বুদ্ধদেব বসু
আমরা যারা শহরে থাকি, আমাদের পক্ষে অন্ধকারই একটা ঐশ্বর্য। কেননা শহরে অন্ধকার বলে কোনো জিনিশই নেই। যেখানেই যাই, যে-কোনো অবজ্ঞেয় গলিতে, যে-কোনো নির্জন রাস্তার পার্কে— অন্ধকারের শরীরকে খোঁচা-খোঁচা আলো ফুটো করে দেবেই, সে যদি ইলেকট্রিসিটির গভীর ক্ষত না-হয়ে গ্যাসের হালকা আঁচড় হয় তাহলেই কৃতজ্ঞ বোধ করি। ভাবতে অবাক লাগে যে কলকাতায় সত্যি-সত্যি অন্ধকার একটি ঘরে শোয়া প্রায় অসম্ভব। কলকাতায় অনেক ঘরে আমি ঘুমিয়েছি; এবং তার একটাতেও চোখ না-বুজলে অন্ধকার নামেনি। ঘরের আলো নেবাতেই কোনো-না-কোনো জানলার ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলোর একটি-না-একটি তির্যক রেখা এসে পড়েইছে— ঠিক আমার চোখ লক্ষ্য করে। পর্দা দিয়ে তাকে হয়তো চাপা দিতে পেরেছি, বাধা দিতে পারিনি। সময়ে মানুষের সবই নাকি সয়ে যায়, কিন্তু এই একটা কষ্ট এ-পর্যন্ত তো আমার সহ্য হলো না। যেখানেই যাই— যানে আর পথে, ঘরে আর বাজারে— সেখানেই তো আলোর তীব্র চীৎকার; সকল কাজের শেষে যখন ঘুম, তখন অন্তত সে-কলরোল স্তব্ধ হোক, নামুক অন্ধকার। যে-অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না, তাতে চোখ আর মন ডুবিয়ে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকা— এ যেন অতি বিরল, দুর্মূল্য বিলাসিতা, আমার পক্ষে তা আশা করাই অন্যায়। আলোর উল্কি-আঁকা এই ফ্যাকাশে ছায়া ছাড়া পৃথিবীতে আর-কিছু আছে এ প্রায় ভুলেই গিয়েছি, এমন সময় একদিন টিকিট কিনে রেলগাড়িতে চেপে বসলুম। গাড়ি ছাড়লো; ইস্টিশানের ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে গাড়ি যেই এলো আকাশের তলায়, অমনি চারদিক থেকে নিবিড় নীরন্ধ্র অন্ধকার উঠলো কথা কয়ে। কালো, কালো। কতদিন পর যেন মনে পড়লো, পৃথিবীতে এ-জিনিশও আছে। সে-অন্ধকার অতি উজ্জ্বল আলোর মতোই মনকে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। হাওয়া ছুটে যাচ্ছে কান ঘেঁষে তীরের মতো শিস দিয়ে, হঠাৎ এক ঝাঁক জোনাকি ঝিলকিয়ে মিলিয়ে গেলো, আমরা জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি চুপ করে।
চিল্কার ধারে গিয়ে আমরা নতুন চাঁদের দেখা পেলুম। আসন্ন সন্ধ্যার ভিতর দিয়ে আমাদের প্যাসেঞ্জার গাড়ি চলেছে যেন নতুন চাঁদের বাঁকা রেখাকেই লক্ষ্য করে। এ-সব গাড়িতে বড়ো ভিড় হয় না, আমাদের কামরাতে আমরা ছাড়া আর- একজন ভদ্রলোক। আমরা যেদিকে বসেছি, সেদিকেই চিল্কা। প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে চিল্কা আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে এলো, ছ-টা স্টেশন পার হয়ে। কখনো দূরে ঝাপসা শাদা পাতের মতো, কখনো আরো কাছে, কখনো একেবারে রেল-লাইনের তলায় ছড়ানো। দিগন্ত-ছোঁয়া শান্ত, নিশ্চল জল; মাঝে মাঝে দ্বীপ, পাহাড়। গাড়ি যত এগোচ্ছে, দু-দিকে পাহাড়ের সংখ্যা ততই বাড়ছে। উড়িষ্যা পার হয়ে মান্দ্রাজের সীমানায় ঢুকলুম। এ-গাড়ি ওয়াল্ট্যায়ার যাবে। আমরা যেখানে নামবো তার নাম রম্ভা। সেখানে চিল্কার শেষ। বসে আছি টাইম টেবিল চোখের সামনে খুলে, নির্ভুল নিয়মে একটার পর একটা স্টেশন আসছে। উৎকণ্ঠায় আছি, কখন রম্ভা এসে দ্যাখ- না- দ্যাখ পালিয়ে যায়। ছোটো স্টেশন, গাড়ি হয়তো দাঁড়িয়েই দৌড় দেবে, ঠিকমতো নামতে পারবো তো? কুলি জুটবে কিনা কে জানে। বাক্স বিছানা ইত্যাদি যাবতীয় সম্পত্তি হাতের কাছে জড়ো করে বসে আছি। এদিকে সন্ধে তো হয়-হয়। পুরীর হোটেল থেকে যতটা খবর সংগ্রহ করতে পেরেছিলুম, বিশেষ ভরসা পাচ্ছিনে মনে। ডাকবাংলো একটা আছে শুনেছি, কত দূরে কে জানে। রাত্রের মতো একটা বাসস্থান হলেই হয়, চাল ডাল আলু সঙ্গেই আছে।
সন্ধে হলো। চিল্কার প্রসার দুধের মতো ম্লান। জলের উপরে পাখির ঝাঁক। স্বচ্ছ নীল আকাশে নতুন বাঁকা চাঁদ প্রকাণ্ড একটা মুক্তার মতো জ্বলছে। দু-ধারে নিবিড় সবুজ গাছপালা, ছোটো ছোটো পাহাড়। একটু আগেই আমরা কথা বলছিলাম, এখন আমরা চুপ। আমরা অপেক্ষমাণ, এর পরেই রম্ভা।
যতটা তাড়াহুড়ো করে নামলুম তার কিছুই দরকার ছিলো না। এটা জল নেবার জায়গা, গাড়ি চার মিনিট দাঁড়ায়। যে-লোকটি আমাদের মাল নামালো, তাকে স্টেশনের কুলি ভেবেছিলুম, কিন্তু সে ডাকবাংলোরই পরিচারক। আর-একজন লোক, লম্বা, মস্ত গোঁফ, মস্ত লালচে দাঁত— গাড়ি থামবার সঙ্গে-সঙ্গেই লন্ঠন হাতে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলে আমরা ডাকবাংলোয় যাবো কিনা। যাবো কিনা! সন্ধ্যার অন্ধকারে এই শূন্য জনপদে পা দিতে-না-দিতেই যে আস্ত একজন দূত মিলে যাবে তা আমরা কখনোই আশা করিনি। জিজ্ঞেস করলুম ‘ডাকবাংলো কতদূর?’ লোকটা বললে ‘নগিজ’, অর্থাৎ কাছে। হেঁটে যাওয়া যাবে? লোকটা মাথা নাড়লো। সদ্বিধ মনে স্টেশন থেকে বেরোলাম। দূরত্ব সম্বন্ধে এদের ধারণা অতি অস্পষ্ট, সে- অভিজ্ঞতা আগেই হয়েছিলো। তাছাড়া, পনেরো-কুড়ি মাইল হাঁটাহাঁটি করা যাদের পক্ষে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, কতটা দূর হেঁটে যাওয়া যায় সে-বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের মতদ্বৈধ হওয়াও খুবই স্বাভাবিক। ভয়ে-ভয়েই এগোতে লাগলাম, কিন্তু ভালো করে হাঁটতে আরম্ভও করিনি এমন সময় আমাদের পথপ্রদর্শক হঠাৎ একটা বারান্দায় গিয়ে উঠলো। এই বাড়িই যে ডাকবাংলো সেটা উপলব্ধি করতে রীতিমতো সময় লাগলো আমাদের। গাড়ি থেকে নেমেই আবছা চোখে পড়েছিলো বাড়িটা কল্পনাও করতে পারিনি ঐ বাড়িই আমাদের সাম্প্রতিক ভবন। নগিজ মানে যে সত্যি-সত্যি এত কাছে তা কে জানতো!
এ-ক’ঘণ্টার এত আশঙ্কা মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে গভীর নিশ্বাস ছাড়লাম। ক্ষীণ ক্ষীণ চাঁদ এরই মধ্যে গাঢ়-তামাটে হয়ে আকাশের ঢালু বেয়ে নিচে নেমেছে, আর তার আলো নেই। অন্ধকার আকাশে ঝাঁকে-ঝাঁকে তারা উঠেছে। ট্রেনটা এখনো দাঁড়িয়ে। দরজা খোলা হলো, যে-ঘরটিতে আমরা ঢুলুম তা একসঙ্গে বসবার, শোবার ও খাবার ঘর। তিনদিকে খোলা বারান্দা, পাশে অকৃপণ বাথরুম, কিছুরই অভাব নেই। সেই মুহূর্তে মনে হলো এ যেন দুর্লভ কল্পনার অন্তঃপুর; বহু পুণ্যফলে এখানে প্রবেশ পেয়েছি।
দীর্ঘ গুম্ফবান পুরুষোত্তম আমাদের জানালে যে এখানে প্রায়ই লোকজন আসে, এবং ‘কালকেও দুটো বাবু এথেথিলো। এখন আর-কেউ নেই তো? কিছু চেষ্টা করে জানা গেলো যে এখনকার বাসিন্দা শুধু আমরাই। এটাও ঈশ্বরের দয়া বলতে হবে। বিহার উড়িষ্যা ছোটোনাগপুরে পথে-বিপথে অজস্র ডাকবাংলো ছড়ানো, যে- কোনোটাই এত সুন্দর, দেখলে মনে হয় চিরকাল থাকি। কিন্তু নির্জনতা ও গোপনতাই এদের প্রধান আকর্ষণ। অন্য মানুষের সান্নিধ্যে সমস্ত সুরটাই কেটে যায়। ট্রেন কখন চলে গেছে, চারদিক নিঃঝুম, পৃথিবীতে এই একটি ঘর, আর ঘরের মধ্যে আমরা— এ-ছাড়া আর-কিছু নেই। এ-ক’দিন পুরীতে অবিশ্রান্ত সমুদ্রের চীৎকারের পরে এ-স্তব্ধতা আরো অদ্ভুত লাগলো— এ যেন একটা উপস্থিতি, একটা সজীব অনুভূতি, বুকের মধ্যে রক্তের যেন স্পন্দন। দরজার বাইরে কে যেন আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে, চিরকাল। অনেক, অনেক দূরে দিনের আর রাত্রির কলরোল। এই মুহূর্ত ছাড়া আর-কিছু নেই।
খোলা হলো বাক্স-বিছানা, দেখতে-দেখতে আমাদের ব্যবহারের কত জিনিশ ঘর ভরে ছড়িয়ে গেলো। এখানে চায়ের কৌটো, ওখানে সাবান; এরই মধ্যে চিরুনিটা আবার হারালো কোথায়? এখানেই আমরা ঘর বেঁধেছি। আধ ঘণ্টা আগে আমাদের পক্ষে যে-ঘরের অস্তিত্বই ছিলো না, এখন মনে হয় এখানে যেন আমরা কতকাল ধরে আছি, যেন চিরকাল থাকবো। তালা-বন্ধ ঘর ছিলো ডানা-মোড়া পাখির মতো, মুহূর্তে পাখা মেলে আমাদের ভিতরে টেনে নিয়েছে। আমরা এখন ওর। আমরা ওকে ভরেছি, শুধু আমাদের জিনিশ দিয়ে নয়, আমাদের সত্তা দিয়ে। টেবিলের উপর ছোটো স্টোভে চায়ের জল গরম হচ্ছে, অনেকক্ষণ লাগবে। পুরুষোত্তম গেছে মুর্গি আনতে, ও রাঁধতে পারে।
উড়িষ্যায়, দেখা গেলো, অতি সহজেই নবাবের মতো থাকা যায়। যে-কোনো ডাকবাংলোয় আপনি যান, ভৃত্য একাধিক, আজ্ঞাপালনে ক্ষিপ্র ও অক্লান্ত, এবং সন্তোষসাধনে উৎসুক ও সচেষ্ট। তার উপর, যে-রকম পারিতোষিক তারা প্রত্যাশা করে সেটা ভয়াবহ তো নয়ই, বরং সামান্যই। যে-লোকটি গাড়ি থেকে আমাদের মাল নামিয়েছিলো তার নাম কি চেহারা কেমন কিছুই আমার মনে নেই, কিন্তু যে- দু’দিন ছিলাম, সে আমাদের সেবায় নিজেকে যে-ভাবে নিয়োজিত করেছিলো সেটা ভুলবো না। তার ভাবখানা এমন, আমরা তার গায়ের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে সে খুশি হয়। সে পা টিপে দেবে, তেল মেখে দেবে, নখ কেটে দেবে— কী না করবে? আমাদের দেশের ভূসম্পত্তিবানদের জন্য এ-সব পরিচর্যা। আমি অতি কষ্টে মধ্যবিত্ত, ও-সমস্তে আমার অভ্যেস নেই। নিজের শরীরটাকে একটু নাড়লেই যেখানে হয়ে যায়, সেখানে চাকরকে হুকুম করতে আমি পারি না। আর সুস্থ অবস্থায় শারীরিক সেবা ভৃত্য কেন— কারো হাত থেকে নিতেই আমি স্বভাবতই কুণ্ঠিত। সুতরাং আমার আদেশস্বল্পতায় লোকটি প্রথমটায় বুঝি বিব্রতই হয়েছিলো। নিজের হাতে চেয়ারটা একটু সরালে সে হাঁ-হাঁ করে ছুটে আসে। এতে আমার চটে যাবারই কথা, কিন্তু চটলে তার উপর নিষ্ঠুর অবিচার করা হতো। অগত্যা, তারই মনের শান্তির জন্য আমাকে সায় দিতে হলো। সে যা-কিছু করতে চাইতো, আমি আপত্তি করতুম না। চিল্কায় নৌকোয় বেড়াবার সময় দু-ঘণ্টা সে আমাদের মাথার উপর ছাতা ধরেই রইলো। ঘোরতর অস্বস্তি বোধ করছিলুম, কিন্তু দু-একবার বারণ করাতে সে এমন দুঃখীর মতো করুণ মুখ করলো যে আবার বারণ করতে প্রাণে সইলো না। যদি তার হাত থেকে জোর করে ছাতা কেড়ে নিতুম, মনের দুঃখে সে বুঝি হ্রদের জলেই ঝাঁপ দিতো। কাজে-কাজেই এ-দুটো দিন রইলো আমার সাহিত্যিক জীবনের কালোখাতায় নবাবির লাল কালিতে লেখা হয়ে।
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই বাইরে এলুম। ঝিরঝিরে সকাল, বাতাসে ঘাসের গন্ধ নেশার মতো। এক কোণ থেকে দেখা যায় চিল্কার একটুখানি জল, আর দূরে সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে সূক্ষ্ম ধোঁয়ার মতো কুয়াশা। পাহাড়ের এই ইস্টিশন থেকেই হঠাৎ রেল-লাইন একটা পাহাড়ের পা ঘেঁষে বেঁকে গেছে। ওদিকে তাকালে হঠাৎ চোখ আটকে যায়, তারপর অবাক লাগে। কোথায় গেছে রেল-লাইন, কত দূরে, কত পাহাড় ডিঙিয়ে, কত নদী পার হয়ে, হয়তো সমুদ্রের ধার দিয়ে। ছোটো ছেলের মতো অবাক লাগে। শিশুর জীবনের প্রধান অনুভূতি বিস্ময়, কেননা সে অজ্ঞান। আমরা অনেক জেনে ফেলি বলে বিস্ময়টা ঠিক সেই মাত্রাতেই কমে আসে। তাছাড়া, বিজ্ঞতার একটা দম্ভ থাকে এই যে কিছুতেই অবাক হবো না। অবাক হলেই যেন বিস্ময়ের পাত্রের কাছে ছোটো হয়ে গেলুম। একবার একটি ছোটো ছেলে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। সে এর আগে কলকাতায় আসেনি, কিন্তু সমস্ত শহর বেড়িয়ে যে-কোনো জিনিশই সে দ্যাখে, অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সুরে বলে : ‘ওঃ এর আর কী! আমাদের— গঞ্জেও এ-রকম কত আছে! পাছে আমরা তাকে ‘বাঙাল’ মনে করি, এই ছিলো তার ভয়; এবং সেই ভয়ে কলকাতার যে-মহিমায় তার বালকচিত্ত অভিভূত হওয়া উচিত ছিলো তাকে সে মোটে আমলই দিলে না। ঠকলো সে-ই। আমরা বড়োরাও অনেক সময় ঐ রকম একটা বিকৃত একগুঁয়েমির ভাব মনের মধ্যে শানিয়ে নিই; আত্ম-সচেতনতার কণ্টকিত বেড়া তুলে সহজ বিস্ময়কে রাখি আটকে। যে-কোনো উপলক্ষেই আত্মবিস্মৃত আচ্ছন্ন হয়ে পড়াটা কাঁচা মনের লক্ষণ বলেই প্রসিদ্ধ। এতে লোকসান আমাদেরই, মস্ত একটা রসের জোগান বন্ধ হয়ে যায় আমাদেরই মনে। এ-কথা অস্বীকার করবো না যে জীবনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা আমাদের আত্মরক্ষার বর্ম, সেটা বাদ দিতে গেলে বিপদ অনেক। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রের বাইরে রয়েছে আমাদের অনুভূতির বিশাল জীবন : কতগুলো দৃশ্য আর গন্ধ, কতগুলো ভাব আর কল্পনা আমাদের মনে বিশেষ এক ধরনের প্রতিক্রিয়া আনে— আমরা স্পন্দিত হই, অনুরণিত হই, হই মর্মরিত আর রোমাঞ্চিত। সেখানে হার মানাই ভালো, সেখানে নিজেকে দিতেই হয়। হতে হয় শিশু : তার আদিম নিঃসীম রহস্যবোধ নিয়ে। উন্মুখ বিস্ময়ের কাছে নিজেকে নিঃসঙ্কোচে দিতে পারলে আমরা চলে যাই সংজ্ঞার সীমানা ছাড়িয়ে নতুন এক জগতে; সে-জগৎ শিশুর চিরন্তন রূপকথার, বস্তু ও সত্য সেখান কল্পনার আলোয় রূপান্তরিত। এই সংস্পর্শের আলো যখন জ্বলে তখন সমস্ত পৃথিবীকে আমরা যেমন নিবিড় ও একাগ্র করে পাই তেমন আর কখনোই পাইনে। এ-কথা বলার অর্থ অবশ্য এ নয় যে জ্ঞান বর্জনীয়, এবং শিশুর সর্বাঙ্গীণ অজ্ঞতাই আদর্শ অবস্থা। এ-কথা বলাই বাহুল্য যে শিশুর মধ্যে যে-অজ্ঞতা মধুর, সাবালক মানুষে সেটা জড়তা। তবে বিস্ময় আমাদের জীবনের একটি অমূল্য রস-উৎস; এবং বয়ঃক্রম ও অভিজ্ঞতা বাড়বার সঙ্গে-সঙ্গে এই বিস্ময়-চেতনা অনেক কমে আসে, জীবনও আসে ঠিক সেই অনুপাতে ক্ষীণ ও পাংশু হয়ে। সেটা শোচনীয়। এজন্যে দায়ী জ্ঞান নয়, জ্ঞানের দম্ভ। ভেবে দেখতে গেলে, জ্ঞানের সঙ্গে বিস্ময়ের কোনো বিরোধ নেই : বরঞ্চ এটা বললেই সত্য হয় যে আমরা যত বেশি জানি, তত বেশি অবাক হই। যেমন ধরা যাক, বস্তুবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের মর্মে কিছুটা প্রবেশ করতে পারলে জড় ও জীব নিয়ে প্রকৃতির অফুরন্ত বিচিত্র লীলা আমাদের মনে হয় আরো কত অপরূপ রহস্যময়। জ্ঞান ও বিস্ময়ের এই যে সমন্বয় এটা জীবনের একটা প্রধান সাধনা।
এমনি শিশু হয়ে যেতে হয়, এমনি স্বচ্ছ সহজ বিস্ময়ে মন ভরে যায়, এই চিল্কার ধারে, এই সকালবেলায়। এতখানি আকাশ একসঙ্গে দেখতে পাওয়া জীবনের একটা দুর্লভ সম্পদ— আর এমন আকাশ, এমন আশ্চর্য নীল। ছোট্ট এই রম্ভা স্টেশন: তাছাড়া আর কোনোখানে কিছু নেই। সেখানে ঘণ্টা বাজে। সকালবেলা মাদ্ৰাজ মেল এসে দাঁড়ায়। আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি; লম্বা রেলগাড়ি আর জানলায় জাগরণক্লান্ত মুখগুলি ছবির মতো। ওরা যেন অন্য জগতের বাসিন্দা। ওরা যেন ছায়ার দল, হাওয়া ওদের নিয়ে চলেছে ঝেঁটিয়ে। মোটেও ওদের সত্য মনে হয় না। ঐ চললো গাড়ি, গেলো মুখগুলি মিলিয়ে। কয়েক মিনিট চারদিক ভরে উঠেছিলো ফিরিওয়ালার ডাকে, বেচাকেনায়, কথাবার্তায়— আর ঐ মস্ত রেলগাড়িতে— আবার এখন সব চুপ, সব শূন্য, এঞ্জিনের ফোঁসফোঁসানিও আর শোনা যায় না। হঠাৎ একটা ছায়া পড়েছিলো, ছায়া মিলিয়ে গেলো। আবার নিটোল হয়ে এলো আলো-ভরা স্তব্ধতা। সন্ধেবেলা আবার মাদ্রাজ মেল আসে— এটা যাবে হাওড়া। ছুটে আসে সবুজ সার্চলাইট, অন্ধকার আহত সাপের মতো কাৎরিয়ে ওঠে। গাড়ি এসে দাঁড়ায়; কেউ ওঠে না, কেউ নামে না; যাত্রীরা স্টেশনের নামটাও লক্ষ করে না হয়তো; ওরা কেউ জানে না যে পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর জায়গা এ-ই, এবং আমরাই একে খুঁজে বার করেছি। একটু পরে শুধু একটা দীর্ঘ, মন্থর শব্দ; তারপর চুপ। আর রেলগাড়ি যেখানে দাঁড়িয়েছিলো ঠিক তার উপরে, ঠিক রেল-লাইনের বাঁকের মাথায় তৃতীয়ার চাঁদ। সন্ধের পর অল্প খানিকক্ষণ কুয়াশার মতো পালা আলো— আলোর একটু ছলছলানি, যেন পৃথিবী-ভরা কোনো স্মৃতির অস্পষ্টতা। তারপর রাত বাড়লো, হঠাৎ বাইরে এলাম। চাঁদ নেই; বিশাল অন্ধকার আকাশ জ্বলন্ত তারায়-তারায় নিশ্বসিত।
এখানে, এই সবুজ হ্রদের ধারে
যেন অনেকদিনের হারানো কোনো বন্ধুকে ফিরে পেলুম—
ঠিক বুঝতে পারছি না, কে।
বুঝতে পারছি না।
বুঝতে যে পারছি না সেটাই তো ভালো।
শুধু বুকের মধ্যে একটা অস্পষ্ট আনন্দ, আবছায়া ভয়—
যেন নতুন স্ত্রী খুলে ফেলছে তার সাজ
রাত্রির অন্ধকারে, হাতের চুড়ি বাজিয়ে;
অন্ধকারে বসে শুনছি।
কী যে হারিয়েছিলাম, কী যে ফিরে পেলাম।
সে কি এই স্তব্ধতা,
কলকাতার ট্র্যাফিকের গর্জন আর সমুদ্রের গর্জনের পরে
এই জীবন্ত, ভীষণ স্তব্ধতা?
সে কি এই তারায় ছাওয়া আকাশ,
না কি নতুন চাঁদের বাঁকা রেখা,
না কি ঐ যে রেল-লাইন বেঁকে গেছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে
তারই দিগন্ত-ইঙ্গিত?
এই শুধু জানি, সমস্ত বুক আমার ভরে গেলো
এখানে, এই হ্রদের ধারে।
তাকিয়ে তাকিয়ে পলক পড়তে চায় না চোখের—
আকাশ ভরে এত তারা সাজানো।
একটু পরে মান্দ্রাজের গাড়ি এসে দাঁড়াবে
চাকায়-চাকায় স্তব্ধতাকে আগে-আগে ঝেঁটিয়ে
কাল ভোরে সে কলকাতায়।
কিন্তু কলকাতা এখন কত দূরে
কলকাতাও কত দূরে এখন।
কত দূরে এইমাত্র-শেষ-হওয়া যুদ্ধের ঝননা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন