ইলিশ কোরবানি

তসলিমা নাসরিন

ইলিশ কোরবানি

শুনেছি একটা ইলিশ নাকি ষোলো হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে ঢাকায়। পয়লা বৈশাখে ইলিশ খেতে হবে যে করেই হোক, তাই যে দামই হাঁকছে ইলিশওয়ালা, সে দামেই কিনছে বাঙালি। বাঙালি না বলে ধনী বাঙালি বলাই ভালো। পয়লা বৈশাখ ইলিশ ছাড়া কী করে উৎযাপন হবে। কোরবানির ঈদের আগে চড়া দামে গরু কিনে লোকেরা যেমন চারদিকে বলে বেড়ায় কত টাকায় কিনেছে গরু, এও ঠিক তেমন, ইলিশ কিনে সবাইকে শোনাচ্ছে কত টাকায় ইলিশটা কিনেছে। যত বেশি দাম, তত বেশি ইজ্জত। পয়লা বৈশাখে গরু-খাসির বদলে ইলিশ কোরবানি দেয় মানুষ। পয়লা বৈশাখটা কি ধীরে ধীরে একটুখানি কোরবানির ঈদের মতো হয়ে উঠছে। কী ভালোই না হবে বাংলা নববর্ষ যদি কোরবানির ঈদের মতো বড় উৎসব হয়ে ওঠে। ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে নববর্ষের উৎসব নিশ্চয়ই ঢের ভালো।

তবে যেভাবেই পালন করুক, পয়লা বৈশাখটা পালন করুক বাঙালিরা। বাংলা ক্যালেণ্ডারের উৎপত্তির সঙ্গে বাংলা বা বাঙালির কতটুকু কী জড়িত সে নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে বাংলা ক্যালেণ্ডারকে যেহেতু বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, বাঙালিরা আর ক্যাচাল না করে এর বারো মাসের তেরো পার্বণ উত্যাপন করুক ঘটা করে।

বাঙালির বাঙালিত্ব তো প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ভাষাটাই যাবো যাবো করছে। এই ভাষা গরিব লোকের ভাষা, এই ভাষা দাদু-দিদিমার ভাষা, ঠাকুম্মা- ঠাকুর্দার ভাষা। সত্যিই এখনকার ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলাটা নেহাত প্রাচীন লোকদের ভাষা, চাষোভুযোদের ভাষা।

মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হোক ঢাকা শহরে, প্রতি পয়লা বৈশাখে। কুটির শিল্পের মেলা হোক। মানুষ কাঁচা লংকা আর পান্তা ভাত খাক। কেউ কেউ টিপ্পনি কাটে, বছরের একদিন পান্তা খেয়ে কী লাভ, বাকি দিনগুলোয় তো মোগলাই খাচ্ছে। আমার বক্তব্য, বছরে একদিনই উৎসব করুক। একদিন বৃদ্ধ থেকে শিশু সবাই দেখুক, তাদের সংস্কৃতিটা ঠিক কী। একদিন দেখুক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, শাড়ি ধূতি, নাচ গান, আল্পনা, কাগজের হাতি ঘোড়া। একদিন বাংলায় কথা বলুক, একদিনের জন্য হলেও শত ভাগ বাঙালি হোক।

একদিনের জন্য হলেও উৎসবটা করা জরুরি, কারণ সামনে এমন দিন আসছে, এই একটা দিনও হয়তো আর বাঙালির উৎসবের জন্য জুটবে না। এখনই ইসলামি মৌলবাদীরা হুমকি দিচ্ছে, পয়লা বৈশাখ যেন পালন না করা হয়। একবার তো রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়েছিল ওরা। এরপর বলা যায় না হয়তো পয়লা বৈশাখের উৎসব যারা করবে, তাদের দিন দুপুরে জবাই করে ফেলে রাখবে রাস্তায়। যারা আরবের সংস্কৃতিকে গায়ের জোরে ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদের বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে, তারা খুব ভয়ংকর, তারা আজ বাংলাদেশে বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। তাদের এক হাতে অস্ত্র, আরেক হাতে টাকা। তাদের মাথার ওপর সরকারি আশির্বাদের হাত।

সূতরাং পয়লা বৈশাখের উৎসব বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে যত পারুক উৎসব করে নিক বাঙালি। যত পারুক বাংলা গান গেয়ে নিক। যত পারুক নেচে নিক। যত পারুক ঢাক ঢোল বাজিয়ে নিক। যত পারুক মুড়ি মুড়কির মেলা করে নিক। কবে আবার কাকে হিজাব বোরখা আর টুপি জোব্বার আড়ালে চলে যেতে হয় কে জানে।

সত্যি বলছি, খুব দাম দিয়ে মানুষ ইলিশ কিনছে বলে আমার ভালো লাগছে। মানুষ গর্ব করে বলুক, তারা বাঙালি। বন্ধুদের ডেকে ডেকে দেখাক, আত্মীয় পড়শিদের দেখাক সদ্য কেনা রূপোলি রূপোলি ইলিশ। পয়লা বৈশাখের পেছনে যত টাকা যায়, যাক। বাঙালিকে সারাবছর বাঙালিত্ব বিসর্জন দিতে হয়, একদিন অন্তত বাঙালিত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠুক। যত হুমকিই আসুক, যত শত্রুই থাকুক বাঙালির আশেপাশে, তবুও যেন অকুতোভয়ের মতো পালন করে যায় বছরের একদিনের এই উৎসব।

ইহুদিরা আজও নিজের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছে। নিজভূমি থেকে নির্বাসিত হয়ে ওরা হাজার হাজার বছর কাটিয়েছে বিদেশ বিভূঁইয়ে, ভিন্ন সংস্কৃতির দেশে, সংখ্যালঘু হয়ে, নিরন্তর অপমান সয়ে। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে কী করে এতকাল তারা বেঁচে ছিল, এই বিস্ময় জাগায়। এতদিনে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সব। কিন্তু না, সবই টিকে আছে। কারণ হাজার বছর ধরে ঘরে ঘরে নিজেদের ভাষা আর সংস্কৃতির চর্চা চালু রেখেছিল বলেই টিকে আছে। যে করেই হোক টিকিয়ে রাখবে এই প্রতিজ্ঞা করেছিলো বলেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।

ইহুদি পারলে বাঙালি পারবে না কেন! নিশ্চয়ই পারবে, যদি নিজের ভাষা আর সংস্কৃতিকে ইহুদিদের মতো ভালবাসে। এখানেই আমার সংশয়, আমার মনে হয়। বাঙালি তাদের সংস্কৃতিকে সত্যিকার ভালোবাসে না। বাসে না বলেই অত সহজে আরবের এবং ইংরেজের সংস্কৃতি বাংলাকে দখল করে নিতে পেরেছে। এই অবাঙালির দেশে আমি কী করে কাটাবো আমার পয়লা বৈশাখ!পদ্মার ইলিশ কোথায় পাবো, রমনার বটমূলে গানই বা কী করে শুনতে যাবো! আমি না হয় দূর থেকেই সবার আনন্দ দেখলাম। না হয় দূর থেকেই গানের সুর শুনলাম। কাছে যাওয়া আমার না-ই হলো। সবার কি আর সব হয়!

সকল অধ্যায়

১. কুপমন্ডুক
২. ধর্মীয় সন্ত্রাস
৩. গৃহকর্মীদের নির্যাতন করছে গৃহকর্ত্রীরা!
৪. নাকুশা
৫. সন্ত্রাসের দুনিয়া
৬. একটি মৃত্যু
৭. ঈদের নামাজ নিষিদ্ধ
৮. ঈদ
৯. ও আমার দেশের মাটি
১০. মেয়েদের কেন ঠকানো হয়?
১১. লজ্জা দিবস
১২. গোমাংস নিষিদ্ধ
১৩. ব্যক্তিগত শোক
১৪. নতুন পৃথিবী
১৫. বজরঙ্গি ভাইজান
১৬. হুমায়ুন আজাদ
১৭. ভারতে পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ
১৮. নার্গিস
১৯. অসহিষ্ণুতা
২০. ইসলামী খুনী
২১. বইমেলায় প্রবেশ নিষেধ
২২. দৈনন্দিন জীবন
২৩. উইকিপিডিয়া
২৪. কোথায় আছি
২৫. দ্বিখণ্ডিত
২৬. ফাঁসি
২৭. স্টেটমেন্ট
২৮. হাতি ঘোড়া
২৯. আইসিস
৩০. খুন
৩১. দুর্বৃত্ত
৩২. প্রতিবাদ
৩৩. ফ্রিডম ফ্রম রিলিজন
৩৪. গুলাম আলী
৩৫. হজ্ব
৩৬. সৌদি আরবের কীর্তিকলাপ
৩৭. কোরবানির ঈদ
৩৮. ডেঙ্গি
৩৯. তাইপেই
৪০. কবিতা
৪১. এস
৪২. কবিতা
৪৩. সৌদি আরবে সেক্স শপ
৪৪. অভিজিৎকে কেন মরতে হলো
৪৫. বারসেলোনা
৪৬. মেক্সিকো
৪৭. অনুভূতিতে আঘাত না করে সমাজ বদলানো যায় না
৪৮. অভিজিৎকে যেভাবে চিনি
৪৯. পড়ানো
৫০. অসম্মান
৫১. গরবাচেভ
৫২. ভাষা দিবস
৫৩. ভারতের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা মুক্তমনাদের খুন করছে
৫৪. অ্যাসেম্বলি
৫৫. আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
৫৬. খাওয়াদাওয়া
৫৭. আমি কোথায় এখন?
৫৮. গার্হস্থ্য
৫৯. পুরোনো পাপী
৬০. উপহার
৬১. বর্ণবাদ
৬২. বিলবাও
৬৩. ইলিশ কোরবানি
৬৪. পাটনা
৬৫. লিঁও
৬৬. ইহা বোমা নহে
৬৭. এই সময়
৬৮. এলোমেলো
৬৯. জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা
৭০. মা
৭১. ফেসবুক
৭২. দেশ ১
৭৩. কল্পনার রাজ্য
৭৪. ওরা আটজন
৭৫. চূর্ণী গাঙ্গুলী
৭৬. এসব কী হচ্ছে দেশে?
৭৭. ভিন্নমতের নিরাপত্তা নেই, বাংলাদেশ কি আদৌ কোনও ডেমোক্রেসিং?
৭৮. অভিজিৎ
৭৯. কীরকম যেন ভয় ভয় লাগে
৮০. গরিবের গ্রেনেড
৮১. কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা
৮২. গুন্টার গ্রাস
৮৩. চুম্বন
৮৪. ছিঃ!
৮৫. ছোট ছোট ভাবনা
৮৬. নারী
৮৭. নারী দিবস
৮৮. নাস্তিক নাগরিকদের নিরাপত্তা দিন
৮৯. নারী দিবস
৯০. ধর্ম আর রাজনীতি
৯১. টুকরো ভাবনা
৯২. পতিতাপ্রথা বন্ধ হোক
৯৩. পাকিস্তানে খুন
৯৪. বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না
৯৫. টুকরো টুকরো জীবন
৯৬. বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না
৯৭. বাক স্বাধীনতা
৯৮. বাঘ আর বেড়াল
৯৯. ভূমিকম্প, গরুর মাংস
১০০. স্বপ্নগুলো
১০১. ব্লগার হত্যা?
১০২. মানুষ মানুষের জন্য?
১০৩. মেনোপজ?
১০৪. ইসলামী ইনকুইজেশন
১০৫. লিঙ্গসূত্র
১০৬. মুসলিম শরণার্থীদের সাহায্য করছে অমুসলিম দেশগুলো
১০৭. স্যানিটারি প্রতিবাদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন