আমি চঞ্চল হে – ৯

বুদ্ধদেব বসু

খানশামা জিজ্ঞেস করলে : ‘টিকিট না পাস?’ কথাটা বুঝতে না-পেরে মুখের দিকে তাকালুম। ‘আপনারা কি পাসে যাচ্ছেন? তাহলে অন্যরকম বিল্ হবে। না, পাস নয়। এবং খুর্দা রোড স্টেশনে গাড়িতে বসে এই আমরা দ্বিতীয়বার চা খাচ্ছি, এ- ছাড়া পাস মনে করবার আর-কোনো কারণও ভাবতে পারলুম না। চেহারা সম্বন্ধে লোকটার স্মরণশক্তি ভালো, বলতে হবে। প্রথমবার ভুবনেশ্বর থেকে পুরীর পথে। তারপর এই পুরী থেকে চিল্কা যাচ্ছি। বিকেলের চা এমনিতেই এত সুখকর যে তুলনা হয় না; দ্বিগুণ সুখকর, যদি তা খাওয়া হয় এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় যাবার পথে রেলগাড়িতে বসে। জীবনের এ একটি নিটোল-মধুর মুহূর্ত; যখন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নিজের সম্পূর্ণ সমন্বয় অনুভব করে মন শান্ত-সোনালি হয়ে ওঠে। ট্রেনে বসে এই চা-খাওয়ার জন্য যে-দামটা দিই গৃহের তুলনায় সেটা অতিরিক্ত হলেও আসলে অতি তুচ্ছ। স্থান ও সময়ের সন্নিবেশে জিনিশের দাম স্বভাবতই বাড়ে-কমে। সুইৎসার্ল্যান্ডে পাহাড়ে চড়তে-চড়তে যে-ইংরেজ এক গ্লাশ বিয়ারের জন্য তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে দিতে প্রস্তুত, নেমে এসে সরাইতে বসে সেই বিয়রের জন্য একটু বেশি দিতে হলে সে তীব্র প্রতিবাদ করবে। ট্রেনে শরীর ক্লান্ত থাকে, ক্ষুৎপিপাসা হয় পৌনঃপুনিক; সুতরাং বিকেল পড়তেই যে-স্টেশনে এসে গাড়ি দাঁড়ালো, সেখানে যদি চমৎকার চায়ের ব্যবস্থা দেখা যায় তাহলে সেটা ঈশ্বরের আশীর্বাদই মনে হয়, মনে হয় না পয়সা দিয়ে কেনবার সামান্য পানীয়। রেলে-ইস্টিমারে চা ও খাদ্য যে প্রায় সব সময়েই অতি উৎকৃষ্ট মনে হয় তার আসল কারণটা ওদের ভাঁড়ারে বোধহয় নয়, আমাদেরই মনে।

আমরা চায়ে চুমুক দিচ্ছি অলসভাবে, আর মাঝে-মাঝে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি। ও-দুটো কাজ একসঙ্গে করতে পারা সত্যি রাজকীয় বিলাসিতা। অনেকগুলো কাজ আছে যা এমনিতে বিশেষ-কিছু নয়; কিন্তু একাধিক যুক্ত হলেই উপভোগ উপচিয়ে পড়ে। যেমন ধরা যাক, বই পড়তে অনেক সময়েই ভালো লাগে, কিন্তু রাত্রে ঘুমের আগে বিছানায় শুয়ে বই পড়ার বিশেষ ও অদ্ভুত একটি আনন্দ আছে। সুখাদ্য অনেকেরই প্রিয়, কিন্তু সামাজিক নিমন্ত্রণে গিয়ে এক রাশ অপরিচিতের মাঝখানে বসে সে-রস বিষ হয়ে ওঠে রসনায়; আর নিজের বন্ধুদের সঙ্গে হাসিতে-গল্পে মিশিয়ে যখন খাওয়া তখন তা ঔদরিক ভোজের সীমানা ছাড়িয়ে মনের উৎসব হয়ে ওঠে। এমনি অনেক ছোটোখাটো যোগাযোগ থেকে আমাদের অনেক আনন্দের জোগান। সুখী হতে হলে সব সময় মস্ত ঘটনার দরকার করে না, জীবনের অতি সহজ অতি সাধারণ জিনিশগুলির সংযোগই আমাদের প্রাণের লালন।

এখানে লাইনটা বাঁকা; আমাদের গাড়ি অর্ধচন্দ্রের আকারে দাঁড়িয়েছে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালে অন্য কামরাগুলো চোখে পড়ে, কোনো জানলায় একটা কনুইয়ের কোণ, কোনো জানলায় একটা মুখ বাড়ানো। ওদিকে গার্ডের গাড়ি, এদিকে এঞ্জিনটা অস্পষ্ট। দু-দিকে প্ল্যাটফর্মে নানা লোকের আসা-যাওয়া। এঞ্জিনগুলো এক লাইন থেকে আর-এক লাইনে যাওয়ার সময় যেমন খানিকটা ফোঁসফোঁস করে এদিক- ওদিক ঘোরে, তেমনি ঘুরছেন নীল ইজের আর কুর্তা পরা রেলের সায়েরা। একটা লোক খবরের কাগজ ফিরি করছে; কলকাতা ছেড়েছি পর ও-বস্তু ছুঁয়ে দেখিনি। হঠাৎ কৌতূহল হলো : দেখা যাক, এ-ক’দিনে পৃথিবী কোথায় পৌঁছলো। একখানা স্টেটসম্যান কিনলুম। কোনো খবর নেই। এস্কিমোদের সম্বন্ধে একটা চলনসই ‘গল্প’ আছে, সেটা পড়া গেলো। কোনোদিনই যেন কাগজে কোনো খবর থাকে না। কোনোদিনই আমি পড়বার মতো কিছু খুঁজে পাইনে এতে। তবু বাড়িতে সকালবেলায় যতক্ষণ না খবরের কাগজ খুলেছি, মনে শান্তি নেই। ভাঁজ-করা টাটকা পাতাগুলো হাত দিয়ে খুলতেই যেন ভারি একটা সুখ। পেয়ালায় চা ঢাললেই যে-গন্ধটি বেরোয় তা যেন বন্ধুর গলার চির-পরিচিত ডাকের মতো; কাগজের গায়ের গন্ধেও তেমনি একটি অভ্যস্ত সম্ভাষণ। সেই স্পর্শ আর গন্ধের জন্যই খবরের কাগজ অপরিহার্য হয়েছে আমার জীবনে। প্রথম সেই মুহূর্তটিই ভালো, তারপর খুলে আর ভিতরে কিছু পাই না। দু-কলম জোড়া হেডলাইন ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সম্পাদকীয় প্রবন্ধের শিরোনামা দেখেই ভড়কে যাই : একমাত্র পঠিতব্য মনে হয় বিজ্ঞাপনগুলোই। অনেক চেষ্টা করেও দশ মিনিটের বেশি ও-নিয়ে নাড়াচাড়া চলে না। তারপর ইস্ত্রি-করা ফিটফাট মহোদয়ের ছেঁড়াখোঁড়া হয়ে মেঝেয় গড়াগড়ি। আমার খেলার বাতিক নেই, ক্রসওয়ার্ডের মাথা নেই, শেয়ার-মার্কেটের খবরের দরকার নেই— এবং সর্বোপরি পলিটিক্স সম্বন্ধে ছিটেফোঁটা আগ্রহও নেই। কথাটা স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করছি : কিন্তু আমার মতো নিষ্কর্মা অসামাজিক জীবেরও যাতে আত্মসম্মান বজায় থাকে, সেইজন্যেই বোধহয় আনাতোল ফ্রাঁস তাঁর এক চরিত্রকে দিয়ে বলিয়েছিলেন : ‘আমি তো এমন প্রতিভাহীন নই, ম্যাডাম, যে পলিটিক্সে আমার কোনোরকম আগ্রহ থাকবে।

স্টেটসম্যান পড়ে রইলো, গাড়ি এখনো ছাড়ছে না। স্টেশনটি সুন্দর। সুন্দর আমাদের গাড়ির এই দাঁড়াবার অর্ধ-বৃত্ত ভঙ্গি। এখানে অপেক্ষা করতে বিরক্ত লাগে না। তাকিয়ে দ্যাখো। একটু পরেই এঞ্জিনে টান পড়বে, ঋজু হবে ট্রেনের লম্বা শরীর, পাশের জানলায় পাগড়ি-বাঁধা মাথা আর দেখবো না, আমরা ছুটবো মাঠ ছাড়িয়ে নদী পেরিয়ে পাহাড় পিছনে ফেলে। নতুন জায়গায় চলেছি বলে মনে-মনে আমরা উত্তেজিত, তবু আমাদের পৌঁছবার তাড়া নেই। গন্তব্যের চাইতে পথের আকর্ষণ কম নয়; যেমন কিনা উপায়ের সার্থকতা অনেক সময় নিজের মধ্যেই, লক্ষ্যের মহিমায় নয়। রুদ্ধচোখে ঊর্ধ্বশ্বাসে কোনোরকম করে অভীষ্টে পৌঁছতে পারলেই হলো, এ হচ্ছে বেনে মনের কথা— যেমন একটা কথা আছে যে পয়সা হলেই হলো, উপায়টা যা-ই হোক; যেমন সওদাগরি দালালের ভ্রমণ সবচেয়ে-অল্প সময়ে সবচেয়ে-বেশি মুনাফার হিসেবে ছক-কাটা। আর্টের প্রধান মহিমা তো এইখানেই যে সেখানে কোনো তাড়া নেই। একমাত্র আর্টই হাতে-হাতে নগদ দাম পাওয়ার বৈশ্য প্রত্যাশা থেকে মুক্ত। জিনিশটার রচনাতেই আনন্দ; ফললাভ— অন্তত তখনকার মতো— অবান্তর। রাস্তাটাই এত সুখের যে গন্তব্যের কথা আর মনে থাকে না। লেখায় একটা ছোট্ট কাটাকুটির উপর কলম বুলোতেও ভালো লাগে; ছবিতে নতুন রঙের একটা পোঁচ দিয়ে দশ মিনিট তাকিয়ে থাকা যায়। ‘নষ্ট হয় না সে-সময়টা। কিন্তু যে-লোক দশটার সময় আপিশে চলেছে সে যদি হঠাৎ সকালবেলার ময়দানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ট্রাম থেকে নেমে মাঠে খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ায় তাহলে পরদিন থেকে হয়তো সে আপিশে যাওয়ার দায় থেকেই নিষ্কৃতি পাবে; যে-লোকের দুশো কাগজ সই করে আজকের ডাকেই পাঠাতে হবে, সে নিজের সুশ্রী হস্তাক্ষরের দিকে তাকাতে গিয়ে আধ মিনিটও দেরি করতে পারে না। জীবনে সকল ক্ষেত্রেই আলস্য, দীর্ঘসূত্রতা ও অন্যমনস্কতা দোষাবহ; এক আর্টের ক্ষেত্রেই ওগুলো সার্থক।

আমাদের বেড়ানোও আমার এই লেখারই মতো; তার পৌঁছবার গরজ নেই, পথে-পথে কেবলই নানা ছুতোয় সে দেরি করছে। এখানে একটু দাঁড়াও, ওখানে একটু দ্যাখো। কিসের গন্ধ লাগলো; এলো স্মৃতির হাওয়া। ভাবনার কত রঙিন সুতো ঢিলে হয়ে ঝুলে পড়ছে, জড়িয়ে যাচ্ছে পরস্পরে; সেগুলোকে মেলানো যদি না যায় তো না-ই গেলো। প্রতিটি আলাদা সুতো উজ্জ্বল হয়ে আসে চোখের সামনে, তাকিয়ে দেখতে হয়। তাকাতে হয় ঐ ওদিকের লাইনে সার-বাঁধা মালগাড়ির দিকে। এত লম্বা, শেষটা ধূ-ধূ করছে। এরা আলাদা চেহারার, এমনকি আলাদা রঙের— কেননা এক-এক কোম্পানির এক-এক গাড়ি। বি-এন, ই-আই, এম-এস-এম, জি-আই-পি— ভারতবর্ষের এমন রেল-কোম্পানি প্রায় নেই, ওখানে যার ভাগ না আছে। গাড়িগুলোর চেহারার সূক্ষ্ম তারতম্য লক্ষ করি, কে কত টন নিতে পারে সে-অঙ্কগুলো পড়ি মন দিয়ে, ক-মনে এক টন হয় সে-হিসেবও মনে- মনে প্রায় হয়ে যায়। পৃথিবীর পরম একটি রহস্য মনে হয় একে এই নিশ্চল, নিশ্চিন্ত, স্টেশনের এক প্রান্তে পড়ে-থাকা মালগাড়িগুলো। আমার বুদ্ধি, আমার হিসেবের ক্ষমতা এ-রহস্যের তল খুঁজে পাবে না কখনো। কেন আছে ওরা ওখানে? কী আছে ওদের ভিতরে? ওরা কি সবাই একই জায়গায় যাবে, নাকি এক-এক তারিখে এক-এক এঞ্জিনের পিছনে এদের যাত্রা? উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নানা কোম্পানির নানা গাড়ি যে এই স্টেশনে এসে জুটেছে, এর পিছনে হয়তো আছে কত বছরের কত দিগ্বিদিক যাওয়া-আসা। ভাবতে রোমাঞ্চ হয়। প্রায় সব স্টেশনেই সব সময় দেখা যায়, এমনি কিছু-কিছু মালগাড়ি-সংগ্রহ পড়ে রয়েছে। এদের উপরে রেল-কোম্পানির যেন কোনো মায়াই নেই, নিতান্ত অনাদরে অবহেলায় সমস্ত দেশ ভরে এরা যেখানে-সেখানে ছিটোনো। একটা স্টেশন ছাড়িয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ দেখলুম, অনেক আঁকাবাঁকা লাইনের মাঝখানে এক কোণে দুটো নিঃসঙ্গ মালগাড়ি নিতান্ত অকারণে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে-সঙ্গে এক বিশাল বিস্ময়ে মন ভরে যায়; রেলের বিরাট ব্যবস্থার কোন ক্ষুদ্র ও অপরিহার্য অংশ যে এই গাড়িদুটো এখানে দাঁড়িয়ে পূর্ণ করছে তা ভাবতে গিয়ে কল্পনাতেও ঝিম ধরে। দেখে মনে হয় না, এদের দিয়ে পৃথিবীতে কারো কিছু দরকার আছে। এদের পাশ দিয়ে দিনে আর রাত্রিতে কত গাড়ির রুদ্ধশ্বাস যাওয়া-আসা; এরা অচঞ্চল, এরা অকারণ। মালিক- কোম্পানি এদের আর কখনো ফিরে পাবে কিনা তা-ই বা কে জানে। ভাব দেখে মনে হয়, মালগাড়ি কিছু-কিছু খোয়া গেলেও কোম্পানির বিশেষ এসে যায় না। কিন্তু তা তো হতে পারে না; নিশ্চয়ই আসে একটা সময় যখন প্রতি কোম্পানিরই মালগাড়ির হিসেব মিলোতে হয়। সে-সময় কখন— গাড়িগুলো তো সব সময়ই সমস্ত দেশ ভরে ছড়িয়ে আছে। আর হিসেবখানাও তো সোজা নয়— তা কি মানুষ মিলোতে পারে! এমন কি কখনোই হয় না যে অন্তত দু-চার-খানা গাড়ির খোঁজ মিলছে না— ধরা যাক, সেই দুটো গাড়ি যা আমরা স্টেশন ছাড়িয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ দেখেছিলুম? কর্তারা তো ভুলেও যেতে পারেন।

অবিশ্যি কোনো গোলমালই কখনো হয় না। গাড়িগুলো নিখুঁত হিসেবমতোই চলে, দাঁড়ায়, সার বাঁধে; আর এ-সব হিসেব মিলোবার কোনা সূক্ষ্ম সংক্ষিপ্ত কৌশলও আছে নিশ্চয়ই, আর মোটা মাইনের অনেক চাকুরেও আছে এর জন্যে— মোট কথা সবই ঠিকমতো হচ্ছে, মাঝখান থেকে আমিই খামকা ভেবে মরছি। ভাবনার কোনো কারণই নেই; প্রতিদিনের জীবনে এমনি কত আশ্চর্য জিনিশই তো আমরা আজকাল অনায়াসে মেনে নিচ্ছি, নেপথ্যে আছে অসংখ্য লোক যারা অবিশ্রান্ত মাথা ঘামাচ্ছে আর খাটছে। আমাদের জলের কল আর ইলেকট্রিসিটি আর ঘুম ভাঙার আগে রোজ সকালে মুড়মুড়ে খবরের কাগজ— এ-নিয়ে কখনো কি আমরা ভাবি? সুবিধেগুলো নিশ্চিন্ত ঔদাস্যে ভোগ করে যাওয়ার জন্যে আমরা। কখনো-কখনো ভাবতে ভালো লাগে, এই যা; অবাক হতে ভালো লাগে; ভালো লাগে স্টেশনের এই ব্যস্তসমস্ত হাশফাশ ভাবের মধ্যে এক ধারে নির্বোধের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে-থাকা এই মালগাড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হতে। ই-আই, জি- আই-পি, এস-আই; প্রতিটি কথা যেন জাদুকরের মন্ত্র, অত ছোট্ট শব্দের মধ্যে চাপা রয়েছে, অফুরন্ত ইঙ্গিত। মনে-মনে এক-একটি কথা উচ্চারণ করি, আর মনের এক- এক দিগন্ত খুলে যায়। শ্রীনগর থেকে ধনুষ্কোডি পর্যন্ত সমস্ত ভারতবর্ষ যেন মগজের মধ্যে বোঁ করে ঘুরে ওঠে। এরা নিজেরা নিশ্চল, এই গাড়িগুলো, কিন্তু এরা মনে আনে কত দূরের কত দিগন্তের ছবি, কত কল্লোলিত সমুদ্রের, কত অলস সূর্যের, কত নগরের, কত নীরবতার, আর কত অরণ্য-নীল রাত্রির।

কিন্তু ঘণ্টা বেজেছে, গাড়ি ছাড়লো। যেদিক থেকে এসেছিলাম, মনে হয় সেইদিকেই আবার চলেছি। স্টেশন ছাড়িয়ে আসতে-আসতে কত লাইন কিলবিলে সাপের মতো গাড়ির চাকার নিচে ঢুকলো আর মিলিয়ে গেলো। এখন আমাদের উল্টোদিকে আর-একটা লাইন শুধু রইলো, এটা পুরী গেছে, এটা দিয়েই আমরা এসেছিলাম। এখন চলেছি মান্দ্রাজের লাইনে। ভুবনেশ্বর থেকে পুরী আসতে-আসতে খুর্দা রোডের পরে এই মান্দ্রাজের লাইন যখন আলাদা হয়ে বেরিয়ে গেলো, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলুম তার দিকে। চলতি গাড়ি থেকে অন্যদিকের অন্য কোনো লাইন দেখতে বড়ো অদ্ভুত লাগে। নিজেকে হঠাৎ ব্যর্থ মনে হয়; মনে হয় ঐ লাইন গেছে না জানি কত আশ্চর্য দেশে, কত রহস্যের প্রান্তে— ঐ রাস্তায় যারা বেরিয়েছে তারাই ধন্য। নিঃসীম নির্জনতার মধ্যে এই ধূ-ধূ রেল-লাইন দেখলেই মুহূর্তে যেমন সুদূরের তৃষ্ণায় রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে, তেমন কি অন্য কিছুতে হয়? মান্দ্রাজের এই লাইনকে তখন মনে হয়েছিলো রূপকথার দেশে যাবার নির্ভুল রাস্তা; এখন চলেছি সে- রাস্তাতেই, পুরীর লাইন এইমাত্র দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে গেলো, এখন দু-দিকের ঢেউ- খেলানো সবুজে বিকেলের বন্যা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন