গরিবের গ্রেনেড

তসলিমা নাসরিন

গরিবের গ্রেনেড

সেদিন আলোচনা হচ্ছিল কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। প্রসঙ্গ বাংলাদেশ। আজকাল বাংলাদেশের কথা ওঠা মানে পেট্রোল বোমার কথা ওঠা। পেট্রোল বোমায়। এ পর্যন্ত প্রচুর লোক নিহত, প্রচুর আহত। তুমি বাড়ি থেকে বের হলে, কিন্তু তুমি জানো না তুমি বাড়ি ফিরতে পারবে কি না। তুমি যখন বাইরে, বাসে চড়ছো, গাড়িতে চড়ছো, রাস্তায় হাঁটছো, আচমকা কোনও এক পেট্রোল বোমা উড়ে এসে তোমার গায়ে পড়তে পারে এবং তোমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। তুমি নিশ্চিত নও পেট্রোল বোমা তোমার গায়ে পড়বে না বা তুমি পুড়বে না বা তুমি মরবে না।

বাড়ি থেকে বেরোনো মানে যদি যে কোনও সময় মরে যাওয়া হয়, তবে বাড়ি থেকে বেরোনোই হয়তো উচিত নয়। সবাইকে সিঁটিয়ে থাকতে হবে ভয়ে, জীবন স্থবির করে দিয়ে ঘরবন্দি বসে থাকতে হবে অনির্দিষ্টকাল। কিন্তু ঘরবন্দি হলে চাকরি খোয়াতে হয়, ব্যবসা লাটে ওঠে, কারো কারো জন্য তো দুবেলা অন্নের সংস্থানই হয় না! এ অনেকটা দুটো মৃত্যুর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা। যে বাসের কনডাক্টরটা সেদিন পুড়ে মরলো, তার কি ঘরবার না হলে চলতো? কানাডা থেকে দেশে ফিরেছেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক, আমার অনুরাগী পাঠক, দিল্লিতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন, পারলেন না। একদিন আমাকে খুব দুঃখিত কণ্ঠে জানিয়ে। দিলেন, বাসে উঠতে ভয় পাচ্ছেন তিনি। দেশটায় নাকি আগুন জ্বলছে।

খালেদা জানেন সব। জানেন মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বাইরে বেরোবে। হয়তো মরবো না এই বিশ্বাস নিয়ে লোকে বেরোবে। কারণ ঘরে বসে থাকলে মানুষের চলবে না। দেশজুড়ে বিষম এক আতঙ্ক তৈরি করতে চাইছেন খালেদা। ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে দেবেন না। হরতাল ডেকে বসলেন পরীক্ষার দিন। নিজের ক্ষমতা ছাড়া আর কাউকে বা আর কিছুকে তিনি কি কখনও মূল্য দিয়েছেন? আমার জানা মতে, দেননি।

তুমি বাসে চড়ছো, বাজারে যাচ্ছো, ভাগ্য ভালো হলে বেঁচে যাবে, তা না হলে আজই আগুনে জ্বলে পুড়ে তোমাকে মরতে হবে। এত নিরাপত্তাহীনতা স্বদেশে থাকে না, থাকে শত্রুর দেশে, অথবা যুদ্ধ চলছে এমন দেশে। ফিনল্যাণ্ডের লোকেরা তিরিশের দশকের শেষদিকে পেট্রোল বোমা বানিয়েছিল রাশিয়ার লোকদের মারার জন্য। পেট্রোল বোমাকে ওরা বলতো, মলোটভ ককটেল। একে গরিবের গ্রেনেড়ও বলা হয়। এই পেট্রোল বোমা ফিনল্যাণ্ডের যুদ্ধে আর স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে ব্যবহার

হয়েছিল। আর এতকাল পর উক্রেইনে গতবছর এর সামান্য ব্যবহার দেখা যায়। যুদ্ধ ছাড়া এই বোমা কেউ ব্যবহার করেনি। যুদ্ধ নেই, অথচ বাংলাদেশে এই বোমা ব্যবহৃত হচ্ছে। যুদ্ধ নেই, অথচ শুরু হয়েছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এ থেকেই শুরু হয়ে যেতে পারে বিচ্ছিরি গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ শুরু হোক বা না হোক, ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে চিরকালের যে লড়াই, সেটি তো রয়েই যাবে। ধর্মান্ধরা এখন আগুন হাতে নিয়েছে। এ আগুন জেহাদের আগুন। নরকের আগুনের চেয়েও এর বীভৎসতা বেশি।

রাষ্ট্রদূতেরা পেট্রোল বোমা বন্ধ করা নিয়ে কথা বলেছেন দুই নেত্রীর সঙ্গে। বিরোধীদলের নেত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে, ঘণ্টার পর ঘন্টা তাঁকে বোঝানো হয়েছে ভায়োলেন্সবিহীন আন্দোলনে যাওয়ার জন্য। বলা হয়েছে, আপনার লক্ষ লক্ষ কর্মী মাঠে নামুক, মিছিল করুক, সভা করুক, অবরোধ করুক, কিন্তু খালি হাতে করুক, হাতে কোনও বোমা, কোনও বন্দুক না নিয়ে করুক। না, খালেদা রাজি নন। তিনি কোনো ভায়োলেন্সবিহীন অবরোধে রাজি নন। তিনি ভায়োলেন্স দেখতে চান, মৃত্যু দেখতে চান, রাজপথ রক্তে ভেজাতে চান। রক্ত ছাড়া তাঁর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে তিনি নাকি পৌঁছোতে পারবেন না। অগত্যা ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতদের হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। কারও কথাই তিনি শুনবেন না। মানুষ আগুনে পুড়ে মরছে– এতে তাঁর কিছু যায় আসে না। ইরাক-সিরিয়ার সন্ত্রাসী দল আইসিসও তো সেদিন জ্যান্ত পোড়ালো জর্দানের পাইলটকে। জেনে শুনে খালেদাও পোড়াচ্ছেন। কী পার্থক্য দুই দলে?

যাত্রীবাহী বাসে ট্রাকে লঞ্চে পেট্রোল বোমা ছোঁড়া হচ্ছে, বা নিরপরাধ মানুষকে গুলি করে মারা হচ্ছে, এসব খবর যখন কানে আসে, আমি প্রশ্ন করি, যদি সরকারের ওপর এত রাগ বিরোধী দলের, বিরোধী দলের সঙ্গী ধর্মীয় দল জামাতে ইসলামী আর ছাত্র শিবিরের, তবে তারা অরাজনৈতিক দরিদ্র নিরীহ নিরপরাধ লোকদের মেরে ফেলছে কেন, কেন সরকারের কোনও মন্ত্রী বা কোনও রাজনীতিকের বাড়িতে, বা অফিসে, বা গাড়িতে বোমা ছুড়ছে না? সরকারের পতন চাও, তবে পেট্রোল বোমা সরকারের দিকে তাক করো, সাধারণ মানুষের দিকে তাক করছে কেন? সাধারণ মানুষকে মারা সোজা, জানি। কিন্তু কঠিন কাজটাই তো কঠিন সময়ে করতে হয়, অন্তত চেষ্টা তো করো। সরকারকে না মারলে সরকারের পতন কী করে হবে? সত্যি বলতে কী, গরিব মরলে কারও কিছু যায় আসে। না সরকারের, না বিরোধী দলের, না জনগণের।

কিছুদিন পর ইউরোপীয় সংসদ থেকে মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে বিশেষজ্ঞরা আসবেন। তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলের নেত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে কেবল বিরোধীদলের নেত্রী জনগণের মানবাধিকার লন করছেন তা নয়, প্রধানমন্ত্রীও লম্ফন করছেন মানবাধিকার। মত প্রকাশের অধিকার অন্যতম মানবাধিকার। আর সেটিই নিয়ত পদদলিত হচ্ছে। বাক স্বাধীনতার বিরোধী আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারাটি বহাল তবিয়তে এখনও বিরাজ করছে। ইন্টারনেটে এমন কোনও কথা কেউ যদি লেখে, যা সরকারের পছন্দ নয়, তবেই হাতকড়া পরিয়ে জেলে নিয়ে যাবে পুলিশ। তাছাড়া মুক্তচিন্তকদের নির্যাতন করার জন্য বাংলাদেশ ফৌজদারি আইনের ২৯৫ ধারা তো আছেই। এইসব দুষ্ট আইন বাতিল করা তো হচ্ছেই না বরং নির্বিচারে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মানে এই আইনগুলো রক্ষা করা হচ্ছে দুষ্ট কাজ করার জন্য। বাংলাদেশের সব সরকারই দুষ্ট কাজে ভীষণই পারদর্শী। এই সরকারকে সংখ্যালঘুদের পক্ষের সরকার ভাবা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি মন্দির আক্রমণ হচ্ছে, সরস্বতীর একশ মূর্তি ভেঙে ফেলা হলো সেদিন, হিন্দুরা আওয়ামী আমলেও দেশত্যাগ করছে। আমি তো আশার কিছু দেখি না কোথাও। কেবল হতাশায় বসতি।

মানুষ কতটা অসহায় হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে বাস করে। কতটা অসহায় হলে বাসে পেট্রোলবোমা পড়তে পারে জেনেও বাসে চড়ে। কতটা অসহায় হলে রাজনীতিকদের সব অনাচার অত্যাচার সহ্য করেও, অবর্ণনীয় দুর্ভোগের দিন কাটাতে কাটাতেও স্বপ্ন দেখে দিন বদলের!

বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলে এইটুকু টের পেয়েছি, বাংলাদেশকে তাঁরা গণতান্ত্রিক দেশ বলে মনে করেন না। জানি না, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ঠিক কী তন্ত্র বলে তাঁরা মনে করেন। তবে আমার কথা বলি, যে দেশে জনগণের নিরাপত্তা নেই, সে দেশকে দেশ বলতে আমার বাধে, গণতন্ত্র বলতে তো আরও বাধে। গণতন্ত্র মানে কিন্তু শুধু ভোটাভুটি নয়, গণতন্ত্র মানে সবার কথা বলার অধিকার, সবার সমান অধিকার, সবার নিরাপত্তার অধিকার।

সকল অধ্যায়

১. কুপমন্ডুক
২. ধর্মীয় সন্ত্রাস
৩. গৃহকর্মীদের নির্যাতন করছে গৃহকর্ত্রীরা!
৪. নাকুশা
৫. সন্ত্রাসের দুনিয়া
৬. একটি মৃত্যু
৭. ঈদের নামাজ নিষিদ্ধ
৮. ঈদ
৯. ও আমার দেশের মাটি
১০. মেয়েদের কেন ঠকানো হয়?
১১. লজ্জা দিবস
১২. গোমাংস নিষিদ্ধ
১৩. ব্যক্তিগত শোক
১৪. নতুন পৃথিবী
১৫. বজরঙ্গি ভাইজান
১৬. হুমায়ুন আজাদ
১৭. ভারতে পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ
১৮. নার্গিস
১৯. অসহিষ্ণুতা
২০. ইসলামী খুনী
২১. বইমেলায় প্রবেশ নিষেধ
২২. দৈনন্দিন জীবন
২৩. উইকিপিডিয়া
২৪. কোথায় আছি
২৫. দ্বিখণ্ডিত
২৬. ফাঁসি
২৭. স্টেটমেন্ট
২৮. হাতি ঘোড়া
২৯. আইসিস
৩০. খুন
৩১. দুর্বৃত্ত
৩২. প্রতিবাদ
৩৩. ফ্রিডম ফ্রম রিলিজন
৩৪. গুলাম আলী
৩৫. হজ্ব
৩৬. সৌদি আরবের কীর্তিকলাপ
৩৭. কোরবানির ঈদ
৩৮. ডেঙ্গি
৩৯. তাইপেই
৪০. কবিতা
৪১. এস
৪২. কবিতা
৪৩. সৌদি আরবে সেক্স শপ
৪৪. অভিজিৎকে কেন মরতে হলো
৪৫. বারসেলোনা
৪৬. মেক্সিকো
৪৭. অনুভূতিতে আঘাত না করে সমাজ বদলানো যায় না
৪৮. অভিজিৎকে যেভাবে চিনি
৪৯. পড়ানো
৫০. অসম্মান
৫১. গরবাচেভ
৫২. ভাষা দিবস
৫৩. ভারতের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা মুক্তমনাদের খুন করছে
৫৪. অ্যাসেম্বলি
৫৫. আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
৫৬. খাওয়াদাওয়া
৫৭. আমি কোথায় এখন?
৫৮. গার্হস্থ্য
৫৯. পুরোনো পাপী
৬০. উপহার
৬১. বর্ণবাদ
৬২. বিলবাও
৬৩. ইলিশ কোরবানি
৬৪. পাটনা
৬৫. লিঁও
৬৬. ইহা বোমা নহে
৬৭. এই সময়
৬৮. এলোমেলো
৬৯. জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা
৭০. মা
৭১. ফেসবুক
৭২. দেশ ১
৭৩. কল্পনার রাজ্য
৭৪. ওরা আটজন
৭৫. চূর্ণী গাঙ্গুলী
৭৬. এসব কী হচ্ছে দেশে?
৭৭. ভিন্নমতের নিরাপত্তা নেই, বাংলাদেশ কি আদৌ কোনও ডেমোক্রেসিং?
৭৮. অভিজিৎ
৭৯. কীরকম যেন ভয় ভয় লাগে
৮০. গরিবের গ্রেনেড
৮১. কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা
৮২. গুন্টার গ্রাস
৮৩. চুম্বন
৮৪. ছিঃ!
৮৫. ছোট ছোট ভাবনা
৮৬. নারী
৮৭. নারী দিবস
৮৮. নাস্তিক নাগরিকদের নিরাপত্তা দিন
৮৯. নারী দিবস
৯০. ধর্ম আর রাজনীতি
৯১. টুকরো ভাবনা
৯২. পতিতাপ্রথা বন্ধ হোক
৯৩. পাকিস্তানে খুন
৯৪. বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না
৯৫. টুকরো টুকরো জীবন
৯৬. বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না
৯৭. বাক স্বাধীনতা
৯৮. বাঘ আর বেড়াল
৯৯. ভূমিকম্প, গরুর মাংস
১০০. স্বপ্নগুলো
১০১. ব্লগার হত্যা?
১০২. মানুষ মানুষের জন্য?
১০৩. মেনোপজ?
১০৪. ইসলামী ইনকুইজেশন
১০৫. লিঙ্গসূত্র
১০৬. মুসলিম শরণার্থীদের সাহায্য করছে অমুসলিম দেশগুলো
১০৭. স্যানিটারি প্রতিবাদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন