৯। বাংলায় ছাপা বাঙালির লেখা প্রথম বই

বাংলায় ছাপা বাঙালির লেখা প্রথম বই

গত সপ্তাহে লিখেছিলাম, বাংলা গদ্যের বয়স এখন একশো সাতানব্বই বছর। মানে তার জন্ম হয়েছিল আঠারোশো সালে। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে ভাষা বয়ে চলে নদীর মতো। যুগ যুগ ধরে হরেক মানুষের আশা, স্বপ্ন, সংস্কৃতি এসে মেশে তাতে। পলি জমে জমে খাতবদল হয় নদীর। তেমনি ভাষাও বদলে যায়, ধীরে ধীরে। বাংলা ভাষার এই বহতা স্রোতের মধ্যে ঠিক আঠারোশো সালের স্লুইস গেটটা আমরা বসিয়ে দিচ্ছি কোন আক্কেলে? তার আগে কি গদ্যে কথা বলত না লোকে? হ্যাঁ বলত, কিন্তু লিখত না। সাহিত্য তো নয়ই। দুনিয়ার সব ভাষাতেই এই এক প্রবণতা দেখা গেছে। আগে পদ্য তারপর গদ্যসাহিত্য। বাংলায় পদ্যের একচ্ছত্র চলেছিল প্রায় আটশো বছর। অবশ্য ষোড়শ শতাব্দী কিংবা তার পরে লেখা কিছু চিঠি, দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া গেছে। কিন্তু তা তো সাহিত্য নয়। তার সংস্কৃত, আরবি, ফারসি মেশানো আড়ষ্ট গদ্যকে বাংলা বলে চেনাও মুশকিল। বরং পোর্তুগিজ পাদ্রিরা কিছু কাজ করেছেন। বাংলা গদ্যে বই লিখেছিলেন তাঁরা। লিসবন থেকে সে বই ছাপাও হয়েছিল। তার পঁয়ত্রিশ বছর পর ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে বসেছিলেন আমাদের পঞ্চানন কর্মকার। তৈরি হয়েছিল বাংলা হরফ। শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে বেরিয়েছিল সেন্ট ম্যাথু’র সুসমাচার। কিন্তু আঠারোশো সালের তুলনায়, এসব চেষ্টা ছিল দুর্বল, বিচ্ছিন্ন। ওই বছর তৈরি হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। বাংলা গদ্যের ভিত গাঁথার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছিলেন একদল দেশি-বিদেশি পণ্ডিত। সংগঠিত এবং পরিকল্পিতভাবে। ছিল দরাজ সরকারি সাহায্য। ফলও মিলেছিল হাতে হাতে। তাই বলছিলাম, বাংলা গদ্যের আসল জন্ম সাল আঠারোশো খ্রিস্টাব্দ।

তোমাদের খটকা লাগতে পারে, ইংরেজ তো এসেছিল শাসনের নামে এই দেশটাকে শোষণ করতে। তাহলে নেটিভ ভাষার উন্নতির জন্য তারা এত ব্যস্ত হল কেন? আসলে সে সময় বিলেত থেকে অনেক তরুণ ইংরেজ নানা প্রশাসনিক কাজ নিয়ে এখানে আসতেন। অথচ এই দেশটা সম্পর্কে তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন অজ্ঞ। অন্তত দেশীয় ভাষাটা তো কাজ চালানোর মতো শিখিয়ে নেওয়া চাই। তাই কলেজ দরকার। দরকার বাংলা শেখার জন্য গদ্য ভাষায় লেখা পাঠ্যবই। অতএব তৈরি করো ফোর্ট উইলিয়াম। কাজে লাগিয়ে দাও কয়েকজন পণ্ডিতকে। এই ছিল সরকারের যুক্তি। গদ্য ভাষার বিকাশ ছাড়াও, দেশীয় মানুষের ইংরেজি শিক্ষা, রেললাইন পাতা, টেলিফোন ব্যবস্থা এরকম আরও অনেক ক্ষেত্রে, নিজেদের শাসনের সুবিধা করতে গিয়ে পরোক্ষে আমাদের উপকার করেছেন সরকার বাহাদুর। যাই হোক, তাঁরা কলেজের বাংলা আর সংস্কৃত ডিপার্টমেন্টের ভার নেওয়ার জন্য শ্রীরামপুর থেকে ডেকে আনেন উইলিয়াম কেরিকে। বাছাইটা হয়েছিল একেবারে মোক্ষম। কেরি যেমন সুপণ্ডিত তেমনি কাজপাগল লোক। তিনি একদল যোগ্য অধ্যাপক নিয়োগ করে পাঠ্যপুস্তক রচনা শুরু করলেন। এক বছরের মধ্যেই বেরিয়ে গেল রামরাম বসু প্রণীত ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’। বাঙালির লেখা, সম্পূর্ণ বাংলা হরফে ছাপা প্রথম বাংলা গদ্যের বই। এরপর যে বইগুলো বেরোয় তার মধ্যে খুব উল্লেখযোগ্য মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ আর কেরির লেখা ‘কথোপকথন’। এঁদের কাজটা ছিল প্রায় কলম্বাসের মতো। গদ্যের অচেনা জমিতে পা রাখার জন্য বানাতে হয়েছিল বাংলা শব্দের অভিধান। ঠিক করতে হয়েছিল আরবি, ফারসি, সংস্কৃত কিংবা ইংরেজির প্রভাবমুক্ত বাংলা সিনট্যাকস বা বাক্যগঠনের কৌশল। এর পাশাপাশি এঁরা বাংলা ভাষার সঠিক ইডিয়মগুলোর প্রয়োগ ঘটাতে চাইছিলেন। যার ফলে লেখার ভাষা পৌঁছে যাচ্ছিল মুখের ভাষার কাছাকাছি। এটা খুব বড়ো কাজ। এর ফলে একদিকে টিকি কিংবা টুপিধারী পণ্ডিতদের এলিট গণ্ডি ভেঙে বাংলা গদ্য আপামর বাঙালির উঠোন ছুঁয়ে ফেলেছে। আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। অন্যদিকে সেকালের সাধারণ জনজীবনের একটা বিশ্বস্ত ছবিও ধরা থাকছে কাগজে-কলমে। যেমন মৃত্যুঞ্জয়ের লেখায়, ‘শাকভাত পেট ভরিয়া যেদিন খাই সেদিন তো জন্মতিথি। তেল বিহনে মাতায় খাড়ি উড়ে।… হে ঈশ্বর দুঃখের উপরেই যত দুঃখ। ওরে পোড়া বিধাতা আমাদের কপালে এত দুঃখ লেখিস তোর কি ভাতের পাতে আমরাই ছাই দিয়াছি।’ এই ভাষা চমৎকার ঝরঝরে হলেও ক্রিয়াপদগুলো সাধু। কেরির ‘কথোপকথনে’ ধরা আছে আরও চলতি একেবারে গ্রাম্য বুলির নমুনা।

ইংরেজরা শুধু বাংলা গদ্য তৈরিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন তাই নয়। তাঁদের উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম বাংলা খবরের কাগজ। আঠারোশো আঠারো সালে, শ্রীরামপুর প্রেস থেকে। সম্পাদক মার্শম্যান, নাম ‘সমাচার দর্পণ’। ওই বছরই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য আর হরচন্দ্র রায় বার করেন আরেকটি কাগজ ‘সমাচার দর্পণ’। সাহেবদের অনেক ধন্যবাদ দিয়েও একটা কথা বলা দরকার। খোদ ইংল্যান্ডে গদ্য ভাষা তৈরি হয়েছে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষে আর প্রথম খবরের কাগজ বেরিয়েছে তার সাড়ে তিনশো বছর পর প্রথম ইংরেজি উপন্যাসও লেখা হয়েছে প্রায় একই সময়ে। আর বাংলায় গদ্য তৈরির সতেরো বছরের মধ্যে বেরিয়ে গেছে খবরের কাগজ। প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ লেখা হয়েছে আঠারোশো পঁয়ষট্টিতে। অর্থাৎ শিশু গদ্যভাষা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য লেখার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে মাত্র চৌষট্টি বছরে। শুরুটা ইংরেজদের হাতে হলেও, গদ্যের এই বিস্ময়কর অগ্রগতি সম্ভবই হত না, যদি শিক্ষিত বাঙালি এ কাজে হাত না লাগাতেন। শুধু শিক্ষিত বললে ভুল হবে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম এঁরা ছিলেন যুগপ্রবর্তক। জন্মেছিলেন এক টালমাটাল সময়ে। পুরোনো নীতি নিয়ম আদর্শ সংস্কার সব ভেঙে পড়ছে। আসছে জ্ঞানবিজ্ঞানের নতুন ঢেউ। বিজ্ঞানমনস্কতা, মুক্তবুদ্ধি। এই ঝড়ের মধ্যে এঁরা ছিলেন কান্ডারী। সদ্যোজাত বাংলাভাষার পালটি খাটিয়ে নিয়েছিলেন নৌকোয়। যুগের দাবিতেই তাঁদের লিখতে হয়েছে দু’হাতে। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, ধর্ম, সাহিত্য—সব, সব কিছু নিয়ে। করতে হয়েছে অনুবাদ। সম্পাদনা করতে হয়েছে নতুন নতুন পত্রপত্রিকার। আর একটু একটু করে সাবালক হয়েছে গদ্য ভাষা।

আঠারোশো পনেরো খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল রামমোহন রায়ের ‘বেদান্ত গ্রন্থ’। অমনি যেন ঢিল পড়ল মৌচাকে। উচ্চবর্গের লোকেরা এতদিন বলতেন, বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ এসব উচ্চাঙ্গের দর্শন। সংস্কৃত জানা সুশিক্ষিত লোকেরাই এগুলো পড়বেন, তার ব্যাখ্যা করবেন। রামা-শ্যামাদের এসব জিনিসে অধিকার নেই। রামমোহন তো চাইছেন উল্টোটা। সাধারণ মানুষের কাছে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে ধর্মের নামে দেশে যে বর্বর কাণ্ড-কারখানা চলেছে, আসলে ধর্মের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। এগুলো কুসংস্কার মাত্র। কাজেই তাঁর বেদান্ত অনুবাদ আর তাই নিয়ে পণ্ডিত মহলের হিংস্র আক্রমণ। রামমোহন সব মিলিয়ে প্রায় তিরিশখানা বাংলা বই লিখেছিলেন। তারা প্রায় সবগুলোই বিরোধীদের সঙ্গে সওয়াল জবাব। সব আক্রমণ তিনি ঠেকিয়ে ছিলেন বাংলা ভাষার লাঠি দিয়ে। একই রকম ঝড়ের মুখে পড়তে হয়েছিল বিদ্যাসাগরকে। তিনি একদিকে লিখে গেছেন ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’-এর মতো চিন্তাশীল তীক্ষ্ন যুক্তি, ধারালো পুস্তিকা। অন্যদিকে সংস্কৃত থেকে অনুবাদ। শুধু শাস্ত্র নয়, সত্যিকারের বাংলা গদ্যকে গড়েপিটে নিয়েছিলেন নিজের মতো করে। বাক্যে যতি চিহ্ন এনেছিলেন। ছোটো ছোটো সরল বাক্যের ব্যবহার করে ভাষার একটি ছাঁদ গড়ে নিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর রচনার বিষয় অনুযায়ী বাংলা লিখলেন। বর্ণপরিচয়ের গল্পের জন্য ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’ এরকম সহজ বাক্য, যাতে তৎসম শব্দ এমনকি কোনও ক্রিয়াপদও নেই। আবার ‘সীতার বনবাসে’র জন্য জমকালো গয়না পরানো ভাষা— ‘এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি’। নিজে ছিলেন মাস্টারমশাই। তাই ভাষা নিয়ে যা কিছু ভেবেছেন তা শেখাতে চেয়েছেন ছাত্রদেরও। যুগ যুগ ধরে আমরা পড়ে এসেছি ‘কথামালা’। মুখে কথা ফুটতে না ফুটতে আঁকড়ে ধরেছি ‘বোধোদয়’। ধর্ম সংস্কার, সমাজ সংস্কার করতে গিয়ে এঁরা শুধু বাংলা গদ্যকে কাজে লাগাননি। বাংলা গদ্যের উন্নতিও এঁদের একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইউরোপেও একসময় ধর্মগ্রন্থ পড়া-লেখা হত শুধু লাতিন ভাষায়। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে জার্মান, ইংরেজি, আরও বিভিন্ন ভাষায় তার অনুবাদ আর তাই নিয়ে আমাদের মতোই গোঁড়া বনাম উদারপন্থীদের কাজিয়া শুরু হয়। যাকে বলে রিফর্মেশন আন্দোলন। নেতৃত্বে ছিলেন মার্টিন লুথারের মতো পণ্ডিতরা। কিন্তু আপন আপন ভাষা নিয়ে তাঁদের কাউকেই এত ঘাম ঝরাতে হয়নি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, রামমোহন-বিদ্যাসাগরের আগে এলিটরা বাংলাকে দিয়ে করাতেন নোকর চাকরের কাজ। ওঁরাই প্রথম তার উপর গুরুদায়িত্ব চাপান। তাই নিয়ম হেঁকে কোদাল হাতে ভাষার নতুন পথও বানাতে হয়েছিল।

বিদ্যাসাগরের বানানো পথে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হাঁটছিলেন তাঁর একেশ্বরের দিকে। অক্ষয়কুমার দত্ত হাঁটছিলেন বিজ্ঞানের দিকে। রাজেন্দ্রলাল মিত্র ইতিহাস আর পুরাতত্ত্বের দিকে। কিন্তু এমন ভাবগম্ভীর বাংলা ভাষায় সন্তুষ্ট ছিলেন না প্যারীচাঁদ মিত্র। লিখলেন ‘আলালের ঘরে দুলাল’। চলতি শব্দ, কথা ভাষা, আর কলকাত্তাইয়া রসিকতার ফোয়ারা ছুটল। এগিয়ে এলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তিনি আরও সাহসী। ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ সাধু গদ্যের গুমোর একেবারে ভেঙে দিয়েছিল। গদ্যের সমস্ত ভাবগাম্ভীর্যটুকু বজায় রেখেও কী ক’রে তাকে রসের ভিয়েন ক’রে তোলা যায়, তা বোঝার জন্য বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আর মাত্র দু’বছর। প্রকাশিত হল ‘দুর্গেশনন্দিনী’। বঙ্কিম আর রবীন্দ্রনাথের মতো লেখক কলম ধরার পর, কোনও ভাষাকেই আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় না। বাংলাও তাকায়নি। বরং নতুন নতুন রং ঢং, সাজ সজ্জায় মাতিয়ে দিয়েছে সাহিত্যের দশ দিগন্ত। সে গল্প পরের কিস্তির জন্য তোলা রইল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন