আমি চঞ্চল হে – ৪

বুদ্ধদেব বসু

আমাদের কপালগুণে সেদিনই বৃষ্টি এলো। কনকনে হাওয়ায় উত্তরের শান, আর ঠাণ্ডা পাৎলা বৃষ্টি। সুতরাং ধরমশালার ছোটো ঘরে বসে-বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকানো, আর মাঝে-মাঝে ছোটো স্পিরিট স্টোভে আধঘণ্টায় জল ফুটিয়ে চা- পান— এ-ছাড়া কিছুই আর করবার রইলো না। দিঘির বুকের উপর বৃষ্টি যেন কুয়াশার পর্দা, ঝাপসা মাঠ বন গাছপালা চারদিকে। কেমন একটা ফ্যাকাশে হলদে রঙের আকাশ, আর থেকে-থেকে ঝাপটা আসে আর হঠাৎ থেমে যায়। কুণ্ডে যাওয়া হলো না, দিঘিতে স্নান সেরে নিলুম। পান্ডাজি নিয়ে এলেন মন্দিরের প্রসাদ— তার চেয়ে ভালো খাদ্য ভুবনেশ্বরে দুষ্প্রাপ্য। এ-দেশের জলের গুণে তীব্র ক্ষুধাবোধ হয়, কিন্তু খাদ্য সে-অনুযায়ী পাওয়া যায় না। আমিষভোজী বাঙালির পক্ষে, বিশেষ করে, দু-দিনেই প্রায় অনশনে এসে ঠেকে, যদি আশ্রয় হয় ধরমশালা। এই পান্থনিবাসগুলিতে অবিশ্যি আমিষ-প্রবেশ নিষিদ্ধ। কোটিপতি মাড়োয়ারিদের দান এগুলি। ভারতবর্ষের সমস্ত তীর্থস্থানে মাড়বসন্তানের পুণ্যক্রয়ের এমনি কত দলিল! সমস্ত দেশের খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে জেনে-শুনে যে পাপ এঁরা করেন, তারই ক্ষতিপূরণ হয় ধরমশালা নির্মাণে, মন্দিরে-মন্দিরে মহার্ঘ উপঢৌকনে। অন্ধ বিশ্বাসের মস্ত একটা সুবিধে এই যে বিবেক অতি সহজেই পরিষ্কার রাখা যায়। এঁরা বিনা দ্বিধাতেই বিশ্বাস করেন যে প্রেম ও যুদ্ধের মতো বাণিজ্যেও কিছুই অন্যায় নয়, কেননা মুনাফার একটা অংশ তো দেয়া হয় দেবতাকেই। ও-সমস্ত উপায় অবলম্বন না-করলে দেবতার এ-পাওনা হতো না, সুতরাং চিনিতে বালি মেশাবার উদ্যমেও দেবতাই সহায়।

যা-ই হোক, তখনকার মতো মাড়োয়ারির পুণ্যলোভকে ধন্যবাদ না-দিয়ে পারিনি। এখানকার ধরমশালার আশ্রয় অনুদার নয়। ঘরের দরজা বন্ধ করলেই নিশ্চিন্ত। জানলার বাইরে মাঠের পর মাঠ গাছে-গাছে সবুজ হয়ে দিগন্তে মিশেছে, এই মাটির ঢেউ-খেলানো সমুদ্রে চোখ কোথাও বাধা পায় না। উড়িষ্যা ঘন পল্লবের দেশ। সাঁওতাল পরগনার পাহাড় কঠিন নীল পাথরের স্তূপ, একটি ঘাস জন্মায় না। উড়িষ্যার পাহাড় নিবিড় সবুজে মোড়া। সে-সবুজ প্রায় কালো। বাংলার হৃদয়ের ভাষা যেমন নদী, এখানকার প্রকৃতি তেমনি অজস্র জঙ্গলে কথা কয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা নামলো, আবার বৃষ্টি এলো। ঘরে লন্ঠনের আলো দেয়ালে অদ্ভুত ছায়া ফেলেছে, বাইরে থমথমে অন্ধকার। দূরে বুঝি দেখা যায় একটা আলোর ফুটকি, হঠাৎ শোনা যায় কে যেন চীৎকার করে কাকে ডাকছে অন্ধকারে। সন্ধ্যা হতে-হতেই মধ্যরাত্রি। একটা অস্পষ্ট আতঙ্কে মন ভরে যায়। অনেকরাত্রে বুঝি চাঁদ উঠলো; মেঘ চুঁইয়ে পড়লো আবছা জ্যোছনা। সেই মৃত্যু-ম্লান জ্যোছনায় নিঃসীম জনহীন প্রান্তর কঙ্কালের মতো ফুটে উঠলো; মনে হলো পৃথিবীর হাড়গোড় যেন দেখা যাচ্ছে।

পরের দিন প্রকৃতি প্রসন্ন হলো। হেসে উঠলো আকাশ, শিরশিরে হাওয়ায় দিঘির জলে ছোটো-ছোটো ঢেউ উঠছে, ঢেউ উঠছে আমাদের মনে— এমন নীল আকাশ, আর এমন সোনার রোদ, আর পায়ের নিচে মাটির স্পর্শ এমন মধুর। কেননা কুণ্ডে স্নান করতে যাবার পথে পায়ে আমাদের জুতো ছিলো না। আঁকাবাঁকা সরু পথের দু-ধারে কত মন্দিরের ভাঙা-ভাঙা স্তূপ মাঝখানে ছোট্ট ঝরনা ছলছলিয়ে চলে গেছে— কী ঠাণ্ডা জল— আর আকাশের পরে আকাশ ছড়ানো, শেষ নেই। কুণ্ডের ধারে মন্দির, স্নানের পর সেখানেই সে-বেলার অন্ন জুটলো। গাছের ছায়ায় সবুজ শ্যাওলার উপর বসে খাওয়াটা রোমান্টিক খুবই, তবে সে-খাওয়া যদি কাঁকর- মেশানো মোটা ভাতের সঙ্গে অখাদ্য একটা ব্যঞ্জন আর ভাতের মতোই মোটা দানার নুনে পর্যবসিত হয় তাহলে রোমান্টিক রস অনেকটা ফিকে হয়ে আসে এ-কথা বলবোই। তার উপর ঐ দুধকুণ্ডের জল খেলেই খিদেটা নিতান্ত অসভ্যের মতো চাড়িয়ে ওঠে।

ভুবনেশ্বর মন্দিরের দেশ। ওটুকু জায়গা ভবানীপুরে তুলে আনলে যতগুলো পানের দোকান পাওয়া যাবে, ঠিক ততটাই বোধহয় মন্দির ভুবনেশ্বরে ভাঙা-আস্ত ছোটো-বড়ো মিলিয়ে। এক পা বাড়ালেই কোনো-না-কোনো ধ্বংসস্তূপের উপর হুঁচট খেতে হয়। এখানে-ওখানে, যেখানে-সেখানে পাথরের এই ভাঙা-ভাঙা কবিতা ছড়ানো। কোনোটা হয়তো কখনো শেষই হয়নি, কোনোটা হয়তো আরম্ভ হয়েছিলো মাত্র। মনে হয় এই দেশের লোকের এককালে মন্দির বানানো ছাড়া আর কোনো কাজই ছিলো না। কি মনে হয় এ ছিলো তাদের অবসরের প্রধান খেয়াল; জীবিকার কাজের ফাঁকে-ফাঁকে পাথরের বোবা সুর নিয়ে এই খেলা। সে কি চমৎকার সমাজ নয়, যার শরিকরা দিনের কাজের শেষে এসে জোটে দেবতার খেলাঘর বানাবার কাজে, সেই পাথরের ছন্দ তাদেরই হৃদয়ের ছন্দ নয় কি? সকল শিল্পের মধ্যে স্থাপত্য চরম নৈর্ব্যক্তিক; তা একজনের নয়, তা হাজার লোকের; তা সমস্ত জাতির অন্তরের একটি ভঙ্গির প্রকাশ। সে-ভঙ্গি বিশেষ করে ভক্তির। পৃথিবীর ইতিহাসে এইটে দেখা গেছে যে স্থাপত্যের প্রধান প্রেরণা ধর্মই জুগিয়েছে চিরকাল। দেবতার গৃহনির্মাণে শুধু একজন শিল্পীর কলাচাতুর্য নয়, আছে সমস্ত জাতির প্রার্থনা ও উদ্দীপনা; উদারতম অর্থে সে-প্রেরণা ধর্মের। মন্দির গড়তে যে-উৎসাহ প্রাণে আসে, তা আসতেই পারে না সিনেমার ঘর কি পোলিটিকাল বক্তৃতার আস্তানা বানাতে, যা-ই বলুক না আধুনিক মন। আজকের দিনে এ-কথার প্রমাণের অভাব নেই। বিজ্ঞানের ময়দানব চমক-লাগানো আজব বাড়িই বানাতে পারে, তার বেশি পারে না। লোক-লশকর হাতিয়ার প্রচুর আছে, অভাব প্রেরণার। বাহবা নেয়াই তার উদ্দেশ্য, যেমন একশ্রেণীর লেখক মনে-মনে পাঠকের হাততালি শুনতে-শুনতে লেখে। অবাক করে দেয়াটাই নয়াদিল্লি আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর আধুনিকতম প্রমোদভবনের লক্ষ্য ও সার্থকতা। অনেক খরচে অনেক চমকে যন্ত্রের অনেক কৌশলে কাণ্ড বটে একখানা। কিন্তু গির্জা বানাবার প্রেরণা আর নেই। মানুষের মনই বদলে গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে আজব ছবিঘর বানাতেও মজুররা নেহাৎ পয়সার জন্য কাজ করবে, কাজ করে জীবন ধন্য মনে করবে না। যাদের হাতে মন্দির গড়ে উঠতো তারা জানতো সে-কাজ পুণ্যের। সেই পুণ্যেই মন্দির পবিত্র।

ভালোবেসে যা করি, আর যা করি নেহাৎই টাকার জন্য, কাজের এই দুই প্রকৃতি শুধু আলাদা নয়, পরস্পরের বিরোধী। ভালোবাসার কাজে শরীর আর মনের বিকাশ, নিছক রোজগারের কাজে বিনাশ। তার প্রমাণ আমাদের অনেককেই বোধহয় প্রতিদিনের জীবনে পেতে হয়। নিজেকে দিয়েই বলি। আমার এই লেখার কাজে আমি তীব্র আনন্দ পাই, যে-আনন্দ পাই, সে-আনন্দ কখনো যন্ত্রণার মতো। ঈশ্বর জানেন, যে-কাজে প্রতি মুহূর্তে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে তীক্ষ্ণ-সজাগ রাখতে হয় তার চেয়ে কষ্টের আর-কোনো কাজ নয়। আপিশের আট ঘন্টার ধরা-বাঁধা কাজে যে- পরিশ্রম, নিজের ঘরে বসে তিন-চার ঘণ্টা একটানা কিছু লেখাতে পরিশ্রম তার দ্বিগুণ, এ আমি শপথ করেই বলবো। এবং ঈশ্বর জানেন, এই লেখার কাজের কোনো আর্থিক অনুপ্রেরণা বাঙালি লেখকের অন্তত নেই। তবু কিছুদিন ধরে কিছু না-লিখলেই আমার মনে হয় জীবন যেন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। লম্বা মাইনেওয়ালা দশটা-পাঁচটার চাকুরে হবার সুযোগ যদি বা পাই, লুব্ধ হবো না এমন কথা বলিনে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো রাজি হবো না।

এর মূলে কি আছে আমার গর্বের ভাব? কিন্তু এই গর্বই বা কোত্থেকে আসে? পরিশ্রম অতি কঠিন, উপার্জন অতি ক্ষীণ; তবু এই গর্ব টেকে কিসের জোরে? নিশ্চয়ই কিছু আছে, যাতে পুষিয়ে যায়, যাতে ক্ষয়ের চেয়ে লাভ হয় বেশি। সেটা আর-কিছুই নয়, সেটা কাজেরই আনন্দ। ফরমায়েশি কাজের ক্লান্তি মনকে সহজেই আক্রমণ করে, স্বতঃস্ফূর্ত কাজের ক্লান্তি শুধুই শারীরিক। জীবনে আর খুব কম উপলক্ষই আছে, যাতে আমার মন এমন নিবিড় নিটোল খুশিতে ভরে ওঠে, যেমন হয় এক প্রস্থ লেখা শেষ করে উঠলে। ভারি সার্থক মনে হয় নিজেকে। লেখার আসল পুরস্কারটা তখনই হাতে-হাতে পাওয়া যায়, অন্য সব পরবর্তী ও প্রাসঙ্গিক।

সব কাজই এইরকম হওয়া উচিত। পৃথিবীর যন্ত্রযুগের আগে সকল পেশাই ছিলো ব্যক্তিগত, লিমিটেড কোম্পানির তাঁবেদার নয়। তখন জীবিকার সঙ্গে জীবনের (লরেন্সের একটি অপরূপ কথা চুরি করে বলছি) এই কঠিন বিরোধ ছিলো না। যে- কাজে উপার্জন সে-কাজেই ছিলো আনন্দ। ধরা যাক, ঘরে বসে নিজের খেয়ালমতো নানা রঙে ও ছাঁচে পুতুল বানাতে ফূর্তি কম নয়, এবং সে-পুতুল হাটে বেচে অন্ন- বস্ত্রেরও সংস্থান হতে পারে। এদিকে পুতুলের কারখানায় আট ঘণ্টা খেটে অন্নবস্ত্রের সংস্থানটা হয়তো বেশ ভালোরকমই হয়, কিন্তু তার নীরস ধূসর একঘেয়েমি মৃত্যুর মতো। এ-যুগ নিতান্তই · বৈশ্য যুগ, নেহাৎ জীবিকার জন্য পরিশ্রম এ-যুগেরই বিশেষত্ব। মানুষের পক্ষে জীবিকার ব্যবস্থা না-করলেই নয়, ইতর প্রাণীর তুলনায় মানুষের এই একটা মস্ত অসুবিধে। কিন্তু সে-ব্যবস্থা কি হতেই হবে নিষ্প্রাণ নিরানন্দ ব্যক্তিত্ব-স্পর্শহীন? কাজকে আমরা আজকাল বন্ধন বলে ভাবতে শিখেছি, কিন্তু কাজেই তো মানুষের মুক্তি, যদি কাজের মতো কাজ হয়। আদর্শ সমাজ-সংগঠনের প্রধান শর্তই এই যে তাতে মানুষের উপার্জনের সঙ্গে আনন্দের সংগতি থাকবে। পৃথিবীতে নানারকম মানুষের জন্য নানারকম কাজ থাকতে বাধ্য, তার মধ্যে ছোটো- বড়ো ভেদও অনিবার্য, কিন্তু যদি হয় ব্যক্তিগত ও স্বতঃস্ফূর্ত, কোনো কাজ‍ই তাহলে হীন হয় না। আর আজকাল বড়ো কাজও প্রায়ই হীন। কেননা সব কাজই প্রায় অন্যের কাজ। যত ক্ষুদ্রই হোক, এ-কাজ আমার এটা ভাবতে পারলেই মুক্তি। পঁচিশ টাকার কেরানি আর হাজার টাকার আমলা— হীনতা উভয়েরই সমান। দু-জনেই পরের কাজে নিযুক্ত। কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সত্তা স্বীকার্য নয় কারুরই। এর ফলে কাজও নষ্ট হওয়া উচিত; তবে বখশিশের লোভে-লোভে কাজ যদি বা আদায় হয়, মানুষগুলো যে নষ্ট হয় এটা নিশ্চিত।

আমার লেখার কাজের মস্ত সুবিধে এই যে তাতে বেশ একটা খেলার ভাব আছে। রবীন্দ্রনাথের শিশু ভুল বলেনি; লেখা ব্যাপারটা আসলে লেখা-লেখা খেলা। এখানে অনেকটা যেন আছে শিশুর খেলার স্বাধীনতা। আমি ইচ্ছেমতো বিষয় নির্বাচন করতে পারি, এবং এটা মানতেই হবে যে বিষয়ের ভাণ্ডার অপরিসীম। তারপর এই কথাগুলোকে যদি খেলনা মনে করা যায়, সেগুলো নিয়ে যেমন খুশি নাড়াচাড়া ভাঙাগড়া করি, ভালো না-লাগলে ফেলে দিই, দরকার হলে নতুন তৈরি করে নিই— মোটের উপর সমস্ত জিনিশটাকে নিজের পছন্দমতো একটা রূপই দিই।

সমস্ত কাজেই এই খেলার ভাব খানিকটা থাকা দরকার। আর এই খেলার ভাব আসলে সকল কাজেই কিছু-না-কিছু আছে; কিন্তু সেটা আধুনিক সভ্যতা খুব নিপুণ হাতেই ছেঁটে ফেলে, তার বদলে চালায় কর্তব্য ও দায়িত্বের স্থূল নিশ্চল ভার। মনে করুন, মস্ত একটা জাহাজ বানাবার চাইতে অদ্ভুত উত্তেজক খেলা আর কী হতে পারে? অনায়াসে সমস্ত লোককে ডাক দিয়ে বলা যায় : এসো ভারি একটা মজার খেলা খেলবে। কিন্তু এই সভ্যতা ডাক দেয় এই বলে : এসো তোমাদের বেকার জঠরে কিছু রুটি-মাংস চালান করি। দলে-দলে লোক ছুটে আসে পেট ভরাবার টানে; তারা দেখে জাহাজকে তাদের খাদ্যদানের যন্ত্র, দেখে না জাহাজ অপরূপ কোনো বিশাল পাখির মতো জল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দিগন্তের সমুদ্রের দিকে চলেছে। যে- জাহাজ তাদের নিয়ে যেতে পারতো মুক্তির মোহানায় তা হয়ে রইলো নিতান্তই রুটি-মাংসবাহী মালজাহাজ।

ভুবনেশ্বরে চারদিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিলো, মন্দির বানানো ছিলো এ-দেশের লোকের উদ্দাম আনন্দের খেলা। তাতে কোনো দায় ছিলো না, ছিলো না কোনো ভাবনা; যেমন আমরা গুনগুন করে গান করি অবসরের সোনালি সময়ে, তারপর তা-ই থেকে ফুটে ওঠে নতুন বিচিত্র সুর, তেমনি এদের রঙিন আলস্যের লীলা পাথরের অপরূপ ছন্দে। বিশেষ ও নির্দিষ্ট কোনো সংকল্পের ফলে একটি তাজমহল হয়, কিন্তু তার পিছনে যদি থাকতো এই চিন্তাহীন খেলার হাওয়া তাহলে তার আশেপাশে হাজার ছোটো ছোটো ভাঙাচোরা তাজমহল গড়ে উঠতো। তাজমহল একজনের, এই মন্দিরগুলো সকলের। শিল্পসৃষ্টি অত্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার; কিন্তু সে-আনন্দের ভাগ সমস্ত জাতিকে এক স্থাপত্যই বুঝি দিতে পারে। যারা হাত দিয়ে কাজ করে না, তারাও মন দিয়ে যোগ দেয়। একদা ভারতবর্ষের দক্ষিণাপথে নিশ্চয়ই কোনো বিশাল সর্বব্যাপী অনুপ্রেরণা এসেছিলো, তারই হাওয়ায় ফুটেছে পথের ধারে ধারে বসন্তের ফুলের মতো এত অজস্র মন্দির। এই অজস্রতা দেখেই অবাক লাগে ভুবনেশ্বরে। এখানে আকাশে-বাতাসে পুঞ্জ-পুঞ্জ পাষাণের নীরব বন্দনা। কোনো রাজার দেবশক্তির সাড়ম্বর বিজ্ঞাপন নয় এখানকার মন্দির। সরল নির্মল নির্মম এই ভুবনেশ্বরের মন্দির, তাতে কোনো অলংকারের উপসর্গ নেই, সোনামণিমুক্তার প্রগলভতা থেকে এ আশ্চর্যরকম মুক্ত। দেবতার মহিমা মহামূল্য বিশাল সামগ্রীতে প্রকাশ পাবে, এ নিতান্তই গ্রাম্য মনের কথা। এই গ্রাম্যতায় হিন্দুর অনেক মন্দিরই পীড়িত। ভুবনেশ্বরে তার চিহ্নমাত্র দেখলুম না। ঠাণ্ডা কালো কষ্টিপাথরের নগ্ন মূর্তিগুলো কারুরচনায় আর মুখশ্রীর অপূর্ব ব্যঞ্জনায় এতই সুন্দর যে দেখেই মনে হয় তারা ঐশ্বর্যের ঘোষণা নয়, ভালোবাসার প্রকাশ। যে-নির্জনে দেবতার ঘুম ভাঙে সেই নির্জনতা এখানকার সুর। তাছাড়া, তীর্থ যত বড়ো, পাপের আস্তানাও তত বড়ো এইটেই সাধারণত দেখা যায়। দেবতা যেখানে জাগ্রত, সেখানে বেশ্যা, গুণ্ডা, জোচ্চোর, ভিক্ষুক, ব্যাধিগ্রস্ত— এরাও ঘুমিয়ে নেই। পুরীর মন্দিরের আশেপাশে হাটবাজার, ধুলো, নোংরামি, চ্যাঁচামেচি, ভিড়ের ঠেলাঠেলি— সবই হয়তো সহ্য করা যেতো, যদি এতৎসত্ত্বেও তার শিল্পরূপ হতো সার্থক। জগন্নাথদেবের গৃহ বিশাল বটে, কিন্তু বিশালতাই বোধহয় তার একমাত্র অভিজ্ঞান; তাছাড়া কোনোরকম আকর্ষণই নেই। আমাদের অভিরুচি সরল নির্মল ভুবনেশ্বরেই। ভুবনেশ্বরে ভিড় নেই। চারদিক পরিষ্কার, চারদিক চুপচাপ। এই ছোট্ট গ্রামে মানুষই বা কত, আর স্থায়ী বাসিন্দারা প্রায় সকলেই কোনো-না-কোনোভাবে মন্দিরের সঙ্গেই যুক্ত। জিনিশের বেচাকেনায় প্রাচীন পৃথিবীর মন্থরতা; যদিও দু-মাইল দূর দিয়ে রেল-লাইন গেছে, আধুনিক ব্যবসার তাড়াহুড়োর ধাক্কা এখনো এসে যেন পৌঁছয়নি। চারদিকের প্রশান্তির মধ্যে মন্দিরের গম্ভীর অভীপ্সা আকাশে উদ্যত; আর সেদিন সকালে পরিচ্ছন্ন মন্দিরপ্রাঙ্গণের এককোণে বসে চারদিকে তাকিয়ে যেন মনে হলো কোনো চিরন্তন সকালবেলার একটি সুর এখানে ধরা পড়েছে; এখানে আটকে রয়েছে যে- সুর, এ-যুগের পৃথিবীতে তা আর নেই, নেই আমাদের জীবনে, আমাদের আলস্যে কি স্বপ্নেও নেই। প্রগতির চাকায়-চাকায় পৃথিবী এগিয়ে চলে গেলো, তার টান এখানে যেন লাগলো না, এখানে রইলো কোনো সুগন্ধি অতীত চিরকাল হয়ে।

বৃষ্টি কেটে গেছে,
আকাশে ছেঁড়াখোঁড়া শাদা মেঘ,
রোদের ঝিলিমিলি তার ফাঁকে।

বাতাসে প্রথম শীত,
বাতাসে ধার;
দিঘির নীল জল উঠছে শিরশিরিয়ে
যেন কোনো হৃদয় ভালোবাসার ভার আর সইতে পারছে না।

বৃষ্টি কেটে গেছে।

আমরা স্নান করে এসেছি
আঁকাবাঁকা গ্রামের পথ দিয়ে,
দু-দিকে মাঠ দিগন্ত ছোঁয় ছোঁয়,
মাঝখানে ঠাণ্ডা জলের ঝরনা,
আর পায়ের নিচে কাঁকর।

বৃষ্টি কেটে গেছে।
আমরা ডুব দিয়েছি ঝরনার জলে
ঝরনার উৎস-মুখে;
ফুলের মতো মেলে দিয়েছি আমাদের শরীর
এই নতুন শীতের নতুন সূর্যের দিকে।

এই নতুন-নীল আকাশের দিকে
চারদিক থেকে উঠেছে হাজার মন্দিরের চূড়া,
মাঝখানে নির্মম ভুবনেশ্বর।
বৃষ্টি কেটে গেছে,
আমরা স্নান করে এসেছি।

সমুদ্র আর দূরে নয়,
আজ বিকেলে আমরা সমুদ্রের কাছে গিয়ে দাঁড়াবো।
আর আজ এই নতুন সূর্যের আলোয়
হাজার মন্দিরের পাথরের ছন্দে
একটি প্রার্থনা আমরা এঁকে গেলাম
একটি প্রার্থনা আমরা রেখে গেলাম

—তারপর সমুদ্র।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন