রাজসিংহ – ৮.১২

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : অগ্নি পুনর্জ্বালিত

উদয়সাগরের তীরে ফিরিয়া আসিয়া, ঔরঙ্গজেব তথায় শিবির স্থাপন ও রাত্রি যাপন করিলেন। সৈনিক ও বাহনগণ খাইয়া বাঁচিল। তখন সিপাহী মহালে গান, গল্প এবং নানাবিধ রসিকতা আরম্ভ হইল। একজন মোগল বলিল, “হিন্দুর রাজ্যে আসিয়াছি বলিয়া আমরা একাদশীর উপবাস করিয়াছিলাম |” শুনিয়া একজন মোগলিনী বলিল, “বাঁচিয়া আছ, তবু ভাল। আমরা মনে করিয়াছিলাম, তোমরা নাই–তাই আমরাও একাদশী করিয়াছিলাম |” একজন গায়িকা কতকগুলি সৌখীন মোগলদিগের সম্মুখে গীত করিতেছিল; গায়িতে গায়িতে তাহার তাল কাটিয়া গেল। একজন শ্রোতা জিজ্ঞাসা করিল, “বিবিজান! এ কি হইল? তাল কাটিল যে?” গায়িকা বলিল, “আপনাদের যে বীরপনা দেখিলাম, তাহাতে আর হিন্দুস্থানে থাকিতে সাহস হয় না। উড়িষ্যায় যাইব মনে করিয়াছি–তাই তাল কাটিতে শিখিতেছি |” কেহ বা উদিপুরীর হরণবৃত্তান্ত লইয়া দু:খ করিতে লাগিল–কোন খয়েখাঁ হিন্দুসৈনিক রাবণকৃত সীতাহরণের সহিত তাহার তুলনা করিল–কেহ তাহার উত্তরে বলিল, “বাদশাহ এত বানর সঙ্গে আনিয়াছিল, তবু এ সীতার উদ্ধার হইল না কেন?” কেহ বলিল, “আমরা সিপাহী–কাঠুরিয়া নহি, গাছ-কাটা বিদ্যা আমাদের নাই, তাই হারিলাম |” কেহ উত্তরে বলিল, “তোমাদের ধানকাটা পর্‍যন্ত বিদ্যা, তা গাছ কাটিবে কি?” এইরূপ্ রঙ্গ রহস্য চলিতে লাগিল।
এ দিকে বাদশাহ শিবিরের রঙ‍মহালে প্রবেশ করিলে জেব-উন্নিসা তাঁহার নিকট যুক্তকরে দাঁড়াইল। বাদশাহ জেব-উন্নিসাকে বলিলেন, “তুমি যাহা করিয়াছ, তাহা ইচ্ছাপূর্‍বক কর নাই, বুঝিতে পারিতেছি। এজন্য তোমাকে মার্‍জনা করিলাম। কিন্তু সাবধান! বিবাহের কথা প্রকাশ না পায় |”
তারপর উদিপুরী বেগমের সঙ্গে বাদশাহ সাক্ষাৎ করিলেন। উদিপুরী তাঁহার অপমানের কথা আদ্যোপান্ত সমস্ত বলিল। দশটা বাড়াইয়া বলিল, ইহা বলা বাহুল্য। ঔরঙ্গজেব শুনিয়া অত্যন্ত ক্রুব্ধ ও বিমর্‍ষ হইলেন।
পরদিন দরবারে বসিয়া, আমরদরবার খুলিবার আগে, নিভৃতে মবারককে ডাকিয়া বাদশাহ বলিলেন, “এক্ষণে তোমার সকল অপরাধ আমি মার্‍জনা করিলাম। কেন না, তুমি আমার জামাতা। আমার জামাতাকে নীচ পদে নিযুক্ত রাখিতে পারি না। অতএব তোমাকে দুই হাজারের মন‍সবদার করিলাম। পরওয়ানা আজি বাহির হইবে। কিন্তু এক্ষণে তোমার এখানে থাকা হইতে পারিতেছে না। কারণ, শাহজাদা আকব্বর, পর্‍বত মধ্যে আমার ন্যায় জালে পড়িয়াছেন। তাঁহার উদ্ধারের জন্য দিলীর খাঁ সেনা লইয়া অগ্রসর হইতেছেন। সেখানে তোমার ন্যায় যোদ্ধার সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন। তুমি অদ্যই যাত্রা কর |”
মবারক এ সকল কথায় আহ্লাদিত হইলেন না; কেন না, জানিতেন, ঔরঙ্গজেবের আদর শুভকর নহে। কিন্তু মনে যাহা স্থির করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিয়া দু:খিতও হইলেন না। অতি বিনীত ভাবে বাদশাহের নিকট বিদায় লইয়া দিলীর খাঁর শিবিরে যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
তার পর ঔরঙ্গজেব একজন বিশ্বাসী দূতের দ্বারা দিলীর খাঁর নিকট এক লিপি প্রেরণ করিলেন। পত্রের মর্‍ম এই যে, মবারক খাঁকে দুইহাজারি মন্‍সবদার করিয়া তোমার নিকট পাঠাইয়াছি। সে যেন একদিনও জীবিত না থাকে। যুদ্ধে মরে ভালই,-নহিলে অন্য প্রকারে যেন মরে।
দিলীর মবারককে চিনিতেন না। বাদশাহের আজ্ঞা অবশ্য পালনীয় বলিয়া স্থির করিলেন।
তার পর ঔরঙ্গজেব আমদরবারে বসিয়া আপনার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। বলিলেন, “আমরা কাঠুরিয়ার ফাঁদে পড়িয়াই সন্ধিস্থাপন করিয়াছি। সে সন্ধি রক্ষণীয় নহে। ক্ষুদ্র একজন ভুঁইঞা রাজার সঙ্গে বাদশাহের আবার সন্ধি কি? আমি সন্ধিপত্র ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছি। বিশেষ, সে রূপনগরের কুঙারীকে ফেরৎ পাঠায় নাই। রূপনগরীকে তাহার পিতা আমাকে দিয়াছে। অতএব রাজসিংহের তাহাতে অধিকার নাই। তাহাকে ফিরাইয়া না দিলে, আমি রাজসিংহকে ক্ষমা করিতে পারি না। অতএব যুদ্ধ যেমন চলিতেছিল, তেমনই চলিবে। রাণার রাজ্যমধ্যে গোরু দেখিলে, মুসলমান তাহা মারিয়া ফেলিবে। দেবালয় দেখিলেই তাহা ভগ্ন করিবে। জেজেয়া সর্‍বত্রই আদায় করিবে |”
এই সকল হুকুম জারি হইল। এদিকে দিলীর খাঁ দাইসুরীর পথ দিয়া মাড়বার হইতে উদয়পুরে প্রবেশের চেষ্টায় আসিতেছেন শুনিয়া রাজসিংহ, ঔরঙ্গজেবের কাছে লোক পাঠাইলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন যে, সন্ধির পর আবার যুদ্ধ কেন? ঔরঙ্গজেব বলিলেন, “ভুঁইঞার সঙ্গে বাদশাহের সন্ধি? বাদশাহের রূপনগরী বেগম ফেরৎ না পাঠাইলে বাদশাহ তোমাকে ক্ষমা করিবেন না |” শুনিয়া, রাজসিংহ হাসিয়া বলিলেন, “আমি এখনও জীবিত আছি |” রূপনগরের রাজকুমারীর অপহরণটা ঔরঙ্গজেবের সম্ভাবনা নাই বিবেচনা করিয়া, রূপনগরের “রাও সাহেবকে” এক পর‍ওয়ানা দিলেন, তাহাতে লিখিলেন, “তোমার কন্যা এখনও আমার নিকট উপস্থিত হয় নাই। শীঘ্র তাহাকে উপস্থিত করিবে–নহিলে রূপনগরের গড়ের চিহ্ন রাখিব না |” ঔরঙ্গজেবের ভরসা যে, পিতা জিদ করিলে চঞ্চলকুমারী তাঁহার নিকট আসিতে সম্মত হইতে পারে। পরওয়ানা পাইয়া বিক্রমসিংহ উত্তর লিখিল, “আমি শীঘ্র দুই হাজার অশ্বারোহী সেনা লইয়া আপনার হুজুরে হাজির হইব |”
ঔরঙ্গজেব ভাবিলেন, “সেনা কেন?” মনকে এইরূপ বুঝাইলেন যে, তাঁহার সাহায্যার্‍থ বিক্রমসিংহ সেনা লইয়া আসিতেছে।

সকল অধ্যায়

১. রাজসিংহ – ১.১
২. রাজসিংহ – ১.২
৩. রাজসিংহ – ১.৩
৪. রাজসিংহ – ১.৪
৫. রাজসিংহ – ১.৫
৬. রাজসিংহ – ২.১
৭. রাজসিংহ – ২.২
৮. রাজসিংহ – ২.৩
৯. রাজসিংহ – ২.৪
১০. রাজসিংহ – ২.৫
১১. রাজসিংহ – ২.৬
১২. রাজসিংহ – ২.৭
১৩. রাজসিংহ – ৩.০১
১৪. রাজসিংহ – ৩.০২
১৫. রাজসিংহ – ৩.০৩
১৬. রাজসিংহ – ৩.০৪
১৭. রাজসিংহ – ৩.০৫
১৮. রাজসিংহ – ৩.০৬
১৯. রাজসিংহ – ৩.০৭
২০. রাজসিংহ – ৩.০৮
২১. রাজসিংহ – ৩.০৯
২২. রাজসিংহ – ৩.১০
২৩. রাজসিংহ – ৪.১
২৪. রাজসিংহ – ৪.২
২৫. রাজসিংহ – ৪.৩
২৬. রাজসিংহ – ৪.৪
২৭. রাজসিংহ – ৪.৫
২৮. রাজসিংহ – ৪.৬
২৯. রাজসিংহ – ৪.৭
৩০. রাজসিংহ – ৫.১
৩১. রাজসিংহ – ৫.২
৩২. রাজসিংহ – ৫.৩
৩৩. রাজসিংহ – ৫.৪
৩৪. রাজসিংহ – ৫.৫
৩৫. রাজসিংহ – ৫.৬
৩৬. রাজসিংহ – ৬.১
৩৭. রাজসিংহ – ৬.২
৩৮. রাজসিংহ – ৬.৩
৩৯. রাজসিংহ – ৬.৪
৪০. রাজসিংহ – ৬.৫
৪১. রাজসিংহ – ৬.৬
৪২. রাজসিংহ – ৬.৭
৪৩. রাজসিংহ – ৬.৮
৪৪. রাজসিংহ – ৬.৯
৪৫. রাজসিংহ – ৭.১
৪৬. রাজসিংহ – ৭.২
৪৭. রাজসিংহ – ৭.৩
৪৮. রাজসিংহ – ৭.৪
৪৯. রাজসিংহ – ৮.০১
৫০. রাজসিংহ – ৮.০২
৫১. রাজসিংহ – ৮.০৩
৫২. রাজসিংহ – ৮.০৪
৫৩. রাজসিংহ – ৮.০৫
৫৪. রাজসিংহ – ৮.০৬
৫৫. রাজসিংহ – ৮.০৭
৫৬. রাজসিংহ – ৮.০৮
৫৭. রাজসিংহ – ৮.০৯
৫৮. রাজসিংহ – ৮.১০
৫৯. রাজসিংহ – ৮.১১
৬০. রাজসিংহ – ৮.১২
৬১. রাজসিংহ – ৮.১৩
৬২. রাজসিংহ – ৮.১৪
৬৩. রাজসিংহ – ৮.১৫
৬৪. রাজসিংহ – ৮.১৬
৬৫. রাজসিংহ – ৮.১৭ (শেষ)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন