আমি চঞ্চল হে – ৬

বুদ্ধদেব বসু

সন্ধের পর সমুদ্রের ধারে বড়ো মন-খারাপ লাগে। নিঃস্পন্দ নীরন্ধ্র অন্ধকার, আর হু-হু হাওয়া, আর একটা নামহীন দুর্দান্ত আতঙ্কের মতো সমুদ্র। তখন ঘোর কৃষ্ণপক্ষ। গভীর, গভীর রাত্রে অসুস্থ পীত চাঁদ ছায়ার মতো ফ্যাকাশে আলো মেলে দিতো আকাশে। সন্ধেবেলাটা অন্ধকারে থমথমে। হয়তো শহরের দিকে গিয়েছিলুম, সরু রাস্তা দিয়ে আসতে-আসতে হঠাৎ এক সময়ে সমুদ্রের শব্দে বুক কেঁপে উঠলো রাস্তা ছেড়ে বীচে এসে পড়লুম; অন্ধকার সমুদ্র প্রলয়ের জলরাশির মতো ভয়ংকর। ভালো করে কিছু দেখা যায় না, শোনা যায় ভীষণ গর্জন; বুঝি কোনো অনুচ্চারণীয় সর্বনাশ দাঁত বার করে ছুটে আসছে। মন চায় তখন ঘর, চায় অভ্যাসের আরাম, চায় চারদিকে শক্ত দেয়ালের নিশ্চিন্ততা। টর্চ জ্বেলে-জ্বেলে এগিয়ে চলি, দুরে হোটেলের পেট্রোম্যাক্সে সাধারণ অভ্যস্ত জীবনের আশ্বাস। হারিকেন লন্ঠনের আলোয় ঘরে বসে আছি : সবে সন্ধে হলো, এখনই যেন মধ্যরাত্রি। এসো কিছু পড়ি। এসো চিঠি লিখি। কিছু কাজ নেই। ভয়াল একটা দুরন্ত উপস্থিতির মতো সমুদ্র, হাওয়াটা কান্নার মতো, অন্ধকার যেন মৃত্যুর হাঁ-করা দরজা। হাওয়ায় উড়ে চলছে জোনাকির পাল। সমুদ্রে স্ফুরজ্যোতি পতঙ্গদল থেকে-থেকে ঝিলকিয়ে উঠছে। আমরা বসে আছি চুপ করে।

এই সময়টাতেই কলকাতার কথা মনে পড়ে। প্রকৃতির কোনো মহান প্রকাশের খুব কাছাকাছি থাকা উচিত নয় বোধহয়। অতি প্রবল তার প্রভাব, তার চাপে আমদের মন যেন অভিভূত, আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কলকাতায় আমাদের প্রকৃতিসেবন যেন দাগ-কাটা ওষুধ খাওয়া— সেটাও নিয়মিত ঘটে না, ঘটে দৈবাৎ—আর তা-ই সবচেয়ে ভালো কিনা কে জানে। মানুষের মনের কতগুলো মূলগত সংস্কার আছে, কতগুলো প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসে তার জীবনের ভিত্তি। আমরা কাজ করি, আমরা গল্প করি; আশা আর যুদ্ধ আর শান্তি নিয়ে আমাদের জীবন। কতগুলো জিনিশের মূল্য আমরা ধরেই নিই, তা-ই নিয়ে বাঁচি। কিন্তু রাত্রির অদৃশ্য-কল্লোলিত সমুদ্রের মুখোমুখি, মুহূর্তে সে-সব মূল্য হারিয়ে যায়; শূন্য, শূন্য হয়ে যায় মন; কিছু নেই, জীবনে কিছু নেই; আমি ব্যর্থ, আমি নিঃসঙ্গ। কলকাতায় আমার সত্তা নিশ্চিত সেখানে আমার সব চেষ্টার আর যুদ্ধের মূল্য নিঃসংশয়ে গৃহীত; সেখানকার বাড়ি আর রাস্তা আর রাস্তার মানুষই সেই মূল্যস্বীকারের প্রমাণ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমার একটা ‘মানে’ আছে। সন্ধেবেলা ঘরে বসি, আসে বন্ধুরা, স্রোতের মতো পরস্পরের মধ্যে আমাদের সঞ্চার; পরস্পরকে আমরা উদ্দীপিত করি, উজ্জীবিত করি; পারস্পরিক বিশ্বাসে আত্মবিশ্বাস নিবিড় করি; এইটে ভালো করে বুঝি যে আমি আছি, এবং সেই থাকাটা সার্থক। কিন্তু রাত্রির এই অন্ধকার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে একটা হতাশা এই উদ্দাম হাওয়ার মতো হা-হা করে ওঠে— আমি নেই, আমি নেই। এই আকাশ আমাকে গ্রাস করেছে, এই অন্ধকার আমাকে গিলে ফেললো, আমাকে ছিনিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলো হাওয়া। কালো-কালো ডাকাতের মতো কালো ঢেউগুলো এলো হৈ-হৈ করে, দরজা ভাঙলো বুঝি, লাফিয়ে উঠলো ওরা হোটেলের ছাদে, লুঠ করে নিয়ে গেলো সব, নিচের তলায় পেট্রোম্যাক্স- জ্বালানো এই ভদ্র চেহারার বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গেলো অন্তিম সর্বনাশের বন্যায়। রাত্রে সমুদ্রের জোর আরো বাড়ে কিনা জানি না, হতে পারে সেটা আমাদের মনেরই প্রতিচ্ছবি, কিন্তু সত্যি এক-এক সময় মনে হয় সমুদ্র বুঝি লাফিয়ে একেবারে ঘরের মধ্যে উঠে এলো। মনের যে-সব কোণ দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিজের সত্তা আমরা অনুভব করি, সব নিঃশেষে হারিয়ে যায় : নিছক জৈবপ্রাণটা অঙ্গহীন চর্মহীন আদিম জেলিমাছের মতোই অসহায়ভাবে পড়ে থাকে। স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে, যখন ঠাকুর রাত্রের খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে। ঐ খাওয়াতেই যেন ফিরে পাই নিজের সুস্পষ্ট-নির্দিষ্ট সংজ্ঞাসম্ভব মনুষ্যতা।

বিশ্বসৃষ্টির পটভূমিকায় মানুষের সকল কাজই নগণ্য। কথাটা এতই সত্য যে ধরা বুলিই বলা যায়। এটা দর্শন কি বিজ্ঞানের নয়; সাধারণ মানুষের নিত্য অভিজ্ঞতার কথা। কেননা এমন মানুষ পৃথিবীতে বোধহয় কমই জন্মেছে যে তার জীবনের কোনো-এক দিনে আকাশ-ভরা তারার দিকে তাকিয়ে নিজের তুচ্ছতার উপলব্ধিতে অভিভূত হয়ে পড়েনি। কিন্তু সে-উপলব্ধি ক্ষণিক, ধন্যবাদ ঈশ্বরকে। তা না-হলে উপায় ছিলো না। শঙ্করাচার্য জীবনের সর্বব্যাপী ব্যর্থতা উপলব্ধি করলেন, কিন্তু সেই উপলব্ধি প্রচার করবার প্রকাণ্ড ব্যর্থতা তো বুঝতে পারলেন না। মায়ার বশ আমরা সকলেই। যে-মানুষ সন্ন্যাসী হয়, সমস্ত জিনিশের অনিত্যতাই তার মনে ধরা পড়ে; শুধু তার ঐ নির্জন তপস্যার পরম অনিত্যতার বোধ কেমন করে তাকে এড়িয়ে যায় সে আশ্চর্য। যদি কোনো মানুষ সত্যি-সত্যি কখনো তার নিজের অপার অর্থহীনতা সর্বাঙ্গীণভাবে উপলব্ধি করে, তার একমাত্র ন্যায্য পরিণাম হচ্ছে আত্মহত্যা। সে-রকম প্রায় হয়ই না, আর যদি বা হয়, সে-মানুষকে আমরা মহামানব বলে শ্রদ্ধা করি না, উন্মাদ বলে করুণা করি। প্রকৃতির যে-অদম্য প্রেরণা পৃথিবী নামক গ্রহে প্রাণ নামক আশ্চর্য সংঘটন সম্ভব করেছে, তারই একটা কারসাজি এই যে নিজের তুচ্ছতার এই উপলব্ধি নিম্নপ্রাণীতে একেবারে আসবেই না, আর পূর্ণবুদ্ধি জীবেরও হবে আংশিক ও ক্ষণিক। একটা-না-একটা বিশ্বাস আছে সকল মানুষেরই জীবনে; অনেক বিষয়ে মোহমুক্ত হয়েও কোনো-না-কোনো জায়গায় প্রকাণ্ড একটা মোহ আমাদের আছেই আছে। সেই মোহই আমাদের জীবনের মূল ভিত্তি; সেটা না-থাকলে বাঁচতে পারতো না কেউ। যেমন আমি সাহিত্যরচনা সম্বন্ধে মনে-প্রাণে আস্থাবান। শেয়ারের দালালের কাছে, খেলোয়াড়ের কাছে, ‘সোসাইটি’র মেয়ের কাছে এই সাহিত্যরচনা ব্যাপারটা একেবারে অর্থহীন। তাতে অবিশ্যি আমার কিছু এসে যায় না, ঐ সব মানুষদের অবজ্ঞা করে আমি নিশ্চিন্ত, নিজের মোহের মধ্যে সম্পূর্ণ আমি। তবু যদি কখনো ভেবেই দেখি, সমস্ত জীবন ভরে আমি যতই লিখি না কেন, আয়ু যেদিন শেষ হবে সেদিন মরবোই, আর সূর্য যেদিন নিবে যাবার সেদিন যাবেই, আর সেই তো একদিন হবে পৃথিবীর শেষ। এ-ধরনের ভাবনা সচরাচর মনে আসে না, সে-জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনে। আর যখন আসে, সে নিতান্তই ক্ষণিক। তারপর আরো ভাবা যায় : আমাদের এই সূর্যমণ্ডলের নির্বাপণ সমস্ত সৃষ্টির বিচারে একটা দেশলাইয়ের কাঠির জ্বলা-নেবার মতো : মনে করো প্রতিটি তারা একটি সূর্য, আমাদের সূর্যের অনেক হাজারগুণ বড়ো— আর তাও সবসুদ্ধ ক-টাই বা মানুষ জানতে পেরেছে, সবচেয়ে জোরওয়ালা দূরবীক্ষণের নাগালের বাইরে আরো কত আকাশ, আর কোটি-কোটি সূর্যের পুঞ্জ পুঞ্জ উপনিবেশ। আর আমার লেখা, হায়রে!

যদি পুরী হতো য়োরোপের কোনো শহর, তাহলে এই ব্যর্থতাবোধ নিয়ে বিলাস করবার কোনো সুযোগ অবশ্য হতো না। তাহলে জ্বলে উঠতো বীচের প্রান্ত থেকে প্রান্ত কড়া ইলেকট্রিক আলোয়, ভরে যেতো আকাশ আমোদলোভীদের কোলাহলে, এখানে ভোজ ওখানে নাচ-বাজনা ইত্যাদি; রইলো সমুদ্রের স্বাস্থ্য, রাজধানীর প্রমোদসুলভতাও বাদ গেলো না। একা লাগবে এমন ফাঁক কোথায়; মন খারাপ করবো এমন সময় নেই। অনেকেই হয়তো খুশি হবেন, পুরী যদি হঠাৎ একদিন ও-রকম হয়ে যায়। বাকি পৃথিবীর চাইতে আমরাও কম ‘আধুনিক’ নই। হয়তো এটাও সত্যি যে বালুর উপর দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটতে-হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ হাতের কাছে একটা ভদ্রগোছের সরাইখানা জুটে গেলে ভালোই লাগে। উল্লসিত হতাম, যদি সমুদ্রের ধারে শুয়ে সমস্তটা দিন কাটিয়ে দেবার উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকতো। কিন্তু সে-উল্লাস স্বভাবতই অনেক হ্রস্ব হয়ে আসে, যখনই ভাবি যে সে- রকম ব্যবস্থা থাকলে সকলেই তার সুযোগ নিতো; এবং সমুদ্রতীর যদি ক্লাইভ স্ট্রিটের মতোই মানুষে কিলবিল করে, তবে আর সেখানে শুয়ে থাকবার মজাটা কোথায়? সকলেই যখন একসঙ্গে বীচে শুয়ে সময় কাটাতে আরম্ভ করে, তক্ষুনি দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর।

গণ-মনের প্রধান লক্ষণই এই যে অন্য সকলে যা করে তা-ই করতেই ভালোবাসে। জড় হোক, মৃত হোক, এই ধরনের মনের একটা সুবিধে এই যে কিসে সে সুখী হবে তা সে নির্দিষ্টভাবেই জানে, সুতরাং সাধ্যমতো সে-সুখের অনুধাবন ও করতে পারে। ফুটবলের মাঠে আর পোলিটিকাল সভায় গিয়ে যারা হৈ-চৈ করে, আমেরিকান সিনেমা আর য়োরোপীয় পানীয়ে যাদের সন্ধ্যাযাপন ছাঁচে-ঢালা, এটা মানতেই হবে যে জীবনটা তাদের পক্ষে তত বড়ো সমস্যা নয়। কতগুলো অভ্যাসের সুক্ষ্মযন্ত্রে ঘুরছে তাদের দিন আর রাত্রি; তারা যেখানেই যাবে নিয়ে যাবে সেই অভ্যেসগুলোকে। সুতরাং আজকাল দেখা যায়, যে-সব জনপদকে প্রকৃতিই অপরূপ করে রেখেছে, তাকেও সম্পূর্ণ করেছে মানুষের পানাশালা, ক্রীড়াক্ষেত্র আর প্রমোদভবন— আর হোটেলে চরম আরামের ব্যবস্থা— রাজধানীতে যেমন জীবন কাটাই, তিনদিনের ছুটিতে বেড়াতে এসেও ঠিক তেমনটি চাই, হিমালয় কি সমুদ্র যেন ভাড়াটে খুশিকরনেওয়ালা— আমরা যতক্ষণ নাচবো কি খেলবো কি ফ্লার্ট করবো, ওরা অপেক্ষা করতে পারে। কী আশা করতে হবে, তা তারা নিশ্চিত জানে; এবং যা তারা আশা করে তা তারা পায়।

স্বীকার করবো, এ-সুবিধে আমার নেই। বহুলতম প্রচারিত আমোদগুলির প্রতি আমার স্বাভাবিক ও অনতিক্রম্য বিতৃষ্ণা। ভোজ যদি বা কখনো হয় লোভনীয়, সার্বজনীন মহোৎসবে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে পাত পেড়ে বসে যাওয়ার চিন্তাই আমার পক্ষে অসহ্য। ফলে আমাকে দুঃখ পেতে হয় বেশি। আমার নিজের খুশি নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়, এবং মনের হাওয়া সব সময় অনুকূল বয় না। কত সময় অকারণে মনখারাপ করে বসে থাকি। মনে হতে পারে সেটাই মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষ যাতে কখনোই মনখারাপ না করে, সেজন্যে আজকালকার বাজারে কত রঙিন মোড়কের ফূর্তি সাজানো

কিন্তু এ-ও বলি, মানুষের কি মাঝে-মাঝে মনখারাপ করবার অধিকারও নেই? সুখ তো আমাদের পরের হাতে চলেই গেছে, দুঃখী হবার স্বাধীনতাও কি আমাদের থাকবে না? বুকের ভিতর থেকে যেই একটা দীর্ঘশ্বাস উঠলো, অমনি কি গিয়ে বসতে হবে ছবিঘরের ঘেঁষাঘেষির মধ্যে টিকিট কিনে, কি হুইস্কির গেলাশ সামনে নিয়ে ক্যাবারে নাচের ঊরু-প্রদর্শনীতে? কি এই পুরীর হোটেলে সন্ধেবেলাটা যদি ‘ডাল্’ লাগে, বসে কি যেতেই হবে লন্ঠন জ্বালিয়ে একশোয় একআনা হারে ব্রিজ খেলতে? যে-দুঃখ বাস্তব নয়, যে-দুঃখ একটা বিলাস, মনের একটা মেঘ-মায়া, তাকে এত ভয় কেন? সেটাকেই রসিয়ে চেখে দেখা যাক না, সেটাও তো একটা অভিজ্ঞতা। দুঃখেও তো কম রোমাঞ্চ নেই— বিশেষ, সে-দুঃখ যদি হয় পরোক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক। ট্র্যাজেডি আমরা পড়তে ভালোবাসি সে কি ঠিক এই কারণেই নয় যে তাতে আমরা দুঃখের রোমাঞ্চটা সম্পূর্ণই পাই, আঘাতটা একেবারেই পাই না। এ- ও তো তেমনি, এই যে অন্ধকার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনটা হু-হু করে ওঠে— এই অনুভূতিটাকে ধ্বংস করার জন্যে হাজার আয়োজন কি না-করলেই নয়? মনে-মনে গুমরোনো খারাপ, আধুনিক বিজ্ঞানের এইরকম একটা কথা আছে, সেটা ‘সুস্থ’ নয়। এবং যাতে আমরা একা-একা মনে-মনে গুমরে পীড়িত হয়ে না পড়ি, তার জন্যেই আধুনিক সভ্যতার এই বিরাট বাণিজ্য-আয়োজন। সে-জন্যে অবিশ্রান্ত অফুরন্ত উপকরণ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু একটা সন্ধ্যা তাসের জুয়ো খেলে, কি একটা দিন ঘোড়দৌড়ের জুয়ো খেলে কাটানো— সেটা কোনরকমের ‘স্বাস্থ্য’ তা-ও তো জানিনে। আর তাছাড়া, মনে-মনে গুমরোনোটাই বা এমন কী খারাপ? ভেবে দেখতে গেলে, তা থেকেই তো সমস্ত আর্টের সৃষ্টি। তা থেকে আমাদের মনে নানা রঙের ভাবনা আসে— কিন্তু ঐ ভাবনাটাতেই তো আপত্তি। পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক একেবারেই ভাবতে চায় না। এবং যাতে তাদের ভাবতে না হয়, সে-জন্যে তারা এই সমুদ্রের ধারে এসে আর-কোনো উপায় না পেলে হারিকেন লন্ঠন জ্বালিয়ে তাস খেলেই সমস্তটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দেবে। যাতে মানুষকে ভাবতে না হয় তার অসংখ্য বিচিত্র ব্যবস্থা যন্ত্র সম্ভব করেছে। এবং তারই নির্ভরে পৃথিবীর বেনেদের কোটিপতিত্ব। তোমরা মনখারাপ কোরো না, আমাদেরকে অনেক জিনিশ বেচতে হবে। আমাদের সব জিনিশ কেনো : ভাবনার দায় থেকে বাঁচবে। সেই যে ইংরেজ কবি বলে গিয়েছেন ‘এ পৃথিবীতে ভাবতে গেলেই দুঃখ’, এই কথার উপরে ভর করেই বিংশ শতাব্দীতে বাণিজ্যের এই আশ্চর্য স্ফীতি।

বহু ধন্যবাদ ঈশ্বরকে, পুরী য়োরোপের কোনো শহর নয়। যে-সমুদ্রতীরে আগাগোড়া তাল-পাকানো, খোসা ছাড়ানো মনুষ্যতার পিও সেখানে নিজেকে কল্পনা করে কোনোই সুখ পাইনে। মনুষ্যতার দৃশ্য ও সংস্পর্শ এড়াবার জন্যেই মাঝে-মাঝে আমরা বাইরে আসি। কলকাতা থেকে রুদ্ধশ্বাস হয়ে পালিয়ে চলে আসি— কলকাতারই আর-একটি প্রতিকৃতি দেখবার জন্যে নয় নিশ্চয়ই? এখানেও কি সেই সব নগর-ধূসর মুখ, আর নগর-মৃত কথা, আর নাগরিক উল্লাসের অশ্লীল সুড়সুড়ি? ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন। কলকাতায়, বাড়িতেই আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নই, আমাদের নির্জনতা অক্ষত নয়। যাতে সম্পূর্ণরূপে একা হতে পারি, সেজন্যেই বেরোতে হয় ঘর ছেড়ে। এখানে নির্জনতা। এখানে অন্ধকার। এখানে শান্তি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন