মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়
অনুভব করিবে না কভু আর সহজ বিস্ময়;
বিয়োগের অমিত অভাবে
সুন্দরের আবির্ভাব কেবলই হারাবে।।

তাই যবে বসন্তের উচ্ছৃঙ্খল দিনে,
গতাসু বরষে,
সহসা উঠিল জেগে নিম্বের বিপিনে
বিহ্বল চন্দনগন্ধ মলয়ের কবোষ্ণ পরশে;
ধৈর্যহীন অপব্যয়ে বৃথা পুষ্পাঞ্জলি
বসুন্ধরা নিজেরে অর্পিল;
বন্দ্ৰ অলি
তালে বেঁধে দিল
সৃষ্টির স্বয়ম্ভূ সামগান;
উৎকণ্ঠিত প্রজাপতি করিল সন্ধান
অনুর্বরা প্রোষিতারে, বিরহীর চিত্রলিপি ল’য়ে;
কে পরাল রজনীর কনক বলয়ে
উদ্বাহসিন্দুরবিন্দু গোধূলিলগনে;
সে-দিনের দক্ষযজ্ঞে, সার্বভৌম মিলনপার্বণে
পড়িল না তাই মোর ডাক।।

পুনর্বার এসেছে বৈশাখ;
গেছে মুছি
প্রতীচীর পাণ্ডু গণ্ডে জীবনের শেষ রক্ত রুচি।
আজি তবে কেন
বাজায় মোহনবেণু শীর্ণ কুঞ্জে কালের রাখাল?
অতিক্রান্ত সন্ধিলগ্ন, ভ্ৰষ্টপাল
কামধেনু যেন,
পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে
স্মরণের গোষ্ঠে ফিরে আসে।

এক দিন
পুলকি অপরিচিত নদীর পুলিন
তাপতাম্র এমনই নিদাঘে,
যে-অপূর্ব জপমন্ত্র কানে মোর নিবিড় সোহাগে
দিয়েছিল সুন্দরের দূতী,
ভ’রে ওঠে বর্তমান নৈঃসঙ্গ্যের শ্রুতি
সে-প্রণাদ অনুলাপে;
বক্ষে কাঁপে
কী এক বচনাতীত, তীব্র সংবেদন;
সপ্তসিন্ধুপরপারে বিচঞ্চল নারিকেলবন
মৃদুল মর্মরে
সহসা সম্পূর্ণ করে
অসমাপ্ত পরিচয় তার।।

বারংবার
নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে দেখি,
সমস্ত ভুবন জুড়ে, আবার এলে কি,
ক্ষণিকা পরমা?
প্রতিবেশী পত্রে, পুষ্পে নেহারি যে তোমারই উপমা;
সে-দিনের ভুলে-যাওয়া তুচ্ছ দানগুলি
ভারাক্রান্ত করি তুলে তপোরিক্ত বৈশাখের ঝুলি।
ঘুচে যায় ভয়;
জানি, জানি বিধাতা নির্দয়
কোনও দিন পারিবে না অর্গলিতে সে-স্বর্গের দ্বার,
ইন্দ্রত্বের ধ্রুব অধিকার
তোমার প্রেমের স্মৃতি রচিয়াছে মোর লাগি যেথা,
অয়ি মহাশ্বেতা।।

২১ এপ্রিল ১৯৩০

সকল অধ্যায়

১. হৈমন্তী (বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়)
২. চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)
৩. অপচয় (প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী)
৪. কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)
৫. পণ্ডশ্রম (অভ্যস্ত লজ্জার ছল, আচারের ব্যর্থ ব্যবধান)
৬. মূর্তিপূজা (মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে)
৭. মহাসত্য (অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ)
৮. পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)
৯. ভবিতব্য (শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী)
১০. বিকলতা (শেফালী অঙ্গুলি তব গণ্ডে মম বিচরে কৌতুকে)
১১. অনুষঙ্গ (তোমারে যে কেন বাসি ভালো)
১২. মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)
১৩. সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)
১৪. প্রলাপ (জানি, জানি)
১৫. উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)
১৬. নাম (চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই)
১৭. জিজ্ঞাসা (দিলেম বিমুক্ত ক’রে পিষ্টপুষ্প নিকুঞ্জের দ্বার)
১৮. সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)
১৯. দৈন্য (নিরালোক, স্তব্ধশোক, আয়ত নয়ানে)
২০. ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)
২১. সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)
২২. মার্জনা (ক্ষমা? ক্ষমা? কেন চাও ক্ষমা)
২৩. শাশ্বতী (শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে)
২৪. বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)
২৫. অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন