রানা! সাবধান!! – ৭

কাজী আনোয়ার হোসেন

সাত

‘সন্তোষ না নিয়ে গিয়েছিল হেলিকপ্টারটা?’ বলল রানা এটা পুরো খুলে দিয়ে। যে করে হোক ঘাটে পৌঁছতে হবে এখন। বিপদটা টের পেয়ে গেছে সে পুরোপুরি।

‘এটা ক্লিনিকের সেই হেলিকপ্টার না,’ বলল শায়লা দ্রুত অগ্রসরমান কপ্টারের দিকে চেয়ে। ‘আগে কখনও দেখিনি এটা। খুব সম্ভব গোপনে রাখা ছিল মিলিটারি এলাকায়।’

নেমে এল হেলিকপ্টার অনেকখানি নিচে। টুপ করে পানিতে পড়ল গোলমত কি যেন বোটের কয়েক গজ সামনে।

‘শুয়ে পড়ো!’ চিৎকার করে উঠল রানা। ‘শুয়ে পড়ো সবাই!’ কয়েক গজ সামনে ফাটল হ্যাণ্ড গ্রেনেড ওদের সবাইকে চুপচুপে করে ভিজিয়ে দিয়ে। এবার গুলি বর্ষণ শুরু করল হেলিকপ্টারের মেশিনগান।

ডানদিকে কাটল রানা। কাৎ হয়ে গেল স্পীড় বোট, পানির ছিটে এসে লাগল সবার চোখে-মুখে। ঠক্ ঠক্ শব্দ করে কাঠ চিরে ঢুকে গেল বোটের মধ্যে কয়েকটা বুলেট। আরও নেমে এসেছে হেলিকপ্টার। পানি ছুঁই ছুঁই করছে চাকাগুলো। সামনের দিক থেকে এগিয়ে আসছে সেটা এবার।

সামান্য বাঁয়ে কেটে সোজা হেলিকপ্টারের দিকে চালিয়ে দিল রানা স্পীড বোট। তেড়ে আসছে স্পীড বোট আর হেলিকপ্টার পরস্পরের দিকে। কেউ হটবার পাত্র নয়। কার সায়ুতে কত জোর যেন পরীক্ষা হবে এবার। রানা হিসেব করে দেখেছে দুটোতে ধাক্কা লাগলে জয়ী হবে স্পীড বোটই। তাছাড়া মেশিনগানের গুলি থেকে বাঁচতে হলে কাছাকাছি থাকতে হবে হেলিকপ্টারের। কো-পাইলট গুলি চালাচ্ছে ঠিকই কিন্তু অ্যাঙ্গেলে পাচ্ছে না আর ওদের, কয়েক ফুট পিছনে পানিতে পড়ছে সব গুলি।

নিজের অসুবিধার কথা টের পেল পাইলট। এই অবস্থায় ধাক্কা খেলে বোটের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে হেলিকপ্টারের। ফুট ছয়েক থাকতেই রণে ভঙ্গ দিল সে। উঠে গেল কয়েক হাত উপরে। সাঁ করে বেরিয়ে গেল স্পীড বোট হেলিকপ্টারের তলা দিয়ে একরাশ পাখার বাতাস খেয়ে।

আবার ডান দিকে কাটল রানা। সোজা এগোচ্ছে সে তীরের দিকে। আবছা মত ঝোপঝাড় দেখা যাচ্ছে তীরে। কপ্টারও চলেছে সাথে সাথে। আক্রমণের চেষ্টা করছে না সেটা আর। খুব সম্ভব রেডিও মারফত ওদের পজিশন জানাচ্ছে অন্যদের।

‘রানা, পানি উঠছে বোটে,’ বলল শায়লা।

‘গর্তটা খুঁজে বের করে বন্ধ করবার চেষ্টা করো,’ হুকুম দিল রানা।

‘একটু বাঁয়ে একটা খালের মুখ দেখা যাচ্ছে, রানা। দুই পাশে জঙ্গল, বলল শায়লা একটু পরে। ভয়ানক ভয় পেয়েছে সে। কিংবা পানিতে ভিজে শীতে কাঁপছে।

‘ওই দিকেই যাব। আগে তীরের কাছে গিয়ে নিই,’ উত্তর দিল রানা। ‘পানি বন্ধ হয়েছে?’

‘কমেছে, একেবারে বন্ধ হয়নি। দুটো ফুটো।’

পারের কাছাকাছি এসে গাছের ছায়ায় ছায়ায় এগোল রানা বাঁয়ে। কিন্তু ঠিক যখন খালের মুখে ঢুকে পড়বে সেই সময় হঠাৎ আঙুল তুলে দেখালেন ডক্টর ফৈয়াজ। ‘ওই দেখো, লঞ্চ আসছে।

তেতো হয়ে গেল রানার মনটা। ইচ্ছে করছিল না, তবু পিছন ফিরে দেখল সে। মাইলখানেকও হবে না। দোয়াতের কালির মত কালো পানির ওপর সাদা ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছে একটা লঞ্চ।

ঢুকে পড়ল রানা সরু খাল দিয়ে। স্পীড কমিয়ে দিল। খালের দুই ধারে উঁচু তীর। প্রকাণ্ড সব গাছ-পালা খালের দুই তীরে গজিয়ে উঠে আকাশে গিয়ে পরস্পরের সাথে মিশেছে। তলায় নিকষ কালো অন্ধকার। রানা বুঝল বেশি দূরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু যতদূর যাওয়া যাবে ততই লাভ। লঞ্চ আসতে পারবে না ভিতরে। স্পীড বোটের তলাই মাঝে মাঝে হালকাভাবে স্পর্শ করছে নিচের মাটি।

আধ মাইল এসে ঘ্যাশ্শ্ করে থেমে গেল স্পীড বোট। আর যাবে না। সাদেক খানকে নামানো হলো আগে, তারপর কোলে করে নামিয়ে আনল রানা ডক্টর ফৈয়াজকে- একহাতে ঝুলিয়ে নিল ওঁর হুইলচেয়ার। তারপর নামল শায়লা ওর খাবার আর ওষুধের বাক্স নিয়ে। এবার টেনে একটু গভীর পানিতে নিয়ে গেল রানা বোটটাকে। এমনিতেই পানি খেয়ে ঢোল হয়ে গেছে ওটার পেট, আধ মিনিট এদিক-ওদিক দোলাতেই তলিয়ে গেল নিচে।

হুড লাগানো পেন্সিল টর্চ জ্বেলে অল্পক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরই একটা সরু পথ পেল রানা। উঁচু-নিচু পাহাড়ী পথ, কিন্তু অমসৃণ নয়। বেশ কিছুদূর হাঁটবার পর দেখতে পেল সে গুহাটা। খালের ধারে ফিরে এসে একে একে সাদেক খান এবং ডক্টর ফৈয়াজকে নিয়ে এল সে পাহাড়ী পথটার ওপর। ডক্টর ফৈয়াজকে হুইল-চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সাদেক খানকে তুলে নিল পিঠে। ঘুমন্ত অবস্থায় দ্বিগুণ ওজন হয়ে যায় মানুষের। ধীরে ধীরে এগোল ওরা গুহাটার দিকে। আগে আগে টর্চ হাতে চলল শায়লা।

গুহায় পৌঁছে সাদেক খানকে পিঠের ওপর থেকে নামিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল রানা। বলল, ‘বাব্বাহ্, জগদ্দল পাথর! এইটাকে সজ্ঞানে হাঁটিয়ে নেয়া যায় না?’

‘জ্ঞান ফিরতে ওর আরও দুই ঘণ্টা,’ বললেন ডক্টর ফৈয়াজ।

‘দেখি, ভজিয়ে ভাজিয়ে যদি হাঁটাতে পারি তাহলে বেঁচে যাই। যদি হঠাৎ খেপে ওঠে, সামলানো যাবে তো? ওষুধ আছে সঙ্গে?’

‘তা আছে, বলল শায়লা। ‘ওর পাগলামি শুরু হবার কয়েকটা সিম্‌টম্‌ আছে। টের পেলেই ঠাণ্ডা করে দেয়া যাবে।

‘কিন্তু ঘণ্টা দুই অপেক্ষা করব, না এখুনি রওনা হয়ে যাব ভাবছি। আজ রাতে পৌঁছতেই হবে ইলোরে। এখানে বসে থাকলে ধরা পড়ে যেতে পারি। লঞ্চ থেকে সৈন্য নামানো হবে ডাঙায়, সার্চ আরম্ভ হয়ে যাবে আজই রাতে। খুব বেশিদূর যে যেতে পারব না আমরা তা ওরা ভাল করেই জানে। তার ওপর নিরস্ত্র আমরা তিনজনই,’ যেন নিজের সাথেই কথা বলছে এমনিভাবে বলে চলল রানা। ‘কিন্তু ছয় মাইল ওকে পিঠে নিয়ে হাঁটা অসম্ভব। কাজেই দেরি…আচ্ছা! কোন ওষুধ দিয়ে, ওর জ্ঞান ফিরিয়ে আনা যায় না?

‘যায়। কিন্তু তার দরকার হবে না। বড় বড় হাই তুলছে, অল্পক্ষণেই জেগে যাবে ও। খুব সম্ভব পানিতে ভিজে ওষুধের প্রভাবটা কেটে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি।

কিন্তু বিশ মিনিটের মধ্যে ভাঙল না সাদেক খানের ঘুম। ভিতর ভিতর অস্থির হয়ে উঠল রানা। ভারতীয় সৈন্যগুলো এই গুহা থেকে আর কতদূরে আছে কে জানে? ওরা কোন্ দিকটা আগে খুঁজবে? ওরা কি আন্দাজ করে নেবে যে ইলোরের দিকেই যাবে রানারা?

রানার অস্থিরতা বুঝতে পেরে সিরিঞ্জ বের করল শায়লা ওর মেডিকেল কিট থেকে। তারপর একটা কর্ক আঁটা গ্লাস টিউব থেকে সামান্য ওষুধ নিয়ে ঢুকিয়ে দিল সাদেক খানের হাতে। দশ সেকেণ্ডের মধ্যে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল সাদেক খান।

‘কোথায় আমি!’ এদিক-ওদিক চাইল সে। রানার দিকে চাইল সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে। ‘কে আপনি? কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে?’

‘আমার নাম মাসুদ রানা। পাকিস্তানী স্পাই। আমি পাকিস্তান থেকে এসেছি আপনাকে এই পাগলা গারদ থেকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে। আপনাকে বন্দী করে নিয়ে এসেছিল ওরা এইখানে।

‘না, আমাকে বন্দী করে আনবে কেন? আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে পাকিস্তান এদের কাছে।

‘পাকিস্তান মস্ত ভুল করেছিল। সেজন্যে অনুতপ্ত হয়ে পাঠিয়েছে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে,’ কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল রানা।

‘ফিরিয়ে নিয়ে কি করবে? হেমায়েতপুর পাগলা গারদে পাঠাবে তো? আমি যাব না।’ ডক্টর ফৈয়াজের দিকে চোখ পড়তেই বলল, ‘এই ল্যাংড়া এখানে কেন? ওকেও কি বিক্রি করে দিয়েছিল পাকিস্তান?’

‘না। উনি ভারতীয়। আমাদের সাহায্য করছেন পালিয়ে যাবার ব্যাপারে। আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে কয়েকজন গার্ড- যে-কোন মুহূর্তে ওরা এসে পড়তে পারে এখানে- আর তো দেরি করা ঠিক হবে না। ধরা পড়লে আমাদের সবাইকে গুলি করে খুন করবে ওরা।

‘আমাকে মারবে না,’ বলল সাদেক খান সবজান্তার হাসি হেসে। ‘আমি মহা-মূল্যবান সম্পদ ওদের। আমি পালাতে যাব কোন্ দুঃখে? আমার ব্রেনের সাহায্য নিয়ে ওরা একটা কম্পিউটার তৈরি করছে। আমাকে কিছুতেই…’

‘বোকার মত কথা বলছেন আপনি,’ রানা বুঝল একে ভয় না দেখালে কাজ উদ্ধার হবে না। ‘কম্পিউটারটা ধ্বংস করে দিয়েছি আমি। যে বৈজ্ঞানিকের সাহায্যে ওই কম্পিউটার তৈরি করা হচ্ছিল সেই ডক্টর ফৈয়াজ চলেছেন আমাদের সঙ্গে। কাজেই শুধু শুধু আপনাকে কোলে বসিয়ে সকাল- বিকেল চুমু খাবে না ভারত সরকার। আপনার এক কানাকড়িও মূল্য নেই এখন ওদের কাছে। এলে আসতে পারেন, নইলে চললাম আমরা। আপনাকে দেখতে পেলেই কুকুরের মত গুলি করে মারবে ওরা এখন।

এবার সত্যিই ভয় পেল সাদেক খান। কয়েক সেকেণ্ড স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মাটির দিকে, তারপর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।

‘আসছে ওরা!’ ফ্যাশফেঁশে কণ্ঠে বলল সাদেক খান। ‘ক্যাপ্টেন খান্না এইমাত্র বলল, ‘নিশ্চয়ই গুহার মধ্যে পাবে ওদের, ওরা ভাববে খুঁজে পাব না আমরা। বাধা দিলে গুলি চালাবে।’- পালান সাহেব। আসছে ওরা!’ রানার কাছাকাছি সরে এল সে ভয়ে ভয়ে। ‘ঠিকই বলেছেন আপনি। আমার আর কানাকড়িও মূল্য নেই ওদের কাছে। কাল রাতেই বিষ খাইয়ে খুন করতে চেয়েছিল ওরা আমাকে। আপনি বাঁচান আমাকে, মিস্টার!

‘কোন ভয় নেই আপনার। আমার কথামত চললে এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকায় ফিরে রেক্সের পরোটা-কাবাব খাওয়াব। নিন, চলুন, ওই পোঁটলাটা তুলে নিন মাথার ওপর।

দুই ঘণ্টা একটানা চলার পর জঙ্গলের শেষ প্রান্তে পাকা সড়কের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ওরা। ভোর হয়ে আসছে। ইলোর আর আধ মাইল। মেডিকেল কিটটা মাটিতে নামিয়ে তার পাশে বসে পড়ল রানা। কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘বসে পড়ো, শায়লা। বসুন, সাদেক সাহেব। পাঁচ মিনিট রেস্ট। দেখুন তো, সাদেক সাহেব, গার্ডরা এখন কি ভাবছে?

‘ওরা আশেপাশে অনেকটা জায়গা খুঁজেছে আমাদেরকে গুহায় না পেয়ে। তারপর ফিরে যাচ্ছে ক্যাপ্টেনের কাছে রিপোর্ট করতে। ও আমি হাঁটতে হাঁটতেই টের পেয়েছি অনেকক্ষণ আগে।’

‘বাহ্, চমৎকার! এবার আমি বেরোব একটা গাড়ির খোঁজে। আপনারা বিশ্রাম…’

‘না না, গাড়ি না,’ হাত নেড়ে নিষেধ করল সাদেক খান। ‘এই কিছুক্ষণ আগেই কর্নেল বটব্যাল খান্নাকে বলল বিজয়ভদ থেকে রাজামুন্দ্রি পর্যন্ত প্রত্যেকটা গাড়ি যেন সার্চ করা হয়। গাড়িতে পালাতে পারবেন না, জনাব।’

চমকে উঠল রানা। চট্ করে চাইল ডক্টর ফৈয়াজের দিকে। মাথা ঝাঁকালেন বদ্ধ, পাগলের প্রলাপ নয়, ঠিকই বলছে সাদেক খান। ‘কতটা বিশ্বাসযোগ্য?’ জিজ্ঞেস করল রানা সংক্ষেপে।

‘সেণ্ট পারসেন্ট,’ জবাব দিলেন ডক্টর ফৈয়াজ।

‘তাহলে উপায়?’

‘উপায় ও-ই বাতলে দেবে। আচ্ছা, সাদেক, ট্রেন সম্পর্কে কেউ কোন আলাপ করেছে কিনা দেখো তো চিন্তা করে?’

‘না। ট্রেন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল খান্না কর্নেলকে। সে বলেছে স্টেশনে ঢুকতে সাহস পাবে না পলাতকেরা। শুধু শুধু ট্রেনের যাত্রীদের হয়রানি করা ঠিক হবে না।’

উঠে দাঁড়াল রানা। ‘আমি এক্ষুণি গিয়ে রাজামুন্দ্রির টিকেট করে আনছি। আপনারা জঙ্গলের আরেকটু ভিতরে গিয়ে অপেক্ষা করুন।

‘কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? একা…’ কিছু বলতে যাচ্ছিল শায়লা, বাধা দিল রানা।

‘এছাড়া আর কিছুই করবার নেই আমাদের, শায়লা। এটা এতই বিপজ্জনক যে সাদেক খান না বললে কিছুতেই এক পা-ও যেতাম না আমি স্টেশনের দিকে। ঠিক এই কারণেই ওরা স্টেশনটা ধর্তব্যের বাইরে রেখেছে- ট্রেনে করে আমরা পালাবার ঝুঁকি নিতে পারি একথা কল্পনাতেও আসেনি বটব্যাল লোকটার। তাই ওটাই এখন একমাত্র বিপদমুক্ত পথ। আর একার কথা বলছ, একা গেলেই বিপদের সম্ভাবনা কম। যদি গোলমাল দেখি একা কেটে পড়তে সুবিধা হবে আমার- সবাই থাকলে অসুবিধায় পড়ব তখন। যদি দেখি সব ঠিক আছে তাহলে ফিরে এসে নিয়ে যাব তোমাদের। আর যদি না ফিরি তাহলে বুঝবে কোনও কিছু ঘটেছে। তাহলে যেভাবে পারো হায়দ্রাবাদ যাওয়ার চেষ্টা করবে। একটা ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, এই ঠিকানায় দেখা করবে ইউসুফ গজনভি বলে একজন লোকের সঙ্গে। ও তোমাদের পাকিস্তানে পৌঁছবার ব্যবস্থা করে দেবে। একটুকরো কাগজে খসখস করে লিখল রানা ঠিকানাটা। তার নিচে লিখল- সাদেক খানকে সঙ্গে নেয়ার কোন দরকার নেই।

কিছু বলতে যাচ্ছিল শায়লা, বাধা দিয়ে কথা বলে উঠলেন ডক্টর ফৈয়াজ।

‘ঠিকই বলেছে রানা। একা গেলেই বরং বিপদের আশঙ্কা কম। তুমি যদি এক ঘণ্টার মধ্যে না আসো তাহলে এই জায়গা থেকে ঠিক আধমাইল উত্তরে জঙ্গলের মধ্যে সরে গিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করব আমরা আজ সারাদিন। যদি অন্য কোন কারণে দেরি হয় তাহলে ওখানে দেখা পাবে আমাদের।’

‘আজকের বেশি কিন্তু কোনও অবস্থাতেই দেরি করবেন না।’ সাদেক খানের দিকে চাইল রানা। চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে গুনগুন গান গাইছে সে। ‘ওকে সামলাতে পারবেন? না সঙ্গে নিয়ে যাব?’

‘ওকে রেখেই যাও। কোন অসুবিধে হবে না। আমরা সামলাতে পারব।’ পকেট থেকে কিছু টাকা আর একটা ক্ষুরধার ছুরি বের করে দিলেন বৈজ্ঞানিক রানার হাতে। ছুরিটার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এটা সাথে রাখো। দরকার হতে পারে।

রাস্তায় উঠেই দ্রুতপায়ে এগোল রানা স্টেশনের দিকে। ফর্সা হয়ে আসছে চারদিক। বেশি লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে আসার আগেই পৌঁছতে হবে ওকে স্টেশনে।

স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে সাবধানে চারদিকে চাইল রানা। একটা পান- বিড়িওয়ালা ছোকরার কাছ থেকে সিজার সিগারেট কিনল পাঁচটা। কোন পুলিস বা মিলিটারি চোখে পড়ল না ওর। অসাধারণ কিছুই চোখে পড়ল না। স্টেশনের স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজকর্ম চলছে। সুইপার ঝাড়] দিচ্ছে প্ল্যাটফরম, নোংরা কাঁথা গায়ে একপাশে শুয়ে আছে কয়েকজন লোক, অসংখ্য মাছি ভন ভর করছে। বুকিং অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। কাউন্টারে বসে গাল চুপসানো একজন বয়স্ক লোক চশমাটা নাক পর্যন্ত নামিয়ে নিয়ে মাথা পিছন দিকে করে খবরের কাগজ পড়ছে।

চারপাশে চোখ বুলাল রানা একবার। আপার ক্লাস ওয়েটিং রূমের দরজাটা খুলে গেল। প্রকাণ্ড গোঁফওয়ালা এক জমাদার বেরোল সেখান থেকে, বগলে নারকেলের ঝাড়ু আর হাতে বালতি।

‘যাবেন কোথায়?’ গলার স্বর ভেসে এল কাউন্টারের ওপাশ থেকে।

‘রাজামুন্দ্রির চারটে টিকেট দিন,’ বলল রানা পরিষ্কার হিন্দিতে।

বিনা বাক্য-ব্যয়ে কড়ায় গণ্ডায় পয়সা বুঝে নিয়ে চারটে টিকেট বের করে খটাং খটাং ডেট লাগিয়ে দিল চমশাধারী। তারপর বলল, ‘আটটায় ছাড়বে গাড়ি।

একটা গাড়ি এসে ইন্‌ করছে তখন স্টেশনে। রানাকে ওটার দিকে চাইতে দেখে বলল, ‘এটা না। এটা হায়দ্রাবাদ এক্সপ্রেস।’

মাথা নাড়ল রানা- যেন আগে থেকেই জানে, এমনি ভাবে। তারপর ঘুরে দাঁড়াল। তাহলে ঠিকই বলেছে সাদেক খান। ওরা কল্পনাও করতে পারেনি যে রানারা ট্রেনের সাহায্য নিতে পারে।

কয়েক পা এগিয়েই একজন হায়দ্রাবাদ থেকে আগত যাত্রীর সাথে ধাক্কা খেল রানা।

‘মাফ করবেন,’ বলে সরে যাচ্ছিল রানা; হঠাৎ ধক করে উঠল ওর বুকের ভিতরটা। সর্বাঙ্গ বরফ-জমা আড়ষ্ট হয়ে গেল।

বিস্মিত ভীত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে লোকটা ওর মুখের দিকে।

প্রফেসর সন্তোষ মুখার্জী!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন