কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

কস্মৈ দেবায়

হায়, গৰ্বান্বিতা,
দানবিক আত্মারে যে-অনির্বাণ রাবণের চিতা,
ভ্যান্ত না ক’রে, দহে হৃদয়সৈকতে,
ভাবো তুমি জন্মে জন্মে, পুনরুক্ত শপথে শপথে,
যোগাও ইন্ধন তার লাগি?
ভাবো আমি জাগি
অনাদ্যন্ত দিনমান, উৎকণ্ঠিত নিশা
শুনিবারে তব পদধ্বনি?
প্রত্যাসন্ন নূপুরের মুগ্ধ আগমনী
আমার উদ্বেল মর্মে ভ’রে দেয় স্বর্গবিজিগীষা?
কঙ্কণের প্রস্থিত নিক্বণে
মুমূর্ষার প্ররোচনা অসংবদ্ধ প্রাণের গহনে?

ভালোবাসি তোমারে নিশ্চয়;
দাম্ভিক হৃদয়
তোমার চরণচিহ্ন আজীবন বহিবে গৌরবে;
মনে রবে বিকারে, বিক্ষোভে,
এক দিন দিয়েছিলে জ্বালি
প্রেতসঞ্চরিত ধ্বংসে উৎসবের অচির দীপালী;
মোর ভালে
একদা যে এঁকেছিলে ইন্দ্রত্বের টিকা,
সংক্ষিপ্ত সুকৃতি-শেষে স্বর্গ হতে বিদায়ের কালে
মনে রবে সে-কথা, ক্ষণিকা।।

জানি তবু
তোমার উদীর্ণ আবির্ভাবে
মোর শূন্য পরিপূর্ণ হয় নাই কভু;
অবলুপ্ত অতল অভাবে,
তোমার অজস্র দান
বরঞ্চ গিয়েছে রেখে নেতির প্রমাণ।
নিভৃত নিশীথে
নীরব আকাঙ্ক্ষা-ভরে এসেছিলে বাসরশয্যায়;
ত্রস্ত অলজ্জায়
চেয়েছিলে অযাচিত উপহার দিতে
অনুপম কৌমার্য তোমার।
অজাতসংস্কার,
মদমত্ত, আরণ্যিক আমার যৌবন
প্রাক্তন তিমিরে করে অহরহ যার অন্বেষণ,
তুমি সে-স্বৈরিণী নও, হে দাক্ষিণ্যময়ী।।

অমৃতের উদাত্ত মাভৈ
নিবিদ আহ্বানে যার প্রতিধ্বনি তোলে অবিরত,
সে আসে না, নব অনুরাগিণীর মতো,
নম্র নেত্রে, রক্ত মুখে, সন্তর্পণে সংবরি কিঙ্কিণী।
নিঃশঙ্কিনী,
জনারণ্য উন্মথি, সে চলে,
আস্ফালি উদ্ধত অসি, নির্জিতের মুণ্ডমালা গলে,
নির্মল নগ্নতাখানি বর্মসম পরি।
বেষ্টনীর কুটিল কৌতুক
ছারখার করি,

স্থিরলক্ষ্য নয়নের নিবদ্ধ কার্মুক
বর্ষে নিরন্তর
মর্মঘাতী উপেক্ষার অগ্নিময় শর।
সে আসে না, ভিক্ষুকের প্রায়,
উচ্ছিষ্ট প্রেমের কণা আহরিতে অধম ক্ষুধায়;
সে আসে না স্তব্ধ অন্ধকারে,
সামান্য চোরের মতো, অজানার গুপ্ত অভিসারে।
 বিজয়ীর বেশে
সশস্ত্র ভাণ্ডারে পশি, আপনার দক্ষিণা কাড়ে সে।।

তারই তরে
উৎসুক প্রত্যাশা মোর দিকে দিগন্তরে
নেহারে অস্থির মরীচিকা।
এক বার হয়েছিল মনে
তব শিষ্ট প্রণয়ের গভীর গোপনে
সৃজনপ্রলয়ময়ী, অনিশ্চয় আগ্নেয়াদ্রিশিখা
অন্তঃশীলা রয়েছে বুঝি বা।
সমুন্নত গ্ৰীবা
তাই অবনত করি, ও-মুখের পানে
চাহিলাম ব্যাকুল নয়ানে।।

কিন্তু, হায়,
অতিমর্ত্য উন্মাদনা অচিরাৎ পলাল কোথায়?
তরুশিরে আন্দোলন তুলি,
ভুবনে স্তব্ধতা হানি, চ’লে যায় যথা, পথ ভুলি,
দূর দিয়ে মত্ত প্রভঞ্জন,
তেমনই এল না লগ্নে, আসি আসি ব’লেও, মাতন।
অকস্মাৎ
তোমার সর্বাঙ্গে নামে আর্ত পক্ষাঘাত,
হৃত বাক্যে ক্লীবের নিষ্পুণ্য প্রত্যাখ্যান;
নির্বাপিত চক্ষে জাগে সংসারীর ভীরু কাণ্ডজ্ঞান।
ঊর্ধ্ববাহু আজ রিক্তাকাশে
যৌবনযজ্ঞাগ্নি মোর যে-অনাম দেবতার আশে,
জানি সে-অচেনা
কোনও দিন আমার হবে না;
তবুও নিশ্চয়
আমার উদ্যত অর্ঘ্য, প্রেয়সী, তোমার তরে নয়।।

১১ সেপ্টেম্বর ১৯২৯

সকল অধ্যায়

১. হৈমন্তী (বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়)
২. চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)
৩. অপচয় (প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী)
৪. কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)
৫. পণ্ডশ্রম (অভ্যস্ত লজ্জার ছল, আচারের ব্যর্থ ব্যবধান)
৬. মূর্তিপূজা (মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে)
৭. মহাসত্য (অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ)
৮. পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)
৯. ভবিতব্য (শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী)
১০. বিকলতা (শেফালী অঙ্গুলি তব গণ্ডে মম বিচরে কৌতুকে)
১১. অনুষঙ্গ (তোমারে যে কেন বাসি ভালো)
১২. মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)
১৩. সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)
১৪. প্রলাপ (জানি, জানি)
১৫. উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)
১৬. নাম (চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই)
১৭. জিজ্ঞাসা (দিলেম বিমুক্ত ক’রে পিষ্টপুষ্প নিকুঞ্জের দ্বার)
১৮. সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)
১৯. দৈন্য (নিরালোক, স্তব্ধশোক, আয়ত নয়ানে)
২০. ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)
২১. সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)
২২. মার্জনা (ক্ষমা? ক্ষমা? কেন চাও ক্ষমা)
২৩. শাশ্বতী (শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে)
২৪. বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)
২৫. অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন