ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন
যখনই স্মরণ
নিরুদ্দিষ্ট চংক্রমণে ফিরে সে-তিথিতে
যবে তব করপুটে মোর হিয়া পেরেছিল দিতে,
শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা মানি,
সর্বশেষ অন্তরীয়খানি,
নিজেরে উজাড় করি, নিষ্কবচ করি।।

হায়, আত্মম্ভরি,
তার অর্থ পশিল না তোমার মানসে :
যৌবনের নির্বোধ সাহসে
প্রাপ্য ভেবে, সে-নৈবেদ্য তুমি নিলে তুলি;
দেখিলে না কাঁধে শূন্য ঝুলি,
চ’লে যায় লোকান্তরে মৈত্রীর দেবতা,—
প্রত্যাখ্যাত আশীর্বাদ, প্রতিহত অমৃতবারতা।।

বুঝিলে না, তুমি বুঝিলে না
তুমি শুধু উপলক্ষ; মুক্তহস্ত বিধাতার দেনা
আমি চাই শুধিবারে, তোমারে মধ্যস্থমাত্র ক’রে।
ঋতুপতি বৎসরে বৎসরে
আনিল আমার তরে যে-বিচিত্র বরণের ডালি,
যে-দিব্য দীপালী
জ্বেলে দিল অমাবস্যা মাসে মাসে মোর সংবর্ধনে,
দিন দিন চিত্তের গহনে
উদয়াস্ত রেখে গেল যে-অক্ষয় রূপের সঞ্চয়,
সে তো নয়
ব্যয়কুণ্ঠ কৃপণের লাগি।।

সম্ভোগের স্বপ্ন থেকে উঠেছিল জাগি
আমার হৃদয় তাই, তোমার ভিক্ষার গান শুনে।
তাই সেই অমিত ফাল্গুনে,
সার্বভৌম সুন্দরের অমূর্ত উদ্দেশে,
দেহের দেউলে তব সঁপিলাম সর্বস্ব অক্লেশে।।

কিন্তু ঋণ চুকিল না; কৃতজ্ঞতা হল না লাঘব;
শুধু জনরব
পিটায়ে বিদ্রূপডঙ্কা হাটে হাটে করিল ঘোষণা
অবান্তর অলজ্জার ব্যর্থ বিড়ম্বনা।
সন্ধিক্ষণ
প্রমাণিল আমি অকিঞ্চন।
বৈদ্যুতিক ব্যথা
দেখাল নিঃসঙ্গ শয্যা, উদ্‌ভাসিল নিরর্থ নগ্নতা
মতিভ্রান্ত উর্বশীকান্তের।।

সর্বস্বান্ত যে-ক্ষতির জের
রেখেছে অজ্ঞাত ক’রে আজও মোরে দুঃস্থ নির্বাসনে
পথশূন্য বনের নির্জনে,
সে-সর্বনাশের দায়, জানি, নয় তোমার, আমার।
তথাপি ধিক্কার
মর্মে মর্মে তীব্র কষা হানে;
নিরস্ত্র, বিবস্ত্র হিয়া ছুটে চলে মুমূর্ষার পানে॥

২৩ জানুআরি ১৯৩২

সকল অধ্যায়

১. হৈমন্তী (বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়)
২. চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)
৩. অপচয় (প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী)
৪. কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)
৫. পণ্ডশ্রম (অভ্যস্ত লজ্জার ছল, আচারের ব্যর্থ ব্যবধান)
৬. মূর্তিপূজা (মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে)
৭. মহাসত্য (অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ)
৮. পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)
৯. ভবিতব্য (শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী)
১০. বিকলতা (শেফালী অঙ্গুলি তব গণ্ডে মম বিচরে কৌতুকে)
১১. অনুষঙ্গ (তোমারে যে কেন বাসি ভালো)
১২. মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)
১৩. সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)
১৪. প্রলাপ (জানি, জানি)
১৫. উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)
১৬. নাম (চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই)
১৭. জিজ্ঞাসা (দিলেম বিমুক্ত ক’রে পিষ্টপুষ্প নিকুঞ্জের দ্বার)
১৮. সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)
১৯. দৈন্য (নিরালোক, স্তব্ধশোক, আয়ত নয়ানে)
২০. ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)
২১. সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)
২২. মার্জনা (ক্ষমা? ক্ষমা? কেন চাও ক্ষমা)
২৩. শাশ্বতী (শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে)
২৪. বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)
২৫. অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন