প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলেত গেছেন। নেমন্তন্ন করেছেন গণ্যমান্য সাহেবসুবোদের। তারপর সারা হলঘর মুড়ে দিয়েছেন সোনা-রুপোর কাজ করা বহুমূল্য কাশ্মীরি শালে। এক একজন নিমন্ত্রিত আসেন আর দ্বারকানাথ এক-একখানা শাল খুলে তাঁদের গায়ে জড়িয়ে দেন। এক নেটিভের কাছে এমন রাজসিক অভ্যর্থনা পেয়ে উন্নাসিক সাহেবরা কেমন তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন, বুঝতেই পারছ। দ্বারকানাথের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ধর্মপ্রাণ, মহর্ষি। কিন্তু বিলাস আর শৌখিনতায় তিনিও কিছু কম যেতেন না। অবনীন্দ্রনাথের লেখা ‘ঘরোয়া’ পড়ে দেখো। দেবেন্দ্রনাথ শোভাবাজারের রাজবাড়িতে জলসায় যাবেন। সাজপোশাকে মর্যাদা রক্ষা করা চাই তো! তাই করমচাঁদ জহুরিকে দিয়ে নতুন জুতো বানানো হল। তাতে সাদা মখমলে মুক্তোদানার কাজ। ঠাকুরবাড়ির জমিদারেরা যেমন অগাধ উপার্জন করেছেন, তেমনি খরচও করেছেন বেপরোয়া। রবীন্দ্রনাথের আমলে উপার্জন কিছু কমলেও, দাদু কিংবা বাবার পথে হাঁটতে তাঁর খুব একটা অসুবিধা হত না। অথচ হিরেমুক্তোর ঐশ্বর্য দেখিয়ে লোকের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেননি। বরং নিজের সম্পত্তি, স্ত্রীর গয়না সব কিছু বিক্রি করে, দেশে বিদেশে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে, এমনকি নোবেল প্রাইজের শেষ কপর্দকটুকুও ঢেলে দিয়ে বানাতে চেয়েছেন একটি প্রতিষ্ঠান—বিশ্বভারতী। জমিদারি থেকে যেটুকু আয় হয়েছে, তার বেশিরভাগ খরচ হয়ে গেছে পল্লিমঙ্গলে, কারিগরি শিক্ষায় প্রজাদের জন্য গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কিংবা সমবায় তৈরিতে। আসলে তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ বাঁচে নিজের জন্য নয়, অন্য মানুষের জন্য। এই অন্য মানুষদের বিরাট অংশই বাস করে গ্রামবাংলায়। অন্ধকারে। জমিদার আর ইংরেজ শোষণে জর্জরিত হয়ে। জাতপাত আর হাজারো ধর্মীয় সংস্কার, অশিক্ষায় ডুবে। কলকাতার জমিদারি হাভেলিতে যখন টাকার ঝনঝনানি, তখন গঙ্গা পদ্মা মেঘনার জল নোনা হয়ে যাচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের চোখের জলে। নগরে নবজাগরণের ঝড় উঠছে। কিন্তু নিচুতলায়, গ্রামেগঞ্জে বাতাসও বয় না।
বাবার আদেশে, জমিদারি তদারকির জন্য যুবক রবীন্দ্রনাথ পাড়ি দিয়েছিলেন শিলাইদহে। তারপর পাতিসর, সাজাদপুর। ঠাকুরবাড়ির চকমেলানো দেউড়ি পেরিয়ে, একেবারে গ্রামবাংলার বুকের মধ্যে। চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল যেন। এক দিকে প্রকৃতির ছলছল শ্যামলিমা। আর তার মধ্যে নিরন্ন, নিরীহ, ভাগ্যবিশ্বাসী মানুষের বাঁচার লড়াই। এদের দেখতে দেখতে বুঝতে বুঝতে জেগে উঠল সহিতত্ব। অর্থাৎ আত্মীয়তাবোধ। মানুষের চোখের জলে কলম ডুবিয়ে নিলেন কবি। নিজেই বলেছেন, সহিতত্ব থেকেই সাহিত্য। ফলে, জেগে উঠল রবীন্দ্রসাহিত্যের এক নতুন রূপ। ছোটোগল্প।
গত সপ্তাহে বলেছিলাম, কিশোরবেলা থেকেই নিজস্ব ভাষা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। কখনও গুরু মেনেছেন বিদ্যাপতিকে, কখনও বিহারীলালকে। কখনও বা বঙ্কিমচন্দ্রকে। কিন্তু লেখার বিষয়টাকে যদি একান্ত নিজের করে না তোলা যায়, তা হলে ভাষায় নিজস্বতা আসবে কী করে? এতদিনে সম্ভব হল তা। ‘গল্পগুচ্ছ’-র গোড়ার দিকের লেখাগুলোতে আছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় : ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখকথা।’ যা কিনা ‘নিতান্তই সহজ সরল’। স্বাভাবিকভাবেই তার ভাষায় অক্ষর-ডম্বর নেই। তৎসম শব্দ বা অনুপ্রাসের আড়ম্বর নেই। আছে মৃদু ঘরোয়া ভঙ্গিমা। তারই মধ্যে হঠাৎ ঝলসে ওঠা বিদ্রুপ, কখনও স্নিগ্ধ কৌতুক। আর ছবির পর ছবি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে দুটো রবীন্দ্রগল্প পড়তে হয় তোমাদের। ‘দেনাপাওনা’ আর ‘শাস্তি’। প্রথমটা সম্ভবত ১৮৯১-তে অর্থাৎ গল্প লেখা শুরু করার দু’বছরের মধ্যে রচনা করেছিলেন। আরও দু’বছর পর ‘শাস্তি’। ‘গল্পগুচ্ছ’-র প্রথম তিনটি গল্পের নাম ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’ আর ‘মুকুট’। এগুলিতে কিছুটা বঙ্কিমী গন্ধ আছে। বিষয়ে, ভাষাতেও। আছে সুদূর ইতিহাস, পুরাণ-চেতনা, রোম্যান্টিকতার স্বাদ। কিন্তু চতুর্থ গল্প ‘দেনা পাওনা’-য় লেখকের নিজের সময় আর নির্যাতিত মানুষের মুখ ধরা দিল। তৈরি হল ছোটোগল্পের এক বিশেষ রীতি। ‘নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা / নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ। / অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে / শেষ হয়ে হইল না শেষ।’ একত্রিশ নম্বর গল্প ‘শাস্তি’তে এই রীতি চমকপ্রদ সাফল্য পেয়েছে। কবি স্পষ্ট বুঝেছেন, ভাষার আসল ঐশ্বর্য বহিরঙ্গে নয়, অন্তরে। যেমন মানুষের ঐশ্বর্য তার মনে। সোনা রুপোর কাজ করা শালদোশালা কিংবা নাগরাতে নয়।
‘দেনাপাওনা’, ‘শাস্তি’ দুটোই সাধুগদ্যে লেখা গল্প। অথচ তৎসম শব্দ উল্লেখযোগ্যভাবে কম। লেখকের বর্ণনা আর চরিত্রদের সংলাপ—দুই ক্ষেত্রেই সচরাচর ক্রিয়াপদের রূপ সাধু। কিন্তু চলিতের দিকে একটা ঝোঁক লক্ষ করা যায়। যেমন ‘দেনাপাওনা’-র প্রথম বাক্যেই ‘জন্মগ্রহণ করিল’ না লিখে, লিখেছেন ‘জন্মিল’। সংলাপে পাচ্ছি : ‘কেন আসতে দেবে না মা। আমি তোমাকে নিয়ে আসব।’ খেয়াল কর, ‘আসিব’ নয় ‘আসব’। সর্বনামের বেলাতেও তাই। ‘তবে যেমনটি ঘটিয়াছে তাই বলিস, সকল দিক রক্ষা করা অসম্ভব’—’শাস্তি’ গল্পে চক্রবর্তী মশাইয়ের এই সংলাপে ক্রিয়াপদ সাধু। কিন্তু ‘তাহাই’ এর বদলে ব্যবহার করছেন ‘তাই।’ আসলে দৈনন্দিন কথোপকথনের চালটা ধরতে চাইছেন কবি। কিন্তু সাধুগদ্যের সংস্কার ছাড়তে পারছেন না। ‘শাস্তি’তে ছোটো ছোটো বিদ্যুতের মতো সংলাপ লিখেছেন তিনি। অনেকখানি অনুভব ধরা পড়েছে একটুখানি কথায়। আর পাছে চলতি ঢংটা ক্ষুণ্ণ হয়, তাই অসমাপিকা ক্রিয়া এড়িয়ে যাচ্ছেন— তাহারা, উহারা ইত্যাদি বহুবচন সর্বনামও। যেমন:
‘এ তোমার কে হয়?’
‘ও আমার স্বামী হয়।’
‘ও তোমাকে ভালোবাসে না?’
‘উঃ, ভারি ভালোবাসে।’
চন্দরা জেরার উত্তরে কখনও বলেছে স্রেফ ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’। নির্ভার সংলাপ লিখতে লিখতে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যাচ্ছেন সেই মোক্ষম উপসংহারে। স্বামী দেখা করতে চায় শুনে, চন্দরা কহিল—’মরণ!’ ‘দেনাপাওনা’র ভাষায় একটু নাটুকেপনা আছে। কিন্তু ‘শাস্তি’ সত্যিকারের নাটকীয়। বহিরঙ্গে নয়, অন্তরঙ্গে। এর পর থেকে গল্পের বিষয় চরিত্রদের মানসিকতা যত জটিল, ঝোড়ো আর আবেগ-থরথর হয়ে উঠেছে, ভাষাও তত স্বচ্ছন্দ হয়েছে। সাধুগদ্যের দিকে ঝোঁক কমতে কমতে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ‘স্ত্রীর পত্র’-তে। ‘গল্পগুচ্ছ’-র তৃতীয় খণ্ডের বেশিরভাগ গল্পই চলতি ভাষার। প্রকাশিত হয়েছিল ‘সবুজ পত্র’য়। যার সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী। চলতি ভাষার রথযাত্রায় প্রধান সারথি।
কয়েক মাস আগে এই কলমে লিখেছিলাম ভাষা দিয়ে ছবি আঁকার কথা। ছবি, অর্থাৎ চিত্রকল্প ভাষার পয়লা নম্বর গয়না। উদাহরণ দিয়েছিলাম ‘শাস্তি’ থেকে। আজ আরেকটা নমুনা : ‘বন্দিনী হইয়া চন্দরা, একটি নিরীহ ক্ষুদ্র চঞ্চল কৌতুকপ্রিয় গ্রামবধূ, চিরপরিচিত গ্রামের পথ দিয়া, রথতলা দিয়া, হাটের মধ্য দিয়া, ঘাটের প্রান্ত দিয়া, মজুমদারদের বাড়ির সম্মুখ দিয়া, পোস্টাপিস এবং স্কুলঘরের পার্শ্ব দিয়া, সমস্ত পরিচিত লোকের চক্ষের উপর দিয়া কলঙ্কের ছাপ লইয়া চিরকালের মতো গৃহ ছাড়িয়া চলিয়া গেল।’ এই ছবির সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল গতি। চন্দরা হাঁটছে। পেছনে পেছনে ছেলের পাল হাঁটছে। পুলিস হাঁটছে। আমরাও হাঁটছি। চন্দরার মতোই দেখতে দেখতে যাচ্ছি চিরপরিচিত জায়গাগুলো। আর মাথা নুয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র, চঞ্চল, কৌতুকপ্রিয়—এই সব বিশেষণের ফলে, বাক্যের শুরুটা হয়েছিল উজ্জ্বল রঙে। তারপর একটা করে জায়গা যায়, একটা বাক্যাংশ শেষ হয়, পথ বেঁকে যায় আরও লজ্জাজনক কোনও নতুন জায়গার দিকে। আর উজ্জ্বল রঙের ওপর পড়তে থাকে গাঢ় ছায়া। শেষে, কলঙ্ক শব্দটা যেন কালি ঢেলে দেয় পটের ওপর। এই চলমানতার পাশাপাশি কবি এঁকেছেন ছোটো ছোটো স্থিরচিত্র। গ্রামের মেয়েরা চন্দরাকে দেখছে। ‘কেহ কেহ ঘোমটার ফাঁক দিয়া, দ্বারের প্রান্ত হইতে, কেহ বা গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া।’ চন্দরার মনের অবস্থা স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না। কেবল জানা যাচ্ছে, তাকে দেখে ‘মেয়েরা লজ্জায়, ঘৃণায়, ভয়ে কন্টকিত হইয়া উঠিল।’ এই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছবিতে এসে গেল তীব্র আবেগের চাপ।
‘দেনাপাওনা’র নিরুপমা সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছিল। চন্দরা প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু নীরবে। তার মূক প্রত্যাখ্যান মুখর হয়ে উঠল ‘স্ত্রীর পত্র’-তে। ‘গল্পগুচ্ছ’র তিনটি খণ্ডই পড়ে ফেলো না! তা হলে প্রতিবাদী মেয়ে মৃণালের চিঠিতে নিজেরাই খুঁজে পাবে আরও অনেক ছবি। ধারালো ছোরার মতো ভাষা। সূর্যের আলোয় যা ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন