কাজী আনোয়ার হোসেন
রানাকে হায়দ্রাবাদে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ডাকোটা। ওখান থেকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হবে ওকে ওঙ্কার দ্বীপে। হেলিকপ্টারের পাইলটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ডাকোটার এয়ার হোস্টেস।
‘এখান থেকে ওঙ্কার দ্বীপে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘দুই ঘণ্টা,’ উত্তর দিল পাইলট। ‘কিন্তু রওনা হতে আধঘণ্টা দেরি আছে। আসুন, খাওয়া-দাওয়া সেরে নেয়া যাক।’
এয়ারপোর্ট রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ খেয়ে নিয়ে ওরা এসে দাঁড়াল হেলিকপ্টারের সামনে। ফোর-সীটার, টুইন রোটর ব্লেড। দরজা খুলে দিতেই উঠে বসল রানা।
‘কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। প্রফেসর সন্তোষ মুখার্জীকেও নিতে হবে ক্লিনিকে।’
‘প্রফেসর সন্তোষ কে?’
‘ওখানকারই লোক। গত পরশু হায়দ্রাবাদে এসেছিলেন কয়েকটা ওষুধ কিনতে। প্রায়ই যান-আসেন। ডাক্তার-ফাক্তার হবেন- জিজ্ঞেস করিনি কোনদিন।
রানাকে হেলিকপ্টারের কন্ট্রোলগুলোর দিকে চাইতে দেখে বলল, ‘আপনি পাইলট নাকি?’
‘কঠিন কিছুই না, অন্যগুলোর থেকে একটু আলাদা।’
‘স্পীড কত?’
‘একশো দশ। টু-ফিফটি-ফাইভ হর্স পাওয়ার, এ১-১৪ভি পিস্টন এঞ্জিন।’
‘রেঞ্জ কি রকম?’
‘সোয়াশো মত। নালগোন্দায় নামতে হবে একবার।’
মনে মনে একবার চিন্তা করল রানা সাদেক খানকে যদি বের করতে পারে তাহলে এটা নিয়ে নরসাপুরে অপেক্ষারত সাবমেরিন পর্যন্ত পৌঁছবার সুবিধা-অসুবিধা। তারপর অন্য কথায় চলে গেল সে।
‘ক্লিনিকটা কি রকম?’
‘অত্যাধুনিক,’ বলল পাইলট। ‘একটা দ্বীপের ওপর। আমি অবশ্য ল্যাবরেটরির ভেতরে যাইনি কোনদিন। আমার কাজ হলো এটাতে করে খাবার-দাবার আর লোক পারাপার করা।’
‘দ্বীপের সবকিছু কি হায়দ্রাবাদ থেকে যায়?’
‘না। ইলোর থেকে। এখানে বিশেষ দরকার না পড়লে আসতে হয় না আমাকে। আজ এসেছি আপনার জন্যে- হঠাৎ প্রফেসর সন্তোষ খবর পাঠলেন উনিও ফিরবেন আজ ক্লিনিকে। এক ঢিলে দুই পাখি মেরে নিয়ে চলেছি। এই যে এসে গেছেন প্রফেসর।’
হেলিকপ্টার পার্কের গা ঘেঁষে দাঁড়াল এসে একটা অ্যামব্যাসাডার গাড়ি। বেঁটে খাটো, চকচকে টাক-মাথা একজন কালো ফ্রেমের চশমা পরা লোক নামল গাড়ি থেকে। গোল মুখ, গাল দুটো ফোলা। দাড়ি গোঁপ পরিষ্কার করে কামানো।
‘আপনি নিশ্চয়ই মেজর মাসুদ রানা? অ্যামনেশিয়া পেশেন্ট?’ বলল লোকটা একটা সীটে উঠে বসে। কণ্ঠস্বরটা ফ্যাশফেঁশে। যেন একরাশ কফের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরোচ্ছে। অস্বস্তিকর। নিজেই কেশে গলা পরিষ্কার করতে ইচ্ছে করে শ্রোতার। ‘আমার নাম সন্তোষ মুখোপাধ্যায়। ক্লিনিকের হেড সাইন্টিস্ট।
‘আমি শুনলাম ডক্টর ফৈয়াজ বলে একজন নাকি এখানকার চীফ সাইন্টিস্ট?’ জিজ্ঞেস করল রানা নিরুৎসুক কণ্ঠে।
‘ডক্টর ফৈয়াজ?’ প্রফেসর সন্তোষের মুখে অসন্তোষ ফুটে উঠল। ‘হ্যাঁ উনি রিসার্চ নিয়ে আছেন, পেশেন্টের ভার আমারই ওপর।’
গর্জন করে উঠল হেলিকপ্টার এঞ্জিন। দু’শো গজ উপরে উঠেই ছুটল সেটা সোজা পুব দিকে।
‘দু’দিনেই আপনার স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনব আমরা। আধুনিকতম যন্ত্রপাতি আছে এই ক্লিনিকে। স্পেশাল টেকনিকে টিস্টমেন্ট করা হয় আমাদের এখানে।’
‘শুনে স্বস্তি বোধ করছি,’ বলল রানা। ‘আমি একটা প্লেন দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। আগে-পরের সবকথা মনে আছে আমার, কিন্তু মাঝে থেকে দুটো সপ্তাহ গায়েব। এই দুই সপ্তাহের কোন কথা কিছুতেই মনে করতে পারছি না।’
‘এরকম হয়। কিন্তু আপনাকে ভালমত পরীক্ষা না করে কিছুই বলতে পারছি না। পকেট থেকে কয়েকটা কাগজ-পত্র বের করে তার মধ্যে মগ্ন হয়ে পড়ল প্রফেসর সন্তোষ মুখার্জী। খেত খামার, ছোট ছোট গ্রাম নদী খাল বিল আর মাঝে মাঝে পাহাড় দেখতে দেখতে চলল রানা। নালগোন্দায় দশ মিনিট থেমে আবার রওনা হলো হেলিকপ্টার। ঘণ্টা দেড়েক চুপচাপ কাটল।
রানা ভাবছে, দুই বছর সোয়া দুই বছর আগের কথা, শায়লা কি চিনতে পারবে ওকে? আর চিনতে পারলেও কি সাহায্য করতে রাজি হবে? ডক্টর আবদুল্লাহ ফৈয়াজই বা সাহায্য করবেন কেন? কেমন যেন দেখতে ছিল শায়লা? একজোড়া প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা চোখ আর চিবুকের একটা ছোট্ট তিল ছাড়া স্পষ্ট কিছুই মনে নেই রানার। রানা নিজেই ওকে চিনতে পারবে কিনা তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে ওর। তখন তরুণী ছিল, এখন যুবতী হয়েছে শায়লা। চেহারাতেও নিশ্চয়ই পরিবর্তন হয়েছে অনেক।
হঠাৎ মনে পড়ল রানার একটি চুম্বনের কথা। মিট মিট করে আকাশে জ্বলছিল অসংখ্য তারা- হু-হু বাতাস- লরীর একটানা শব্দ, আর আলতো একটি চুম্বন। একটি তরুণীর প্রথম প্রেম নিবেদন নয় তো?
কাগজগুলো দেখা শেষ হতেই ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল প্রফেসর। তারপর আবার শ্লোজড়িত ফ্যাশফেঁশে গলায় গল্প আরম্ভ করল।
‘কোলায়ের লেকের একটা দ্বীপের মধ্যে এই ক্লিনিকটা। প্ৰকাণ্ড লেক। বারো মাইল চওড়া, বিশ মাইল লম্বা। কয়েক হাজার বছর আগে পাহাড়ী এলাকা ছিল এটা। খুব সম্ভব পাহাড় ধসে গিয়েই তৈরি হয়েছে এই প্রকাণ্ড লেক। ভূতত্ত্ববিদদের মতে পুবে গোদাবরী আর পঠি মে কৃষ্ণা নদী থাকায় ভূপৃষ্ঠ নরম হয়ে গিয়ে পাহাড়ের ওজন আর ধারণ করতে পারেনি, ফলে বসে গেছে এই সম্পূর্ণ পাহাড়ী এলাকাটা। জল এসে জমেছে স্বভাবতই। কয়েকটা শিখর কেবল জেগে আছে জলের ওপর।’ স্কুল মাস্টারের ভঙ্গিতে একঘেয়ে কণ্ঠে
বক্তৃতা দিয়ে চলেছে যেন সে ঘণ্টা পড়ার অপেক্ষায়। ‘ক্লিনিকের পক্ষে জায়গাটা একটু অদ্ভুত না? মানে, রোগীদের আনা নেয়া করতে অসুবিধা হয় না আপনাদের?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘আসলে এটা যতখানি না ক্লিনিক, তার চেয়ে বেশি রিসার্চ সেন্টার। বিশেষ ধরনের রিসার্চ হচ্ছে এখানে। খুব বেশি রোগী আনা নেয়া করতে হয় না আমাদের। বেশির ভাগ রোগীই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত বিকৃতমস্তিষ্ক কয়েদি। তাছাড়া স্টাফ কোয়ার্টার আছে, সব রকমের সুবিধা আছে, আমাদেরকেও খুব একটা বাইরে যেতে হয় না। আপনি ওখানে গেলেই বুঝতে পারবেন ওঙ্কার দ্বীপ সবদিক থেকে স্বয়ং-সম্পূর্ণ। আমাদের নিজেদের জেনারেটিং প্ল্যান্ট, সিউয়েজ ডিপোজাল ইউনিট, ওয়াটার পাম্পিং অ্যাণ্ড পিউরিফাইং ইকুইপমেণ্ট আছে।’
ইলোরের ওপর দিয়ে চলেছে এখন হেলিকপ্টার। রেল-স্টেশনে দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস ধোঁয়া ছাড়ছে একটা মেল টেনের এঞ্জিন। নিচের দিকে চেয়ে গোটা শহরটার একটা মোটামুটি ধারণা নিয়ে নিল রানা।
জলহস্তীর পিঠের মত উঁচু হয়ে আছে, দ্বীপটা প্রকাণ্ড লেকের মধ্যে। এরই নাম ওঙ্কার দ্বীপ। কয়েকটা দালান-কোঠা দেখতে পেল রানা দ্বীপের পি ম পাশে। সেগুলো থেকে বেশ খানিকটা দূরে উত্তর পাশে প্রকাণ্ড একটা গোলাকার ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে আছে ছয় পায়ে ভর দিয়ে- রানা আন্দাজ করল খুব সম্ভব ফুয়েল ট্যাঙ্ক হবে। তারই পাশাপাশি দ্বীপের উত্তর-পমি পাশে ছোট্ট একটা জেটি দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে সরু একটা পিচ-ঢালা সড়ক সোজা এসে ঢুকেছে দ্বীপের ঠিক মাঝখানে চারদিক ঘেরা মস্ত একটা এলাকার গেট দিয়ে। অনেকগুলো বড় বড় দালান-কোঠা দেখা গেল সেই সুরক্ষিত এলাকার ভিতর। আর একটু এগোতেই রানা দেখল একটা নয়, দু’দুটো দেয়াল দিয়ে ঘেরা আছে বাড়িগুলো। গার্ডদের টাওয়ারও দেখা গেল। রানা বুঝল, ওটাই রিসার্চ সেন্টার।
জেটির কাছেই একটা ছোট্ট কাঁটাতার ঘেরা জায়গায় নামল হেলিকপ্টার। এঞ্জিন বন্ধ করে অল্পক্ষণ অপেক্ষা করল পাইলট- রোটরগুলো থেমে আসতেই নেমে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
রানাকে নিয়ে এগোল প্রফেসর। বলল, ‘এইটুকু রাস্তা হাঁটতে আপত্তি নেই তো আপনার? এই দশ মিনিটের পথ।
‘না, না। আপত্তি কিসের? এতক্ষণ বসে থাকার পর হাঁটতে বরং ভালই লাগবে,’ বলল রানা।
ডানধারে অনেকগুলো ব্যারাক দেখা গেল।
‘ট্রুপ থাকে এখানে,’ রানার উৎসাহ দেখে বলল প্রফেসর। ‘দ্বীপ রক্ষী-বাহিনী। আড়াইশো সশস্ত্র সৈন্য আছে এই দ্বীপে।
‘প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই মনে হচ্ছে।’
‘তা মনে হতে পারে অবশ্যি, কিন্তু আসলে আমাদের সত্যিকার প্রয়োজনের তুলনায় সৈন্য সংখ্যা কিছু কমই হয়ে গেছে।’
নীরবে হাঁটল ওরা কিছুক্ষণ। প্রথম গেটটার সামনে এসে দাঁড়াতেই সেন্ট্রি বক্সে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরী সুইচ টিপল একটা। খুলে গেল সামনের গেট।
‘ভিতরে ঢোকা অপেক্ষাকৃত সহজ,’ বলল প্রফেসর সন্তোষ সন্তুষ্টির হাসি হেসে, ‘কিন্তু এখান থেকে বেরোনো খুব মুশকিল। মেইন সিকিউরিটি অফিস থেকে টেলিভিশন ক্যামেরার মাধ্যমে প্রত্যেকের গতিবিধি দেখতে পাচ্ছে ডিউটি অফিসার। সে যদি ভিতরে বসে একটা বোতাম না টিপত, তাহলে এই গার্ড ওর সামনের বোতামটা হাজার টিপলেও খুলতে পারত না গেট।’
বিশ গজ গিয়ে থামল আবার ওরা আরেকটা গেটের সামনে। এই গেট এবং দেয়াল প্রথমটার চেয়ে অনেক উঁচু। ইনসুলেটার দেখে রানা বুঝল- ইলেকটিস্ফায়েড। ঠিক আগের নিয়মেই খুলে গেল গেটটা। এগোল ওরা এবার রিসার্চ ল্যাবরেটরির দিকে।
‘এই হচ্ছে আমাদের সিক্ ওয়ার্ড, আর ওই যে দেখছেন, ওটা ল্যাবরেটরি। গর্বের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দেখাল সন্তোষ মুখার্জী, এর প্রত্যেকটি আবার আণ্ডারগ্রাউণ্ড প্যাসেজ দিয়ে ইন্টারকানেকটেড। বিশেষ যত্নের সঙ্গে মাটির নিচেও ওয়ার্ড বানাতে হয়েছে আমাদের টেম্পারেচার কনস্ট্যান্ট রাখবার জন্যে।
আঙুল দিয়ে ডানদিকে দেখাল এবার প্রফেসর। ‘ওই দেখুন আমাদের পাম্প হাউজ আর পাওয়ার জেনারেটার। এমন কি ইমার্জেন্সি জেনারেটিং প্ল্যান্টও আছে আমাদের। স্বয়ংসম্পূর্ণ। রেডিও আছে, টেলিফোন আছে। কি নেই? ওই দেখুন, ওটা আমার কোয়ার্টার, পাশেরটায় থাকে এখানকার সিকিউরিটি কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন খান্না। আর এই হচ্ছে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ব্লক।’
অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং-এর একটা বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। দরজার পাশে দেয়ালের গায়ে চারকোনা একটা স্পিকিং গ্রিল। ওটার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় কি যেন বলল প্রফেসর। খুলে গেল দরজা। ইউনিফরম পরা দু’জন মিলিটারি গার্ড বসে আছে একটা গ্লাস-পার্টিশন দেয়া ঘরে, দরজা দিয়ে ঢুকলে হাতের ডানধারে।
‘আপনাকে ডক্টর ফৈয়াজের অফিসে পৌঁছে দিয়ে আপাতত আমি আমার নিজের কাজে যাব। উনিই আপনার কেসটার চার্জে আছেন।
একটা ছোট্ট অফিস কামরায় রানাকে ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল প্রফেসর মুখার্জী। কেউ নেই ঘরের মধ্যে। একটা পুরানো ডেস্কের ওপাশে একখানা চেয়ার, এপাশে দু’খানা- এই হচ্ছে ঘরের আসবাব। জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল রানা। স্টীলের রড দিয়ে তৈরি করা হয়েছে জানালার গরাদগুলো। জানালার ওপাশে একটা ল্যাবরেটরির কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে।
ডেস্কের পিছনের একটা দরজা খুলে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল বাইশ-তেইশ বছর বয়সের একটি মেয়ে। কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ একদৃষ্টে চেয়ে থাকল সে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা মাসুদ রানার দিকে। তারপর কোমল কণ্ঠে ডাকল, ‘মাসুদ রানা!’
চমকে ফিরে চাইল রানা। দেখল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে শায়লা। এই সোয়া দুই বছরে আরও অনেক সুন্দর হয়েছে শায়লা। একহারা দীঘল দেহে এসেছে লাবণ্য। মুখের ভাবে মনে হলো অনেক পরিণতও হয়েছে যেন। নীল একটা শাড়ি কুঁচি দিয়ে পরা, মুখে সামান্য প্রসাধনের আভাস।
‘শায়লা! আমি…
থেমে গেল রানা। ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করবার ইঙ্গিত করছে শায়লা।
‘আপাতত আমার কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিলেই আপনার জন্যে নির্দিষ্ট কামরায় গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারবেন,’ বলল শায়লা।
‘নিশ্চয়ই।’
ডেস্কের ওপর থেকে একটা ফরম নিয়ে লিখতে বসল শায়লা।
‘আপনার পুরো নাম?’
‘দিন না, আমিই লিখে দিচ্ছি,’ বলে কাগজটা টেনে নিয়ে রানা লিখল, ‘তোমার সাথে অনেক কথা আছে, শায়লা। কখন এবং কোথায় সেটা সম্ভব হবে?
‘হ্যাঁ। এবার আপনার বয়স আর জন্মস্থান লিখুন পরের কলামে।’ কাগজ কলম টেনে নিয়ে শায়লা লিখল, ‘ধৈর্য ধরো, ব্যবস্থা করছি।’
ফরমটা লেখা হয়ে যেতেই শায়লা বলল, ‘এবার দয়া করে একটু পাশের ঘরে আসুন, আপনাকে পরীক্ষা করতে হবে। তারপর আজ রাত্রির মত বিশ্রাম নেবেন আপনি। কাল সকাল থেকে চিকিৎসা শুরু হবে আপনার।’
ব্লীচিং পাউডার আর ডেটল-ফেনাইলের গন্ধ পাশের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিল শায়লা। তারপর ডাক্তারী চালে বলল, ‘জামা-কাপড় সমস্ত খুলে ফেলুন।
বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল রানা। মুচকে হাসছে শায়লা ওর দিকে চেয়ে। স্টেইনলেস স্টীল স্টেরিলাইজারের সামনে গিয়ে বোতাম টিপে চালু করে দিল শায়লা সেটা। ঢাকনিটা খুলে কয়েকটা যন্ত্রপাতি ফেলল তার মধ্যে সশব্দে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই সোঁ সোঁ করে বাষ্প বেরোতে আরম্ভ করল ওটা থেকে। ঘুরে দাঁড়াল শায়লা।
‘এবার কথা বলতে পারো। কিন্তু আস্তে। মাইক্রোফোন আছে সব ঘরে।’
‘মাইক্রোফোন কেন?’
‘তা জানি না, ক্যাপ্টেন খান্না সারাক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে আমাদের ওপর।’
‘তোমাদের বিশ্বাস করে না ওরা?’
‘দুই-দুইবার পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে কি করে আর বিশ্বাস করবে বলো?’
‘তোমার আব্বা জানেন যে আমি এসেছি এখানে?’
‘আমরা গতকাল সন্ধ্যায়ই খবর পেয়েছি। তোমার কথা আব্বার মনে ছিল না, আমি বলতেই মনে পড়েছে। তুমি আমাকে রক্ষা করছিলে আম্বালা হাসপাতালে একজন ক্যাপ্টেনের হাত থেকে। একাগ্র দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে চেয়ে আছে শায়লা। ‘এবং এখন এখানে এসেছ তোমার ঋণ কিয়দংশে শোধ করতে পারি সেই আশায়। তুমি সাদেক খানকে নিতে এসেছ, রানা।
চমকে উঠল রানা। ‘সে কথা তুমি জানলে কি করে?’
‘অত্যন্ত সহজ যুক্তির বলে। আমি জানি যত বড় প্রমাণই তোমার বিরুদ্ধে থাকুক না কেন, প্রাণ গেলেও তুমি নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। কাজেই তোমার এখানে আসার সাদেক খান ছাড়া আর কি কারণ থাকতে পারে? তোমাকে কি খুন করে রেখে যাবার আদেশ দেয়া হয়েছে?
‘না। নিতান্ত বাধ্য না হলে হত্যা করা হবে না। ওকে ফেরত চাই আমরা।’
‘পাকিস্তানে ফেরত নিতে চাও ওকে?’ আশ্চর্য হয়ে গেল শায়লা। ‘কি করে নেবে ওকে পাকিস্তানে?’
‘তোমাদের সাহায্যে। তোমার আব্বা কোথায়?’
‘কাজ করছেন ল্যাবরেটরিতে। এসে পড়বেন। কিন্তু আমরা সাহায্য করলেও তোমার পক্ষে ওকে নিয়ে পাকিস্তানে ফেরা অসম্ভব মনে হচ্ছে আমার কাছে। ভয়ঙ্কর রকমের পাগল লোকটা। খুনী। সিকিউরিটি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে ওকে। এক সময় তো আমরা ভেবেছিলাম মেরে ফেলতে হবে বুঝি, মাঝে মাঝে ওর উন্মত্ততা এতই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত প্রফেসর সন্তোষ এক বিকল্প উপায় বের করেছে ওকে কিছুটা শান্ত রাখার জন্যে।’
‘কি রকম?’
‘স্ত্রীলোক নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছে সে ইলোর থেকে। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘প্রসটিটিউট।
অবাক হয়ে গেল রানা। বলল, ‘সাদেক খানকে নির্বিঘ্নে খুন করতে দিচ্ছে প্রফেসর? শুনেছি মেয়েদের খুন করে লোকটা উন্মত্ত অবস্থায়?
মাথা ঝাঁকাল শায়লা। ‘কেবল খুন করতে দিচ্ছে তা নয়, এ থেকে প্রচুর আনন্দ লাভ করছে সে। ঘরের মধ্যে লুকানো ক্যামেরায় সাদেক খানের প্রত্যেকটি কার্যকলাপের ছবি তুলে ভেট দিচ্ছে কর্নেল বটব্যালের বিকৃত মনোবৃত্তি চরিতার্থ করবার জন্যে।’
নিজের অজান্তেই শিউরে উঠল রানা একবার। বলল, ‘আশ্চর্য লোক তো।’
‘লোকটা একটা পিশাচ। আব্বার পিছনে স্পাইয়ের মত লেগে আছে সে সারাক্ষণ। বুঝবার ক্ষমতা নেই, মাথায় কুলোয় না- অথচ সে চায় এই গবেষণার সমস্ত সুনাম যেন ওর হয়। সাপের চেয়েও বিষাক্ত লোকটা।’
‘সাদেক খানের ব্যাপারে কতদূর এগিয়েছে তোমাদের কাজ?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘এক সপ্তাহের মধ্যেই রেডি হয়ে যাবে মেশিন। তিন হাজার মাইল পর্যন্ত টেস্ট করে দেখেছি আমরা ইতিমধ্যেই।’
‘কি ধরনের মেশিন সেটা? আমাদের ধারণা তোমরা ওর ব্রেন ওয়েভগুলো কমপিউটারাইজ করতে যাচ্ছ।’
‘ব্যাপারটা অত্যন্ত টেকনিকাল। তবে খুব সহজ করে বলতে গেলে ব্যাপারটা মোটামুটি তাই দাঁড়ায়। আসলে হিটারো সাইকি পেনিট্রেট করবার যন্ত্র তৈরি করছি আমরা। একটা রেডিও রিসিভার ইচ্ছেমত যে কোনও মানুষের মনের উপর টিউন করা গেলে যে অবস্থা হত অনেকটা তাই ঘটাবার চেষ্টা চলছে এখানে। যে-কোনও লোকের যে-কোন রকমের চিন্তা ইচ্ছে করলে জানতে পারি আমরা।’
‘আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না ব্যাপারটা। ধরো রেডিও সেটের দৃষ্টান্তই যদি নিই, ওয়েভ লেংথ জানা থাকলে পরে তবেই তুমি একটা বিশেষ স্টেশন ধরতে পারো। তাই না? কোনও বিশেষ মানুষের মনের বা চিন্তার ওয়েভ লেংথ জানবে কেমন করে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ব্রেন চার্ট তৈরি করা অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। সেটারও সহজ উপায় বের করেছি আমরা। ঠিকই বলেছ, ওই চার্ট ছাড়া কারও থট্ রিডিং সম্ভব নয়।’
‘কিভাবে পাবে তোমরা চার্ট?’
‘নানান কায়দায় সমস্ত পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় বৈজ্ঞানিক, সেনাপতি আর শাসকবৃন্দের ব্রেন চার্ট জোগাড় করবার জন্যে দিনরাত পরিশ্রম করছে ভারতের পাঁচ-ছয়শো সিক্রেট এজেন্ট। এরই মধ্যে আমাদের হাতে পৌঁছে গেছে প্রায় সাড়ে তিনশো চার্ট।’
‘কয়টা কমপিউটার তৈরি হচ্ছে?’
‘আপাতত একটা। এটা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে অতি সহজে বানানো যাবে এর পরেরগুলো। যত ইচ্ছা তৈরি করা যাবে তখন।
‘ধরো, যদি যন্ত্রটা নষ্ট করে দেয়া হয়, আরেকটা যন্ত্র তৈরি করতে পারবে ওরা?’
‘যদি আব্বাকে দিয়ে করায় তাহলে পারবে। অবশ্য অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্যে সাদেক খানের ব্রেনও প্রয়োজন পড়বে।’
‘প্ল্যানের কোনও কপি নেই ওদের কাছে?
‘আছে, ব্লু প্ৰিণ্ট আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা জায়গায় আব্বা ইচ্ছে করেই ভুল তথ্য দিয়েছেন ওদের। কবীর চৌধুরী বলে একজন লোকের ওপর আব্বার খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা জন্মেছে ইদানীং। বোধহয় মুসলমান বলেই। তাছাড়া লোকটা ভদ্রও খুব। ওরই চেষ্টায় জেল থেকে ছাড়া হয়েছে আব্বাকে। ওরই নির্দেশে এই কাজটা করছেন তিনি। শেষের কিছু অংশ ছাড়া বেশির ভাগ আসল কপিই এখন কবীর চৌধুরীর কাছে।’
ভ্রূ কুঁচকে গেল রানার। কবীর চৌধুরী সম্পর্কে কিছু বলতে যাচ্ছিল- চেপে গিয়ে অন্য কথায় চলে এল সে।
‘তোমার আব্বা জেলে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ। দেড় বছর। তুমি আমাকে উদ্ধার করে রেখে এলে নয়াদিল্লীতে। পরদিন ভোরেই মিলিটারি এসে ধরে নিয়ে গেল আমাদের। সাত দিন সাত রাত অকথ্য অত্যাচার করা হলো আমাদের ওপর। কোন তথ্য বের করতে না পেরে ছেড়ে দিল। নজরবন্দী করে রাখা হলো আমাদের। ইউনিভারসিটির চাকরি চলে গেল আব্বার। আমরা প্ল্যান করলাম, পাকিস্তানে চলে যাব, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করল একজন। যেদিন আমাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা তার আগের রাতে ধরে নিয়ে গেল ওরা আব্বাকে। আমি ঘুমিয়েছিলাম- হৈ-হল্লা শুনে ছুটে গেলাম। দেখলাম ছেঁচড়ে টেনে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওরা আব্বাকে। ছুটে গেলাম। এক ধাক্কায় আমাকে মাটিতে ফেলে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে চলে গেল ওরা।’
মরার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে শায়লার মুখ। ঠিক যেন নালিশ জানাচ্ছে সে রানার কাছে। ডান হাতটা রাখল রানা ওর কাঁধের ওপর। বলল, ‘তোমার কষ্ট হচ্ছে, শায়লা।
‘না।’ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সামলে নিল শায়লা নিজেকে। খানিকটা সুস্থির হয়ে আবার আরম্ভ করল সে।
‘দেড় বছরের জন্যে আব্বার সঙ্গে ওই আমার শেষ দেখা। তিন মাস প্রত্যেকদিন হাঁটাহাঁটি করেছি আমি ওদের মিলিটারি হেড কোয়ার্টার আর সেন্ট্রাল জেল সুপারের কাছে। ওরা হেসেছে, বলেছে ওরা জানে না কোথায় আছে ডক্টর ফৈয়াজ, আর জানলেও বলত না। ছয় মাস পর হোস্টেলে এসে দেখা করল আমার সাথে মিলিটারি হেড কোয়ার্টারের একজন অফিসার। ও বলল, আব্বার সব খবর জানাতে পারে সে, বিনিময়ে আমি যদি…’
থেমে গেল শায়লা। একটা চেয়ারের মাথা আঁকড়ে ধরল বাম হাতে।
‘থাক, শায়লা,’ বলল রানা। ‘ওসব কথা আর মনে নাই আনলে। ভুলে যাবার চেষ্টা করো।’
‘না। বলতেই হবে আমাকে। তোমাকে বলব না তো কাকে বলব? ওর জঘন্য প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে নিয়ে ও আমাকে জানাল যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে আব্বাকে। ও বলল, আমি যদি সহযোগিতা করি, যদি নিয়মিত ওর ইচ্ছা পূরণ করে যাই তাহলে ওর মারফত কিছু বই, খাবার পাঠাতে পারি আব্বাকে।
‘আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। টাকা ছিল না আমার কাছে। কিন্তু আমি ছাড়া যে আব্বার আর কেউ নেই। ভাল ছাত্রী ছিলাম, আমার টিউশন ফি লাগত না, কিন্তু হোস্টেল খরচ আমার নিজেকেই চালাতে হত। দু’একজন বান্ধবী দয়া পরবশ হয়ে সাহায্য করত, আর টিউশনি করতাম। আব্বার জন্যে খাবার আর বই পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আরও একটা টিউশনি নিলাম। দিনে আঠারো বিশ ঘণ্টা করে কাজের চাপ পড়ত। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে আরম্ভ করল। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে আমি টিন ভর্তি খাবার আর এক-আধটা বই কিনে দিয়ে আসতে থাকলাম সেই অফিসারের কোয়ার্টারে। এক বছর চলল এই রকম।
‘কিন্তু ক্রমেই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতে আরম্ভ করল লোকটা। সারাদিন পরিশ্রম করে এত ক্লান্ত থাকতাম যে ওকে সন্তুষ্ট করা সব সময় সম্ভব হয়ে উঠত না আমার পক্ষে। একদিন লাথি মেরে তাড়িয়ে দিল ও আমাকে। অনেক অনুনয়-বিনয় করলাম, ধরনা দিয়ে পড়ে থাকলাম, কথা দিলাম আমার সাধ্যমত সবকিছু করব ওকে সন্তুষ্ট করার জন্যে- শুধু পার্সেলগুলো আব্বার কাছে পাঠানো যেন সে বন্ধ না করে। শুনল না। ওর হাত ধরতে গিয়েছিলাম, থুথু দিল আমার মুখে। তারপর টেনে নিয়ে গেল কোয়ার্টারের পিছনের ছোট্ট উঠানে। এক কোণে জড়ো করা আছে ভাঙা টিনগুলো- বইগুলো গাদা করা আছে তার পাশেই। পুরো একটা বছর নিজের ওপর কি কঠোর নির্যাতন করে আব্বার জন্যে কিনেছিলাম আমি ওগুলো। ও বলল, খাবারগুলো নিজে খেয়ে টিনগুলো জমিয়ে রেখেছে সে এতদিন, বিদায়ক্ষণে আমাকে দেখাবে বলে।
টপ টপ করে পানি পড়ছে শায়লার গাল বেয়ে। মাথার মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে রানার। নিজের অজান্তেই দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল দুটো ব্যথা হয়ে গিয়েছে। বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করল রানা। তারপর মুছে দিল শায়লার চোখ। একটি কথাও বেরোল না ওর মুখ থেকে। কি চমৎকার উদ্ধার করেছিল সে শায়লাকে! এখন এসেছে সে উপকারের প্রতিদান গ্রহণ করতে!
‘দোষী মনে করে শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিয়ো না, রানা। তোমার কোনও দোষ নেই। দোষ আমার কপালের।’ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল শায়লা। ছ’মাস আগে ছেড়ে দিয়েছে ওরা আব্বাকে হঠাৎ কবীর চৌধুরীর অনুরোধে। এখানে নিয়ে এসে গবেষণায় লাগিয়েছে। কাজ শেষ হয়ে গেলেই আবার জেলে পোরা হবে ওঁকে। তাই সময় নিচ্ছেন আব্বা এত, প্ল্যান খুঁজছেন এখান থেকে পালিয়ে যাবার। তুমি এসেছ সাদেক খানকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে, আমরা তোমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করব, রানা, যদি আমাদের সাথে নাও।’
‘এত লোক একসাথে পালানো তো মুশকিল হয়ে যাবে, শায়লা। আমি সাদেক খানকে রেখে যদি আবার ফিরে আসি তাতে হবে না?’
‘না, ততদিনে মেরে ফেলবে ওরা আব্বাকে।’
‘তোমার আব্বা কি বলেন? তোমরা নিশ্চয়ই আলাপ করেছ এই ব্যাপারে?’
‘হ্যাঁ। যখনই তোমার সংবাদ শুনলাম তখনই বুঝতে পেরেছি আমরা তোমার উদ্দেশ্য। এইটাই আমাদের শেষ সুযোগ, রানা। এইটুকু সাহায্য করবে না আমাকে?’
‘গতবার ফুটন্ত কড়াই থেকে উদ্ধার করে তোমাকে আগুনে ফেলেছিলাম, শায়লা। যদি বলো চেষ্টা করব আমি। কিন্তু তাতে করে সবাই একসাথে মারা পড়ব- কারও কোনও লাভ হবে না।’
‘কোন্ পথে কি ভাবে পালাবে ঠিক করেছ?’ জিজ্ঞেস করল শায়লা।
‘কয়েকটা পথ আছে। নরসাপুরে অপেক্ষা করছে আমাদের সাবমেরিন। কিন্তু ওখানে পৌঁছবার কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছি না। খুব সম্ভব হায়দ্রাবাদের দিকেই যাব। ওখানে আমাদের এজেণ্ট আছে- মাদ্রাজে নোঙর করা একটা ইটালিয়ান জাহাজে আমাদের তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করবে সে। দেখা যাক। এখানে দুই-একদিন থাকলেই পালাবার একটা রাস্তা বের করে ফেলব।
‘কবে নাগাদ পালাতে চাও?’
‘তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। এত লম্বা জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। দু-তিনদিন বিশ্রাম নেব, ধীরে সুস্থে এই দ্বীপটাকে স্টাডি করে তারপর হঠাৎ গায়েব হয়ে যাব সুবিধা মত।
‘সন্তোষ মুখার্জী হঠাৎ ফিরে আসায় ঘাবড়ে গেছি আমি। লোকটা অসম্ভব ধূর্ত। ওর ব্যাপারে খুব সাবধানে থাকতে হবে রানা। ওর ফিরবার কথা ছিল আরও কয়েক দিন পর, অথচ…’
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল রানার। চমকে উঠল সে ভিতর ভিতর।
‘শায়লা! সন্তোষ মুখার্জী এই দ্বীপের বাইরে ছিল। হায়দ্রাবাদে ওষুধ কিনতে গিয়েছিল সে। কবে গিয়েছিল সে এখান থেকে?’
‘গত পরশুদিন সকালে। কেন?’
‘এর মধ্যে ক্লিনিকের সাথে কোন কথাবার্তা হয়েছে ওর?’
‘না, সেটা সম্ভব নয়। হায়দ্রাবাদ থেকে এখানে যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা ডাইরেক্ট দিল্লী হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে কানেক্টেড। কিন্তু কেন? কি হয়েছে?’
‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, শায়লা। আমার সম্বন্ধে সব কিছু জানল কি করে সন্তোষ মুখার্জী? এখানে খবর পৌঁছেচে কাল সন্ধ্যায়, তার আগের দিন সকালে সে হায়দ্রাবাদ চলে গেছে- অথচ আমার সম্পর্কে সবকিছু জানল কি করে? প্লেনটা ক্র্যাশও করেনি তখন। গত পরশুদিন সকালে আমি ছিলাম মান্দালয়ে।’
‘তাই তো! আশ্চর্য!’
‘এর একটি মাত্র ব্যাখ্যা আছে। আগে থেকেই জানত সে আমার কথা। তার মানে কি? শায়লা, এরা আগে থেকেই জানত আমি আসছি। সবকিছুই আগে থেকে প্ল্যান করা। জাল পেতেছিল ওরা আমার জন্যে। এদের তৈরি ফাদে ঢুকে পড়েছি আমি!’
বিবর্ণ হয়ে গেল শায়লার মুখ। বলল, ‘তাহলে? কি হবে এখন?’
‘পালাতে হবে। ওরা মনে করবে ক্লান্ত হয়ে আছি, আজ রাতটা বিশ্রাম নেব আমি। তাই আজই পালাতে হবে আমাদের।’
‘কি করে?’
‘তা জানি না। একটা কিছু প্ল্যান ঠিক করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। এছাড়া আর কোন উপায় নেই এখন। গতি দিয়ে ধুলো দিতে হবে ওদের চোখে।
‘আমাদের নিচ্ছ তো?’
একটু দ্বিধা করল রানা। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘আমার গা ছুঁয়ে বলো।’
‘ছেলেমানুষী কোরো না, শায়লা!’ ধমক দিল রানা। তারপর ওর হাত ধরে বলল, ‘কথা দিলাম, নিয়ে যাব- অন্তত চেষ্টা করব।’
উদ্ভাসিত হয়ে উঠল শায়লার দুই চোখ। রানার হাতটা তুলে চুম্বন করল সে। ‘বাঁচালে আমাকে, রানা।’
হাতটা কেড়ে নিল রানা। ‘তোমার উচ্ছ্বাস রাখো এখন, শায়লা। এই দ্বীপের একটা নক্সা এঁকে দাও জলদি। ঠিক কোন জায়গাটায় কম্পিউটার আছে এঁকে দেখাও আমাকে। যাবার আগে ওটাকে শেষ করে দিয়ে যেতে হবে।
ঠিক এমনি সময়ে কামরার দরজাটা খুলে গেল দু’পাট। একজন বদ্ধ ভদ্রলোক ঢুকলেন ঘরে। একমাথা এলোমেলো পাকা চুল, গাল ভেঙে বসে গেছে, দুই চোখের কোলে কালি, কপালে বয়স এবং নির্যাতনের চিহ্ন। প্রথমে চিনতে পারেনি রানা, পরমুহূর্তে সদাহাস্যময় একটা সৌম্য চেহারা মনে পড়ল ওর- সোয়া দুই বছর আগে দেখেছিল একবার। চেনাই যায় না এই মানুষকে সেই মানুষ বলে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন বদ্ধ শীর্ণ একটা হাত সামনে বাড়িয়ে।
‘মাসুদ রানা! মাসুদ রানা! ঠিক চিনতে পেরেছি আমি। আমাদের নেবে তুমি, রানা, তোমার সঙ্গে?’
বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রানা ডক্টর আবদুল্লাহ্ ফৈয়াজের দিকে। উত্তর বেরোল না ওর মুখ থেকে।
‘ও আমাকে কথা দিয়েছে, আব্বাজী,’ বলল শায়লা। হতবুদ্ধি রানার দিকে ফিরে চাইল শায়লা এবার। ‘আমি দুঃখিত, রানা। আগে বলিনি, বললে তুমি রাজি হতে না কিছুতেই। গুলি করেছিল ওরা আব্বার পায়ে জেল থেকে পালাবার চেষ্টা করায়। ফেলে রেখেছিল সাতদিন বিনা চিকিৎসায়। দুটো পা-ই হাঁটু পর্যন্ত কেটে বাদ দিতে হয়েছে। হুইল চেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না আব্বা।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন