বুদ্ধদেব বসু
কালপুরুষকে কতদিন দেখেছি। কত আশ্বিনের সবুজ সন্ধ্যায় পূর্ব দিগন্তে প্রশ্নচিহ্নের মতো, কত চৈত্রসন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে তির্যক ছাঁদে ঝুলন্ত, কত মৃত জ্যোছনায় ম্লান, কত অন্ধকারে আশ্চর্য উজ্জ্বল। কত জানলা থেকে দেখেছি তাকে, দেখেছি গলির উপরে, শহরের পথে যেতে-যেতে সেই ভীষণ জ্বলন্ত মূর্তি চমক লাগিয়ে দিয়েছে কতবার। আমাদের আকাশে এই জ্যোতির্ময় আতঙ্কের মতো আর-কিছু নেই,– কোটি কল্পের এই ধ্বংসহীন সূর্যপুঞ্জ, অন্ধকারের দুরন্ত হৃৎপিণ্ড যেন। আর আছে শান্ত গম্ভীর সপ্তর্ষি, উত্তরের আকাশে নিঃস্পন্দ। কালপুরুষ আনে আমাদের রক্তে দুর্দান্ত হিংস্রতা, সপ্তর্ষি আনে শান্তি। কতদিন আমি খুঁজেছি সপ্তর্ষিকে এই শেষ শরতের আকাশে, দেখা পাইনি। আজকাল বড়ো দেরি করে ওঠে সে, তখন আমাদের ঘুম। আজকাল সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় সমস্ত আকাশ কালপুরুষেরই খড়্গেঙ্গ দ্বিখণ্ডিত। আছে আরো অনেক তারা, তারা ম্লান, তারা বিচ্ছিন্ন; তাদের কোনো নির্দিষ্ট সম্মিলিত মূর্তি আমার চোখে ধরা পড়ে না। এ-আকাশে আরো কত নক্ষত্রপুঞ্জের মেলা, কিন্তু আমার আনাড়ি চোখ তাদের চেনে না : কালপুরুষের অসহ্য সৌন্দর্যে ক্লান্ত, আমি খুঁজি সপ্তর্ষির শান্তি। কোন গভীর রাত্রে উঠে আসে সে, চুপে-চুপে, ভীরু ভাঙা চাঁদের মতো, একটু পরেই বুঝি মিলিয়ে যায় ভোরের আভাসে। যাবে শীত, প্রথম বসন্তে যখন দক্ষিণে হাওয়ার দোলা, তখন এক সন্ধ্যায় হঠাৎ দেখবো দিগন্তের উপরে ভীরু সপ্তর্ষি, আর কালপুরুষ পশ্চিমে আনত।
—কিন্তু এ-দেখাও আমার অদৃষ্টে ছিলো! হঠাৎ ভাঙলো ঘুম, তারপর ঘুমের জড়তা কাটিয়ে এটা উপলব্ধি করতে কিছু সময় লাগলো যে আমাদের গোরুর গাড়ি আছে দাঁড়িয়ে। কানে এলো গাড়োয়ানের শীতে-কর্কশ কণ্ঠস্বর : চীৎকার করে আমাদের ডাকছে। সেই অতি সংকীর্ণ শকটের লেপ-চাপা অবলুপ্তি থেকে উঠে আসাও বড়ো সহজ কথা নয়। উঠতে হলো : অন্ধকারে ঘড়ির জ্বলজ্বলে কাঁটায় ঠিক তিনটে বেজেছে। বেরিয়ে এলুম গোরুর গাড়ির ঘুটঘুট্টি অন্ধকার থেকে। সঙ্গে-সঙ্গে স্বপ্নের মতো কানে বাজলো জলের ছলছলানি।
গাড়োয়ান বললে : নদীতে জোয়ার এসেছে। নদী? ঐ তো নিয়াকিয়া নদী। তারার আলোয় দেখা গেলো ম্লান জলের অস্পষ্ট ঝিলিমিলি। পার হওয়া যাবে না? গাড়োয়ান মাথা নাড়লো। নৌকো? নৌকোয় গাড়ি সুদ্ধ পার হওয়া যায় বটে, কিন্তু নৌকো কোথায়? গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালুম, দীর্ঘরাতের শিশিরে বালুগুলো ভেজা, জুতোর উপর দিয়েও টের পাওয়া যায়। সেই বিশাল, শূন্য বালু-প্রান্তরে গাড়োয়ান হাতের আঙুল গোল করে মুখে ঠেকিয়ে শীতে ভাঙা-ভাঙা গলায় চীৎকার করে মাঝিকে ডাকতে লাগলো। বার-বার ফিরে এলো প্রতিধ্বনি নদীর ওপার থেকে। আজ এই হাজার তারা-ভরা আকাশের তলায়, এই নিঃসীম নিঃস্পন্দ অন্ধকারে আমরা ছাড়া আর-কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। শুধু মাঝে-মাঝে সমুদ্র ডেকে উঠছে বাঘের মতো। সমুদ্র কোথায়? জানি না। শুধু সারারাত সমুদ্রের ডাক এসেছে আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে, হঠাৎ বুঝি ঢেউয়ে-ঢেউয়ে ধাক্কা লাগলো, যেন ধ্বসে পড়লো বিরাট মাটি গাছপালা পোকা-পাখি আর পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘর নিয়ে, যেন হঠাৎ গুলি- খাওয়া বাঘের হুংকারে অরণ্য তোলপাড় করে উঠলো। পূর্ববঙ্গে নদীর ভাঙন যারা জানে, তাদের কাছে রাত্রি-ভরা এই গুমগুমানি একেবারে অপরিচিত নয়। আমাদের পথে-পথে কখন থেকে এই শব্দ, ঘুমের মধ্যে চমক লাগানো, কখনো দূরের রেলগাড়ির শব্দের মতো ঘুম-পাড়ানো। তারপর রাত্রির শেষে ঘুম-ভাঙা কানে এই তোলপাড় চুরমার, হাজার তারার আকাশের নিচে, নিয়াকিয়া নদীর ধারে।
এ-কথা বলতে হবে এমন আকাশের নিচে আর কখনো আমি দাঁড়াইনি, এমন নীরন্ধ্র নিঃস্পন্দ রাত্রিময় প্রান্তরের মধ্যে। সমস্ত দিকে ছড়িয়ে স্তব্ধ, অস্পষ্ট বালু- বিস্তার : আর-কিছু চোখে পড়ে না, দূরে যদি থাকে গাছের সারি মনে হয় রাত্রিই নেমেছে নিবিড় হয়ে দিগন্তে। উপরে তাকালুম : আর আকাশে যা চোখে পড়লো তা ঠিক ঐ রকম করে আমি আর দেখবার আশা রাখি না। প্রথম কথা, আকাশ বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি, এ সে জিনিশই নয়। আকাশের ভাঙা-ভাঙা রঙিন টুকরো নিয়ে আমরা সাজাই মনের খেলাঘর, সমস্তটা আকাশ একসঙ্গে কল্পনাতেও আসে না আমাদের। এ কি কখনো আমরা ভাবতে পারি, এই যে আকাশ উঠে গেছে সমস্ত দিক থেকে তীক্ষ্ণ তারা-স্রোতে, বাধা নেই, দ্বিধা নেই, সমস্ত পৃথিবীর উপরে চিরকালের ছায়ার মতো ছড়ানো। ক্ষুদ্র সীমায় অভ্যস্ত আমাদের চোখ এতটা একসঙ্গে নিতে পারে না, পড়ে ক্লান্ত হয়ে। টুকরো চাঁদ অস্ত গেছে প্ৰথম প্রহরেই; এখন আকাশের প্রান্ত থেকে প্রান্ত জ্বলন্ত জীবন্ত তারায়-তারায় নিশ্বসিত। ঠিক মাথার উপরে দেখলুম কালপুরুষ, আর উত্তরের দিগন্তে এইমাত্র বুঝি সপ্তর্ষি উঠে এলো। স্পষ্ট দেখলুম সাতটা তারা, আর তাদের শান্ত ভঙ্গি, আর মাথার উপরে তীব্র হিংস্র কালপুরুষ আকাশের মাঝখান দিয়ে যেন ফাটল ধরিয়ে দেবে। এত তারার চাপে আকাশ বুঝি ভেঙে পড়লো। কিন্তু ভিড় থেকে বিচ্ছিন্ন নির্লিপ্ত, আকাশের দূর প্রান্তে ঐ তো সপ্তর্ষির শান্তি— সপ্তর্ষিকে কতদিন পর দেখলুম!
গাড়োয়ানের হাঁক-ডাকের কোনো জবাবই এলো না, নিয়াকিয়া ছলছলিয়ে বয়ে চলেছে। ছোট্ট নদী, কিন্তু সমুদ্রের সঙ্গে এর যোগ, এখন তাতে এসেছে জোয়ারের ধার। এখন পার হওয়া যাবে না; ভোরবেলায় লাগবে ভাঁটার টান, ততক্ষণ এখানেই অপেক্ষা। বিকেলবেলা পুরীর হোটেল থেকে বেরিয়েছিলুম, মনে আশা ছিলো প্রতিষ্ঠিত প্রথা-অনুযায়ী সূর্যোদয়ের আগেই কোনারক পৌঁছনো যাবে। গেলো সে-আশা। আমাদের এই গাড়োয়ান হোটেল থেকে রওনা হয়ে শহরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত রাস্তায় যাকে-তাকে ডেকে বলেছে, ‘কোনারক যাউচি। বুঝলুম, গো- যানচালকদের মধ্যে কোনারক যাত্রা কৌলীন্যের চিহ্ন। এত ঘটা করে যখন আরম্ভ করলো, তখন এই পরিচালক ঠিকমতো আমাদের পৌঁছিয়ে দেবেই, এমন আশা ছিলো মনে। তা হলো না : কাছাকাছি এসে এখন তিন ঘণ্টা অপেক্ষা। কোনারকের ‘বিখ্যাত’ সূর্যোদয় দেখা আমাদের কপালে নেই।
সুতরাং গুঁড়িসুড়ি মেরে ফিরে গেলুম বিছানাতেই। ঐটুকু তো গাড়ি, তার মধ্যে আমরা, আমাদের জলের কুঁজো, আমাদের শীতবস্ত্র, একটি বাক্সে চায়ের পেয়ালা স্টোভ ইত্যাদি— কিছুই ভুলিনি। টর্চের আলোয় জায়গা দেখে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পড়লুম। কোনো বন্য জন্তুর সবুজ স্ফুরিত চোখের মতো ইলেকট্রিক টর্চ মুহূর্তের জন্য জ্বলেই নিবে গেলো। গাড়ির মধ্যে জমাট অন্ধকার। মনে হয় আদিম কোনো গুহার মধ্যে শুয়ে আছি। বাইরের বাতাসে থমকে থমকে সমুদ্রের স্বর আছড়াচ্ছে শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়লুম।
ঘুম যখন ভাঙলো, তখন বেশ বেলা। রোদ্দুর উঠেছে ঝিলকিয়ে। পথ দিয়ে চলেছে দু-চারজন দেহাতি লোক। নদীতে এখন ভাঁটা, গাড়িসুদ্ধ পার হয়ে গেলুম। নদীর মাঝখানে গোরুর গলা অবধি জল। গোরুদুটো কাঁপতে কাঁপতে এসে পৌঁছলো উল্টো পাড়ে। সেখানে কয়েক ঘর বসতি, হাটগোছের বোধহয়, তারপর ধু-ধু মাঠ আর মাঠ গড়িয়ে চলেছে। এখন চা খেতেই হবে। বেরুলো স্টোভ আর পেয়ালা আর রসদ, কিন্তু সেই দিকশূন্য প্রান্তরে হৃ-হূ হাওয়ায় স্টোভ কিছুতেই ধরে না। গাড়ি থামিয়ে গাড়ির তলায় ঢুকে চেষ্টা করা গেলো, হলো না। অগত্যা গাড়ির ভিতরেই দু-দিকে কাপড় খাটিয়ে আড়াল করে নেয়া হলো; ধরলো স্টোভ, হলো চা খাওয়া।
ধু-ধু করছে ব্রাউন রঙের প্রান্তর। ঘাস নেই, গাছ অল্প। চারদিকে তাকিয়ে একটা কুঁড়েঘরও চোখে পড়ে না। কদাচ দু-একটি লোকের আসা-যাওয়া। এত ফাঁকা জায়গাও আজকালকার পৃথিবীতে আছে! কিন্তু উড়িষ্যার এই অভ্যন্তর বুঝি আজকালের নয়। এখানে যেন পুরোনো পৃথিবীর প্রসার ও শূন্যতা বইছে বালু- ওড়ানো হাওয়া মাইলের পর মাইল। ফসল ফলে না : অকারণ অর্থহীন ঈষৎ বন্ধুর মাটি গড়িয়ে চলেছে, নেহাৎই যেন আমাদের আর কোনারকের মধ্যবর্তী ব্যবধান বাড়াবে বলে। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে টলস্টয়ের সেই ভীষণ গল্প মনে পড়ে : মানুষের কতটা জায়গা লাগে। এখানে যদি কেউ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পরিক্রমণ করে, সে একটি রাজধানী বসাবার মতো জায়গা দখল করতে পারবে— এবং তার জন্যে বোধহয় তাকে বিশেষ-কিছু দিতেও হবে না। কিন্তু বিনাযুদ্ধে বিনামূল্যে পেলেও এ-ভূখণ্ড কেউ কি কখনো নিতে চাইবে— উড়িষ্যায় এমনিতেই জায়গার ছড়াছড়ি। মনে হয় এ-সমস্ত জায়গা এমনি খাঁ-খাঁ করবে চিরকাল, রেল- লাইন থেকে দূরে, সভ্যতা থেকে দূরে, সময় থেকে দূরে। পৃথিবীতে যুদ্ধ বাধবে, ডুববে এক দেশ, অন্য দেশ জাগবে; মানুষ সম্পূর্ণ করবে তার বৈবর্তনিক নিয়তি; কিন্তু এই শূন্য ব্রাউন প্রান্তর এমনিই পড়ে থাকবে চিরকাল, আর তার উপর দিয়ে মাঝে-মাঝে আমাদেরই মতো কোনো যাত্রী গোরুর গাড়িতে যাবে কোনারকের দিকে।
এখন আর সমুদ্রের শব্দ শুনছি না, সকালের আলোয় অদ্ভুত স্তব্ধ পৃথিবী। রাত ভরে সমুদ্রের গর্জন এলো আমাদের সঙ্গে, হঠাৎ কি সমুদ্রকে অনেক দূরে ফেলে এলাম, নাকি অন্য-কোনো কারণে শব্দটা এসে পৌঁচচ্ছে না? কোনারকের মন্দিরে উঠতে-উঠতে সমুদ্র যদি চোখে না-পড়তো তাহলে প্রথম কারণটাই নিঃসংশয়ে ধরে নিতুম। অনেকটা দূর অবিশ্যি, কিন্তু রাত্রেই কি খুব কাছে ছিলো? এ-সমস্যার মীমাংসা হবে না। আর মীমাংসা হবে না পুরীর সমুদ্রের অদ্ভুত ব্যবহারের। পুরীতে বীচ ছাড়িয়ে শহরের দিকে একটুখানি ঢুকলেই সমুদ্রের সেই প্রচণ্ড চীৎকার একেবারে মিলিয়ে যায়। অথচ কোনারকের পথে কতদূর থেকে শোনা গেলো সমুদ্রের গর্জন। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত, অন্বেষণের যোগ্য। দুঃখের বিষয়, এই রহস্যে প্রবেশ করবার মতো সংগতি আমার আদৌ নেই। অথচ জগন্নাথদেব সমুদ্রের গোলমাল পছন্দ করেন না, এ-কথা শুনে জগন্নাথের মহিমায় বিহ্বল হয়ে চুপ করে থাকার ক্ষমতাও অবিশ্যি নেই আমার। আমি শুধু অবাক হতে পারি, শুধু পারি মনে-মনে ছটফট করতে।
কলকাতায় ফেরবার গাড়িতে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা; তিনি পুরীরই বাসিন্দা, এবং উড়িষ্যার পুরাবৃত্তে পণ্ডিত বলে খ্যাত। অনেক আশা নিয়েই প্রশ্নটা তাঁর কাছে উত্থাপন করেছিলুম। কিন্তু তিনি প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করে তারপর এমনভাবে চুপ করে গেলেন যেন সেটা আলোচনার যোগ্যই নয়। মনটা দমে গেলো, তবু পণ্ডিতের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের লোভ সামলাতে না পেরে কোনারক ও পুরীর মন্দিরের গায়ে মিথুন-মূর্তির ইতিহাস সম্বন্ধে প্রশ্ন করলুম। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো; তিনি আমাকে সাগ্রহে জানালেন যে এ-দেশের ‘আর্কিটেকচার’ নিয়ে তিনি অনেক গবেষণা করেছেন, সম্প্রতি তাঁর একটি প্রবন্ধও লেখা হয়েছে, এবং প্রবন্ধটি তাঁর সঙ্গেই রয়েছে বাক্সে। ‘তাহলে লেখাটাই আপনাকে পড়ে শোনাই। ভদ্রলোক বাক্স থেকে প্রবন্ধটি বার করবার আয়োজন প্রায় করেন আর কি, এমন সময় জগন্নাথদেবের দয়া হলো, গাড়ি দিলো ছেড়ে, আর আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলুম। আমি নিতান্তই অজ্ঞ বলে অতি সরল একটা প্রশ্নই করেছিলুম, ভদ্রলোক তার উত্তরে আমার মাথায় ‘আর্কিটেকচারে’র ইট ছুঁড়ে না-মারলেই দয়া করতেন।
বেলা দশটায় কোনারক পৌঁছলুম। হঠাৎ একটা গাছে ভরা উঁচু জায়গায় ঢুকলো আমাদের গাড়ি। শুনলুম, এসে গেছি। দূর থেকেই মন্দিরের দর্শন মিলবে, এইরকম একটা ধারণা ছিলো, কিন্তু সারি-সারি লম্বা ঝাউগাছের আন্দোলিত ছায়ার উপর দিয়ে গাড়ি চলেইছে। ডাকবাংলোই বা কোথায়? মস্ত এক ঝাউবনে ঢুকেছি আমরা, অবিশ্রান্ত উঠছে শোঁ-শোঁ দীর্ঘশ্বাস। ঐ একটা পুকুর। এখানেই গাড়ি থামবে। গোরুর গাড়িতে ষোলো ঘণ্টা : একটা ছোটো গল্পের চমৎকার নাম। ঐ পুকুরের ধার দিয়ে হেঁটে যেতে হবে, অ্যাটাশে কেসটা হাতে নিয়ে নাও।
পুকুরের ধার দিয়ে এসে বাঁক পার হয়ে উঠতেই রোদে ঝলসে উঠলো পুরোনো ছবির মতো একটি হলদে রঙের একতলা বাড়ি। একমুহূর্ত আগেও তাকে দেখিনি। সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম বারান্দায়, ঘর খোলা হলো আমাদের জন্যে খোলা হলো স্নানের ঘর, টবে এক্ষুনি জল ভরা হবে। এখানে আছে সভ্যতার নানা আয়োজন। আগে দাঁত মাজতে হবে। এখনো মন্দির দেখিনি : আগে বিশ্রাম হোক, স্নানাহার হোক।
বিশাল মর্মরিত ঝাউবনের মধ্যে এই মন্দির আর ডাকবাংলো পাখির মতো লুকিয়ে আছে যেন। একেবারে কাছে না-এলে কিছুই বোঝা যায় না। ডাকবাংলোটি একটু ফাঁকা জায়গায়, তাতে ঢোকবার প্রধান পথটির দু-দিকে ঝাউয়ের সারি; অন্যদিকে প্রকাণ্ড সবুজ প্রাঙ্গণের মাঝখানে ইঁদারা। ঝাউবনের বুকের ভিতর থেকে যে-একটি সূক্ষ্ম নিশ্বাসের ঢেউ কেবলই উঠছে-পড়ছে, তা যেন কোনো চিরন্তন স্তব্ধতারই সুর। কাছাকাছি একটা রেল-লাইনও নেই যে এই স্তব্ধতা মুহূর্তের জন্যও ভাঙবে। মোটরের রাস্তা আছে, তা বছরে ছ-মাস বন্ধ; ঝাউয়ে লুকোনো, হাওয়ায়-ধোয়ানো, আলোয় ঝলসানো এই স্বর্গে পৌঁছতে গো-যানই গতি।
এখানে ক্লান্তি নেই। আসতে-আসতে শেষের দিকে অবসন্ন লাগছিলো, কিন্তু যে- মুহূর্তে এই বাড়িতে ঢুকেছি, যে-মুহূর্তে গায়ে লেগেছে এই ঝাউয়ের হাওয়া, ফূর্তির ঢেউ হয়ে উঠেছে আমাদের শরীর। আকাশে উড়তে-উড়তে হঠাৎ পাখি দিক বদল করে, সেই তীক্ষ্ণ বাঁকা রেখা যেন আমি। এ কোথায় এলাম? এত আলো, এত আকাশ, এত শান্তি, আর এমন স্বচ্ছ উজ্জ্বল নীরবতা— বিশ্বাস হয় না যেন। এখানে যেন সৃষ্টির কাজ এখনো শেষ হয়নি; মাত্র ষোলো ঘণ্টা গোরুর গাড়ি চড়ে আমরা পালিয়ে এসেছি সময় থেকে, আমরা মুক্তি পেয়েছি কোন স্তব্ধ নিভৃত অতীতে, কোন আদিম সময়হীনতায়।
নাকি এই নগ্ন সরল স্তব্ধতায় আমরাই নিয়ে এলাম তালি-দেয়া কাটাছেঁড়া বর্তমানকে? আমাদের আত্মবিস্মৃতি কখনোই বুঝি সম্পূর্ণ হয় না। যতই ডুবে যাই, কোথায় যেন ভেসে ওঠে শক্ত, একগুঁয়ে একটা সচেতনতা। এখানে আমরা নিয়ে এসেছি আমাদের বছর আর তারিখ : ভুলিনি। খাবার আগে যেটুকু সময় তাতে আমরা বাড়ির লোকদের চিঠি লিখবো। কাগজ-কলম ডাকটিকিট আছে সঙ্গে। কিন্তু খবর পেলাম, নিকটতম ডাকঘর পাঁচ মাইল দূরে, রাজার ডাক ধরতে হলে মাঝামাঝি আর-কোনো উপায় নেই। নিশ্চিত ছিলুম যে ডাকবাংলোয় ডাকবাক্স একটা আছে নিশ্চয়ই, এবং যদিও কলকাতার বাইরে এলে ডাকবাক্স সম্বন্ধে আমার মনে দ্বিধার অন্ত থাকে না, তবু তারই ভরসায় কলম শানিয়ে নিচ্ছিলুম। ছেলেবেলায় ছিলুম মফস্বলের পাড়াগেঁয়ে শহরে, রাস্তার লাল বাক্সের প্রতি অবিশ্বাসের সূত্রপাত সেখানেই। হঠাৎ লোকালয়ের বাইরে শূন্য রাস্তায় এক টগর গাছের ডালে সাত জায়গায় দুমড়ানো রং-চটা একটা বাক্স দেখলে প্রিয়জনকে লেখা প্রিয় চিঠি তার গহ্বরে ফেলতে অনিচ্ছা হওয়াই স্বাভাবিক। বরঞ্চ দু-পা হেঁটে গিয়ে খোদ ডাকখানাতে ফেলাই সহজ। উত্তরকালে আমার এই শঙ্কা অনেকটা কেটেছে; কলকাতার যেখানে-সেখানে জীর্ণদর্শন বিবর্ণ বাক্সে চিঠি ফেলেও দেখেছি, যথাসময়ে যথাস্থানেই পৌঁচেছে। তারপর শীতকালে কলকাতার বাক্সগুলো যখন সিঁদুরের মতো টকটকে রং করা হয়, তখন তো তারা রীতিমতো সম্ভ্রমেরই উদ্রেক করে; আমাদের মধুরতম প্রেমপত্রের, আমাদের জরুরিতম ব্যবসা-সংবাদের দায়িত্ব দিয়ে অনায়াসে তাদের বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু কলকাতার বাইরে এলে বালককালের সেই ভয় আবার চাড়িয়ে ওঠে আমার মনে, খুব সাবধানেই চিঠিপত্র ফেলি। কিন্তু এবারের মতো ডাকবাংলোর ভাঙাচোরা যা-হোক বাক্সের উপরে ভরসা করেই আমাদের চমৎকার চিঠিগুলো ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলুম; সে-সুযোগও জুটলো না।
হতাশ হতে হলো : টিকিটে কোনারকের ছাপ-মারা, কাগজের উপর ‘কোনারক ডাকবাংলো’ লেখা চিঠি আমাদের আত্মীয়রা আর পেলেন না; সে-রোমাঞ্চ থেকে বাধ্য হয়েই তাঁদের বঞ্চিত করতে হলো। বাড়ি থেকে পা বাড়ালেই আমরা এক- একজন মস্ত চিঠি-লিখনেওয়ালা হয়ে উঠি : আমাদের দাঁতের মাজন আর সাবানের বাক্সর সঙ্গে চিঠির কাগজ আর ফাউন্টেন পেনের কালিও থাকে আমাদের তোড়জোড়ের অংশ। অবশ্য চিঠি লেখবার সংকল্পটা সাধু, তাতে আশ্চর্য হবারও কিছু নেই; আশ্চর্য এই যে সত্যি-সত্যি আমরা চারদিকে প্রচুর পরিমাণেই চিঠি লিখি। একখানা সাবানের অর্ধেকও হয়তো ক্ষয় হয় না, কিন্তু কাগজের বাক্স তলায় এসে ঠেকে এমন নয় যে আত্মীয়-বন্ধুর বিচ্ছেদে আমরা ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় মোহ্যমান হয়ে থাকি; বরঞ্চ পর্যটনের উল্লাসে ও উত্তেজনায় নব-বিবাহিতার পক্ষে মাতৃবিরহ ভুলে থাকাও সম্ভব। তবু এটা কেন হয় যে বাড়িতে বসে যে-দূরস্থ বন্ধুর সঙ্গে পত্রালাপের কোনো উপলক্ষই হয় না, বাইরে এসে তাকেও একখানা চিঠি না-লিখলে চলে না যেন। হঠাৎ মনে হয় সুকুমার কী ভালো ছেলে, ছেলেবেলায় কত ভালোবাসতুম তাকে, আর এখন সে কেমন আছে না জানি। সুতরাং তাকেও একখানা চিঠি লিখতে হয়, ভুবনেশ্বর ধর্মশালার ঘরে তক্তাপোশে উপুড় হয়ে শুয়ে। আর বীণা সেই যে বিয়ের পরে জলপাইগুড়ি চলে গেলো, তার তো আর কোনো খোঁজই নেই। অবশ্য দুটো চিঠি তার কবে যেন এসেছিলো, তখন জবাব দেয়া হয়ে ওঠেনি, এখন একটা চিঠি না লিখলে চলে না। ‘প্রিয় বীণা : এখন আমরা চিল্কায়। এমন সুন্দর এই …’ চললো চার পৃষ্ঠা অনায়াসে। সারারাত ট্রেনে কাটিয়ে সকালবেলা হোটেলে উঠে প্রথমেই মনে হয় চিঠি লেখার কথা; আর গোরুর গাড়িতে ষোলো ঘণ্টার পরে ডাকবাংলোর আশ্রয় পেয়েই যে কাগজ-কলম বার করে নিয়ে বসি তা তো দেখাই গেলো। কোনো বাধা, কোনো অসুবিধেতেই এ-উৎসাহ শ্লথ হয় না। ট্রেনের সময় আসন্ন, এক্ষুনি বেরুতে হবে স্টেশনের দিকে; সুটকেসের উপরে বসে ওরই মধ্যে হু-হু করে দু-খানা পোস্টকার্ড লেখা হয়ে গেলো। সকালবেলা একচোট বেড়িয়ে এসেছি; দুপুরে খাওয়ার পর আবার বেরুবো, গাড়ি যতক্ষণ না আসে, দুটো ফাউন্টেন-পেন সমানে কাগজের উপর উড়ে চলেছে। আমরা ক্লান্ত থাকি; কিন্তু চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে না এমন ক্লান্ত কখনোই নয়; আমাদের মোটে সময় নেই, কিন্তু চিঠি লেখবার সময় সব সময়ই।
ভেবে দেখেছি, এর মূলে হয়তো আমাদের অতি মৃদু নিরীহ গোছের একটু স্মবারি। বেড়াবার মজা কী হলো, যদি হাতে-হাতে তখন-তখন সেটা সকলকে জানাতে না-পারলাম? যে-দুর্ভাগারা জলপাইগুড়িতে কি ঢাকায় বসে পচছে, কি সেই চিরকালের চির-চেনা কলকাতাতেই আটকে আছে, তারা অন্তত এই রোমাঞ্চম দেশান্তরের চিঠি পেয়েই ধন্য হোক। কোনারকে ডাকবাক্স না-থাকাটা শোচনীয় তাদের পক্ষেই কী চমৎকার চিঠি তারা পেতে পারতো, টাটকা-টাটকা বর্ণনায় যেন সেই জায়গার গন্ধ। আর চিল্কা থেকে যে-সব চিঠি আমরা পাঠিয়েছিলাম, তাতে অসম্পূর্ণ ঠিকানা লিখে পরে আমাদের যে-আপশোস হয়েছিলো, সে-ও তাদেরই খাতিরে। অত কথাই লিখতে পারলাম, আর মান্দ্রাজ কথাটা লিখতে কী হয়েছিলো। আমরা যে সত্যি-সত্যি মাদ্ৰাজ প্রদেশে এসে পড়েছি, এ-কথাটা তারা হয়তো জানলোই না। ‘চিল্কা হ্রদ (মাদ্রাজ) – শোনাতোও ভালো। নিজেদের অন্যমনস্কতায় আত্মীয়-বন্ধুদের এ-রকম বঞ্চিত করা কি উচিত?
চিঠিপত্রে বিজ্ঞপ্তির যে-সব ত্রুটি হয়তো হয়েছিলো, এই বইয়ে সে-সব পুষিয়ে নেয়া হয়েছে, এই ধরনের একটা ব্যঙ্গোক্তি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক হয়। সত্যি, এতগুলো পৃষ্ঠা কেন লিখলাম? এর মূলে কি কেবলই আত্মনিনাদের প্রবৃত্তি? আমি অবিশ্যি নিজেকে এই কথাই বলি যে এটা আত্মপ্রচার নয়, আত্মপ্রকাশ। আত্মপ্রকাশের চেষ্টা, অন্তত। বাস্তবপক্ষে, এটুকু সাফাই আমার আছে যে আমার এই রচনায় রটনার অংশ অতি সামান্য। এতে হয়তো আমি শুধু নিজের কথাই বলেছি; কিন্তু তেমনি, কবিতায় গল্পে উপন্যাসে নিজের কথাই তো আমরা বলি। যাদের আঙুলে লেখার সুড়সুড়ানি তাদের পক্ষে নিছক বাঁচা যথেষ্ট হয় না। তাদের পক্ষে, অভিজ্ঞতা বলতে জীবনের ঘটনাই শুধু বোঝায় না। আরো বলা যায় : ঘটনামাত্রেই অভিজ্ঞতা নয় তাদের পক্ষে। আছে কোনো-কোনো নিবিড় সংবেদনের মুহূর্ত, অবশ্যতই যে বৃহৎ ঘটনাপ্রসূত, তা নয়। হয়তো বিশেষ কিছুই হয়নি; হয়তো শুধু বৃষ্টির পরে রোদ উঠেছে, কি একটা রেলগাড়ি ছুটে গেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে হা-হা করে— হঠাৎ মনে হলো এই তো, এই তো দেখলুম, মনে হলো মুহূর্তের জন্য বিশ্বের রহস্য উন্মোচিত হলো বুঝি। এই মুহূর্তগুলিই আমাদের জীবনের চিহ্ন, এদের দিকে না-তাকালে বুঝতে পারিনে যে বেঁচেছি। ভাবনার হাওয়ায় তারা চঞ্চল, স্মৃতির কুয়াশায় তারা রঙিন। তারা হারাবে না, তারা পুরোনো হবে না, নতুন হয়ে তারা ফিরে আসবে। এই তো কয়েকটি মুহূর্ত কবে ছাড়িয়ে এসেছি, তবু এখনো তাদের দেখতে পাচ্ছি যেন শাদা পাখির ঝাঁক সমুদ্রের দিগন্তে। একদিন হয়তো দিগন্ত ছাড়িয়ে উড়ে যাবে, রইলো এখানে তাদের পাখার শব্দ, রইলো তাদের উড়ে-চলার হাওয়া।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন