৮। বাংলা গদ্য : সময়ের সঙ্গে যে ভাবে হাঁটছে

বাংলা গদ্য : সময়ের সঙ্গে যেভাবে হাঁটছে

মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা টেক্সটে অনেকগুলো গদ্য পদ্য পড়তে হয় তোমাদের। সেগুলো সব কিন্তু এক সময়ে লেখা হয়নি। যদি লেখার সময় অনুযায়ী একটা তালিকা বানাতে চাও, তা হলে সবচেয়ে আগে আসবে কৃত্তিবাসের ‘রামের বিলাপ’। প্রায় ছ’শো বছর আগে লেখা ‘শ্রীরাম পাঁচালি’র অংশ এটি। তারপর ‘পূর্বরাগ’। পদকর্তা চণ্ডীদাস ঠিক কোন সময়ের লোক তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর তর্ক আছে। তবু ধরে নেওয়া যায়, পাঠ্যপদটি পঞ্চদশ শতকের রচনা। এরপর দু’শো বছর পেরিয়ে এলে পাওয়া যাবে ‘অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরীপাটনী’। কবির নাম ভারতচন্দ্র। ১৭৬০ সালে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটি যুগ শেষ হল। আরও একশো বছর পর পাচ্ছি অক্ষয়কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর, মাইকেলের রচনা। বঙ্কিমচন্দ্রকেও এঁদের প্রায় সমসাময়িক বলা যেতে পারে। ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদিগের দুরবস্থা বর্ণন’, ‘ভরত ও দুষ্মন্তের মিলন’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র দুটি পাঠ্য অংশ, ‘বাবু’, ‘রাজসিংহ ও মানিকলাল’ এই সব লেখাই প্রকাশিত হয়েছে উনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে। যেগুলো বাকি রইল, সব বিশ শতকের রচনা। এ সবই বাংলা ভাষায় লেখা। কিন্তু প্রত্যেকের শব্দ ব্যবহার, বাক্য সাজানোর কৌশল, ছন্দ ও ধ্বনির ব্যবহার আলাদা রকমের। তার কারণ শুধু এই নয় যে লেখকেরা আলাদা মানুষ। আসল কথা হল, তারা আলাদা সময়ের মানুষ। অক্ষয়কুমার আর বিদ্যাসাগর দুজনেরই জন্ম ১৮২০ সালে। যে যার মর্জি অনুসারে লিখেছেন বলে, ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদিগের দুরবস্থা বর্ণন’ আর ‘ভরত ও দুষ্মন্তের মিলন’-এ অনেক ভাষাগত ফারাক আছে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে অনায়াসে বোঝা যাবে দুজনে একই সময়ের গদ্যকার। ১৮৬০ সালে বসে, অক্ষয়কুমারের পক্ষে সম্ভবই ছিল না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (পদ্মা নদীর মাঝি / ১৯৩৬) মতো ভাষা ব্যবহার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই পাল্টায়। মানুষ বুড়ো হয়, মারা যায়, তারপর নতুন নতুন মানুষেরা আসে। তাদের সমাজ বদলায়, বলার কথা, বলার ভঙ্গি বদলায়। ভাষা তো বদলায়ই। আগে বদলে যায় মুখের ভাষা। তারপর লেখার। লেখকেরা সাধারণত তার সময়ের সবচেয়ে চালু ভাষারীতিতে কলম চালাতে চান। তেমনি সেই ভাষাকে ঘষে মেজে আরও সুন্দর করার চেষ্টা করেন। কৃত্তিবাস থেকে সুকান্ত ভট্টাচার্য সকলেই যে যার সাধ্যমতো সে কাজে হাত লাগিয়েছেন।

কেমন করে ভালো বাংলা লিখতে হয়, তা নিয়ে অনেকদিন ধরে কথা বলছি তোমাদের সঙ্গে। বলেছি শব্দ, ছন্দ, ধ্বনি, তুলনা, ভাষার আরও নানা গয়নাগাঁটির কথা। কিন্তু এ সব কায়দাকানুন তো কোনও আলাদিনের দৈত্য এসে একদিনে তৈরি করে দিয়ে যায়নি। এর জন্য হাজার বছর ধরে কত মানুষ কত ঘাম ঝরিয়েছেন। দীর্ঘ এক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমাদের কলমে এসেছে আজকের বাংলা। টেক্সট বইয়ে আচমকা ওই বিবর্তনের দু’একটা বাঁকের মুখোমুখি হও তোমরা। তাই চণ্ডীদাসী পদ শুনলেই বিরক্ত লাগে। কৃত্তিবাসী ভাষা শুনলে হাসি পায়। কিন্তু যে ভাষায় আমরা ভালোবাসি, গান গাই, স্বপ্ন দেখি, তার ঐতিহ্যকে না জানলে তো চলবে না। শিকড়হীন গাছের পাতায় জল ঢেলে লাভ নেই। তাই এসো, আজ একেবারে শুরুর থেকে শুরু করা যাক।

যিশুখ্রিস্ট জন্মানোর দেড় হাজার বছর আগেকার কথা। দক্ষিণ এশিয়া থেকে এক দল যাযাবর মানুষ ঘোড়া ছুটিয়ে এসে পৌঁছোলেন সিন্ধুনদের দেশ ভারতে। এরা নিজেদের বলতেন আর্য। আর্যরা এ দেশে বসতি স্থাপন করলেন। এখানকার জল-হাওয়া সভ্যতার সঙ্গে তাদের সংস্কৃতির মিলন হল। তৈরি হল ঋক বেদ। বৈদিক ভাষাকে আর্যদের পোশাকি ভাষা বলা যায়। দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগত কথ্য সংস্কৃত। পাণিনি নামের এক পণ্ডিত ওই কথ্য ভাষাকে ব্যাকরণের নিয়মে বাঁধেন। এদিকে আর্যরা যতই সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ছেন, বৈদিক আর সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে ততই মিশে যাচ্ছে নানা আঞ্চলিক উপাদান। বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হচ্ছে পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ। রাজা অশোকের অনুশাসনগুলোর দৌলতে পালি ভাষার কথা তো তোমরা জানোই। প্রাকৃতের নমুনা আছে বেশ কিছু শিলালিপিতে, পুঁথিতে, বিশেষত সংস্কৃত নাটকের অশিক্ষিত মানুষজনের সংলাপে। এ থেকে বোঝা যায়, সংস্কৃত জানা এলিটরা প্রাকৃতকে একটু নিচু নজরে দেখতেন। কিন্তু সারা ভারত জুড়ে পাঁচ ধরনের প্রাকৃতভাষার রাজত্ব চলেছিল প্রায় হাজার বছর। তারপর প্রত্যেকটা প্রাকৃত থেকে এক একটা অপভ্রংশ তৈরি হতে থাকে। মোটামুটি ন’শো খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অপভ্রংশ ভাষা ভেঙে আমাদের চেনা ভারতীয় ভাষাগুলো, যেমন পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি ইত্যাদির যাত্রা শুরু। পূর্বভারতে চলত মাগধী প্রাকৃত। তা থেকে মাগধী অপভ্রংশ। দশম শতাব্দীতে মাগধী অপভ্রংশ থেকে জন্ম হল বঙ্গ-অসমিয়ার। বুঝতেই পারছ, এর পরের ধাপেই পাওয়া যাবে দুটো আলাদা ভাষা—অসমিয়া আর বাংলা।

১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই নেপাল থেকে খুঁজে এনেছিলেন ‘চর্যাপদের পুঁথি’। চর্যাপদ হল বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরোনো নিদর্শন। বৌদ্ধ সাধকদের লেখা ছোটো ছোটো কবিতা। এরপর পাবো চোদ্দশো-খ্রিস্টাব্দে লেখা বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। সেই পুঁথির আবিষ্কারক বসন্তরঞ্জন রায়। চর্যা বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা যে বাংলাই এক নজর দেখে তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু পণ্ডিতেরা বাংলা শব্দ, বিভক্ত, অনুসর্গ, ছন্দ ইত্যাদির আদি চেহারা খুঁজে বার করেছেন তা থেকে। যেমন ধর, সংস্কৃত ‘অস্মাভি’ শব্দটা থেকে প্রাকৃতে এসেছিল ‘অমহাহি’। তা থেকে চর্যার ‘আমহে’, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ‘আহ্মে।’ এরই আজকের চেহারা ‘আমি’।

মজার ব্যাপার হল, বড়ু চণ্ডীদাস আর কৃত্তিবাসের মধ্যে সময়ের ব্যবধান বড়োজোর একশো বছর। কিন্তু কৃত্তিবাসের ভাষা বুঝতে তো কোনও অসুবিধা হয় না আমাদের। এইটুকু সময়ের মধ্যে বাংলার এমন বৈপ্লবিক তফাত ঘটল কীভাবে? আসলে, চর্যা আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথি মোটেই বহুলপ্রচারিত ছিল না। কিন্তু কৃত্তিবাস অথবা ‘পূর্বরাগ’এর রচয়িতা চণ্ডীদাসের লেখা বাঙালিরা নকল করেছেন, নকলের নকল করেছেন অসংখ্যবার। আর কপি করতে ব’সে সকলেই একটু আধটু বদলে নিয়েছেন মূল ভাষাকে। ‘রামের বিলাপ’ আর ‘পূর্বরাগ’-এর আসল চেহারা ঠিক কী ছিল তা আর জানার উপায় নেই। মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বাংলায় আরবি, ফারসি শব্দ, বাকবিধি মিশতে শুরু করেছিল। বৈষ্ণব কবিরা বয়ে আনেন মৈথিল ভাষার প্রভাব। তারপর এল মঙ্গল কাব্যের যুগ। মনসা, চণ্ডী এইসব মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীরা সকলেই ছিলেন সমাজের নিচুতলার মানুষদের আরাধ্য। স্বাভাবিকভাবেই এ সব রচনায় আনাগোনা শুরু হল লৌকিক ভাষারীতি আর দেশি শব্দের। ইতিমধ্যে এক হাতে বাইবেল, এক হাতে বাণিজ্যের ছাড়পত্র নিয়ে হানা দিয়েছে ইংরেজ। ১৭৬৫ সালে তারা সরাসরি ঢুকে পড়েছে বাংলার শাসক মণ্ডলে। ইংরেজরা বুঝেছিল, ধর্মপ্রচার, বাণিজ্য কিংবা দেশশাসন কোনওটাই স্থানীয় ভাষার বিকাশ ছাড়া সুষ্ঠুভাবে করা যাবে না। বিজাতীয় আরবি, ফারসি, ইংরেজির বদলে চাই বাংলা। পদ্যের লালিত্য নয়, চাই কেজো গদ্যের চর্চা। তাদের উদ্যোগেই জন্ম নিয়েছিল বাংলা গদ্য, যার বয়স মাত্র একশো সাতানব্বই বছর। নড়বড়ে পা ফেলতে ফেলতে কেমন ক’রে হাঁটতে শিখল আমাদের গদ্য ভাষা? সে গল্প আরেকদিন করা যাবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন