৫। শব্দের মজা মজার শব্দ

আমাদের ছোটোবেলাটা ছিল গল্প দিয়ে ঘেরা। সন্ধে হলেই দাদুর কোলঘেঁষে বসতাম। তিনি দুই আঙুলে নস্যির টিপ ধরে অনর্গল বলে যেতেন রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, পুরাণ মায় গোপাল ভাঁড়ের গল্প। সেইসব গল্প বলিয়ে দাদু-ঠাকুমারা কোথায় হারিয়ে গেলেন কে জানে! উপেন্দ্রকিশোর, রাজশেখর বসুও তেমন বিক্রি হন না। এখন তাদের জায়গা নিয়েছেন রামানন্দ সাগরেরা। গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে সিরিয়াল হচ্ছে, তার কথা সবাই জানো। ভারতচন্দ্র টিভিতে চান্স পাননি, তাই অন্নদামঙ্গলের গল্প জানে না অনেকেই। মাধ্যমিকে ‘অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরী পাটনী’ বলে যে কবিতাটা আছে, সেটা অন্নদামঙ্গল থেকে তুলে আনা। লিখেছিলেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। ইনি গোপালের সমসাময়িক মানুষ। দুজনেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভা আলো করে থাকতেন। ভাষার কারুকাজে রায়গুণাকর ছিলেন ওস্তাদ। তাই তাকে নিয়ে পদ্য লেখা হয়েছে, ভারত ভারতখ্যাত আপনার গুণে।’ লক্ষ করো, এই লাইনটাতেও রয়েছে শব্দের খেলা। ভারত শব্দটা ব্যবহার হচ্ছে দু’বার দু’রকম অর্থে। প্রথমটার মানে কবি ভারতচন্দ্র, দ্বিতীয়টার ভারতবর্ষ। এই কায়দাটা আরও অনেক লেখাতেই দেখে থাকবে তোমরা। অন্নদাশঙ্করের ছড়ায় আছে, ‘মশায়, দেশান্তরী করলে আমায় কেশনগরের মশায়।’ প্রথম মশায় হল সম্বোধন। দ্বিতীয়টার মানে নিশ্চয় বলে দিতে হবে না, যারা এখনও বোঝোনি, তাদের জন্য আর একটা ছড়া— ‘ক্লোরোকুইন খেতেই হল কিংখানের কুইনকে / করতে বাজার শ্যামবাজারে এসেছিলেন যেদিনকে। / পুরসভার মান বাঁচেনি কামান যতই দাগুন না / আগুন হয়ে ইউ এন ওতে নালিশ করেন জেমাইমা।’ জেমাইমা সত্যিই কোনও দিন মশার কামড় খেয়েছিলেন কি না সেটা বড়ো কথা নয়। আসল ব্যাপার হল, এই ছড়াটার মধ্যেও রয়ে গেছে ক্লোরোকুইন-কুইন, বাজার-শ্যামবাজার, কামান-মান, আগুন-দাগুন। অর্থাৎ একই শব্দ বা শব্দের টুকরো ব্যবহৃত হচ্ছে একাধিক বার, একাধিক অর্থে।

ঈশ্বরী পাটনী কবিতায় শব্দ নিয়ে আরেকরকম মজা করেছেন কবি। একেকটা শব্দ একবার মাত্র ব্যবহার করেই তার দু’রকম মানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফলে গোটা কবিতাটাই একটা হেঁয়ালির চেহারা পেয়েছে। অন্নদা বলছেন, ‘অতি বড় বৃদ্ধপতি সিদ্ধিতে নিপুণ।’ অর্থাৎ তাঁর স্বামী হলেন সিদ্ধিদাতা ভগবান। আবার একরকম নেশার জিনিসকেও সিদ্ধি বলে। তাই পাটনী ভাবছে অন্নদার স্বামী বুঝি সিদ্ধিখোর বুড়ো। তেমনি ‘অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম’ এই লাইনের বাম শব্দটা। বামদেব শিবের অন্য নাম, আবার বাম মানে বিমুখ। যাঁরা মুখে ভালো কথা বলতে পারেন তাঁদের কথার ভাঁজেও লুকিয়ে থাকে এরকম হেঁয়ালি। যেমন রবীন্দ্রনাথ। একদিন নৃত্যনাট্যের অনুষ্ঠান শেষে গ্রিনরুমে বিশ্রাম করছেন, একজন শুধোল ‘চা খাবেন?’ কবি উত্তর দিলেন ‘নাগো, আমি নটীর দলে।’ নটী মানে কিন্তু কেবল নর্তকী নয়, No Tea অর্থাৎ চা না খাওয়ার দল।

অনেক সময় দেখবে, পাশাপাশি এমন দুটো শব্দ লেখা বা বলা হচ্ছে যাদের মানে একই। যেমন পাঠসংকলনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কবিতার ‘জাতিকুল’। কিংবা ‘কাগজপত্র’, যা আমরা হামেশা বলে থাকি। নজরুল লিখেছেন, ‘দুর্গমগিরি কান্তারমরু দুস্তর পারাবার / লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’ রাত্রি তো নিশীথেরই প্রতিশব্দ। তাহলে এমন পুনরুক্তির দরকারটা কী? দরকার, কারণ ‘রাত্রি-নিশীথে’ শুনলেই যে বিরাট অন্ধকারের কথা মনে হয়, একটা বিচ্ছিন্ন শব্দে সেইভাব জাগত না। একই কারণে আমরা ব্যবহার করি বিশ্বজগৎ, তনুদেহ—সমার্থক দুটো শব্দের যুগলবন্দী। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কবিতায় জসিমউদ্দিন আরও একটা মজার শব্দ লিখেছেন— ‘ঝলমলমল’। মাঠের বুক ধানের শিসে উছলে উঠলে বাতাস ঝলমলমল গান গায়। কথাটার এমনিতে কোনও মানে নেই, কিন্তু ওর পেটে লুকিয়ে আছে তিন তিনটি শব্দ — ঝলমল, মল আর মলমল। কবি বলতে চান, বাতাসের গান আনন্দের রঙে ঝলমলে, মল বা নূপুরের মতো ছন্দোময় আর মলমলের মতো নরম। একে বলে বাক্স শব্দ। আজগুবি ছড়ায় প্রায়ই বাক্সশব্দ খুঁজে পাবে। যেমন সত্যজিৎ রায়ের ছড়া, ‘নাসিকের সাহেবের বাহারের নাসিকা / বাঁশি হয়ে বাজে সেটা, লোকে বলে বাঁশিকা।’ বাঁশিকার মধ্যে বাঁশি আছে, নাসিকাও আছে।

এর আগে ভাষার তিনরকম গয়নার কথা বলেছিলাম তোমাদের—ছবি, ছন্দ আর ধ্বনি। কারুকাজ করা শব্দ হল সবচেয়ে দামি গয়না। শব্দের যে কত বিচিত্র, কত মজাদার প্রয়োগ হতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরও আলোচনা করা যাবে। আপাতত যা শিখলে সেটুকুই কাজে লাগানোর চেষ্টা করো না! বন্ধুকে বল, ‘কাগজপত্র পড়া খুব দরকার / তাই আজকাল পড়ি প্রতি বুধবার। / বুধসভা জমে গেছে হরেকরকমবায় / শব্দের ব্যবহারে বল কে বা কম যায়?’ বলার আগে কাগজপত্র, আজকাল, বুধবার, বুধসভা, হরেকরকমবা— এইসব শব্দগুলোর মজাটা ভালো করে বুঝে নিতে ভুলো না যেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন