প্রলাপ (জানি, জানি)

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

প্ৰলাপ

জানি, জানি
উপস্থিত বেদনা ও হানি
আমারই প্রবীণ চক্ষে লাগিবে যে মূঢ়তার মতো
এক দিন আশু ভবিষ্যতে।
বিদায়ের পথে
যে-মৌনী শোকের স্পর্ধা করেছে ব্যাহত
দরদীর বাঙ্ময় সান্ত্বনা,
যে-রূঢ় যন্ত্রণা,
উপাড়ি মৃন্ময় মূল, এনেছে আমারে
নৈরাশ্যের পারে,
সে-সবার মহিমা বিনাশি,
মোর বিজ্ঞ হাসি
শোনা যাবে অচিরাৎ আগামী উৎসবে।
সে-দিন মনের মধ্যে সংশয়ের লেশ নাহি রবে;
জিজ্ঞাসুরে বলিব নিশ্চয়
আজিকার অভিজ্ঞতা তুচ্ছ অতিশয়
তারুণ্যের আতিশয্য, অমৃতের স্পর্শ তাতে নাই।।

কভু যদি সত্য হয় তাই,
তোমার অমর বরে, হে বিধাতা, তবে কাজ নাই।
চাহি না থাকিতে বর্তমান
নির্বিকার পটে আঁকা নিরালোক দীপের সমান।
প্রণয়ের প্রহসনে নায়কের পদ
যে-দুর্মদ
আত্মার নিয়োগে,
থাকুক সে বিপ্রলব্ধ অনন্ত বিয়োগে।
ছাড়িলাম অমৃতের দাবি;
ফিরে নাও প্রতিশ্রুত নন্দনের চাবি।
বজ্রবহ্নি, সংক্ষিপ্ত সংহারে,
জাগাক অসহ্য জ্বালা পুনরায় বিক্ষুব্ধ আঁধারে।
কৈবল্যের পরিবর্তে করো প্রত্যর্পণ
নশ্বর আশ্লেষে তার নিমেষের বিশ্ববিস্মরণ;
দিতে চাও, দাও, ভগবান,
সে-চপল চুম্বনের অখণ্ড নিৰ্বাণ;
শুধু এক বার,
ধ্বংসি মুহূর্তের তরে সূক্ষ্ম তর্ক, কুটিল বিচার,
আনো মোরে মুখামুখি নির্বাক নিশাতে
ক্ষীণপ্রাণ পার্থিবার বিশ্বম্ভর প্রণয়ের সাথে।।

ভয় নাই, ওরে ভয় নাই,
অমরত্ব মিথ্যা কথা, মৃত্যুঞ্জয় বিজ্ঞের বড়াই
অক্ষয় শ্রুতির মধ্যে রবে না সঞ্চিত।
আসে মৃত্যু ব্রহ্মাণ্ডবাঞ্ছিত,
আসে মৃত্যু নীলকণ্ঠ, আসে মৃত্যু রুদ্র মহাকাল,
নিষ্পেষিত মানুষের শোণিতে গুলাল
চরণে অলক্তরেখা আঁকি।
হানো, হে পিনাকী,
হানো তবে তব বিষবাণ:
গলিত পরান
হোক লয় তিলে তিলে, যাক মিশে নিমেষে নিমেষে
স্মৃতিশূন্য বিলয়ের শুদ্ধ নিরুদ্দেশে।।

শুধু যেন রহে অন্তঃশীলা
তোমার অতনুলীলা
মোর ব্যর্থ প্রতীক্ষার অবাধ প্রান্তরে;
ক্ষুধাভরে
যেন না ভরাই বারংবার
বিরহসন্তপ্ত এই শূন্যতা আমার
নব নব ঝঞ্ঝারে আহ্বানি;
নাস্তিক বুদ্ধির বশে কোনও দিন যেন নাহি মানি,
হে অন্তরতমা,
তুমি ভ্রান্তি যৌবনের, নও নিত্য সৃষ্টির সুষমা।।

১৮ এপ্রিল ১৯৩০

সকল অধ্যায়

১. হৈমন্তী (বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়)
২. চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)
৩. অপচয় (প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী)
৪. কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)
৫. পণ্ডশ্রম (অভ্যস্ত লজ্জার ছল, আচারের ব্যর্থ ব্যবধান)
৬. মূর্তিপূজা (মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে)
৭. মহাসত্য (অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ)
৮. পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)
৯. ভবিতব্য (শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী)
১০. বিকলতা (শেফালী অঙ্গুলি তব গণ্ডে মম বিচরে কৌতুকে)
১১. অনুষঙ্গ (তোমারে যে কেন বাসি ভালো)
১২. মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)
১৩. সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)
১৪. প্রলাপ (জানি, জানি)
১৫. উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)
১৬. নাম (চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই)
১৭. জিজ্ঞাসা (দিলেম বিমুক্ত ক’রে পিষ্টপুষ্প নিকুঞ্জের দ্বার)
১৮. সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)
১৯. দৈন্য (নিরালোক, স্তব্ধশোক, আয়ত নয়ানে)
২০. ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)
২১. সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)
২২. মার্জনা (ক্ষমা? ক্ষমা? কেন চাও ক্ষমা)
২৩. শাশ্বতী (শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে)
২৪. বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)
২৫. অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন