‘মহাভারত’ বইটাকে এক বিরাট ইস্কুল বলে মনে হয় আমার, বলেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে যখন তখন শুরু হয়ে যায় ক্লাস। বনে, পাহাড়ে, আশ্রমে। দেব, দানব, মুনি, ঋষি সকলেই সেখানে শিক্ষক। শিক্ষার্থীও অনেক। যাঁদের মধ্যে পয়লা নম্বর হলেন যুধিষ্ঠির। সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলোও তাঁকেই দিতে হয়েছে। যেমন, চার ভাইয়ের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যুইজ কনটেস্ট। ক্যুইজ মাস্টার বকরূপী ধর্ম। তোমরা যারা মহাভারত পড়েছ তারা জান, ধর্মের একটা প্রশ্ন ছিল। জগতের সব থেকে দ্রুতগামী জিনিস কী! যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিলেন, মন। ব্যাস, একেবারে ফুল মার্কস। এই সূত্রে আর একটা প্রশ্ন মাথায় আসে। মন যদি এত দ্রুতগামী হয়, তাহলে কথা তার সঙ্গে পাল্লা দেবে কী করে! দশ সেকেণ্ড সময়ের মধ্যে বহু বহু দূরে হারিয়ে যেতে পারি আমরা মনে মনে। মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে উঠতে পারে অনেকগুলো এলোমেলো বিষয়। কিন্তু দশ সেকেণ্ডের মধ্যে ক’টা কথা বলে উঠতে পারি আমরা? একটা গোটা বাক্যও নয়। আমাদের চিন্তা হল বিক্ষিপ্ত কিছু ছবি, ইংরেজিতে যাকে বলে ইমেজ, তার মিছিল। চিন্তা করার সময় সঠিক শব্দ খুঁজতে হয় না আমাদের। শব্দগুলোর পরস্পরের ব্যাকরণগত সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে হয় না। সবচেয়ে বড়ো কথা চিন্তা যেহেতু একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, অন্যকে তা বোঝানোর দায়িত্বও নিতে হয় না। কিন্তু কথা বলার সময় এ সবই করতে হয়। ফলে সময় লাগে অনেক বেশি। লিখতে আরও বেশি। কারণ, লেখার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিকল্প বাক্যের মধ্যে অব্যর্থ যেটা সেইটাকে ধরতে চাই আমরা। লিখি, কাটাকুটি করি, আবার লিখি।
নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই দিব্যি বোঝা যায়, আমাদের সব কথার পিছনে মনের খেলা থাকে। অন্যের কথা শোনামাত্র মগজ ভয়ানক সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুরু হয়ে যায় পরস্পরগ্রথিত কিংবা পরস্পরবিরোধী নানা ইমেজের ছুটোছুটি। সেই বিরাট ভাঁড়ার থেকে অল্পই তুলে আনতে পারি আমরা। হয়তো একটা-দুটো শব্দ। যেমন ‘শাস্তি’ গল্পের শেষে, ফাঁসি যাওয়ার আগে একবার স্বামীকে দেখতে চায় কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে চন্দরা বলেছিল ‘মরণ’! কেন বলেছিল? ঠিক কী ভেবে বলেছিল? তার দাম্পত্যজীবন খুব বেশি বড়ো নয়। কিন্তু তারই মধ্যে রয়ে গেছে কত ফ্রেমে বাঁধানো ইমেজ। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-ভাব-ভালোবাসার অসংখ্য মুহূর্ত; হয়তো ভালবাসায় বিভোর হয়েছিল চন্দরা। তাই মরার আগে কলঙ্কিত মুখটা দেখাতে চায়নি স্বামীকে। হয়তো ভাইকে বাঁচানোর জন্য বউয়ের নামে দোষচাপানো মিথ্যেবাদী স্বামীর অকৃতজ্ঞতাটাই বড়ো হয়ে উঠেছিল সেই সময়। তাই এত বিকর্ষণ। কিংবা, কেন মিথ্যেকে স্বীকার করে নিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে আনল, সেই গ্লানিতে খাক হয়ে যাচ্ছিল সে। গ্লানি যাতে না বাড়ে, তাই স্বামীর মুখোমুখি হতে ভয় হয়েছিল তার। হয়তো সবটাই চন্দরার আত্মনির্যাতন। স্বামীকে শেষবার দেখার ইচ্ছায় মনটা আকুলিবিকুলি করে উঠেছিল বলেই, সেই ইচ্ছের গলা টিপে মারল সে। চরিত্রের গড়ন, চারপাশের নানা ঘটনায় তার ভূমিকা, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক, গল্পের কার্যকারণ—এইসব বিবেচনা করে চন্দরার মনের নানা ব্যাখ্যা করতে পারি আমরা। সেই ব্যাখ্যা বিভিন্ন রকম হতে বাধ্য। কারণ, প্রত্যেক পাঠক যে যার মনের মতো করে দেখছেন চন্দরাকে। আবার একই পাঠক একাধিক ব্যাখ্যাকে গ্রহণযোগ্য মনে করছেন। অঙ্কের মতে দুই দুগুণে চার বসিয়ে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান কোনওদিন করা যাবে না। আমাদের মগজ সুপার কম্পিউটারের চাইতেও অনেক বেশি জটিল, বিচিত্র আর খেয়ালি থেকে যাবে।
তবু পাঠক হিসেবে এটাই আমাদের কাজ। ‘কথা’র আড়ালের ‘না কথা’কে বোঝার চেষ্টা করা। ব্যাপারটা অনেকটা হিমশৈলের মতো। ওপরে চূড়াটুকু জেগে আছে। আর জলের ভিতর তলিয়ে আছে তার বিশাল ভিত। অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন চূড়াটুকু দেখেই তলাটার ব্যাপ্তি অনুমান করতে পারেন। জাহাজ বাঁচিয়ে এগিয়ে যান। অবশ্য তাঁকে সাহায্য করার জন্য আরও অনেক লোক থাকে। পাঠকও কিন্তু একা নন। তাঁর সবচেয়ে বড়ো সাহায্যকারী স্বয়ং লেখক। তিনি নিজেই যেহেতু চরিত্র এবং তার কথা সৃষ্টি করছেন, সেই কথার পিছনের ভাবনা অর্থাৎ ‘না কথাটা তিনি একরকম করে জানেন। সেটা কখনও স্পষ্টভাবে, কখনও আভাসে জানিয়েও দেন পাঠককে। যেমন ওই ‘শাস্তি’ গল্পেই বড়ো বউ খুন হওয়ার পর চক্রবর্তী মশাইকে দেখে ছিদাম বলে ফেলে, ‘ঝগড়া করিয়া ছোটো বউ বড়ো বউয়ের মাথায় এক দায়ের কোপ বসাইয়া দিয়াছে।’ কেন বলে? চন্দরাকে ধরিয়ে দিয়ে আবার বিয়ে করার মতলবে? বউ গেলে বউ পাব, কিন্তু ভাই গেলে ভাই পাব না, এই যুক্তিতে? না। আসলে দুই বউ যে ঝগড়া করে, এমনকি আজও সারাদিন ধরে করেছে, পাড়ার সবাই তা জানে। চক্রবর্তীও জানেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দুই বউয়ের ঝগড়া হচ্ছে, সেজন্য দুখিরাম কাঁদে কেন! এর উত্তরে হঠাৎ ফস করে বউয়ের নামে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে ছিদাম। ভেবেছে এটাই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হবে। স্বয়ং লেখক জানিয়ে দিয়েছেন, ‘উপস্থিত বিপদ ছাড়া আর যে কোনও বিপদ থাকিতে পারে একথা সহজে মনে হয় না। ছিদাম তখন ভাবিতেছিল, ভীষণ সত্যের হাত হইতে কী করিয়া রক্ষা পাইব। মিথ্যা যে তদপেক্ষা ভীষণ হইতে পারে তাহা তাহার জ্ঞান হইল না। রামলোচনের প্রশ্ন শুনিবামাত্র তাহার মাথায় তৎক্ষণাৎ একটা উত্তর জোগাইল এবং তৎক্ষণাৎ বলিয়া ফেলিল।’ কিন্তু সবসময় এমন সাহায্য পাওয়া যায় না। লেখক বারবার আমাদের হাত ধরতে পারেন উপন্যাসে। গল্পে সে সুযোগ কম। আর নাটকে একেবারেই নেই।
নেই, কারণ গল্প-উপন্যাস লেখা হয় অল্পবিস্তর সংলাপ আর লেখকের বর্ণনা মিশিয়ে। কিন্তু নাটকে শুধুই সংলাপ। একের পর এক চরিত্র মঞ্চে আসে যায়, ঘোরেফেরে, কথা বলে। নাট্যকার তো আর মঞ্চে ঢুকে গিয়ে ‘সিরাজদৌল্লা এখন এই ভাবিতেছেন’ বলে বক্তৃতা জুড়তে পারেন না! সিরাজ যে কী ভাবিতেছেন তা মঞ্চে তাঁকে দেখে, তাঁর কথাবার্তা শুনেই বুঝে নিতে হয় আমাদের। নাট্যকার শুধু সেই কথাগুলোই লেখেন। আর বড়োজোর ব্র্যাকেটের মধ্যে কিছু সূত্র ধরিয়ে দেন। যেমন, যে মঞ্চের ওপর সিরাজ ঘোরাফেরা করছেন সেটা কেমনভাবে সাজানো থাকবে। তিনি কেমন পোশাক পরে থাকবেন। অনেক সময় চরিত্রের বিশেষ কোনও অভিব্যক্তি কিংবা কাজও বলে দেওয়া হয় ছোট্ট করে। কিন্তু সে তো উল্লেখমাত্র। তার উপর ভিত্তি করে গোটা চরিত্রের মনটাকে স্পষ্ট বুঝে নিতে হয় নাটকের অভিনেতা, পরিচালকদের। অভিনয়ের সময় একবার মাত্র দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, প্রত্যেক ‘কথা’র আড়ালের ‘না কথা’গুলো বুঝতে বুঝতে যেতে হয় আমাদের। বেশিরভাগ দর্শকই সিরাজদৌল্লা চরিত্রের যে রকম ব্যাখ্যা অভিনেতাটি করেছেন, সেটাকেই মেনে নেন। সিরাজের বীরত্বে হাততালি দেন, দুঃখে হা-হুতাশ করেন। আর অভিনয় খারাপ লাগলে কোনও কোনও বুদ্ধিমান দর্শক ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেন, ‘আরে সিরাজের ক্যারেকটারটা ও ধরতেই পারেনি।’
নাটক যখন দেখছ না, শুধুই পড়ছ, তখন কিন্তু আলো, মঞ্চ, অভিনেতা, কিচ্ছু নেই। শুধু তুমি আছ আর লেখকের দেওয়া সংলাপ, ছোটো ছোটো ব্র্যাকেটে বাঁধা সূত্রগুলো আছে। তাই থেকে গোটা দৃশ্যের ছবিটা তৈরি করে নিতে হচ্ছে কল্পনায়। এতে সুবিধা দুটো। প্রথমত, নাটক দেখতে পাচ্ছ একবারই কিন্তু বইটা বিনি পয়সায় যতবার খুশি, যতক্ষণ খুশি পড়া যায়। দ্বিতীয়ত, পড়ার সময় চরিত্রগুলোকে ব্যাখ্যা করার সম্পূর্ণ অধিকার তোমারই। অভিনেতা আর একটা ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তোমাদের পাঠ্য ‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই’ নাট্যাংশটা খুলে দেখো। এটা বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্য। শুরুতেই কোনও সংলাপ নেই, মঞ্চে এক বিয়েবাড়ি সাজানো রয়েছে। সেখানে সুবেশ ধনী লোকজনের ভিড়। তাদের মুখে হাসি। অনেক আলো, বাজনা। আমন্ত্রণ, আপ্যায়ন চলছে। উল্টোদিকে অন্ধকার ডাস্টবিন। সেখানে এঁটো কাঁটা নিয়ে কুকুর আর হাভাতে মানুষের লড়াই। এই প্রেক্ষাপটের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন নাট্যকার। কারণ এরপর যে কথাগুলো হবে, তার ভেতর দিয়ে ওই আলোকিত ফটক আর অন্ধকার ডাস্টবিনের মধ্যেকার বৈপরীত্য, বৈষম্যটাই নানাভাবে প্রকাশ করতে চাইবেন তিনি। প্রসঙ্গত বলি, বিজনবাবু এই নাটকের নাট্যকার শুধু নন, অন্যতম পরিচালকও ছিলেন। মঞ্চ, আলো, বাজনা—এসব নিয়ে এত কথা তিনি নাটক লেখার সময়েই ভেবেছেন এমন নয়। এর অনেক কিছু প্রযোজনার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়ে উঠেছে। পরে বইটা প্রকাশের সময়, পাঠকদের সুবিধার্থে সেগুলো ছেপে দেওয়া হয়েছে। অনেক নাট্যকার পরিচালকের স্বাধীনতার ওপর বেশি নির্ভর করেন। তাঁরা স্টেজ ডিরেকশান প্রায় দেন না বললেই হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ। তোমাদের পাঠ্য ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’-এ ঘটনাটা কোথায় ঘটছে, কখন ঘটছে, সেটুকুরও উল্লেখ নেই। ‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই’তে স্থান কালের বর্ণনা ছাড়াও তিনবার ছোটো হরফে লেখা আছে ‘নেপথ্যে মাগো মাগো ধ্বনি’ আর একবার ভদ্রলোকদের হো হো করে হেসে ওঠার নির্দেশ। হাসি আর কান্নার এই সমাবেশ আমাদের ঘাড় ধরে ভাবিয়ে নেয়, এমন কেন হবে! এ হল মানুষের অমানুষ হয়ে যাওয়া, তাই দেখে অন্য মানুষদের উদাসীনতার প্রতি নাট্যকারের ঘেন্না, প্রতিবাদের প্রকাশ। প্রতিবাদটা আরও তীব্র হয় যখন প্রধান নেংটি পরে দাঁড়িয়ে বড়ো বাড়ির দিকে হাত তুলে চেঁচায় ‘তোমরা কি সব বধির হয়ে গেছ বাবু—অন্তর কি সব তোমাদের পাষাণ হয়ে গেছে!’ এরই মধ্যে কুঞ্জর হাতে কুকুরে কামড়ানো ক্ষতটায় একটা পট্টি বেঁধে দিচ্ছে তার বউ রাধিকা। নাট্যকার খুদে হরফে লিখে দিয়েছেন ‘কুঞ্জ তাকিয়ে থাকে রাধিকার দিকে সাশ্রু চোখে। …তার চোখেও জল ভরে আসে সব কিছু স্মরণ করে।’ বড়ো চমৎকার দৃশ্য। লেখক যেন বলতে চান, শত যন্ত্রণার মধ্যেও মানুষ ভালোবাসার কথা ভাবে। কিন্তু ঠিক কী ভাবছিল কুঞ্জরা? ফেলে আসা দিনগুলোর কথা? কোনও বিশেষ দিন, বিশেষ ঘটনার কথা? সেটা ভেবে নেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের। তাহলে শুরু করো ভাবতে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি ভাবতে ভাবতেই পরে নাও একটা ছেঁড়াখোঁড়া জামা। হাতে একটা ভাঙা সানকি নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও। তুমি স্বয়ং হয়ে ওঠো কুঞ্জ। কে বলতে পারে, তোমার মধ্যেই ভবিষ্যতে মঞ্চ কাঁপানো এক অভিনেতা লুকিয়ে আছে কি না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন