১১। ভুল বানান আর সাধু চলিতের খিচুড়ি

ভুল বানান আর সাধু চলিতের খিচুড়ি

কলেজের ঠিকানায় প্রায়ই তোমাদের চিঠি পাই। যারা নিয়মিত এই কলম পড়ো, তাঁদের নানা প্রশ্ন, কিছু অভিযোগ আর অনেক আবদার। এত সবুজ আর আন্তরিক কলম তোমাদের, তবু মন খারাপ হয়ে যায়। বেশিরভাগ চিঠিতেই ভুল বানান, বেখাপ্পা বাক্যগঠন আর সাধু চলিতের খিচুড়ি। এসব শোধরাবার জন্যই তো এত লেখা লিখি! অবশ্য দোষটা পুরোপুরি তোমাদের নয়। কৃষ্ণনগর থেকে উদয় নাগ লিখেছে, সবাই বলেন গল্পের বই পড়লে ভাষাজ্ঞান বাড়ে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র পড়তে গিয়ে দেখেছি ভালো লাগে না। আসলে এখন চটজলদির যুগ। টু মিনিটস ম্যাগি খেতে খেতে লুচি হালুয়ার স্বাদটাই ভুলতে বসেছি আমরা সবাই। টিভিতে বিজ্ঞাপনের জিঙ্গলস দেখি আর পড়ি কমিকস, বড়ো জোর ক্যুইজের বই। যে কোনও উচ্চাঙ্গের জিনিস উপভোগ করতে গেলেই গভীরভাবে চিন্তা করতে হয়। তাতেই আমাদের আলস্য। এর একমাত্র দাওয়াই হল লেগে থাকা। বঙ্কিম ভালো না লাগলে রবীন্দ্রনাথ পড়ো, নইলে শরৎচন্দ্র। আর উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, অবনীন্দ্রনাথ? ধরে নিচ্ছি : এঁদের আগেই পড়েছো। কোনও কোনও চিঠি পড়ে মনে হয় অনেকের ধারণা, ব্যাকরণ ভালো করে জানলেই বুঝি ভালো গদ্য লেখা যাবে। মোটেই তা নয়। পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার জন্য ব্যাকরণ জানা, অভ্যাস করা নিশ্চয় দরকার। কিন্তু এসব হল জ্বালানি কাঠকুটো। ছন্দ, ধ্বনি, তুলনা এগুলোকে বলা যায় চকমকি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এত কিছু জড়ো করলেও আগুন জ্বলবে না, যদি বুক ভরে ফুঁ দিতে না পারো! ফুঁ মানে তোমার কল্পনাশক্তি। বার্নপুরের পার্থ দে প্রত্যয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছ। ৪ জুনের ‘পড়ার পাতা’ দেখো। অঞ্জনাদি চমৎকার আলোচনা করেছেন। কিন্তু আবার বলছি, ব্যাকরণ কিংবা ছন্দ-অলঙ্কার না জেনেও ভালো গদ্য লেখা যায়। যদি দেখতে দেখতে, পড়তে পড়তে চোখ কান তৈরি হয়। যাকে ইংরেজিতে বলে Acquisition <। আবার নাড়া বেঁধেও শেখা যায়। যাকে বলে Learning <। সেই উদ্দেশ্যেই আমরা শুরু করেছি বাংলা গদ্যের গয়নাগাঁটি, তার উত্থান আর বিবর্তন নিয়ে কথা বলা। তবে, এই পথে হাঁটতে গেলেও কল্পনাশক্তির সাহায্য বিনা গতি নেই। সেজন্য দরকার বড়ো বড়ো কল্পনাকুশল মানুষ, অর্থাৎ লেখক, শিল্পীদের সাহচর্য। মাস্টারমশাই যেখানে থেমে যান, সেইখান থেকে শুরু হতে পারে লেখক আর তোমাদের গোপন কথোপকথন। তোমাদের সিলেবাসের রচনাগুলোকে একটা সময়সারণিতে সাজিয়ে নিয়ে, প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য গদ্যকারের বৈশিষ্ট্য, অবদান নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা শুরু করেছি আমরা। নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ, সিলেবাসের বাইরে পা রাখলেও ছুঁয়ে আছি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলোকেও। সিলেবাসের গণ্ডিটা আগে চিনে নাও। তারপর টপকে যাও তা। ‘বাবু’র ছদ্মগম্ভীর রচনাশৈলী নিয়ে লেখা হয়েছে আগের কিস্তিতে। আলোচনা হয়েছে ‘রাজসিংহ ও মানিকলাল’-এর অ্যাকশান-প্যাকড, তরতরে নিরলঙ্কার ভাষা নিয়েও। সেই চাবি দিয়ে ‘লোকরহস্যে’র দরজা খোলার চেষ্টা করে দেখো না! পড়ে ফেল গোটা ‘রাজসিংহ’টাই। সাহিত্যকে ভালোবাসলে সেই তোমার হাত ধরে নিয়ে যাবে কল্পনার জানাডুতে।

চন্দননগর থেকে মৌটুসি পাল জানতে চেয়েছ, একজন লেখকের কি একটাই গদ্যশৈলী থাকে? রবীন্দ্রনাথ যে এতদিন ধরে লেখালেখি করলেন, তাঁর ভাষা কি পাল্টায়নি কখনও? খুব ভালো প্রশ্ন। কেরি, মৃত্যুঞ্জয়, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমকে নিয়ে আগেই আলোচনা হয়েছে। এঁদের পর বাংলা গদ্যের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা রবীন্দ্রনাথ। আজ তবে তাঁকে নিয়েই কথা বলি। শুধু একটা বড়ো ব্যাপার মনে রেখো। বিষয়ভেদে রচনার ভাষা অল্পবিস্তর বদলে যায়। কিন্তু সব বড়ো লেখকেরই চেষ্টা থাকে, নানা সময়ে, নানা বিষয় নিয়ে লিখতে লিখতে, ক্রমে এমন একটা ভাষারীতি তৈরি করা যা একান্তভাবে তাঁরই। সেই জন্যই বঙ্কিমের যে কোনও লেখা দেখলেই বোঝা যায়, এ লেখা বঙ্কিমী। রবীন্দ্রনাথের গদ্য, পদ্য, প্রবন্ধের ভাষায় নানা তফাত থাকলেও, তা বিশেষভাবে রাবীন্দ্রিক। ভাষার এই পরিণতি কিন্তু একদিনে আসে না। তা অর্জন করার জন্য অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয় লেখককে। রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রম নন।

রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলাটা ছিল ঘড়ির সঙ্গে বাঁধা। বিরাট বাড়ি। বিশাল পরিবার। অসংখ্য অভিভাবক। তাঁরা অনেকেই যেমন পণ্ডিত তেমনি খেয়ালি। যে যার ইচ্ছে অনুযায়ী ছেলেদের নানারকম শিক্ষার বন্দোবস্ত করেছেন। তাই ভোর থেকে রাত অবধি আসছেন একের পর এক মাস্টারমশাই। কেউ কুস্তির, কেউ গানের, কেউ অস্থিবিদ্যার, কেউ বা ইংরেজির। অবশ্য বেশি রোজগেরে হওয়ার জন্য এখনকার মতো ছোটোবেলা থেকেই ইঁদুর দৌড় অভ্যাস করতে হয়নি কবিকে। ওঁদের ‘মানুষ হওয়া’র ধারণাটা ছিল অন্যরকম। তাই অভিভাবকেরা চাপ যেমন দিয়েছেন, কল্পনার অবকাশও দিয়েছেন। সেই অবকাশের সঙ্গী হয়েছে, টিভি নয়, জল, মাটি আর আকাশ। কবি লিখেছেন, ভোর হতে না হতেই একছুটে চলে যেতেন বাগানে। মনে হত, দিনটা যেন রঙিন পাড় বসানো বন্ধ খাম। তার ভেতরে কত রহস্য, কত সৌন্দর্য, কত অজানা অনুভব। এমন সংবেদনশীল মনকে তো নিয়মের বেড়ায় আটকে রাখা যায় না। তাই গোঁফের রেখা উঠতে না উঠতেই বউঠানের অগাধ প্রশ্রয়ে বড়োদের পাঁচিল ঘেরা জগতে উঁকি মারা শুরু হল। মনের মধ্যে বাসা বাঁধল বেনিয়মের আলস্য, বানিয়ে তোলা বিষণ্ণতা। বকুল ঝরতে থাকল উদাসী হাওয়ার পথে পথে। আদর্শ হিসেবে পেলেন রোমান্টিক কবি বিহারীলালকে। বিহারীলাল মানুষটি যেমন, তাঁর ভাষাও তেমনি। উদাস, এলায়িত। লঘু ব্যঞ্জনবর্ণ আর সরল অনুপ্রাসে ভরপুর। গেঁয়ো নদীর মতো মিঠে। সেই জলে কখনও সখনও উচ্ছ্বাস জাগে বটে। কিন্তু তাতে তেজের চাইতে ফেনা বেশি। কিশোর রবীন্দ্রনাথের ভাষাও তৈরি হল ওই ছাঁচে। পরে তিনি নিজেই তাই নিয়ে রসিকতা করেছেন। মাইকেলি ভাষা যখন তাঁর চক্ষুশূল ছিল। সেই স্বাভাবিক। কারণ বিহারীলালের লেখনীকে যদি ফুলবাগিচা ঘেরা চালাঘরের সঙ্গে তুলনা করি, মাইকেল তবে চকমেলানো দালান হাঁকিয়েছেন। তাতে ভারী ভারী অসংস্কারের স্তম্ভ। জমকালো ধ্বনির খিলান। ফি লাইনে চোদ্দো অক্ষর বজায় রেখেও, পাংচুয়েশনের নিপুণ ইঞ্জিনিয়ারিং। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ অক্ষর ডম্বর ছাড়া কিছু নেই। সরস্বতীর সঙ্গে বন্দোবস্ত করে মহাকাব্য লেখার ধ্রুপদী নিয়ম মেনে, মাইকেল কোমর বেঁধে নেমেছেন। কিন্তু কল্পনাসুন্দরী পালিয়ে গেছেন জানলা গলে। একে তো কবি ছেলেবেলা থেকে দড়িবাঁধা শিক্ষাদীক্ষার দাপটে হাঁফিয়ে উঠেছেন। তার ওপরে শিষ্যত্ব নিয়েছেন বিহারীলালের। এক অরসিক মাস্টারমশাই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ থেকে ব্যাকরণ শেখাতে গিয়ে আরও বিগড়ে দিয়েছেন তাঁকে। তাই মাইকেলি বাংলা যে একই সঙ্গে আরবি ঘোড়ার মতো তেজিয়ান আর চিক্কনসুন্দর, সেটা তাঁর চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। পরে মুক্তকণ্ঠে সেই ভুল তিনি স্বীকার করেছেন। ভুলটা যদি না হত, তাহলে হয়তো বনফুলের ভাষা অত ফেনায়িত হত না। আবেগের অবাধ প্রবাহে যুক্তির বাঁধ পড়ত। বাঁধ পড়ল, যখন থেকে গুরু মানলেন বঙ্কিমচন্দ্রকে। ভাষা ব্যবহার শেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ কিন্তু Learning নয়, Acquisition -এর রাস্তাতেই হেঁটেছিলেন বেশি করে। তোমাদের বয়সে, তিনি ব্যাকরণের প্রতি খুব অনীহ। কিন্তু সাহিত্য পড়ায় একেবারে চ্যাম্পিয়ান। বলছেন, ‘পড়ার বইয়ের স্থান দেউড়িতে। মনের অন্দর মহলে নয়। তার সার বাঁধা সিলেবল ফাঁক করা বানানগুলো অ্যাকসেন্ট চিহ্নের তীক্ষ্ন সঙিন উঁচাইয়া শিশুপাল বধের জন্য কাওয়াজ করিতে থাকিত।’ তার অন্দরের সঙ্গী ছিলেন শেক্সপিয়র, মুর, বাইরন, পেত্রার্ক, গোল্ডস্মিথ, বাল্মীকি, ব্যাস, হোমার, মিল্টন, ভার্জিল, বিদ্যাপতি, জয়দেব, কালিদাস, চণ্ডীদাস, আরও কত জন! এঁদের লেখা পড়ছেন, অনুবাদ করছেন, কখনও বা অনুসরণের চেষ্টা করছেন আপন আনন্দে। ‘এখন আমি যে সব বই পড়ার চেষ্টা করেছি, কোনও কোনও গুরুজন তা আমার হাতে দেখে মনে করেছেন —স্পর্ধা। কিন্তু শিক্ষার কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে যখন শিক্ষার স্বাধীনতা পেলুম, তখন কাজ বেড়ে গেল অনেক বেশি। অথচ ভার গেল কমে।’ এ সময় তাঁর বয়স কিন্তু পনেরো-ষোলোর বেশি নয়। নিজস্ব ভাষা খুঁজে নেওয়ার জন্য তাঁর লড়াই যে শুরু হয়ে গেছে তা বোঝা যায় ‘মালতী পুঁথি’ দেখলে। এ হল কবির নোটবুক। তাঁর পাতায় সৌন্দর্য, তাঁদের পারস্পরিক প্রভাব, বাংলা শব্দবিধি নিয়ে মন্তব্য। তবু কখনও বিহারীলালের মতো, কখনও বঙ্কিমের মতো, কখনও টমাস চ্যাটারটনের মতো গদ্য-পদ্য লিখতে হচ্ছে তাঁকে। শেষের জন এক বালক কবি। পূর্বসূরিদের নকল করে পদ্য লিখেছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথও বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষায় লিখলেন ‘ভানুসিংহের পদাবলী’। এই বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে কেমনভাবে তিনি নিজস্ব ভাষা খুঁজে পেলেন, আর কীভাবে তা আরও পরিণত হল, পরের হপ্তায় তা নিয়ে আলোচনা হবে। তোমাদের পাঠ্যরচনাগুলোর ভাষারীতি নিয়েও কথা বলব আমরা। তোমাদেরও কিন্তু তৈরি করতে হবে এক একখানা ‘মালতী পুঁথি’। ভাষা শিক্ষার টুকিটাকি লিখে রাখার জন্য পার্সোনাল নোটবুক।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন