অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
সন্ত্রাসবিরোধী আটক আইনে সেনাবাহিনীর অস্ত্র লুঠের অভিযোগে গ্রেপ্তারের এগারো মাসের মাথায় তৃতীয় দফার জেরায়ও লালকমল নীলকমল আগের মতোই জানাল- মালগাড়ির সিল ভেঙে অস্ত্র লুঠের ব্যাপারে তারা কিছুই জানে না। পাহাড়ে খানিকটা উঠে জঙ্গলের মধ্যে একইরকম কয়েকটা বাক্সের একটা মুখ-খোলা বাক্স থেকে দুজনে দুটো গ্রেনেড তুলে নিয়েছিল। সেই গ্রেনেড দুটোই তাদের হাতে ছিল, পরদিন মিছিলে লোকেদের ছোটাছুটিতে জোর ধাক্কা লেগে হাত থেকে ছিটকে গিয়েছিল। দুজনকে আলাদা আলাদা এবং একসঙ্গে জেরা করেও এর বেশি আর কিছু জানা যায়নি।
তৃতীয় বারের জেরার বেশ কিছুদিন পর একদিন গভীর রাতে দুজন সান্ত্রী এসে তাদের কুঠুরির দরজা খুলে দুজনকে আর্মির ট্রাকে তুলে দিল। পরদিন ভোর রাতে পাহাড়ি গ্রামের রেল স্টেশনের অনেকটা আগে গাড়ি থামিয়ে সঙ্গের সেনা অফিসার বললেন, ‘এখানেই তোমাদের নামিয়ে দেওয়া হবে। পাহাড়ে জঙ্গলের ঠিক যেখানে গ্রেনেড পেয়েছিলে সেই জায়গাটা এদের দেখাবে। তোমাদের দেখে পাহাড়ের সন্ত্রাসবাদীরা যদি আক্রমণও করে তোমাদের ভয় নেই, সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গুলি করা হবে।’
দুই ভাইয়ের হ্যান্ডকাফ খুলে ছেড়ে দেওয়া হল। একই সময়ে ট্রাক থেকে নেমে সাধারণ পোশাকের ছ-জন এদিক ওদিক কে কোথায় মিলিয়ে গেল, দু-ভাই জানবার সুযোগই পেল না।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর নীলকমল প্রথম জায়গাটা দেখতে পেয়ে ভাবছে কাকে দেখাবে, এদিক-ওদিক তাকাবার আগেই একজন বুড়ো ডাকহরকরা পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুমঝুম শব্দে নেমে এসে বলল, ‘ঠিক আছে, ট্রাকের কাছে ফিরে যাও।’
দু-ভাই সাবধানে পা ফেলে জঙ্গল থেকে বেরতে যাচ্ছে, গর্ত থেকে সাপের মতো চারজন লিকলিকে চেহারার যুবক জঙ্গল ফুঁড়ে এসে তাদের ঘিরে ধরল। দুজনের হাতে রিভলবার, একজনের দুহাতে দুটো, দুজনের হাতে বন্দুক। গামছা দিয়ে সকলের মুখ বাঁধা। ‘তোরাই সেই স্পাই!’ বলে খুঁড়িয়ে হাঁটা লোকটা লাফিয়ে এসে লালকমল-নীলকমলের কপালে দুহাতে দুটো রিভলবার ঠেকিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে বলল, ‘চল শালা, খোচরের বাচ্চা!’ কয়েক পা এগিয়ে খোঁড়াটাই সঙ্গের অন্য দুজনকে বলল, ‘আলো ফোটবার আগেই হাত-পা কাটা ধড় দুটো স্টেশনের কাছে ফেলে আসবি। ‘গুপ্তচরের শাস্তি’ লেখা কাগজ-দুটো মুণ্ডু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখবি!’
লালকমল-নীলকমলকে নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরবার মুখে সশস্ত্র চারজনই মাথায় গুলি খেয়ে গুলি চালাবার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
‘খান্ডেলওয়ালা, তোমার ট্র্যাপ খুব কার্যকর হয়েছে। ওয়েল প্ল্যান্ড, ওয়েল লেড আউট। অ্যান্ড ইট ইল্ডেড দ্য ভেরি বেস্ট রেজাল্ট।’ ট্রাকে অপেক্ষায় থাকা অফিসার অপারেশন করে ফেরা ছ’জনের দলটার লিডারকে একথা বলে লালকমল-নীলকমলকে দেখিয়ে আবার বললেন, ‘নাউ উই আর কনভিন্সড, দে আর ইনোসেন্ট।’
‘ইয়েস স্যার, দে অলসো হেল্পড আস গেট ক্লোজার টু দ্য মিলিটারি ওয়াগান ব্রেকার। এই জঙ্গলেই তাদের ডেরা। ডিলেড কম্বিংয়ে তারা আরও গভীর জঙ্গলে সরে যাবে।’
চলন্ত ট্রাক থেকে ওয়ারলেসে কোড ল্যাঙ্গোয়েজে দূরের কারও সঙ্গে বার্তা চালাচালি চলতে লাগল। কর্নেল খাণ্ডেলওয়ালা ওয়ারলেসেই লালকমল-নীলকমলের উদ্দেশে ক্যাপ্টেন বিৎসের অভিনন্দন শুনিয়ে দিলেন।
নিরাপত্তার কারণে লালকমল-নীলকমলকে আরও তিন মাস বি-এস-এফ গেস্ট হাউসে অন্তরীণ রেখে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হল।
অনেকদিন পর এক রবিবার ভোরের ট্রেনে বালিসোনা পৌঁছে দুজনে বাড়িতে ঢোকার আগে রাসমাঠের সামনে এসে থমকে গেল। মাঠের সামনের অংশ জুড়ে বিরাট একটা অট্টালিকার অল্প খানিকটা গাঁথা হয়ে পড়ে আছে। বেশিটাই নিমচারা খেজুরচারা চোরকাঁটা বুনো লতাগুল্ভমে ঢাকা। তার পিছনে গানের মিছিল বেরবার তোড়জোড় চলছে। আগের মতো দৈর্ঘ্য আর নেই, কিন্তু পুরো মিছিল জুড়ে শুধুই বিষাদগাথা।
সাদা কাগজে, সাদা কাপড়ে লাল-কালো কালিতে লেখা পরীক্ষিতের নানা সময়ের লেখার টুকরো উঁচুবাড়ির বারান্দা থেকে পড়া যায় না, দূর থেকে শুধু সাদা প্ল্যাকার্ড আর ফেস্টুনের ঢেউ চোখে পড়ে। তবে কয়েকশো মানুষের একসঙ্গে গাওয়া গান বালিসোনার সব জায়গা থেকে শোনা যাচ্ছিল।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন-পুরনো অনেকে এসে মিছিলে যোগ দিল। নন্দিনীও এই প্রথম গানের মিছিলে এসেছে। অরণ্য অনেক কাল পরে আবার নিয়মিত আসতে শুরু করেছে।
জনশূন্যি মোড়ে মিছিলের সামনের দিকে কিসের গোলমালে সমবেত গান ক্রমশ এলোমেলো হয়ে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল মিছিলে লালকমল-নীলকমলের ভূত দেখার গুজবে ভয় পেয়ে অনেকে পালাচ্ছে, অনেকে গানের খেই হারিয়ে ফেলেছে। আসল ব্যাপারটা কী বুঝতে লক্ষ্মী-সরস্বতী, লিওন, চিরন্তনী এগিয়ে গিয়ে দেখল, বন্ধ একটা রেশন দোকানের রোয়াকে আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলা যুবক-যুবতীদের দলটা সকলে মিলে নানা অঙ্গভঙ্গি সহকারে শুধু আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলে চলেছে। তারা নাকি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ বর্ণনা করছে। তা দেখতে হাটভাঙা মানুষ রাস্তায় এসে ভিড় করেছে। কাহিনী বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে একজন একটা মেয়ের গা থেকে শাড়ি ধরে টেনেই চলেছে, মেয়েটাও উল্টো পাকে ঘুরে যাচ্ছে। সবটা খোলার কিছু আগে বস্ত্রহরণ থামিয়ে দলের অন্যরা কতগুলো ঝুলি খুলে উৎসাহী জনতাকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস দেখাতে লাগল। প্রত্যেকটা জিনিসের সঙ্গে কাগজে জিনিসটার গুণ লেখা আছে। কোনওটা কুরূপাকে সুরূপা করে, কোনওটা চোখে দিলে নারী পুরুষ পরস্পরের দৃষ্টির বশীভূত হয়, কোনওটা মধু মিশিয়ে খেলে বৃদ্ধ বয়েসে যৌবন ফিরে পাওয়া যায়- এরকম আরও অনেক জিনিস চোখের নিমেষে বিক্রি হয়ে যাবার পর আবার বস্ত্রহরণ শুরু হল।
শাড়ি খুলেই চলেছে। পুরোটা খুলে যাবার পর দেখা গেল বুকে দুটো নারকোল মালা লাগানো ল্যাঙট-পরা একটা লোক দ্রৌপদী সেজেছিল। শুধু হাত-মুখের আকারে-ইঙ্গিতে দ্রোপদীর বস্ত্রহরণ পালার কথা শুনে প্রথমে যারা এসেছিল, তার পরও অনেকে এসেছে, তাদের ধারণা ছিল রাস্তায় নাচগানের আসর বসেছে। তারও পরে যারা এসেছে তারা কিছু শোনেওনি, ভাবেওনি, ভিড় দেখে চলে এসেছে। ফলে রাস্তা বন্ধ। মিছিল এগোবার উপায় নেই। বাজারে, স্টেশনে, চৌরাস্তায় আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলা নারী-পুরুষের দল কিছুদিন ধরে অনেকেরই চোখে পড়েছে। পুরুষই বেশি। অচেনা হলেও বোবা-কালা ধরে নিয়ে এইসব মানুষের প্রতি সহানুভূতিতে কেউ বিরক্ত বা বিরূপ হয় না। কিছু দিন পর পর এরকম আরও একটা করে দল এসে এদের সঙ্গে মিশে যায়। এরা সবসময় অন্যদের দেখিয়ে দেখিয়ে, নিজেরা তাদের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে শুধু আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলে।
লক্ষ্মী-লিওন দুজন ভিড়ের সামনের দিকের কয়েকজনের উদ্দেশে দু-হাত তুলে তাদের কথা শোনবার অনুরোধ জানালে সামনের লোকেরা আগ্রহে লক্ষ্মীদের কাছে এসে নমস্কার করে দাঁড়াল।
লক্ষ্মী বলল, ‘আপনারা যদি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে এদের মূকাভিনয় দেখেন, গানের মিছিল তাহলে এগিয়ে যেতে পারে।’
ভিড় থেকে আরও কয়েকজন সামনে চলে এসেছে। কেউ কেউ গানের মিছিলেও কয়েকবার হেঁটেছে। সবাই মিলে রাস্তার একটা পাশ পরিষ্কার করে দিল। হাটের অনেকে মিছিলে চলে এল।
আরও এগিয়ে এবার সারি সারি মুড়কি-বাতাসার দোকানের সামনে দোকানদারদের সঙ্গে লম্বা জুলফিওলা চাঁদা পার্টির হুমকি-হাতাহাতির ভিড়ে সন্ত্রস্ত পরীকে দেখে লক্ষ্মী মিছিল ছেড়ে পরীকে উদ্ধার করতে এগিয়ে গেল।
লক্ষ্মী শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। ওই অবস্থায় পরী কেঁদে ফেলে বলল, ‘আমার বাতাসার ঠোঙা ধুলোয় পড়ে গেছে! চাঁদার ছেলেরা দোকানদারদের পেটাতে পেটাতে বাতাসার টিন লুট করছিল! তারাও একটা গুণ্ডার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।’
গান গাইতে গাইতে দীর্ঘ মিছিল এগোতে লাগল। চাঁদা তোলার ছেলেরাও ততক্ষণে উধাও, লালকমল-নীলকমলের ভূত তারা স্বচক্ষে দেখেছে।
অরণ্য সুস্থ হয়ে ফিরে এসে বাবাকে আর বাড়িতে দেখেনি।
দিন-রাতের বেশিটাই সে পরীক্ষিতের পড়ার ঘরে কাটায়। কখনও ঘন্টার পর ঘন্টা পরীক্ষিতের লেখা পংক্তির প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন বানায়। রাতে প্রদীপ এসে পরদার পিছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কাল পারবি রে পরীক্ষিৎ? নতুন রাস্তার দুধারে অনেক জায়গায় এখনও বীজ ছড়ানো বাকি, বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। কাল যাবি তো?’
অরণ্য বাবার হয়ে প্রক্সি দেয় ‘না প্রদীপদা, কাল পারব না। পরশু তোমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই বেরব।’
‘রাতে আমার ঘরে একবার আসিস। অবনীকাকার তৈরি মেডিসিনাল প্ল্যান্টের তালিকায় আরও অনেক গাছ লতা-গুল্ভম আমি যোগ করেছি। একুশ একর খালি জমির একটা ম্যাপও এঁকেছি। তোকে দেখাব।’
লালকমল-নীলকমলকে সন্ধেবেলা ঘরে ঢুকতে দেখে নীলাঞ্জনা দুহাতে দুজনকে বুকে টেনে নিয়ে একবার লালের গালে একবার নীলের গালে মুখ ঘষতে ঘষতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
লাল বলল, ‘কান্না না, তোমার হাসি দেখতে এসেছি মা।’
নীল বলল, ‘মাগো, হাসো তো দেখি।’
চোখের জল নিয়ে নীলাঞ্জনা হেসে ফেলল, ‘তোমরা বুঝি এখন দাড়ি কামাও?’
‘তুমি আমাদের চিরকাল ছোটই ভাববে?’
নীলের কথার পিঠে লালের সংযোজন, ‘আমাদের তুমি যুদ্ধফেরতও বলতে পারো।’
দুই ছেলেকে তখনও ধরে রেখে নীলাঞ্জনা বলল, ‘তোমরা সিগ্রেট ধরেছ! তামাকের বিশ্রী গন্ধ পাচ্ছি!’
লালের অকপট কৈফিয়ৎ- ‘রেলে বিরাট পাগড়িওলা এক গুজরাটি বিড়ি-ব্যবসায়ী বস্তাবস্তা বিড়ি নিয়ে ডিব্রুগড় যাচ্ছিল, সে-ই আমাদের দুজনকে দুটো গুজরাটি বিড়ি চাখতে দিয়েছিল।’
নীল যোগ করল, ‘তার মাথায় যেমন দুহাত উঁচু পাগড়ি, তার বিড়িও তেমনই চার ইঞ্চি লম্বা। কাশতে কাশতে আমাদের যা অবস্থা হয়েছিল দেখলে তুমি ভয় পেতে মা। বাবাকে দেখছি না তো!’
পায়ে শেকল দিয়ে বাবাকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে শুনে দুভাই শিকারের ওপর সিংহীঝাঁপ মেরে বলল, ‘আমরা এখুনি যাব।’
নতুন দুজনের অনুমতি জোগাড় করতে পুরো সপ্তাহ কাটল। দু-ফেরতা মোটা জালের ওপর দুহাতের জোড়া ঘুঁষি মেরে লালকমল চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমাকে আটকে রাখে সাধ্য কার!’ ঘুঁষি ও হুংকার শুনে দুজন কারারক্ষী ও একজন গোয়েন্দা অফিসার একসঙ্গে দৌড়ে এসে প্রথমজন লালকমলের কাঁধে জোর একটা চাপড় মেরে বলল, ‘দেশে আইন-কানুন নেই? চুপচাপ দেখে চলে যান!’
‘কাঁধ থেকে হাত নামান! আমাদেরও একই প্রশ্ন- এ কি মগের মুল্লুক নাকি?’
নীলকমলের গলার স্বরে ও কথা বলার ধরনে লালকমলের কাঁধ থেকে কারারক্ষীর হাত আপনিই নেমে এল।
লালকমল-নীলকমলকে চিনতে পেরেছে কিনা বোঝা গেল না, তবে পরীক্ষিতের মরা চোখে ঝিলিক দেখা গেল, ফ্যাসফেসে গলায় জোর এনে বলল, ‘তোদের সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।’ যতবারই জালের ওপর ঝুঁকে কথা বলতে যায়, জালের ওপারে যে-কোনও নড়াচড়া দেখলেই সে দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। কিছু বলতে পারে না।
লালকমল-নীলকমল গোয়েন্দা ও কারারক্ষীদের আলাদাভাবে অনুরোধ করল, ‘আপনারা কাইন্ডলি একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়াবেন? বাবা আমাদের কিছু বলতে চাইছেন।’
রক্ষীরা দুজন রাজি হলেও গোয়েন্দা অফিসার এক ইঞ্চিও সরবেন না।
শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান আর্মির ক্যাপ্টেন বিৎসের নামে কাজ হল। পরীক্ষিৎ তবু চোখ ঘুরিয়ে সামনের দু-পাশটা দেখবার চেষ্টা করে জালের ওপর ঝুঁকে এসে বলল, ‘কুয়াশাদ্বীপের সাধু আমাকে অনেক ওষুধ দিয়ে গেছে, তোরা একটা ঘোড়া এনে দে, মানুষ বড় কষ্টে আছে রে।’
লালকমল ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, ‘বাবা, আমাদের চিনতে পারছ না?’
পরীক্ষিৎ গোঁফ-দাড়িতে হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘তোরা তো সেই লালকমল-নীলকমল!’
তারপরই চোখের তারা ঘুরিয়ে গায়ের পায়ের শেকল দেখতে দেখতে খুব মৃদু স্বরে বলল, ‘আমাকে কেন শেকলে বেঁধেছে রে? কে বেঁধেছে?’
নীলকমল লোহার জালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, ‘এ শেকল আমরা ভাঙবই।’
লালকমলও একইভাবে জালে কপাল চেপে বলল, ‘এই মুহূর্ত থেকে লড়াই শুরু!’
লক্ষ্মী সরস্বতী নীলাঞ্জনা লিওনের সঙ্গে সেদিন সন্ধের আলোচনায় পরীক্ষিতের ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট লেখক সাংবাদিক সমাজসেবকদের সমর্থনের বিষয়ে বিশদ জানা গেল। বিদেশ থেকেও কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক, দার্শনিকের কাছ থেকে পরীক্ষিতের মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন মাঝেমাঝে খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে। এর পাশাপাশি কেস রিওপেন করার বিষয়ে আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা চলছে।
‘আমাদের অ্যাকশন প্ল্যান কোথায়?’ লালকমলের কথার পিঠে নীলকমল বলল, ‘একটা দিনও আর নষ্ট করা যাবে না।’
লালকমল-নীকমলের কাছে সকলেই তাদের বন্দীজীবনের কথা জানতে চায়। সকলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে লালকমল বলল, ‘আমাদের কথা শোনবার অনেক সময় পাবে। বাবাকে বাইরে আনা এখন সবচেয়ে বড় কাজ। এটাই আমাদের টপ মোস্ট প্রায়রিটি।’
রাসমাঠের শপিং মল নির্মাণ নিয়ে হরেন ভদ্রের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা ও সেই সূত্রে স্ট্যাটাস কোর মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে অরণ্যকে মেজো-জ্যাঠার বাড়িতে যেতে হয়েছিল। রাতে বাড়ি ফিরে লালকমল-নীলকমলকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘তোদের ফিরে পেয়ে নতুন শক্তি পাচ্ছি রে! বাবাকে এবার মুক্ত করবই। বাবার জন্য খুব বড় অ্যাডভোকেটও মেজো-জ্যাঠা ঠিক করে দিচ্ছে।’
চৌধুরীবাড়িতে যেন সান্ত্বনার পরব চলছে। নীলাঞ্জনা মিতাকে, সরস্বতী নন্দিনীকে, লালকমল-নীলকমল পরীকে- নিরুপায় হয়ে সবাই সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
তিস্তাদের বাড়িতে সাইকেলটা রেখে মেঘাবৃত রাত করে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। নীলাম্বর তার তিনবন্ধুকে নিয়ে কোথাও যাবার পথে মেঘাবৃতকে দেখে বলে উঠল, ‘তোমার সঙ্গে আমার ভি-ভি-আই-পি কথা আছে, একটু দাঁড়াবে?’
থানায় সাপ্তাহিক হাজিরার দিন বাদে বাকি ছ-দিন নীলাম্বর বন্ধুদের নিয়ে মদের আসর বসায়। পোস্ট অফিসের সামনে এই নির্জন রাস্তায়ও তাদের মুখ থেকে মদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
বন্ধুদের ছেড়ে দিয়ে মেঘাবৃতর একটা হাত টেনে নিয়ে নীলাম্বর বলল, ‘এভাবে মনের যন্ত্রণা ভোলা যায় না বন্ধু। শকুন্তলার কাছে চলো, ও সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।’
‘ডাক্তার শকুন্তলা মিত্র, সাইকিয়াট্রিস্ট?’
‘সাইকিয়াট্রিস্ট না, পতিগৃহে যাত্রার শকুন্তলাও না, নতুন এসেছে।’
‘আমাদের হাসপাতালে? কিসের ডাক্তার?’
‘যাব্বাবা! ব্যাটাছেলের জন্য মেয়েছেলের ডাক্তারি তো একটাই।’ রহস্যময় হেসে নীলাম্বর আবার বলল, ‘তুমি তো লেখাপড়ায় এক নম্বর, বলো তো পণ্ডিত, তপোবনের সেই শকুন্তলার বয়েস কত?’
বিস্ফোরণের আগে ক্রোধ স্তরে স্তরে পুঞ্জীভুত হতে যেটুকু সময় লাগে, সেই সময়টুকুতে নীলাম্বর অবুঝের মতো বলল, ‘তুমি হেরে গেলে। আমি বলব? চোদ্দ।’
মেঘাবৃতর চড়ে নীলাম্বর লাট খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেল।
বাড়ি ফেরার পরই মেঘাবৃতর মুখ দেখে লালকমল-নীলকমল তার বড় কোনও অঘটন সন্দেহ করেছিল, তিস্তার সম্পূর্ণ কাহিনি শুনে তাদের মনের ভাব কী হল বোঝা গেল না।
পরের সপ্তাহে থানায় হাজিরার আগের রাতে জঙ্গলে নীলাম্বরের ধড়-মুণ্ড পাশাপাশি পাওয়া গেল।
অনেক রাতে লালকমল-নীলকমল প্রদীপের দরজায় টোকা দিতে গিয়ে ভেতরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরেই দ্বিধা ঝেড়ে দরজার বাইরে থেকে বলল, ‘ছোটদাদু, জেগে আছ?’
প্রদীপ সময় নিয়ে ভেতর থেকে গলা তুলে বলল, ‘আমি তো লিখছি রে, আমার কি ঘুমোলে চলে?’
আজকাল দরজা খুলতেও তার সময় লাগে।
সারা ঘর ঝোপঝাড়ে ভরা। ধুলোর গন্ধে দম আটকে আসে। বেশির ভাগ লতা-পাতা শুকনো বিবর্ণ। মরা ডালপালার ফাঁকফেঁাকড় দিয়ে অল্প কয়েকটা সজীব গাছ কোনও রকমে মাথা তুলে আছে। মেঝেময় হিজিবিজি লেখা কাগজ ছড়ানো।
দরজা খুলে দিয়ে প্রদীপ ভাঙা কোমরে ঝুঁকে হাঁটুতে এক হাত রেখে কয়েক পা হেঁটে মেঝেয় গিয়ে বসে পড়ল।
ঘাড় না ঘুরিয়ে লালকমল-নীলকমলের উদ্দেশে বলল, ‘তোমরা তো কেউ পরীক্ষিৎ না। তোমরা কে?’
ঘরের কোথাও বসবার মতো জায়গা নেই। লালকমল-নীলকমল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দম প্রায় বন্ধ করে প্রদীপের কুঁজো চেহারা দেখছিল, প্রশ্ন শুনে লালকমল বলল, ‘আমরা লালকমল আর নীলকমল।’
‘তোমাদের তো ঠিক চিনলাম না।’
‘আমরা পরীক্ষিতের দুই ছেলে।’
প্রদীপ অবিশ্বাস্য এক ঝটকায় দুজনের দিকে ফিরে বলল, ‘সে কী! ভগবান কি সত্যিই আছে নাকি রে!’
নীলকমল এই প্রথম কথা বলল, ‘তখন বললে লিখছ, চোখে না দেখে তুমি লেখো কী করে?’
‘অক্ষরের চেহারা, শব্দের রূপ কখনও ভোলা যায়!’
‘এখন কী লিখছ, ছোটদাদু?’
লালকমলের প্রশ্ন শুনে প্রদীপ তাকে কাছে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কপিখেতের যুদ্ধের ইতিহাস।’
মেঝেয় বসে তক্তাপোষে বিছানার ওপর কাগজ রেখে প্রদীপ দিনরাত লেখে, দুভাই মেঝে থেকে কয়েকটা কাগজ তুলে নিয়ে দেখল, লাইনের ওপর লাইন, শব্দের ওপর শব্দ জড়াজড়ি হয়ে কিছুই পড়া যায় না।
নিওরোলজিস্ট সুব্রত সরকারি হাসপাতালের কাজে ইস্তফা দিয়ে কয়েক বছর বিদেশে কাজ করে বালিসোনায় ফিরে এসেছে, এখন এখানেই স্বাধীনভাবে প্র্যাক্টিস করার কথা ভাবছে।
তার বিদেশি শিক্ষক বিশ্ববিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ডাঃ জবাভিতেল কলকাতায় একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নিমন্ত্রিত হয়ে আসছেন শুনে সুব্রত তিস্তার কেস হিস্ট্রি ও চিকিৎসার বিবরণ আগে ভাগে তাঁর ব্রাটিস্লাভার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিল। সম্মেলনের শেষ দিনের আনুষ্ঠানিক ডিনার বাদ দিয়ে ডাঃ জবাভিতেল সুব্রতর সঙ্গে বালিসোনায় এসে তিস্তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। অধিকাংশ ওষুধ বন্ধ করে দিয়ে পরামর্শ দিলেন- রোজ তিস্তার নাগালে তার ডানাওলা সাইকেলটা রেখে, তার চোখের সামনে অন্য সাইকেলটা চড়ে তার প্রেমিক যেন মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়। যত উড়বে, যত দূরে যাবে ততই ভালো, তবে একেবারে মেয়েটির দৃষ্টির বাইরে যেন চলে না যায়।
সেদিন ও তার পরদিন স্নায়ুবিজ্ঞানের অতল রহস্যসন্ধানী গুরুশিষ্য তিস্তাদের বাড়িতে থেকে নিজেরাই রোগীর পরিচর্যা করলেন। ওষুধ ও ইনজেকশানও নিজেরাই দিলেন।
ন-মাস রোজ একা-একা সাইকেলে উড়ে মেঘাবৃত যখন ক্লান্ত ও বাকিরা হতাশ, চৈত্র-বৈশাখের আগুনে, খ্যাপা ঝড়জলে, শ্রাবণের চারদিক সাদা-করা বৃষ্টিতে তাকে মরিয়া হয়ে সাইকেল চালাতে দেখে সকলেই যখন চিন্তিত, তখন শরতের এক সকালে মেঘাবৃত টের পেল তার থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে অন্য সাইকেলটাও আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে ডানামেলা সাইকেলে সাদা প্যান্ট-শার্ট পরা তিস্তাকে দেখতে পেল। ঘন্টির বদলে বাঁশি বাজিয়ে বাঁশিতেই তার উত্তরও পাওয়া গেল।
আরও পাঁচ মাস পর বসন্তের এক বিকেলে ঘোড়াদহের মাঠে দুজনে সাইকেল নামানোর আগে থেকেই অনেককে তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
সকলের মুখ থমথমে। লিওনার্দো এগিয়ে এসে শান্ত স্বরে, অভ্যাসমতো ধীরে ধীরে মেঘাবৃতকে বলল, ‘অরণ্য নীলাঞ্জনা জেলে চলে গেছে, বালিসোনার বহু মানুষ তাদের সঙ্গে গেছে, পরীক্ষিৎকে নিয়ে ফিরবে বলে। ফিরবে ঠিকই, কিন্তু ফিরবে পরীক্ষিতের মরদেহ নিয়ে। শহরের মানুষও জেলের সামনে ভিড় করে আছে। খবর পাচ্ছি, ভিড় বেড়েই চলেছে। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে মরদেহ বালিসোনায় আনতে হয়তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে।’
লিওনার্দো আরও কী বলতে যাচ্ছিল, মেঘাবৃত বাধা দিয়ে বলল, ‘মরদেহ? তাঁর তো আজ মুক্তি পাবার কথা!’
তিস্তা স্তম্ভিত- ‘মুক্তির কথা শুনেই তো আজ আমরা বড় আনন্দে উড়াল দিয়েছিলাম!’
কথার সঙ্গে তিস্তার দু-চোখ জলে ভরে উঠেছে।
‘সেটা তোমরা কেউ ভুল শোনোনি। পরীক্ষিতের নিঃশর্ত মুক্তির রায় গতকালই বেরিয়ে গেছে। তা শুনেই বালিসোনার সবাই তাঁকে আনতে শহরে গেছে। কিন্তু আদালতের রায়ের কপি জেলে এসে পৌঁছয়নি বলে কাল তাঁকে ছাড়া যায়নি। আর আজ তার মৃত্যুর খবরটুকু পর্যন্ত ভোরের আগে জানানো হল না।’
বালিসোনার দীর্ঘতম শবযাত্রায় প্ল্যাকার্ডে ফেস্টুনে পরীক্ষিতের সারাজীবনের কথাগুলো ছাড়া আর কোনও কথা ছিল না। অদ্ভুত নীরবতা ছাড়া কোনও সংগীতও শোনা যায়নি।
পরীক্ষিতের মৃত্যু প্রদীপের মনে থাকে না। তাকে আর ঘরের বাইরেও বিশেষ দেখা যায় না। অনেকদিন পরে পরে হঠাৎ কখনও কোমর ভেঙে লাঠি ঠুকে ঠুকে পরীক্ষিতের দরজা পর্যন্ত এসে বলে যায়, ‘কাল যাবি তো রে, পরীক্ষিৎ? বীজে পোকা ধরে যাচ্ছে!’
অরণ্য গলা পাল্টে উত্তর দেয়, ‘কাল পারব না, প্রদীপদা। পরশু নিশ্চয়ই যাব।’
‘মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এখন কাল-পরশু করলে কি চলে! প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে না তারাই শুনছি এগিয়ে আছে।’
একদিন ফাল্গুনের হাওয়ায় তিস্তা-মেঘাবৃত ডানা মেলে অনেক উঁচু দিয়ে সাইকেলে উড়তে উড়তে দেখল, নীচে অরণ্য দুই ভাইকে নিয়ে আধখোড়া নদীখাত পার হয়ে শিমুলবনের ধার দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। তিনজনের চোখ মাটিতে। হয়তো কিছু খুঁজছে।
শিমুলগাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে হঠাৎই একঝাঁক বন্দুকের গুলি এসে লালকমল-নীলকমলের মাথা চুরমার করে দিল। কাগজ বাঁধা দুটো তীরও এসে দূরের মাটিতে গেঁথে গেছে।
মেঘাবৃত-তিস্তা চিলের মতো ডানা গুটিয়ে দ্রুত নেমে এল। তিস্তা অরণ্যের কাছে দৌড়ে গেল, মেঘাবৃত কাগজ দুটোর ভাঁজ খুলে দেখল, দুটোতে একই কথা লেখা- ‘গুপ্তচরের শাস্তি।’
পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে অরণ্য যখন লালকমল-নীলকমলের কাছে ফিরে এল তখনও তাদের শবদেহের ওপর শতাব্দীর শেষ শিমুলফুল ঝরে পড়ছে।
পুলিশের গাড়িতেই রক্তস্নাত দুই ভাইকে তুলে সকলে মিলে হাসপাতালের দিকে রওনা হল।
নতুন শতাব্দীও একটা ‘কথার কথা’-র মতো নিজের পথে এগিয়ে চলে।
বছর বছর বালিসোনায় রক্তপাত বেড়েই চলল। বর্ষাকালে মরা গাঙ যেখানে যতটুকু প্রাণ পায় সেখানকার অস্বচ্ছ জলে রক্ত গিয়ে মিশে যায়।
প্রাোমাটারের লোকজন চৌধুরীবাড়ি ভাঙা প্রায় শেষ করে মহালয়ার আগের দিন একতলার একটা বন্ধ দরজা বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে কেটে ফেলল।
শুকনো, মরা, ধুলো খাওয়া গাছপালা লতা-গুল্ভমের মধ্যে আস্ত একটা মানুষের কংকাল দেখেও অরণ্য কথা বলতে পারল না।
কংকালের খবর পেয়ে তরুণবয়সি প্রাোমোটর গাড়ি থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে কাটা দরজায় এসে দাঁড়াল। ভেতরে একপলক চোখ বুলিয়ে অরণ্যকে জিজ্ঞেস করল, ‘কে ইনি? আপনার কে হয়?’
বলেই খেয়াল হল লোকটা বোবা। নিজের লোকদের বলল, ‘চৌধুরীদের একজন আগের শাসকদলের কিছু একটা ছিল, হয়তো এ-ই। চুপিচুপি পাচার করে দে। করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে নিবি।’
এক যুগ আগে শিমুলতলায় গুলিবিদ্ধ দু-ভাইকে রেখে পুলিশ ডেকে আনার পরই অরণ্য তার ঠাকুর্দার মতো কণ্ঠস্বর হারিয়েছিল, প্রাোমোটারের কথায় মুখ বেঁকিয়ে-চুরিয়ে কিছু একটা বলতে চাইল, কিন্তু তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরল না।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন