একটি মৃত্যু

তসলিমা নাসরিন

একটি মৃত্যু

কত ছেলেকে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কত ছেলে মার খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকে। কত মেয়েকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। কত মেয়েকে প্রতিদিন স্বামীর অত্যাচার সইতে হয়! তাদের খবর কজন রাখে!

আমরা তো জানিই যে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে মানুষ। মানুষের এই হত্যাযজ্ঞ কি কেউ থামাতে পেরেছে আজ অবধি? মানুষ তো মানুষকে পেটাচ্ছে, চিল ছুড়ছে, হয়রানি করছে, এসব দেখে অভ্যস্ত, এসব নৃশংসতা দেখে সবাই যে যার মতো বাড়ি চলে যায়, সংসার করে। ফুটপাতের মৃতদেহ ডিঙিয়ে সকালে আপিসের দিকে হাঁটে। কারও সময় নেই থমকে দাঁড়িয়ে থাকার, অথবা প্রতিবাদ করার। মানুষ দল বেঁধে দেখে যখন কোনও মেয়েকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। মানুষ হাততালি দেয় যখন কাউকে উলঙ্গ করে গ্রাম জুড়ে হাঁটানো হয়। এ কি মানুষের আজকের স্বভাব? আদিকালে মানুষকে শুলে চড়ানো, ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো, ক্রশবিদ্ধ করা– সবই জনতার সামনে হতো। জনতা হাততালি দিত, হাসতো, ঘৃণা ছুঁড়ে দিতো অত্যাচারিত নির্যাতিত অসহায় মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে। এ আমাদের মানুষজাতির বৈশিষ্ট্য।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক গ্রামে রাজন নামের একটা গরিব ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে কিছু লোক। পেটানোর দৃশ্য অনেকে দেখেছে। দেখেছে আর হেসেছে। পিটিয়ে মেরে ফেলার ভিডিও ওরা ফেসবুকেও দিয়েছে। এই যে দিন-দুপুরে একটা ছেলেকে মেরে ফেলা হলো, কেউ কি বাঁচাতে এসেছিল? কেউ আসেনি। রাজন নাকি কী চুরি করেছিল, তাই পেটানো হয়েছিল। আমি কিন্তু একথা বলতে চাইছি না। যে রাজনকে গরিব করেছে এই সমাজ, দোষটা সমাজের। চুরি না হয় করেছে রাজন, তাই বলে তাকে মেরে ফেলতে হবে?। আমি শুধু বলতে চাইছি, মানুষ নামক জাতটার জন্য বর্বরতা নৃশংসতা নিষ্ঠুরতা হিংস্রতা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দুর্বলকে মেরে ফেলে। মানুষের মতো কাজই করেছে ওরা। সবল-মানুষ দুর্বল-মানুষকে মারে। ধনী-মানুষ গরিব মানুষকে মারে। পুরুষ মানুষ মেয়ে মানুষকে মারে। নানা কায়দায় মানুষ মানুষকে মারে। প্রতিদিন মারে। কেবল রক্ত গড়ালেই আর শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হলেই কি মৃত্যু ঘটে? অনেকে মার খেতে খেতে মৃতবৎ বেঁচে থাকে।

 গোটা জগত জুড়ে মারামারি চলছে। কিছু মানুষ মারামারি ঠেকাতে রূপকথার আশ্রয় নেয়, ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে মানুষকে শান্ত করে। কিছু মানুষ আইন বানিয়েছে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানুষের রক্তপিপাসা কমায়। কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ ইস্কুল খুলেছে, মানুষকে খুনী না হওয়ার পরামর্শ দেয়। আজ যদি মানুষ জানে ঈশ্বর,ভগবান বা আল্লাহ বলে কিছু নেই, যদি জানে দেশে কোনও শাস্তির আইন নেই, মানুষ হত্যা করতে তারা আজই ঝাঁপিয়ে পড়বে। রক্তে ভেসে যাবে পৃথিবী। আমি বলতে চাইছি, মানুষ মূলত বর্বর, মূলত ভয়ংকর দানব। বলতে চাইছি, মানুষ অত্যন্ত নৃশংস বীভৎস প্রজাতি। হাতে গোনা কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ সাধারণ মানুষকে পরামর্শ দেয় স্বভাব চরিত্র বদলাতে, নৃশংসতা বন্ধ করতে। এ অনেকটা সাপকে ছোবল না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার মতো।

 কেউ কেউ বলছে রাজনকে কামরুল নামের এক লোক যৌন নির্যাতন করতে চেয়েছিল, কিন্তু রাজন রাজি হয়নি বলে চুরির অপবাদ দিয়ে ওকে মেরেছে। কামরুল কয়েক লাখ টাকা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে পালিয়ে যায় সৌদি আরবে। সৌদি আরবে তাকে ধরা হয়েছে। ধরা হয়েছে সম্ভবত মিডিয়া সরব ছিল বলে। তা না হলে কজন পালিয়ে যাওয়া ধর্ষক বা খুনীকে এভাবে ধরা হয়।

একবার আমি সচক্ষে দেখেছিলাম বাসের এক পকেটমারকে কী করে পিটিয়েছিল। বাসের যাত্রীরা। কারও পকেট থেকে দুটাকা চুরি করেছিল গরিব পকেটমার ছেলেটি। খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসের কিছু যাত্রী ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলেটার ওপর। বাসের বাকি যাত্রীরা কী কারণে ছেলেটাকে মারছে না জেনেই আক্রমণে অংশ নেয়। কী ভীষণ আক্রোশ। পারলে ছেলেটাকে প্রাণে মেরে ফেলে। অন্যকে মারায় যে এত আনন্দ তা না দেখলে বিশ্বাস হতো না। মেরে ছেলেটার হাড়গোড় ভেঙেছিল। রক্ত বেরোচ্ছিল ছেলেটার নাক মুখ দিয়ে। তারপরও ওরা থামেনি। থামানোর চেষ্টা করে দেখেছি, আমিও মার খাচ্ছি। পৃথিবীর আর কোনও প্রাণী নিজেদের এভাবে অত্যাচার করে বলে আমার জানা নেই। মানুষই সম্ভবত একমাত্র প্রজাতি যে অন্য প্রজাতিকে শুধু নয়, নিজ প্রজাতিকেও নির্যাতন করে।

রাজনকে মারার ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে বলে রাজনের হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হচ্ছে। যদি প্রতিটি অত্যাচারের, নির্যাতনের, ধর্ষণের, হত্যার ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়? মানুষ কি সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হবে রাজনের মৃত্যুতে যেরকম সরব হয়েছে? এই প্রশ্নটি আমি ফেসবুকেই করেছিলাম। উত্তর যা এলো,তা দেখে আমি থ। ধর্ষণের ভিডিও পোস্ট করলে ধর্ষিতার প্রতি মায়া হওয়া আর ধর্ষকের বিরুদ্ধে রুখে ওঠার বদলে বরং এই ধর্ষণটাকে মানুষ নাকি উপভোগ করবে। পর্ন ছবিগুলো অনেকটা ধর্ষণের মতোই। আজকাল পর্ন ছবির বিজ্ঞাপনেও বলা হয় যে ভায়োলেন্স আছে, রেপ আছে, মেয়েদের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া আছে। শুধু ধর্ষণই কি উপভোগ করবে, হয়তো অত্যাচার আর খুনও উপভোগ করবে। কেউ কাউকে মারছে, এই দৃশ্য দেখতে তো মানুষের চিরকালই খুব ভালো লাগে। তাই তো ভায়োলেন্সের আর যুদ্ধের চলচ্চিত্র এত জনপ্রিয়।

কদিন পর রাজনকে মানুষ ভুলে যাবে। তার খুনীর কোনও বিচার হয়েছে কী না কেউ খবরও নেবে না। নতুন রাজনরা মরবে। মানুষ হয়তো জানবেও না। খুনীরা আর অত্যাচারীরা পার পেয়ে যাবে, যেমন পার পেয়ে যায়। গরিব মরলে বেশিরভাগ সময় মানুষ কোনও প্রতিবাদ করে না। গরিবের অপঘাতে মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলে কারও মনে হয় না। হঠাৎ হঠাৎ ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে। রাজন হত্যার বিচার চাওয়াটা ব্যতিক্রম।

মানুষকে মানুষ হলেই চলবে না, শুভবুদ্ধির মানুষ হতে হবে। তা না হলে মানুষ নামক প্রজাতির মধ্যে বর্বর আর হিংস্র মানুষ ছাড়া আর কেউই রইবে না।

সকল অধ্যায়

১. কুপমন্ডুক
২. ধর্মীয় সন্ত্রাস
৩. গৃহকর্মীদের নির্যাতন করছে গৃহকর্ত্রীরা!
৪. নাকুশা
৫. সন্ত্রাসের দুনিয়া
৬. একটি মৃত্যু
৭. ঈদের নামাজ নিষিদ্ধ
৮. ঈদ
৯. ও আমার দেশের মাটি
১০. মেয়েদের কেন ঠকানো হয়?
১১. লজ্জা দিবস
১২. গোমাংস নিষিদ্ধ
১৩. ব্যক্তিগত শোক
১৪. নতুন পৃথিবী
১৫. বজরঙ্গি ভাইজান
১৬. হুমায়ুন আজাদ
১৭. ভারতে পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ
১৮. নার্গিস
১৯. অসহিষ্ণুতা
২০. ইসলামী খুনী
২১. বইমেলায় প্রবেশ নিষেধ
২২. দৈনন্দিন জীবন
২৩. উইকিপিডিয়া
২৪. কোথায় আছি
২৫. দ্বিখণ্ডিত
২৬. ফাঁসি
২৭. স্টেটমেন্ট
২৮. হাতি ঘোড়া
২৯. আইসিস
৩০. খুন
৩১. দুর্বৃত্ত
৩২. প্রতিবাদ
৩৩. ফ্রিডম ফ্রম রিলিজন
৩৪. গুলাম আলী
৩৫. হজ্ব
৩৬. সৌদি আরবের কীর্তিকলাপ
৩৭. কোরবানির ঈদ
৩৮. ডেঙ্গি
৩৯. তাইপেই
৪০. কবিতা
৪১. এস
৪২. কবিতা
৪৩. সৌদি আরবে সেক্স শপ
৪৪. অভিজিৎকে কেন মরতে হলো
৪৫. বারসেলোনা
৪৬. মেক্সিকো
৪৭. অনুভূতিতে আঘাত না করে সমাজ বদলানো যায় না
৪৮. অভিজিৎকে যেভাবে চিনি
৪৯. পড়ানো
৫০. অসম্মান
৫১. গরবাচেভ
৫২. ভাষা দিবস
৫৩. ভারতের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা মুক্তমনাদের খুন করছে
৫৪. অ্যাসেম্বলি
৫৫. আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
৫৬. খাওয়াদাওয়া
৫৭. আমি কোথায় এখন?
৫৮. গার্হস্থ্য
৫৯. পুরোনো পাপী
৬০. উপহার
৬১. বর্ণবাদ
৬২. বিলবাও
৬৩. ইলিশ কোরবানি
৬৪. পাটনা
৬৫. লিঁও
৬৬. ইহা বোমা নহে
৬৭. এই সময়
৬৮. এলোমেলো
৬৯. জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা
৭০. মা
৭১. ফেসবুক
৭২. দেশ ১
৭৩. কল্পনার রাজ্য
৭৪. ওরা আটজন
৭৫. চূর্ণী গাঙ্গুলী
৭৬. এসব কী হচ্ছে দেশে?
৭৭. ভিন্নমতের নিরাপত্তা নেই, বাংলাদেশ কি আদৌ কোনও ডেমোক্রেসিং?
৭৮. অভিজিৎ
৭৯. কীরকম যেন ভয় ভয় লাগে
৮০. গরিবের গ্রেনেড
৮১. কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা
৮২. গুন্টার গ্রাস
৮৩. চুম্বন
৮৪. ছিঃ!
৮৫. ছোট ছোট ভাবনা
৮৬. নারী
৮৭. নারী দিবস
৮৮. নাস্তিক নাগরিকদের নিরাপত্তা দিন
৮৯. নারী দিবস
৯০. ধর্ম আর রাজনীতি
৯১. টুকরো ভাবনা
৯২. পতিতাপ্রথা বন্ধ হোক
৯৩. পাকিস্তানে খুন
৯৪. বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না
৯৫. টুকরো টুকরো জীবন
৯৬. বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না
৯৭. বাক স্বাধীনতা
৯৮. বাঘ আর বেড়াল
৯৯. ভূমিকম্প, গরুর মাংস
১০০. স্বপ্নগুলো
১০১. ব্লগার হত্যা?
১০২. মানুষ মানুষের জন্য?
১০৩. মেনোপজ?
১০৪. ইসলামী ইনকুইজেশন
১০৫. লিঙ্গসূত্র
১০৬. মুসলিম শরণার্থীদের সাহায্য করছে অমুসলিম দেশগুলো
১০৭. স্যানিটারি প্রতিবাদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন