রানা! সাবধান!! – ৪

কাজী আনোয়ার হোসেন

চার

কি হয়েছে?’ পুলিস ভ্যান থেকে নেমে এল একজন অফিসার।

‘এই লোকটা প্লেন নিয়ে আক্রমণ করেছিল আমাদের ব্যারাক। লছমন আর ভৌমিক গুলি করে নামিয়েছে,’ জানাল একজন সীমান্তরক্ষী উত্তেজিত কণ্ঠে।

‘কে তুমি? কি হয়েছিল প্লেনের?’ জিজ্ঞেস করল অফিসার রানাকে। ‘আমার নাম মাসুদ রানা। প্লেনের দু’জন গার্ডকে খুন করে পাইলটকে ভারতীয় এলাকায় ল্যাণ্ড করতে বাধ্য করেছি আমি।

‘কেন?’ প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারল অফিসার এখন এই লোকটাকে দিয়ে কোন কথা বলালে গুজব আরম্ভ হয়ে যেতে পারে। ‘ঠিক আছে সব কথা হেড কোয়ার্টারে গিয়ে শোনা যাবে। উঠে পড়ো গাড়িতে।

অফিসারের পাশেই বসানো হলো রানাকে। আগেই সার্চ করে দেখা গেছে অস্ত্র নেই রানার সাথে। ছেড়ে দিল গাড়ি। অল্প কিছুদূর গিয়ে রাস্তার বামে থেমে দাঁড়াল কয়েক সেকেণ্ড টং-টং করে ঘণ্টা দিতে দিতে দুটো দমকল লরী চলে গেল বিধ্বস্ত প্লেনটার দিকে। চলল এবার ওরা আগরতলার দিকে।

‘পাকিস্তানী?’ প্রশ্ন করল অফিসার। তারপরই রানার দুইহাতের কব্জিতে ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেল সে। ‘বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তোমাকে। হাতকড়ার দাগ না ওগুলো? স্পাই?’

‘হ্যাঁ। আমাকে কোর্টমার্শালের জন্যে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ঢাকায়।’

বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল অফিসার রানার মুখের দিকে। বোধহয় আন্দাজ করতে পারল কেন একজন পাকিস্তানী স্পাইকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ঢাকায় কোর্টমার্শালের জন্যে, কেন ভারতীয় এলাকায় প্লেন ল্যাণ্ড করাতে পারলে ভয়ের কিছুই নেই বলে ভাবছে একজন পাকিস্তানী স্পাই। চুপ করে রইল সে। এসব ডিফেন্সের ব্যাপারে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল।

‘আমার ডান পায়ের কব্জিটা বোধহয় ভেঙে গেছে। আগরতলা পৌঁছেই কোন ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করানো দরকার।’

‘চিন্তা করবেন না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

পুলিস হেডকোয়ার্টার থেকে দু’তিন জায়গায় টেলিফোন করতেই যেন ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়ল। মুহুর্মুহুঃ রানা সংক্রান্ত টেলিফোন আসতে আরম্ভ করল পুলিস হেডকোয়ার্টারের পাঁচ-পাঁচটা লাইনে। অস্থির হয়ে উঠল অফিসার। ক্রমে রানার প্রতি তার ব্যবহারটা ধমক থেকে সমীহ, শেষকালে শ্রদ্ধায় পরিণত হলো। রীতিমত খাতির-যত্ন আরম্ভ করল লোকটা রানাকে। এক কথায় যাকে বলে ভি আই পি টিস্টমেণ্ট। চা, সিগারেট এমন কি শেষ পর্যন্ত পানও খাবার অনুরোধ করে বসল সে রানাকে। ইতিমধ্যে লোশন লাগিয়ে রানার মচকানো পায়ে ব্যাণ্ডেজ করে দিয়েছে একজন ডাক্তার।

আধঘণ্টার মধ্যে দিল্লীর সাথে জরুরী বেতার যোগাযোগের পর চারজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারী এসে উপস্থিত হলো ল্যাণ্ডরোভারে করে। তাদের একটা ঘরে বসিয়ে রানাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে।

‘বসুন,’ বলল এদের মধ্যে কর্নেল র‍্যাঙ্কের অফিসার। পুলিসের অফিসারকে বলল, ‘আপনি এবার যেতে পারেন, প্রয়োজন হলে ডাকব।

‘ইয়েস, স্যার। বেরিয়ে গেল পুলিস অফিসার।

‘আপনার নাম মেজর মাসুদ রানা? পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন এজেন্ট- দেশের বাইরে কার্যরত অবস্থায় প্রয়োজন বোধে মানুষ হত্যার অনুমতি যে পেয়েছে সরকারীভাবে?’

‘দু’জনকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। আমি তাদের মধ্যে একজন,’ বলল রানা।

‘কিছুদিন আগে আপনি আমাদের হয়ে কাজ করবেন বলে লিখিতভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন?’

‘খুব সম্ভব,’ আমতা আমতা করে বলল রানা।

‘খুব সম্ভব? তার মানে?’

‘মানে…মানে, ঠিক মনে নেই। অ্যাক্সিডেন্টের পর কিছু কিছু কথা চেষ্টা করেও মনে আনতে পারছি না।

‘মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন নাকি?’ সচকিত কণ্ঠে বলল কর্নেল। ‘এইবার মনে এসেছে। জেনেভায় একরাতে, অতিরিক্ত মদ খেয়েছিলাম, সুহর্ষ নাগ বলে একজনের সাথে পরিচয় হয়েছিল, তাকে বলেছিলাম আপনাদের হয়ে কাজ করতে রাজি আছি…’

‘সেসব তো দু’মাস আগের কথা। তারপর কোন ঘটনা স্মরণ করতে পারছেন না?’

‘হ্যাঁ, বিস্ফোরণ…ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম আমি দু’জনের ওপর…তারপর জোরে ধাক্কা খেল প্লেনটা যেন কিসের সঙ্গে। লোকগুলোকে বের করবারও চেষ্টা করেছিলাম আমি…’

এ সবকিছুই জানি আমরা,’ বলল কর্নেল। ‘গতকাল রেঙ্গ]নে চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিসের হাতে বন্দী হয়েছিলেন আপনি। ওখান থেকে মান্দালয়ে নিয়ে আসা হয় আপনাকে কালই ইন্টারোগেশনের জন্যে। মনে পড়েছে?’

‘কই না তো। মান্দালয়? আমার মনে পড়ছে রিভলভার কেড়ে নিয়ে গুলি করেছিলাম গার্ডদের। হঠাৎ ডিগবাজি খেতে আরম্ভ করল প্লেনটা…’

‘ঠিক আছে। পাইলট এবং দু’জন গার্ড ঠিকই ছিল। ওরা তিনজন চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিসের লোক ছিল। ওদের ইউনিফরমের দুই-একটা ব্রাসের টুকরো পাওয়া গেছে ভস্ম স্তূপের মধ্যে। কিন্তু আমরা জানতে চাই অন্যকথা। টেবিলের উপর কনুই রেখে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এল কর্নেল।

‘চীন সফর শেষ হলে হংকং থেকে কাগজ-পত্র নিয়ে এসেছিলেন আপনি রেঙ্গুনে। মনে আছে?’

‘কাগজ-পত্র?’ অবাক হলো রানা।

‘হ্যাঁ, অত্যন্ত জরুরী কিছু কাগজ-পত্র। বইয়ের মধ্যে ছিল। হংকং-এর একটা বইয়ের দোকান থেকে বইটা কিনে রেঙ্গ]নের আরেকটা দোকানে বিক্রি করেছিলেন আপনি সেটা। পথে তথ্যগুলো মুখস্থ করেছিলেন আপনি ঢাকায় আমাদের এজেন্টকে দেবার জন্যে- অত্যন্ত জরুরী কয়েকটা তথ্য, মনে নেই?’

‘কোথায়। মনে পড়ছে না-তো!’ ভুরু কুঁচকে মনে আনবার চেষ্টা করল রানা। ‘খুবই কি জরুরী কিছু। মনে আসছে না তো আমার…’

‘ভাল করে ভেবে দেখুন,’ বলল কর্নেল।

‘চেষ্টা তো করছি, মনে না এলে কি করব?’ জবাব দিল রানা।

নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কি যেন আলোচনা করল অফিসাররা। বেল টিপতেই তটস্থ হয়ে ঢুকল ঘরে পুলিস অফিসার।

‘এই ভদ্রলোকের মেডিকেল চেক-আপ করা হয়েছে?’

‘পা মচকে গিয়েছিল, ডাক্তার ডেকে ব্যাণ্ডেজ করিয়ে দিয়েছি, স্যার।’

‘আর কিছু চেক করা হয়নি?’

‘না, স্যার। উনি বললেন কেবল পায়ে ব্যথা পেয়েছেন তাই…’

‘মানুষটা প্লেন ক্র্যাশে আহত হলো, সাথের তিনজন মারাই গেল, তবু আপনি থরো মেডিকেল চেক-আপ করাননি ওর?’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল কর্নেল। রানা বুঝল তথ্যগুলো ভারতের জন্যে নিশ্চয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রানার দিকে ফিরে বলল কর্নেল, ‘আপনি আপনার স্মৃতিভ্রংশের কথা বলেননি ওকে?’

‘না। আমি নিজেও ভাল করে টের পাইনি আগে, এখন বুঝতে পারছি। দিল্লীর সাথে রেডিও মারফত আলাপ করা হলো। রানার স্মৃতিভ্রংশের কথা জানানো হলো, সেখান থেকে ডিরেকশন এল। নোট করে নিয়ে আবার ঘরে প্রবেশ করল কর্নেল। টুকিটাকি কয়েকটা প্রশ্ন করে রানার উত্তরগুলো লিখে নিল সে। খুবই চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন মনে হলো তাকে।

‘ঠিক আছে,’ উঠে দাঁড়াল কর্নেল। সাথে সাথে আর সবাইও দাঁড়াল। ‘কিচ্ছু ভাববেন না। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবেন আপনি ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। নয়াদিল্লীর সাথে কথা বলেছি, আপনার সব রকমের সুবিধার দিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে আমাকে। আজই রাতে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নয়াদিল্লী, ওখান থেকে আমাদের একটা স্পেশাল ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হবে। খুব শীঘ্রিই ভাল হয়ে যাবেন।

‘অনেক ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘কোথায় সেই ক্লিনিকটা?’

‘দাক্ষিণাত্যে। কোলায়ের লেকের একটা দ্বীপে। ভারতের সেরা মেন্টাল ক্লিনিক ওটা এখন।’

যেন দাক্ষিণাত্যেই হোক আর দার্জিলিং-এই হোক রানার কিচ্ছু যায় আসে না, এমনিভাবে মাথা নাড়ল রানা। ভিতরের উচ্ছ্বাস টিপে মারল সে কঠিন হাতে- চেহারায় প্রকাশ পেল না একবিন্দুও। ঠিকই বলেছিল বুড়ো- চীনা এজেন্টের নামের লিস্টটা খুবই দরকার ভারতের। তাই সেরা ক্লিনিকে পাঠাবে এরা রানাকে। এই রকম প্ল্যান মাফিক ভালয় ভালয় বাকিটুকু সারা গেলেই হয় এখন। আসলে বাইরে থেকে সব কিছুই কঠিন মনে হয়, কাজে নেমে গেলে কেমন করে যেন সহজ হয়ে যায় সবকিছু। এ রানা বহুবার দেখেছে। মনটা হালকা হয়ে গেল রানার।

.

খলখল করে হেসে উঠল লোকটা।

বিছানার উপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে একটি রমণীদেহ। এলোমেলো কুঁচকানো বিছানার চাদর। কপালটা একখানে অসম্ভব ফুলে উঠেছে রমণীর। অসাড় দেহটা জ্ঞানহীন মনে হচ্ছে- তবে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে।

এবার দ্বিতীয় ক্যামেরায় ধরা পড়ল একজন লোকের চেহারা। দোহারা গড়ন, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে অস্বাভাবিক দৃষ্টি। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। দুই কষা বেয়ে লালা গড়াচ্ছে। লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিছানার দিকে।

এগোতে গিয়েও কি মনে করে ফিরে গেল লোকটা ড্রেসিং টেবিলের কাছে। ড্রয়ার টেনে কি যেন খুঁজল ব্যস্ত হাতে। কি যেন মুঠো করে ধরে এগিয়ে এল সে বিছানার পাশে। বালিশের পাশে রাখল সে জিনিসটা।

প্রথম ক্যামেরা চালু হলো আবার। বালিশের পাশে দাড়ি কামানোর খুর দেখা গেল একটা। আলোর প্রতিফলন হচ্ছে ওটার চকচকে খোলা ব্লেড়ে। তেমনি শুয়ে রয়েছে রমণী। জ্ঞানহীন। উঠে এসেছে লোকটা, দুলে উঠল বিছানা।

সামনের দিকে ঝুঁকে নিবিষ্টচিত্তে একশো পঞ্চান্নতম বার উপভোগ করছে দৃশ্যটা কর্নেল মিস বটব্যাল। একা। প্রশস্ত ঘরটায় প্রজেক্টারের একটা মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে কর্নেল বটব্যালের। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে, শুকিয়ে এসেছে জিভ। ধ্বক্ ধ্বক্ করে জ্বলছে দুই চোখ। স্ক্রীনের ওপরের দৃশ্যটা গিলে খাচ্ছে যেন সে।

অদ্ভুত ধরনের একটা মুখোশ পরা কর্নেল মিস্ বটব্যালের মুখে। পাতলা রাবারের তৈরি। নাক, মুখ, চোখ সবই আছে ঠিক ঠিক জায়গায় বসানো, কিন্তু সবটা মিলে কেমন বিকট লাগে দেখতে। রুজ লিপস্টিক লাগানো আছে গালে, ঠোঁটে। মুখে সর্বক্ষণ লেগে আছে একই মাপের একটুকরো হাসি। আড়ালে হয়তো তার সম্পর্কে সমালোচনা হয়, কিন্তু এই মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে বুক কাঁপবে না এমন বীরপুরুষ খুব কমই আছে ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসে। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বদমেজাজী উচ্চপদস্থ অফিসার সে সার্ভিসের।

ঘামে পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে মুখোশ। চোখের গর্তটা সরে যেতে চাইছে একপাশে- ব্যস্ত হাতে টেনে ঠিক করে নিল বটব্যাল। সমস্ত মনোযোগ তার একত্রীভূত হয়েছে এখন স্ক্রীনের ওপর। এইবার!

ঠিক এমনি সময় ডেস্কের উপর একটা ওয়ার্নিং লাইট জ্বলে উঠল পরমুহূর্তে বেল বেজে উঠল ঘরের মধ্যে। রসভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় জিভ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করল মিস্ বটব্যাল। প্রজেক্টার অফ করে দিয়ে ডেস্কের ওপরের একটা সুইচ টিপল সে। দেয়ালের গায়ে বসানো ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন স্ক্রীনে আগন্তুকের চেহারা দেখা গেল। আরেকটা সুইচ টিপতেই একটা দরজা খুলে গেল। ঘরে প্রবেশ করল সামরিক পোশাক পরা একজন লোক।

‘কি খবর, ক্যাপ্টেন খান্না? বিরক্ত করবার আর সময় পেলে না?’ কণ্ঠস্বরটা বিরক্ত কিন্তু মুখোশের মেকি হাসিটা লেগেই আছে ঠোঁটে, তাই অস্বাভাবিক শোনাল কথাগুলো।

মিস্ বটব্যালের মুডের সাথে গত তিনমাসে ভাল ভাবেই পরিচয় হয়ে গেছে ক্যাপ্টেন খান্নার, তাই প্রথমে কাজের কথায় এল সে।

দিল্লী থেকে মেসেজ এসেছে। এসে গেছে মাসুদ রানা। ওকে এই ওঙ্কার দ্বীপের উদ্দেশে রওনা করে দেয়া হয়েছে প্লেনে।

এক কথাতেই পাল্টে গেল বটব্যালের মেজাজ। খুশি হয়ে উঠল সে। বলল, ‘ভারতে ঢুকল কি করে?’

‘প্লেন ক্র্যাশ। আগরতলায়। পুরো রিপোর্ট পৌঁছে যাবে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে।

‘মাসুদ রানার শারীরিক কোন ক্ষতি হয়নি তো?’

‘না। তবে স্মৃতিভ্রংশের ভান করবে বলেছিলেন, ঠিক তাই হয়েছে।’

‘তা তো হবেই। ওরা জানে ডক্টর আবদুল্লাহ ফৈয়াজ অ্যামনেশিয়ার বিশেষজ্ঞ। কাজেই এ রকম একটা কিছু ভান করলে ওঙ্কার দ্বীপে এসে পৌঁছতে পারবে মাসুদ রানা।’

মৃদু হাসল_ ক্যাপ্টেন খান্না। ‘এ পর্যন্ত এই ব্যাপারে আপনি যা যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সবগুলো মিলে গেছে কাঁটায় কাঁটায়। আৰ্য…’

‘অত আ র্য হবার কি আছে? তুমি কি মনে করেছিলে এক-আধটা কথা না-ও মিলতে পারে?’ জিজ্ঞেস করল কর্নেল বটব্যাল কঠোর কণ্ঠে।

‘না, না। তা ঠিক ভাবিনি। তবে ওদের প্রত্যেকটা প্ল্যান, প্রত্যেকটা কার্যকলাপ, প্রতিটা খুঁটিনাটি এমন নির্ভুলভাবে দু’মাস আগে বলে দিলে কে না আ র্য হবে, বলুন?’

‘আমি বৈজ্ঞানিকের মত চুল চেরা বিশ্লেষণ করেছি এই ব্যাপারটা খান্না, একটা বিশেষ ব্যক্তিগত স্বার্থে। যখনই পাকিস্তান এবং চীন জানতে পেরেছে সাদেক খানের আ র্য শক্তির কথা তখনই জানি ওরা একজন এজেন্ট পাঠাবে হয় ওকে খুন করতে, নয় দেশে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করতে। পাঠাবেই। আর যেহেতু শায়লা ফৈয়াজকে একবার বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিল মাসুদ রানা- মাসুদ রানাকে পাঠানোই স্বাভাবিক। তার পরের ব্যাপারগুলো তো ছক বাঁধা গৎ। কথা বলতে গিয়ে মুখোশটা সরে গিয়েছিল একটু, টেনে সোজা করে বলল, ‘যাক। ক্লিনিকের খবর কদ্দূর?’

‘প্রফেসর সন্তোষ বলছে হপ্তাখানেকের মধ্যেই ডক্টর ফৈয়াজের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। ব্রেন অ্যানালিসিস সম্পূর্ণ তো হয়েছেই, কম্পিউটারও তৈরি হয়ে গেছে, কয়েকটা অ্যাডজাস্টমেন্ট কেবল বাকি। কিন্তু, কবীর চৌধুরী সাহেব না ফেরা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না

‘কবীর চৌধুরী ফিরছেন কবে?’ সমীহ ফুটে উঠল মিস্ বটব্যালের কণ্ঠে।

‘ঠিক নেই। আজ, কাল, পরশু- যে কোনদিন ফিরতে পারেন।’

‘যাক, সন্তোষ মুখার্জী সবকিছু বুঝে নিয়েছে তো?’

‘বলছে তো বুঝে নিচ্ছে।’

‘বেশ। তারপর খতম করে দিতে হবে ওই শয়তান দুটোকে। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষার কোন মানেই হয় না। পালিয়ে গেলে দেশের অগৌরব। দুই-দুইবারের চেষ্টা ব্যর্থ করা গেছে, তৃতীয়বার ফসকেও যেতে পারে। কাজেই শেষ করে দিতে হবে।’ হঠাৎ অস্ফুট কণ্ঠে অনেকটা আপন মনে বলল, ‘সব ক’টাকে জড়িয়ে এনেছি জালে। এইবার বিষ কামড় দিতে হবে।’ তারপর সচকিত হয়ে সামলে নিল সে। ‘সাদেক খানের কি অবস্থা?’

‘নার্সটাকে খুন করবার পর থেকে বেশির ভাগ সময় ঘুম পাড়িয়েই রাখা হচ্ছে ওকে।

‘ঠিক আছে। তুমি এখন যেতে পারো। আর দেখো, মাসুদ রানা যেন নির্বিঘ্নে ক্লিনিকে পৌঁছায়। মাঝে কেউ কোন মাতব্বরি করলে সরাসরি আমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে তাকে।’

‘আমি সব ডিপার্টমেণ্টকেই জানিয়ে দিয়েছি। টপ প্রায়োরিটি দেয়া হবে সবখানে।

‘কাল বিকেলে পৌঁছবে সে এখানে। আমি চাই পরশু সকাল পর্যন্ত যেন সে কিছুই টের না পায়। একটা রাত ও মনের আনন্দে প্ল্যান করুক- মনে করুক সবকিছু ঠিক আছে ওদের প্ল্যান মাফিক। প্রফেসর সন্তোষ ফিরলেই আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো, ঠিক কবে সে সব কাজ হাতে তুলে নিতে পারবে আমি নিজের কানে শুনতে চাই। আর কবীর চৌধুরী যদি এর মধ্যে এসে পৌঁছান খেয়াল রাখবে যেন মাসুদ রানার ব্যাপার তাঁর কানে না যায়। বুঝেছ? এবার যাও।’

বেরিয়ে গেল ক্যাপ্টেন খান্না। সুইচ টিপতেই বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মিস্ বটব্যাল। পাশের বাথরূমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে। মুখের ঘা থেকে রস বেরিয়ে ভিজে চটচটে হয়ে গেছে রাবারের মুখোশটা। হালকা একটা দূর্গন্ধ নাকে আসছে। বেসিনে ঠাণ্ডা পানি ভরল সে। তাকের উপর থেকে একটা ক্রীমের শিশি নামাল। তারপর খুলে ফেলল মুখোশটা।

নিজের ভয়ঙ্কর চেহারার দিকে একবারও চাইল না কর্নেল বটব্যাল। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে ছোট-বড়-মাঝারি গর্ত, ক্ষতচিহ্ন আর ঢাকা চাকা কালো পোড়া মাংস জমে থাকা বীভৎস মুখে ঠাণ্ডা পানি ছিটাল কিছুক্ষণ। মুখোশ খোলা অবস্থায় দেখলে মানুষের চেহারা বলে চেনা যায় না। ঠোঁটগুলো গলে গিয়ে বিচ্ছিরি আকার ধারণ করেছে মুখটা, নাকের ডানপাশটা সম্পূর্ণ নি িহ্ন, একটি পাপড়ি নেই চোখে- চোখের পাতাও গলে গেছে খানিকটা, পৈশাচিক দৃষ্টি সে চোখে।

যত্নের সঙ্গে লোশন লাগাল ক্ষতগুলোয়। আপন মনে বলল, ‘ধৈর্য ধরো, ললিতা, আর একটা দিন ধৈর্য ধরো। আসছে মাসুদ রানা। এতদিন অপেক্ষা করেছ, আর একটা দিন। তোমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ হবেই।

দুর্গন্ধযুক্ত মুখোশটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা মুখোশ পরে নিল কর্নেল ললিতা বটব্যাল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন