৩। সকালবেলা কাটিয়া গেল বিকাল নাহি যায়

সকালবেলা কাটিয়া গেল বিকাল নাহি যায়

আমাদের পাড়ার জগদীশবাবু গত তিরিশ বছর ধরে কোনও এক অফিসে বড়োবাবুগিরি করেছেন। কাজপাগল মানুষ। সদ্য রিটায়ার করে একেবারে অথৈ জলে পড়ে গেছেন তিনি। রোজ বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে দেখি, নিজের তিনফুট বাই তিনফুট ব্যালকনিতে বসে আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। আমার মাথায় রোজই একটা কবিতার লাইন গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘সকালবেলা কাটিয়া গেল বিকাল নাহি যায়।’ সেই ছোট্টবেলা থেকে কত গল্প, কবিতাই তো পড়ে আসছি আমরা। আবার ভুলেও যাচ্ছি। তারই মধ্যে এমন নাছোড়বান্দা কিছু লাইন কেন গেঁথে যায় মগজে? রাস্তা পার হতে হতে, বাজারের খুচরো ফেরত নিতে নিতে, বেমক্কা মনে পড়ে, সকালবেলা কাটিয়া গেল…।

কী এমন আছে ওই আটপৌরে শব্দগুলোতে? সেটা বুঝতে গেলে আগে খোলা গলায় লাইনটা বার কয় আউড়ে যেতে হবে। তাহলে নিজের কানেই ধরা পড়বে একটা বিষণ্ণ মন্থর সুর। মনে হবে বিরাট দিনটা অলসভাবে বয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। শব্দগুলোও যেন গড়িয়ে চলেছে একঘেয়ে দুপুর পেরিয়ে অফুরন্ত বিকেলের দিকে। কবি যদি লিখতেন, ‘সকালবেলাটা কাটিয়া গেল, নাহি যাইতেছে বৈকাল’ তাহলেও মানেটা একই থাকত। কিন্তু ওই মন্থর গতির অনুভবটা থাকত না। আসল কথা, বড়ো কবিরা যা বলতে চান, সেই বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বলার একটি ভঙ্গিও আবিষ্কার করেন। সেই ভঙ্গিটা লুকিয়ে থাকে শব্দনির্বাচন আর তা সাজানোর কায়দায়। যেমন ধরা যাক, আমরা সারা দুপুর চিড়িয়াখানায় হুল্লোড় করেছি। তারপর সব ভাইবোন মিলে ট্যাক্সি চেপে চলেছি ‘জুরাসিক পার্ক’ দেখতে। জগদীশবাবুর ক্লান্ত মানসিকতার সঙ্গে আমাদের তরতাজা মনগুলো নিশ্চয়ই মিলবে না। তাই আমাদের কথা বলতে গেলে, বলার ভঙ্গিও পাল্টাতে হবে কবিকে। হয়তো তিনি লিখবেন, ‘সক্কাল কাটতেই এল বৈকাল’। অমনি তৈরি হবে টাট্টু ঘোড়ার মতো ছটফটে চলন। এই নতুন লাইনটা দু-চারবার পড়লেই ধরতে পারবে সেটা। দেখবে এভাবে সাজালে প্রত্যেক শব্দের গোড়ায় একটা stress বা শ্বাসাঘাত পড়ছে। তাতেই আরও টগবগিয়ে উঠছে লাইনটা।

কোন কবিতা কেমন গতিতে পড়তে হবে, পড়ার সময় লাইনের কোথায় কোথায় থামতে হবে, কবিই সেটা নির্দিষ্ট করে দেন। আমরা অসচেতনভাবেই তাঁর নির্দেশ মেনে চলি। বিশ্বাস না হয় পরীক্ষা করে দেখো। আমাদের প্রথম উদাহরণটা পড়তে দাও যে কোনও পাঁচজনকে। সকলেই পড়বেন ‘সকালবেলা / কাটিয়া গেল / বিকাল নাহি / যায়।’ অর্থাৎ লাইনটাকে ভেঙে নেবেন চারটে টুকরোয় বা পর্বে। প্রথম আর তৃতীয় পর্বের পর, প্রায় বোঝা না যাওয়ার মতো অল্প একটু ফাঁক দেবেন। ‘কাটিয়া গেল’র পর থামবেন তুলনামূলকভাবে বেশিক্ষণ। লাইনটা তো এক নিঃশ্বাসেই পড়ে ফেলা যায়। কিন্তু তাতে মন্থর গতিটা হারিয়ে যেতে পারে। তাই কবি যেন তিনটে হার্ডলস সাজিয়ে রেখেছেন, দুটো ছোটো আর একটা একটু বড়ো। হার্ডলগুলো যদিও অদৃশ্য তবু একটুও এধার-ওধার করার জো নেই। কেউ যদি পড়েন ‘সকাল / বেলা কাটিয়া / গেল / বিকাল নাহি / যায়।’— তাহলে বাচ্চারাও হেসে উঠবে।

কিন্তু সকলকেই ওই নির্দিষ্ট জায়গাগুলোয় থামতে বাধ্য করার উপায়টি কী? গুণে দেখো, কবি মোট সতেরোটা সিলেবল ব্যবহার করেছেন। তারপর পাঁচটা করে সিলেবল বেঁধে দিয়েছেন এক একটা পর্বে। তিন পাঁচে পনেরো, হাতে রইল দুই। সেই দুটো সিলেবল ঝুলে আছে লাইনের শেষে, অপূর্ণ পর্ব হিসেবে।

অবশ্য এত সহজ নিয়মে যে কোনও লাইনকে ভাঙা যায় না। তার আরও যে সব কায়দাকানুন আছে, তোমরা বড়ো হয়ে নিজেরাই শিখে নিতে পারবে। আপাতত এটুকু জানা যথেষ্ট যে — ১। একটি কবিতা লেখার সময় শব্দ খুঁজে বার করা আর তা সাজানোর মধ্যে কবি এক ধরনের প্যাটার্ন তৈরি করেন। তাকেই বলি ছন্দ। ২। ওই প্যাটার্ন কেমন হবে তা নির্ভর করে কবিতার ভাবের ওপর। ৩। যে কোনও ছন্দোবদ্ধ লাইনেরই একটা নিজস্ব চলন থাকে, যা কখনও ধীর, কখনও মাঝারি, কখনও দ্রুতগতির। ৪। লাইনটা পড়ার সময় জায়গা মতন অল্পস্বল্প থামতে হয় আমাদের। এর ফলে পাওয়া যায় অনেকগুলো পর্ব। পর্বগুলো যতদূর সম্ভব সমান মাপে সাজানো থাকে।

ছন্দের এই যে প্রাথমিক সূত্রগুলো শিখলে, এগুলো মাথায় রাখলে পাঠ্যকবিতাগুলো পড়া সহজ হবে, বোঝাও। বুঝে শুনে পড়তে পারলে, ধীরে ধীরে ছন্দের কান তৈরি হবে। তারপর একদিন, বলা যায় না, নিজেরাও লিখে ফেলতে পারো দু-এক কলম কবিতা। অবশ্য তার আগে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সূত্রগুলো মিলিয়ে নেওয়া দরকার। ধরা যাক নজরুলের ‘ছাত্রদলের গান’ — ‘সবাই যখন / বুদ্ধি জোগায় / আমরা করি / ভুল। / সাবধানীরা / বাঁধ বাঁধে সব / আমরা ভাঙ্গি / কুল।’ কবি যদিও বাঁধ ভাঙার কথা বলছেন, তবু কথাগুলো বেঁধেছেন নির্দিষ্ট নিয়মে। প্রত্যেক লাইনে চার পর্ব। বড়ো পর্বগুলো সব চার সিলেবল-এর। প্রত্যেক পর্বের গোড়ায় শ্বাসাঘাত পড়ছে। তাই লাইনগুলো ছুটছে হইহই করে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ভোরাই কবিতার মধ্যেও এইরকম তারুণ্য আর উচ্ছ্বাস আছে। তিনিও শব্দ সাজিয়েছেন এ রকম খুশিয়াল গতিতে— ‘কল্পনা আজ / চলছে উড়ে / হালকা হাওয়ার / খেল খেলে’। ‘বিভীষণের প্রতি ইন্দ্রজিৎ’ পদ্যাংশের বিষয় কিন্তু মোটেই এমন চপল নয়। বরং উল্টো— ‘এতক্ষণে / অরিন্দম / কহিলা বি / ষাদে’…। লক্ষ করো, এখানেও চার সিলেবল-এর পর্ব। কিন্তু গতিটা একদম আলাদা। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে রাজপুত্র বলে যাচ্ছেন তাঁর শেষ কথাগুলো। স্বাভাবিকভাবেই এর চলন ধীর, গভীর, গম্ভীর।

আজ শুধু কবিতা নিয়ে কথা হল বলে একথা ভেবো না যে ছন্দ শুধু কবিতাতেই থাকে। ছন্দ থাকে গদ্যে, এমনকি আমাদের সাজগোজ, হাবভাব, হাঁটাচলা সব কিছুতেই। সে জন্যই আমরা বলি— অমুক ছেলেটার কোনও ছিরিছাঁদ নেই! আগামী সাতটা দিন পদ্যের ছিরিছাঁদ খোঁজার চেষ্টা করো তোমরা। ভবিষ্যতে গদ্যভাষার ছন্দ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন