বিষাদগাথা – ১৫

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

এক পয়সা থেকে পাঁচ পয়সা, পাঁচ পয়সা থেকে দশ পয়সা পর্যন্ত বিনিময়মূল্য বাড়িয়েও ক্রমবর্ধমান পাউরুটি প্রার্থীদের দৈনিক পাউরুটি বিলোনো স্বর্গীয় ওয়াল পেসিডেনের প্রতিষ্ঠিত সুষমা বালিকা বিদ্যালয়ের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। ময়দার দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজারে পাউরুটির দাম বাড়াতে বাধ্য হলেও অম্বরীশ তার কারখানার ম্যানেজারের জবরদস্তি সত্ত্বেও স্কুলের বরাদ্দ রুটি বরাবরের মতো বাজার দরের অর্ধেক দামে দেবার ব্যবস্থা চালু রেখেছে।

শনিবারের সন্ধেবেলার কীর্তন ও খিচুড়ি ভোগ আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শিবকৃষ্ণর আত্মহত্যার এক দশক পর তারই প্রতিষ্ঠিত স্কুলের ছাত্রী স্কুল ফাইনালে নবম হওয়ায় সরোজিনীর উদ্যোগে ওই দিনটিকে তার আবির্ভাব ও প্রয়াণদিবস ধরে নিয়ে বছরে ওই একদিন সকালে ছাত্রীদের গান আবৃত্তি ও সকাল-সন্ধে দুবেলাই কীর্তন-খিচুড়ি ভোগের আয়োজন হয়। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের সামনে রাস্তার ধারে টিন টালি অ্যাসবেসটস চালাঘরের সেলুন, স্টুডিও, জেরক্স, লোকাল ও এসটিডি টেলিফোন বুথের খুপরির লোকজনকেও ওই দিন খিচুড়ি ভোগে ডেকে নেওয়া হয়। মৃত্যুর ন’মাস ঊনিশ দিন পরে শিবকৃষ্ণর সাধনসঙ্গিনীর গর্ভে জন্মানো তাদের একমাত্র সন্তান নীলাম্বর তার যেখানে যত সমবয়সি বা আরও কমবয়সি বন্ধু আছে প্রত্যেককে নিমন্ত্রণ করে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজে উপোস করে থেকে সবার কলাপাতায় খিচুড়ি পরিবেশনের তদারকি করে। সে নিজেও খিচুড়ির বালতি হাতে আনন্দে দৌড়োদৌড়ি করে। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিজের হাতে খিচুড়ি দিতে তার খুব উৎসাহ। তার মা বলে, ‘তোর এই স্বভাব তুই তোর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিস। সারা জীবন তোর জন্য অপেক্ষা করে করে হতাশ হয়ে, হয়তো সেই দুঃখেই, চলে গেলেন। তুই আসছিস, সেটুকুও জেনে গেলেন না।’

পাউরুটির কারখানা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্কুলে রুটি বিতরণ কয়েকদিনের জন্য বন্ধ রইল। লিওনের চেষ্টায় তার আম-লিচু প্রসেসিংয়ের ব্যবসার লাভের অংশ থেকে কলকাতার রুটি কারখানায় অর্ডার দিয়ে নিয়মিত রুটি আনার মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হল। তবে পাইকারি দরের ওপর অম্বরীশের কারখানার মতো বাড়তি ডিসকাউন্টের অভাবে রুটির সাইজ হাফ পাউন্ডের বদলে কোয়ার্টার পাউন্ড করা হল। মিষ্টি রুটির বদলে হল সাধারণ পাউরুটি।

দূরে কোথাও মৌলবাদী হিন্দুদের হাতে মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে মুসলমান পাড়ায় কয়েকজন নেতার প্ররোচনায় বালিসোনায় বহুকাল পর আবার দাঙ্গা শুরু হল। অম্বরীশের রুটি কারখানার অধিকাংশ কর্মীদের চেষ্টায় প্রথম কয়েকদিন পরিবেশ শান্তই ছিল, এরই মধ্যে চারজন কর্মী তাদের পাড়ার নেতাদের পরামর্শে মুসলমান কর্মীদের মধ্যে রটিয়ে দিল হিন্দুরা বেছে বেছে দেশের সব বড় বড় মসজিদ ধ্বংসের চক্রান্ত করেছে।

ক্রাচে ভর করে অম্বরীশ বহু কষ্টে কারখানায় এসে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের মূল্য ও গুরুত্ব বোঝাবার চেষ্টা করল। জনে জনে ব্যাখ্যা করে, কারখানার সকলের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি থাকার জন্যই সংশ্লিষ্ট সকলে আর্থিক সুফল পাচ্ছে। দেশের মুষ্টিমেয় লোকের ধর্ম নিয়ে গুণ্ডাবাজিতে অকারণ মেতে গিয়ে সেই বহুকষ্টের সুফল কি নষ্ট হতে দেওয়া উচিত?

কারখানার ভেতরে দাঙ্গা ঠেকানো গেলেও, দাঙ্গায় উৎসাহদাতা দুই সম্প্রদায়ের মোট সাতজন কর্মীকে বরখাস্ত করার প্রতিবাদে কারখানায় ঢোকবার মুখে ডজন ডজন ঝাণ্ডা পুঁতে দু-সম্প্রদায়েরই কর্মী ও অকর্মী বহু লোক স্লোগান দিতে লাগল। পিছনের দরজার সামনেও একই ব্যবস্থা। দুদিক থেকেই ভেতরে যাতায়াতের পথ বন্ধ। বেশির ভাগ কর্মী কাজে যোগ দিতে এসেও কারখানায় ঢুকতে পারল না।

বালিসোনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখনও দাঙ্গার রেশ থাকায় পুলিশ গেট আটকে রাখা জনতাকে লাঠি চালিয়ে হটিয়ে দেবার সাহস করল না। কারখানার কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। বহুকষ্টে অনেক ক্ষতি স্বীকার করে গড়ে তোলা তার কারখানা অন্যের মতামত মেনে চালাতে অম্বরীশও আর রাজি নয়।

১৬

চৌধুরীবাড়ির পিছন দিককার ঘন বাঁশবনের আলো-আঁধারি থেকে বেরিয়ে দিবাকর তার মুখ ও মাথার মাকড়শার জাল ছাড়াতে ছাড়াতে চৌধুরীদের ন’ছেলের তেতলার ঘরের জানলার নীচে এসে দাঁড়াল। জানলার গরাদে কপাল চেপে নন্দিনী ইঙ্গিতে দিবাকরকে অপেক্ষা করতে বলল। তারপর কাছে এসে দিবাকরের শার্টে হ্যাঁচকা টান দিয়ে দ্রুত পায়ে আনারসের বন ছাড়িয়ে, ধূতরার জঙ্গল পার হয়ে, খেজুরগাছের সারির পাশ দিয়ে রেললাইনের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘যা বলবে তাড়াতাড়ি বলো, পরীক্ষিৎ আজকাল এইসব জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।’

‘সাগরখাঁড়ি যাবে? সেখানে আমি সাগরের কুচো চিংড়ির ঝাঁক শুকনো করার যন্ত্র বসিয়েছি। কাঠের যন্ত্র, আমারই তৈরি। ওই যন্ত্রে সারা দিন আমি চিংড়ির জলীয় পদার্থ বের করি। তুমি গেলে ওখানেই থাকব, বালিসোনায় আর ফিরব না। যাবে?’

‘বাবা-জ্যাঠারা আমাকে কেটে বাদায় পুঁতে দেবে।’

ট্রেন আসতে দেখে দুজনেই রেললাইন ছেড়ে নেমে দাঁড়াল। রেলগাড়ির মাথায়ও শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে মানুষ চলেছে।

‘তোমাদের বাড়িটা আসলে পাগলদের আলাদা একটা পৃথিবী। একেক জনের একেক রকম কাণ্ডকারখানা।’

কথাটা শুনতে শুনতে দিবাকরের কোঁকড়া চুল থেকে মাকড়শার জাল-জড়ানো শুকনো বাঁশপাতা ফেলে দিয়ে নন্দিনী বাপমা-হারা কুচকুচে কালো ছেলেটির আশ্চর্য নিখুঁত নাক-ঠোঁট-চিবুক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। সেই ঘোর থেকেই বলল, ‘সাগরখাঁড়িতে তোমার নিজের ঘর আছে?’

‘সৈকতের কাছেই আমার দুখানা ঘর, একটায় আমার যন্ত্র আর একটা নৌকো থাকে, আরেকটায় ওখানকারই দুটো ছেলেকে রেখেছি, আমার সঙ্গে কাজ করে।’

‘তুমি থাকো যন্ত্রটার সঙ্গে?’

‘আমি ঠিক সাগরখাঁড়িতে থাকি না, আমি থাকি সাগরের বুকে ছোট্ট একটা দ্বীপে। দিনের শেষে নৌকোয় চলে যাই।’

‘সেই দ্বীপে তোমার বাড়ি?’

‘গাছের ওপর কাঠের বাড়ি। আমিই বানিয়েছি। আমার কী মনে হয় জানো? ওটাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি। প্যাঁচা-পাখি, জোনাকি-কাঠবিড়ালি, কয়েকটা ইঁদুর-খরগোস ছাড়া ওই দ্বীপে আর কেউ থাকে না। জোয়ারে দ্বীপে জল উঠে যায় বলে ঘরে যাবার বাঁশের সিঁড়ি গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখি। জোছনায় দ্বীপটা কী যে অদ্ভুত সুন্দর দেখায় তুমি ভাবতে পারবে না।’

নন্দিনী তন্ময় হয়ে শুনছিল। একসময় বলল, ‘এত সুন্দর বাড়ি ছেড়ে বাঁশবনের এই বাদুড়-চামচিকের বাসায় তুমি আসো কেন?’

‘তোমার জন্যে। না হলে কবেই আমি বালিসোনা ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যেতাম। বাবার কাছে শুনেছি বালিসোনার যারা আসল মানুষ তারা অনেকেই আর নেই।’

শৈশবে মাতৃহীন দিবাকর শহরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় বাবার অকাল মৃত্যুতে পড়া শেষ করতে পারেনি। কয়েকটা ছোটখাটো ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় কাজ করে সুখ হল না। তারপর তাদের বাঁশবনের বাড়িতে থেকে কচুরিপানা থেকে খুব হালকা কৌটো বাক্স টেবিল চেয়ারের ব্লক তৈরির মেশিন বানিয়ে ভালোই জীবিকা নির্বাহ করছিল। কাছে দূরে অনেক গ্রামেই চাষি-তাঁতি পরিবারের ভবিষ্যতহীন যুবকেরা তার মেশিন কিনে কচুরিপানার ব্লক তৈরির দোকান করে দাঁড়িয়ে গেছে। এই সময় সে রাসমাঠের রথের মেলায় হঠাৎই একদিন নন্দিনীকে দেখল। তারপর থেকে ঘুমে-জাগরণে বারবার তাদের দেখা হয়। যতদিন না দেওয়ালে, গাছের গুঁড়িতে ‘বাঁশবনের শেয়াল রাজা/কচুরিপানা খায় ভাজা’, ‘দিবাকর নন্দিনীর সনে/ভালুক যেমন কাশের বনে’ দেখা গেল এবং তাকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করা হল, ততদিন দুজনের দেখা হওয়াই ছিল দুজনের দিনরাত্রির তাড়না।

ছ’মাসের মধ্যেই বালিসোনার বিভিন্ন দোকান মারফৎ ‘দিবাকর ডিহাইড্রেটেড চিংড়ি’র নানা মাপের প্যাকেট অনেকের বাড়িতেই তারিফ পাওয়ার খবর শুনে সে আবার বালিসোনায় আনাগোনা শুরু করেছে।

রেললাইনের পাশের নিচু পথ বেয়ে মাথার ওপর মৌমাছির ঝাঁক নিয়ে সাইকেলে মোহন মউলেকে আসতে দেখে তাদের তন্ময়তা ভেঙে গেল। কতক্ষণ দুজনের কেউই মুখে কিছু না বলে মনে মনে কথা বলে যাচ্ছিল কারওই খেয়াল নেই। মোহন মউলের দৃষ্টির সামনে থেকে সরে যাবার আর উপায় নেই, দিবাকরই উঠে দাঁড়িয়ে তাকে থামাল।

হ্যান্ডেল এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে পালাবার চেষ্টা করেও মোহন মাটিতে তার লম্বা পায়ের ভরে পতন সামলে অপ্রস্তুত হেসে ফেলে বড় এক শিশি মধু দিবাকরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘দু-চামোচ মধুতে আস্ত পাতিলেবুর রস মিশিয়ে তার মধ্যে তোমার চিংড়ি ভাজা ঘন্টাখানেক রেখে খেয়ে দেখো।’

‘তোমাকে আমি টাকার তাগাদা দিতে থামাইনি। ও-মধু তুমিই রেখে দাও। মেশিনটা শুধু ফেরত পেলেই হবে। লিওনদাদা দেখতে চেয়েছেন। কচুরিপানার কাজে তুমি যখন জুৎ করতে পারোনি, তখন ও-মেশিন রেখে তোমার লাভ কী? খামোখা দেনা মাথায় দিন কাটাবে কেন! এই, তোমার মাছি সামলাও!’

নন্দিনী দুহাতে মুখ ঢাকল- ‘আমার দিকে আসবে না তো?’

‘ভয় নেই। কালই লিওনকত্তাবাবুর বাড়িতে মেশিনটা আমি দিয়ে আসব।’

‘তার আগে আমার কাছে আনবে, ওটা আরও একটু ইমপ্রুভ করব। আরও এফেকটিভ।’

‘কী করবে?’

‘আরও ভালো। আরও কাজের করতে পারব। পরে হয়তো এই মেশিনকে আরও শক্তিশালী করে পাটকাঠির বড় বড় ব্লক তৈরির উপযুক্তও করা যাবে।’

পরের বার বালিসোনায় এসে দিবাকর তার উন্নত যন্ত্র লিওনার্দোকে দেখাল। নতুন যোগ করা অংশ-দুটোর কাজও বুঝিয়ে দেল।

লিওন অনেকক্ষণ ধরে দেখে বলল, ‘তোমার যন্ত্রের কল্পনা ও কারিগরি বিস্ময়কর। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে তুমি আরও অনেক নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন করবে। আমি তোমাকে কোনওভাবে সাহায্য করতে পারি কি?’

‘নন্দিনীকে আমার জীবনে জুড়তে পারলে বড় ভালো হয়। একই যন্ত্রের দুটো পার্টস যেন আলাদা হয়ে আছে। জোড়া লাগলে জোর বাড়ে।’

লিওন হেসে ফেলল, ‘তার মানে তোমার মনোযন্ত্রটি আরও ক্রিয়াশীল হবে, তাই তো? আমার উপদেশ, তোমরা দুজনে একসঙ্গে সরোজিনীর কাছে যাও। তাঁকে সব বলো।’

বিকেলে দিল্লি থেকে প্রদীপের পাঠানো নতুন বইয়ের পার্সেল খুলে সরোজিনী প্রথমেই পিঁপড়ের বোধবুদ্ধি ও অনুমানশক্তির বিষয়ে মোটা বইটা নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছে, ঠিক সেইসময় নন্দিনী ঘরে ঢুকে বলল, ‘রাঙাজেঠি, তুমি কি খুব ব্যস্ত এখন?’

‘খুব একটা না। কী বলবি, বল না।’

‘দিবাকরকে বাইরে দাঁড় করিয়ে এসেছি। তোমার সঙ্গে একবার কথা বলতে চায়।’

‘এখানেই নিয়ে আয়।’

দিবাকর ঘরে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে করজোড়ে সরোজিনীকে নমস্কার করে বলল, ‘আমার মনের একটা কথা আপনাকে বলব, কত্তামা?’ সরোজিনীর হাতের বইটার মলাটে পিঁপড়ের ছবিতে চোখ পড়ায় আবার বলল, ‘ছোট্ট একটা পিঁপড়ের ভেতর কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম যন্ত্র, ভেবে অবাক হয়ে যাই।’

‘তোমার কি আবার নতুন কোনও যন্ত্র মাথায় এল নাকি? বলো, শুনি।’

‘আমার কোনও যন্ত্রের কল্পনাই আসছে না আর।’

‘আবার বালিসোনায় আসছো বলে কেউ কিছু বলেছে নাকি? লোকে তো এখন তোমার শুখা চিংড়ির প্রশংসাই করে।’

‘আমার কথা লিওনদাদাকে সব বলেছি। আপনি যদি, কত্তামা, ওনার কাছে শুনে একটা বিধান দেন তাহলে হয়তো আবার আমার মনোযন্ত্র সচল হয়ে নতুন নতুন যন্ত্রের কল্পনায় মাততে পারে।’

‘এবার বুঝলাম। কিন্তু দিবা আর নিশি দুটো আলাদা সময়, তাদের মেলাবার শক্তি কি আমার আছে?’

শুখা চিংড়ির পর থেকে সরোজিনী নন্দিনীকে মাঝে মাঝে দিবাকরের সঙ্গে মিলিয়ে ‘নিশি’ বলে।

সরোজিনী, লিওন, লক্ষ্মী, অম্বরীশ, মিতা, পরীক্ষিৎ সকলেই দিবা-নিশির বিয়েতে একমত হয়ে, প্রদীপ ও সরস্বতীকে চিঠি লেখে। মেজো সেজো ন-ভাইদের মতামত চায়। একজনের কোনও মতামতই নেই, আরেকজনের ঘোর অমত, কন্যার বাবা অধিকাংশের মতে অগত্যা মত দিল। সরোজিনীকে মনে হয় সে-ই বিয়ের পুরোহিত, আর লিওন যেন একইসঙ্গে বর ও কন্যা কর্তা।

বালিসোনার বাঁশবনে বসেই দিবাকর উভচর সাইকেল উদ্ভাবনায় মন লাগাল। তার কল্পনার সাইকেল মাটিতেও চলবে, দরকারে আকাশেও উড়বে।

এগারো দিনের চেষ্টায় দিবাকরের সাইকেল যখন মাত্র দু’ফুট দূরত্ব উড়তে পেরেছে, মসৃণভাবে নামিয়ে আনার মেকানিজম তখনও অধরা, নিজের সাইকেল চালিয়ে সুখবর দিতে এসে লিওন দিবাকরের এই অদ্ভুত যানটি খুঁটিয়ে দেখে বলল, ‘একি পক্ষিরাজ-সাইকেল নাকি? আগে কোথাও তুমি দেখেছ?’

‘স্বপ্নে দেখেছি।’

‘উড়বে কবে মনে করছ?’

‘ফড়িংয়ের ফিনফিনে পাখনা আর লেজের আনুপাতিক দৈর্ঘে্যর রহস্য পুরোপুরি ভেদ করতে পারলেই অনেকটা এগিয়ে যাব।’

‘তোমার মনোযন্ত্রের উপযুক্ত পার্টসও এবার পেয়ে যাচ্ছ! জানো কি- তোমাদের আকাÉায় সকলের সম্মতি মিলেছে?’

‘এবার তবে পক্ষিরাজই বানাব!’

দিবাকর সাইকেলের সব পার্টস খুলে ফেলে আবার নতুন করে শুরু করার কথা ভাবতে বসল।

১৭

‘বালিসোনায় অচেনা মানুষের ভিড় যত বাড়ছে, চেনা পাখিও তত কমছে। ঘর-বাড়ি যত বাড়ছে, গাছপালাও তত কমছে। রাতের আকাশে হয়তো তারাও আর তত দেখা যায় না।’ পূর্ণিমার আগের দিন জ্যোৎস্নার সূচনায় নির্জন রেললাইন ধরে দুজনে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পরীক্ষিৎ বলে যাচ্ছে, তিকান চুপ করে শুনছে।

অনেক পরে ফেরার পথে, চাঁদ যখন পূর্ণিমার মতো জ্বলছে, তিকানের গলা শোনা গেল- ‘ঠিক কী তুমি করতে চাও? বিয়ে করে আর পাঁচজনের মতো সংসার করার কথা কখনও ভাবো কি?’ একটু থেমে আবার, ‘দিবাকরদের মতো, চলো না, আমরাও রাঙাজ্যাঠাইমার কাছে যাই।’

‘তুমি গেলে জ্যাঠাইমা খুশিই হবেন। তোমার কীর্তন শুনতে উনি খুব ভালোবাসেন। হয়তো একটা গাইয়েই ছাড়বেন। তবে কী জানো, ওদের বিয়েতে পারিবারিক বাধা ছিল। আমাদের তো কোনওরকম বাধা নেই।’

‘বাধা এলে তুমিই সে বাধা ভাঙবে। বাধা নেই বলেই আমার ভয়। বললে না- আকাশে আর তত তারা ফোটে না? এরপর হয়তো বলবে জ্যোৎস্নাও আর তত আলো দেয় না। একদিন বলবে তিকান আর তত তিকান নেই।’

তার চোখের জলে জ্যোৎস্না চিক চিক করছে।

নিঃশব্দে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তিকানের কানের কাছে মুখ নামিয়ে পরীক্ষিৎ মৃদুস্বরে বলল, ‘জ্যোৎস্নালাগা চোখের জলে, দুঃখ খুঁজব সেই অতলে!’

‘জগতের সবার দুঃখের তল তুমি পাবে, আমার দুঃখ তুমি কোনওদিনই বুঝবে না।’ একটু থেমে, আবার, ‘আমার সামনে অন্য বিপদও আছে।’

‘আমাকে বলোনি কেন? বলো কী বিপদ? বলো আমাকে।’

পরীক্ষিতের একটা হাত টেনে নিয়ে তিকান মৃদু হেসে বলল, ‘তোমাকে বলা আর নদীর জলে একটা বটের ছায়াকে বলা একই। তুমি বুঝবে না।’

‘বুঝব না? দূর আকাশে চিল দেখলে, চিবুক-ঘেঁষা তিল দেখলে, গাড়িভরতি মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ব হঠাৎ-’

পরীক্ষিতের উচ্ছ্বসিত স্বর শুনেও অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিকান আবার বলল, ‘বাবার মুখের দিকে আর তাকাতে পারি না। জেল থেকে ফেরার পরও তাঁর স্বাস্থ্য দেখে অবাক হয়েছি। আগের মতোই সেই তেজি গলা, দ্রুত হাঁটা, মেরুদণ্ড সব সময় সোজা। অথচ এই কয়েকটা বছরে বাবা বুড়ো হয়ে গেলেন। পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক আগেই ত্যাগ করেছিলেন, এখন সঙ্গী শুধু হতাশা, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা। আর একটা লক্ষণ নতুন দেখছি, সব কিছুই ভীষণরকম ভুলে যাচ্ছেন। চেনা-জানাদেরও সেভাবে চিনতে পারেন না।’

কথার মধ্যেই ব্রতীন দূর থেকে ছুটতে ছুটতে এসে পরীক্ষিৎকে ধরে ফেলল, ‘কোথায় না কোথায় খুঁজে বেড়াচ্ছি, এক্ষুনি চলো, সবাই তোমার অপেক্ষায় বসে আছে। ছোট কত্তাবাবুর দেহের লোমকূপ দিয়ে বিজবিজে ঘামের মতো রক্ত বেরচ্ছে! কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না।’

কাল রাত থেকেই নাকি এরকম হচ্ছে। অম্বরীশ কাউকে জানায়নি। তোয়ালে দিয়ে মুছে নেবার পরও সারা শরীর আবার শিশিরের মতো রক্তে ভিজে যাচ্ছে।

সকলেই অম্বরীশের ঘরে জমায়েত হয়ে পরীক্ষিতের অপেক্ষা করছিল। শুধু লিওন গেছে ডাক্তার ধরে আনতে। ওদিকে কলকাতার বড় হাসপাতালে নিয়ে যাবার তোড়জোড়ও চলছে।

লিওনের সঙ্গে বালিসোনার বিখ্যাত ডাঃ ভদ্র ঘরে ঢুকেই অম্বরীশের চোখের পাতা টেনে নামিয়ে একপলক দেখে রোগীর বুকের ওপর থেকে তোয়ালে সরিয়ে ঝুঁকে পড়ল।

‘ব্লাড সিপেজ কতক্ষণ চলছে? প্রথম কখন জানা গেল?’

অম্বরীশ নির্বাক চোখ মেলে শূন্য দৃষ্টিতে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছে। মনে হয় তন্ময় হয়ে কিছু ভাবছে।

‘জ্বালা বা চুলকুনি বা কোনওরকম ব্যথা আছে?’

অম্বরীশকে এবারও নিরুত্তর দেখে মিতা বলল, ‘উনি নিজে কিছু বলেননি, আমাকেও জানাননি। কিন্তু তোয়ালের দু-পিঠেই প্রচুর শুকনো ও ভিজে রক্ত দেখে মনে হচ্ছে কাল রাত থেকে শুরু হয়েছে। রাতে সেই যে শুলেন, তারপর আর একবারও ওঠেননি। উঠলে আমি জানতে পারতাম। বাথরুমে যাবার দরজাই উনি নিজের হাতে খুলতে পারেন না।’

ডাক্তার আরও কয়েকটি জিনিস পর্যবেক্ষণ করে সরাসরি মিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনও কারণে খুব কি ভয় পেয়েছেন?’

‘ভয় কিনা জানি না, তবে ইদানিং প্রায় রোজই দেখছি রাতে ঘুমের মধ্যে ওঁকে বোবায় ধরছে। একটানা গোঁ গোঁ শুনে জেগে গিয়ে বুকের ওপর জড়ো করে রাখা হাত দুটো ছাড়িয়ে দু-পাশে নামিয়ে দেবার পর বোবায় ধরা ছেড়ে যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার, কাল রাতে বেশ কয়েকবার ওঁকে বোবায় ধরেছিল। তখনও রক্ত আমার চোখে পড়েনি, হয়তো আমাকে দেখাতে চাননি।’

প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে ডাক্তার বললেন, ‘ওষুধে রক্ত বেরনো বন্ধ না হলে, কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কয়েকটা ক্লিনিক্যাল টেস্ট করতে হবে। কালকের দিনটা দেখে পরশু আমাকে খবর দেবেন।’

ওষুধের সঙ্গে টোটকাও চলল। সারা গায়ে গাঁদাপাতার রস, ঢোলকলমির রস পাল্টাপাল্টি করে লাগিয়েও ঘামের মতো রক্তোচ্ছ্বাস একটুও বন্ধ হল না।

পরীক্ষিৎ সারা রাত বাবার বিছানার পাশে বসে ফটকিরি দেওয়া জলে তোয়ালে ভিজিয়ে বার বার তার গা-হাত-পা মুছিয়ে দিল।

প্রথমদিনই সে হাসপাতালের গাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছিল, এবার একদিনের জায়গায় তিনদিনেও রোগের সামান্য উপশম হল না দেখে যখন কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া স্থির, তখনও পরীক্ষিৎ সবাইকে নিরস্ত করল। তার যুক্তি, বাদা ছেড়ে দূরে গেলে বাবা বাঁচবেন না।

উদ্বেগে দুশ্চিন্তায় দিনে দিনে মিতার কথা কমে আসছে। গলার স্বরও ক্রমশ আরও মৃদু। পরীক্ষিৎ শুনতে পায়, মিতা বলছে, ‘বাদা থেকেই একটা কুবাতাস বইছে।’

কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা এসেও রোমকূপ থেকে বিন্দুবিন্দু ঘামের মতো রক্ত ফুটে বেরনো বন্ধ করতে পারলেন না। নামকরা এক ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শে লোশনে ভিজিয়ে গজ দিয়ে অম্বরীশের আপাদমস্তক জড়িয়ে দেওয়া হল। মিতা আর একজন নার্স মিলে দিনে বেশ কয়েকবার ব্যান্ডেজ বদলে দিলেও গজ আবার নতুন করে রক্তে ভিজে যায়।

ভোরের বাতাসে জানলা দিয়ে ভেসে আসা স্বর্ণচাঁপার গন্ধ চিনতে পেরে অম্বরীশ দুর্বল গলায় বলল, ‘বাদায় স্বর্ণচাঁপার গাছও হতে পারে।’

রাতের নার্সের সঙ্গে দিনের নার্সের ডিউটি-বদলের সময় হঠাৎ কথাটা শুনে দুজনে চোখাচোখি করল। শেষ রাতে বদলানো গজও রক্তে ভেজা। মিতার সাহায্য নিয়ে দুই নার্স অম্বরীশকে বার বার এপাশ-ওপাশ করিয়ে তার সারা শরীর তিন-চার ফেরতা গজ দিয়ে মুড়ে দিল।

সরোজিনীর সঙ্গে পরীক্ষিৎ ঘরে ঢোকা মাত্র তার মন বিষাদে ভরে যায়। ঠিক একটা মমির মতো দেখাচ্ছে তার বাবাকে!

রাত গভীর হলে অম্বরীশকে ঘুমোতে দেখে নার্সও ঘুমোয়। অম্বরীশ তখনই আবার জেগে ওঠে। অপেক্ষা করে, ঝুল বারান্দায় কখন কংকালদের লাফিয়ে নামার শব্দ হবে। বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে হল না, নিয়মমতো সাত কংকাল ঘরে ঢুকে এলে সেও অভ্যাসমতো বার্মা টিকের বেঞ্চি এগিয়ে দিল।

অনেকদিন পর আবার তারা একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে কথাবার্তা শুরু করল। ‘মাটির বিষয়ে আপনি কতটুকু কী জানেন কত্তা?’ বলে তারা অম্বরীশের উত্তরের অপেক্ষায় বসে বসে পা নাচাতে লাগল।

অম্বরীশ অনেক ভেবে উত্তর দিল, ‘মাটির নীচে ধনসম্পদ, ওপরে চাষবাস।’

‘ভুল কথা। মাটির নীচে মানুষের হাড়গোড়, ওপরে মাটির জন্যি মারামারি। রোজই খাতি-নাতি বেলা যায় বলে জীবনকালে কথাটা কেউ বুঝতি চায় না। মাটির সার কথাটা কী জানেন কত্তা? তার এক মুঠোও কেউ ওপারে নে যাতি পারে না। এক মুঠো কী কই কত্তা, এক কণা মাটিও নিজের বলি সঙ্গে নিতি পারে না।’ আবার চুপচাপ খানিকক্ষণ পা নাচিয়ে, ‘প্রমাণ দেখতি চান কত্তা? তালি এট্টু কষ্ট করে আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতি হবে।’

সকলে মিলে অম্বরীশকে দাঁড় করিয়ে দিল- ‘এট্টু পা চাল্যে চলুন কত্তা, নিজ-চোখেই প্রমাণ দেখতি পাবেন।’

সাত কংকাল তার বুকে চেপে বসছে না দেখে অম্বরীশের ভয় কেটে যায়, গলায়ও অনেকটা জোর পাচ্ছে, নির্দ্বিধায় বলল, ‘যাব যে, আমি তো ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারি না!’

‘আমাদের দুজনের ঘাড়ে আপনার দুই বগল চেপে আমাদের ওপর ভর দিয়ে চলুন, এট্টু খরখর যেতি হবে।’

এভাবে হাঁটতে তার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। মেদ-মাংস ঝরে গিয়ে শরীরও এখন অনেক হালকা।

অম্বরীশের আরোগ্যের সব আশা মিথ্যে হয়ে যেতে দেখে মিতাকে এখন আর এ ঘরে রাত জাগতে দেওয়া হয় না, খুব ভোরে এসে অম্বরীশের খবর নিতে এসে শূন্য বিছানা দেখে সে চিৎকার করে উঠল। দূরে ঘরের কোণে চেয়ারে ধরফড় করে জেগে উঠে নার্স এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করে। অনেক দিন থেকেই উঠে বাথরুমে যাবার ক্ষমতা নেই, সবসময় তাকে বেডপ্যান দেওয়া হয় জেনেও সে বাথরুমের ভেতরটা দেখে এল। সবাই মিলে বাড়ির সব ঘর-বারান্দা খোঁজা হল, অম্বরীশ কোথাও নেই। নার্স ভেবে পায় না, ঘর, বারান্দা আর বাইরের গেটের দরজা উনি খুললেন কী করে?

নানা দলে ভাগ হয়ে চারদিকে খোঁজাখুঁজি করতে করতে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষিৎই প্রথম তার বাবাকে দেখতে পেল। বাদায় যেখানে নতুন খোঁড়া মাটির ছোট একটা ঢিবি আছে, সেই ঢিবিতে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় জ্ঞানহীন অম্বরীশ যেন শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। শরীরের ব্যান্ডেজ গোলাপের পাঁপড়ির মতো হালকা রঙে ছোপানো।

গ্রামীণ হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে তাকে প্রথমে সেখানেই নেওয়া হল। ধুলোকাদা পরিষ্কার করে নতুন করে ব্যান্ডেজে আপাদমস্তক মুড়ে তাকে নিজের ঘরে ফিরিয়ে আনতে বিকেল হয়ে গেল। সকলেরই প্রশ্ন, বাদায় অম্বরীশ এল কী করে? এ কি ঝম্পটির ছেলেদের কাজ?

জ্ঞান ফিরলেও অম্বরীশ আগের মতো দুয়েকটা কথাও আর বলে না। তার চোখ কোটরে, গালে মাংস নেই, ব্যান্ডেজ বদলাবার সময় চামড়ার নীচে হাড় গোনা যায়।

একদিন বিকেলে অবনীর গলা শুনে, অম্বরীশের ঘুম ভেঙে গেল। অবনী তার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘তোর এ কী চেহারা হয়েছে! কোথায় তোর কষ্ট আমাকে বল।’

চোখ খুলে দেখে সত্যিই অবনী। মুখ রোদে পুড়ে তামাটে, মাথার চুল ছাইরঙা।

অনেক কাল পর অম্বরীশ মনের মধ্যে আরাম বোধ করল। অদ্ভুত একটা আশায় সে তার ব্যান্ডেজ বাঁধা ডান হাত অবনীর দিকে বাড়িয়ে দিল। গজ খুলে হাতের রক্তখচিত রোমকূপ খুঁটিয়ে দেখে সেদিনই রাতে বিছানার পাশে বসে অবনী তাকে এক ডোজ হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাইয়ে দেয়। অম্বরীশ অতি কষ্টে তার হাত ধরে থেকে বলল, ‘আগে যেদিন এসেছিলি, তোর লম্বা চুলদাড়ি দেখেছিলাম, আমাকে ওষুধ দিবি বলেও না দিয়ে চলে গেলি। অনেক খুঁজেছিলাম তোকে। কেউ নাকি তোকে দেখেনি। কে জানে হয়তো স্বপ্ন দেখেছি।’

প্রায় চিঁচি করে কথা বলছে। অবনী বলল, ‘তোর স্বপ্নেই এসেছিলাম।’

অনেকদিন পর অম্বরীশ অনেক কথা বলতে চায়। গলার স্বর প্রায় শোনা যায় না, মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে বুঝতে হয়। ‘ছোড়দা, তোর সেই লম্বা চুলদাড়ি কেটে ফেলেছিস? তুই কি সন্ন্যাস ত্যাগ করে এসেছিস?’

‘সন্ন্যাসী আর হলাম কই! হব বলেই বাড়ি ছেড়েছিলাম। তারপর অনেক ঘুরেও মনের মতো গুরু পেলাম না, ফলে সন্ন্যাসী হওয়া আমার হল না। হলাম ভবঘুরে। ভারতের পথে পথে মানুষের কত যে দুঃখ-দুর্দশা দেখলাম, একজীবনে বলে শেষ করা যায় না।’

অবনী সত্যিই ফিরে এসেছে খবর পেয়ে স্কুলের স্পেশ্যাল ক্লাস শেষ করে হোস্টেলের দিকে না গিয়ে সরোজিনী বাড়ি ফিরে এল। অবনীমোহনকে নিজের ঘরে ডেকে এনে তার একটা হাত হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। মাঝে মাঝে চোখ তুলে অবনীর বদলে যাওয়া মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

পরীক্ষিৎ ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাঙাজ্যাঠাইমাকে এভাবে আগে কখনও দেখেনি। অবাক হয়ে কিছু বলবার আগেই সরোজিনী বলল, ‘আয়, কাছে আয়। জ্যাঠার সামনে এসে বোস।’

‘এ তো যৌবনের অম্বরীশ! হুবহু সেই মুখ। তোমার মাকে একবার ডাকো তো বাবা।’

‘আপনিই আমার সেই সন্ন্যাসী জ্যাঠা? বাবার কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি।’

‘সন্ন্যাসী না রে, পর্যটক। পদযাত্রী। কখনও দুপায়ে, কখনও দুচাকায়, কখনও রেলে-বাসে, বিশাল এই ভারত ঘুরে বেড়িয়েছি।’

‘আপনার কাছে আমি আপনার ভারত দর্শনের কথা শুনতে চাই।’

মিতা স্কুলে খবর পেয়ে ঝড়ের মধ্যে কুটোর মতো উড়ে এসে বলে উঠল, ‘দাদা, আপনি আমাদের বাঁচান। আমাদের মাথার ওপর কেউ নেই। দিদিই শুধু তার সর্বশক্তি দিয়ে যেটুকু পারছেন সবাইকে আগলে রেখেছেন।’

‘অম্বরীশকে আমি ওষুধ দিয়েছি। ধৈর্য ধরো।’

অবনীমোহনের আশ্চর্যজনক প্রত্যাবর্তনের খবর সকলের কাছে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। লক্ষ্মী লিওন মেয়েকে নিয়ে সে রাতে আর নিজেদের বাড়ি ফিরল না। সরস্বতীপ্রতিমা ও প্রদীপও শিগগিরই এসে পড়বে, তাদের টেলিগ্রাম করা হয়েছে।

১৮

বাবুইপাখি যেভাবে জোনাকি ধরে, দিবাকর চেষ্টা করে দেখেছে মানুষের পক্ষে সেভাবে জোনাকি ধরা সম্ভব নয়। বিয়ের তৃতীয় সপ্তাহে দিবাকর একদিন তাদের গাছবাড়িতে সন্ধে থেকে বহু কসরৎ করে তিনটি জোনাকি পোকা ধরে শুতে যাবার আগে মাথার কাছেই মাটির মালসায় একদলা কাদার মধ্যে গুঁজে দিয়ে কেরোসিনের লম্ভ এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিল। দপ করে জ্বলে ওঠা জোনাকির নরম আলোয় দুজনে দুজনের মুখ দেখে ছেলেমানুষের মতো খুশি। পরের মুহূর্তেই অন্ধকার, সেও ভারি খুশির ব্যাপার। দুয়েক মুহূর্ত দেখে নিয়ে নন্দিনী বলল, ‘পুজো প্যান্ডেলে টুনি বাল্বের মতো কীরম জ্বলছে-নিভছে, রোজ এমন করা যায় না?’

‘রোজ এর’ম গঙ্গাযমুনা হলে রোজই তোমায় আমি ঘরের মধ্যে একসঙ্গে অমাবস্যা-পুন্মিমে দেখাব।’

আরেকদিন মালসার মধ্যে কাদায় জোনাকির মাথা গুঁজে রেখেও কেরোসিনের আলো না নিভিয়ে বিছানায় গিয়ে দিবাকর নন্দিনীকে বলল, ‘তোমার সৃষ্টিযন্ত্র ভালো করে দেখবার আমার বড় সাধ।’

‘ছিঃ!’

‘ছি কেন? ভগবান কত বড় কারিগর ভাবো তো! তার হাতের কাজ দেখতে ইচ্ছে হয় না?’

উভচর সাইকেলের কাজ যত এগোয় নন্দিনীর প্রতি দিবাকরের আবেগ তত উথলে ওঠে। একদিন রাতে শুতে এসে বলল, ‘শিবলিঙ্গ আসলে কী তুমি জানো? যোনিপটে লিঙ্গ স্থাপন। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার প্রতীকী যন্ত্র।’

‘ভারি অসভ্য তুমি!’

কথাটা হয় শুনতে পায়নি, নয় তো গায়ে মাখেনি, খানিকক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকার পর দিবাকর আবার বলল, ‘তোমার পট আমি দেখেছি। অনেকটা অপরাজিতা ফুলের মতো।’

দুম দুম করে দিবাকরের বুকে পিঠে কিল মারতে মারতে নন্দিনী বলল, ‘অসভ্য, অসভ্য, অসভ্য! ভীষণ অসভ্য তুমি!’

গাছবাড়িতে যতক্ষণ দুজনে একসঙ্গে থাকে ততক্ষণ তাদের আনন্দের সীমা থাকে না। একা থাকতে নন্দিনীর খুব ভয়। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-নামতেও সাহস পায় না। জোয়ারে যখন দ্বীপ ডুবে যায় তখন দিবাকরকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করে না।

শুখা চিংড়ির ব্যাপারে বা বাঁশবনের বাড়িতে উভচর সাইকেল তৈরির কাজে যখনই দিবাকরকে বালিসোনা যেতে হয়, নন্দিনীকে সঙ্গে নিতে হয়। দ্বীপ থেকে নৌকোয় ডাঙায় আসা, সেখান থেকে কাজের তদারকি সেরে বাসে নদীতীর, তারপর নদী পেরনো, তারপর আবার বাস, তারপর ট্রেন- ভোরে রওনা হয়ে বালিসোনায় পৌঁছতে দিনের আলো মুছে যায়। প্রত্যেক যানবদলের জায়গায় অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে দিবাকর নন্দিনীকে বলে, ‘আমার সাইকেল ঠিকমতো হয়ে গেলে সাইকেলেই নদীর ওপর দিয়ে উড়ে যাব।’

অবনীমোহনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের পর নন্দিনীকে চৌধুরীবাড়িতে রেখে দিবাকর কিছুদিন একাই তার গাছবাড়ি থেকে বালিসোনা থেকে যাতায়াত করে।

যেদিনই বালিসোনায় আসে চৌধুরীবাড়ি একবার ঘুরে যাবেই। নন্দিনীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটানো ছাড়াও অবনীমোহনের কাছেও তার একটা প্রশ্ন আছে।

নন্দিনীই তাকে বাড়ির আর সকলের সঙ্গে বসিয়ে দেয়। সেখানে লিওনের সঙ্গেও প্রায়ই দেখা হয়। একদিন লিওন অবনীমোহনকে তার উভচর সাইকেলের কথা বলল- ‘আমাদের এই ব্রাদার-ইন-ল আকাশে-মাটিতে চলবার মতো একটা সাইকেল বানাচ্ছে।’

দিবাকরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে লিওনের দিকে তাকিয়ে অবনী বলল, ‘আমাদের দরকার আসলে নতুন চিন্তা, নতুন কল্পনা। যে বালিসোনা আমি ছেড়ে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে সেই বালিসোনাকে আর খুঁজে পেলাম না। অম্বরীশের পায়ের ক্ষত দেখলেই বোঝা যায় বালিসোনায় পচন কতদূর ছড়িয়েছে। আগে এখানে কত দেয়ালপত্রিকা দেখতাম। তরুণরা কবিতা লিখত, রাগের কথা লিখত, প্রেমের কথা লিখত, সুখ-দুঃখের কথা লিখত।’

‘শিবকৃষ্ণবাবুও একজন কবি ছিলেন, যৌবনে তাঁর বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল। দেওঘরের বাড়ি বিক্রির সময় উইয়ে কাটা কয়েকটা কবিতা সঙ্গে এনেছিলেন।’

মিতার কাছে এ তথ্য শুনে সরোজিনী যোগ করে, ‘বালিসোনায় তখন আরও কেউ কেউ কবিতা লিখতেন, তাঁদেরই কেউ কবিতায় লম্বা লম্বা চিঠি লিখতেন আমাকে। কবির নাম থাকত না।’

ফিরে আসার পর এই প্রথম অবনীর মুখে হাসি দেখা গেল- ‘আমাদের সংসারে তখন তোমার ওপর এমন অবিচার অত্যাচার চলত, ভয়ে নামটা আর লিখতাম না।’

‘তুমি! তুমি লিখতে ওসব!’

দিবাকর হঠাৎ বলে উঠল, ‘রাস্তায় চলে, আকাশেও ওড়ে এমন কোনও বাহন কোথাও আপনি দেখেছেন?’

কোনও উত্তর না দিয়ে অস্বস্তিকর দীর্ঘ নীরবতার পর অবনী দুচোখ বুজে দূরাগত স্বরে বলল, ‘যন্ত্র না, মন্ত্র খুঁজি আমি। বালিসোনায় ফিরে দেখছি হাত থেকে পড়ে যাওয়া মহার্ঘ গ্লাস-পেইনটিঙের মতো মানুষের সব মূল্যবোধ ভেঙে চুরমার, হালভাঙা মাঝির মতো তারা দিশাহারা।’

‘বিজ্ঞানের এত উন্নতি, এমন নিত্যনতুন আবিষ্কারের সুফল সকলের জীবনে সহজলভ্য হলেই কি সমাজেরও উন্নতি হবে না?’

চোখ বোজাই রইল। লিওনের প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া গেল না।

সবাই চলে গেছে, ঘরে শুধু লিওন একা। অবনীর মুখের দিকে চেয়ে বসে আছে।

ক্রাচের শব্দে চোখ খুলে অম্বরীশকে দেখে, কিন্তু লিওনের চোখে চোখ রেখে অবনী বলল, ‘বিজ্ঞান শুধুই প্রযুক্তি নয়, বাবা। জাপানে জার্মানিতে আমেরিকায় টেকনোলজির ঝোড়ো বিকাশ দেখছ তো? মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে গেছে, মন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। ধর্ম ও দর্শনের মতোই বিজ্ঞানও জগৎ ও জীবনের সত্য খোঁজে, অর্থ বুঝতে চায়। এ যেন দুটো নদী অনেক দূর অবধি আলাদা বয়ে মহাসাগরে গিয়ে মিশে যায়।’

অবনীর ওষুধে রোমকূপ থেকে রক্ত বেরনো সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়াকে অম্বরীশ অলৌকিক ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। সেই থেকে সে অবনীকে দৈব ক্ষমতার অধিকারী আধ্যাত্মিক পুরুষ রূপে দেখে। বরাবরের মতো এখন আর তার ছোড়দাকে তুই-তোকারি করে কথা বলতে পারে না। তার আশা, গ্যাংগ্রিন হয়ে যাওয়া তার পায়ের ক্ষতও একদিন অবনী সারিয়ে দেবে। ক্ষতের জন্য অবনী তাকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ায়, কিন্তু আরোগ্যের আশ্বাস দেয় না। হাঁটু ও উরুর ক্ষত সামলিয়ে চেয়ারে বসে অম্বরীশ বলল, ‘আমার মাথায় কী ঘুরছে জানো? বালিসোনার সবাইকে রাসমাঠে ডেকে এখানকার বিপদ-আপদ তুমি তাদের বোঝাও। এ থেকে উদ্ধারের উপায় বলে দাও।’

লিওন উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘খুব ভালো কথা। খুব ভালো আইডিয়া। আইডিয়ার বাংলা কী হবে? তবে, বেশির ভাগ বাঙালিকে ‘আইডিয়া’ই বলতে শুনেছি। বালিসোনার মানুষকে আপনার ভারতযাত্রার বিপুল অভিজ্ঞতার কথাও বলবেন।’

সমর্থন পেয়ে অম্বরীশ আরও বলল, ‘বালিসোনার অবস্থা ভাবতে পারবে না। বোমা এখন কটেজ ইন্ডাস্ট্রির মতো, ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে। যৌবনে আমিও কিছু কিছু পাপ করেছি। পরে অনুতাপও করেছি। এখন তো গোঁফ গজানোর বয়েস থেকেই ছেলেরা দাদাদের কাছে শয়তানির অ্যাপ্রেন্টিসশিপ শুরু করে। তোমার কথায় হয়তো বালিসোনার মানুষ আবার আগের মতো সরল আর দয়ালু হয়ে উঠবে। তোমারও কি তাই মনে হয় না, লিওন?’

‘মানুষের হৃদয় অত সহজে বদলাবার নয়। তাছাড়া বালিসোনায় এখন বহিরাগতই বেশি। তবে কিছু করতে হলে বাবাকেই করতে হবে। পারলে তিনিই পারবেন।’

বাড়ির পুবদিকের গোলাপজাম বাগানে অম্বরীশকে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে পারমিতাই প্রথম দেখতে পেল কোণের ঝোপঝাড়ের মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি টাঙিয়ে কয়েকজন বাসা বেঁধেছে। একটা প্লাস্টিকের চাদরের ওপর মাছধরার বড় জাল ছড়ানো। পাশেই খোলা আকাশের নীচে কাঠকুটো জ্বালিয়ে রান্নাও চলছে। তাদের কাছে যাবার আগে দুটি মেয়ে দৌড়ে এসে অম্বরীশের পায়ের সামনে দণ্ডীকাটার মতো উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। দুজনের বয়সই তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, দেখে মনে হয় এরা যমজ বোন, তাদের একজন উবু হয়ে বসে যা বলল তার মর্মার্থ এইরকম- বাদার পশ্চিমে মুসলমানপাড়ার সীমানায় তাদের বাড়ি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। মিতা জানতে চাইল- কে উচ্ছেদ করল, উচ্ছেদের কারণ কী?

দু’দেশের সীমান্ত পার হয়ে রোজই দলে দলে লোক ওপাড়ায় তাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের বাসায় ওঠে। কোত্থেকে কী করে তারা রেশনকার্ড করিয়ে এদেশের ছিটিজেন হয়ে যায় সেকথা তারাই জানে। মাথা গোঁজবার জায়গা হলেও পাড়ার মাত্র কয়েকটা পায়খানায় অত বাড়তি মানুষের চলে না, তারা অন্ধকার থাকতে উঠে দু’পাড়ার মাঝের অংশে মাঠ সারতে আসে। সে মাঠ ভরে গেলে তারা গাড়ুহাতে হিন্দুপাড়ার আরও ভেতরে ঢুকে পড়ে। এইভাবে তারা এগিয়ে আসতে থাকে। দুর্গন্ধের জন্য কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে পরদিন ভোররাতে তার উঠোনেই তারা বসে যাবে। দুই বোন আর তাদের জন্মান্ধ ভাই আরও কয়েকজনের সঙ্গে প্রতিবাদ করেছিল। পরদিন সকালে তাদের সকলের ঘরদোর উঠোন নরক হয়ে গিয়েছিল। রোজ এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দুই বোন স্থানীয় এম-এল-এ-র বাড়ি গিয়ে তাঁর চামচার কাছে নালিশ জানিয়ে ফিরছিল। পথে একদল ছেলে তাদের মারধর করে বাড়িতেই আর ফিরতে দেয়নি। এক বোন বলল, ‘আরও যারা তাড়া খেয়ে আপনাদের বাগানে ছাউনি করেছে, তাদের ঘরের ব্যাটাছেলেরা আজ লাঠি-সড়কি নিয়ে ঘর-দরজার দখলদার হটাতে গেছে।’ আরেক বোন বলল, ‘আপনারা আমাদের মা-বাপ, আপনাদের দয়াতেই বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে আমরা সুখে-দুঃখে এখানে বাস করছি। এখন এরা শুধু হেগেই আমাদের ভিটেছাড়া করেছে, এবার গ্রামছাড়া করবে।’

মিতার শিক্ষকসত্ত্বা জেগে ওঠে- ‘সব কিছুতে হিন্দু-মুসলমান দ্যাখো কেন? মানুষ-অমানুষ ভাবতে পারো না? অমানুষের কি ধর্ম থাকে?’

অম্বরীশের হাঁটুর জ্বালা বেড়ে গেছে, উরুর অসহ্য ঝিঁঝিঁ হুল ফোটাচ্ছে, দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণার কাঁপুনি সামলে জিজ্ঞেস করল, ‘থানায় জানিয়েছ?’

‘আমাদের বাপ নেই, সোয়ামী নেই, ঘরে ব্যাটাছেলে বলতে ওই এক ‘জন্মান্ধ’ ভাই, থানায় কে যাবে? আমাদের থানায় যাবার সাহস নেই।’

মিতা সহানুভূতি থেকে জানতে চাইল, ‘তোমাদের সোয়ামীরা কোথায়?’

‘আমাদের দুই বোনের একজনই সোয়ামী। এদিককার নদীতে মাছ না পেয়ে আসামের বেম্মপুত্তুরে সেই যে গেছে, তিন বছর হয়ে গেল আর খবর নেই।’ কথা বলল একজন, কথার শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একসঙ্গে দুজনই।

এক বোন ভাইকে নিয়ে রয়ে গেল, আরেক বোনকে সঙ্গে নিয়ে মিতা একাই থানায় ডায়রি করতে গিয়ে দেখে দুজন মাত্র কনস্টেবল বসে আছে।

মিতার মুখে সঙ্গের মেয়েটির লাঞ্ছনার বিবরণ শুনে, পুলিশের উত্তর- ‘যান, এবার নিজের বাড়ি ফিরে যান। ওই মুসলমানপাড়াতেই পুলিশ রেইড করতে গেছে। এখন আর তারা কিছু করতে সাহস পাবে না।’

মিতা জানতে চাইল, ‘যারা মার খেয়ে ঘর ছাড়া, তাদের অভিযোগ পেয়েই কি পুলিশ গেছে?’

‘অভিযোগ তো এই প্রথম আপনিই করলেন।’ নির্জন থানায় পুরুষসঙ্গীহীন দুই মহিলার উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে সে জানাল, ‘পুলিশ রেইড করছে স্মাগলারদের গ্যাং ধরতে। স্পেশ্যাল ফোর্সও সঙ্গে আছে।’

১৯

ঋতু আসে, ঋতু যায়। আকাশ-বাতাসের ভাষা বদলায়। স্বভাব বদলায়। প্রকৃতির স্পর্শ গায়ে এসে লেপটে যায়। বালিসোনার ভাগ্যাকাশের মেঘ পাথরের মতো, তার আর নড়চড় নেই।

পাউরুটি কারখানা বন্ধ, মাটি খোঁড়ার কাজ বন্ধ, শ্রমিকদের মধ্যে যারা আগে পুরসভার মেথর ছিল তারা কেউ কেউ হাসপাতালের মেথর বা স্কুলে বাজারে নার্সিং হোমে ঝাড়ুদার হয়ে গেল। তারা বেশির ভাগ রোজ বাদায় এসে অর্ধেক খোঁড়া মরা নদীর দুধারে সারি দিয়ে বসে থাকে। আবার কাজ শুরু হবার আশায় শুধু নলকূপের জল খেয়ে সারা দিন কাটিয়ে সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে যায়। যাবার আগে কোনওদিন গুজব শোনে, সবাইকে বাদার উঁচু অংশের জমিতে কলাচাষ করতে দেওয়া হবে। কোনও দিন রটে, বাস রাস্তার ধারে সারি সারি মুড়কি-বাতাসার দোকান করে দেওয়া হবে। আজকাল প্রচুর বাইরের গাড়ি আসে, সেসব গাড়ির যাত্রীরা যাতায়াতের পথে বালিসোনার বিখ্যাত বাতাসা কিনে নিয়ে যাবে। এ অঞ্চলের চিনির বাতাসা ও নলেনগুড়ের মুড়কির খুব খ্যাতি।

একদিন বাদা থেকে ঘরে ফেরার মুখে হঠাৎ জনা কুড়ি যুবক এসে শ্রমিকদের ঘিরে ধরল। তাদের চমকে দিয়ে জানতে চায়, ‘তোমরা কাজ চাও?’

কী কাজ? কোথায় কাজ? টাকা পাওয়া যাবে তো? মনে সন্দেহ, তবু কৌতূহলী দিনমজুররা প্রশ্ন না করে পারল না।

অচেনা যুবকদল জানাল- সকলেই কাজ পাবে। প্রথমে কিছুদিন ট্রেনিং, তখন বিনাপয়সায় তিনবেলা পেটপুরে খাওয়া, ট্রেনিং হয়ে গেলে থাকা-খাওয়া ছাড়াও মাস-মাস বেতন। অনেকটা আর্মির কাজের মতো।

শুনে তরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।খালিহাতে ঘরে ফিরে রোজই সেই একই হতাশা ও গালমন্দ। তার চেয়ে অজানা কাজের আশায় ভিন গাঁয়ে চলে যাওয়া ভালো!

সবাই বাদা পেরিয়ে, রেললাইন পেরিয়ে, বন পেরিয়ে যুবকদলের আদেশে এই প্রথম এক জায়গায় এসে থামল। যুবকদের চারজনের হাতে রিভলবার।

‘তোমাদের ভয় নেই। আমাদের কথা মতো চললে তোমাদের লাভই হবে।’

একজনের এই আশ্বাসবাণী শেষ হবার আগেই চারটি বাগানো রিভলবারের সামনে দশ-বারোজন যুবক এগিয়ে এসে শ্রমিকদের প্রত্যেকের চোখ বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘কেউ চেঁচাবে না। একটু পরে আমরাই বাঁধন খুলে দেব। এসো, আমাদের হাত ধরে চলো।’

মাঝ রাতে গভীর জঙ্গলে পৌঁছে তাদের চোখের শক্ত বাঁধন খুলে দেওয়া হল। সে রাতে পেট ভরে গরম শাক-ভাত খেয়ে গাছের নীচে শুকনো পাতার আস্তরণে মাথা রেখেই ঘুম।

পরদিন ভোরে গুড়-মুড়ি খেয়ে শুরু হল তাদের প্রশিক্ষণ। লেফট-রাইট, হাত উঠাও, সামনে হাঁটো, পিছে হাঁটো, দৌড় লাগাও, উপুড় হয়ে শুয়ে যাও, এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াও, গাছে চড়ো, কাঠবিড়ালীর মতো শাখা বেয়ে চলো, লুকিয়ে পড়ো, বাঁদরের মতো এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফাও- প্রথম কিছুদিন এইসব চলল। পরে ক্রমশ লাঠি খেলা, তলোয়ার চালানো, তীরধনুক বর্শা হ্যান্ড গ্রেনেড ছোঁড়া, বন্দুক চালানোয় হাত পাকানোয়। যে যে-অস্ত্র ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারে তাকে সেই অস্ত্রের আলাদা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেরাদের বেছে নেওয়া হয় অ্যাকশান স্কোয়াডে অংশ নিতে।

চোখ, নাকের ফুটো ও ঠোঁট বাদে আগুনঝরা জ্যৈষ্ঠদিনের মতো সারা মুখ-মাথায় পুরু গামছা বাঁধা বড় এক নেতা এসে একদিন বলল, ‘তোমাদের দুঃখদারিদ্র্য দূর করার ক্ষমতা চৌধুরীদের নেই, পুরসভার নেই, কোনও সরকারেরও নেই। তাদের শুধু শাসন আর শোষণ ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা থাকলেই গরিবের দুঃখ-কষ্ট তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার অধিকার থাকে। গরিব চাষি, তাঁতি, মজুর, পাতা-কুড়ুনি- সকলের সঙ্গে থেকে আমরা তাদের শক্তি জোগাব, অস্ত্র জোগাব। সবাইকে লড়াই করতে হবে। মনে রেখো, যখন যেমন নির্দেশ পাবে সেইমতো তোমাদের তা পালন করতে হবে। তোমাদের সকলের নাম, বাড়ির লোকের নাম, কোন পাড়ার কোথায় বাড়ি, সব আমাদের কাছে লেখা আছে। মাসে মাসে প্রত্যেকের বাড়িতে ডাকপিওনের ছদ্মবেশে তোমাদের ভাতা পৌঁছে দেওয়া হবে। ভাতা বলো আর বেতন বলো আর সাহায্যই বলো, এ শুধু তোমাদেরই দেওয়া হচ্ছে। আমরা তোমাদের পাশে আছি। কোনওরকম চালাকি বা বিশ্বাসঘাতকতা বা পুলিশের চরবৃত্তির শাস্তি কিন্তু একটাই- মৃত্যু।’

পাশাপাশি তিন গ্রামের তেইশজন জোয়ান ছেলে বাদায় কাজে গিয়ে আর ফেরেনি দেখে তাদের স্বজনরা দুশ্চিন্তায় উদ্বেগে দিন কাটায়। প্রতিবেশীরাও অজানা আশংকায় দিশাহারা। সংক্রামক ব্যাধির মতো তিন গ্রামের ভয় আশপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ল। একমাস পর ডাকপিওনের কাছ থেকে ছেলেদের পাঠানো টাকা পেয়ে আশায় আনন্দে তারা বুক বাঁধলেও এতগুলো ছেলের একসঙ্গে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া এবং এতদিনে কারও কোনও খবর না পাওয়ায় গ্রামবাসীদের মনের শংকা থেকেই যায়। যে তিন বাড়িতে ছেলেরা টাকা পাঠায়নি সেই তিন বাড়িতে গ্রামে পিওন আসার দিন থেকে সূর্যাস্তের পর আর আলো জ্বলে না।

সেদিন থেকেই নিতাই আকুলির উঠোনে দিনের আলোয় রাতের আঁধারে নাতির জন্য তার বুড়ি মার বিলাপ শোনা যায়। দু-হাত দু-পায়ে মোট যত আঙুল, তার চেয়েও কম বয়েস নাতিটার।

বিলু যেদিন নিরুদ্দেশ হল সেদিনই বৈরাগীবাড়ির হাঁসু বৈরাগী বাদার পাঁক ঘেঁটে অনেকদিন পর বড় একটা শোল পেয়েছিল, বিলুর মা ছেলের পছন্দমতো অসময়ের মুলো দিয়ে এক কড়াই ঝোল রেঁধে সারা রাত ছেলের পথ চেয়ে বসে ছিল। ছেলেকে না পেয়ে সেই ঝোল তারা খায়ওনি, ফেলেওনি। পিওনকে পাশের বাড়িতে টাকা দিয়ে তাদের ঘরের সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখে সর-পড়া, পচা শোলমাছের কড়াসুদ্ধ উঠোনে তিনটে ছানা বেষ্টিত একটা কুকুরের সামনে ঢেলে দিল।

তৃতীয় জন দুখিরাম, বিছানায় লেপটে থাকা তার বাবা কিছুদিনের মধ্যেই হাঁপরের মতো শ্বাস নিতে নিতে একসময় শেষবারের মতো বালিসোনার বাতাসটুকু আর নিতে পারল না।

এরা কেউ জানে না, প্রথম সপ্তাহেই তাদের তিন ছেলে পালাতে গিয়ে জঙ্গলে পথ হারিয়ে পিছন থেকে বন্দুকের গুলি খেয়ে মারা গেছে।

ঘোড়াপোষা গ্রামের হারান পই ছেলের পাঠানো টাকায় প্রথমেই নিজেদের জন্য চাল-নুন ছাড়াও তাদের ধান বইবার হাড়জিরজিরে বুড়ো ঘোড়ার জন্য এক বস্তা ছোলা কিনল। ছেলে হারিয়ে সামনের মঙ্গলবার চাষিদের বচ্ছরকার ঘোড়দৌড়ের লড়াইয়ে ঘোড়া নিয়ে যাবার আশা ছেড়ে দিয়েছিল, এবার ঠিক হল, পবন এর মধ্যে না ফিরলে, বারো বছরের নাতি ভোলা ঘোড়া ছোটাবে।

হাড়ভাঙি গ্রামের ঢাংপাড়ার কেষ্ট ঢাং, নয়ন ঢাং দুজনেই ভৃঙ্গরাজ, ঘৃতকুমারী, শতমূলী, বিশল্যকরণীর লতা-পাতা বস্তা ভরে শহরের আয়ুর্বেদ ওষুধ-কারখানায় সরবরাহ করে কোনক্রমে সংসার চালায়। রহস্যময়ভাবে নিরুদ্দিষ্ট ছেলেদের কাছ থেকে টাকা আসায় তারা বেশি করে নয়নতারা ও ঘৃতকুমারী চাষের কথা ভাবে। একজন ফড়ে বলেছে দুইয়েরই এখন খুব চাহিদা, ভালো দামও পাওয়া যাবে।

ছেলের পাঠানো টাকা পেয়ে গোপাল ধীবর মুদির দোকানের ধার মিটিয়ে, আবার ধারেই চাল নুন তেল কিনে ঘরে ফিরে দাওয়ায় বউয়ের সামনে বসে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। মালতী চমকে গিয়ে দুবছরের মেয়ে বিন্তির মুখ থেকে বুকের দুধ ছাড়িয়ে নেওয়ায় বিন্তি ভারি অবাক হয়ে বাবার দিকে একমুহূর্ত চেয়ে রইল, তারপর নিজেও কাঁদতে লাগল। মালতী গলা চিরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের কালবোস আর বেঁচে নেই, তাই তো? তা-ই বলতেই এসেছ তো?’ কথার মধ্যেই আহত জন্তুর মতো হিংস্র আর্তনাদ করে উঠল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন