উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

সে-দিনে বৈশাখ
ধরেছিল ধ্বংসের পিনাক;
জমেছিল সর্বনাশ অনাথ অম্বরে;
তার পরে
ঘটেছিল কম্প্র তাপে অবরোহী আলোর বিকার;
শোষণে নিঃসার
সূর্য, শুষ্ক জবা-সম, উদ্যত কালীর বক্ষ হতে
খসেছিল আঁধি-ঢাকা প্রলয়ের পথে।
সঙ্গে সঙ্গে মহামৌনে কোটিকণ্ঠ নগরের শ্বাস
থেমেছিল; অহেতু সন্ত্ৰাস
নেমেছিল মোর প্রাণে; হয়েছিল মনে
অনাত্মীয় পরিবেশ ভাষাহীন প্রেতের ক্রন্দনে
উঠিতেছে গুমরি গুমরি।
ছিঁড়ে দড়াদড়ি,
ভয়ার্ত অশ্বের মতো, ছুটেছিল বিলুপ্তির পানে
আমার উন্মত্ত আত্মা মুমূর্ষার টানে।।

অকস্মাৎ
বাধা পেল অব্যর্থ সম্পাত;
তোমার আমার কক্ষ, সীমাবদ্ধ স্ব স্ব দেশ-কালে,
মিলে গেল ক্ষণতরে দৈবের খেয়ালে
নিরালম্ব শূন্যে আচম্বিতে
উপজিল স্বপ্নলোক; নক্ষত্রসংগীতে
শতধাবিভক্ত বিশ্ব পার্ষরিল বিরোধ, বিবাদ;
আমাদেরই চিত্তের প্রসাদ
সঞ্চরিল নগরীর বিভীষিকাবিক্ষুব্ধ মূর্ছায়—
জাগিল সে, প্রিয়স্পর্শে দয়িতার প্রায়,
ওষ্ঠে অনিশ্চিত হাসি, আঁখিকোণে সন্দিগ্ধ মির্মির
বিতরিল মন্দারের পরাগ সমীর;
চাহিলাম ঊর্ধ্বমুখে,
দেখিলাম অন্ধ তম ঝলমল স্বর্গের কৌতুকে :
তোমার নশ্বর কটি কথা
শুনাল সে-দিন মোরে অমৃতের পরম বারতা।।

সংশয় জেগেছে আজ বুকে;
আবার সম্মুখে
পুঞ্জিত হয়েছে আঁধা স্তরে স্তরে, স্তবকে স্তবকে;
নিরালোকে
অন্তর্হিত পুন ধ্রুবতারা;
সহচর কারা,
কেন্দ্রস্থলে সংকুচিত আত্মার ধিক্কার।
বারংবার
আতুর নয়ন তাই করে অন্বেষণ
কুটিল আমার মধ্যে তব বভ্রু কেশের মাতন,
অবাধ্য, উৎক্ষিপ্ত বহ্নি-সম;
তাই নিরাশ্রয় স্মৃতি খুঁজে মরে মরুর বাতাসে
অনুপম
সে-তনুর রতিপরিমল;
অক্ষম হতাশে
আবার দেখিতে চাই দরদের বলি সে-ললাটে।।

প্রযত্ন নিষ্ফল।
বৈনাশিক বুদ্ধি হানে করাঘাত ভঙ্গুর কবাটে;
সমস্বরে শূন্যবাদ দেখায় প্রমাণ
আকস্মিক সে-বিশ্বয় আপতিক অধৈর্যের দান,
নাই তাতে তিলার্ধ নির্দেশ—
অমর্ত্যের উপাদানে বিরচিত নয় সে-আবেশ;
অলকানন্দার আগমনী
শুনিনি সে-দিন কানে; গর্জেছিল আমারই ধমনী
বাঁধ-ভাঙা রিরংসার আবিল বন্যায়;
মরুবাসী বর্বরের প্রায়,
অনভ্যস্ত সুসময়ে লজ্জাবস্ত্র কাড়ি,
কুচকলি নিঙাড়ি নিঙাড়ি,
মিটায়েছিলাম তৃষ্ণা, সুধা ভেবে, পর্যুষিত ক্লেদে।
নেশা আজ কেটেছে নির্বেদে :
বিবিক্তিতে তাই
মুমূর্ষার প্রতিকার নাই।।

সে-দিনের সেই ইন্দ্রজাল,
সে আর কিছুই নয়, শুধু গণ্ডে গ্রীষ্মের গুলাল,
অসতর্ক ভুজভঙ্গে যদৃচ্ছ সুষমা?
তাই, নিরুপমা,
অসংলগ্ন স্মরণে কি ফিরে মোর অসংবদ্ধ গান,
প্রবাসে অজ্ঞাতলক্ষ্য পান্থের সমান?

৪ মার্চ ১৯৩১

সকল অধ্যায়

১. হৈমন্তী (বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়)
২. চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)
৩. অপচয় (প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী)
৪. কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)
৫. পণ্ডশ্রম (অভ্যস্ত লজ্জার ছল, আচারের ব্যর্থ ব্যবধান)
৬. মূর্তিপূজা (মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে)
৭. মহাসত্য (অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ)
৮. পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)
৯. ভবিতব্য (শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী)
১০. বিকলতা (শেফালী অঙ্গুলি তব গণ্ডে মম বিচরে কৌতুকে)
১১. অনুষঙ্গ (তোমারে যে কেন বাসি ভালো)
১২. মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)
১৩. সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)
১৪. প্রলাপ (জানি, জানি)
১৫. উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)
১৬. নাম (চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই)
১৭. জিজ্ঞাসা (দিলেম বিমুক্ত ক’রে পিষ্টপুষ্প নিকুঞ্জের দ্বার)
১৮. সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)
১৯. দৈন্য (নিরালোক, স্তব্ধশোক, আয়ত নয়ানে)
২০. ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)
২১. সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)
২২. মার্জনা (ক্ষমা? ক্ষমা? কেন চাও ক্ষমা)
২৩. শাশ্বতী (শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে)
২৪. বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)
২৫. অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন