রাজসিংহ – ৮.১৩

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মবারকের দহানারম্ভ

সৌন্দর্‍যের কি মহিমা! মবারক জেব-উন্নিসাকে দেখিয়া আবার সব ভুলিয়া গেল। গর্‍বিতা, স্নেহাভাবদর্পে প্রফুল্লা জেব-উন্নিসাকে দেখিলে আর তেমন হইত কি না, বলা যায় না, কিন্তু সেই জেব-উন্নিসা এখন বিনীতা, দর্পশূন্যা, স্নেহশালিনী, অশ্রুময়ী। মবারকের পূর্‍বানুরাগ সম্পূর্‍ণরূপে ফিরিয়া আসিল। দরিয়া, দরিয়ায় ভাসিয়া গেল। মনুষ্য স্ত্রীজাতির প্রেমে অন্ধ হইলে, তাহার হিতাহিত ধর্‍মেধর্‍ম জ্ঞান থাকে না। তাহার মত বিশ্বাসঘাতক, পাপিষ্ঠ আর নাই।
সহস্র দীপের রশ্মি-প্রতিবিম্ব-সমন্বিত, উদয়সাগরের অন্ধকার জলের চতু:পার্শ্বে পর্‍বতমালা নিরীক্ষণ করিতে করিতে, পটমণ্ডপের দুর্গমধ্যে ইন্দ্রভুবন তুল্য কক্ষে বসিয়া মবারক জেব-উন্নিসার হাত, আপন হাতের ভিতর তুলিয়া লইল। মবারক বড় দু:খের সহিত বলিল, “তোমাকে আবার পাইয়াছি, কিন্তু দু:খ এই যে, এই সুখ দশ দিন ভোগ করিতে পারিলাম না |”
জেব-উন্নিসা। কেন? কে বাধা দিবে? বাদশাহ?
মবারক। সে সন্দেহও আছে। কিন্তু বাদশাহের কথা এখন বলিতেছি না। আমি কাল যুদ্ধে যাইব। যুদ্ধে মরণ জীবন দুই আছে। কিন্তু আমার পক্ষে মরণ নিশ্চয় আমি রাজপুতদিগের যুদ্ধের যে সুবন্দোবস্ত দেখিয়াছি, তাহাতে আমি নিশ্চিত জানি যে, পার্‍বত্য যুদ্ধে আমরা তাহাদিগকে পরাভব করিতে পারিব না। আমি একবার হারিয়া আসিয়াছি, আর একবার হারিয়া আসিতে পারিব না। আমাকে যুদ্ধে মরিতে হইবে।
জেব-উন্নিসা সজল নয়নে বলিল, “ঈশ্বর অবশ্য করিবেন যে, তুমি যুদ্ধে জয়ী হইয়া আসিবে। তুমি আমার কাছে না আসিলে আমি মরিব |”
উভয়ে চক্ষুর জল ফেলিল। তখন মবারক ভাবিল, “মরিব, না মরিব না?” অনেক ভাবিল। সম্মুখে সেই নক্ষত্রখচিতগগনস্পর্‍শী পর্‍বতমালাপরিবেষ্টিত অন্ধকার উদয়সাগরের জল–তাহাতে দীপমালাপ্রভাসিত পট-নির্‍মিতা মহানগরীর মনোমোহিনী ছায়া–দূরে পর্‍বতের চূড়ার উপর চূড়া–তার উপর চূড়া–বড় অন্ধকার। দুই জনে বড় অন্ধকারই দেখিল।
সহসা জেব-উন্নিসা বলিল, “এই অন্ধকারে, শিবিরের প্রাচীরের তলায়, কে লুকাইল? তোমার জন্য আমার মন সর্‍বদা সশঙ্কিত |”
“দেখিয়া আসি” বলিয়া মবারক ছুটিয়া দুর্‍গপ্রাকারতলে গেলেন। দেখিলেন, একজন যথার্থই লুকাইয়া শুইয়া আছে বটে। মবারক তাহাকে ধৃত করিলেন। হাত ধরিয়া তুলিলেন। যে লুকাইয়াছিল, সে দাঁড়াইয়া উঠিল। অন্ধকারে মবারক কিছু ঠাওর পাইলেন না। তাহাকে টানিয়া দুর্‍গমধ্যে দীপালোকের নিকট আনিলেন। দেখিলেন যে, একটা স্ত্রীলোক। সে মুখে কাপড় দিয়া মুখ ঢাকিয়া রহিল–মুখ খুলিল না। মবারক তাহাকে কক্ষমধ্যে লইয়া আসিলেন।
জেব-উন্নিসা বলিল, “তুমি কে? কেন লুকাইয়াছিলে? মুখের কাপড় খোল |”
সে স্ত্রীলোক তখন মুখের কাপড় খুলিল। দুই জনে সবিস্ময়ে দেখিল–দরিয়া বিবি!
বড় সুখের সময়ে, সহসা বিনা মেঘে সম্মুখে বজ্রপতন দেখিলে যেমন বিহ্বল হইতে হয়, জেব-উন্নিসা ও মবারক সেইরূপ হইল। তিন জনের কেহ কোন কথা কহিল না।
অনেক্ষণ পরে দীর্‍ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া মবারক বলিল, “ইয়া আল্লা! আমাকে মরিতেই হইবে |”
জেব-উন্নিসা তখন অতি কাতরকণ্ঠে বলিল, “তবে আমাকেও |”
দরিয়া বলিল, “তোমরা কে?”
মবারক তাহাকে বলিল, “আমার সঙ্গে আইস |”
তখন মবারক অতি দীনভাবে জেব-উন্নিসার নিকট বিদায় লইল।

সকল অধ্যায়

১. রাজসিংহ – ১.১
২. রাজসিংহ – ১.২
৩. রাজসিংহ – ১.৩
৪. রাজসিংহ – ১.৪
৫. রাজসিংহ – ১.৫
৬. রাজসিংহ – ২.১
৭. রাজসিংহ – ২.২
৮. রাজসিংহ – ২.৩
৯. রাজসিংহ – ২.৪
১০. রাজসিংহ – ২.৫
১১. রাজসিংহ – ২.৬
১২. রাজসিংহ – ২.৭
১৩. রাজসিংহ – ৩.০১
১৪. রাজসিংহ – ৩.০২
১৫. রাজসিংহ – ৩.০৩
১৬. রাজসিংহ – ৩.০৪
১৭. রাজসিংহ – ৩.০৫
১৮. রাজসিংহ – ৩.০৬
১৯. রাজসিংহ – ৩.০৭
২০. রাজসিংহ – ৩.০৮
২১. রাজসিংহ – ৩.০৯
২২. রাজসিংহ – ৩.১০
২৩. রাজসিংহ – ৪.১
২৪. রাজসিংহ – ৪.২
২৫. রাজসিংহ – ৪.৩
২৬. রাজসিংহ – ৪.৪
২৭. রাজসিংহ – ৪.৫
২৮. রাজসিংহ – ৪.৬
২৯. রাজসিংহ – ৪.৭
৩০. রাজসিংহ – ৫.১
৩১. রাজসিংহ – ৫.২
৩২. রাজসিংহ – ৫.৩
৩৩. রাজসিংহ – ৫.৪
৩৪. রাজসিংহ – ৫.৫
৩৫. রাজসিংহ – ৫.৬
৩৬. রাজসিংহ – ৬.১
৩৭. রাজসিংহ – ৬.২
৩৮. রাজসিংহ – ৬.৩
৩৯. রাজসিংহ – ৬.৪
৪০. রাজসিংহ – ৬.৫
৪১. রাজসিংহ – ৬.৬
৪২. রাজসিংহ – ৬.৭
৪৩. রাজসিংহ – ৬.৮
৪৪. রাজসিংহ – ৬.৯
৪৫. রাজসিংহ – ৭.১
৪৬. রাজসিংহ – ৭.২
৪৭. রাজসিংহ – ৭.৩
৪৮. রাজসিংহ – ৭.৪
৪৯. রাজসিংহ – ৮.০১
৫০. রাজসিংহ – ৮.০২
৫১. রাজসিংহ – ৮.০৩
৫২. রাজসিংহ – ৮.০৪
৫৩. রাজসিংহ – ৮.০৫
৫৪. রাজসিংহ – ৮.০৬
৫৫. রাজসিংহ – ৮.০৭
৫৬. রাজসিংহ – ৮.০৮
৫৭. রাজসিংহ – ৮.০৯
৫৮. রাজসিংহ – ৮.১০
৫৯. রাজসিংহ – ৮.১১
৬০. রাজসিংহ – ৮.১২
৬১. রাজসিংহ – ৮.১৩
৬২. রাজসিংহ – ৮.১৪
৬৩. রাজসিংহ – ৮.১৫
৬৪. রাজসিংহ – ৮.১৬
৬৫. রাজসিংহ – ৮.১৭ (শেষ)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন