বুদ্ধদেব বসু
সেদিন আমার এক মফস্বলবাসিনী আত্মীয়া আমাকে বলছিলেন :
‘কলকাতায় কী করে থাকো! এই তো খাঁচার মতো ফ্ল্যাট, চলতে-ফিরতে গায়ে- গায়ে ঠোকাঠুকি। ধোঁয়া। ধুলো। অসুখ। খরচ। খাওয়ার জিনিশের যা দাম। তবে হ্যাঁ— কাপড়-চোপড় পাওয়া যায়।
প্রতিটি কথাই সত্য, অনস্বীকার্য। কলকাতার বাতাসে বিষ, অন্নে বেরিবেরি, জলে টাইফয়েড, ও দুধে জল। এখানে আমাদের অধিকাংশের জন্যে যে-আকারের ও যে-রকমের বাড়ি জোটে তা দেখে মফস্বলবাসীর হাসিই পায়; এবং তার জন্যে যে-ভাড়া দিতে হয়, মফস্বলের কোনো গ্রাম্য শহরে তা দিয়ে খোদ মাজিস্টরের কুঠি দখল করা যায়। এই ঘনমেঘে একমাত্র রুপোলি রেখা যদি এই হয় যে এখানে দোকানে-দোকানে বস্ত্রের বৈচিত্র্য, আমার মনে অবিশ্যি সেটা কিছুমাত্র রেখাপাত করতে পারে না।
তবু আমরা কলকাতায় থাকি, থাকতে ভালোবাসি, কলকাতা ছাড়া অন্য-কোথাও থাকবার কথা ভাবতে পারিনে। ‘আমরা’ মানে এখানে আর-কেউ হোক আর না- ই হোক, আমি নিশ্চয়ই। আমার মতোই কলকাতা-প্রেমিক আরো অনেকে হয়তো আছেন, তবু নিজের হয়ে কথা বলাই ভালো।
নিজের কথাই বলি। কলকাতায় গৃহ সংকীর্ণ, রোগ, আহার্য দুর্মূল্য ও (এটা আমার আত্মীয়া উল্লেখ করতে ভুলে গেছলেন) আকাশের তারা দুর্লভদর্শন; তবু কোনো প্রলোভনে আমি কলকাতা ছেড়ে যাবো না। আছে আমার মনে কলকাতার এক মোহ, যেটা কাটিয়ে ওঠা আমার পক্ষে কিছুতে সম্ভব নয়। কী এই মোহ? কলকাতার এই অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের গোপন রহস্য কোনখানে? কেন, এত সব স্পষ্ট ও অনুপেক্ষণীয় অসুবিধে সত্ত্বেও কলকাতাকেই আমি ভালোবাসি
কেন? জানিনে। কেউ জানে না। কলকাতায় যারা থাকে তারা থাকে, বাইরে মন টেঁকে না। তেমনি, মফস্বলে যারা থাকে, কলকাতায় এসে থিয়েটার বায়োস্কোপ ও মনোহর বস্ত্রবিপণী সত্ত্বেও সাতদিনেই ওঠে হাঁপিয়ে। এ হচ্ছে নিছক শারীরিক কতগুলো অভ্যাসের বৈষম্যের কথা।
কথাটা যদি একমাত্র এ-ই হতো তাহলে এ-নিয়ে কোনো আলোচনারই ক্ষেত্ৰ থাকতো না। কিন্তু সত্যি, ব্যাপারটা কী হয়? কখনো ভেবে দেখিনি, কিন্তু ভেবে দেখবার মতো এটা। ধরা যাক, এত সব পার্থিব ক্লেশ সত্ত্বেও কলকাতার উপর কেন আমার এই অনাক্রমণীয় অনুরাগ? এমন-কোনো লাভ— অন্তত লাভের সম্ভাবনা— নিশ্চয়ই আছে, যাতে ও-সমস্ত পুষিয়ে গিয়েও বেশি হয়। কী সেটা? সেটা কি এই যে এই রাজধানী কালচারের কেন্দ্র, এবং যেহেতু আমি কিনা মগজওয়ালা মানুষ, এখানকার অনুশীলন কি হাওয়ার বাইরে গেলেই ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি খেতে থাকি? নাকি এই যে আমি পার্থিব উচ্চাশায় প্রণোদিত, এবং এটা তো সবাই জানে যে বুদ্ধির জোরে যে বড়লোক হতে চায় তার পক্ষে কলকাতা ছাড়া জায়গা নেই। কিংবা হয়তো তারই আকর্ষণ আমার পক্ষে সব চেয়ে বড়ো, খুব সংক্ষেপে যাকে বলা যেতে পারে ‘ফূর্তি’? মানে, বিশেষ এক রকমের ফূর্তি, যার ইংরিজি নাম গুড টাইম, ভোজ, গীতনৃত্য, আলাপের ভাষাবিলাস, হৃদয়ের প্রজাপতিবৃত্তি ও অন্যান্য স্বাদু আনুষঙ্গিক নিয়ে যার রচনা। এবং এ-সমস্ত স্বাদবৈচিত্র্য বারো মাস এত বেশি পরিমাণে কলকাতার মতো আর কোনোখানেই পাওয়া যায় না, এ তো সবাই জানে।
তিনটেই হয়তো, কে জানে। মনের পাপ গোপন করে লাভ নেই : স্বীকার করাই ভালো যে মাঝে-মাঝে ফূর্তির একটু-আধটু ঝাপটা মন্দ লাগে না আমার— মানে, ভাবতে মন্দ লাগে না। কিন্তু সেই ভাবনা যদি কখনো বাস্তব রূপ ধরে, তাহলে দেখা যায় কল্পনার এই রসোপভোগ ঠিক যেন উৎরোচ্ছে না, যেন বিরক্তই লাগছে, যেন ঠেকছে অর্থহীন। এ একটা বস্তু যা নিয়ে ভাবতেই ভালো, ভাবনা অনুযায়ী তৈরি করতে গেলে সমস্তটা বিরস হয়ে ওঠবার আশঙ্কাই বেশি। জীবনের ফূর্তির মুহূর্তগুলো ফরমায়েশ মানে না, নিজের খেয়ালে তাদের গতি। হাত বাড়িয়ে ধরা যায় না তাদের, তারা আসে।
কল্পনা ছেড়ে বাস্তবে এলে দেখা যাবে নাগরিক জীবনের এ-সমস্ত সংগতি আমার পক্ষে কোনো আকর্ষণই নয়। আমার পক্ষে শহরের সব চেয়ে লোভনীয় যে- জায়গা সে হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের কোনো গলির বিশেষ একটি বাড়ি— এবং সেই বাড়িরও বিশেষ একটি ঘর। সে-বাড়ি আমার এই অর্থে যে আমি তার ভাড়া দিই; সে-ঘর আমার এই অর্থে যে আমি সেখানে থাকি। সেই ঘরে কাটে আমার দিনরাত্রির অধিকাংশ; ঘর থেকে যখন বেরোই হয় অর্থাগমের নয় অর্থব্যয়ের উদ্দেশ্যে। দু-ই আবশ্যিক কর্তব্য। সিনেমার প্রতি আমার অনাসক্তি ইতিমধ্যে বহুবার বহুভাবে প্রকাশ করেছি; এবং যেহেতু চার্লি চ্যাপলিন তিন বছরে একটার বেশি ছবি তৈরি করেন না, আমার সিনেমা গমনও প্রায় সেই হারে এসে ঠেকেছে। এককালে থিয়েটার ভালোবাসতুম, কিন্তু শিশির ভাদুড়ীর (অন্যান্য থিয়েটারের কথা ধরছিইনে) কতগুলো ‘নবতম অবদান’ আশ্চর্যরকম ‘কৃত হয়ে সে-ভালোবাসা আমার মন থেকে ঠুকরে বার করে দিয়েছে। বছর পাঁচেক আগে পর্দার প্রতি যে-বিতৃষ্ণা আমার প্রথম এসেছিলো, এখন সেই বিমুখতা এসেছে মঞ্চের প্রতি। জীবনে, দেখা গেলো, কোনো মোহই ঢেঁকে না : আগে আর পরে।
তাছাড়া, আমি খেলা দেখিনে। কলকাতার অনেক লোকের পক্ষেই মস্ত আকর্ষণ এটা। কথাটা কে কী-ভাবে নেবেন জানিনে, কিন্তু সত্যি-সত্যি আমি ফুটবলের মাঠে একা যাইনি। এটা অপরাধ, সামাজিক বেআদপি; সেই সাফাইস্বরূপ এটুকু বলে রাখি যে আমার এই ক্রীড়াবৈরাগ্য আসলে বৈরাগ্য নয়, অক্ষমের হতাশা। আমার শরীর হলেও তাতে রক্ত আছে : এবং সে-রক্ত ‘নিরীহ’ ক্রীড়া অপর ব্যক্তির রক্তপাতের সম্ভাবনায় নেচেও ওঠে। ফুটবলের উন্মাদনা ও উত্তেজনা সম্পূৰ্ণ বুঝি : যুদ্ধরূপ দুগ্ধের সাধ মেটাতে অতি উৎকৃষ্ট ঘোল এটি। রাগবির মতো খেলা— যাতে শুনতে ইচ্ছাকৃত হত্যা ছাড়া সবই অনুমোদিত— সমস্ত পৃথিবীতে ভাবে প্রচলন করতে পারলে কি যুদ্ধের অবসান করা যায় ছোকরারা রাগবি ফেলে যুদ্ধ করতে চাইবেই না— ঝকঝকে পিতলের বোতাম-আঁটা সেনা-সজ্জার লোভেও নয়। যুদ্ধের মস্ত উল্লাস ঐ খেলাতেই তারা পাবে নরহত্যার সামরিক অধিকার থেকেও সম্পূর্ণ বঞ্চিত হবে না। বিশেষ, যুদ্ধ ব্যাপারটা ক্রমশই এত বেশি বৈজ্ঞানিক ও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠবে যে পরবর্তী ‘যুদ্ধ-শেষ-করা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে খুন করার কি খুন হওয়ার রোমাঞ্চ একেবারেই থাকবে না। খুব ঠাণ্ডা মেজাজে একজন একটা কল টিপবে; দুশো মাইল দূরের একটা শহর যাবে গুঁড়ো হয়ে। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে চা খেতে বসে হঠাৎ একজন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে রক্তমাংসের কতগুলো ডেলায় পরিণত হবে; কোন মহৎ উদ্দেশ্যে বীরের মতো তারা প্রাণ দিলে, তা বোঝবারও সময় হবে না যৌবনের অগ্নিময় রক্ত ও-ধরনের যুদ্ধে একফোঁটা মজাও পাবে না; প্রত্যক্ষভাবে ঢের বেশি উত্তেজক ও রক্তময় রাগবিকেই আঁকড়ে থাকবে তারা। সত্যি বলতে, রাগবি আন্তর্জাতিক শান্তির চমৎকার একটি ভিত্তি হতে পারে। উপযুক্ত কপিরাইট মূল্য পেলে প্রস্তাবটি দাখিল করতে পারি জেনিভায়।
উপরে যা বললাম তা থেকে এটা নিশ্চয়ই বোঝা যাবে যে আমি খেলা না- দেখলেও খেলার মর্ম বুঝি ভালো করেই। এবং কখনো যে দেখি না, আমার শরীরের ভীরুতা ছাড়া তার আর কোনো কারণ নেই। অভিজ্ঞদের মুখে শুনে যতটা সংগ্রহ করতে পেরেছি, সেই সবুজ রণাঙ্গনে প্রবেশলাভ, অবস্থান ও সেখান থেকে নিষ্ক্রমণ সবই অমানুষিক ধৈর্য, সহনশক্তি এবং খানিকটা দৈহিক বল ও তৎপরতার অপেক্ষা রাখে। এক কথায় : সে-যুদ্ধ দেখতে যাওয়া মানে নিজে ছোটখাটো একটি যুদ্ধ করা। আর যে-কোনো অবস্থায়, যে-কোনো কারণে, শারীরিক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে আমি পরম অনিচ্ছুক।
তাহলে একটা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকাতেই আমার সুখ, সে-ঘর কলকাতাতেই হোক, কি মাদারিপুর হবিগঞ্জেই হোক, তাতে কি কিছু এসে যায়? রাজধানীর মনীষার সঙ্গে যোগাযোগ— আমার পক্ষে সেটাই প্রধান আকর্ষণ নিশ্চয়ই? আলাপ, আলোচনা, চিন্তার বিনিময়, সমধর্মীর বাঞ্ছিত সংযোগ। দেশের সেরা লোকদের তো বেশির ভাগ কলকাতাতেই নিবাস; অন্তত, কলকাতায় থাকলে কখনো-না-কখনো তাঁরা অধিগম্য হনই। এটা মস্ত কথা সন্দেহ নেই; কথা বলে— ও কথা শুনে— সত্যি-সত্যি সুখ পাওয়া যায় এমন কয়েকটি মানুষের সঙ্গের জন্য অনেক কিছুই ছাড়া সহজ। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক সব সময় স্থাপিত হয় না— সব ব্যক্তিগত সম্পর্কে সুখ হয় না। এবং নিছক চিন্তার বিনিময়ই যদি উদ্দেশ্য হয়, সেটা পত্রযোগেও চলে, এবং পত্রযোগেই ভালো চলে। এমন কোন অজ মফস্বল বঙ্গদেশেও নেই যেখানে কাছাকাছি একটা ডাকঘর না আছে; এবং আজকালকার দিনে ডাকঘরের কাছাকাছি থাকা মানেই পৃথিবীর কালচার-কেন্দ্রে থাকা। বই পাওয়া যায়, পাওয়া যায় সাময়িক পত্র, চিঠি লেখালেখি চলে। কলকাতায় থাকার উপরি লাভ তাহলে কী?
কিছুই না। নবীন বিলেতযাত্রী বাঙালি ছেলে এ-কথা ভেবে উল্লসিত হতে পারে যে হাইড পার্কে পা দিয়েই সে দেখতে পাবে বুড়ো বর্নার্ড শ চলেছে ঘোড়ায় চড়ে হাওয়া খেতে, এবং বাস্-এ উঠেই পাশে বসবে এক্কেবারে চেস্টার্টন সাহেবের কিন্তু আসল ব্যাপারটা অবিশ্যি ঠিক সে-রকম নয়। ‘দেশের সেই লোকদের’ সঙ্গে দেখাশোনার সুযোগ অল্পই মেলে (যদি না ইংরেজরা যাকে বলে সিংহ-শিকারী, তা- ই হওয়া যায়); এবং সেরা লোকরা সকলেই যে সব সময় পরিচয়ের খুব যোগ্য হন তাও নয়। আমার কথা এই যে লোকজনের সঙ্গে চেনাশোনার যত সুযোগ আমি পেয়েছিলাম সব নিতান্ত নিশ্চিন্ত ও চিন্তাহীনভাবে অপব্যয় করেছি : এখন আমি কাউকেই প্রায় চিনি-শুনি না; এমনকি, এককালে যাদের চিনতাম তারাও এখন প্রায় না-চেনার মধ্যে। এ-রকম হয়েছে আমার স্বভাবেরই দোষে; আমার মনের সংকোচ ও শরীরের আলস্যই এ-জন্য দায়ী। বাড়ি থেকে বেরোতেই আমি অনিচ্ছুক; বাড়িতে বসে ভালো না-লাগলেও বাইরে গিয়ে খুশি হওয়ার চেষ্টা করা আমার উৎসাহে যেন কুলিয়ে ওঠে না। আমার বন্ধুর গণ্ডি তাই অতি, অতিশয় সংকীর্ণ : কলকাতায় এমন লোক পাঁচজনের বেশি নেই, যাদের সঙ্গে আমি সত্যি-সত্যি যেন খুলে কথা কইতে পারি। এবং তারা মহৎ লোক নয়, অন্তত, আমার চেয়ে বেশি মহৎ নয়। সে-বিষয়ে আমি একটু দৃষ্টিই রাখি, যাতে আমার চাইতে একেবারে অনেক মস্ত বড়ো কারো সঙ্গে আমার বেশি সাহচর্য না হয়। কেননা সেরকম কোনো লোকের সংসর্গে এলে কেবল কথা শুনেই যেতে হয়, এবং কেবল শোনাকে আলাপ বলে না। তাছাড়া, সে-কথা বলতেই বুদ্ধিদীপ্ত, যতই গম্ভীর চিন্তাপ্রসূত, যতই সূক্ষ্ম-সরস হোক, খানিক পরে ক্লান্ত লাগতে আরম্ভ করেই। আর তাছাড়া, কথা বলায় আমি খুব নিপুণ না হতে পারি, তবু মাঝে-মাঝে আমারও কথা কইতে ইচ্ছে করে।
সুতরাং কালচার-কল্পতরুর আশ্রয় কি সুজন-সঙ্গের আনন্দ—, কলকাতার গোপন রহস্য এর কোনোটাই নয়। তাহলে কি বৈষয়িক আকাঙ্ক্ষাই রয়েছে আমার কলকাতা-আসক্তির মূলে? এ-সন্দেহ অগ্রাহ্য হবে এই বললেই যে সে-রকম কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার মনে যদি বা থাকে, তা পূর্ণ হবার কোনোরকম সম্ভাবনাই নেই। আমি তা জানি। মনের ইতর ইচ্ছাগুলো স্বীকার করে ফেলাই ভালো : নিশ্চিত ও প্রচুর আয়ের আরামকেদারায় বসে মনের সুখে চটি-খোলা পায়ে পা বুলোতে আমার খুবই ইচ্ছা করে কখনো-কখনো। ইচ্ছে করে নিজের গাড়িতে চড়ি, ইচ্ছে করে এমন পাড়ায় এমন বাড়িতে থাকি যেখানে চুপচাপ একা থাকতে চাইলে বাইরের কি ভিতরের কোনোরকম বাধা হবে না, ইচ্ছে করে… অনেক কিছুই। তবে এ-সব ইচ্ছা আলানাস্করি স্তরে পৌঁছতে পারে না এই কারণে যে দিবাস্বপ্নের অন্যান্য (এবং এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কেননা বেশি টেকসই) উপকরণ আছে আমার। এক যেহেতু আমি বাংলাদেশে লিখনেওয়ালা হয়ে জন্মেছি, এ-সব ইচ্ছা আমার মধ্যে শুধু কলিকের ব্যথার মতো মাঝে-মাঝে মুচড়িয়ে উঠবে— তার বেশি কিছুই কোনোদিন হবে না— এ আমি ভালো করেই জানি। কবিদের দারিদ্র্যের প্রবাদ সব দেশেই : এ-দেশে অতি মারাত্মকরকম সত্য। এবং সব দেশেই কবিরা উচ্চতর জীবনের দোহাই দিয়ে নিজেদের সান্ত্বনা দিয়েছেন, গোপন করেছেন ঈর্ষা।
এসো বন্ধু, তাদের করুশা করি, আমাদের চেয়ে যারা সংগতিবান।
বন্ধু, এ-কথা মনে রেখো
ধনীর বাবুর্চি-খানশামা আছে, বন্ধু নেই,
আর আমাদের আছে বন্ধু, নেই বাবুর্চি-খানশামা।
এসো বিবাহিতকে করুণা করি
করুণা করি অবিবাহিতকে।
ঘরে ভোর আসে ছোট্ট পা ফেলে
পাভলোভার প্রতিমার মতো,
বাসনা আসন্ন আমার।
আর এই যে স্বচ্ছ শীতল মুহূর্ত
একসঙ্গে ঘুম ভাঙার এই যে মুহূর্ত
জীবনে এর চেয়ে ভালো কিছু নেই।
এজরা পাউন্ডের রচনা থেকে এ-দৃষ্টান্তটা মনে পড়লো (পাউন্ড-ভক্তরা এই শিথিল তর্জমা মার্জনা করবেন)। এই আত্ম-সান্ত্বনা যে একেবারেই অমূলক এমন নয়; এ- জীবন সত্যিই উঁচু স্তরের।
যাই হোক, যে-কারণে এত সব স্পষ্ট অসুবিধে সত্ত্বেও কলকাতাকে আমি ভালোবাসি, সেটা ধনী হবার আশা নয়। বস্তুত সে-আশা মনে স্থান দেবারই উপায় নেই আমার। হতাম যদি দালাল কি দোকানদার কি পাঠ্যকেতাব-লিখিয়ে তাহলে কলকাতাকে একটা খনি মনে করতে পারতাম বটে, যেখান থেকে বুদ্ধির কুড়োল মেরে-মেরে সোনা তুলে আনলেই হলো। আমার ফাউন্টেন-পেনের তাড়নায় যদি নেকড়ে বাঘ দরজার বাইরে থাকে তাহলেই যথেষ্ট।
সত্যি, কেন তবে এই কলকাতার মোহ? কোনো কারণ নেই। বরঞ্চ যা-কিছু আমি ঘোরতর অপছন্দ করি, সবই এই শহরেরই আনুষঙ্গিক। এখানে ভিড়। এখানে ধুলো। এখানে গোলমাল। স্তব্ধতা নেই, নেই অন্ধকার। এখানে গণ-মনের সংঘবদ্ধ উন্মত্ততা। এখানে পৃথিবী অতি কৃপণ : কি গৃহে কি যানে কি কর্মস্থলে, হাত-পা নাড়বার জায়গা নেই কোনোখানেই। সবই ঘোরতর অপছন্দ করি, তবু কলকাতাকে ভালোবাসি, এ-সমস্ত উপদ্রব ছাড়িয়ে কোনখানে যেন আছে কলকাতার এক বিশাল, অন্ধকার আত্মা, তার আকর্ষণ আমার রক্তে। এ একটা মোহ, তা ছাড়া আর কী বলবো? মোহ কখনো যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়। পুরুষ যখন মেয়েকে ভালোবাসে, তার কি কোনো কারণ থাকে? সেটা মোহ— খুব ভালো অর্থে। জীবনকে লালন করবার যত কৌশল আছে প্রকৃতির, তার মধ্যে মোহই তো শ্রেষ্ঠ। মনে নেশা ধরায়— আর জীবনের যতখানি আমরা নেশার অবস্থায় কাটাতে পারি, ততখানিই সার্থক। আমি অনেক মোহের মানুষ, স্বভাবতই আমি মাতাল। সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ অবস্থা আমার পক্ষে মৃত্যুর মতো। কবে একদিন কলকাতার মোহ লেগেছিলো আমার মনে; এখনো ট্রামে যেতে-যেতে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ যেন লাগে বিস্ময়ের ধাক্কা। কলকাতার সেই অন্ধকার রহস্যের সত্তা— এই সমস্ত দৃশ্য আর শব্দ তারই প্রকাশ, তবু তা সমস্ত দৃশ্য-শব্দের অতীত— হঠাৎ-ঝলকে কখনো-কখনো তা ধরা পড়ে। সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে কিছুদিন বাইরে কাটাবার পর ভোরবেলা হাওড়া কি শেয়ালদায় এসে পৌঁছলে। এইমাত্র-জল-দেয়া কালো চিকচিকে রাস্তা থেকে যে-একটি অদ্ভুত গন্ধ উঠে আসে, তা যেন পুরোনোকালের স্মৃতির মতোই প্রিয়— সময়ের হাতও কোনোদিন তাকে ছুঁতে পারবে না। মুহূর্তে কথা কয়ে ওঠে বুকের মধ্যে শহরের অন্ধকার, চিরন্তন আত্মা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন