আমি চঞ্চল হে – ৩

বুদ্ধদেব বসু

রেলগাড়িতে চড়া এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। হঠাৎ এক পৃথিবী থেকে আর-এক পৃথিবীতে আমরা বদলি হয়ে যাই। যেন আলাদিনের কোনো জিন ঘুমের মধ্যে আমাদের তুলে নিয়ে যায় প্রাত্যহিক ও অভ্যস্ত আবেষ্টনী থেকে কোনো আশ্চর্য নতুনে। অবাক হয়ে যাই চোখ মেলে।

আজকাল প্রায় সব ভালো গাড়ি রাত্রিতে চলে; এ-রকম মনে হওয়ার আরো বেশি কারণ সেইজন্যে। সত্যি-সত্যি ঘুমের মধ্যে আমরা চলে যাই প্ৰদেশ থেকে অন্য প্রদেশে, নরম থেকে শক্ত মাটিতে, ভিজে থেকে শুকনো হাওয়ায়। এ তো পথ চলা নয়, এ হচ্ছে চালান হওয়া। এ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা আপত্তি এই হতে পারে যে উপায়টা বড়ো বেশি সহজ। কথাটা পুরোনো। যদি অভিজ্ঞতা থেকে কোনো সার্থকতা চাই-ই, তার অর্জন হবে দুঃখসাপেক্ষ। যার জন্যে কষ্ট করতে হলো না, তাকে বেশি মূল্য না-দেয়াটা মানুষের স্বভাব। যে-সময়ে রোমে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না, সে-সময়ে ক্যাথলিক পুণ্যপিপাসুরা কেবল পায়ে হাঁটাতেই খুশি না-থেকে জুতোর মধ্যে পাথরের কুচি ঢুকিয়ে নিয়ে পুণ্যের ওজন বাড়াতেন। আমাদের দেশেও তীর্থপর্যটন এত বড়ো মহৎ পুণ্য ছিলো এই কারণেই যে অমানুষিক ক্লেশ ছাড়া তা সম্ভব হতো না। প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিলো প্রতি পদে। রেল-কোম্পানি এসে তীর্থযাত্রা সুসাধ্য করেছে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে— এবং সেই কারণেই— তীর্থমাহাত্ম্যও অনেক কমিয়ে দিয়েছে।

দ্রুত ও সুলভ যানের এই দিনে পদপর্যটনা সম্বন্ধে রোমান্টিক কল্পনা সহজেই উদ্দীপিত হয়। প্রথম কথা, ভ্রমণের ক্লেশেই গন্তব্য মহিমান্বিত হয়। কষ্ট করে যেখানে পৌঁছতে হয় সেটাই তীর্থ। যেমন কিনা, লেখার উপর চলনসই রকমের দখলও অনেক কষ্টেই আসে, সুতরাং সে-অবস্থায় পৌঁছতে পারা নিঃসন্দেহে পুণ্য। যন্ত্রের জিন দূর করেছে শরীরের ক্লেশ, কিন্তু সাধনার দুঃখ মানুষের চিরন্তন। মনের সাধনা সব মানুষের জন্য নয়; সাধারণ মানুষের জন্য শরীরের এই ক্লেশ বোধহয় ভালোই ছিলো। তাতে ছিলো মুক্তি। যে-পরিব্রাজক শীতে অনশনে পরিশ্রমে দীর্ঘপথ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত একদিন দূর থেকে দেখতে পেতো রোমের কি কাশীধামের উজ্জ্বল আভাস, তার জীবনের সেই এক মুহূর্তের পরম রোমাঞ্চ অতি মহার্ঘ জিনিশ।

লৌকিক ধর্মের পতন এ-যুগের একটা বিশেষ ঘটনা। তাতে আমরা অনেক ঘোর অমঙ্গল থেকে রেহাই পেয়েছি; কিন্তু লোকশানও বোধহয় কিছু হয়েছে। এতকাল ধর্মে ছিলো মানুষের মনের নিষ্ক্রমণ; তার জীবনটাকে একটা সুস্পষ্ট নির্দিষ্ট ছন্দে বেঁধে দেয়া হতো নানা আচারে নানা অনুষ্ঠানে, উৎসবে ও উপবাসে। সে-ছন্দ কেড়ে নিয়েছে আধুনিক কাল, কিন্তু তার বদলে কিছু কি দিতে পেরেছে? নেহাৎ আনুষ্ঠানিক ধর্মেরও এটুকু সার্থকতা ছিলো যে তা মানুষের জীবনকে ব্যবহারিক সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বের করে নিয়ে আসতো বিশ্বসৃষ্টির পটভূমিকায় আর আজকালকার মানুষের জীবন কী? একজন ইংরেজ বলেছেন : ধর্মের আর প্রয়োজন নেই আজকাল, তার বদলে আর্ট আছে। কিন্তু আর্ট তো সকলের জন্যে নয়। সাধারণের জন্য আছে সিনেমা আর রেডিও আর খবরের কাগজ, পলিটিক্স আর ক্রওয়ার্ড আর অসংখ্য কলে-চলা আমোদ, যাতে ব্যক্তির স্ফুর্তি নেই, আছে সংঘবদ্ধ উন্মত্ততা। সমুদ্রের বীচে প্রায়-উলঙ্গ অবস্থায় (ঐ প্রায়টাই অশ্লীল) হাজার স্ত্রী-পুরুষের সম্মিলিত মাংসপিণ্ডে চটকে যাওয়ার চাইতে গির্জার নির্জন অন্ধকারে প্রতিমার সামনে মোমবাতি জ্বালানো সত্যিই অনেক পুণ্যময় কাজ। এ-কথা মানতেই হবে যে গ্রেটা গার্বোকে দেবী করে তোলার চাইতে শ্রীরাধার দেবীত্বে বিশ্বাস করায় সাধারণ বুদ্ধির পরিচয় অন্তত বেশি।

আধুনিক জীবনের সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি এই যে ফূর্তিটাও ফরমায়েশি। মানুষের সুখদুঃখের উপকরণ থাকে তার নিজেরই মধ্যে, সেটা একটা স্বাভাবিক ক্ষরণ। কিন্তু আজকালকার মানুষ সুখের কারখানার দাস, সেখান থেকে আসে বিচিত্র লেবেল-আঁটা রংবেরঙের টাটকা আমোদ— পয়সা দিয়ে কিনতে হয় বলেই সন্দেহ থাকে না যে ফূর্তি হলো। অন্য সব-কিছুর মতো ভ্রমণেও তা-ই হয়েছে। ভ্রমণ করে প্রায়ই আমরা রেল-কোম্পানির বিজ্ঞাপন সার্থক করি মাত্র। বেরিয়ে পড়ি ছক-কাটা রাস্তায়; বিজ্ঞাপনের ভাষার বহর অনুসারে চেষ্টা করি উপভোগ চাড়িয়ে তুলতে। বিজ্ঞাপনের অতি সূক্ষ্ম প্রভাবের অধীন আমরা সবাই, সবাই। আমরা যাই ‘বিখ্যাত’ জায়গায়, যাই সেখানে, যেখানে অন্য সবাই যায়। ছুটিতে বেড়ানোর প্রধান আকর্ষণ যে নিরিবিলি চুপচাপ কয়েকটা দিন কাটানো, এ-কথা তাদের দেখে মনেই হয় না যারা গরম পড়তেই সদলবলে দার্জিলিং শহরে যায় ফ্যাশনের পুরোদস্তুর কুচকাওয়াজ নিয়ে।

মাঝে-মাঝে, তাই, পুরোনো দিনের জন্য মন-কেমন করে। এটা অনিবার্য। গণ- মতের চাপে যাদের মন একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি, এমন কিছু-কিছু লোক প্রতিযুগেই থাকবে। এবং তাদের কাছে বর্তমানকে হতেই হবে অতৃপ্তিকর : তারা ভবিষ্যৎকে নিজের বাসনার রঙে সাজাবে, কি অতীতের কোনো যুগকে নিজের কল্পনায় নতুন সৃষ্টি করে নেবে। কোনো-এক কাল্পনিক সময় হবে তাদের মানসজগৎ, সেখানে তাদের ইচ্ছাপূরণ। কাল্পনিক ইচ্ছে করে বলছি, কেননা এ-সব অতৃপ্ত মন যে-অতীতের কোনো যুগকে আশ্রয় করে, সে-অতীত তো ইতিহাসের পাতা নয়, সে কবিতা, কল্পনার তাপে গলানো সে, ভাবের ছাঁচে গড়া। উইলিয়ম মরিসের মধ্যযুগ অবিশ্যি ইতিহাসের মধ্যযুগ নয়; কালিদাসের কাল রবীন্দ্রনাথেরই, কালিদাসের খুব সম্ভবত নয়।

তেমনি আমারও মাঝে-মাঝে মনে হয়, পরিব্রাজনা আর গোযানের দিনে আসলে কত বেশি সুখী ছিলো মানুষ! রোমাঞ্চ ছিলো, উন্মাদনা ছিলো; তাছাড়া ছিলো প্রকৃত পর্যবেক্ষণের অপরিসীম সুযোগ। আমাদের মন ধনী হয় অভিজ্ঞতার পরিমাণ অনুসারে নয়, নিবিড়তা অনুসারে; আর দশ মাইল পায়ে হাঁটায় আমরা যা দেখবার, যা অনুভব ও গ্রহণ করবার সুযোগ পাই, তা কি পাওয়া যায় রেলগাড়িতে রাতারাতি একটা আস্ত দেশ পার হয়ে? সেই তো সত্যিকারের পথ চলা, যখন পথের দু-ধারে কত-কিছু থেকে-থেকে ডাক দেয়— এখানে একটা অদ্ভুত চেহারার গাছ, ঐ হলদে পাখিটা উড়ে গেলো, একটা কুকুর ছায়ায় শুয়ে হাড় চিবোচ্ছে হয়তো। কিছু ফেলবার নয়, সবই ভালো লাগে। সেই তো প্রকৃত অবসর, যখন পৌঁছবার তাড়া নেই, লক্ষ্যটা হয়ে উঠলো উপলক্ষ, পথ চলা হলো আপনাতে আপনি সার্থক। সেই তো আলস্য, সেই তো উপভোগ। ‘What is life if full of care, we have no time to stand and stare?’

এখানে, শহরে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকাটা শুধু বেয়াদবি নয়, প্রায় বে- আইনি। শুধু তা-ই নয়, তাতে শারীরিক বিপদেরও আশঙ্কা আছে। শহরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যারা তাকিয়ে থাকে, নিতান্তই তারা রাস্তার লোক। তারা ভিড়। এ-সংস্কার আমাদের মনে এমনি মজ্জাগত যে রাস্তায় যখনই বেরুই, ব্যস্ত না-হলেও ব্যস্ত হবার ভান অন্তত করতে হয়। নয়তো নিজেরই কাছে মানহানি হয় যেন। অথচ এই কলকাতারই পথে-পথে অকারণে ঘুরে বেড়াবার আনন্দই কি কম! ভবানীপুরের বিশেষ একটা রাস্তা আছে, যাতে সন্ধের পর ম্লান গ্যাসের আলোয় ঢুকতেই আমার কেমন অদ্ভুত লাগে। কিন্তু কদাচ যাওয়া হয় সেখানে, কেননা যাওয়ার কোনো ‘কারণ’ নেই। এমনি অলক্ষিত ও অলঙ্ঘনীয় সংস্কারের বন্ধন।

শহর ছেড়ে পালাবার জন্য এক-এক সময় মনটা যে ছটফট করে ওঠে তা তো এই স্বাধীনতারই টানে, নিরুদ্দেশ ঘুরে বেড়াবার ও অকারণ তাকিয়ে থাকবার এই অধিকারের লোভে। এখানে যখনই বাড়ি থেকে বেরোই, হয় কাজে কি ভোজে, অর্থের কি আমোদের সন্ধানে, ব্যবসার খাতিরে কি নিমন্ত্রণরক্ষায়। সাজসজ্জা, আচার-ব্যবহার, কথার কায়দা, কত কী! বাইরে, এ-সমস্তর কোনো বালাই নেই। বেরিয়ে পড়লাম যখন খুশি যে-কোনো রাস্তা ধরে, রাস্তা ছেড়ে মাঠে, মাঠ ছেড়ে বনে, পৌঁছতে হবে না কোনোখানে, ফেরবার তাড়া নেই— গায়ের জামাটায় ভব্যতার কড়া ইস্ত্রি না-থাকলেও বেরুনো আটকাবে না, এমনকি। নিজের পরিবেশ ছেড়ে পালাবার প্রধান আনন্দ এই স্বাধীনতা। করুণা করতে হয় তাদের যারা ছুটির দিনেও কলকাতার ‘দল’ ও কলকাতার ব্যবহার বাইরে টেনে নিয়ে যায়; আর দয়া করতে হয় সেই মাতব্বরদের যারা যেখানেই যায় ঘেরাও হয়ে থাকে সাজগোজ লোকলস্কর এনগেজমেন্টের ভিড়ে।

তবু এটাও ঠিক যে পায়ে হেঁটে দেশভ্রমণ ভাবতে যতই রোমাঞ্চকর হোক, আমার জীবনে তা ভাবনার আকাশে রঙিন মেঘ হয়েই থেকে যাবে। সবচেয়ে বড়ো বাধা হচ্ছে শারীরিক ক্লেশ। ভেবে দেখছি আজকালকার মানুষের মানসিক দুঃখভোগের এত বিচিত্র উপায় আছে, যে স্বর্গের দরবারে দাবি পাকা করবার আশায় ইচ্ছে করে শরীরের কষ্ট নিয়ে লাভ নেই। তার উপর, আমার যেমন শরীর তার কষ্ট করবার ক্ষমতা অত্যন্ত কম। কোনো রোমাঞ্চের প্রলোভনেই আমি নৌকোয় কি সাইকেলে পৃথিবীভ্রমণ করতে রাজি হবো না। শরীরটাকে যথাসম্ভব শান্তিতে রেখে উদ্দাম আকাশে মানসযাত্রা আমার চরম অ্যাডভেঞ্চার।

এ-সমস্ত ছাড়াও আরো একটা মস্ত কারণ আছে যার জন্যে রেলগাড়ির যুগ থেকে পায়ে হাঁটার যুগে বদলি হতে আমি নারাজ। রেলগাড়ি জিনিশটাই ভারি আশ্চর্য। বেগের আনন্দ আধুনিক মনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ, সে-কথা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু রেলগাড়ি যে-অদ্ভুত অভিজ্ঞতার জোগান দেয় পদাতিক ভ্রমণে সেটা সম্ভব নয়, অন্য কোনো যানেই সেটা সম্ভব নয়। রেলগাড়ি শুধু আমাদের এক ইস্টিশান থেকে আর-এক ইস্টিশানেই নিয়ে যায় না, বাস্তব থেকে রূপকথার জগতেও নিয়ে যায়। রাত্রির ভিতর দিয়ে দ্রুত ধাবমান গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এই বাস্তব পৃথিবীকে আর চিনতে পারিনে, প্রতি মুহূর্তে রূপকথার এক-একটি পাতা খুলে যাচ্ছে। সবই অদ্ভুত। বাড়ি আর কলকারখানা, শহর আর মাঠ ঝোপ জঙ্গল, এমনকি পশু পাখি মানুষ— সবই অদ্ভুত, সবই ক্ষণিক; কিছুরই অবয়ব স্পষ্ট নয়, সবই ছায়াময়, সবই ছায়া-স্নানে আজানুমগ্ন, সবই বাঁকাচোরা, যেন শেষ-না-হওয়া; যেন এই সৃষ্টি বিধাতার কল্পনার সমুদ্র থেকে জেগে উঠেছে এইমাত্র। একটা কথা আছে যে বিশ্বসৃষ্টি স্থবির নয়, সাবলীল; এই আপাতস্তব্ধতার আড়ালে বয়ে চলেছে একটি চিরকালের প্রাণস্রোত : জড়বস্তুর সেই তীব্র তির্যক গতিস্রোত রেলগাড়ির জানলায় বসে হঠাৎ-আভাসে ধরা পড়ে যেন। সেখানে বসেই দেখা যায় গাছগুলো ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুটে চলেছে, পাহাড় পাখা মেলে উড়ে চলে গেলো, দিগন্ত কতবার ঘুরে-ঘুরে গেলো পাখির ঝাঁকের মতো। হয়তো অন্ধকার, হয়তো অস্পষ্ট জ্যোছনা; আলোর কয়েকটা ফুটকি চোখের উপর দিয়ে ঝিলকিয়ে গেলো, একটা স্টেশন; কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, হঠাৎ চোখ মেলে দেখি বড়ো ইস্টিশানে গাড়ি লেগেছে।– ঘুমে-ভরা চোখে ছায়ামূর্তির মতো মানুষগুলি, শব্দগুলি যেন স্বপ্নে শোনা— কিংবা দেখি গাড়ি সাঁকো পার হচ্ছে মৃদুবেগে, নিচে বালুর বিছানায় ম্লান জ্যোছনার ঝিকিমিকি, মাঝখান দিয়ে অতি সরু একটি জলস্রোত চলেছে সরু সাপের মতো এঁকেবেঁকে, দূরে একটা পাহাড়। আবার ঘুমিয়ে পড়লুম; তারপর ভোরবেলা যেখানে নামলুম, সেখানে এ কী বিচিত্র সুন্দর পৃথিবী। আগের রাত্রে যে-কলকাতাকে ছেড়ে এসেছি, এই কয়েক ঘণ্টাতেই তাকে গেছি ভুলে। সে যেন বিস্মৃতির কুয়াশায় লিপ্ত; সে যে কোনোদিন ছিলো তাও যেন আর ভালো করে মনে করতে পারিনে।

এটা উপলব্ধি করেছিলুম সেদিন, যেদিন পুরী যাওয়ার পথে নামলুম ভুবনেশ্বরে। তখন ভোর। কৃষ্ণপক্ষের বিলম্বিত চাঁদের জ্যোছনা ছিলো প্রায় সমস্ত পথ, এখনো লেগে রয়েছে তার ভূতুড়ে আভাস। চারদিক অদ্ভুত চুপচাপ; আলো-জ্বালা জানলাগুলো নিয়ে লম্বা রেলগাড়িটা ছবির মতো দাঁড়িয়ে, শুধু দূরে শোনা যাচ্ছে এঞ্জিনের অসহিষ্ণু নিশ্বাস। কী অর্থহীন হয়ে যায় রেলগাড়ি, যে-মুহূর্তে আমরা তা থেকে নামি! কী নিরর্থক মনে হয় যাত্রীদের, যেমন-তেমন শুয়ে বসে ঝিমুচ্ছে। গেলো গাড়ি ছেড়ে, সমস্ত জনপদ হঠাৎ বিরহী গৃহের মত খাঁ-খাঁ করে উঠলো। কিন্তু পর- মুহূর্তেই সব ডুবলো নতুন দেশের নতুন দৃশ্যে। প্ল্যাটফর্মের অন্য দিকে দিনের আলো ফুটেছে, কত মাঠ কত গাছ কত আকাশ। আকাশে দপ্ দপ্ করে একটা তারা জ্বলছে, ঐ তো সবুজ পাহাড়। পান্ডাজি এগিয়ে এলেন, শরণ নিলুম। নিলুম গোরুর গাড়ি, এখন পর্যন্ত উড়িষ্যার প্রধান যান। উঠলো বাক্স-বিছানা, আমরা উঠলুম। জ্যোছনার শেষ ছায়া মিলিয়ে গেছে ততক্ষণে, ভোর হলো। লাল মাটির রাস্তা দিয়ে অতি আস্তে আমরা চলেছি। গাড়ির চাকা কঁকাচ্ছে। আমাদের নাকে খড়ের আর গোরুর গায়ের আর শিশিরে ভেজা সকালবেলার গন্ধ। পথের দু-ধারে পাখির ডাক, ঘন গাছের সারি। দেখতে-দেখতে রোদ ফুটলো, আমাদের পথে আলো-ছায়ার জাল বোনা; আমাদের কানে গাড়ির চাকার গোঙানি আর পাখির ডাক। একটু পরেই দেখা পেলাম হাজার মন্দিরের দেশে প্রথম মন্দিরের। দু-একজন বাঙালি বৃদ্ধ বেড়াচ্ছেন, অতিরিক্ত শীতবস্ত্রে মোড়া; ছোটো ছোটো বাড়ি; লোকালয় কাছে। তারপর রাস্তাটা হঠাৎ একটা সরু বাঁক নিয়ে নেমে গেছে, গড়গড়িয়ে গাড়ি চললো, তারপর আর-একটা বাঁক পার হয়ে বিশাল কালো দিঘি কূলে-কূলে ভরা, ওপারে ভুবনেশ্বরের বিশাল পরিষ্কার মন্দির ভোরের আকাশে উঠে গেছে, এপাশে ধরমশালা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন