রাজসিংহ – ৬.৩

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : অগ্নিচয়ন

অপরাহ্নে ঔরঙ্গজেব দরবারে আসীন হইলে, মাণিকলাল সেখানে গিয়া হাজির হইলেন। দিল্লীর বাদশাহের আমখাস অনেক গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে, এখানে তাহার বিস্তারিত বর্ণনা আমার অভিপ্রেত নহে। মাণিকলাল প্রথম সোপানাবলী আরোহণ করিয়া একবার কুর্ণিশ করিলেন। তার পর উঠিতে হইল। একপদ উঠিয়া আবার কুর্ণিশ–আবার একপদ উঠিয়া আবার কুর্ণিশ। এইরূপ তিনবার উঠিয়া তক্তে তাউস সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন। মাণিকলাল অভিবাদন করিয়া রাজসিংহপ্রেরিত সামান্য উপহার বাদশাহের সম্মুখে অর্পিত করিলেন। নজরের অনর্‍ঘতা দেখিয়া ঔরঙ্গজেব রুষ্ট হইলেন, কিন্তু মুখে কিছু বলিলেন না। প্রেরিত দ্রব্যের মধ্যে দুইখানি তরবারি ছিল; একখানি কোষে আবৃত, আর একখানি নিষ্কোষ। ঔরঙ্গজেব নিষ্কোষ অসি গ্রহণ করিয়া আর সব উপহার পরিত্যাগ করিলেন।
মাণিকলাল রাজসিংহের পত্র দিলেন। পত্রার্থ অবগত হইয়া ঔরঙ্গজেব ক্রোধে অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি ক্রুব্ধ হইলে সচরাচর বাহিরে কোপ প্রকাশ করিতেন না। তখন মাণিকলালকে বিশেষ সমাদরের সহিত জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। তাঁহাকে উত্তম বাসস্থান দিবার জন্য বখ‍শীকে আদেশ করিলেন। এবং আগামী কল্য মহারাণার পত্রের উত্তর দিবেন বলিয়া মাণিকলালকে বিদায় করিলেন।
তখনই দরবার বরখাস্ত হইল। দরবার হইতে উঠিয়া আসিয়াই ঔরঙ্গজেব মাণিকলালের বধের আজ্ঞা করিলেন। বধের আজ্ঞা হইল, কিন্তু যাহারা মাণিকলালকে বধ করিবে, তাহারা মাণিকলালকে খুঁজিয়া পাইল না। যাহাদিগের প্রতি মাণিকলালের সমাদরের আদেশ হইয়াছিল, তাহারাও খুঁজিয়া পাইল না। দিল্লীর সর্‍বত্র খুঁজিল কোথাও মাণিকলালকে পাওয়া গেল না। তাহার বধের আজ্ঞা প্রচার হইবার আগেই মাণিকলাল সরিয়া পড়িয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, যখন মাণিকলালের জন্য এত খোঁজ তল্লাস হইতেছিল, তখন সে আপনার পাথরের দোকানে ছদ্মবেশে সওদাগরি করিতেছিল। আহদীরা মাণিকলালকে না পাইয়া, তাঁহার শিবিরে যাহাকে যাহাকে পাইল, তাহাকে তাহাকে ধরিয়া কোতোয়ালের নিকট লইয়া গেল। তাহার মধ্যে নির্‍মলকুমারীকেও ধরিয়া লইয়া গেল।
কোতোয়াল, অপর লোকদিগের কাছে কিছু সন্ধান পাইলেন না। ভয়প্রদর্শন ও মারপিটেও কিছুই হইল না। তাহারা কোন সন্ধান জানে না, কি প্রকারে বলিবে?
কোতোয়াল শেষ নির্‍মলকুমারীকে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন–পরদানশীন বলিয়া তাঁহাকে এতক্ষণ তফাৎ রাখা হইয়াছিল। কোতোয়াল এখন নির্‍মলকুমারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন। সে উত্তর করিল, “রাণার এল্‌‍‍‌চিকে আমি চিনি না |”
কোতোয়াল। তাহার নাম মাণিকলাল সিংহ।
নির্‍মল । মাণিকলাল সিংহকে আমি চিনি না।
কো। তুমি রাণার এল‍চির সঙ্গে উদয়পুর হইতে আস নাই?
নি। উদয়পুর আমি কখন দেখিও নাই।
কো। তবে তুমি কে?
নি। আমি জুনাব যোধপুরী বেগমের হিন্দু বাঁদী।
কো। জুনাব যোধপুরী বেগমের বাঁদীরা মহালের বাহিরে আসে না।
নি। আমিও কখন আসি নাই। এইবার হিন্দু এল‍্‍চি আসিয়াছে শুনিয়া বেগম সাহেবা আমাকে তাহার তাম্বুতে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।
কো। সে কি? কেন?
নি। কিষণজীর চরণামৃতের জন্য; তাহা সকল রাজপুত রাখিয়া থাকে।
কো। তোমাকে ত একা দেখিতেছি। তুমি মহালের বাহিরেই বা আসিলে কি প্রকারে?
নি। ইহার বলে।
এই বলিয়া নির্‍মলকুমারী যোধপুরী বেগমের পাঞ্জা বস্ত্রমধ্য হইতে বাহির করিয়া দেখাইল। দেখিয়া কোতোয়াল তিন সেলাম করিল। নির্‍মলকে বলিল, “তুমি যাও। তোমাকে কেহ আর কিছু বলিবে না |”
নির্‍মল তখন বলিল, “কোতোয়াল সাহেব! আর একটু মেহেরবানি করিতে হইবে। আমি কখন মহালের বাহির হই নাই। আজ বড় ধর-পাকড় দেখিয়া বড় ভয় হইয়াছে। আপনি যদি দয়া করিয়া একটা আহদী, কি পাইক সঙ্গে দেন, যে আমাকে মহাল পর্‍যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া আসে, তাহা হইলে বড় ভাল হয় |”
কোতোয়াল তখনই একজন অস্ত্রাধারী রাজপুরুষকে উপযুক্ত উপদেশ দিয়া নির্‍মলকে বাদশাহের অন্ত:পুরে পাঠাইয়া দিলেন। বাদশাহের প্রধানা মহিষীর পাঞ্জা দেখিয়া খোজারা কেহ কিছু আপত্তি করিল না। নির্‍মলকুমারী একটু চাতুরীর সহিত জিজ্ঞাসাবাদ করিতে করিতে যোধপুরী বেগমের সন্ধান পাইল। তাঁহাকে প্রণাম করিয়া সেই পাঞ্জা দেখাইল। দেখিবামাত্র সতর্ক হইয়া, রাজমহিষী তাহাকে নিভৃতে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। বলিলেন, “তুমি এ পাঞ্জা কোথায় পাইলে?”
নির্‍মলকুমারী বলিল, “আমি সমস্ত কথা সবিস্তার বলিতেছি |”
নির্‍মলকুমারী প্রথমে আপনার পরিচয় দিল। তার পর দেবীর রূপনগরে যাওয়ার কথা, সে যাহা বলিয়াছিল, সে কথা, পাঞ্জা দেওয়ার কথা, তার পর চঞ্চল ও নির্‍মলের যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা বলিল। মাণিকলালের পরিচয় দিল। মাণিকলালের সঙ্গে যে নির্‍মল আসিয়াছিল, চঞ্চলকুমারীর পত্র লইয়া আসিয়াছিল, তাহা বলিল। পরে দিল্লীতে আসিয়া যে প্রকার বিপদে পড়িয়াছিল, তাহা বলিল; যে প্রকারে উদ্ধার পাইয়া, যে কৌশলে মহাল মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা বলিল। পরে চঞ্চলকুমারী উদিপুরীর জন্য যে পত্র দিয়াছিলেন, তাহা দিল। শেষ বলিল, “এই পত্র কি প্রকারে উদিপুরী বেগমের কাছে পৌঁছাইতে পারিব, সেই উপদেশ পাইবার জন্যই আপনার কাছে আসিয়াছি |”
রাজমহিষী বলিলেন, “তাহার কৌশল আছে। জেব-উন্নিসা বেগমের হুকুমের সাপেক্ষ। তাহা যেন চাহিতে গেলে গোলযোগ হইবে। রাত্রে যখন এই পাপিষ্ঠারা শরাব খাইয়া বিহ্বল হইবে, তখন সে উপায় হইবে। এখন তুমি আমার হিন্দু বাঁদীদিগের মধ্যে থাক। হিন্দুর অন্নজল খাইতে পাইবে |”
নির্‍মলকুমারী সম্মত হইলেন। বেগম সেইরূপ আজ্ঞা প্রচার করিলেন।

সকল অধ্যায়

১. রাজসিংহ – ১.১
২. রাজসিংহ – ১.২
৩. রাজসিংহ – ১.৩
৪. রাজসিংহ – ১.৪
৫. রাজসিংহ – ১.৫
৬. রাজসিংহ – ২.১
৭. রাজসিংহ – ২.২
৮. রাজসিংহ – ২.৩
৯. রাজসিংহ – ২.৪
১০. রাজসিংহ – ২.৫
১১. রাজসিংহ – ২.৬
১২. রাজসিংহ – ২.৭
১৩. রাজসিংহ – ৩.০১
১৪. রাজসিংহ – ৩.০২
১৫. রাজসিংহ – ৩.০৩
১৬. রাজসিংহ – ৩.০৪
১৭. রাজসিংহ – ৩.০৫
১৮. রাজসিংহ – ৩.০৬
১৯. রাজসিংহ – ৩.০৭
২০. রাজসিংহ – ৩.০৮
২১. রাজসিংহ – ৩.০৯
২২. রাজসিংহ – ৩.১০
২৩. রাজসিংহ – ৪.১
২৪. রাজসিংহ – ৪.২
২৫. রাজসিংহ – ৪.৩
২৬. রাজসিংহ – ৪.৪
২৭. রাজসিংহ – ৪.৫
২৮. রাজসিংহ – ৪.৬
২৯. রাজসিংহ – ৪.৭
৩০. রাজসিংহ – ৫.১
৩১. রাজসিংহ – ৫.২
৩২. রাজসিংহ – ৫.৩
৩৩. রাজসিংহ – ৫.৪
৩৪. রাজসিংহ – ৫.৫
৩৫. রাজসিংহ – ৫.৬
৩৬. রাজসিংহ – ৬.১
৩৭. রাজসিংহ – ৬.২
৩৮. রাজসিংহ – ৬.৩
৩৯. রাজসিংহ – ৬.৪
৪০. রাজসিংহ – ৬.৫
৪১. রাজসিংহ – ৬.৬
৪২. রাজসিংহ – ৬.৭
৪৩. রাজসিংহ – ৬.৮
৪৪. রাজসিংহ – ৬.৯
৪৫. রাজসিংহ – ৭.১
৪৬. রাজসিংহ – ৭.২
৪৭. রাজসিংহ – ৭.৩
৪৮. রাজসিংহ – ৭.৪
৪৯. রাজসিংহ – ৮.০১
৫০. রাজসিংহ – ৮.০২
৫১. রাজসিংহ – ৮.০৩
৫২. রাজসিংহ – ৮.০৪
৫৩. রাজসিংহ – ৮.০৫
৫৪. রাজসিংহ – ৮.০৬
৫৫. রাজসিংহ – ৮.০৭
৫৬. রাজসিংহ – ৮.০৮
৫৭. রাজসিংহ – ৮.০৯
৫৮. রাজসিংহ – ৮.১০
৫৯. রাজসিংহ – ৮.১১
৬০. রাজসিংহ – ৮.১২
৬১. রাজসিংহ – ৮.১৩
৬২. রাজসিংহ – ৮.১৪
৬৩. রাজসিংহ – ৮.১৫
৬৪. রাজসিংহ – ৮.১৬
৬৫. রাজসিংহ – ৮.১৭ (শেষ)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন