৪। ধ্বনির ম্যাজিক ভাষায়

ধ্বনির ম্যাজিক ভাষায়

রবীন্দ্রনাথ কুসমীদিদিকে বাচস্পতির গল্প শুনিয়েছিলেন। বাচস্পতি নাকি কথা বলতেন ডুন্ডুম্মানিত ভাষায়। সে ভাষায় পণ্ডিতকে বলে পেডেন্ডো, সম্রাটকে বলে সম্মমরাট। লোকে এ সব শব্দের মানে জানতে চাইলেই বাচস্পতি খেপে যেতেন। বলতেন, ‘শব্দের আপন কাজই হচ্ছে বোঝানো। তাকে আবার বোঝাবে কে?’

সমস্যাটা বুঝিয়ে বলা যাক। আমাদের সকলেরই একটা করে নাম আছে। কিন্তু কোন মানুষটার কী নাম দেওয়া হবে তার কোনও নিয়ম নেই। যার নাম হরিপদ, তাকে রাহুল নাম দিলেও কিছু এসে যেত না। রাহুল যে রাহুল আর হরিপদ যে হরিপদ, তার কারণ ওদের অভিভাবকরা সবাই মিলে ওই নামটাই ঠিক করেছেন। আমরা আলাপের গোড়াতেই নামটা জেনে নিই। তারপর চেনা মহলে সেই নাম বলামাত্র সকলে বুঝতে পারেন কার কথা বলা হচ্ছে। তেমনি কোনও ভাষা তৈরি হওয়ার সময়, সেই ভাষা ব্যবহারকারীরা এক একটা জিনিসের জন্য এক একটা শব্দ বা নাম বরাদ্দ করেন। যেমন চার দেয়ালওয়ালা থাকার জায়গাকে বাংলায় বলা হয় বাড়ি, রান্নার গোল পাত্রকে হাঁড়ি। এ ক্ষেত্রেও কিন্তু বাড়ি জিনিসটার সঙ্গে তার নামের কোনও নিশ্চিত যোগাযোগ নেই। থাকার জায়গাকে হাঁড়ি আর রান্নার পাত্রকে বাড়ি বললেও কোনও ক্ষতি হত না। কোনও অচেনা মানুষের নাম শুনে মানুষটা কে বা কেমন বোঝা যায় না। তেমনি অচেনা শব্দ শুনলেও তার মানে বুঝতে পারি না আমরা। সে জন্য অভিধান দেখতে হয়। প্রত্যেক ভাষার আলাদা আলাদা অভিধান। কারণ, নিজেদের খুশিমতো বাঙালিরা যাকে বাড়ি বলছেন, হিন্দিওয়ালারা তাকেই বলছেন মকান, ইংরেজরা হোম।

বাচস্পতি এই সমস্যাটার গোড়ায় ঘা মারতে চেয়েছিলেন। তিনি এমন এক ভাষায় কথা বলতেন, যার শব্দগুলো শোনামাত্র মানেটা মোটামুটি আন্দাজ করা যাবে। যেমন ধরো, খুব লেখাপড়া জানা লোককে আমরা বলতে পারি পড়ুয়া। কিন্তু শব্দটা শুনতে কেমন পলকা লাগে। ক্লাস টেনের ফার্স্ট বয়কে হয়তো পড়ুয়া বলা যায়, তার মাস্টারমশাইকে বলা উচিত পণ্ডিত। পণ্ডিত শব্দটা পড়ুয়ার তুলনায় অনেক ভারী। যিনি পণ্ডিতের চেয়েও বড়ো পণ্ডিত তার জ্ঞানকে বোঝানোর মতো কোনও শব্দ আমাদের হাতে নেই। বাচস্পতি তাকেই বলবেন পেডেন্ডো। শুনলেই মনে হয়, হ্যাঁ, বিদ্যার ভার আছে বটে। এঁকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য দশ বিশজন ডিগ্রিধারী জওয়ানের দরকার হয়।

আসলে, কথা বলার সময় আমরা যে সব ধ্বনি ব্যবহার করি তার প্রত্যেকটার এক একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। কেউ পাখির মতো ছটফটে, কেউ বা পাথরের মতো ভারী। একটু খেয়াল করে শুনলেই এই তফাতটা কানে ধরা পড়ে। বোঝা যায় ড় ধ্বনির চাইতে ড-এর ভার বেশি। একটা হালকা ব্যঞ্জন ধ্বনির মাথায় ভার চাপালে, অর্থাৎ যুক্ত ব্যঞ্জন তৈরি হলে তার ওজন বাড়ে। সে জন্যই পণ্ডিতের থেকে পড়ুয়ার বিদ্যা কম ঠেকে। আর পেডেন্ডো শব্দটা এত জাঁদরেল শোনায়।

ধ্বনি বলতে আমরা কী বুঝেছি সেটা এই বেলা ব’লে নেওয়া ভালো। সব মানুষের গলাতেই বাগযন্ত্র থাকে। সেখান থেকে আওয়াজ বের হয়। সেই আওয়াজের সবচেয়ে ছোটো টুকরোকে বলে ধ্বনি। যেমন অ, আ, উ—এগুলো হল স্বরধ্বনি; ক, চ, প—এগুলো হল ব্যঞ্জনধ্বনি। শব্দের মানে কী আর সেটা শুনতে কেমন—এই দুইয়ের মধ্যে সমঝোতা ঘটানো যায় ঠিকঠাক ধ্বনি ব্যবহার করলে। অনেক সময় অসচেতনভাবে হলেও, সেই চেষ্টা করি আমরা। যেমন, উ ধ্বনিটা লাগাই ছোটো বা নরম কিছু বোঝাতে। অ বা ও ব্যবহার করি বড়ো কিংবা শক্তের বেলায়। কাঠবেড়ালি বাদাম খায় কুটকুট করে। মানুষ শক্ত ছোলাভাজা খায় কট কট করে। বাচ্চারা হাঁটে গুটগুটিয়ে, বাবু হাঁটেন গটগটিয়ে। জুতো সকলেই পরে, কিন্তু খোকা পরে লাল জুতুয়া।

আমরা অসচেতনভাবে যা করি, লেখকরা সেটাই করেন সচেতনভাবে। সঠিক ধ্বনিটা খুঁজে পাওয়ার জন্য রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হয় তাঁদের। কবিতার এক একটা শব্দ লেখেন, কেটে দেন, আবার লেখেন। আগের সপ্তাহগুলোয় ভাষার দু’রকম গয়নার কথা বলেছিলাম তোমাদের — ছবি আর ছন্দ। অর্থের সঙ্গে মাননসই ধ্বনির ব্যবহার হল গয়না নম্বর তিন। সকলের শোনা দুটো রবীন্দ্রসংগীতের উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা সহজ হবে। দুটোই বর্ষা ঋতুর গান — ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে’ আর ‘শ্রাবণের গগনের গায়, বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়।’ আষাঢ়, শ্রাবণ দুটোই তো বর্ষার মাস। প্রথম গানটায় শ্রাবণ আর দ্বিতীয়টায় আষাঢ় ব্যবহার করলে কি কোনও ক্ষতি হত? হত, কারণ প্রথম গানে কবি দিগন্ত জুড়ে এঁকেছেন ঘন কালো মেঘ। সন্ধ্যা যত এগিয়ে আসছে, আকাশও তত থমথমে হয়ে উঠছে। এই অনুভবটা প্রকাশ করার জন্য ষ আর ঢ় এই দুটো ভারী ধ্বনি দরকার ছিল। দ্বিতীয় গানের অনুভব ঠিক উল্টো রকম। এখানে বৃষ্টি যেন ঘুঙুর পরা নাচিয়ে। তার লঘু আনন্দকে উসকে দিচ্ছে শ, র, ণ এই সব চটুল ধ্বনিগুলো।

মাধ্যমিকের পাঠ্য ‘নববর্ষা’ কবিতাতেও বর্ষার এমন খুশিয়াল চেহারা ধরা পড়েছে। ‘নয়নে আমার সজল মেঘের / নীল অঞ্জন লেগেছে, নয়নে / লেগেছে’—এই লাইনটা পড়ামাত্র একটা স্নিগ্ধ নরম অনুভূতি হয়। ন, ল, ঞ, ধ্বনিগুলোর পৌনঃপুনিক ব্যবহারই তার কারণ। লাইনটা কিন্তু অন্যভাবেও লেখা যেত — ‘চক্ষে আমার পয়োধর তার / ধূপছায়া রং দিয়েছে, লাগিয়ে / দিয়েছে।’ এতে যে কবিতার সৌন্দর্য অনেক কমে যেত, তাতে সন্দেহ নেই, অথচ মানেটা একই আছে। আসলে এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে খ, ধ, দ, গ এই সব ধ্বনি, যাদের মধ্যে চপল আনন্দের ভাব আদৌ নেই। আবার এই নববর্ষা কবিতাতেই অন্য এক লাইনে গ ধ্বনিটাকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন কবি, — ‘গুরুগুরু মেঘ গুমরি গুমরি / গরজে গগনে গগনে, গরজে / গগনে।’ যেন মেঘের ডাক আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে গড়িয়ে গেল। লাইনের গোড়ায় গ-এর সঙ্গে আছে উ স্বরধ্বনি, শেষে অ। তাই মনে হয় মেঘের ডাক যেন ক্ষীণভাবে শুরু হয়ে ক্রমশ বেড়ে উঠছে। প্রায় স্টিরিওফোনিক এফেক্ট। তোমরাও ধ্বনির ম্যাজিক ভাষায় ধরার চেষ্টা করে দেখো না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন