কাজী আনোয়ার হোসেন
খট্ করে শব্দ হলো কেবল, গুলি বেরোল না পিস্তল থেকে। খনখনে গলায় হেসে উঠল মেজর টিং ফং। উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে।
‘মাফ করবেন, মেজর মাসুদ রানা। হাতে সময় আছে, তাই একটুখানি বাস্তব রসিকতা করছিলাম, আমার চীফ একটু ব্যস্ত আছেন, এক্ষুণি ডাক আসবে আপনার, ততক্ষণ…’
টেবিলের ওপর টেলিফোন বেজে উঠল। একটিও কথা না বলে রিসিভার কানে তুলে শুনল সে বিশ সেকেণ্ড, তারপর নামিয়ে রাখল।
‘হাত কড়াটা খুলে দাও। চলুন, মেজর রানা। তলব এসেছে চীফের কাছ থেকে। দোতলায় যেতে হবে আমাদের এখন। তোমরা থাকো, তোমাদের আর যেতে হবে না।’
সিঁড়ি দিয়ে উঠেই লম্বা করিডর। তিনটে ঘর ছেড়ে বাঁয়ে গেছে আরেকটা করিডর। শেষের ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। দুটো টোকা দিয়ে অনুমতির অপেক্ষা না করেই রানাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল টিং ফং ঘরের ভিতর।
ঘরের মেঝেতে পুরু লাল কার্পেট বিছানো। প্রথমেই চোখ পড়ল রানার ঘরের দেয়ালে টাঙানো বিভিন্ন রকমের বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল ও রিভলভারের ওপর। মারলিন কারবাইন, মসবার্গ আর উইনচেস্টার রাইফেল, ফারলাখ, ফিনিশ লায়ন, ওয়ালথার, সাকো- কি নেই? আর্জেন্টিনার ব্যালেস্টার মলিনা, ইটালিয়ান গ্লিসেনটিস, সুইডিস লাটিস, আর রাশান ম্যাকারভ- সব রকম আছে। শেষের তাকে সাজানো আছে কয়েকটা টেলিস্কোপিক সাইট, সায়ানাইড ফায়ারিং সিগারেট কেস, টাইম বম্ব ফিট করা মিনিয়েচার ক্যামেরা আর এক্সপ্লোসিভ রিস্টওয়াচ।
তারপরই দেখতে পেল রানা, একটা মস্ত বড় বাঁকা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে বসে ফাইল ঘাঁটছে একজন লোক। একনজরেই অনায়াসে চিনতে পারল রানা। চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিসের চীফ, অ্যাডমিরাল হো ইন। এবার সত্যি অবাক হলো রানা। এ ভাবে ধরে আনা হলো কেন ওকে?
‘আসুন, মেজর মাসুদ রানা।’ সহাস্যে স্বাগত জানালেন অ্যাডমিরাল। ‘বসুন ওই চেয়ারটায়। টিং ফং, তুমি এখন যেতে পারো। ঠোঁটের ওপর রক্ত দেখেই বোঝা যাচ্ছে যাত্রাটা তেমন উপভোগ্য হয়নি মাসুদ রানার। তাছাড়া সারাটা দিন খাওয়া-দাওয়া হয়নি ওঁর। সেই ব্যবস্থা করো গিয়ে তুমি। দরকার হলেই ডাকব তোমাকে।…কই, বসুন?’
অবাক হয়ে চেয়ে আছে রানা জানালার দিকে। ছিপছিপে লম্বা একজন লোক রানার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে চেয়ে রয়েছে। দাঁতে চেপে ধরা পাইপ থেকে ধোঁয়া উঠছে অল্প অল্প। অ্যাডমিরাল হো ইনের কথা কানে ঢুকল না রানার। হাঁ হয়ে গেল ওর মুখটা। বাইরের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের চীফ, মেজর জেনারেল রাহাত খান।
দীর্ঘ পদক্ষেপে টেবিলের কাছে চলে এলেন রাহাত খান। অ্যাডমিরাল হো ইনের পাশের চেয়ারটায় বসে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘বসো, রানা।
বিস্মিত রানা বসল একটা চেয়ারে। মাথার মধ্যে অনেকগুলো চিন্তা একসাথে ভিড় করে এসে গোলমাল করে দিল সবকিছু। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। মান্দালয়ে রাহাত খান, হো ইন- এরা কেন? ওকেই বা ছেলে-ভুলানো কাজ দিয়ে রেঙ্গনে পাঠানো হয়েছিল কেন? ধরেই বা আনা হলো কেন এমন রূঢ় ভাবে? কি এদের উদ্দেশ্য? মেজর টিং ফং কি ঠিকই বলেছিল? তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে সন্দেহ করে এখানে ধরে আনা হয়েছে?
‘এসবের কি অর্থ, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল রানা আহত কণ্ঠে।
‘অর্থ আছে। তোমার সব প্রশ্নেরই সদুত্তর পাবে। কিন্তু তার আগে খাওয়া-দাওয়াটা সেরে নিতে চাও?’
‘না, স্যার। এক্ষুণি জানতে চাই আমি কেন এভাবে…’
‘আমিই বরঞ্চ শুরু করি, কি বলেন, মেজর জেনারেল?’ হঠাৎ বলে উঠলেন অ্যাডমিরাল হো ইন। ‘আমার মুখ থেকে শুনলে আঘাতটা কম লাগবে মেজর রানার। মোটামুটি ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, আপনি তলে তলে ভারতের সাথে হাত মিলিয়েছেন, কিংবা অদূর ভবিষ্যতে ওদের পক্ষে কাজ করবেন বলে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, এই সন্দেহ করে আপনাকে এখানে ধরে আনা হয়েছে।
‘আমি কী এমন কাজ করেছি, যার জন্যে আপনাদের মনে এই জঘন্য সন্দেহ?’ জিজ্ঞেস করল রানা বিস্মিত কণ্ঠে।
‘একটা-দুটো প্রমাণে আমাদের সন্দেহ উৎপন্ন হয়নি, মেজর মাসুদ রানা। অসংখ্য প্রমাণ হাতে আছে আমাদের। কোটা বলব? ভারতীয় এজেন্টের কাছে পাকিস্তানের অনেক গোপন তথ্য পাচার করেছেন আপনি, বেইজিং-এ চীনা সামরিক ঘাঁটির ছবি তুলে দিয়েছেন ওদের হাতে, ভারতে কার্যরত চীনা ও পাকিস্তানী এজেন্টদের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছেন ওদের হাতে…কত বলব? সব রিপোর্ট টাইপ করা আছে আমাদের কাছে, আপনি পাবেন এককপি।’
‘আপনারও কি এই মত, স্যার?’ সোজাসুজি চাইল রানা রাহাত খানের চোখের দিকে। ‘আপনিও কি বিশ্বাস করেন এ-সব কাজ আমার দ্বারা সম্ভব?’
‘আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছুই এসে যায় না, রানা, দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপটা হাতে নিয়ে বললেন রাহাত খান। ‘স্পষ্ট প্রমাণ আছে তোমার বিরুদ্ধে, পুরো এক ঘণ্টার একটা ফিল্ম আছে, গোটা পঞ্চাশেক স্টিল ফটোগ্রাফ আছে…’
‘গোড়া থেকে বুঝিয়ে বলুন, স্যার।’ আকাশ ভেঙে পড়ল রানার মাথার ওপর। মেজর জেনারেল রাহাত খানের মুখে এই কথা শুনবে, কল্পনাতেও ছিল না ওর।
‘আমিই বলছি,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ‘ব্যাপারটা শুরু হয়েছে দু’মাস আগে জেনেভায়। মাতাল অবস্থায় হোটেলে ফিরছিলেন আপনি অনেক রাতে। আপনাকে ঘরে পৌঁছে দেয় ভারতের একজন প্রতিভাবান সিক্রেট এজেণ্ট সুহর্ষ নাগ। এবং একজন পরমাসুন্দরী ভারতীয় মহিলা এজেন্টকে ঢুকিয়ে দেয় আপনার ঘরে। বাকি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছেন। ছবি তোলার বন্দোবস্তটাও সে-ই করেছিল। আমাদের কষ্ট করতে হয়নি। তিনদিন পরে মেয়েটির লাস পাওয়া গিয়েছিল হোটেলের সুইমিং পুলে। আপনি প্রকৃতিস্থ হয়েই বুঝতে পেরেছিলেন কি ভুল করে ফেলেছেন- তাই এইভাবে মুক্তি পেতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু জড়িয়ে পড়লেন আরও। সুহর্ষ নাগ সময় মত সাহায্য না করলে খুনের দায়ে জেল খাটতে হত আপনাকে।
‘আচ্ছা! তাহলে খুনও করেছি?’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রানা কথা কয়টা। ‘কেবল তাই নয়, নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিক্রি করে দিয়েছেন সুহর্ষের কাছে। অবশ্য আপনি ওর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি করেননি, কিন্তু এতগুলো ছবি এবং জ্বলন্ত প্রমাণ সুহর্ষের হাতে থাকায় তেমন কোন সুবিধা করে উঠতে পারেননি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হতে হয়েছে আপনাকে সুহর্ষের প্রস্তাবে। এবং তারপর থেকে আপনি ডাবল এজেন্টের কাজ করে চলেছেন- বিনিময়ে পয়সাও পাচ্ছেন প্রচুর। বিভিন্ন দেশের পাকিস্ত ানী হাই কমিশনারের অফিস থেকেও আপনি অনেকগুলো ডকুমেন্টের ফটোগ্রাফ তুলে পাচার করেছেন ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের কাছে। ঢাকায় ফিরেও পূর্ণোদ্যমে কাজ করে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আপনাকে টোকিও হয়ে বেইজিং যাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হলো, আমাদের অনুরোধে। যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও যাচ্ছেন, এমনি ভাব করে ভেতর ভেতর আহ্লাদে আটখানা হয়ে চলে গেলেন আপনি বেইজিং আপনার নতুন প্রভুদের নির্দেশে কিছু তথ্য জোগাড় করতে। কি, মনে পড়েছে এখন সব কথা?’
কোনও উত্তর দিল না রানা।
‘আরও বলব? আপনার অজান্তে ঢাকার পি.সি.আই. হেড কোয়ার্টারে ঢুকেছেন আপনি মাইক্রো ট্রান্সমিটার সঙ্গে নিয়ে, ফলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে চীন ও পাকিস্তানের। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার অন্তত একশো জন সিক্রেট এজেন্টকে কায়দা মত বাগে এনে ফেলবে ওরা অল্পদিনের মধ্যেই, ওদের ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করবে। আরও শুনবেন?’ এতক্ষণ একটানা কথা বলে লম্বা করে দম নিলেন অ্যাডমিরাল।
‘বলুন, বলুন। থামলেন কেন? আর কি কি করেছি শুনি,’ বলল রানা তিক্ত কণ্ঠে।
এবার কথা বললেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। পাইপটা ধরিয়ে নিয়েছেন তিনি ইতিমধ্যে।
‘এ ব্যাপারে আর বিশেষ কিছু বলার নেই তোমাকে। সীলমোহর করা চিঠি দেয়া হয়েছিল নিজহাতে বেইজিং পৌঁছে দেবার জন্যে, সেটা ওদের না দিয়ে আজ তুমি পোস্ট করেছ নয়াদিল্লীর ঠিকানায়। এরপরেও তোমাকে মুক্ত রাখা যুক্তিযুক্ত মনে না করায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। আমি আজই সকালে চলে এসেছি জরুরী খবর পেয়ে।’
‘আচ্ছা। এবার আমার কপালে কি ঘটতে চলেছে? ফাঁসি না যাবজ্জীবন কারাদণ্ড?’ জিজ্ঞেস করল রানা শান্ত কণ্ঠে।
‘প্রথমে তোমাকে আচ্ছা করে ইন্টারোগেট করা হবে, মারধোর করা হবে অল্পবিস্তর, তারপর একটা প্লেনে করে পাঠিয়ে দেয়া হবে পাকিস্তানে কোর্ট মার্শালের জন্যে। পথে দু’জন গার্ড এবং একজন পাইলটকে হত্যা করে তুমি প্লেনটাকে ক্র্যাশ ল্যাণ্ড করাবে ভারতীয় এলাকায়।’
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রানা মেজর জেনারেল রাহাত খানের তীক্ষ্ণ দুই চোখের দিকে। দশ সেকেণ্ড একটি কথাও বেরোল না ওর মুখ থেকে। রাহাত খানের ঠোঁটের কোণে পাতলা একফালি রহস্যময় হাসি।
‘কিন্তু…কিন্তু…’ থেমে গেল রানা। আবার কথা বললেন রাহাত খান।
‘ব্যাপারটার গুরুত্ব নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। ভয়ঙ্কর একটা ঝুঁকি নিতে হবে তোমাকে। ইচ্ছে করলে এখনও এড়িয়ে যেতে পারো। ভেবে দেখো ভাল করে।’
ধীরে ধীরে অনাবিল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রানার মুখ। বুকের ওপর চাপানো দশ মণী পাথরটা কেউ তুলে নিয়েছে যেন। চট্ করে চোখ ফিরিয়ে দেখল অ্যাডমিরালের মুখেও হাসি। রানাকে এড়িয়ে চোখ টিপে ইশারা করতে গিয়েছিলেন তিনি রাহাত খানকে, ধরা পড়ে গেলেন।
‘কিন্তু, স্যার, মাসুদ রানা হিসাবে এতদিন কাউকে দিয়ে যদি অভিনয় করিয়ে থাকেন, আমার চেহারা দেখলেই বুঝে ফেলবে ওরা।’
‘না। সে সম্ভাবনা নেই। সুহর্ষ নাগ আমাদের লোক। আর তোমার নামে যে লোকটাকে এতদিন চালিয়েছি সে দেখতে অনেকটা তোমারই মত। চুলগুলো পর্যন্ত তোমার মত করে ছাঁটিয়ে নেয়া হয়েছিল। আর সিনেমা রীলটা তোলা হয়েছিল আমাদের ফটোগ্রাফিক ল্যাবরেটরিতে সেট তৈরি করে নিয়ে। বেশিরভাগ সময়ই লোকটার মুখ আবছা রাখা হয়েছে- যখন স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে তখন সেটা তোমার ছবি।
‘ঢাকায় যে ভারতীয় এজেন্ট মাসুদ রানাকে কন্ট্যাক্ট করেছিল, সে তো নকল মাসুদ রানাকে স্পষ্ট দেখেছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘দেখেছে। কিন্তু সাক্ষ্য দিতে আসবে না সে আর কোনদিন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তার,’ গম্ভীর মুখে বললেন রাহাত খান।
ভুরু কুঁচকে গেল রানার। খুন-খারাপি পছন্দ করেন না মেজর জেনারেল। কতখানি সিরিয়াস ব্যাপার হলে এতসব আয়োজন দরকার হতে পারে, উপলব্ধি করল রানা। বুঝল ওর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যাসাইনমেন্ট এসে উপস্থিত হয়েছে আজ সামনে। চীন-পাকিস্তানের যৌথ কোনও ব্যাপার। ভয়ঙ্কর কোন কাজের কথা পাড়বে এক্ষুণি বুড়ো। ছলকে উঠল এক ঝলক রক্ত ওর বুকের ভিতর।
‘তা, অন্য কাউকে দিয়ে অভিনয় না করিয়ে গোড়াতেই আমাকে বলেননি কেন, স্যার? অনর্থক…
‘অনর্থক আমি কোন কাজ করি না, রানা।’ চাবুক পড়ল যেন রানার পিঠে।
‘সরি, স্যার, আমি ঠিক তা বলতে চাইনি…’
‘বুঝেছি। তোমাকে প্রথমেই আনা হয়নি এই জন্যে যে, প্রথমেই যদি হঠাৎ কোন সড়ক দুর্ঘটনায় তোমার মৃত্যু হয় তাহলে আমাদের সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে যাবে। তোমাকে দূরে সরিয়ে রেখে আগে অন্য লোককে দিয়ে তাই পথ পরিষ্কার করেছি। তুমি এই প্ল্যানের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।’
‘খুবই সাদঘাতিক ব্যাপার মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ।’ এতক্ষণে কথা বললেন অ্যাডমিরাল। ‘আপনি যদি সফল হতে না পারেন তাহলে আগামী ছয় মাসে পৃথিবীর চেহারা পাল্টে যাবে। সিক্রেট সার্ভিসের ইতিহাসে এক মহা বিপ্লব ঘটতে চলেছে, মেজর রানা। আপনি যদি ঠেকাতে না পারেন তাহলে আমাদের একটা তথ্যও ওদের কাছে অজানা থাকবে না। আমাদের অস্ত্র তৈরির আগেই তার ফর্মুলা মুখস্থ হয়ে যাবে ওদের। আমাদের সরকার কি প্ল্যান করতে যাচ্ছে, জেনে ফেলবে ওরা বৈঠকে আলোচনা হবার আগেই। এমন কি আমাদের রাষ্ট্রীয় নেতারা কি চিন্তা করছে তাও অজানা থাকবে না ওদের কাছে। ছয় মাসের মধ্যেই সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবে ইণ্ডিয়া। যে কোন রাষ্ট্র যত শক্তিশালীই হোক, মাথা নোয়াতে বাধ্য হবে ভারতের কাছে। কল্পনা করতে পারেন কি ভয়ঙ্কর অবস্থা সেটা?’
রানা কিছুতেই ভেবে পেল না কি করে তা সম্ভব। কি এমন ব্যাপার ঘটাচ্ছে ভারত যাতে মহাচীন পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে?
‘পাগলামি মনে হচ্ছে আপনার কাছে, তাই না?’ সিগারেট ধরালেন অ্যাডমিরাল। ‘আসলে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল পাগলামি থেকেই। গোড়া থেকে শুনুন। গদি আঁটা চেয়ারে একটু নড়ে চড়ে বসে আরম্ভ করলেন তিনি। ‘লোকটার নাম সাদেক খান। জন্ম ঢাকা জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। কিন্তু বি.এ. পরীক্ষার পরই মাথা খারাপ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে একটু ভাল থাকে- বছর খানেক চাকরি করে এ-অফিস ও অফিসে, অদ্ভুত ধূর্ততার সাথে প্রচুর পয়সা উপার্জন করে, তারপর আবার মাস ছ’য়েক কাটায় পাবনার মেন্টাল হসপিটালে। কেবল মাথা খারাপ হলে হত, ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে একটা গাড়ির তলায় চাপা পড়ে মাথায় চোট পেয়েছিল লোকটা, দৃষ্টিশক্তিটা বাঁচাবার জন্যে মাথার মধ্যে সূক্ষ্ম একটা অপারেশন করতে হয়েছিল- সেই থেকে অদ্ভুত এক ধরনের বিকৃতি দেখা দিয়েছে ওর মধ্যে। এখানে-সেখানে যুবতী নারীর মৃতদেহ পাওয়া যেতে আরম্ভ করল পঁয়ষট্টি সালের গোড়া থেকে। অষ্টম খুনের পরই ধরা পড়ল লোকটা। বিচারে কিন্তু পাগল সাব্যস্ত হলো। মেন্টাল হসপিটালের সেলে পুরে দেয়া হলো ওকে।
চুপচাপ সিগারেট টানলেন অ্যাডমিরাল কিছুক্ষণ।
‘গত বছর জুলাই মাসে বন্দী স্পাই বিনিময় হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। হঠাৎ সাদেক খানকে চেয়ে বসল ভারত সরকার দুইজন মূল্যবান পাকিস্তানী এজেন্টের বিনিময়ে। এক কথায় রাজি হয়ে গেল পাকিস্তান…’
‘ঠিক এক কথায় নয়,’ বাধা দিলেন রাহাত খান। ‘আমরা সাদেক খান সম্পর্কে সব রকম খোঁজ-খবর নিলাম। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে ভারতীয় এজেণ্ট হিসাবে দাঁড় করানো গেল না। হাসপাতালে খবর নিয়ে জানা গেল প্যারানোইয়ার প্রথম স্টেজ চলছে ওর। ওর ধারণা প্রত্যেকটা লোক ওকে হত্যা করবার সুযোগ খুঁজছে। তার ওপর আরেক উপসর্গ- মঙ্গলগ্রহের লোকদের সঙ্গে নাকি টেলিপ্যাথির সাহায্যে কথা বলছে সে অনর্গল। আমরা বুঝলাম- যদি অতীতে ভারতের হয়ে কোন কাজ করেও থাকে, এখন লোকটা বদ্ধ পাগল। কাজেই রাজি হয়ে গেলাম।
‘ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু মাস দু’য়েক পর হঠাৎ পাওয়া গেল সাদেক খানের ডায়েরীটা। লুকিয়ে রেখেছিল সে ওটা ভেন্টিলেটার গ্রিলের ওপর- হোয়াইট ওয়াশ করতে গিয়ে মিস্তিরীর চোখে পড়েছিল ওটা। হয়তো ওর মধ্যে কোন তথ্য থাকতে পারে মনে করে নার্স সে ডায়েরীটা দিয়েছিল সাদেক খান যে সাইকিয়াট্রিস্টের পেশেন্ট ছিল তাকে। তার ডেস্কে পড়েছিল ওটা হপ্তা খানেক, তারপর হঠাৎ একদিন পাতা উল্টেই অবাক হয়ে গিয়েছিল ডক্টর নিয়াজ। এতই আশ্চর্য কয়েকটা কথা লেখা ছিল ওতে যে, সেই দিনই সে ডায়েরীটা তুলে দেয় পুলিসের হাতে। সেখান থেকে সোজা চলে আসে আমাদের কাছে- কারণ আমরাই ডিল করছিলাম সাদেক খানের কেস।’
পাইপটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে আবার ধরাবেন কিনা ভাবলেন রাহাত খান, তারপর নামিয়ে রাখলেন সেটা টেবিলের ওপর।
‘প্রত্যেকটা লোককে সন্দেহের চোখে দেখতে আরম্ভ করেছিল সাদেক খান। ডাক্তারদের ওপরই সন্দেহ ছিল ওর সবচেয়ে বেশি। এইসব অনুভূতির কথা লেখা আছে ডায়েরীতে। আশ্চর্যের কথা এই যে, প্রত্যেকটা ডাক্তার এবং নার্সের নিজেদের মধ্যেকার টুকরো টুকরো আলাপ-আলোচনা হুবহু লেখা আছে ডায়েরীতে। এমন কি জটিল সব কেস হিস্ট্রি পর্যন্ত হুবহু টোকা আছে। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড ডক্টর নিয়াজ বলছেন উনি যে-কথা কখনও কাউকে বলেননি, মনে মনে চিন্তা করেছেন কেবল, সেইসবও হুবহু লেখা আছে।
‘প্রথম দিকে তথ্যের কিছু কিছু ভুল-ভ্রান্তি ছিল, কিন্তু মাঝামাঝি আসতেই বোঝা যায় এক অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছে সাদেক খান। এভিয়েশন টার্ম দেখে আমরা পি.আই.এ-র প্রত্যেকটি পাইলটের সাথে যোগাযোগ করেছি। দেখা গেছে ল্যাণ্ডিং করবার সময় গ্রাউণ্ড কন্ট্রোলের সাথে তাদের কথাবার্তা লেখা আছে ডায়েরীতে। এমন কি একজন পাইলট বলল তার ব্যক্তিগত জীবনের দুই-একটা কথা চিন্তা করছিল সে সেই সময়ে তাজ্জব কথা, হুবহু সেই চিন্তাগুলো লেখা আছে- এমন কি তার স্ত্রী-পুত্র- কন্যাকে সে যে-নামে ডাকে সে-সবও ঠিক ঠিক লিখে গেছে সাদেক খান।
‘আশ্চর্য!’ বলল রানা।
‘আরও অনেক কথা লেখা আছে ডায়েরীতে। সেসব তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু তার থেকে একটা কথা জানা গেছে, দূরত্ব সাদেক খানের এই টেলিপ্যাথিক কনট্যাক্টে কোন রকম বাধার সৃষ্টি করে না। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি হাজার হাজার মাইল দূরের কথাবার্তা লাইনকে লাইন লিখে গেছে সে নির্ভুলভাবে। বিস্ময়কর ব্যাপার, তাই না? যে-কোন লোকের চিন্তা ভাবনা, কথাবার্তা জানতে পারছে লোকটা। ঠিক যেন রেডিও রিসিভার।
‘সত্যিই আশ্চর্য!’ বলল রানা। ‘কোনমতে ওর এই ক্ষমতার কথা টের পেয়ে ভারত নিয়ে গেছে ওকে। ওকে এখন ব্যবহার করবে আমাদের বিরুদ্ধে…’
‘না। তার চেয়েও বড় কিছু। সে সব কথায় পরে আসছি। বর্ডার ক্রস করবার পরই সাদেক খানকে রাজকীয় সম্মানের সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দিল্লী, সেখান থেকে কোলায়ের লেকের একটা সুরক্ষিত ক্লিনিকে। দক্ষিণ ভারতের ঈস্টার্ন ঘাটে গোদাবরী আর কৃষ্ণা নদীর মাঝামাঝি এলাকায় রয়েছে বিশাল এই কোলায়ের লেক। ইলোরের কাছে। ছোট ছোট অনেকগুলো দ্বীপ আছে এই লেকের মধ্যে। একটার নাম ওঙ্কার। এই ওঙ্কার দ্বীপে সেই সুরক্ষিত ক্লিনিক। হঠাৎ থেমে সোজাসুজি রানার চোখের দিকে চাইলেন রাহাত খান। ‘কবীর চৌধুরীকে মনে আছে?’
‘কবীর চৌধুরী! রাঙামাটির ডুবো পাহাড়ের সেই পাগল বৈজ্ঞানিক ‘হ্যাঁ। কৌশলে জেল থেকে পালিয়ে ইণ্ডিয়ায় চলে যায়। সেই কবীর চৌধুরীই এ সমস্তকিছুর উদ্যোক্তা। সে-ই আবিষ্কার করে সাদেক খানকে। এবং ভারত সরকারের মাথায় এই প্ল্যানটা ঢোকায়। এই প্রজেক্টটা পরিচালনা করছে কবীর চৌধুরী। মানুষ মরণশীল। কবীর চৌধুরী জানে হাজার চেষ্টা করলেও সাদেক খানের আয়ু বাড়াতে পারবে না সে। তাই ওর ব্রেনের অনুরূপ কম্পিউটার তৈরি করছে এখন। কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। তৈরি হয়ে গেলে পৃথিবীর কোন তথ্য আর অজানা থাকবে না ওদের কাছে। সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা রানা। আর আমরা যা জানতে পেরেছি সেটা আরও ভয়ঙ্কর। যদিও ভারতের সাহায্য নিয়ে যন্ত্রটা তৈরি করছে কবীর চৌধুরী, ভারত এর ফল ভোগ করতে পারবে না। অত্যন্ত শক্তিশালী একটা ইন্টারন্যাশনাল গ্যাঙ তৈরি করেছে কবীর চৌধুরী- যন্ত্রটা তৈরি হলেই তারা ছোবল মারবে ভারতের বুকে। যাই হোক, আপাতত সাদেক খানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদেরকে, রানা।
‘তার মানে আমাকে যেতে হচ্ছে ওঙ্কার দ্বীপে?’
‘হ্যাঁ। সমস্ত পৃথিবীর স্বার্থেই ওদের ঠেকানো দরকার। তোমার কি মনে হয়?’
‘নিশ্চয়ই, স্যার। নইলে গোপন বলে কিছু থাকবে না। পৃথিবীর সমস্ত সামরিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক তথ্য জানা হয়ে যাবে ওদের এবং নিজেদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করবে ওরা ওসব তথ্যকে। সারা দুনিয়া ওদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে পড়বে। আশ্চর্য! কিন্তু সত্যিই কি টেলিপ্যাথি দিয়ে এইসব ব্যাপার সম্ভব?’
‘এ নিয়ে আমিও আলাপ-আলোচনা করেছি কয়েকজন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞের সাথে। তাঁরা বলছেন, অত্যাধুনিক বিজ্ঞান এতদিনে স্থির নিশ্চিত হয়েছে যে, সত্যিসত্যিই এমন একটা জিনিস আছে। খুব সম্ভব ব্রেন অপারেশনের পরেই ওর এই ক্ষমতা জন্মেছে।’
‘প্লেন ক্র্যাশ করবার পর আমার কাজ কি হবে, স্যার?’
‘সে-সব তোমাকে পরে জানাব। আজ তুমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে আছ। খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে নাও।
এই কথায় রানার মনে পড়ল তাকে কিভাবে ধরে আনা হয়েছে। বলল, ‘কিন্তু এমন ভাবে আমাকে ধরে আনার পেছনে…
‘সব প্রশ্নের উত্তর পাবে তুমি, রানা। তখন দেখবে তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করার পেছনে সত্যিই যৌক্তিকতা আছে।’ পাইপটা আবার ধরালেন রাহাত খান। কয়েকটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন, তারপর ওটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘আর একটা কথা, ভারতীয়রা ভাল করেই জানে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছে ওরা এবার। কাজেই গার্ডের ব্যবস্থাও সেই পরিমাণ কঠোর করা হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত গার্ড দিয়ে ঘেরাও করতে পারছে না, পাছে তাই দেখে ব্যাপার কি জানতে চেষ্টা করি আমরা। ওরা জানে না যে আমরা সাদেক খানের অলৌকিক শক্তি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হয়ে গেছি মাস তিনেক আগেই। কাজেই আমার মনে হয়, তোমার পক্ষে লোকটাকে উদ্ধার করে আনা অসম্ভব না-ও হতে পারে।
‘আপনারা যখন জানেন কোথায় ওদের গবেষণাগার, জায়গাটা ধ্বংস করে দিলেই তো চুকে যায়।’
‘আরেকটা যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে পারি তাহলে। সেটা চাই না আমরা।’
‘বোমা ফেলা ছাড়া আরও তো উপায় আছে।’
‘নেই। ভেতরে না ঢুকতে পারলে কিছু করা যাবে না। সেজন্যেই তোমার গ্রাউণ্ড তৈরি করা হয়েছে বহু যত্নের সঙ্গে।
‘আমি এই প্ল্যানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলাম কি করে, স্যার? এত লোক থাকতে আমাকে বেছে নেয়া হলো কেন?’
‘তার কারণ তুমি ক্লিনিকের ভেতর থেকে সাহায্য পাবে। ওই ক্লিনিকে এমন একজন আছে যাকে তুমি চেনো- এমন একজন, যে তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ- যাকে তুমি সাহায্য করেছিলে সোয়া দুই বছর আগে।’
‘কে?’ ভুরু কুঁচকে স্মরণ করবার চেষ্টা করল রানা। কাকে সে সাহায্য করেছিল সোয়া দুই বছর আগে। কে তার কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ হয়ে আছে।
‘এই ক্লিনিকের প্রধান বৈজ্ঞানিক ডক্টর আবদুল্লাহ্ ফৈয়াজ এবং তাঁর সহকারিণী ও একমাত্র কন্যা শায়লা ফৈয়াজ।’
‘শায়লা ফৈয়াজ!’ চেনা চেনা লাগল নামটা রানার কাছে।
‘যাকে তুমি আম্বালা হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে পৌঁছে দিয়েছিলে নয়াদিল্লী ওর বাবার কাছে।
‘আচ্ছা!’ স্পষ্ট মনে পড়ল রানার শায়লার মুখটা।
‘এবার বলো, রানা। যাবে তুমি ওঙ্কার দ্বীপে?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন বদ্ধ রানার দিকে।
‘যাব,’ মৃদু হেসে বলল রানা।
উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেজর জেনারেলের চোখ-মুখ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন