রাজসিংহ – ১.১

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রথম খণ্ড
চিত্রে চরণ
প্রথম পরিচ্ছেদ : তসবিরওয়ালী

রাজস্থানের পার্‍বত্যপ্রদেশে রূপনগর নামে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। রাজ্য ক্ষুদ্র হউক, বৃহৎ হউক, তার একটা রাজা থাকিবে। রূপনগরেরও রাজা ছিল। কিন্তু রাজ্য ক্ষুদ্র হইলে রাজার নামটি বৃহৎ হওয়ায় আপত্তি নাই–রূপনগরের রাজার নাম বিক্রমসিংহ। বিক্রমসিংহের আরও সবিশেষ পরিচয় পশ্চাৎ দিতে হইবে।
সম্প্রতি তাঁহার অন্ত:পুরমধ্যে প্রবেশ করিতে আমাদিগের ইচ্ছা। ক্ষুদ্র রাজ্য; ক্ষুদ্র রাজধানী; ক্ষুদ্র পুরী। তন্মধ্যে একটি ঘর বড় সুশোভিত। গালিচার অনুকরণে শ্বেতকৃষ্ণপ্রস্তরঞ্জিত হর্‍ম্যতল; শ্বেতপ্রস্তরনির্‍মিত নানা বর্ণের রত্নরাজিতে রঞ্জিত কক্ষপ্রাচীর; তখন তাজমহল ও ময়ূরতক্তের অনুকরণই প্রসিদ্ধ, সেই অনুকরণে ঘরের দেওয়ালে সাদা পাথরের অসম্ভব পক্ষী সকল, অসম্ভব রকমে অসম্ভব লতার উপর বসিয়া, অসম্ভব জাতির ফুলের উপর পুচ্ছ রাখিয়া, অসম্ভব জাতীয় ফল ভোজন করিতেছে। বড় পুরু গালিচা পাতা, তাহার উপর এক পাল স্ত্রীলোক, দশ জন কি পনর জন। নানা রঙের বস্ত্রের বাহার; নানাবিধ রত্নের অলঙ্কারের বাহার; নানাবিধ উজ্জ্বল কোমল বর্‍ণের কমনীয় দেহরাজি,–কেহ মল্লিকাবর্‍ণ, কেহ পদ্মরক্ত, কেহ চম্পকাঙ্গী, কেহ নবদূর্‍বাদলশ্যামা,–খনিজ রত্নরাশিকে উপহাসিত করিতেছে। কেহ তাম্বূল চর্‍বণ করিতেছে, কেহ আলবোলাতে তামাকু টানিতেছে–কেহ বা নাকের বড় বড় মতিদার নথ দুলাইয়া ভীমসিংহের পদুমিনী রাণীর উপাখ্যান বলিতেছেন, কেহ বা কাণের হীরকজড়িত কর্ণভূষা দুলাইয়া পরনিন্দায় মজলিস জাঁকাইতেছেন। অধিকাংশই যুবতী; হাসি টিটকারির কিছু ঘটা পড়িয়া গিয়াছে–একটু রঙ্গ জমিয়া গিয়াছে।
যুবতীগণের হাসিবার কারণ, এক প্রাচীনা, কতকগুলি চিত্র বেচিতে আসিয়া তাঁহাদিগের হাতে পড়িয়াছিল। হস্তিদন্তনির্‍মিত ফলকে লিখিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপূর্‍ব চিত্রগুলি; প্রাচীনা বিক্রয়াভিলাষে এক একখানি চিত্র বস্ত্রাবরণমধ্যে হইতে বাহির করিতেছিল; যুবতীগণ চিত্রিত ব্যক্তির পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতেছিল।
প্রাচীনা প্রথম চিত্রখানি বাহির করিলে, এক কামিনী জিজ্ঞাসা করিল, “এ কাহার তসবির আয়ি?”
প্রাচীনা বলিল, “এ শাহজাঁদা বাদশাহের তসবির |”
যুবতী বলিল, “দূর মাগি, এ দাড়ি যে আমি চিনি। এ আমার ঠাকুরদাদার দাড়ি |”
আর এক জন বলিল “সে কি লো? ঠাকুরদাদার নাম দিয়া ঢাকিস কেন? ও যে তোর বরের দাড়ি |” পরে আর সকলের দিকে ফিরিয়া রসবতী বলিল, “ঐ দাড়িতে একদিন একটা বিছা লুকাইয়াছিল–সই আমার ঝাড়ু দিয়া সেই বিছাটা মারিল |”
তখন হাসির বড় একটা গোল পড়িয়া গেল। চিত্রবিক্রেত্রী তখন আর একখানা ছবি দেখাইল। বলিল, “এখানা জাঁহাগীর বাদশাহের ছবি |”
দেখিয়া রসিকা যুবতী বলিল, “ইহার দাম কত?”
প্রাচীনা বড় দাম হাঁকিল।
রসিকা পুনরপি জিজ্ঞাসা করিল, “এ ত গেল ছবির দাম। আসল মানুষটা নুরজাঁহা বেগম কতকে কিনিয়াছিল?”
তখন প্রাচীনাও একটু রসিকতা করিল; বলিল, “বিনামূল্যে |”
রসিকা বলিল, “যদি আসলটার এই দশা, তবে নকলটা ঘরের কড়ি কিছু দিয়া আমাদিগকে দিয়া যাও |”
আবার একটা হাসির রোল পড়িয়া গেল। প্রাচীনা বিরক্ত হইয়া চিত্রগুলি ঢাকিল। বলিল, “হাসিতে মা, তসবির কেনা যায় না। রাজকুমারী আসুন, তবে আমি তসবির দেখাইব। আর তাঁরই জন্য এ সকল আনিয়াছি |”
তখন সাত জন সাত দিক হইতে বলিল, “ওগো আমি রাজকুমারী। ও আয়ি বুড়ী, আমি রাজকুমারী |” বৃদ্ধা ফাঁপরে পড়িয়া চারিদিকে চাহিতে লাগিল, আবার আর একটা হাসির গোল পড়িয়া গেল।
অকস্মাৎ হাসির ধুম কম পড়িয়া গেল–গোলমাল একটু থামিল–কেবল তাকাতাকি, আঁচাআঁচি এবং বৃষ্টির পর মন্দ বিদ্যুতের মত ওষ্ঠপ্রান্তে একটু ভাঙ্গা হাসি। চিত্রস্বামিনী ইহার কারণ সন্ধান করিবার জন্য পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, তাঁহার পিছনে কে একখানি দেবীপ্রতিমা দাঁড় করাইয়া গিয়াছে।
বৃদ্ধা অনিমেষলোচনে সেই সর্‍বশোভাময়ী ধবলপ্রস্তরনির্‍মিতপ্রায় প্রতিমা পানে চাহিয়া রহিল–কি সুন্দর! বুড়ী বয়োদোষে একটু চোখে খাট, তত পরিষ্কার দেখিতে পায় না–তাহা না হইলে দেখিতে পাইত যে, এ ত প্রস্তরের বর্ণ নহে; নির্‍জীবের এমন সুন্দর বর্ণ হয় না। পাথর দূরে থাকুক, কুসুমেও এ চারুবর্‍ণ পাওয়া যায় না। দেখিতে দেখিতে বৃদ্ধা দেখিল যে, প্রতিমা মৃদু মৃদু হাসিতেছে। পুতুল কি হাসে! বুড়ী তখন মনে মনে ভাবিতে লাগিল, এ বুঝি পুতুল নয়–ঐ অতিদীর্‍ঘ কৃষ্ণতার, চঞ্চল, সজল, বৃহচ্চক্ষুর্‍দ্বয় তাহার দিকে চাহিয়া হাসিতেছে।
বুড়ী অবাক হইল–এর ওর তার মুখপানে চাহিতে লাগিল–কিছু ভাবিয়া ঠিক পাইল না। বিকলচিত্তে রসিকা রমণীমণ্ডলীর মুখপানে চাহিয়া বৃদ্ধা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “হাঁ গা, তোমরা বল না গা?”
এক সুন্দরী হাসি রাখিতে পারিল না–রসের উৎস উছলিয়া উঠিল–হাসির ফোয়ারার মুখ আপনি ছুটিয়া গেল–যুবতী হাসিতে হাসিতে লুটাইয়া পড়িল। সে হাসি দেখিয়া বিস্ময়বিহ্বলা বৃদ্ধা কাঁদিয়া ফেলিল।
তখন সেই প্রতিমা কথা কহিল। অতি মধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “আয়ি, কাঁদিস কেন গো?”
তখন বুড়ী বুঝিল যে, এটা গড়া পুতুল নহে। আদত মানুষ–রাজমহিষী বা রাজকুমারী হইবে। বুড়ী তখন সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিল। এ প্রণাম রাজকুলকে নহে–এ প্রণাম সৌন্দর্‍যকে। বুড়ী যে সৌন্দর্‍য দেখিল, তাহা দেখিয়া প্রণত হইতে হয়।

অধ্যায় ১ / ৬৫

সকল অধ্যায়

১. রাজসিংহ – ১.১
২. রাজসিংহ – ১.২
৩. রাজসিংহ – ১.৩
৪. রাজসিংহ – ১.৪
৫. রাজসিংহ – ১.৫
৬. রাজসিংহ – ২.১
৭. রাজসিংহ – ২.২
৮. রাজসিংহ – ২.৩
৯. রাজসিংহ – ২.৪
১০. রাজসিংহ – ২.৫
১১. রাজসিংহ – ২.৬
১২. রাজসিংহ – ২.৭
১৩. রাজসিংহ – ৩.০১
১৪. রাজসিংহ – ৩.০২
১৫. রাজসিংহ – ৩.০৩
১৬. রাজসিংহ – ৩.০৪
১৭. রাজসিংহ – ৩.০৫
১৮. রাজসিংহ – ৩.০৬
১৯. রাজসিংহ – ৩.০৭
২০. রাজসিংহ – ৩.০৮
২১. রাজসিংহ – ৩.০৯
২২. রাজসিংহ – ৩.১০
২৩. রাজসিংহ – ৪.১
২৪. রাজসিংহ – ৪.২
২৫. রাজসিংহ – ৪.৩
২৬. রাজসিংহ – ৪.৪
২৭. রাজসিংহ – ৪.৫
২৮. রাজসিংহ – ৪.৬
২৯. রাজসিংহ – ৪.৭
৩০. রাজসিংহ – ৫.১
৩১. রাজসিংহ – ৫.২
৩২. রাজসিংহ – ৫.৩
৩৩. রাজসিংহ – ৫.৪
৩৪. রাজসিংহ – ৫.৫
৩৫. রাজসিংহ – ৫.৬
৩৬. রাজসিংহ – ৬.১
৩৭. রাজসিংহ – ৬.২
৩৮. রাজসিংহ – ৬.৩
৩৯. রাজসিংহ – ৬.৪
৪০. রাজসিংহ – ৬.৫
৪১. রাজসিংহ – ৬.৬
৪২. রাজসিংহ – ৬.৭
৪৩. রাজসিংহ – ৬.৮
৪৪. রাজসিংহ – ৬.৯
৪৫. রাজসিংহ – ৭.১
৪৬. রাজসিংহ – ৭.২
৪৭. রাজসিংহ – ৭.৩
৪৮. রাজসিংহ – ৭.৪
৪৯. রাজসিংহ – ৮.০১
৫০. রাজসিংহ – ৮.০২
৫১. রাজসিংহ – ৮.০৩
৫২. রাজসিংহ – ৮.০৪
৫৩. রাজসিংহ – ৮.০৫
৫৪. রাজসিংহ – ৮.০৬
৫৫. রাজসিংহ – ৮.০৭
৫৬. রাজসিংহ – ৮.০৮
৫৭. রাজসিংহ – ৮.০৯
৫৮. রাজসিংহ – ৮.১০
৫৯. রাজসিংহ – ৮.১১
৬০. রাজসিংহ – ৮.১২
৬১. রাজসিংহ – ৮.১৩
৬২. রাজসিংহ – ৮.১৪
৬৩. রাজসিংহ – ৮.১৫
৬৪. রাজসিংহ – ৮.১৬
৬৫. রাজসিংহ – ৮.১৭ (শেষ)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন