রানা! সাবধান!! – ৯

কাজী আনোয়ার হোসেন

নয়

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রানা একটা লম্বা টেবিলের ওপর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ইলোর পুলিস স্টেশনের মাটির নিচের সেলে। মাথাটা ছাড়া আর কিছুই নড়াবার উপায় নেই। চারদিকে চাইল রানা। বাড়িটা বহুদিনের পুরানো। খুব সম্ভব ইলোরের কোন জমিদারের বন্দীশালা ছিল এটা ইংরেজ আমলে, কিংবা তারও আগে; ঘরের দেয়ালে তারই নিদর্শন হিসেবে কয়েকটা জং ধরা পুরানো তলোয়ার, বর্শা আর তীর ধনুক টাঙানো। আগেকালের সাঁড়াশী জাতীয় কয়েকটা নির্যাতনের যন্ত্রপাতিও আছে। ঘরের তিন দেয়ালে তিনটে লোহার গেট। ওপাশে বোধহয় আরও সেল আছে। চতুর্থ দিকটায় একটা খাড়া সিঁড়ি ওপরে উঠে গিয়ে শেষ হয়েছে একটা বন্ধ দরজার পায়ের কাছে।

শায়লা, ডক্টর ফৈয়াজ আর সাদেক খানের কথা ভাববার চেষ্টা করল রানা। কি করছে ওরা? জঙ্গলের আধ মাইল গভীরে ঢুকে অপেক্ষা করবেন বলেছিলেন ডক্টর ফৈয়াজ। অপেক্ষা করতে নিষেধ করা উচিত ছিল ওর। শুধু শুধুই মূল্যবান সময় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ওদের। ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না ওদের কোনদিন।

সিঁড়ির দরজা খুলে গেল। কমলা রঙের একটা শাড়ি চোখে পড়ল রানার। দু’জন নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। এস. পি-কে চিনতে পারল রানা, কিন্তু মহিলাকে চিনতে পারল না। রবারের একটা মুখোশ পরা তার মুখে।

দ্রুতপায়ে টেবিলের কাছে চলে এল মহিলা। একটা স্থির হাসি আঁকা আছে মুখোশের ওপর। ছোট্ট দুটো গর্ত দিয়ে উজ্জ্বল এক জোড়া চোখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল চোখ দুটো রানার মুখের দিকে। পনেরো সেকেণ্ড পার হয়ে গেল নীরবে। অস্বস্তি বোধ করল রানা।

‘হ্যাঁ। এই লোকটাকেই খুঁজছিলাম আমি। সোয়া দুই বছর। আজ আপনি তাকে তুলে দিয়েছেন আমার হাতে, মি. আচারিয়া। দিল্লীতে ফিরে গিয়েও আপনার কথা স্মরণ থাকবে আমার।’

‘সেটা আপনার দয়া। আজ পাঁচ-পাঁচটা বছর কোন প্রমোশন হয়নি আমার। আপনি যদি কেবল স্মরণ রাখেন, সে-ই আমার জন্যে যথেষ্ট। এখন এই লোকটাকে কি হাতকড়া পরিয়ে তুলে দিতে হবে গাড়িতে?’

‘না,’ বলল মুখোশধারী মহিলা স্থির দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে চেয়ে থেকে। ‘লোকে বলে শারীরিক নির্যাতনের কোন মানে হয় না। নির্যাতন করলে যে-কোনও লোক যে-কোন কথা স্বীকার করবে। কয়েক সেকেণ্ড নির্যাতন থেকে বাঁচবার জন্যে যে কোন মিথ্যে কথাকেও সত্যি বলে স্বীকার করবে। এর চেয়ে ওষুধ বা সম্মোহন অনেক ভাল। কিন্তু আমার ধারণা অন্যরকম। আমার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যাকে খুঁজে বেড়ালাম তাকে ধরে যদি স্কোপোলামিন দিয়ে সব কথা স্বীকার করিয়ে ফেলি- পরদিন একটা গোপন বিচারকক্ষে বিচার হয়ে যাওয়ার পর গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে, তাহলে শিকারীর মজাটা রইল কোথায়? ধীরে ধীরে নির্যাতন করে হত্যা করবার অধিকার রয়েছে শিকারীর। আপনার কি মনে হয়?

‘নিশ্চয়ই। একশোবার অধিকার আছে,’ বলল এস.পি. আচারিয়া। ‘তাহলে ওপরে গিয়ে শক্তিশালী আর নিষ্ঠুর দেখে একজন লোককে পাঠিয়ে দিন। ওপরেই অপেক্ষা করবেন আমার জন্যে। আপাতত কয়েকটা কথা বের করতে হবে এই লোকটার মুখ থেকে। এখানে আপনার উপস্থিতির কোন প্রয়োজন নেই।’

সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল এস.পি. অনুগত ভৃত্যের মত। রানা মহিলার অসামান্য ক্ষমতার কথা ভেবে আ র্য হলো। কে এই মহিলা? সেই বটব্যাল? সন্তোষ আজ যার কথা বলছিল শ্রদ্ধার সঙ্গে? মুখে মুখোশ কেন?

খড়ম পায়ে নিচে নেমে এল একজন প্রকাণ্ড চেহারার লোক। হাফ প্যান্ট পরা, খালি গা। মস্ত ভুঁড়ি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে হাত দেড়েক। মোটা একগাছি টিকি ছেড়ে পুরোটা মাথা পরিষ্কার করে কামানো। কপালে তিনটে সাদা চন্দনের দাগ, গলায় পৈতে। ছোটবেলায় দেখা হিন্দী গাঁজাখুরি সিনেমার দৈত্যের মত দেখতে। হাতে-পায়ে থোকা থোকা পেশী। রানা আন্দাজ করল- মাদ্রাজী।

‘বাহ্। চমৎকার ভুঁড়ি বাগিয়েছ তো ঘুষ খেয়ে খেয়ে। কি নাম তোমার?’

‘ঘটোৎকচ।’

‘দেখতেও ঠিক ওই রকমই। এইখানে এসে দাঁড়াও। যা বলব সেই মত কাজ করবে। যাক, শোনো, মাসুদ রানা। সাদেক খান, আবদুল্লাহ ফৈয়াজ আর ওই মেয়েলোকটা কোথায় আছে বলতে হবে তোমাকে। দুই মিনিট সময় দিলাম।’

দুই মিনিট কেটে গেল চুপচাপ। এবার মহিলা ফিরল ঘটোৎকচের দিকে।

‘ওর ডানহাতটার কনুইয়ের ওপর হাঁটু ঠেকিয়ে উল্টোদিকে চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলো। যতক্ষণ না ও আমার কথার উত্তর দেবে ততক্ষণ একটা একটা করে হাত-পা ভাঙতে থাকবে। উত্তরটা আমার জানা হয়ে গেলে তখন ওকে মেরে ফেলা হবে- সেটুকু কাজ আমি নিজেই করব।’

মহিলার কণ্ঠস্বরে ভয়ঙ্কর একটা ঘৃণার আভাস ফুটে উঠল। অবাক হলো রানা।

রানার ডান হাতের বাঁধন খুলে ফেলল ঘটোৎকচ। হাত টেনে নেয়ার চেষ্টা করল রানা, কিন্তু পারল না। অসম্ভব শক্তি মোটা লোকটার গায়ে। টেনে সোজা করে রেখে কনুই-এর ওপর হাঁটু ঠেকাল ঘটোৎকচ। একহাতে কব্জি আরেক হাতে বাইসেপ চেপে ধরল সে- এবার এক হ্যাঁচকা টান দিলেই মড়াৎ করে ভেঙে যাবে রানার হাতটা মাঝখান থেকে।

‘তুমি আমাকে এত ঘৃণা করো কেন, কি করেছি আমি তোমার?’ জিজ্ঞেস করল রানা মহিলাকে

‘আচ্ছা! তুমি এখনও জানোই না কেন তোমাকে এত ঘৃণা করি আমি? তাহলে তাকাও আমার দিকে, মাসুদ রানা। এক নিমেষে বুঝতে পারবে তুমি তার কারণ।’ টান মেরে মুখোশটা খুলে ফেলল মহিলা। রানার মুখের সামনে নিয়ে এল ওর বীভৎস মুখ। মুখটা এপাশ-ওপাশ ফিরিয়ে দেখাল রানাকে ভাল করে। লাল লাল ক্ষতগুলোয় পুঁজ জমেছে, দুর্গন্ধ আসছে সেখান থেকে। ভয়ঙ্কর এক পৈশাচিক চেহারা।

রানার হাত ছেড়ে দিয়ে বিড় বিড় করে রাম নাম জপতে জপতে সিঁড়ির দিকে রওনা দিয়েছিল ঘটোৎকচ, পিছন থেকে ‘থামো’ বলে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রস্তর মূর্তিবৎ। শিরদাঁড়া সোজা রেখে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে এবার জোরে জোরে রাম নাম জপতে থাকল দৈত্যটা–এক হাতে মুঠি করে ধরে আছে পৈতে, পিছন ফিরে চাইবার সাহস সঞ্চয় করতে পারল না।

রানাও ভয় পেয়েছে। এমন বীভৎস মুখ জীবনে কখনও দেখেনি সে। কিন্তু সেই সঙ্গে এক অদ্ভুত করুণা দেখা দিল ওর মনের মধ্যে।

‘কে তুমি!’ জিজ্ঞেস করল সে।

‘ললিতা বটব্যাল।’

‘ললিতা বটব্যাল! কিন্তু তুমি না মারা গিয়েছিলে? আম্বালা হাসপাতালে…আমি ভেবেছিলাম মারা গেছ তুমি!’

‘মরিনি। বহুদিন ভেবেছি সেদিন মরে গেলেই ভাল হত। অহত্যার চেষ্টা করেছি বহুবার প্রতিবারই শেষ মুহূর্তে ভেবেছি প্রতিশোধ না নিয়ে মরার কোনও মানে হয় না। আজ সেই সুযোগ এসে উপস্থিত হয়েছে।’ ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা কাঁচের জার বের করল ললিতা বটব্যাল। ‘কনসেনটে’টেড সালফিউরিক অ্যাসিড। নির্যাতন করে তপ্ত হবার পর এই অ্যাসিড ছিটিয়ে দেব আমি তোমার সারা মুখে। আয়নায় দেখতে পাবে সালফিউরিক অ্যাসিড ছিটিয়ে দিলে নিজের চেহারা কেমন লাগে দেখতে।

সত্যিই করুণা হলো রানার। বলল, ‘নিজের দোষ কাটাবার জন্যে বলছি না, ললিতা, কিন্তু সত্যি বলছি, ইচ্ছে করে তোমার এত বড় সর্বনাশ আমি করিনি। বোতলটার মধ্যে যে অ্যাসিড ছিল তা-ও জানা ছিল না আমার। শিউরে উঠে অন্যদিকে মুখ ফেরাল রানা। একজন সুন্দরী স্ত্রীলোকের পক্ষে এটা যে কত বড় ক্ষতি, কেন সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে ওকে ললিতা, বুঝতে পারল রানা। নিজেকে মস্তবড় অপরাধী মনে হলো ওর।

‘যাই হোক, এখন নিশ্চয়ই আমার ঘৃণার কারণটা জানতে বাকি নেই তোমার? এবার ধরে নেয়া যাক, তুমি কিছুতেই বলবে না কোথায় আছে শায়লা, সাদেক খান আর ডক্টর ফৈয়াজ। নাও, তোমাকে যা বলেছিলাম তাই করো ঘটোৎকচ।’

বড় বড় চোখ করে ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে চাইল ঘটোৎকচ। আবার একটা ধমক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল ঝট করে, কিন্তু পৈতে ছাড়ল না।

ঠিক এমনি সময় একজন কনস্টেবল দ্রুতপায়ে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে।

‘টেলিফোন এসেছে, কর্নেল…’ ললিতার মুখের দিকে চেয়েই আটকে গেল ওর মুখের কথা। তারপর বলল, ‘ক…ক… কর্নেল বটব্যালের টে-টেলিফোন।’

‘কে করেছে?’

‘ক-ক্ক-কবীর চৌধুরী!’ বলেই পিছন ফিরে ছুটল সিঁড়ির দিকে।

‘কবীর চৌধুরী!’ গলাটা একটু কেঁপে উঠল ললিতার। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ‘ও জানল কি করে যে আমি এখানে? নিশ্চয়ই খান্না বলেছে। ঠিক আছে, দেখে নেব আমি ওকে। কিন্তু কবীর চৌধুরী আসার আগেই এখানের কাজ শেষ করে ফেলতে হবে।’ মুখোশটা মুখে লাগিয়ে নিয়ে এগোল সে সিঁড়ির দিকে। একটু থেমে ঘাড় ফিরিয়ে ঘটোৎকচকে বলল, ‘এখানেই থাকো। আমি আসছি পাঁচ মিনিটের মধ্যে

তিন মিনিটের মধ্যেই হৃত সাহস ফিরে এল ঘটোৎকচের। টেবিলের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে থাকা রানার অসহায় অবস্থা দেখে আরও একটু বাড়ল সাহস। এতক্ষণের কথোপকথন আবার একবার মনে মনে খতিয়ে দেখে বুঝল, আসলে ভূত-প্রেত কিছুই নয়, এই লোকটা বছর দু’য়েক আগে অ্যাসিড দিয়ে চেহারা খারাপ করে দিয়েছিল কর্নেলের। তারপরেই মনে পড়ল কর্নেলের হুকুমের কথা। ফিরে এসে হাতটা ভাঙা না পেলে ওর বারোটা বাজিয়ে দেবে কর্নেল। দুটো হাতই ভেঙে রাখা বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

আবার এগিয়ে এসে চেপে ধরল সে রানার হাত। হাঁটু ঠেকাল কনুই বরাবর। একহাতে কব্জি আরেক হাতে বাইসেপ টিপে ধরল শক্ত করে। জোরে টান দিলেই মড়াৎ করে ভেঙে যাবে রানার হাত।

চাপ বাড়তে আরম্ভ করল। ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে রানার মুখ, আঁধার হয়ে আসছে চোখ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন