আমি চঞ্চল হে – ৮

বুদ্ধদেব বসু

কালো-কালো মাঝিরা গল্পে মশগুল। তাদের ভাষা আমরা বুঝি না। যেন বানরের কিচির-মিচির। বানরের মতোই শাদা ওদের দাঁত। ওরা দিয়েছে পাল তুলে, নৌকো ছলছলিয়ে এগিয়ে চলেছে। ঐ দেখা যাচ্ছে গাছে-গাছে সবুজ দ্বীপ, আমরা চলেছি সেখানে। এমনি আরো কত দ্বীপ চিল্কার বুকে ছিটোনো। ওদিকের দ্বীপটা একটা পাহাড়, সেখানে আছে দেবাশ্রিত ‘গুম্ফ’। ফেরবার পথে সেখানেও যাবো আমরা সামনের দিকে তাকালে কূল নেই; ঐদিক দিয়েই চিল্কা মিশেছে সমুদ্রে যদি বরাবর নৌকোয় চলে যাই পুরী গিয়ে পৌঁছতে পারবো। অনেক দূরে হ্রদের আর সমুদ্রের সংগম, বড়ো ইচ্ছে করে দেখে আসি, দেখা হবে না। দূরের দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যায়, এত আলো। যেন আকাশের আলো জল হয়ে বিছিয়ে গেছে। কাছের জল ফিকে সবুজ, বেশি গভীর নয়। নিচু হয়ে তাকালে তলাকার মাটি প্রায় দেখা যায়। স্বচ্ছ, শান্ত। আমাদের বাঁ-দিকে তীর খুব কাছে, সেখান দিয়ে গেছে রেল- লাইন। হঠাৎ চেয়ে দেখি, একটা রেলগাড়ি চলেছে, খেলনার মতো ছোট্ট— কী আশ্চর্য, একটু শব্দ করছে না। আর এত আস্তে চলেছে, প্রতিটি চাকা যেন গোনা যায়। চিল্কার উপর দিয়ে নৌকোয় যেতে-যেতে ঐ লাইনে বাঁধা খেলনা-গাড়ির উপর বড়ো করুণা হলো— কত কষ্টে ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে, বেচারাকে পৌঁছতেই হবে। আমাদের পৌঁছবার তাড়া নেই, আমরা চলেছি। হাওয়ায় জুড়িয়ে গেলো শরীর। আমাদের শরীরে বিশ্রামের শান্তি, আমাদের চেতনা এই শান্ত জলের মতো দিগন্তে প্রসারিত। আমাদের শরীর আর নেই— এই অফুরন্ত আকাশের নিচে, এই স্বচ্ছ জলের উপরে। এই যে নৌকোটা একটু-একটু দুলছে, আমরা সেই দোলা। জলের উপরে আমরা প্রজাপতি। বাতাসে পাখি আমরা। শিশিরে-ছোঁয়া হাওয়ায়-ধোয়া এই সকালবেলা— এ আমাদের।

চিল্কার এ-জায়গাটা গভীর, এখানে ছোটো ছোটো ঢেউয়ের খেলা। ওগুলো কী? বাচ্চা হাতির মতো গোলগাল, ফিকে বেগনি রঙের, এই তুলছে মাথা, এই দিচ্ছে ডুব, পেট উঁচিয়ে ভেসে উঠছে নৌকোর কাছে। বেজায় ফূর্তিবাজ, সঙের মতো কেবলই ডিগবাজি খাচ্ছে। ভারি মজা তো। কী ওগুলো? মাঝিরা বললে : মগর মাছ। মগর মানে অবিশ্যি মকর, এবং মকর মানে মাছ; সুতরাং সমস্যার সমাধান হলো না। মাছ তো ওরা নয়, বরং কোনো সামুদ্রিক জানোয়ারের ছোটো ও নিরীহ সংস্করণ। কবে একদিন কোনো-এক দুর্ঘটনার তাড়ায় এক ঘর ছিটকে পড়েছিলো সমুদ্র থেকে; তারপর চিল্কার এক অপেক্ষাকৃত গভীর অংশে তাদের সন্ততি প্রতিবেশীহীন প্রতিযোগিতাহীন নিশ্চিন্ততায় খেলা করে দিন কাটাচ্ছে। বিপদের অভাবে ক্রমশ ছোটো হয়ে গেছে তাদের শরীর, তাদের চেহারা থেকে ভয়ংকর ভাবটা আস্তে-আস্তে কমে গিয়ে এখন নেহাৎই কমিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরো কিছুকাল পরে আরো ছোটো হবে এরা, তারপর একদিন এদের শেষ বংশধর হয়তো এই জলে ডিগবাজি খেতে-খেতে হঠাৎ ধরা পড়বে মানুষের জালে। ঐ একটুখানি জায়গা পার হয়ে এসেই এদের দেখা আর পাওয়া গেলো না। বোঝা গেলো, এদের সংকীর্ণ জগতের সীমানা অতিশয় নির্দিষ্ট। এত জলের মধ্যে ঐ একটু জায়গাতেই এরা যে বয়ে এনেছে সামুদ্রিক জীবনের স্মৃতি— এ নিশ্চয়ই নিতান্ত একটা দৈবঘটনা, এর মূলে রয়েছে প্রকৃতির তেমনি কোনো ব্যতিক্রম যার ফলে কখনো প্রাণের কোনো শাখা হঠাৎ নানা বৈচিত্র্যে পল্লবিত হয়ে ওঠে, আবার অন্য- কোনো শাখা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মরে। যাকে এভল্যুশন বলি তা তো সত্যি একেবারে মাপাজোকা ছকে-আঁকা একটা ক্রমবিকাশী নিয়ম নয়; তাতে অ্যাক্সিডেন্টের অংশ যে কত প্রধান ভাবলে অবাক হতে হয়।

পথ প্রায় শেষ হয়েছে; সরু লম্বা সবুজ দ্বীপটা বৃহৎ রোদ-পোয়ানো সরীসৃপের মতো হঠাৎ যেন গলা বাড়িয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। নৌকো ঠেকলো মাটিতে, মাঝিরা আমাদের পাঁজাকোলা করে নিরাপদ মাটিতে নামালো। রোদ চড়েছে, আমরা ক্লান্ত। সঙ্গের লোক বলছে : ‘ঐ তো রাজার প্যালিস, চলুন ওখানে।’

না, রাজার ‘প্যালিস’ আমরা পরে দেখবো, আগে দ্বীপটা ঘুরে আসি। সত্যি- সত্যি দ্বীপ। চারদিকে যার জল। চওড়ায় এত ছোটো যে এক দৌড়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়া যায়। সমস্ত দ্বীপটা মস্ত একটা উপবন গোছের, ঘন গাছপালা ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে সরু পরিষ্কার রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে গেলুম অন্য প্রান্তে, জলের ধারে নেমে এসে মাটিতে বসলুম একটু বিশ্রাম করতে। আমাদের পায়ের কাছে অনেক নুড়ি ছড়ানো, পাড়ে কয়েকটা নৌকো বাঁধা, এখানে চিল্কার কেমন অদ্ভুত তিন-কোণা চেহারা। জায়গাটি ঠিক যেন সিনেমার ছবি থেকে তুলে আনা; ঠিক সিনেমার গল্পে নৌকাডুবি হয়ে ভেসে এসে ওঠবার মতো জায়গা ধরা যাক, আমরাই যদি কোনো দুর্লভ দৈবক্রমে হতাম এই দ্বীপের প্রথম আবির্ভাব। এ-মাটিতে প্রথম মানুষের পা পড়লো আমাদের, এ-বাতাসে আমাদের স্বরে বাজলো প্রথম ভাষা। হায়রে, কাছাকাছি এইরকম একটা ছোটোখাটো দ্বীপও কি এখন পর্যন্ত অজ্ঞাত থাকতে নেই! তাহলে সেটা আবিষ্কার করেও তো কিছু করতে পারতুম কিন্তু দুঃখের বিষয়, বড়ো দেরি করে জন্মেছি, আমার জন্যে কিছু আর বাকি নেই। যেখানেই মাটি আছে সেখানেই মানুষের পা পড়ে গেছে অনেক আগে; পৃথিবীর সকল জলের উপর দিয়ে ভেসেছে মানুষের বাঁধা তক্তা। যেখানে হয়তো এখনো পা পড়েনি, অতি দুর্গম সেই মাটি, পথ সংকটে সঙ্কুল : এটা নিশ্চিতই জানি সেখানে যে-পা প্রথম পড়বে, সে আমার নয়। ঘরে বসে কাগজে মাথা ঠেকিয়ে কালির আঁচড় কেটে-কেটে আর তার ফলে কোষ্ঠবদ্ধতায় ভুগে ভুগেই এ-জীবনটা কাটলো, আর- কিছু হলো না।

ফেরবার মুখে ‘প্যালিস’ দেখা গেলো। চমৎকার বাড়ি করে রেখেছেন খালিখোটের রাজা, আমাদের ডাকবাংলোটিও তাঁর। ভিতরটা চমৎকার আসবাব সাজানো। রাজার অনুমতি নিয়ে এখানে একরাত্রি থাকা যায়। স্পষ্ট বোঝা গেলো, রবিনসন ক্রুসোর নয় এ-দ্বীপ। এই সিনেমা-দ্বীপের মধ্যে হঠাৎ এই শৌখিন ভবন, চৌরঙ্গির আসবাবে সাজানো। সিনেমাই বটে। বেশ ভাবতে পারি, কোনো আমেরিকান ছবিতে নায়ক- নায়িকা কোনো নামহীন সুদূর দ্বীপে পরিত্যক্ত হয়ে হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ এমনি একটি ফিটফাট বাড়ি আবিষ্কার করে ফেললো, সাদর অভ্যর্থনা নিয়ে প্রস্তুত। আর তারপর হয়তো দেখা গেলো সে-বাড়ির কর্ত্রী আর-কেউ নয়, নায়কের বহুকাল নিরুদ্দিষ্ট অবিবাহিতা পিসি। বাকিটা এক নিশ্বাসে বলা যায় : বুড়ি মরলো, রেখে গেলো একমাত্র ভাইপোকে সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি, দীর্ঘ চুম্বনে ছবি হলো শেষ।

এবার ফিরতে হবে, মাঝিদের তাড়া দিতে হলো। তারা ‘প্যালিসে ঢুকে দিব্যি গুলজার। জাঁকিয়ে বসেছে এক-একজন চেয়ারে, কেউ সিগারেট ফুঁকছে, কেউ পা তুলে দিয়েছে টেবিলে; একজন ওদের মাতৃভাষার খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছে আর-সকলকে, আর মাঝে-মাঝে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে নানারকম মুখবিকৃতি করছে। এই রাজা-উজির খেলা ফেলে চট করে উঠে আসবে না ওরা। আমাদের দেখে উৎসাহটা স্বভাবতই কিছুটা বাড়লো; আরো চড়লো কাগজ-পড়ুয়ার সুর। এ- যাত্রায় সায়েব-বাড়ির আসবাব সার্থক করলে ওরাই।

বেলা বেড়েছে, রোদ চড়েছে। আমাদের বেরুতেই দেরি হয়ে গিয়েছিলো, এখন আমাদের মন নুয়ে-পড়া নিশানের মতো। সেই গুল্কে যাওয়া আর হলো না : হ্রদের বুকে পাহাড়ের গুহার চাইতে অন্নজলের আকর্ষণ এখন আমাদের মনে প্রবল। এতক্ষণে পুরুষোত্তম নিশ্চয়ই খাবার সাজিয়ে দণ্ডকারণ্যে সীতার মতো প্রতীক্ষায় বসে আছে; আর চিল্কার মাছ এতই সুস্বাদু যে গুম্ফবান পুরুষোত্তমের রন্ধনপ্রণালীও তাকে নষ্ট করতে পারে না।

চিল্কার কথা ভাবতে গিয়ে হ্রদের চাইতে রম্ভার ডাকবাংলো আর ইস্টিশনের কথাই বেশি মনে পড়ে। আমরা ভরে গিয়েছিলাম তাতেই, হ্রদ ছিলো বিচ্ছিন্ন পটভূমিকা। এ-জায়গাটি আর ডাকবাংলোর ঘরটিই যেন এমন যে ভোরবেলা চোখ মেলে তাকিয়েই মনে হলো, এখানেই থাকবো চিরকাল। সেদিন বিকেলের গাড়ি তাই আমাদের না-নিয়েই খুর্দা রোডে গিয়ে পৌঁছলো। দরজা-বন্ধ ঘরে শুয়ে-শুয়ে শুনলুম, চলে গেলো গাড়ি। বাঁচা গেলো। আমাদের চিরকাল আরো একটি দিনে এসে ঠেকলো। কিন্তু ছুটি আর সম্বল দুই-ই ফুরিয়ে এসেছে, পরের দিন আর ঠেকানো যায় না। ঠাসো বাক্স, বাঁধো বিছানা, গাড়ির আর দেরি নেই। ফিরতি পথে আবার খুর্দা রোডে বদলের হাঙ্গামা।

মাঝরাতে পুরীর হোটেলে ফিরে এলুম। ছোকরা চাকর চিমা লন্ঠন নিয়ে আমাদের সঙ্গে এলো তেতলার ঘরে। ডাকবাক্সে আমাদের জন্যে অনেক চিঠি। বড়ো ভালো লাগলো। চিমা তার আধো-আধো ওড়িয়া বাংলায় বললে, ‘কাল আপনারা এলেন না, আমরা এত ভেবেথি। এটাও লাগলো ভালো। এ-ক’দিনেই পুরীর এই হোটেলের ঘর আমাদের বাড়ি হয়ে গেছে। এখানে আমাদের জন্য চিঠি পড়ে থাকে। এই ছোটো ঘর তো আমাদের জিনিশেই ভরা। আপাতত, এই আমাদের বাইরে থেকে ঘরে ফেরা।

কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি।

কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে :

কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।

তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
ইস্টিশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চলে গেলো। কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি।

আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায় না।
গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত!
— তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাবো
যা এতদিন পাইনি।

রুপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে, সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর
সূর্যের চুম্বনে। এখানে জ্বলে উঠবে অপরূপ ইন্দ্ৰধনু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
কখনো কি ভেবেছিলে?

কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কত দূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে। কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে, আর আমার
কী ভালো লেগেছিলো

তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ সুখ। দ্যাখো, দ্যাখো,
কেমন নীল এই আকাশ— আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
কেমন করে বলি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন