাকি জেলায় জেলায় দুর্গার মহিষাসুর বধের পালা নামাচ্ছে।’
এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর দু-ঘন্টা ধরে শাসকদলের নেতা পরীক্ষিৎকে তাঁদের দলীয় কর্মসূচি বিশদে বোঝাতে লাগলেন।
পুরো সময়টা নীরব শ্রোতা থেকে পরীক্ষিৎ বলল, ‘সশস্ত্র শান্তি-আলোচনা কি সম্ভব? আমার তো মনে হয় শকুনিকে কোকিলের ডাক শেখানোর মতোই অবাস্তব। আমাকে মাফ করুন, আর এখানে বসে থাকতে পারছি না। আপনি কি জানেন আজ আপনাদের বাইকবাহিনীর চারজন ছুরি উঁচিয়ে রাসমাঠের দানপত্রে আমাদের সই করতে বাধ্য করতে এসেছিল! আমার গালে তার ক্ষত এখনই সেলাই করে এসেছি। আর বসতে পারব না।’
‘সে কী! আমি এখুনি খবর নিচ্ছি। এফ আই আরে সব কটার নাম দিয়েছেন তো? আপনার সামনেই বলে যাচ্ছি, আইন আইনের পথে চলবে। আমার প্রস্তাবটা একটু ভেবে দেখবেন। দেশের স্বার্থে আপনি যে আমাদের দলকে সমর্থন করবেন সে-বিশ্বাস আমাদের আছে।’
নেতাকে বাইরের দরজায় তার গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে পরীক্ষিত বলল, ‘দেশের স্বার্থ আমি কিছুটা বুঝি, দলের স্বার্থের সঙ্গে তার মিল কোথায়, শ্যামানন্দবাবু?’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন