আমি চঞ্চল হে – ৫

বুদ্ধদেব বসু

ময়ূরকন্ঠি সমুদ্র আকাশে গিয়ে মিশেছে। আকাশে আলো। ঢেউগুলো গড়িয়ে চলেছে আলোর ঝলকে-ঝলকে লুটোপুটি করে। সবুজ সবুজ। হলদে সমুদ্র। বেগনি সমুদ্র। নতুন রং লাগছে প্রতি মুহূর্তে। বসে-বসে দেখা। শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে দেখা। চিরকাল এমনি চেয়ে থাকা যায়— বাদামি অর বেগনি আর সবুজ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। কানে লাগছে শোঁ-শোঁ শব্দ, আর ঢেউয়ের ধাক্কার গুমগুমানি আর হাজার তোলপাড়ের চীৎকার। ঘুম আসছে। ঘুমোবো না। আর-একটা সিগারেট ধরাবো, জোর করে চেয়ে থাকবো। দেখবো আকাশ, দেখবো সমুদ্র; সমুদ্রের রাশি-রাশি শব্দের মধ্যে কখন যেন আসে হঠাৎ এক পলকের বিরতি, রইবো কান পেতে তারই জন্য। আর একটু পরেই তো ওরা এসে ডাকবে।

তবু তন্দ্রা আসে। হোটেলের তেতলার একটি মাত্র ঘর আমরা দখল করেছি। মস্ত ছাদটা আমাদেরই কপিরাইট, কিন্তু ঘরটি বড়ো ছোটো। তায় টেবিলে আলনায় তক্তাপাশে এমন ঠাসা যে পা ফেলবার জায়গা নেই। সুতরাং ঘরে থাকলে শুতে হয়, এবং এই দুপুরবেলায় শুলেই তন্দ্রা আসে। মধ্যাহ্নভোজনটা প্রতিদিনই প্রায় ভোজ হয়ে ওঠে, সেটাও তন্দ্রার সহায়ক। সমুদ্রে স্নানের পর দুর্দান্ত ক্ষুধিত হয়ে ফিরে আসি। আমরা লোনা জলটা গায়েই শুকোতে দিই; ‘ভালো’ জলে আবার বাথরুম-মাফিক মাজা-ঘষা নিতান্তই অকারণ। শরীরটা খানিকক্ষণ বেশ কড়কড় করে। খাওয়াটা হয় প্রচণ্ড উৎসাহে, ঠাকুরের সব রান্নাই চমৎকার। তারপর ভরা দুপুর, আর সমুদ্র, আর আমরা। বিকেলে আর-একবার স্নান করবো। যে-ক’দিন পুরীতে আছি, স্বাস্থ্য ভালো করতে হবে।

আমাদের সমস্ত শরীরে একটা অস্ফুট মধুর ব্যথা। সমুদ্র আমাদের মেরেছে। সমুদ্র আমাদের নিয়ে খেলা করে। বালুর উপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে হঠাৎ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বড়ো ভালো। কিন্তু একবারেই ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করো, ঐ ঢেউ আসছে। পাশে আছে জং বাহাদুর আর গোবিন্দ, ভয় নেই। ঐ এলো ঢেউ। ডুব দাও। মাথার উপর দিয়ে সাতশো ঘোড়া লাফিয়ে চলে গেলো। শোনো গর্জন, ঢেউ লাগলো তীরে। শোঁ করে ফিরে যাচ্ছে, দ্রুত ঘূর্ণির টানে আমরাও বুঝি ভেসে গেলাম। পাক খেয়ে পড়ি বালু-মেশানো, বালু-বাদামি জলে, হাতদুটো নরম বালুতে ডুবিয়ে দিয়ে শক্ত হয়ে পড়ে থাকি। ঢেউ সরে যায়, আমরা পড়ে থাকি বালুর বিছানায়, যেন প্রত্যাখ্যাত। আমরা উঠে ছুটে যাই এগিয়ে; ঐ ঢেউ এলো।

এলো। লাফ দাও। ঠিক হলো না; মুখে প্রচণ্ড বাড়ি মেরে চলে গেলো ঢেউ। সর্বনাশ, ঐ আর-একটা, আমরা তো হাঁপিয়ে গেছি। ভয় নেই, জং বাহাদুর আর গোবিন্দ আমাদের তুলে ধরেছে। আমরা ঢেউয়ের উপরে। পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে ঢেউ এলো। গোবিন্দ আর জং বাহাদুরকে দেখা যাচ্ছে না, ওরা ডুবে গেছে, আমাদের এক হাতে ধরেছে উপরে, আমরা ঢেউয়ের ঘোড়সওয়ার। হঠাৎ চকিতে নেমে গেলুম। এ কী অপূর্ব দোলা লাগলো শরীরে। আমরা ভাসছি, নাচছি। ক্লান্ত হয়েছি আমরা; গোবিন্দ আর জং বাহাদুর সাঁত্রাচ্ছে; আমরা ওদের পিঠে চড়েছি গলা আঁকড়ে ধরে। ওরা আমাদের ফেলে দেবে না। ওরা আরো দূরে যেতে চায়, আমরা বারণ করি। ওদের ভয় নেই, সমুদ্র ওদেরই। সমুদ্রের জলে মাছের মতো ওরা। সমুদ্রের জল লেগে লেগে চিক্কণ মসৃণ কালো এদের চামড়া। এরা মান্দ্রাজ উপকূলের মানুষ, পাঁচটা-ছ’টা ভাষা মোটামুটি বলতে পারে। গোবিন্দ বড়ো বেশি কথা বলে; ওর মুখে রাজা-উজির ছাড়া কথা নেই। গোবিন্দ চটে গেলে ওর বৌকে মারে। জং বাহাদুর প্রকাণ্ড লম্বা, সমুদ্রের ধার দিয়ে হাফ প্যান্ট আর নীল জার্সি পরা জং বাহাদুর যখন লম্বা ঠ্যাং ফেলে হেঁটে যায়, দেখায় ভারি জমকালো। ও গম্ভীর মানুষ, বেশি কথা কয় না। গোবিন্দ ওর তুলনায় একটা ফাজিল চালিয়াৎ। আর ওদের দু-জনের তুলনাতেই আমরা নিতান্ত ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ। ঢেউয়ের এত দাপাদাপিতেও ওদের মাথার খড়ের টুপি কখনো খুলে যায় না। আর যদি বা হঠাৎ খুলে যায়, সেই উন্মত্ত তোলপাড়ের মধ্যেও চট করে সেটা ধরে ফেলে তক্ষুনি মাথায় পরে নিয়ে আবার ডুব দেয়। দু-জনেই ওরা আশ্চর্য।

কার্তিক মাস, জলে একসঙ্গে বেশিক্ষণ থাকা যায় না, শীত করে। ভিজে শরীর নিয়ে উঠে আসি, ধুপ করে বসে পড়ি উষ্ণ নরম বালুর উপর, ঘন-ঘন লম্বা নিশ্বাস পেট থেকে উঠে আসে বুকের ভিতর দিয়ে। আমরা হাঁপাচ্ছি, আমরা কাঁপছি, দূরে সমুদ্র কাঁপছে। মুঠো-মুঠো গরম বালু নিয়ে মাখি শরীরে। শ্যামায়মান আমাদের শরীর, আমাদের রক্তে সূর্যের ঘ্রাণ, সূর্যের গান আকাশে-আকাশে। আমরা সূর্য- গুঞ্জিত, আমরা সমুদ্র-উত্থিত। এই তো আমরা শুয়ে পড়েছি বালুর উপর, টান হয়ে, এক হাত মাথার নিচে, আর এক হাত চোখ আড়াল করেছে। আমরা ঋজু, আমরা ক্ষীণ, আমাদের শরীর এই উষ্ণ-মধুর দিনের মধ্যে গলে গেলো। দূরের সমুদ্র ইস্পাতের মতো ঝলসাচ্ছে। গোল হয়ে ঘুরছে সমুদ্রের শাদা পাখিরা, হঠাৎ ছোঁ মেরে মাছ তুলে নিচ্ছে জল থেকে। আমরা মুক্ত, আমরা ঐ পাখিদের মতো দায়িত্বহীন। আমরা বালুর উপর দিয়ে গড়াবো। বালুর মধ্যে গর্ত খুঁড়ে হাত ঢুকিয়ে দেবো, সেখানে ভিজে ঠাণ্ডা। মুখ ডুবিয়ে দেবো শিরশিরে ভিজে বালিতে। যেখানে এসে ঢেউ শেষ হয় সেখানকার নরম, নরম বালুতে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকবো। আমাদের উপর দিয়ে চলে যাবে নিঃশেষিত ঢেউ। হঠাৎ জোরে এসে ছিটকে ফেলে দেবে দূরে। আমরা ভয় করিনে, আমাদের ভালো লাগে এই খেলা। ভিজে বালিতে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কত কী লিখি, ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যায়। চিরকাল নিটোল মসৃণ এই বালুতট, কেউ এতে কোনোদিন একটি আঁচড় রাখতে পারবে না।

আমাদের বিশ্রাম হয়েছে, এবার স্নানের দ্বিতীয় কিস্তি। গোবিন্দ এসে দু-বার তাড়া দিলো, ও কথা বলে বেশি। গোবিন্দ আর জং বাহাদুরের সময়ের মূল্য আছে, আমাদের নেই। জং বাহাদুর গম্ভীর মানুষ; একটু দূরে গিয়ে বালুর উপর লম্বা কালো শরীরটা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে ছিলো, এইবার উঠে এলো। ওদের হাত ধরে আমরা আবার নামলুম। ওরা ধীর। ওদের আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত আমরা। নেহাৎ আনাড়ি, নেহাৎ দুর্বল, ওদের হাতে আমাদের প্রাণ। মস্ত ঢেউ যখন উঁচিয়ে আসে, গোবিন্দ আমার দু-কাঁধ ধরে বলে, ‘হামাকে একখানা কাপড় দেবেন। গোবিন্দ নির্বোধ নয়, পুরস্কার চাইবার ঠিক সময় ও জানে।

বেলা বেড়েছে। আকাশ ঝকঝক করছে। জেলেদের যে-সব নৌকো সকালবেলায় রওনা হয়েছিলো, এতক্ষণে তারা ঐ দূরে কালো একটা ফুটকি। বিকেলে ওরা ফিরে আসবে মাছ নিয়ে। কাঠের ভেলার মতো নৌকো করে কোথায় চলে যায় ওরা। ওদের ভয় করে না, আমাদের যেমন বাস্-এ চড়তে ভয় করে না। বড়ো নৌকোও আছে, পারে পড়ে থাকে সেগুলো। ওরা সেগুলো চড়ে না, ভাড়া খাটায়। তারই একটায় আমরা আজ বেড়াবো।

রোদ চড়ছে, খিদে পেয়েছে, আর থাকা যায় না। সমুদ্রের জল কখন নেমে গেলো। যথেষ্ট ক্লান্ত হয়েছি। এই কাপড়, এই চটি, এই ছাতা। হোটেল মনে হয় কতখানি রাস্তা। সমস্ত দুপুরবেলাটা অলস ভ্রমর। সমুদ্রে আমরা আচ্ছন্ন, সমুদ্রে আমরা ভরে আছি। সমুদ্র নীল নয়। রুপোর মতো শাদা, কি মেঘের মতো ধূসর, কি বাদামি কি বেগনি কি সবুজ, নীল নয় কখনোই। একবার, শুধু একবার আমরা দেখেছিলাম নীল সমুদ্র। সে আশ্চর্য। হঠাৎ যদি আকাশ ফাঁক হয়ে স্বৰ্গ ঝলসে ওঠে চোখের সামনে, এ তেমনি। সিঁড়ির মতো ধাপ বেয়ে ঘুরে-ঘুরে উঠছি কোনারকের মন্দিরে। একটু ভয়ে ভয়েই উঠছি; মন্দিরের সৌন্দর্যের চেয়ে নিজেদের পায়ের দিকেই বেশি নজর। মাঝামাঝি এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালুম। হঠাৎ খুলে গেলো চোখের সামনে দিগন্তরেখার মতো বাঁকা সমুদ্র। নীল, নীল। ‘স্বপ্নের ঢেউ-তোলা নীল সমুদ্র’ এরই নাম। এ আমরা আশা করিনি, সমুদ্র এত কাছে আমরা জানতুম না। তবু এত কাছে নয় যে শব্দ শোনা যায়। চারদিকের গভীর স্তব্ধতায় শুধু বিশাল ঝাউবনের হাওয়ার ঢেউ। অপরূপ, অবিশ্বাস্য কোনো স্বপ্নের মতো নীল, নীল সমুদ্র প্রসারিত। মুহূর্তে যেন মিটলো চোখের চিরকালের তৃষ্ণা। এমনি কোনো দেখা জীবনে ঘটলে এই ভেবে আক্ষেপ হয় যে চোখের দেখাকে আমরা কোনোরকমেই স্থায়ী করতে পারিনে। সমস্ত প্রাণ দিয়ে দেখেও কতটুকুই বা দেখতে পারি! চলে আসতে হয়; শরীরের স্থানান্তরে দেখার অবসান। তাছাড়া, এক মুহূর্তের দেখার চাইতে এক ঘণ্টার দেখা যে অবশ্যতই বেশি, তাও নয়। বরং প্রথম অপ্রত্যাশিত মুহূর্তেই যা দেখবার সমস্তটাই একসঙ্গে দেখে নিই। তারপর শুধু মনের উপর দাগ বুলোনো। কিন্তু সে-দাগ পাকা হয় না। বছর কাটে, রং ফিকে হয়ে আসে। যে- কবিতা ভালো লাগে, তা মনের মধ্যেই রাখতে পারি; মনের মতো বইটিকে কাছাকাছি রাখতে পারি সব সময়। চোখের দেখা হারিয়ে যায়। ক্যামেরা দিয়ে এই দেখাগুলোকে যারা আটকে রাখতে চায়, নিতান্তই তারা সেন্টিমেন্টাল মানুষ। হায়রে নিখুঁত ফোটোগ্রাফ! মৃত প্রিয়জনের ছবি জমকালো করে ঘরে বাঁধিয়ে রাখা নিজের শোকের বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কী? যে মরতেই পারলো তার আবার ছবি! জ্ঞানীর কি কলাবিদের আগ্রহ যদি না থাকে, তাহলে নানা জায়গার ছবি তোলা ও রাখার মুখ্য উদ্দেশ্যই নিজের পর্যটনের দলিলরচনা। প্রতি ভ্রমণকারীর অ্যালবামের উপর অদৃশ্য কিন্তু অতি স্পষ্ট অক্ষরে এই কথাটাই লেখা থাকে : দ্যাখো আমরা কত বেড়িয়েছি! ক্যামেরার ছবি তো মরা; আসল ছবি থাকে মনে, হঠাৎ একদিন চমকে দেয় মুহূর্তের তীক্ষ্ণতায়, হঠাৎ জ্বলে ওঠে রঙিন মেঘে-মেঘে কল্পনার আকাশে। কিন্তু স্বচ্ছ, নিটোল সেই মুহূর্তটি বুদ্বুদের মতো ফেটে যায়, মুছে যায় মেঘ— তারপর হয়তো আমরা ভুলে যাই, হয়তো আবার মনে পড়ে অনেক, অনেক দিন পরে। তবু মৃত্যুর স্মৃতিসঞ্চয়ের মতো ফোটোগ্রাফ নাড়াচাড়া করে কৃত্রিম মনে- পড়ার চাইতে স্বাভাবিকভাবে ভুলে যাওয়া অনেক ভালো। আর যা-ই হোক, মনটাকে জাদুঘর করে তুলতে আমি নিতান্ত নারাজ।

সেদিন বিকেলে সমুদ্র ছিলো বার্নিশ-করা কাঁসার মতো ঝকঝকে। ঢেউগুলো জ্বলন্ত রোদ দিয়ে মাজা। সূর্য হেলেছে পশ্চিমে, নেমেছে সোনার বন্যা তির্যক স্রোতে, চোখ ঝলসে যায়। আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, দরজার বাইরে গোবিন্দ ডাক দিলে। নৌকো প্রস্তুত। মস্ত বড়ো নৌকো, আট-দশজন মাঝি, কোনো ভয় নেই। গোবিন্দ আর জং বাহাদুর থাকবে তীরে দাঁড়িয়ে, দুর্ঘটনার কোনো লক্ষণ দেখলেই তীরের মতো ছুটে যাবে সাঁৎরে। ফুরফুরে হাওয়া বইছে, বিকেলি ঢেউগুলো ছোটো- ছোটো। সমুদ্রের বুকের উপর শাদা পাখির ফুটকি। আমরা পার হয়ে যাবো ঢেউ, যাবো সেখানে যেখানে পাখিরা পাখা মুড়ে জলে বুক চেপে বসে। আতঙ্কসঙ্কুল জলরাশি চাষ করবে এই নৌকোর হাল। নিচে অক্টোপাস, নিচে হাঙর, কত দাঁত- দেখানো দুঃস্বপ্ন। আমাদের ভয় নেই। আমরা বেরোলাম নতুন দ্বীপের সন্ধানে, আমাদের কল্পনার উপনিবেশ। নতুন দেশ জয় করবো আমরা। ঐ তো সমুদ্র ধূ- ধূ করছে; সোজা রওনা হলে দিনের পর দিন ভাসতে ভাসতে কোথায় গিয়ে ঠেকবো? হয়তো বর্মার কোনো ঘোর জঙ্গলে, যেখানে মানুষ এখনো যায়নি।

আমরা রওনা হয়েছি, গোবিন্দ আমাদের নৌকোয় তুলে দিয়েছে কোলে করে। পায়ে আমাদের জুতো, গায়ে সভ্যতার বস্ত্র। নতুন দেশ আবিষ্কার করার মতো চেহারা নয় আমাদের। শরীর সংকীর্ণ, স্থানকালে আবদ্ধ; মন মুক্ত, মনের সীমা নেই। আমাদের মনকে আমরা উড়িয়ে দিয়েছি এই সমুদ্রের লোনা হাওয়ায়। সমুদ্র ঝলমল করছে, সমুদ্র ঝকঝক করছে। চলো, চলো। আমাদের কাপ্তান মনে-মনে মন্ত্র পড়লো, তারপর আটজন খালাসি চীৎকার করে উঠলো একসঙ্গে। দুলে উঠলো নৌকো। ঢেউ পার হচ্ছি আমরা। কাপ্তান খালাসিদের হুকুম দিচ্ছে থেকে-থেকে, অদ্ভুত ওদের ভাষা, অদ্ভুত ওদের কালো-কালো দস্যুর মতো চেহারা। ঘোড়ার মতো চলেছে নৌকো, ঢেউয়ের তালে-তালে লাফিয়ে উঠছে, ধুপ করে তলিয়ে যাচ্ছে। নৌকোয় জল উঠছে, একজন লোক বসে-বসে কেবল ঐ জল সেঁচে ফেলছে। মস্ত দোলনায় আমরা দুলছি : এই আকাশে উঠে গেলুম, এই নেমে গেলুম পাতালে। কতদূর যাবো আমরা এই ঢেউ পার হয়ে। মুখে লাগছে জলের ছিটে : মুখে লাগছে হাজার-হাজার মাইল সমুদ্র পার হয়ে-আসা হাওয়া। ঢেউয়ের একটা সারি আমরা পার হয়েছি, সামনে রয়েছে আর-একটা। পুরীর কূল এরই মধ্যে কত দূরে সরে গেছে; সারি-সারি বাড়িগুলো নিয়ে লম্বা তটরেখা কল্পনার মতো অপরূপ, সোনালি আভায় মোড়া। পুবদিকের শেষ মস্ত লাল বাড়িটা কোন রাজার, তারপর জঙ্গল, ঐ কোনারকের পথ। দূরে তাকালে মনে হয় সমুদ্র ঢালু হয়ে উঠে গেছে, নাবিকের চোখের সমুদ্র বুঝি এই : ইংরেজের ভাষায় সমুদ্র উঁচু কি এরই জন্যে? আর-একটা ঢেউয়ের সারি পার হয়ে এলাম। তীরে যে-গর্জন এত প্রচণ্ড, এখন তা শোনা যাচ্ছে স্বপ্নের মর্মরের মতো, অস্পষ্ট শোঁ-শোঁ ভাসছে হাওয়ায়। ঢেউগুলোকে পিছন থেকে দেখছি : ঘাড় উঁচু করে দৌড়ে চলেছে, আছড়ে পড়ছে মুখে ফেনা তুলে। এখন আর অত ভয়ংকর লাগছে না ওদের। এই ঢেউগুলো নিতান্তই স্থানীয় ঘটনা, এখন বুঝতে পারছি এখানে ঢেউ নেই; এখানে গম্ভীর বিশাল জল মৃত্যুর মতো স্তব্ধ; কোনো শব্দ নেই, কোনো আলোড়ন নেই; শুধু থেকে-থেকে সমুদ্রের বুক অস্ফুট দুলে ওঠে যেন কোনো চিরন্তন অবিশ্রান্ত দীর্ঘশ্বাসে। কেঁপে ওঠে বুক। কেঁপে ওঠে বুক আমাদেরও, ভয় করে। ঢেউয়ের উতরোল উন্মত্ততা, ও তো সমুদ্রের শিশু- খেলা : ভয় এখানে, এই ভীষণ, স্পন্দিত স্তব্ধতায়। চলো, ঢেউয়ের শব্দ কানে প্রায় মিলিয়ে আসছে। সূর্য নেমেছে। হঠাৎ হালের তক্তা খুলে গেলো, জলে ভেসে চললো। ছোট্ট একটা কালো কুচকুচে ছেলে, মুখ-ভরা বসন্তের দাগ, তাকে ওরা জলে নামিয়ে দিলে। অনায়াসে ঝাঁপ দিলে সে; ছোটো ছোটো হাতের জোর বাড়ি লাগলো জলে; মাছের মতো সাঁরে গিয়ে ধরলো তক্তা, নিয়ে এলো কুকুরের মতো কামড়ে। আশ্চর্য! এই জলেই তো হাঙর আর অক্টোপাস, আর কিলবিলে লিকলিকে দাঁতওয়ালা কত জানোয়ার। স্বচ্ছ ধূসর জলে অনেকদূর চোখ যায়, মাঝে-মাঝে জেলিমাছ ফুটে রয়েছে দীর্ঘবৃত্ত ফুলের মতো। ছেলেটা দাঁত বার করে হেসে বললে, আনবো একটা তুলে? একটাকা দিলেই পারি। আমরা বললাম, দু-আনা দিতে পারি। দ্বিতীয় কথা না-বলে ঝুপ করে নেমে গেলো ছেলেটা। ওর কালো শরীর গোল হয়ে জলের নিচে দুলছে, গাছের ডাল ধরা বানর যেন। সগৌরবে নিয়ে এলো জেলি-মাছ— হায়রে, এই নাকি? স্যাৎসেঁতে প্যাঁচপেচে একটা ছোট্ট পিণ্ড, একটু পরে রংটাও ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। শিক্ষা হলো : বৃত্ত থেকে ফুল ছিঁড়তে নেই।

এবার আমরা ফিরবো। বিকেল ঢলে পড়ছে। হাজার মাইল ভরে সমুদ্র পড়ে রয়েছে চারদিকে। ছোটো-ছোটো শাদা পাখিরা এই বসে, এই ওড়ে। পশ্চিমে যেন আগুনের সমুদ্র। পুবদিকে একটি মেঘ গোলাপি হয়ে উঠলো। আমরা ফিরছি। দীর্ঘনিশ্বসিত বুকের মতো সমুদ্রের নিঃশব্দ অলক্ষিত ওঠা-পড়া। ঢেউয়ের বেড়া এসে পড়লো, এবার অতি সহজেই লাফিয়ে গেলাম। তীরে দাঁড়ানো গোবিন্দ আর জং বাহাদুরের মূর্তি বড়ো হয়ে উঠছে। আবার ঢেউ। কত অল্প সময়ে এলাম। ঐ আমাদের হোটেল। ফিরে গিয়ে ছাদে বসে চা খাবো। ঢেউগুলো এবার বাধা দিচ্ছে না, ঢেউয়ের ধাক্কাই নৌকোকে নিয়ে যাচ্ছে ঠেলে। কানে ভিড় করে এলো ঢেউয়ের দাপাদাপি চীৎকার। কাপ্তান চেঁচিয়ে কী বলে উঠলো ওদের অদ্ভুত ভাষায়। নৌকোর নিচে বালি ঠেকলো। গোবিন্দ আর জং বাহাদুর এগিয়ে এসেছে। ওরা হাসছে। আমরাও হাসছি। আমরা জয় করেছি নতুন দেশ, আমরা ফিরে এসেছি।

দ্যাখো না সমুদ্র তোমার কী করে,
এই লোনা নীল জল আর চাবুকের মতো হাওয়া।

যেমন শঙ্খ আর ঝকঝকে ঝিনুক
এই ঢেউয়েরা হাজার বছর ধরে আঁকে
কত অফুরন্ত রঙে, কত বিচিত্র নকশায়
বাদামি আর বেগনি আর অপরূপ মসৃণ
আর আঁকাবাঁকা ঢেউ-খেলানো রেখায়—
তেমনি তারা তৈরি করুক তোমার শরীরকে
শঙ্খের মতো মসৃণ তোমার শরীর।

একবার নিজেকে দাও না সমুদ্রের কাছে
তারপর দ্যাখো সে তোমাকে নিয়ে কী করে।

ঢেউ তোমাকে মেজে দিয়ে যাক
শাদা ফেনার তোলপাড়ে;
সমুদ্র তোমাকে নিয়ে খেলা করুক
তোমার মসৃণ পরিষ্কার শরীর নিয়ে,
তোমাকে জড়িয়ে ধরুক চারদিক থেকে তার বালু-বাদামি জল।
যেমন সে তৈরি করেছে হাজার বছর ধরে ধবধবে শাদা শঙ্খ,
তেমনি সে তৈরি করুক তোমাকে, তোমার ব্রাউন মসৃণ শরীর।

ভয় কোরো না, সমুদ্রকে ভয় কোরো না,
ওর মধ্যে অফুরন্ত স্নেহ।
ঝাঁপিয়ে পড়ো
এই ফেনিল তোলপাড়ের বুকের মাঝখানে,
ঢেউয়ের সঙ্গে নেচে-নেচে যাও
লাফিয়ে ওঠো ঢেউয়ের চূড়ায়
জলকন্যার মতো।

সমুদ্র অপরিসীম, সমুদ্র ভীষণ,
কিন্তু সে ভালোবাসে তোমার সঙ্গে খেলা করতে,
ওর মধ্যে অন্তহীন স্নেহ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন