রাজসিংহ – ৩.০৩

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : মিশ্র ঠাকুরের নারায়ণস্মরণ

পরিধেয় বস্ত্র, ছত্র, যষ্টি, চন্দনকাষ্ঠ প্রভৃতি নিতান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং একমাত্র ভৃত্য সঙ্গে লইয়া, অনন্ত মিশ্র গৃহিণীর নিকট হইতে বিদায় লইয়া উদয়পুর যাত্রা করিলেন। গৃহিণী বড় পীড়াপীড়ি করিয়া ধরিল, “কেন যাইবে?” মিশ্র ঠাকুর বলিলেন, “রাণার কাছে কিছু বৃত্তি পাইব |” গৃহিণী তৎক্ষণাৎ শান্ত হইলেন; বিরহযন্ত্রণা আর তাঁহাকে দাহ করিতে পারিল না, অর্থলোভের আশাস্বরূপ শীতলবারি-প্রবাহে সে প্রচণ্ড বিচ্ছেদবহ্নি বার কত ফোঁস ফোঁস করিয়া নিবিয়া গেল। মিশ্র ঠাকুর ভৃত্য সঙ্গে যাত্রা করিলেন। তিনি মনে করিলে অনেক লোক সঙ্গে লইতে পারিতেন, কিন্তু অধিক লোক থাকিলে কাণাকাণি হয়, এজন্য লইলেন না।
পথ অতি দুর্গম–বিশেষ পার্ব ত্য পথ বন্ধুর, এবং অনেক স্থানে আশ্রয়শূন্য। একাহারী ব্রাহ্মণ যে দিন যেখানে আশ্রয় পাইতেন, সে দিন সেখানে আতিথ্য স্বীকার করিতেন; দিনমানে পথ অতিবাহন করিতেন। পথে কিছু দস্যুভয় ছিল–ব্রাহ্মণের নিকট রত্নবলয় আছে বলিয়া ব্রাহ্মণ কদাপি একাকী পথ চলিতেন না। সঙ্গী জুটিলে চলিতেন। সঙ্গী ছাড়া হইলেই আশ্রয় খুঁজিতেন। একদিন রাত্রে এক দেবালয়ে আতিথ্য স্বীকার করিয়া, পরদিন প্রভাতে গমনকালে, তাঁহাকে সঙ্গী খুঁজিতে হইল না। চারি জন বণিক ঐ দেবালয়ের অতিথিশালায় শয়ন করিয়াছিল, প্রভাতে উঠিয়া তাহারাও পার্বাত্যপথে আরোহণ করিল। ব্রাহ্মণকে দেখিয়া উহারা জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কোথা যাইবে?” ব্রাহ্মণ বলিলেন, “আমি উদয়পুর যাইব |” বণিকেরা বলিল, “আমরাও উদয়পুর যাইব। ভাল হইয়াছে, একত্রে যাই চলুন |” ব্রাহ্মণ আনন্দিত হইয়া তাহাদিগের সঙ্গী হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “উদয়পুর আর কত দূর?” বণিকেরা বলিল, “নিকট। আজ সন্ধ্যার মধ্যে উদয়পুর পৌঁছিতে পারিব। এ সকল স্থান রাণার রাজ্য |”
এইরূপ, কথোপকথন করিতে করিতে তাহারা চলিতেছিল। পার্ব|ত্য পথ, অতিশয় দুরারোহণীয় এবং দুরবরোহণীয়, সচরাচর বসতিশূন্য। কিন্তু এই দুর্গম পথ প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল–এখন সমতল ভূমিতে অবরোহণ করিতে হইবে। পথিকেরা এক অনির্বগচনীয় শোভাময় অধিত্যকায় প্রবেশ করিল। দুই পার্শ্বে অনতি-উচ্চ পার্ব্ত্যদ্বয়, হরিত-বৃক্ষাদিশোভিত হইয়া আকাশে মাথা তুলিয়াছে, উভয়ের মধ্যে কলনাদিনী ক্ষুদ্রা প্রবাহিণী নীলকাচপ্রতিম সফেন জলপ্রবাহে উপলদল ধৌত করিয়া বনানীর অভিমুখে চলিতেছে। তটিনীর ধার দিয়া মনুষ্যগম্য পথের রেখা পড়িয়াছে। সেখানে নামিলে, আর কোন দিক্ হইতে কেহ পথিককে দেখিতে পায় না; কেবল পার্বনত্যদ্বয়ের উপর হইতে দেখা যায়।
সেই নিভৃত স্থানে অবরোহণ করিয়া, একজন বণিক ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার ঠাঁই টাকা-কড়ি কি আছে?”
ব্রাহ্মণ প্রশ্ন শুনিয়া চমকিত ও ভীত হইলেন। ভাবিলেন, বুঝি এখানে দস্যুর বিশেষ ভয়, তাই সতর্ক করিবার জন্য বণিকেরা জিজ্ঞাসা করিতেছে। দুর্বালের অবলম্বন মিথ্যা কথা। ব্রাহ্মণ বলিলেন, “আমি ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ, আমার কাছে কি থাকিবে?”
বণিক বলিল, “যাহা কিছু থাকে, আমাদের নিকট দাও। নহিলে এখানে রাখিতে পারিবে না |”
ব্রাহ্মণ ইতস্তত: করিতে লাগিলেন। একবার মনে করিলেন, রত্নবলয় রক্ষার্থ বণিকদি”গকে দিই; আবার ভাবিলেন, ইহারা অপরিচিত, ইহাদিগেই বা বিশ্বাস কি? এই ভাবিয়া ইতস্তত: করিয়া ব্রাহ্মণ পূর্ব বৎ বলিলেন, “আমি ভিক্ষুক, আমার কাছে কি থাকিবে?”
বিপৎকালে যে ইতস্তত: করে সেই মারা যায়। ব্রাহ্মণকে ইতস্তত: করিতে দেখিয়া ছদ্মবেশী বণিকেরা বুঝিল যে, অবশ্য ব্রাহ্মণের কাছে কিছু আছে। একজন তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণের ঘাড় ধরিয়া ফেলিয়া দিয়া তাঁহার বুকে হাঁটু দিয়া বসিল–এবং তাঁহার মুখে হাত দিয়া চাপিয়া ধরিল। মিশ্র ঠাকুরের ভৃত্যটি তৎক্ষণাৎ কোন্ দিকে পলায়ন করিল, কেহ দেখিতে পাইল না। মিশ্র ঠাকুর বাঙ‍‍নিষ্পত্তি করিতে না পারিয়া নারায়ণ স্মরণ করিতে লাগিলেন। আর একজন, তাঁহার গাঁটরি কাড়িয়া লইয়া খুলিয়া দেখিতে লাগিল। তাহার ভিতর হইতে চঞ্চলকুমারী প্রেরিত বলয়, দুইখানি পত্র, এবং আশরফি পাওয়া গেল। দস্যু তাহা হস্তগত করিয়া সঙ্গীকে বলিল, “আর ব্রহ্মহত্যা করিয়া কাজ নাই। উহার যাহা ছিল, তাহা পাইয়াছি। এখন উহাকে ছাড়িয়া দে |”
আর একজন দস্যু বলিল, “ছাড়িয়া দেওয়া যাইবে না। ব্রাহ্মণ তাহা হইলে এখনই একটা গোলযোগ করিবে। আজকাল রাণা রাজসিংহের বড় দৌরাত্ম্য–তাঁহার শাসনে বীরপুরুষে আর অন্ন করিয়া খাইতে পারে না। উহাকে এই গাছে বাঁধিয়া রাখিয়া যাই |”
এই বলিয়া দস্যুগণ মিশ্র ঠাকুরের হস্ত পদ এবং মুখ তাঁহার পরিধেয় বস্ত্রে দৃঢ়তর বাঁধিয়া, পার্বদতের সানুদেশস্থিত একটি ক্ষুদ্র বৃক্ষের কাণ্ডের সহিত বাঁধিল। পরে চঞ্চলকুমারীদত্ত রত্নবলয় ও পত্র প্রভৃতি লইয়া ক্ষুদ্র নদীর তীরবর্তীক পথ অবলম্বন করিয়া পার্বকতন্তরালে অদৃশ্য হইল। সেই সময়ে পার্বততের উপরে দাঁড়াইয়া একজন অশ্বারোহী তাহাদিগকে দেখিল। তাহারা, অশ্বারোহীকে দেখিতে পাইল না, পলায়নে ব্যস্ত।
দস্যুগণ পার্ব তীয়া প্রবাহিণীর তটবর্তীন বনমধ্যে প্রবেশ করিয়া অতি দুর্গম ও মনুষ্যসমাগমশূন্য পথে চলিল। এইরূপ কিছু দূর গিয়া, এক নিভৃত গুহামধ্যে প্রবেশ করিল।
গুহার ভিতর খাদ্যদ্রব্য, শয্যা, পাকের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সকল প্রস্তুত ছিল। দেখিয়া বোধ হয়, দস্যুগণ কখন কখন এই গুহামধ্যে লুকাইয়া বাস করে। এমন কি, কলসীপূর্ণ জল পর্যরন্ত ছিল। দস্যুগণ সেইখানে উপস্থিত হইয়া তামাকু সাজিয়া খাইতে লাগিল এবং একজন পাকের উদ্যোগ করিতে লাগিল। একজন বলিল, “মাণিকলাল, রসুই পরে হইবে। প্রথমে মালের কি ব্যবস্থা হইবে, তাহার মীমাংসা করা যাউক |”
মাণিকলাল বলিল, “মালের কথাই আগে হউক |”
তখন আশরফি কয়টি কাটিয়া চারি ভাগ করিল। এক এক জন এক এক ভাগ লইল। রত্নবলয় বিক্রয় না হইলে ভাগ হইতে পারে না–তাহা সম্প্রতি অবিভক্ত রহিল। পত্র দুইখানি কি করা যাইবে, তাহার মীমাংসা হইতে লাগিল। দলপতি বলিলেন, “কাগজে আর কি হইবে–উহা পোড়াইয়া ফেল |” এই বলিয়া পত্র দুইখানি সে মাণিকলালকে অগ্নিদেবকে সমর্পণ করিবার জন্য দিল।
মাণিকলাল কিছু কিছু লিখিতে পড়িতে জানিত। সে পত্র দুইখানি আদ্যোপান্ত পড়িয়া আনন্দিত হইল। বলিল, “এ পত্র নষ্ট করা হইবে না। ইহাতে রোজগার হইতে পারে |”
“কি? কি?” বলিয়া আর তিন জন গোলযোগ করিয়া উঠিল। মাণিকলাল তখন চঞ্চলকুমারীর পত্রের বৃত্তান্ত তাহাদিগকে সবিস্তারে বুঝাইয়া দিল। শুনিয়া চৌরেরা বড় আনন্দিত হইল।
মাণিকলাল বলিল, “দেখ, এই পত্র রাণাকে দিলে কিছু পুরস্কার পাইব |”
দলপতি বলিল, “নির্বোখধ! রাণা যখন জিজ্ঞাসা করিবে, তোমরা এ পত্র কোথায় পাইলে, তখন কি উত্তর দিবে? তখন কি বলিবে যে, আমরা রাহাজানি করিয়া পাইয়াছি? রাণার কাছে পুরস্কারের মধ্যে প্রাণদণ্ড হইবে। তাহা নহে–এ পত্র লইয়া গিয়া বাদশাহকে দিব–বাদশাহের কাছে এরূপ সন্ধান দিতে পারিলে অনেক পুরস্কার পাওয়া যায়, আমি জানি। আর ইহাতে__”
দলপতি কথা সমাপ্ত করিতে অবকাশ পাইল না। কথা মুখে থাকিতে থাকিতে তাহার মস্তক স্কন্ধ হইতে বিচ্যুত হইয়া ভূতলে পড়িল।

সকল অধ্যায়

১. রাজসিংহ – ১.১
২. রাজসিংহ – ১.২
৩. রাজসিংহ – ১.৩
৪. রাজসিংহ – ১.৪
৫. রাজসিংহ – ১.৫
৬. রাজসিংহ – ২.১
৭. রাজসিংহ – ২.২
৮. রাজসিংহ – ২.৩
৯. রাজসিংহ – ২.৪
১০. রাজসিংহ – ২.৫
১১. রাজসিংহ – ২.৬
১২. রাজসিংহ – ২.৭
১৩. রাজসিংহ – ৩.০১
১৪. রাজসিংহ – ৩.০২
১৫. রাজসিংহ – ৩.০৩
১৬. রাজসিংহ – ৩.০৪
১৭. রাজসিংহ – ৩.০৫
১৮. রাজসিংহ – ৩.০৬
১৯. রাজসিংহ – ৩.০৭
২০. রাজসিংহ – ৩.০৮
২১. রাজসিংহ – ৩.০৯
২২. রাজসিংহ – ৩.১০
২৩. রাজসিংহ – ৪.১
২৪. রাজসিংহ – ৪.২
২৫. রাজসিংহ – ৪.৩
২৬. রাজসিংহ – ৪.৪
২৭. রাজসিংহ – ৪.৫
২৮. রাজসিংহ – ৪.৬
২৯. রাজসিংহ – ৪.৭
৩০. রাজসিংহ – ৫.১
৩১. রাজসিংহ – ৫.২
৩২. রাজসিংহ – ৫.৩
৩৩. রাজসিংহ – ৫.৪
৩৪. রাজসিংহ – ৫.৫
৩৫. রাজসিংহ – ৫.৬
৩৬. রাজসিংহ – ৬.১
৩৭. রাজসিংহ – ৬.২
৩৮. রাজসিংহ – ৬.৩
৩৯. রাজসিংহ – ৬.৪
৪০. রাজসিংহ – ৬.৫
৪১. রাজসিংহ – ৬.৬
৪২. রাজসিংহ – ৬.৭
৪৩. রাজসিংহ – ৬.৮
৪৪. রাজসিংহ – ৬.৯
৪৫. রাজসিংহ – ৭.১
৪৬. রাজসিংহ – ৭.২
৪৭. রাজসিংহ – ৭.৩
৪৮. রাজসিংহ – ৭.৪
৪৯. রাজসিংহ – ৮.০১
৫০. রাজসিংহ – ৮.০২
৫১. রাজসিংহ – ৮.০৩
৫২. রাজসিংহ – ৮.০৪
৫৩. রাজসিংহ – ৮.০৫
৫৪. রাজসিংহ – ৮.০৬
৫৫. রাজসিংহ – ৮.০৭
৫৬. রাজসিংহ – ৮.০৮
৫৭. রাজসিংহ – ৮.০৯
৫৮. রাজসিংহ – ৮.১০
৫৯. রাজসিংহ – ৮.১১
৬০. রাজসিংহ – ৮.১২
৬১. রাজসিংহ – ৮.১৩
৬২. রাজসিংহ – ৮.১৪
৬৩. রাজসিংহ – ৮.১৫
৬৪. রাজসিংহ – ৮.১৬
৬৫. রাজসিংহ – ৮.১৭ (শেষ)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন