রাজসিংহ – ৫.২

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : রাজসিংহের পরাভব

রাজসিংহ উদয়পুরে আসিলেন বলিয়াছি। চঞ্চলকুমারীর উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ, এজন্য চঞ্চলকুমারীকেও উদয়পুরে লইয়া আসিয়া রাজাবরোধে সংস্থাপিত করিলেন। কিন্তু তাঁহাকে উদয়পুরে রাখিবেন, কি রূপনগরে তাঁহার পিতার নিকট পাঠাইয়া দিবেন, ইহার মীমাংসা তাঁহার পক্ষে কঠিন হইল। তিনি যত দিন ইহার সুমীমাংসা করিতে না পারিলেন, ততদিন চঞ্চলকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন না।
এ দিকে চঞ্চলকুমারী রাজার ভাবগতিক দেখিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলেন। ভাবিলেন, “রাজা যে আমাকে বিবাহ করিয়া গ্রহণ করিবেন, এমন ত ভাবগতিক কিছুই দেখিতেছি না। যদি না করেন, তবে কেন আমি উঁহার অন্ত:পুরে বাস করিব? যাবই বা কোথায়?”
রাজসিংহ কিছু মীমাংসা করিতে না পারিয়া, কতিপয় দিন পরে, চঞ্চলকুমারীর মনের ভাব জানিবার জন্য তাঁহার কাছে গিয়া উপস্থিত হইলেন। যাইবার সময়ে, যে পত্রখানি চঞ্চলকুমারী অনন্ত মিশ্রের হাতে পাঠাইয়াছিলেন, যাহা রাজসিংহ মাণিকলালের নিকট পাইয়াছিলেন, তাহা লইয়া গেলেন।
রাণা আসন গ্রহণ করিলে, চঞ্চলকুমারী তাঁহাকে প্রণাম করিয়া, সলজ্জ এবং বিনীতভাবে এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিলেন। লোকমনোমহিনী মূর্‍তি দেখিয়া রাজা একটু মুগ্ধ হইলেন। কিন্তু তখনই মোহ পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “রাজকুমারি! এক্ষণে তোমার কি অভিপ্রায়, তাহা জানিবার জন্য আমি আসিয়াছি। তোমার পিত্রালয়ে যাইবার অভিলাষ, না এইখানে থাকিতেই প্রবৃত্তি?”
শুনিয়া চঞ্চলকুমারীর হৃদয় যেন ভাঙ্গিয়া গেল। তিনি কথা কহিতে পারিলেন না–নীরবে রহিলেন।
তখন রাণা চঞ্চলকুমারীর পত্রখানি বাহির করিয়া চঞ্চলকুমারীকে দেখাইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ তোমার পত্র বটে?”
চঞ্চল বলিল, “আজ্ঞা হাঁ |”
রাণা। কিন্তু সবটুকু এক হাতের লেখা নহে। দুই হাতের লেখা দেখিতেছি। তোমার নিজের হাতের কোন অংশ আছে কি?
চ। প্রথম ভাগটা আমার হাতের লেখা।
রাণা। তবে শেষ ভাগটা অন্যের লেখা?
পাঠকের স্মরণ থাকিবে যে, এই শেষ অংশেই বিবাহের প্রস্তাবটা ছিল। চঞ্চলকুমারী উত্তর করিলেন, “আমার হাতের নহে |”
রাজসিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিন্তু তোমার সম্মতিক্রমেই ইহা লিখিত হইয়াছিল?”
প্রশ্নটা অতি নির্‍দয়। কিন্তু চঞ্চলকুমারী আপনার উন্নত স্বভাবের উপযুক্ত উত্তর করিলেন। বলিলেন, “মহারাজ! ক্ষত্রিয় রাজগণ বিবাহার্থেই কন্যাহরণ করিতে পারেন। অন্য কোন কারণে কন্যাহরণ মহাপাপ। মহাপাপ করিতে আপনাকে অনুরোধ করিব কি প্রকারে?”
রাণা। আমি তোমাকে হরণ করি নাই। তোমার জাতিকুল রক্ষার্থ তোমাকে মুসলমানের হাত হইতে উদ্ধার করিয়াছি। এক্ষণে তোমাকে তোমার পিতার নিকট প্রতিপ্রেরণ করাই রাজধর্‍ম।
চঞ্চলকুমারী কয়টা কথা কহিয়া যুবতীসুলভ লজ্জাকে বশে আনিয়াছিল। এক্ষণে মুখ তুলিয়া, রাজসিংহের প্রতি চাহিয়া বলিল, “মহারাজ! আপনার রাজধর্‍ম আপনি জানেন। আমার ধর্‍মও আমি জানি। আমি জানি যে, যখন আমি আপনার চরণে আত্মসমর্পণ করিয়াছি, তখন আমি ধর্‍মত: আপনার মহিষী। আপনি গ্রহণ করুন বা না করুন, ধর্‍মত: আমি আর কাহাকেও বরণ করিতে পারিব না। যখন ধর্‍মত: আপনি আমার স্বামী, তখন আপনার আজ্ঞা মাত্র শিরোধার্‍য। আপনি যদি আমাকে রূপনগরে ফিরিয়া যাইতে বলেন, তবে অবশ্য আমি যাইব। সেখানে গেলে পিতা আমাকে পুনর্‍বার বাদশাহের নিকট পাঠাইতে বাধ্য হইবেন। কেন না, আমাকে রক্ষা করিবার তাঁহার সাধ্য নাই। যদি তাহাই অভিপ্রেত, তাহা হইলে রণক্ষেত্রে যখন আমি বলিয়াছিলাম যে, ‘মহারাজ! আমি দিল্লী যাইব’–তখন কেন যাইতে দিলেন না?”
রাজসিংহ। সে আমার আপনার প্রাণরক্ষার্থ।
চ। তার পর এখন, যে আপনার শরণ হইয়াছে, তাহাকে আবার দিল্লী যাইতে দিবেন কি?
রা। তাও হইতে পারে না। তবে, তুমি এইখানেই থাক।
চ। অতিথিস্বরূপ থাকিব? না দাসী হইয়া? রূপনগরের রাজকন্যা এখানে মহিষী ভিন্ন আর কিছু হইতে পারে না।
রা। তোমার মত লোকমনোমোহিনী সুন্দরী যে রাজার মহিষী, সকলেই তাঁহাকে ভাগ্যবান বলিবে। তুমি এমন অদ্বিতীয়া রূপবতী বলিয়াই তোমাকে মহিষী করিতে আমি সঙ্কুচিত হইতেছি। শুনিয়াছি যে, শাস্ত্রে আছে, রূপবতী ভার্‍যা শত্রুস্বরূপ–
“ঋণকার পিতা শত্রুর্মাতা চ ব্যভিচারিণী।
ভার্‍যা রূপবতী শত্রু: পুত্র: শত্রুরপণ্ডিত: ||”
চঞ্চলকুমারী একটু হাসিয়া বলিল, “বালিকার বাচালতা মার্‍জনা করিবেন–উদয়পুরের রাজমহিষীগণ সকলেই কি কুরূপা?”
রাজসিংহ বলিলেন, “তোমার মত কেহই সুরূপা নহে |”
চঞ্চলকুমারী বলিল, “আমার বিনীত নিবেদন, কথাটা মহিষীদিগের কাছে বলিবেন না। মহারাণা রাজসিংহেরও ভয়ের স্থান থাকিতে পারে |”
রাজসিংহ উচ্চহাস্য করিলেন। চঞ্চলকুমারী এতক্ষণ দাঁড়াইয়া ছিল–এখন চাপিয়া বসিল, মনে মনে বলিল, “আর ইনি আমার কাছে মহারাণা নহেন, ইনি এখন আমার বর |”
আসন গ্রহণ করিয়া চঞ্চলকুমারী বলিল, “মহারাজ! বিনা আজ্ঞায় আমি যে মহারাজের সম্মুখে আসন গ্রহণ করিলাম, সে অপরাধ আপনাকে মার্‍জনা করিতে হইতেছে–কেন না, আমি আপনার নিকট জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষায় বসিলাম–শিষ্যের আসনে অধিকার আছে। মহারাজ! রূপবতী ভার্‍যা শত্রু কি প্রকারে, তাহা আমি এখনও বুঝিতে পারি নাই |”
রাজসিংহ। তাহা সহজে বুঝান যায়। ভার্‍যা রূপবতী হইলে, তাহার জন্য বিবাদ বিসংবাদ উপস্থিত হয়। এই দেখ, তুমি এখনও আমার ভার্‍যা হও নাই, তথাপি তোমার জন্য ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে আমার বিবাদ বাধিয়াছে। আমাদের বংশের মহারাণী পদ্মিনীর কথা শুনিয়াছ ত?
চ। ঋষিবাক্যে আমার বড় শ্রদ্ধা হইল না। সুন্দরী মহিষী না থাকিলে রাজারা কি বিবাদ হইতে মুক্তি পান? আর এ পামরীর জন্য মহারাজ কেন এ কথা তুলেন? আমি সুরূপা হই, কুরূপা হই, আমার জন্য যে বিবাদ বাধিবার, তাহা ত বাধিয়াছে।
রাজসিংহ। আরও কথা আছে। রূপবতী ভার্‍যা তে পুরুষ অত্যন্ত আসক্ত হয়। ইহা রাজার পক্ষে অত্যন্ত নিন্দনীয়। কেন না, তাহাতে রাজকার্‍যের ব্যাঘাত ঘটে।
চ। রাজারা বহুশত মহিষী কর্‍তৃক পরিবৃত থাকিয়াও রাজকার্‍যে অমনোযোগী হয়েন না। আমার ন্যায় বালিকার প্রণয়ে মহারাণা রাজসিংহের রাজকার্‍যে বিরাগ জন্মিবে, ইহা অতি অশ্রদ্ধার কথা।
রাজসিংহ। কথা তত অশ্রদ্ধেয় নহে। শাস্ত্রে বলে, “বৃদ্ধস্য তরুণী বিষম্ |”
চ। মহারাজ কি বৃদ্ধ?
র। যুবা নহি।
চ। যাহার বাহুতে বল আছে, রাজপুতকন্যার কাছে সেই যুবা। দুর্‍বল যুবাকে রাজপুতকন্যাগণ বৃদ্ধের মধ্যে গণ্য করেন।
রা। আমি সেরূপ নহি।
চ। কীর্‍তিই রাজাদিগের রূপ।
র। রূপবান, বলবান, যুবা রাজপুত্রের অভাব নাই।
চ। আমি আপনাকে আত্মসমর্পণ করিয়াছি। অন্যের পত্নী হইলে দ্বিচারিণী হইব। আমি অত্যন্ত নির্লজ্জের মত কথা বলিতেছি। কিন্তু মনে করিয়া দেখিবেন, দুষ্মন্ত কর্‍তৃক পরিত্যক্ত হইলে, শকুন্তলা লজ্জা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। আমারও আজ প্রায় সেই দশা। আপনি আমায় পরিত্যাগ করিলে আমি রাজসমন্দরে সরোবরে ডুবিয়া মরিব।3
রাজসিংহ বাক্‍যুদ্ধে এইরূপ পরাভব প্রাপ্ত হইয়া বলিলেন, “তুমিই আমার উপযুক্ত মহিষী। তবে তুমি কেবল বিপদে পড়িয়া আমাকে পতিত্বে বরণ করিয়াছিলে; এক্ষণে আমার হাত হইতে উদ্ধারের ইচ্ছা রাখ কি না, আমার এই বয়সে তুমি আমাতে অনুরাগিণী হইতে পারিবে কি না, আমার মনে এই সকল সংশয় ছিল। সে সকল সংশয় আজিকার কথাবার্‍তায় দূর হইয়াছে। তুমি আমার মহিষী হইবে। তবে একটা কথার অপেক্ষা করিতে চাই। তোমার পিতার ক্ষুদ্র রাজ্য এবং তাঁহার সৈন্য অল্প, কিন্তু বিক্রম সোলাঙ্কি যে একজন বীরপুরুষ এবং উপযুক্ত সেনানায়ক, ইহা প্রসিদ্ধ। মোগলের সঙ্গে আমার যুদ্ধ বাধিবেই বাধিবে। বাধিলে, তাঁহার সাহায্য আমার পক্ষে বিশেষ মঙ্গলজনক হইবে। তাঁহার অনুমতি লইয়া বিবাহ না করিলে তিনি কখনও আমার সহায় হইবেন না। বরং তাঁর অমতে বিবাহ করিলে তিনি মোগলের সহায় এবং আমার শত্রু হইতে পারেন। তাহা বাঞ্ছনীয় নহে, অতএব আমার ইচ্ছা, তাঁহাকে পত্র লিখিয়া, তাঁহার সম্মতি আনাইয়া তোমাকে বিবাহ করি। তিনি সম্মত হইবেন কি?”
চ। না হইবার ত কারণ দেখি না। আমার ইচ্ছা, পিতা-মাতার আশীর্‍বাদ লইয়াই আপনার চরণসেবাব্রত গ্রহণ করি। লোক পাঠান আমারও ইচ্ছা।
তখন রাজসিংহ একখানি সবিনয় পত্র লিখিয়া, বিক্রম সোলাঙ্কির নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। চঞ্চলকুমারীও মাতার আশীর্‍বাদ কামনা করিয়া একখানা পত্র লিখিলেন।

3- রাজসিংহের নির্‍মিত।

সকল অধ্যায়

১. রাজসিংহ – ১.১
২. রাজসিংহ – ১.২
৩. রাজসিংহ – ১.৩
৪. রাজসিংহ – ১.৪
৫. রাজসিংহ – ১.৫
৬. রাজসিংহ – ২.১
৭. রাজসিংহ – ২.২
৮. রাজসিংহ – ২.৩
৯. রাজসিংহ – ২.৪
১০. রাজসিংহ – ২.৫
১১. রাজসিংহ – ২.৬
১২. রাজসিংহ – ২.৭
১৩. রাজসিংহ – ৩.০১
১৪. রাজসিংহ – ৩.০২
১৫. রাজসিংহ – ৩.০৩
১৬. রাজসিংহ – ৩.০৪
১৭. রাজসিংহ – ৩.০৫
১৮. রাজসিংহ – ৩.০৬
১৯. রাজসিংহ – ৩.০৭
২০. রাজসিংহ – ৩.০৮
২১. রাজসিংহ – ৩.০৯
২২. রাজসিংহ – ৩.১০
২৩. রাজসিংহ – ৪.১
২৪. রাজসিংহ – ৪.২
২৫. রাজসিংহ – ৪.৩
২৬. রাজসিংহ – ৪.৪
২৭. রাজসিংহ – ৪.৫
২৮. রাজসিংহ – ৪.৬
২৯. রাজসিংহ – ৪.৭
৩০. রাজসিংহ – ৫.১
৩১. রাজসিংহ – ৫.২
৩২. রাজসিংহ – ৫.৩
৩৩. রাজসিংহ – ৫.৪
৩৪. রাজসিংহ – ৫.৫
৩৫. রাজসিংহ – ৫.৬
৩৬. রাজসিংহ – ৬.১
৩৭. রাজসিংহ – ৬.২
৩৮. রাজসিংহ – ৬.৩
৩৯. রাজসিংহ – ৬.৪
৪০. রাজসিংহ – ৬.৫
৪১. রাজসিংহ – ৬.৬
৪২. রাজসিংহ – ৬.৭
৪৩. রাজসিংহ – ৬.৮
৪৪. রাজসিংহ – ৬.৯
৪৫. রাজসিংহ – ৭.১
৪৬. রাজসিংহ – ৭.২
৪৭. রাজসিংহ – ৭.৩
৪৮. রাজসিংহ – ৭.৪
৪৯. রাজসিংহ – ৮.০১
৫০. রাজসিংহ – ৮.০২
৫১. রাজসিংহ – ৮.০৩
৫২. রাজসিংহ – ৮.০৪
৫৩. রাজসিংহ – ৮.০৫
৫৪. রাজসিংহ – ৮.০৬
৫৫. রাজসিংহ – ৮.০৭
৫৬. রাজসিংহ – ৮.০৮
৫৭. রাজসিংহ – ৮.০৯
৫৮. রাজসিংহ – ৮.১০
৫৯. রাজসিংহ – ৮.১১
৬০. রাজসিংহ – ৮.১২
৬১. রাজসিংহ – ৮.১৩
৬২. রাজসিংহ – ৮.১৪
৬৩. রাজসিংহ – ৮.১৫
৬৪. রাজসিংহ – ৮.১৬
৬৫. রাজসিংহ – ৮.১৭ (শেষ)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন