এসব কী হচ্ছে দেশে?

তসলিমা নাসরিন

এসব কী হচ্ছে দেশে?

দেশের খবর নিতে গেলেই আজকাল দেখছি মসজিদের ইমামরা শিশু ধর্ষণ করছে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে মসজিদের ইমাম মসজিদের ভেতরেই এক শিশুকে ধর্ষণ করেছে। সাতকানিয়ায় এক মসজিদের মুয়াজ্জিন ধর্ষণ করেছে আট বছর বয়সী এক শিশুকে। সিলেটের মৌলভীবাজারে এক মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল নবম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে। আগে আমরা ভাবতাম মসজিদ মাদ্রাসার মৌলভীদের বিজ্ঞানবোধ না থাকলেও নীতিবোধ থাকে। এখন দেখছি সেটিও নেই। মাদ্রাসার হুজুরদের, মসজিদের ইমামদের সৎ এবং আদর্শবান মানুষ হিসেবে সমাজের লোকরা ভেবে আসছে বহুকাল। বাবা মারা নির্দ্বিধায় নিজেদের সন্তানকে সঁপে দেন ওদের হাতে। ওরা অসহায় নিরীহ শিশুদের ধর্ষণ করতে দুবার ভাবে না। শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করে নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায়। অনুমান করতে পারি কতটা বর্বর হলে, কতটা কুৎসিত হলে, কতটা নৃশংস হলে শিশু ধর্ষণে উদ্যোগী হয় পুরুষরা! অথচ ওরা নাকি দিনরাত আল্লাহর নাম জপে, আল্লাহর কালাম পড়ে, আল্লাহর সেবায় নিয়োজিত। আল্লাহ কি শিশু ধর্ষণ পছন্দ করেন? আল্লাহ কি ওই ইমামদের উপদেশ দিয়েছেন শিশুদের ধর্ষণ করার জন্য? আমার তো ভয় কখন ওরা বলে বসে আল্লাহ বলেছেন ধর্ষণ করতে। কিছুদিন আগে আইসিসের জঙ্গীরা বললো, আল্লাহকে ধন্যবাদ আমাদের বিধর্মী মেয়েদের ধর্ষণ করতে দেওয়ার জন্য।

কী যুগ এসেছে? আল্লাহর কালাম পড়া আল্লাহ নাম জপা পরহেজগার মুসলমানদের হাতে এখন ধারালো চাপাতি, তাদের হাতে এখন পিস্তল, রাইফেল, তাদের হাতে অস্ত্র, মারণাস্ত্র। কিছুদিন আগে খবরে পড়লাম, আইসিস নাকি এক বছরের মধ্যে পাকিস্তানের কাছ থেকে পারমাণবিক বোমা কিনছে। যেভাবে সিরিয়া আর ইরাকের প্রাচীন ঐতিহ্য আর ইতিহাস ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, সেভাবেই পৃথিবীটাকে পারমাণবিক বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে ওরা। মানুষ খুন করতে করতে, যা পাচ্ছে হাতের কাছে সব ধ্বংস করতে করতে, ধ্বংসের নেশায় পেয়েছে এদের। এরা যতদিন বাঁচে ততদিন ধ্বংস করবে, আর ধর্ষণ করবে। বোকা হারাম তো অগুনতি শিশুকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ এরা ধর্মের নামেই করছে। ধর্ম কি ধর্ষণের কথা বলে? উত্তরে বেশির ভাগ মানুষ বলবে, না। তবে ধর্ষণের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক না থাকলেও, ধর্ষণের সঙ্গে নারীবিদ্বেষের সম্পর্ক আছে, এ ব্যাপারে কোনও দ্বিধা নেই। নারীবিদ্বেষের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক কিন্তু পুরুষ রচিত ধর্মগুলোর, কেউ স্বীকার করুক বা না করুক।

বাংলাদেশে সেদিন ধরা পড়েছে কোকাকোলা কোম্পানির আইটি প্রধান আমিনুল ইসলাম বেগ। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, লোকটি প্রকৌশলীর আড়ালে একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি নেতা। জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মোজাহেদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) বর্তমান সমম্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। কোকাকোলা কোম্পানির চাকরি তার ওপরের লেবাস। প্রকৃতপক্ষে তিনি বাংলাদেশের জঙ্গি জেএমবি ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইসিসের বাংলাদেশের সমন্বয়কারী। একদল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের দিয়ে জিহাদ করানোর উদ্দেশ্যে তিনি কাজ করছিলেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে ইরাক ও সিরিয়ায় পাঠিয়েছেন। আরও যারা যেতে ইচ্ছুক তাদের পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাশাপাশি বাংলাদেশেও ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় জিহাদ করার জন্য আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছেন। অবাক লাগে, ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার দূর করার জন্য বিজ্ঞানশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলি, অথচ সবচেয়ে বেশি যারা ধর্মান্ধ-জিহাদি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে, তারা বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত লোক। বিজ্ঞানশিক্ষা এরা কোনও ভালো কাজে খাটায় না। যদি আদৌ খাটায়, তবে ধ্বংস করার জন্য, নির্মাণ করার জন্য নয়। আইসিসের গণহত্যা কেউ রোধ করতে পারছে না। সিরিয়ার পালমিরা অঞ্চলটি দখল করার পর ৪০০ জনকে ওরা হত্যা করেছে, যাদের বেশির ভাগই নারী আর শিশু। ওরা আল্লাহর দোহাই দিয়ে নারী আর শিশুকে ধর্ষণ করছে, হত্যা করছে। আর আমরা গোটা বিশ্ব মুখ বুজে দেখছি ওদের ধর্ষণযজ্ঞ, হত্যাযজ্ঞ।

 বাংলাদেশ আজও প্রতিভাবান ব্লগারদের যারা খুন করেছে, তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি। শাস্তি দেওয়া দুরের কথা। এদিকে আবার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্তত এতদিনে একটা ভালো কাজ করেছে সরকার। অবশ্য নিষিদ্ধ করে কী ছাই হবে যদি না খুনীদের গ্রেফতার করা না হয়। একটি নিষিদ্ধ দলের লোক যুক্তিবাদীদের জবাই করে চলে যাবে, দিনে দুপুরে গর্দানে কোপ মেরে চলে যাবে, পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, ওপরের নির্দেশ না এলে খুনীকে ধরবে না। এরকম যদি নিয়ম হয়, তবে আনসারুল্লাহর নিষিদ্ধ হওয়া না হওয়ায় নিশ্চয়ই কিছু যায় আসে না।

সেদিন শুনি গরুধর্ষণ হয়েছে। নারী ধর্ষণ, কিশোরী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণের পাশাপাশি গরুধর্ষণ চলছে। নিরীহ পশুপ্রাণীদেরও বাদ দেয় না পুরুষরা। নীতি আদর্শ সমস্তই লোপ পেয়েছে! যত বেশি ধর্ম বাড়ছে দেশে, তত বেশি অনাচার বাড়ছে। অথচ আমরা এরকমই শিখেছি ছোটবেলা থেকে, যত বেশি ধর্ম বাড়বে, তত বেশি অনাচার কমবে। আমি হিসেব মেলাতে পারি না। ধর্ম কি তবে মন্দ লোকরাই বেশি পালন করে? নাকি মন্দ কাজ করার জন্য ওপরে একটা ধার্মিকের লেবাস লাগানো হয়, যেন কারও সন্দেহভাজন হতে না হয়? আমার তো মনে হয়, ধার্মিকের লেবাস দেখলেই আজকাল ধর্ষক আর খুনী বলে অনেকের সন্দেহ হয়।

আমার নানা, আমার মা ছিলেন ধার্মিক। ধর্মের অর্থ তাঁরা বুঝতেন কারও অনিষ্ট না করা, কাউকে কষ্ট না দেওয়া, বরং অন্যের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানো, অন্যের অভাব দূর করা। ছোটবেলায় ওঁদের মতো অনেক ধার্মিকের দেখা আমি পেয়েছি। কিন্তু এ বেলায় এসব কী দেখছি দেশে? আগে ধর্ম মানে মানুষ বুঝতো সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবতা। আর এখন ধর্ম মানে হিজাব, হিংস্রতা, রমজান মাসে বিশাল খানাপিনা, ঈদে গরু জবাইএর ধুম, ধর্ম মানে এখন মানুষ কুপিয়ে মারা, দিন দুপুরে গরুর মতো জবাই করে ফেলে রাখা। ভাগ্যিস আমার নানা বেঁচে নেই, মাও বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে ধর্মের এই রূপ দেখে ওরা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেতেন। আসলে ধর্ম যেমন ছিল, তেমনই আছে। মানুষ পাল্টেছে। বর্বর লোকরা ধর্মকে বর্ম হিসেবে রেখে যত বীভৎস হতে পারে হচ্ছে।

ধর্মকে আবার মানবিক করার সময় এসেছে। মসজিদের খুতবায়, মাদ্রাসার ক্লাসঘরে মগজধোলাই হচ্ছে কি না লক্ষ্য রাখতে হবে। ব্যাঙের ছাতার মতো মসজিদ নির্মাণ করা উচিত নয়। এগুলোকেই ধর্ষকরা অতঃপর ব্যবহার করতে শুরু করবে ধর্ষণের নিরাপদ জায়গা হিসেবে, যেহেতু মানুষ মসজিদে কোনও অপবিত্র কাজ হয় না বলেই ধারণা করে। ইমামদের, মাদ্রাসার শিক্ষকদের চোখে চোখে রাখতে হবে যেন তারা ছেলেদের জঙ্গি হিসেবে তৈরি না করে, যেন শিশুদের ধর্ষণ না করে। ধর্ম করতে এসে অধর্ম করলে চলবে কেন!

ইমাম ছাড়াও অন্য পুরুষরা অহরহই ধর্ষণ করছে। ইমাম জাতও পুরুষের জাত। কিন্তু ইমামের গুরুত্বটা অনেক। ইমামকে দেখে শেখে পুরুষরা। ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে পুরুষরা নামাজ পড়ে। ইমামের কথা এবং কাজকে তারা মান্য করে, ইমামের উপদেশ পরামর্শ মতো জীবন যাপন করে। সুতরাং ইমাম যদি ধর্ষক হয়, তবে সমাজের পুরুষরা তার কাছ থেকে ধর্ষক হওয়ার প্রেরণা পাবে। সুতরাং ইমামদের চরিত্র নষ্ট হলে চলবে না। ইমামদের গতিবিধি নজর রাখার ব্যবস্থা না হলে সমূহ বিপদ।

দেশে দিন দিন দুঃসংবাদের পাহাড় গড়ে উঠছে। কী ভালোই না হতো যদি দেশটি থেকে ধর্ষণের খবর না আসতো। সেদিন একটা গারো মেয়েকে গণধর্ষণ করা হলো বাংলাদেশে। বাসের ভেতর। ভারত থেকে ভালো অনেক কিছু তো শেখার আছে। শিখলো শিখলো গণধর্ষণটাই শিখলো? যে লোকগুলো মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে, ওদের জিজ্ঞেস করুন, ওরা ধর্মে বিশ্বাস করে কি না, সবাই, আমি নিশ্চিত, বলবে, করে। আল্লাহকে মানে? বলবে, মানে। তোমরা কি নাস্তিক? জিজ্ঞেস করুন। ওরা খুঁসে উঠবে। এত বড় অসম্মান। আমাদের নাস্তিক বললো? ওরা তীব্র প্রতিবাদ করবে, বলবে যে ওরা আস্তিক। মাঝে মাঝে মনে হয়, নাস্তিক হওয়ার পথই বোধহয় সহিষ্ণ হওয়ার, উদার হওয়ার, মানবিক হওয়ার সঠিক পথ।

সকল অধ্যায়

১. কুপমন্ডুক
২. ধর্মীয় সন্ত্রাস
৩. গৃহকর্মীদের নির্যাতন করছে গৃহকর্ত্রীরা!
৪. নাকুশা
৫. সন্ত্রাসের দুনিয়া
৬. একটি মৃত্যু
৭. ঈদের নামাজ নিষিদ্ধ
৮. ঈদ
৯. ও আমার দেশের মাটি
১০. মেয়েদের কেন ঠকানো হয়?
১১. লজ্জা দিবস
১২. গোমাংস নিষিদ্ধ
১৩. ব্যক্তিগত শোক
১৪. নতুন পৃথিবী
১৫. বজরঙ্গি ভাইজান
১৬. হুমায়ুন আজাদ
১৭. ভারতে পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ
১৮. নার্গিস
১৯. অসহিষ্ণুতা
২০. ইসলামী খুনী
২১. বইমেলায় প্রবেশ নিষেধ
২২. দৈনন্দিন জীবন
২৩. উইকিপিডিয়া
২৪. কোথায় আছি
২৫. দ্বিখণ্ডিত
২৬. ফাঁসি
২৭. স্টেটমেন্ট
২৮. হাতি ঘোড়া
২৯. আইসিস
৩০. খুন
৩১. দুর্বৃত্ত
৩২. প্রতিবাদ
৩৩. ফ্রিডম ফ্রম রিলিজন
৩৪. গুলাম আলী
৩৫. হজ্ব
৩৬. সৌদি আরবের কীর্তিকলাপ
৩৭. কোরবানির ঈদ
৩৮. ডেঙ্গি
৩৯. তাইপেই
৪০. কবিতা
৪১. এস
৪২. কবিতা
৪৩. সৌদি আরবে সেক্স শপ
৪৪. অভিজিৎকে কেন মরতে হলো
৪৫. বারসেলোনা
৪৬. মেক্সিকো
৪৭. অনুভূতিতে আঘাত না করে সমাজ বদলানো যায় না
৪৮. অভিজিৎকে যেভাবে চিনি
৪৯. পড়ানো
৫০. অসম্মান
৫১. গরবাচেভ
৫২. ভাষা দিবস
৫৩. ভারতের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা মুক্তমনাদের খুন করছে
৫৪. অ্যাসেম্বলি
৫৫. আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
৫৬. খাওয়াদাওয়া
৫৭. আমি কোথায় এখন?
৫৮. গার্হস্থ্য
৫৯. পুরোনো পাপী
৬০. উপহার
৬১. বর্ণবাদ
৬২. বিলবাও
৬৩. ইলিশ কোরবানি
৬৪. পাটনা
৬৫. লিঁও
৬৬. ইহা বোমা নহে
৬৭. এই সময়
৬৮. এলোমেলো
৬৯. জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা
৭০. মা
৭১. ফেসবুক
৭২. দেশ ১
৭৩. কল্পনার রাজ্য
৭৪. ওরা আটজন
৭৫. চূর্ণী গাঙ্গুলী
৭৬. এসব কী হচ্ছে দেশে?
৭৭. ভিন্নমতের নিরাপত্তা নেই, বাংলাদেশ কি আদৌ কোনও ডেমোক্রেসিং?
৭৮. অভিজিৎ
৭৯. কীরকম যেন ভয় ভয় লাগে
৮০. গরিবের গ্রেনেড
৮১. কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা
৮২. গুন্টার গ্রাস
৮৩. চুম্বন
৮৪. ছিঃ!
৮৫. ছোট ছোট ভাবনা
৮৬. নারী
৮৭. নারী দিবস
৮৮. নাস্তিক নাগরিকদের নিরাপত্তা দিন
৮৯. নারী দিবস
৯০. ধর্ম আর রাজনীতি
৯১. টুকরো ভাবনা
৯২. পতিতাপ্রথা বন্ধ হোক
৯৩. পাকিস্তানে খুন
৯৪. বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না
৯৫. টুকরো টুকরো জীবন
৯৬. বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না
৯৭. বাক স্বাধীনতা
৯৮. বাঘ আর বেড়াল
৯৯. ভূমিকম্প, গরুর মাংস
১০০. স্বপ্নগুলো
১০১. ব্লগার হত্যা?
১০২. মানুষ মানুষের জন্য?
১০৩. মেনোপজ?
১০৪. ইসলামী ইনকুইজেশন
১০৫. লিঙ্গসূত্র
১০৬. মুসলিম শরণার্থীদের সাহায্য করছে অমুসলিম দেশগুলো
১০৭. স্যানিটারি প্রতিবাদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন