১০। গাছতলার ভাষা, রাজসভার ভাষা সবই অমূল্য সম্পদ

সেকালের এক সাহেব পণ্ডিতের কাছে বাংলা শিখছিলেন। গদ্যভাষাটা বেশ সড়গড় হয়ে এলে, একদিন নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, ‘ওহে কর্ণধার, তরী তীরে আনয়ন করহ।’ কিন্তু কর্ণধার তাতে কানই দেয় না। শেষে এক হাটুরে মানুষ, ‘হেই মাঝি, নাও ভিড়া’ বলে হাঁক পাড়তে, সে একগাল হেসে লগি বাইতে শুরু করল। সাহেব তো হতভম্ব। আসলে তিনি জানতেন না, পণ্ডিতের কাছে যা শিখছেন তা পণ্ডিতি ভাষা, আমবাঙালির মুখের ভাষা নয়। প্রচলিত আর পণ্ডিতি ভাষার এই বিভাজন শুরু হয়েছে বহুযুগ আগে। যখন সাধারণ মানুষ কথা বলত প্রাকৃতে আর এলিটরা পড়াশোনা লেখালিখি করতেন সংস্কৃতে। এই কলম যারা নিয়মিত পড়ো তারা জানো, প্রাকৃতের মাগধী শাখা থেকে মাগধী অপভ্রংশ, তা ভেঙে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল। তাই বাঙালি কবি, পদকর্তা, পাঁচলিকাররা কখনই সাধারণ মানুষের ভাব-ভাষা-ইডিয়মকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারেননি। সতেরো শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে যা কিছু লেখা হয়েছে, সবই পদ্যে। পদ্য হলেও তা ছিল আমাদের ঘরের জিনিস। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পদ্যের সমুদ্র সাঁতরে গদ্যের ডাঙায় উঠলাম আমরা। মিশনারি আর পণ্ডিতদের উপর ভার পড়ল গদ্য ভাষা, সাহিত্য তৈরির। কেরির ‘কথোপকথন’ কিংবা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘প্রবোধ চন্দ্রিকা’র মতো দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, বাকি সব লেখকই তাঁদের বইয়ে প্রচলিত বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। হাত পেতেছিলেন সংস্কৃতর কাছে। হজম করতে চেয়েছিলেন সংস্কৃত ধাতু ও শব্দরূপ, ব্যাকরণ, মায় পদবিধি পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা বদহজম হল। গদ্য সাহিত্যের সঙ্গে আমবাঙালির দূরত্ব বাড়ল। বাংলা ভাষার ওই তৎসম কণ্টকিত সমাসবহুল আড়ষ্ট চেহারাকে ঠাট্টা করে বলা হল ‘পণ্ডিতি বাংলা’। পণ্ডিতি বাংলার গুমোর ঘোচানোর চেষ্টা করেছিলেন প্যারীচাঁদ আর কালীপ্রসন্ন। ‘আলালের ঘরে দুলাল’ বিশেষত ‘হুতোম প্যাঁচার নকসা’র আটপৌরে কলকাত্তাই বুলি মাত করে দিয়েছিল মানুষকে। কিন্তু লেখকেরা নিজেরাও জানতেন, এ ভাষায় রং তামাশা জমে, জীবনের মহার্ঘ অনুভূতির কথা বলা চলে না। তাই ‘মহাভারত’ অনুবাদের সময় কালীপ্রসন্ন মোটেই হুতোমি ভাষা ব্যবহার করেননি। সে ভালোই করেছেন। কিন্তু উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সৃষ্টির জন্য, যে কোনও ভাষারই একটা নমনীয়, শুচিবাইমুক্ত রূপের দরকার হয়। এমন রূপ যা রাজসভা থেকে গাছতলা যে কোনও পরিবেশকেই ফোটাতে পারে বিশ্বস্তভাবে। লঘু, গভীর, গম্ভীর, উদাত্ত, চটুল যে কোনও রসেই স্বচ্ছন্দ থাকে। নিজস্বতা বজায় রেখেও অন্য ভাষার ঋণ নিতে পারে অনায়াসে। আমাদের সৌভাগ্য, এই বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্য ঠিক সময়ে এগিয়ে এসেছিল বাবু বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের ঝরনা কলমটি।

বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন, যাকে বলে মেথাডিক্যাল ম্যান। তিনি যা করেছেন, ভেবেচিন্তে করেছেন। শেষ অবধি করেছেন। বাংলায় ভালো প্রবন্ধ পত্রিকা নেই, তো বার করো ‘বঙ্গদর্শন’। বাংলার ইতিহাস নেই, লেখো ইতিহাস। বাংলা উপন্যাস নেই, তো শুরু হোক ‘দুর্গেশনন্দিনী’ লেখা। এমন মানুষ বাংলা ভাষার দুর্বলতাগুলো জেনে বুঝে, নিজের দায়িত্ব বিষয়ে সচেতন হয়ে, কোমর বেঁধে নামবেন এটাই স্বাভাবিক। সেই সচেতনতার প্রমাণ আছে ‘বাঙ্গালা ভাষা’ নামের একটি প্রবন্ধে। বঙ্কিম লিখেছেন, ‘রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন সরলতা এবং স্পষ্টতা। যে রচনা সকলেই বুঝিতে পারে, অর্থগৌরব থাকিলে তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট রচনা।… বলিবার কথাগুলি পরিস্ফূট করিয়া বলিতে হইবে — তজ্জন্য ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহাই গ্রহণ করিবে। কেন না, যাহা অসুন্দর, মনুষ্যচিত্তের উপর তাহার শক্তি অল্প। সরল প্রচলিত ভাষা অনেক বিষয় সংস্কৃত বহুল ভাষা অপেক্ষা শক্তিমতী। কিন্তু যদি তাহাতে উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয়, সংস্কৃতবহুল ভাষার আশ্রয় লইতেই হইবে।’ লক্ষ করো, বঙ্কিম কিন্তু কেবল প্রচলিত ভাষার পক্ষে ওকালতি করছেন না। তাকে যে কোনও মূল্যে সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে বলছেন। তাই তাঁর লেখায়, হুতোমের মতো, আমবাঙালির মুখের কথা ধরা পড়েনি। কিন্তু মনের কথা ঠিক ধরা দিয়েছিল। লেখা হয়েছিল ‘দুর্গেশনন্দিনী’। প্রথম বাংলা উপন্যাস।

মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকে বঙ্কিমচন্দ্রের দুটো গদ্যাংশ পাঠ্য আছে। ‘রাজসিংহ ও মানিকলাল’ আর ‘বাবু’। তোমাদের প্রিয় মাস্টারমশাই আর দিদিমণিরা পড়ার পাতায় দুটো লেখা নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তোমরা জানো, প্রথমটার বিষয় হল রাজপুত রানা রাজসিংহের অ্যাডভেঞ্চার আর দ্বিতীয়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালিবাবুদের নিয়ে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ। প্রথমটা লেখা হয়েছে ছোটো ছোটো বাক্যে, তরতরে ভঙ্গিতে প্রায় নিরলঙ্কার গদ্যে। দ্বিতীয়টার ভাষায় আড়ম্বর অনেক বেশি। বেশি বলেই ব্যঙ্গটা এত মর্মভেদী। ধরো, তোমার এক বন্ধু কথায় কথায় পাংচুয়ালিটির বড়াই করে। সে একদিন আধঘণ্টা দেরি করে ক্লাসে এলো। মাস্টারমশাই বলতে পারেন ‘এই যে ও এসেছে।’ আবার এমনও বলতে পারেন ‘এই যে উনি পদার্পণ করেছেন!’ দ্বিতীয় বাক্যটায় মিস্টার পাংচুয়ালের প্রতি ঠাট্টার সুরটা খুব চড়া। তাই ভাষাও জমকালো। বঙ্কিমের ‘মুচিরামগুড়ের জীবনচরিত’ কিংবা ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ প’ড়ে দেখো। ভাষার এই ছদ্মগাম্ভীর্য, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মক সিরিয়াসনেস’ কী দুরন্ত কৌতুক সৃষ্টি করতে পারে তার হদিস পাবে। ‘রাজসিংহ ও মানিকলাল’-এ কিন্তু কোনও ঠাট্টার ব্যাপার নেই। অসম্ভব ঠাসবুনোট অ্যাকশান আছে। যার গতি হিন্দি সিনেমাকেও হার মানিয়ে দেয়। রাজসিংহ মিশ্রজিকে বলেছেন, ‘কি হইয়াছে অল্প কথায় বলুন’। ব্যাপারটা বুঝে নিয়েই কাজে নেমেছেন। কাজ অবশ্য এমন কিছু নয়। দুটো খুন, একটা জখম আর একজন গ্রেপ্তার। রানার কাছে এগুলো হেলাফেলা। লেখকও তাই একেকজনের জন্য এক এক লাইনের বেশি বরাদ্দ করেননি—’রাজপুত দৃঢ়মুষ্ঠিধৃত তরবারি দলপতির মস্তকে আঘাত করিলেন। তাঁহার হস্তে এত বল যে, এক আঘাতেই মস্তক দ্বিখণ্ড হইয়া ভূতলে পড়িয়া গেল।’ রাজসিংহ, মানিকলাল দুজনেই কম কথার লোক। মোটেই সেন্টিমেন্টাল নন। হৃদয়ের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার ইচ্ছা বা সুযোগ কোনওটাই তেমন পান না। তাঁদের সংলাপ তাই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু ছন্দোহীন নয়। যেমন, ‘বিজয়! এখানে থাকিও — আমি আসিতেছি — কোনও শব্দ করিও না।’ এই নির্দেশটা তো ভারী ভারী ধ্বনি, যুক্তাক্ষর দিয়ে, জটিল বাক্যেও প্রকাশ করা যেত। বলা যেত ‘বিজয়! আমি প্রত্যাগমন না করা পর্যন্ত নিঃশব্দে এই স্থানে অপেক্ষা করিও।’ এতে ভাবটা ঠিকই থাকত, কিন্তু সৌন্দর্য কমে যেত। বঙ্কিম লিখেছেন তিনটে সমান মাপের সরল বাক্য। তাদের আলাদা করেছেন দুটো ড্যাশে। নিয়মিত যতিপাতের ফলে তৈরি হচ্ছে ছন্দঃস্পন্দ। জোরে জোরে পড়লে, ব্যাপারটা নিজেরাই ধরতে পারবে।

পাত্রপাত্রী পালটে গেলে, ঘটনাস্থল আর পরিবেশ পালটে গেলে, বঙ্কিমের গদ্যও কেমন নিজের চেহারা বদলে ফেলে তা বুঝতে গেলে পাড়ার লাইব্রেরি থেকে রাজসিংহ উপন্যাসটা চেয়ে আনো। প্রথম পাতা খুলে দেখো। প্রথম পরিচ্ছেদের ঘটনাস্থল রূপনগরের চকমেলানো প্রাসাদ। ‘তন্মধ্যে একটি ঘর বড় সুশোভিত। গালিচার অনুকরণে শ্বেতকৃষ্ণপ্রস্তর রঞ্জিত হর্ম্ম্যতল; শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত নানা বর্ণের রত্নরাজিতে রঞ্জিত কক্ষপ্রাচীর।’ এ হল অন্তঃপুর। সুন্দরীদের বড়ো ভিড়। তাঁদের ‘নানাবিধ উজ্জ্বল কোমল বর্ণের দেহরাজি,— কেহ মল্লিকাবর্ণ, কেহ পদ্মরক্ত, কেহ চম্পকাঙ্গী, কেহ নবদূর্ব্বাদলশ্যামা।’ এই বর্ণনাতেও ছন্দস্পন্দ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তা হচ্ছে অসম্ভব অলংকৃত, ঝলমলানো ভাষায়। পরের প্যারাগ্রাফেই এক বুড়ি তসবিরওয়ালির দেখা মিলবে। মেয়েরা তাকে ঘিরে কী বলছে শোনো — ‘এ কাহার তসবির আয়ি?… এ দাড়ি যে আমি চিনি। এ আমার ঠাকুর দাদার দাড়ি।’ আর একজন বলিল, ‘সে কি লো? ঠাকুরদার নাম দিয়া ঢাকিস কেন? ও যে তোর বরের দাড়ি।’ পরে আর সকলের দিকে ফিরিয়া রসবতী বলিল, ‘ঐ দাড়িতে একদিন একটা বিছা লুকাইয়াছিল। সই আমার ঝাড়ু দিয়া সেই বিছাটা মারিল।’ রসবতীর উচ্ছ্বলতা প্রকাশ করার জন্য বঙ্কিম অনায়াসে নেমে এসেছেন লঘু চলতি ভাষার আঙিনায়। বঙ্কিমের আরও নানা লেখা যত পড়বে দেখতে পাবে, বিষয় অনুসারে কলমের ভঙ্গি কত বিচিত্র রকমের বদলে যায়। এ থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে আমাদের। কিন্তু তার মানে এই নয় ১৯৯৭ সালে বসে বঙ্কিমের মতো বাংলা লিখতে হবে। আমরা লিখব আমাদের কালের ভাষায়। মিনিবাসের কন্ডাকটাররা যদিও বলেন, ‘পিছনের দিকে এগিয়ে যান’, ভাষারীতির ক্ষেত্রে এই নির্দেশ অচল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন