১। সাহিত্যও পড়তে হবে, ভাষাও শেখা চাই

সাহিত্যও পড়তে হবে ভাষাও শেখা চাই

কলকাতা জায়গাটা ঠিক কোথায়? এই নিয়ে সুকুমার রায় একটি পদ্য লিখেছিলেন। তিনি শিয়ালদা পেয়েছেন, বালিগঞ্জ পেয়েছেন, দমদম পেয়েছেন। কিন্তু সারা শহর খুঁজেও কলকাতা পাননি। শেষমেশ জিজ্ঞাসা করেছেন সাধুরাম ধোপাকে। সে মাথা চুলকে বলেছে—’কলকাতা? হলে হবে উশ্রীর ওপারে।’

তোমাদের বাংলা ভাষার সিলেবাসে ওইরকম একটা ধাঁধা আছে। স্কুল কলেজে ব্যাকরণ, রচনা, ভাবসম্প্রসারণ, গল্প, কবিতা, নাটক সবই পড়তে লিখতে শেখানো হয়। কিন্তু ভাষা শেখানো হয় কি?

মাধ্যমিক পর্যন্ত এই সমস্যাটার দিকে নজর পড়ে না। কারণ অধিকাংশ প্রশ্নই সংক্ষিপ্ত, এমনকি অবজেকটিভ। তার উত্তর সাধারণত টেক্সট -এর মধ্যেই পাওয়া যায়। তাছাড়া টেস্ট পেপার ধরে অভ্যাস করায়, অনেকেই ফুল মার্কস পেয়ে যায় ব্যাকরণে। কিন্তু হায়ার সেকেণ্ডারিতে দুটো পেপার। ফার্স্ট পেপারে ব্যাকরণ নেই। বেশ কিছু প্রশ্ন ব্যাখ্যামূলক। যেমন, অক্ষয় দত্তের প্রবন্ধ থেকে জানতে চাওয়া হয়—’লেখক পল্লিগ্রামের প্রজাদের দুরবস্থার যে ছবি এঁকেছেন তা বর্ণনা কর। এ প্রসঙ্গে তাঁর সমাজ সচেতনতার পরিচয় দাও।’ প্রথম অংশটা ৯ নম্বরের, এর উত্তর টেক্সট-এ আছে। কিন্তু পরের ৫ নম্বরের জন্য জানতে হবে সমাজ কাকে বলে, সমাজসচেতনতা ব্যাপারটাই বা কী? তারপর টেক্সট-এর সঙ্গে মিলিয়ে উত্তর তৈরি করতে হবে। এই কাজটা বেশিরভাগ সময় টিউটোরিয়াল হোমের মাস্টারমশাইরা করে দেন। ফলে কোনও কারণে প্রশ্ন কমন না পেলে তোমরা কলম কামড়াও। ধরা যাক, টেক্সট বইটা দিয়ে দেওয়া হল। সমাজ আর সমাজ সচেতনতা নিয়ে সাধারণ আলোচনা করা হল। তারপরেও প্রশ্ন ওঠে ‘কী করে লিখব স্যার?’

‘নিজের ভাষায় লেখ।’

নিজের ভাষা? সে কীরকম? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সাধুরাম ধোপাকে চাই।

উত্তর মেলে না বলেই ফার্স্ট ইয়ারে এসে অকূল পাথারে পড়তে হয় তোমাদের। রীতিমতো উচ্চাঙ্গের সাহিত্যের মুখোমুখি হতে হয় তখন। ধরা যাক ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’র প্রথম সর্গ থেকে রাবণের রাজপুরীর বর্ণনা লিখতে বলা হয়েছে। তুমি টেক্সটের প্রাসঙ্গিক অংশটা গদ্যে অনুবাদ করে দিলে দশে বড়োজোর সাড়ে চার পাবে। কারণ পরীক্ষক আশা করছেন, ওই রাজপ্রাসাদ যে আসলে রাবণের বিশালতাকে ব্যঞ্জিত করছে তা তুমি ধরতে পারবে। অমন ভুবনমোহন সিংহাসনে বসে রাজা কাঁদছেন— এই বৈপরীত্যটা খেয়াল করবে। মোটকথা, মাইকেলের ভাষার মধ্যে যত বলা আর না বলা কথা আছে সবটুকু আত্মসাৎ ক’রে, তারপর প্রকাশ করতে পারবে। সেই প্রকাশের মধ্যে থাকবে নিজস্বতা। যারা ভবিষ্যতে বাংলা নিয়ে পড়বে সমস্যাটা কিন্তু কেবল তাদের নয়। মাতৃভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে না পারলে কোনও ভাষাই শেখা যায় না। আর ভাষা না জানলে উচ্চশিক্ষার জগতে পায়ের তলায় মাটি মিলবে না। বড়ো হয়ে রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন এঁদের লেখা পড়ে দেখবে, জ্ঞানের সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শন এসবের ভেদাভেদটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হল অন্যকে জানা আর নিজেকে জানানো।

ভাষা হল অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম। তার জন্য প্রয়োজন হয় দু’তরফই চেনেন এমন কিছু চিহ্ন, সেই চিহ্নগুলোকে বাঁধবার একটা সাংকেতিক নিয়ম। আমাদের বলা কিংবা লেখার ভাষায় চিহ্ন হল শব্দ। জরুরি কিছু শব্দের মানে আর বাক্য তৈরি করার সাধারণ নিয়মগুলো জেনে নিলেই যে কোনও ভাষায় কথাবার্তা চালানো যায়। লেখার জন্য আর একটা জিনিস চাই। প্রত্যেকটা শব্দ আসলে কতগুলো ধ্বনির যোগফল। সেই ধ্বনিগুলোর প্রতীক হিসেবে এক একটা ছবি ঠিক করা আছে। সেই ছবি বা লিপিগুলোর উপর দাগা বুলিয়ে অভ্যাস করে নিলেই ব্যাস। তুমি তৈরি।

তোমরা বলবে এটুকু তো আমরা সেই প্রাইমারি স্কুলেই শিখে গেছি। ঠিক, এটুকু জানো বলেই দৈনন্দিন কাজকর্ম, মানে কথাবার্তা চালানো, চিঠি লেখা, ধোপার হিসেব লেখা এসব করতে পারো তোমরা। কিন্তু বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাষার এক আশ্চর্য ক্ষমতার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। মানুষ সকলের চেনা জানা শব্দ আর একই ব্যাকরণের উপর নির্ভর করে প্রতিমুহূর্তে অসংখ্য অজানা ভাব প্রকাশ করে যেতে পারে। যিনি যত বেশি সৃজনশীল তিনি তত সদ্ব্যবহার করেন এই ক্ষমতার। সেই ভাষার অর্থ বোঝার জন্যও সৃজনশীলতা চাই।

মানুষ মাত্রেই সাজতে ভালোবাসে। এখানে সাজ মানে কিছু পি সি চন্দ্রের ম্যানিকুইনের মতো নাকে-কানে-গলায়-সিঁথিতে হীরেমানিকের ঝলকানি নয়। মানুষ সাজে নিজের চরিত্রকে, ব্যক্তিত্বকে আরও উজ্জ্বল করার জন্য। ক্ষ্যান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ি পানের রসে ঠোঁট রাঙান। সেটাই তাঁর সাজ। ফুলটুসী স্রেফ একটা বেড়াবিনুনি বাঁধে। তাতেই সে সুন্দর। আর গলার ভাঁজে মোটা সোনার হারটা থাকে বলেই কুমার শানু সবসময়েই কুমার শানু। যিনি পারেন, তিনি তার ভাষাকেও সাজিয়ে তোলেন। সেই সাজ কেমন হবে, তা ঠিক হয় কে বলছেন, কী বলছেন, কীভাবে বলছেন তার উপর নির্ভর ক’রে। মানে কথক আর কথার চরিত্র অনুযায়ী।

কেমন করে ভাষার সৃজনশীল ব্যবহার করব আমরা? ভাষার গয়না গাঁটিই বা কীরকম? পরের সপ্তাহে তাই নিয়ে আড্ডা মারা যাবে।

অধ্যায় ১ / ১৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন